বহু-বিশ্বের তত্ত্ব (Many-Worlds theory)





প্রথম পর্ব –

পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বৈপ্লবিক ধারণাগুলির মধ্যে একটি এসেছিল এমন একজন অজানা স্নাতকোত্তর ছাত্রের কাছ থেকে যিনি শুধুমাত্র একটি গবেষণা পত্র লিখেছিলেন। তারপর বিশ্ব জুড়ে পদার্থ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে এবং তাঁর নিজের উপদেষ্টার সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। এরপর তিনি সেই ফিল্ড ছেড়ে চলে গিয়ে যুক্ত হয়ে যান সামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। Hugh Everett-এর গল্পটি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিস্ময়কর ইতিহাসের চমকপ্রদ গল্পের মধ্যে একটি।


এভারেটের কাজটি 1950-এর দশকে আমেরিকার Princeton University -তে জন আর্চিবল্ড হুইলারের (John Archibald Wheeler) মেন্টরশিপের অধীনে ঘটেছিল। জন আর্চিবল্ড হুইলার আবার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নিলস বোরের (Niels Bohr) ছাত্র ছিলেন। কুড়ি বছরেরও বেশি আগে বোর এবং তাঁর সহকারীরা কোয়ান্টাম তত্ত্বের 'কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা' (Copenhagen Interpretation) প্রচলন করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বোঝার একমাত্র উপায় হিসাবে কোপেনহেগেন ব্যাখ্যাই প্রচলিত ছিল।


কোপেনহেগেন দৃষ্টিভঙ্গিতে, আমরা মাইক্রো জগতের কোয়ান্টাম সিস্টেম এবং ম্যাক্রো জগতের পর্যবেক্ষকদের মধ্যে পার্থক্য করি। কোয়ান্টাম সিস্টেমগুলি বিভিন্ন সম্ভাব্য পরিমাপের ফলাফলের সুপারপজিশনে (superpositions) বিদ্যমান থাকে, যাকে বলা হয় 'তরঙ্গ ফাংশন' (wave functions)। উদাহরণস্বরূপ, একটি স্পিনিং ইলেকট্রন একটি তরঙ্গ ফাংশনে রয়েছে যা 'স্পিন-আপ' এবং 'স্পিন-ডাউন'-এর একটি সুপারপজিশন বর্ণনা করে। শুধু এটা নয় যে আমরা ইলেকট্রনের স্পিন জানি না, আসলে এটি পরিমাপ না করা পর্যন্ত স্পিনটির মান বিদ্যমান থাকে না। অন্যদিকে একজন পর্যবেক্ষক পরিচিত ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যার সমস্ত নিয়ম মেনে চলে। যে মুহুর্তে একজন পর্যবেক্ষক একটি কোয়ান্টাম সিস্টেম পরিমাপ করে, সেই সিস্টেমের তরঙ্গ ফাংশনটি হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে ভেঙে পড়ে (collapses)। তার ফলে নির্দিষ্ট স্পিন অথবা কোনো পরিমাপ পাওয়া যায়।


স্পষ্টতই কোয়ান্টাম সিস্টেমগুলি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে বিবর্তিত হয়। যখন আমরা তাদের দিকে তাকাই না, তখন 1926 সালে এরউইন শ্রোডিঙ্গার (Erwin Schrödinger) দ্বারা বর্ণিত শ্রোডিঙ্গার সমীকরণ অনুসারে তরঙ্গ ফাংশনগুলি মসৃণভাবে কাজ করে। কিন্তু যখন আমরা সেগুলি দেখি, তরঙ্গ ফাংশনগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে কাজ করে, সেগুলি কিছু নির্দিষ্ট ফলাফলের উপর কোলাপ্স করে।


অনেকেই এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেন না। 'পরিমাপ' বলতে ঠিক কী বোঝায়? কোন জিনিসটা পর্যবেক্ষককে এতো গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে? শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণগুলিতে (তাঁর বিখ্যাত তরঙ্গ সমীকরণ সহ) কোলাপ্স সম্পর্কে কিছুই নেই। বোর এই তত্ত্বকে "ব্যাখ্যা করার" জন্য জোর দিয়েছিলেন যে কেন আমরা একটি পরীক্ষার ফলাফল দেখতে পাই। কেন সেই ফল একটি "মৃত বিড়াল" অথবা একটি "জীবিত বিড়াল" হবে, তার বদলে দশাগুলির একটি মিশ্রণ বা একটি সুপারপজিশন কেন হবে না। আমরা শুধুমাত্র একটি ফলাফল সনাক্ত করি, যা তরঙ্গ ফাংশনের একটি সমাধান। কিন্তু এর মানে এই নয় যে বিকল্প সমাধানগুলি বিদ্যমান নেই। 1952 সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে, শ্রোডিঙ্গার দেখিয়েছিলেন আমরা শুধুমাত্র কোয়ান্টাম সিস্টেমকে পর্যবেক্ষণ করার কারণে একটি কোয়ান্টাম সুপারপজিশন ভেঙ্গে পড়বে – এটা আশা করা বেশ কষ্টকর। তিনি বলেছিলেন তাহলে তরঙ্গ ফাংশন দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। কখনও কখনও তরঙ্গ সমীকরণ দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার মাঝে মাঝে পর্যবেক্ষকের সরাসরি হস্তক্ষেপ দ্বারা, যখন সেই তরঙ্গ ফাংশন তরঙ্গ সমীকরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। তাই সমগ্ৰ বিষয়টি কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে পড়ে।


তবুও কোপেনহেগেন পদ্ধতি প্রচলিত জ্ঞান হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। 1950 এর দশকে এটিকে প্রশ্ন করা কিছুটা খারাপ আচরণ বলে মনে করা হতো। এই পরিস্থিতি এভারেটকে প্রভাবিত করতে পারে নি। 1954 সালে সহকর্মী তরুণ পদার্থবিদ চার্লস মিসনার (Charles Misner, ইনিও হুইলারের একজন ছাত্র ছিলেন) এবং এজ পিটারসনের (Aage Peterson, ইনি বোরের একজন সহকারী ছিলেন) সঙ্গে আলোচনা করার পর এভারেট তাঁর দূরদর্শী ধারণার বীজ বপন করেন যা এখন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বহু-বিশ্বের গঠন (Many-Worlds formulation) হিসাবে পরিচিত।


হুইলারের কাছে এভারেট কোয়ান্টাম কসমোলজি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন। মানে একটি কোয়ান্টাম সিস্টেম হিসাবে সমগ্র মহাবিশ্বের অধ্যয়ন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যদি কোয়ান্টাম ধারণায় মহাবিশ্ব সম্পর্কে কথা বলতে হয়, তাহলে আমরা একটি পৃথক ক্লাসিক্যাল ক্ষেত্র তৈরি করতে পারি না। মহাবিশ্বের মধ্যে থাকা পর্যবেক্ষক সহ প্রতিটি অংশকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুসারে চিন্তা করতে হবে। সেখানে শুধুমাত্র একটি একক কোয়ান্টাম অবস্থা থাকবে, যাকে এভারেট 'সর্বজনীন তরঙ্গ ফাংশন' (universal wave function) বলে বর্ণনা করেছেন।


তাহলে যদি সবকিছুই কোয়ান্টাম হয় এবং মহাবিশ্ব একটি একক তরঙ্গ ফাংশন দ্বারা বর্ণিত হয়, তাহলে পরিমাপ কীভাবে ঘটতে পারে? সেক্ষেত্রে যিনি পরিমাপ করবেন এবং যা দিয়ে পরিমাপ করা হবে, সব‌ই সেই সর্বজনীন তরঙ্গ ফাংশনের মধ্যেই থাকবে। এভারেট যুক্তি দিয়েছিলেন, মহাবিশ্বের একটি অংশ মহাবিশ্বের অন্য অংশের সাথে কিছু উপযুক্ত উপায়ে মিথস্ক্রিয়া করে। এটি এমন কিছু যা শ্রোডিঙ্গার সমীকরণ অনুসারে সর্বজনীন তরঙ্গ ফাংশনের বিবর্তনের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে চলেছে। পরিমাপের জন্য আমাদের কোনো বিশেষ নিয়মের প্রয়োজন নেই। সর্বদাই কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়ে চলেছে।


আপনি কল্পনা করুন যে আমাদের আপ এবং ডাউন সুপারপজিশনে একটি স্পিনিং ইলেকট্রন রয়েছে। আমাদের কাছে একটি পরিমাপ যন্ত্রও রয়েছে, যা এভারেটের মতে তার নিজস্ব একটি কোয়ান্টাম সিস্টেম। কল্পনা করুন যে এটি তিনটি ভিন্ন সম্ভাবনার সুপারপজিশনে থাকতে পারে।

🔹 পরিমাপ যন্ত্রটি ইলেকট্রনকে আপ স্পিন অবস্থায় পরিমাপ করতে পারে।

🔹সেটি ইলেকট্রনকে ডাউন স্পিন অবস্থায় পরিমাপ করতে পারে।

🔹 সেটি এখনও ইলেকট্রনের স্পিনটিকে মোটেও পরিমাপ করতে পারেনি। বিজ্ঞানীরা একে 'রেডি' দশা (ready state) বলেন।


সুতরাং পরিমাপ যন্ত্রটি আমাদের বলে যে কীভাবে সম্মিলিত স্পিন এবং যন্ত্র সিস্টেমের কোয়ান্টাম অবস্থা শ্রোডিঙ্গার সমীকরণ অনুসারে বিকশিত হয়। যদি আমরা পরিমাপ যন্ত্রটিকে রেডি অবস্থায় এবং ইলেকট্রনটিকে সম্পূর্ণরূপে স্পিন-আপ অবস্থায় দিয়ে শুরু করি, তাহলে আমরা নিশ্চিত যে যন্ত্রটি একটি বিশুদ্ধ পরিমাপিত অবস্থায় বিকশিত হবে। (চিত্র 1)


বাম দিকের প্রাথমিক অবস্থাটি 'ইলেকট্রন আপ অবস্থায় আছে এবং যন্ত্রটি তার রেডি অবস্থায় রয়েছে' হিসাবে পড়া যেতে পারে। যখন ডানদিকের যেখানে পয়েন্টারটি উপরের তীর নির্দেশ করে, তা হল 'ইলেকট্রনের আপ স্পিন অবস্থা এবং যন্ত্র এটিকে আপ স্পিন অবস্থায় পরিমাপ করেছে'।


একইভাবে একটি বিশুদ্ধ ডাউন স্পিনকে সফলভাবে পরিমাপ করার ক্ষমতা বোঝায় যে যন্ত্রটিকে অবশ্যই 'রেডি' থেকে 'পরিমাপিত' অবস্থায় বিবর্তিত হতে হবে। (চিত্র 2)


আমরা যা বুঝতে চাই তা হলো, যে যখন প্রাথমিক স্পিন যখন বিশুদ্ধ আপ বা ডাউন অবস্থায় থাকে না, তার বদলে উভয়ের কিছু সুপারপজিশনে থাকে, তখন কী হয়! কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মগুলি পরিষ্কার। আপনি যদি জানেন যে কীভাবে সিস্টেমটি দুটি ভিন্ন অবস্থা থেকে শুরু করে বিবর্তিত হয়, তবে সেই দুটি অবস্থার একটি সুপারপজিশনের বিবর্তন দুটি বিবর্তনের একটি সুপারপজিশন হবে। অন্য ভাবে বলতে গেলে কিছু সুপারপজিশনে থাকা স্পিন এবং পরিমাপ যন্ত্রটি রেডি অবস্থায় শুরু করলে আমরা তৃতীয় চিত্রের মতো বিবর্তিত অবস্থা পাবো যেখানে চূড়ান্ত অবস্থা এখন একটি এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা সুপারপজিশন। (চিত্র 3) স্পিনটি আপ ছিল এবং এটিকে আপ বলে পরিমাপ করা হয়েছিল। এর সঙ্গেই স্পিনটি ডাউন ছিল এবং এটিকে ডাউন বলে পরিমাপ করা হয়েছিল। আমরা যদি শ্রোডিঙ্গার সমীকরণ অনুসারে এটিকে বিবর্তিত করি তাহলে এই ফলাফলটি হলো সম্মিলিত স্পিন এবং পরিমাপ যন্ত্র সিস্টেমের জন্য স্পষ্ট এবং চূড়ান্ত তরঙ্গ ফাংশন। জগৎ এই দুটি সম্ভাবনার একটি সুপারপজিশনে শাখান্বিত (branched) হয়েছে।


এভারেটের অন্তর্দৃষ্টি যেমন সহজ ছিল সেরকম ব্রিলিয়ান্ট ছিলো। শ্রোডিঙ্গার সমীকরণটি র‌ইলো। চূড়ান্ত সুপারপজিশনের সেই দুটি অংশই আসলে সেখানে আছে। কিন্তু তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না। একটি শাখায় (branch) যা ঘটে তা অন্য শাখায় যা ঘটে তার উপর কোন প্রভাব ফেলে না। তাদের আলাদা, সমানভাবে বাস্তব জগত হিসাবে ভাবা উচিত। এটি এভারেটের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূল বিষয়। আমরা জগতগুলোকে পর্যবেক্ষণের দ্বারা তৈরী করছি না। তারা সবসময় সেখানে ছিল এবং শ্রোডিঙ্গার সমীকরণ অনিবার্যভাবে তাদের জীবন্ত করে তোলে। কিন্তু আসল ঘটনাটি হল যে আমরা কখনই আমাদের বিশ্বের অভিজ্ঞতায় বড় ম্যাক্রোস্কোপিক বস্তুর সাথে জড়িত সুপারপজিশনগুলিকে দেখতে পাই না।


এরপর পরবর্তী পর্বে...

লিখাঃ সরোজ নাগ।

সঙ্গের চিত্রগুলি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম