মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই - মম সাহা (দ্বিতীয় খন্ড - পর্ব ১)



বিষন্ন, ক্লান্ত বিকেল। আকাশটা আধাঁর না তবে ক্ষাণিকটা ঘোলাটে। আসমানী রাঙা পাঞ্জাবিটা আঁটসাঁট হয়ে লেগে আছে প্লাবনের চওড়া শরীরে'র সাথে। আসমানী'র সাথে শুভ্রা রঙের পাজামা'টা যেনো স্নিগ্ধ পুরুষের সৌন্দর্যতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। 


পর পর তিন জোড়া পা ব্যস্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের গন্তব্যে। এক জোড়া পায়ের মালিক প্লাবন। আরেক জোড়া পা তার মায়ের। আর আরও এক জোড়া কোমল নারী'র পা এগিয়ে যাচ্ছে। আর একটু পর বোধহয় ঝড় হবে, ভীষণ ঝড়। তার আগে বাড়ি পৌঁছাতে হবে যে দ্রুত। 


জায়গাটা ঠিক সদর ঘাটের কাছাকাছি রাজকীয় এক বাড়ির সামনের বড় রাস্তা। বিশাল প্রাচুর্য ঘেরা এক মহল দেখা যাচ্ছে লোহার গেইটটার ভেতরে। দেশের রাজধানী বলে কথা, দু একটা দারুণ প্রদর্শন তো থাকতেই হয়। 


প্লাবনের মা উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে প্লাবনের উদ্দেশ্যে বললো,

-'বাবু,এটা কিসের দালানরে! মহলটা তো রাজকীয়? নিশ্চয়ই কোনো ঐতিহাসিক জায়গা তাই না?'


প্লাবন হাঁটা থামিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তারপর হাঁপিয়ে উঠা ছোট্ট শ্বাসটা ফেলে সামনের বন্ধ দরজার উপাশে লাল মহলটার দিকে তাকিয়ে রয়। তার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। আজকাল মায়ের কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না। কিন্তু এ দিন দুনিয়ায় মা বড্ড একা তাই পারছে না সেই ইচ্ছে টা প্রকাশ করতে। 


প্লাবনদের পাশে থাকা শাড়ি পরা অল্প বয়সের রমনী বোধহয় বুঝতে পারে প্লাবনের মনোভাব। সে দ্রুত পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই ঝড়ঝড়ে কণ্ঠে বলে উঠে, 

-'হ্যাঁ ফুপিমনি,এটা ঐতিহাসিক জায়গাই। আপনি হয়তো শুনেছেন আহসান মঞ্জিল সর্ম্পকে। এটা সেই মহল। এর প্রতিষ্ঠাটা নওয়াব আবদুল গণি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহ্'র নামে এটার নামকরণ করে। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়। দীর্ঘ অনেকদিনের যত্নে গড়া মহল এটা। ভিতরের পরিবেশ অসাধারণ। নবাবদের রাজকীয় চাল চলণের বেশ নিঁখুত প্রমাণ এটা। আপনাকে আমি বরং একদিন ঘুরতে নিয়ে আসবো। এখানে নবাবদেন স্নানাগার হতে বিশ্রাম কক্ষ অব্দি সব টুকুর জ্বলজ্বল সৌন্দর্যের নির্দেশন আছে৷'


প্লাবনের মা আশালতার চোখ দু'খানা কৌতূহলে ছলছল করে উঠে। তার চেয়ে বেশি সে গর্ববোধ করে নিজের পছন্দের উপর। মেয়েটা কত কিছু জানে! এমনি এমনি কী আর মেয়েটাকে তার মনে ধরেছে?


প্লাবন চুপ করে আর দু'কদম এগুতেই পিছন থেকে চিরপরিচিত ডাকটা ভেসে এলো। শহরে আসার পর ডাকটা যেনো বিলীনই হয়ে গিয়েছিলো। প্লাবন এক সেকেন্ডও নষ্ট না করে পিছনে ফিরে তাকায়। ততক্ষণে ধুতি আর ঢিলে ফতুয়া পড়া বেশ বেটে, গোলগাল লোক এগিয়ে এসেছে। কালো চামড়ায় ছুটে আসার জন্য সদ্য জন্ম নেওয়া ঘাম উঁকি দিচ্ছে। 


লোকটা প্লাবনের সামনে এসে হাতের উল্টো পিঠে মুখের ঘাম খানা বেশখানিকটা মুছে নিলো। হাত জোর করার ভঙ্গিতে বললেন,

-'পেন্নাম নিবেন মাস্টারমশাই। তা,আপনার শরীর ভালা তো! আমারে চিনছেন? আমি হরপ্রসাদ ঠাকুর। ভ্রমরী'র জেঠতুতো ভাই।'


অকপটে নিজের পরিচয় গড়গড় করে মুখস্ত পড়ার মতন বলে থামলেন সিধেসাধা লোকটা। প্লাবন মলিন হাসলো। অবহেলার বাতাসে পথের ক্ষণিকটা মলিন ধূলোও উড়ে গেলো বোধহয়। আশপাশে তখন ঘোলাটে ভাবটা গভীর হলো। মানুষজন তেমন নেই৷ কিছু ফল ব্যবসায়ীর তাজা ফল গুলো একটু সজীবতা হারিয়েছে সারাদিনের তপ্ত রোদের উত্তপ্ততায়। তার সেই সামান্য অসজীব ফল গুলো গুটিয়ে নিচ্ছে তারা। বাড়ি যেতে হবে। অত রাত অব্দি বেচাকেনা করা যায় না এখানে। 


প্লাবন ভদ্রতার সহিতে উত্তর দিলো,

-'প্রণাম হরপ্রসাদ। তোমায় চিনবো না! কী বলছো এসব! কেমন আছো তুমি?'


মাস্টারমশাই এর প্রশ্নে হরপ্রসাদ বেশ খুশি হলো। যাক, তাকে এত বড় মানুষটা মনে রেখেছে সেটাই তো অনেক। খুশিতে জ্বলজ্বল করা চোখ খানা নিয়ে লোকটা বললো,

-'ভালা আছি মাস্টারমশাই। আপনার কুশলাদি বলেন। ভালা আছেন! শহরে আইলেন কবে? কোনো কাজ আছে?'


প্লাবন ছোট্ট শ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে বললো,

-'হ্যাঁ হরপ্রসাদ। আমার আম্মা একটু অসুস্থ হয়েছিলো তাই এসেছিলাম। তা তুমি এখানে তো কিসের যেনো কাজ করো তাই না?'


-'হ মাস্টার। জেঠীমা, আপনি ভালা আছেন এখন?'


আশালতা দাম্ভিকতা বজায় রেখে মাথা নাড়িয়ে বললো,

-'হ্যাঁ ভালো আছি। তা বাবা আমার ছেলের বিয়ে এই সপ্তাহের শেষের দিন। শুক্রবারে। জুম্মার দিনে শুভ কাজটা করবো। তোমার দাওয়াত রইলো।'


মহিলার কথায় খানিকটা ভড়কে যায় হরপ্রসাদ। এতক্ষণে তার চোখ গেলো মাস্টারমশাই এর পাশে থাকা হালকা বেথুন রঙের শাড়ি পড়া সুন্দর,সুশীল মেয়েটার দিকে। মোটা এক বেণীগাঁথা তার চুলে। যে বেণীটা ডানপাশে এনে রাখা হয়েছে। একদম হাঁটু সমান। চোখে মোটা গাড়ো করে কাজল লেপ্টানো। মুখটা একটু লম্বাটে। মায়াবতী না হলেও বেশ রূপবতী। শরীরের শাড়ি আর সুগন্ধিটার সুগন্ধে বোঝা যাচ্ছে বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে। হরপ্রসাদ কিছুক্ষণ মৌন থেকে মাস্টারমশাই এর হবু অর্ধাঙ্গিনী'কে পরোখ করে বললো, 

-'ম্যালা সুন্দর বউ হইবো তাইলে আমাগো মাস্টারমশাই এর। তা বউ লইয়া'ই বুঝি গেরামে যাইবেন?'


-'হ্যাঁ।'


হরপ্রসাদ আর কিছু বললো না কেবল নিরব দৃষ্টিতে তাকালো মাস্টারমশাই এর পানে। মাস্টারমশাই এর দৃষ্টি নিশ্চুপ,নিস্তেজ। হরপ্রসাদ যেনো কিছু প্রত্যাশিত কথা শুনতে চেয়েছিলো কিন্তু তা শুনতে না পেয়ে হতাশার শ্বাস ফেললো। একটা তেঁতো ভাব খেলে গেলো তার শরীরে। আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে হলো না মাস্টারমশাই এর এত সুন্দর বধূর সামনে। দ্রুত বিদায় নিয়ে সে সোজা পথ ধরে হাঁটা ধরলো। 


হরপ্রসাদ বলতে চেয়েছিলো তিস্তা'র নিখোঁজ হওয়ার খবর খানা কিন্তু মাস্টারমশাই এর দারুণ সুখে থাকার গল্প শুনে মিইয়ে গেলো সে ইচ্ছে। মাস্টারমশাই তবে বেশ ভালো আছেন। কিন্তু তিস্তা! সে কোথায়? মানতে পারবো তো এ খবর খানা? 


সাধাসিধা হরপ্রসাদ এর মনে বিষাদের ছায়া নামলো। আজ থেকে প্রায় মাস তিন চার আগের কথা। সে শহরে কাজের ছুটি পেয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলো৷ তিস্তা ভ্রমরীর প্রাণপ্রিয় মানুষ ছিলো বলে তাদের বাড়িতে তিস্তার আনাগোনা বেশিই ছিলো। 


একদিন হরপ্রসাদ সকালে গঞ্জের হাট থেকে সবে বাজার করে ফিরেছে। বাজারের জিনিসপত্র গুলো হেঁশেলে রাখার উদ্দেশ্যে যেতেই দূর হতে তিনজন রমনীর রিনরিনে হাসির শব্দ ভেসে এলো৷ একজন রমনী তার ঘরের বউ, বাকি দু'জন তিস্তা আর ভ্রমরী। হরপ্রসাদ কি ভেবে যেনো আর সামনে এগুলো না। 


ইতিমধ্যে তার স্ত্রীর কথা ভেসে এলো। সে ঠাট্টার স্বরে বললো,

-'দুইজনের তো গলায় গলায় ভাব। তা, বিয়ে কবে করবে দু'জন?'


ভ্রমরী ছটফটে উত্তর দিলো,

-'আরও পরে। আগে অনেক পড়াশোনা করবো। তারপর বিয়ে করবো। তাই না তিস্তা?'


তিস্তা হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,

-'হ্যাঁ। অনেক পড়াশোনা করবো।'


হরপ্রসাদ এর বেশ ছোটখাটো বউটা আবার বলে উঠলো,

-'এত পড়াশোনা করে কী হবে? এ বয়সই তো বিয়ের বয়স। দেখো না আমার বাবা বিয়ে দিয়ে দিলো।'


হঠাৎই তিস্তা লাজুক হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,

-'এত পড়াশোনা করে আমি মাস্টারনি হবো। যেনো মাস্টারমশাই এর সাথে অনেক মানায়।'


কথাটা বলেই থমকে যায় সে। তারপর রান্নাঘরে হাসির বন্যা বয়ে যায়। হরপ্রসাদ এর বউ তিস্তার থুঁতনি ধরে আদুরে কন্ঠে বলে, 

-'ভালোবাসিস নাকি?'


তিস্তা জবাব দেয় না। তবে মুচকি হাসে। যে হাসিতে ছিলো মধুময় উত্তর। 


হরপ্রসাদ সেই দিন গুলো ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা যেনো কেমন আছে? কয়েকদিন আগেই তার বউ তাকে চিঠিতে জানিয়েছিলো তিস্তার নিঁখোজ হওয়ার কথা খানা। আজ চারদিন যাবত মেয়েটা নিখোঁজ। কিন্তু মাস্টারমশাই! সে কি সুন্দর হবু বউ নিয়ে ঘুরছে! 


প্লাবন দ্রুত হেঁটে ঘাটের কাছাকাছি কাছাকাছি চলে এসেছে। রাত নেমেছে আকাশের বুকে। সামনে বিশাল বুড়িগঙ্গা নদী। যার অপরূপ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হবে যেকোনো মানুষ। পানি গুলো ভীষণ নীলাভ, স্রোতও ভীষণ নিবিড়। ঘোলাটে আকাশের ঝাপসা চাঁদের আলো নদীতে পড়াই চিকচিক করে উঠছে সে পানি। এর চেয়ে অসাধারণ, মনোমুগ্ধকর দৃশ্য যেনো হয় না। মোগলরা এ নদী'র মুগ্ধতায় ডুবেই ঢাকাকে রাজধানী করেছিলো। 


কিন্তু এই মায়াবতী বুড়িগঙ্গাও মন ভুলাতে পারে নি প্লাবনের। তার সবকিছু কেমন বিষাক্ত মনে হচ্ছে। কতদিন হলো তিস্তা'কে দেখতে পারছে না। কেমন আছে সে জানেনা। মেয়েটা আগের মতন দুষ্টুমি করে তো? নাকি মাস্টারমশাই এর বিচ্ছেদে নিরব রয়? ছোট্ট চিরকুটটা পেয়েছে তো! এমন হাজার খানেক প্রশ্ন উত্তর বিহীন পোড়ায় তাকে। শান্তি মেলে না। তার উপর মা শহরে চিকিৎসার জন্য এসে তাকে কসম দিয়ে বিয়ের আসরে বসাতে চাচ্ছে। তারই মামাতো বোনের সাথে তার বিয়ে। কীভাবে আটকাবে বিয়েটা? নাকি, অপূর্ণ রবে তিস্তা প্লাবনের গল্প?


দুর্দান্ত কাঠ ফাঁটা রোদে বেশ নাজেহাল গ্রামের মানুষ। কী একটা ঋতু এলো! কখনো তুমুল বর্ষণ তো, কখনো কাঠফাটা রোদ্দুর। রোদের উত্তপ্ততা নিবিড় করতেই বোধহয় বর্ষণ আসে। 


তনয়া বেগম তার ভীষণ ভেঙে যাওয়া শরীর খানা নিয়ে সদ্য গোসল করে এলো। আজ হাতে গণা পাঁচটা দিন মরে গেছে তাদের হাস্যোজ্বল বাড়ির আঙিনাটা। সুখের বীজ যে অচিরেই ঝড়ে গেছে। 


আমান শেখ বাড়ির উঠোনের কিনারার চৌকিতে বসে আছেন। এখন ক্ষানিকটা নড়তে চড়তে পারেন। সবসময় সে কেবল নিজেকে দোষ দিয়ে যায়। না সে দুর্ঘটনার শিকার হতো, আর না তার আদরের মেয়ে এমন ভাবে হারিয়ে যেতো। 


তনয়া উঠোনের মাঝামাঝি এসে দাঁড়াতেই তার বাড়িতে বকুলের মা হাজির হলো। বকুল তিস্তাদের সহপাঠী। গ্রামের দক্ষিণ দিকে তাদের বাড়ি। 


বকুলের মায়ের শরীর দারুণ উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। ভীষণ ঘামছে সে। হ্যাঁ, অতিরিক্ত গরমে ঘামাটা স্বাভাবিক কিন্তু তার এই ঘাম স্বাভাবিক না। অনাকাঙ্খিত কারণে। 


তনয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলেন। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো, 

-'দিদি, ঘামছেন কেনো এভাবে! পানি খাবেন? পানি আনবো? আপনার শরীর কী খারাপ করছে?'


বকুলের মা তার নরম, পুরাতন সুতির কাপড়ের আঁচলটা দিয়ে মুখ মুছলেন। হাঁপাতে থাকা কণ্ঠে বললেন,

-'আহ্লাদী'র মা তাড়াতাড়ি চলো,আমাদের তিস্তা পড়ে আছে সোহাগদের কাছারি বাড়ির বাগানে। তাড়াতাড়ি চলো।'


তিস্তা'র বড় বোনের নাম আহ্লাদী। সেই সুবাধে গ্রামের বেশিরভাগ মহিলা তনয়া'কে আহ্লাদীর মা বলে।


 তনয়া বেগমের মস্তিষ্কে কথাটা পৌঁছাতেই হঠাৎ শরীরটা কেঁপে উঠলো। অনাকাঙ্খিত কিছু হয়েছে ভেবেই ঝড় উঠলো হৃদয় বাগিচায়। এতদিনের ভীষণ ঝড়টা যে এখন প্রলয়ঙ্কারী রূপ নিবে তা আর বুঝতে বাকি নেই। তিস্তা তবে দীর্ঘ পাঁচদিন পর ফিরেছে? আচ্ছা,মেয়েটা বেঁচে আছে তো!


তনয়া বেগম নড়লেন না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন। ততক্ষণে লতিকা বেগম ঘর থেকে হৈ হৈ করে ছুটে আসলেন। আহাজারি করতে করতে বললেন,

-'আমার চোখের মণি ফিরছে! বাঁইচ্চা আছে তো? নাকি জানটাও খাইয়া ফেলছে জা'নোয়ার দের দলেরা?'


আমান শেখ টলতে টলতে পায়ে উঠার চেষ্ঠা করতে করতে আৎকে উঠে বললেন,

-'অমন কথা বলবেন না, আম্মা। আমার মেয়ে তো অনেকদিন থাকবে আমাদের মাঝে। এত তাড়াতাড়ি কই যাবে?'


আর কথা বলতে পারলেন না আমান শেখ। দীর্ঘ ব্যাথাময় পা জোড়া তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দিলো না। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো সে মাটিতে। 


তনয়া বেগম,বকুলের মা,লতিকা বেগম ছুটে গেলেন আমান শেখের কাছে। তনয়া বেগম শক্ত হাতে স্বামীকে ধরে উঠে বসালেন। লতিকা বেগম তার বৃদ্ধ, কম্পমান পা নিয়ে এগিয়ে গেলেন রান্নাঘরে। মাটির কলসি থেকে একটু পানি ঢেলে ছুটে আসলেন ছেলের দিকে। এ বয়সে এত চাপ তার দেহখানা যে নিতে চাচ্ছে না আর! 


বকুলের মা হাতপাখা টা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ বাতাস করলো আমান শেখ'কে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই আমান শেখ ব্যাথিত কণ্ঠে বললো, 

-'আমি হতভাগা বাবা। নিজের মেয়েকে না রক্ষা করতে পারলাম,আর না আগলে রাখতে। তনয়া তুমি তাড়াতাড়ি যাও। আমার মেয়েটা তোমার অপেক্ষায় আছে। তাড়াতাড়ি যাও। ও কতদিন একা ছিলো আমাদের ছাড়া। যাও তাড়াতাড়ি।'


তনয়া বেগম স্বামীর মুখের লেপ্টে থাকা মাটিটুকু মুছে দিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,

-'আপনি এসব বলবেন না। তিস্তা'কে আমি নিয়ে আসছি। আপনি আর আম্মা থাকুন।'


লতিকা বেগম যেতে চেয়েও ছেলের কথা ভেবে আর গেলেন না। তনয়া বেগম শাড়ির আঁচলটা মাথায় জড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটে গেলেন। সে কাঁদে নি,ভেঙে পড়ে নি। পাহাড়ের মতন অটল রয়েছে। পাহাড়'কে নোয়ানো'র সাধ্য তো কারো নেই। এমনকি হয়তো তিস্তার ভয়ঙ্কর পরিণতিরও নেই। 


___


মাথার উপর শব্দহীন, নির্লিপ্ত বাতাস দেওয়া যন্ত্র চলছে। রাজকীয় কার্পেটের মেঝেতে বাসন্তী রাঙা শাড়ি পড়ে ভেজা চুল গুলো মুছতে ব্যস্ত এক রমনী। সদ্য স্নান করে এসেছে। মুখমন্ডলে রাজ্যের স্নিগ্ধতা জড়ানো জেনো। 


রমনী'র চুল মুছাতে বিঘ্ন ঘটিয়ে রুক্ষ পায়ে ঘরে হাজির হলো কেউ। কণ্ঠে রাজ্যের বিরক্ত ঢেলে মানবটা কঠিণ স্বরে বললো,

-'বিষাদীনি, বিয়েটা আটকাবেন না? আমি আপনার কাছে রাজ্যের অসহায়ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছি। ঠুনকো দৃঢ়তার দোহায় দিয়ে কেনো ক্ষত বিক্ষত করছেন আমার কোমল প্রেমোমন্দির?'


রমনী হাসে। নিশ্চুপ হাসি। সেগুন কাঠের তৈরী বড় আরশিযুক্ত আলমারি খানার কাছ থেকে মোটা কাঠের চিরুনি খানা নিয়ে চালান করলো দীঘল কালো চুল গুলোতো। চুল গুলোর আঁধারের মতন ঘন আঁধার, নারী'র হৃদয়ের রহস্য ঘেরা ভাবমূর্তিটাও। 


প্লাবন বিরক্ত হয়। অতিষ্টও বলা চলে। মা যখন কসম নামক নিচু কাজ দ্বারা চুপ করিয়ে দিলো তাকে, তখন থেকেই এ মেয়েটা'র পিছু পড়ে আছে সে। মা তো তাকে দিব্যি দিয়েছে বিয়েটা করার জন্য তাই সে "না" করতে পারছে না। কিন্তু, এই মেয়েটা তো চাইলেই বিয়েটা ভাঙতে পারে। তবে কেনো এত উদাসীনতা মেয়েটার মাঝে এ সামান্য ব্যাপারটুকু মানতে! বুঝে না সে। 


প্লাবন অতিষ্ট হয়ে বলে,

-'আপনি তো বেশ সুন্দরী বিষাদিনী। কলেজও পাশ করেছেন। বেশ রুচিশীল নারী। আমার চেয়ে হাজার গুণ সুন্দর পুরুষ আপনার জন্য অপেক্ষিত, তবে কেনো আমায় একটু দয়া করছেন না?'


রমনী চুল আঁচড়ানো'তে মনোযোগ দিয়ে বাঁকা হেসে বললো,

-'প্লাবন দা,আপনি তো আমার ভীষণ বড়। তবে আমায় কেনো আপনি করে বলেন? তুমি করে বলা শুরু করেন। দুদিন পর নাহয় মানুষ লজ্জা দিবে বউকে আপনি বলার কারণে।'


প্লাবন এমন সময়ে এমন কথায় আশ্চর্যিত,হতবাক এবং হতভম্ব। তার আকুতি মিনতি মেয়েটার কান অব্দি পৌঁছালো না? 


ভীষণ ঠান্ডা মেজাজের প্লাবন ক্ষ্যাপে উঠলো। অসন্তোষজনক স্বরে বললো,

-'আপনি কী আমার কথা বুজছেন না বিষাদীনি? আমি বিয়েটা করতে পারবো না।'


-'কিন্তু কেনো, প্লাবন'দা?'


-'কারণ আমার উড়ন্ত, ছুটন্ত এক কিশোরী প্রণয়ীনি'কে আমি অপেক্ষা করতে বলে এসেছি। আমার জন্য হয়তো দোর ধরে অপেক্ষা করছে সে। ভীষণ অবহেলায় হয়তো পড়ে আছে তার দেহ খানা যত্ন বিহীন। তাকে আমি ফিরাই কেমন করে? এই সাদাসিধা মাস্টারমশাই এর জন্য যে সে দাঁড়িয়ে আছে মধুসখী'র কোল ঘেষে। আমায় যে ফিরতে হবে তার কাছে।'


-'তবে,এটা আপনি কেনো আপনার মাকে জানাচ্ছেন না? ফুপিমণি'কে বলুন আপনার পিপাসাময় প্রণয়ের কথা। প্রেমে পড়েছেন অথচ তা সৎ সাহস দেখিয়ে বলতে পারবেন না, তবে কেমন প্রেমিক হলেন? প্রেমিক হওয়ার অনিবার্য শর্ত হলো তাকে সৎ সাহসের অধিকারী হতে হবে। যখন তখন তার প্রেমের কথা তাকে নির্বিঘ্নে ঘোষণা করতে হবে। প্রেমের পূর্ণতা চান অথচ একটু পরিশ্রম করবেন না?' 


প্লাবন থমকে যায় একটু। সে কী কম পরিশ্রম করেছে? সে তো মাকে জানাতে চেয়েছিলো কিন্তু মা তার আগেই তার মুখ আটকে দিয়েছে। আর মা তো তিস্তা'কে পছন্দও করেনা। জানালে বিশেষ একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না যে। 


দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্লাবন। নিচু কণ্ঠে বললো, 

-'সব চেষ্টা করেই আপনার দ্বারে এসেছি। ফিরাবেন না। আমার চেয়ে ভালো কেউ আপনার জন্য সৃষ্টি হয়েছে। আমায় একটু সাহায্য করুন।'


-'আমি জানি আপনার চেয়ে ভালো কেউ আমার জন্য অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছে। আপনি তো কেমন ভোলা ভালা। আপনার সাথে সত্যিই আমার মানায় না। তবুও আমি বিয়েটা ভাঙবো না। আমার শীতল বাড়িটা ছেড়ে আমি আপনাকে বিয়ে করে গ্রামে যাবো। ভীষণ অপছন্দের মানুষখানার সাথে ঘর করবো। তবুও ছাড়বো না।'


প্লাবন বিরক্ত হয়। এ অব্দি মেয়েটাকে সে তিনবার দেখেছে। এর আগে দু'বার দেখেছিলো ক্ষানিক সময়ের জন্য। কিন্তু এবার দেখছে অনেক দিন যাবত। মেয়েটার গাম্ভীর্যতা দেখে সে হতবাক। মেয়েটার বয়স বেশি হলে বিশ বা একুশ হবে। কিন্তু কথাবার্তা ভীষণ বড় ভাব। অবশ্য এসময়ে মেয়েদের বয়স পনেরো পেরুনোর আগেই মেয়েরা বাপের বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে যায়। সে অনুযায়ী মেয়েটার এমন বড় হওয়া টা স্বাভাবিক। আর শিক্ষিতও সে। 


প্লাবন আর কিছু বলেনি। বিষাদীনি'র বোনের কণ্ঠ ভেসে এলো। খাবারের ডাক পরেছে। প্রাবন অসহ্যের শ্বাস ফেলে রুষ্ট পায়ে বেরিয়ে গেলো। 


প্লাবন বেরুতেই বিষাদিনী বিষাদমাখা হাসি হাসলো। চুল গুলো হাত খোঁপা করে খাটের নিচ থেকে লোহার বড় একটা বাক্স বের করলো। পুরোনো রাজকীয় তালাটা খুলতেই একটা লালসালু কাপড়ে মোড়ানো বাক্স বের হলো। বিষাদিনী লালসালু কাপড়টাতে কতক্ষণ যত্নে হাত বুলালো। তারপর বাক্সটা খুলতেই খুব আগের তোলা দু'খানা ছবি বের হলো। 


রমনী ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে এক বিন্দু বিষাদময় অশ্রু ঝড়ালো। প্রথম ছবিতে থাকা মানুষটার কপালে চুম্বন এঁকে বললো,

-'আপনি আমায় নিয়ে গেলেই পারতেন। আপনার শূণ্যতা সত্যিই আমায় বিষাদিনী বানিয়েছে। যত্ন করে নামটা বুঝি এজন্যই রেখেছিলেন?'


ক্রন্দনরত কন্যার প্রশ্নের উত্তর মেলে না। উত্তর মিলবেই বা কীভাবে? ছবি কখনো কথা বলে?


রমনী ভীষণ যত্নে দ্বিতীয় ছবিটা উঠিয়ে নেয় হাতের মাঝে। বুকের মাঝে কতক্ষণ আগলে রাখলো। এবার ডুকরে কেঁদে উঠে বললো,

-'আপনারে আমি কত যত্ন করে হৃদয় মাঝে গড়েছিলাম আপনি জানেন? জানার আগেই তো মূর্ছে দিলেন আমার হৃদয় খানা। আমিও তো প্রেমে পড়ে ছিলাম। ধ্যান জ্ঞান দিয়ে ভালোবেসে ছিলাম। তার বিনিময়ে তো অনল পেলাম। যে অনলে পুড়ছি দিবানিশি। তবে আমি কেনো অন্যের বেলায় মহৎ হবো! আমিও চাই পৃথিবীর প্রত্যেক টা প্রেমিক প্রেমিকা পুড়ুক ভীষণ না পাওয়ার অনলে। বুঝুক ভালোবাসার বিষবৃক্ষ কি! আমিও তো আমার ভাঙা হৃদয় খানা দাফন করেছি বক্ষ মাঝে। তবে কেনো অন্যের সুখ দেখবো?'


রমনীর গোপন কথা গোপন রয়। শুনেনা কেউ আর্তনাদ। কেবল রাজকীয় জানালা'র সামনে থাকা কাঁঠাল গাছের ডালে বসা অতিথি পাখি গুলো আগ্রহে তাকিয়ে রয় নিশ্চুপ। 


___


কাছারি বাড়ির সামনে বিশাল বটগাছটার নিচে পড়ে আছে তিস্তা। শরীরে থাকা সেই পাঁচদিন আগের জামা খানা প্রায় ছিঁড়ে বিধ্বস্ত বললেই চলে। 


এ জায়গাটা সবসময় ফাঁকা থাকলেও আজ দারুণ ভীড়। তিস্তার গলার কাছে, হাতে, আরও নানান জায়গায় শুঁকিয়ে থাকা রক্ত গুলোর উপর ভনভন করছে মাছির দল। 


তনয়া ছুটে আসে ভীড় ঠেলে। চমকে উঠে মেয়ের পরিণতি দেখে। মেয়েটা নড়ছে না কেনো? শ্বাসও তো নিচ্ছে না। তবে কী,,,!


নিজের ঘরের বিছানাতে নেতিয়ে আছে ছুটন্ত তিস্তা। সময়টা ঠিক ভরসন্ধ্যা। বাড়ির পাশে বাতাবিলেবু গাছটা থেকে লেবুর কড়া সুবাস আসছে। জোনাকির ডাকও ভেসে আসছে দূর হতে। কিন্তু তিস্তার মস্তিষ্ক অব্দি যাচ্ছে না কিছুই।তার শরীরের কাপড় বদলানো হয়েছে আগেই। মাথার কাছে বৃদ্ধ লাতিকা অনবরত তালপাতার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে। তনয়া খাটের কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। 


তখন মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে প্রথমে মনে অনাকাঙ্খিত, ভয়ঙ্কর ভাবনা এলেও পরক্ষণেই মেয়েকে আকড়ে ধরতেই তার ভাবনা বদলে গেলো। মেয়েটা'র শরীরে প্রাণ আছে। গ্রামের মানুষের সাহায্যে তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। তখনও জ্ঞান ছিলো না। পানি দিয়ে শরীর ধুঁয়ে পড়নের জামাকাপড় বদলে দিয়েছে। 


গ্রামে তেমন কোনো ভালো ডাক্তার নেই। সবাই যখন বেশ উৎকণ্ঠিত মেয়েটার সাথে কী হয়েছে জানার জন্য তখনই একজন দেখলো শহর থেকে মোড়লদের গাড়ি এসেছে। সবাই হৈ হৈ করে ছুটলো মোড়লদের বাড়ি। কারণ শহর থেকে গাড়ি এলে মাহিনই আসে। এতদিন সে গ্রামে ছিলো না। মাঝে মাঝে ছুটিতে আসে। 


সবাই ছুটে গেলো মাহিনের কাছে। তিস্তার ব্যাপারে সব জানাতেই মাহিন ছুটে এলো। 


বেশ কতক্ষণ তিস্তাকে পর্যবেক্ষণ করলো মাহিন। তনয়া তখনও ঠাঁই দাঁড়িয়ে। মাহিন ধীরে উঠে বাহিরে চলে গেলো। 


মাহিনের পিছে পিছে তনয়াও বের হলো। লতিকা বেগম নাতনির শরীরে হাত বুলিয়ে বাতাস করে যাচ্ছেন। ভেতর থেকে কান্না'রা দলক পাকিয়ে আসছে। তার ছটফটে নাতনির এ কী হলো! কার কুনজর পড়লো এমন পাখির উপর! কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে মেয়েটার? 


গ্রামবাসী তখন উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার যা ভাবছে তা সঠিক কিনা সে কথাটা ডাক্তারের মুখ থেকে শোনার জন্য। 


মাহিন বের হতেই নেপাল ঠাকুর এগিয়ে এলেন। এ একটা মানুষের মনে চাঞ্চল্যকর খবর শোনার উৎকন্ঠা নেই। বরং সে মেয়েটার শরীরের অবস্থা জানার জন্য আগ্রহী। 


মাহিনের কাছে গিয়ে নেপাল ঠাকুল হাত জোড় করে বললেন,

-'আমাদের মেয়েটা'র কী খবর ডাক্তার? কোনো বড় সমস্যা হইলো নাকি? সদরে নিতে হইবো?'


মাহিনের মুখে তখন রাজ্যের আমবস্যা। সে কোনোরকমে বললো,

-'না আর সদরে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। একটু পরই হুঁশ ফিরবে।'


এবার গ্রামের মুরব্বিরা এগিয়ে এলেন। একজন চাঁপা হুঁশিয়ারি স্বরে বললেন,

-'কী দেখলেন ডাক্তার সাব? মাইয়াটা'র সতিত্ব নাই তাই না?'


সবাই যেনো এ প্রশ্নটারই অপেক্ষায় ছিলো। উন্মুখ হয়ে চেয়ে রইলো উত্তরের আশায়। তনয়া বেগমও তাকালো মাহিনের দিকে। মাহিন কতক্ষণ চুপ রয়। একদম নিরবতায় কেটে যায় কতক্ষণ। তারপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,

-'আপনারা এ ব্যাপার পুলিশদের জানান নি? তারা তদন্ত করছে তো ঠিক ভাবে? এভাবে তিন তিনটা মেয়ের সতিত্ব কারা নষ্ট করলো? তাও তো তিস্তা বেঁচে ফিরেছে কিন্তু বাকিদের তো মেরে ফেলেছে।'


ডাক্তারের প্রশ্নেই যে ছিলো গ্রামবাসীর উত্তর তা আর বুঝতে বাকি রইলো না কারো। তনয়া ধপ করে বসে পড়ে ফ্লোরে। তার দুনিয়াটা যেনো আঁধার করে আসে। উঠানের খাটে বসে থাকা আমান শেখ ডুকরে কেঁদে উঠে। নিমিষেই এক দারুণ ঝড় বয়ে যায়। সবাই হা হুতাশ করে কতক্ষণ। মহিলাদের মাঝে কয়েকজন ছুটে এসে তনয়াকে বাতাস করে, স্বান্তনা দেয়। পুরুষেরা আমান শেখকে ভরসা দেয়। মাহিন গটগট পায়ে চলে যায় সেখান থেকে। 


সন্ধ্যা টা কেটে যায় ভয়ঙ্কর সত্য মানতে না পারার গুঞ্জনে। 


_____


তিস্তা বিছানার পাশে জানালাটা'র দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে। তার জ্ঞান ফিরেছে প্রায় দশ, পনেরো মিনিট হবে। এখন প্রায় মধ্যরাত। কেউ তার আশেপাশে নেই। হারিকেনের আলো জ্বলছে ছোট্ট বসার টুলের উপর। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে তার। এতদিন পর নিজেকে নিজের বিছানায় দেখে বেশ অবাক হয় সে। অতঃপর মনে পড়ে আজকে ভোরের ঘটনা। সে ঐ বন্ধ ঘরটার থেকে পালিয়ে সোহাগ চাচাদের কাছারি বাড়ির সামনে এসে জ্ঞান হারায়। তারপর কী হয়েছিলো কিছুই মনে নেই তার। 


জানালার বাহির হতে ভেসে আসছে জোনাকির ডাক। দু একটা জোনাকি ঘরে ঢুকছে। তাদের জ্বল জ্বল আলোখানা তিস্তার মন ভরিয়ে দিচ্ছে। 


তিস্তার বড্ড ইচ্ছে করছে একটু ছুঁয়ে দিতে তাদের কিন্তু সে ধরছে না। থাক,ওরাও একটু নিজেদের মতন উড়ুক। বাহিরের থেকে ভেসে আসা লেবুর ঘ্রাণটা তিস্তা শুষে নিলো ক্ষাণিকটা। কতদিন পর আবারও নিজের নীড়ে ফিরে এসেছে সে। গত পাঁচদিন যাবত একটা ঘরে নাক, চোখ,মুখ বন্ধ করে তাকে ফেলে রেখেছিলো। এমন অবস্থায় তো মনে হয়েছিলো মরেই যাবে সে। কিন্তু অবশেষে মুক্তি পাবে কে জানতো! 


তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে। মাস্টারমশাই এর কথা মনে পড়ে ভীষণ। এই রাত, এই আধাঁর একদিন মাস্টারমশাই ঘুঁচিয়ে দিয়েছিলো তার আবদারে। 


তখন সময়টা ছিলো শরৎকাল। তিস্তাকে তখন প্রায় মাস্টারমশাই বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিতো। সেদিনও পৌঁছে দিচ্ছিলো। শুধু তিস্তা না, সাথে আরও ছেলেমেয়ে প্রায়ই থাকতো। সেদিনও ছিলো। তিস্তা, ভ্রমরী,বকুল, রাসেল, সোহেল আরও অনেকে। 


আঁধারের পথখানায় মাস্টারমশাই নিজের টর্চ লাইট টার আলো দিয়ে আধাঁরটা কিছুটা হালকা করার প্রয়াস চালিয়ে হাঁটছে গ্রামের পথ দিয়ে। তিস্তার তো চরম দুরন্তপনা। সে ছুটতে ছুটতে,লাফাতে লাফাতে হাঁটছে। হঠাৎ বাঁশবাগানের সাথে দিয়ে আসার সময় এক ঝাঁক জোনাকিপোকা জ্বল জ্বল আলো দিয়ে পুরো পথটা যেনো আলোকিত করে দিলো। 


তিস্তার বরাবরই স্বভাব জোনকি দেখলেই হাতের মুঠোয় চেঁপে ধরা। তার মনে হয় আকাশের মস্ত বড় চাঁদ তার মুঠোয়। সেই অভ্যাসবশত জোনাকি ধরার প্রয়াসে সে একটু লাফ দিতেই ছিটকে পড়ে রাস্তা থেকে পাশের ছোট্ট গর্তটায়। ভীষণ ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে। সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেছিলো। 


মাস্টারমশাই ডানে বামে না দেখে তিস্তার কাছে এসেই ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় তার গালে। তিস্তা ব্যাথা ভুলে আহম্মক হয়ে তাকিয়ে রয়৷ মাস্টারমশাই তাকে মেরেছে সে কথাটা মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই ছিটকে আসে কান্নার দল। যেই ঠোঁট ভেঙে সে কান্নায় মনোনিবেশ করবে তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে মাস্টারমশাই বাম গালে আরেকটা চড় বসিয়ে দেয়। 


এবার যেনো অতি বিষ্ময়ে কান্না গুলোও আটকে যায় কোথাও। মাস্টারমশাই তিস্তাকে পাঁজাকোলে তুলে ধমকাতে ধমকাতে বললো,

-'মন তো চাচ্ছে আরও চারটা চড় বসাই তোর গালে। শান্তি দিবি না আমায়? একটুর জন্য আমার জানটাই বের হতে নিচ্ছিলো। কী দরকার ছিলো অন্ধকারে লাফ দেওয়ার?'


তিস্তা হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই মাস্টারমশাই এর ধমক শুনে হুঁশ ফিরতেই কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো, 

-'আমি তো জোনাকিরে ধরতে গিয়েছিলাম। কে জানতো পরে যাবো!'


তিস্তার এহেন বোঁকামার্কা কথা শুনে প্লাবন আরও ক্ষাণিকটা বকে দেয়। 


পায়ে বেশ ব্যাথা পাওয়ায় পরেরদিন পুরোটা সময় ঘরে বসিয়ে কাটায় সে। রাত তখন দশটা কি এগারোটা। সবে খাবার খেয়ে তিস্তা ঘুমাতে এসেছিলো। হঠাৎ জানলার কাছে একটা জ্বলতে থাকা কাঁচের বয়াম দেখে চমকে উঠে। আরেকটু ভালো করে দৃষ্টি দিতেই দেখে হাসি হাসি মুখ করে সাদা পাঞ্জাবি খানা পরে দাঁড়িয়ে আছে তার মাস্টারমশাই। তিস্তা অবাকে হা হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই তার ভয়ডর ততটা নেই তাই সে ভয় পায় নি প্রথমেই। 


মাস্টারমশাই'কে দেখে তিস্তা দ্রুত ছুটে গেলো খাটে। মাস্টারমশাই তখন জানালা ধরে বাহিরের দিকটায় দাঁড়িয়ে। তিস্তাকে ছুটতে দেখে চোখ রাঙিয়ে সাবধান করে। 


তিস্তা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,

-'আপনি এত রাতে এখানে!'


জোনাকির আলোয় চোখে পড়ে মাস্টারমশাই এর মিষ্টি হাসি। মিষ্টি হেসে সে বললো,

-'তোর জন্য কিছু সুখ কুড়িয়েছি। এই যে, বয়ামে বন্দি করে এনেছি। এগুলোর জন্য ই তো কাল ব্যাথা পেলি।তাই এনে দিলাম।'


তিস্তা খাটে থাকা বয়ামটা আকড়ে ধরলো। খুশি যেনো তার ধরে না। এতগুলা জোনাকি তো সে কখনোই একসাথে ধরতে পারে না। মাস্টারমশাই তাকে কত গুলো জোনাকি দিলো! কত ভালো মাস্টারমশাই টা। 


প্লাবন তিস্তার বাঁধনহারা খুশি দেখে জানালার লম্বা শিকের ফাঁকাটা দিয়ে নিজের হাতটা এগিয়ে তিস্তার মাথায় আদুরে, স্নেহের হাত বুলালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো, 

-'কবে বড় হবি? তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যা না।'


কথাটা বোধগম্য হয় নি তিস্তার। সে তখন তার জোনাকি দেখায় ব্যস্ত। সেই মধ্য রাতের মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই এর বিমোহিত কণ্ঠের ছোট্ট বাক্যের অর্থ বুঝিনি অবুঝ তিস্তা। কিন্তু আজ বুজছে সেই আকুতি মাখা বাক্যের তাৎপর্য। আজ বড়ও হয়েছে। কিন্তু কোথায় সে মাস্টারমশাই? যার জন্য বড় তিস্তার বুকের বা'পাশ খালি লাগে, কোথায় সে? মধ্যরাতের সে সুখ বিক্রেতা পুরুষ আজ এক আকাশ বিষন্নতা দিয়ে কোথায় গেলো?


এসব ভাবনার মাঝে নিজের শরীর ভীষণ ধাক্কা অনুভব করে। দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখে তার মা দাঁড়িয়ে আছে ভাতের থালা নিয়ে। কতদিন পর মাকে দেখলো। 


তিস্তা তৎক্ষনাৎ মাকে জড়িয়ে ধরলো। এতদিনের কান্না ঝড়িয়ে দিলো ভীষণ ভাবে। তনয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলালো। মেয়েটা কাঁদছে কেনো! তবে কী খারাপ ঘটনা গুলো মনে করে কাঁদছে? 


তনয়া ভাতের থালাটা খাটে রেখে স্বান্তনার স্বরে বললো,

-'কাঁদছো কেনো? কিচ্ছু হয় নি। ভাগ্যে যা ছিলো তা হয়েছে। তুমি এর জন্য নিজেকে দোষ দিও না। ওরা তোমার সাথে যা সর্বনাশ করেছে তার বিচার হবে।'


মায়ের কথায় তিস্তা অবাক হয়। সর্বনাশ করেছে! আটকে রাখাটাই কী সর্বনাশ? তিস্তা অবুঝ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-'কী সর্বনাশ মা? আটকে রেখেছে যে?'


তনয়া অবাক হলো। মেয়েটা কেমন প্রশ্ন করছে! পাগল হলো নাকি? কী সর্বনাশ ও কী বুঝে না! 


বাহির থেকে দাদী ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

-'তোর সতীত্ব ছিঁইড়া খাইছে জানোয়ারের মতন। এর চাইয়া বড় সর্বনাশ হয়!'


দাদীর কথায় তিস্তা জেনো আকাশ থেকে পরলো। অবাক কণ্ঠে বললো,

-'ওরা তো আমায় কিছু করে নি,যুবতী!'


শীতল রাত। আধাঁর ঘেরা চারপাশে। বড় রাজকীয় বাড়িটার, ঠিক পেছনের দিকের ছোট্ট বাগানের দিকে দাঁড়িয়ে আছে প্লাবণ। সে কিছুই করতে পারছে না। তার হাত পা শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে যেনো কেউ। এই মুহুর্তে তার বসে থাকার সময় নেই তবুও দম খিঁচে বসে থাকতে হচ্ছে। কেমন আছে তার ছোট্ট তিস্তা? প্রায় একমাস তো হতে চললো,তাদের প্রেমের নির্বাসনের। মেয়েটা যা দুষ্টু,শরীরের ঠিকমতন খেয়াল রাখে তো! নাকি, মাস্টারমশাই এর বিরহে মেয়েটা থম মেরে গেছে? ভালো আছে মেয়েটা! আচ্ছা, হরপ্রসাদ যদি এর মাঝে গ্রামে গিয়ে তাদের বিয়ের কথা বলে দেয়, তখন? মেয়েটা যে মানতে পারবে না। মাস্টারমশাইকে'ই নিয়ে তো তার সব অনুভূতি'র সৃষ্টি। কিশোরী মনের আধিপত্য বিস্তার করে মাস্টারমশাই। সে মাস্টারমশাই এর কাছ থেকে এমন প্রতারণা সামলে উঠতে পারবে তো মেয়েটা?


প্লাবণ থমকায়। এসব যে সে আজ ভাবছে, তেমনটা না। প্রতিদিনই তিস্তার ভাবনায় তার ঘুম,খাওয়া আর হয় না। এ খবর তো জানবে না তিস্তা, কেবল জানবে, তার মাস্টারমশাই তাকে বাজে ভাবে ঠকিয়েছে। প্লাবনের মনে পড়ে গ্রামের প্রথম দিনের কথা। কাঠফাটা রোদ্দুরে সে দেখেছিলো প্রথম তিস্তার মুখ। ছোট্ট কিশোরী হাঁটু থেকে আরেকটু নিচ অব্দি একটা গাঢ়ো হলুদ রঙের ফ্রক পড়ে ক্ষেতের মাঝ দিয়ে দু'হাত ছড়িয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। তার যেনো কোনো পিছুটান নেই। ঘর্মাক্ত লাল মুখখানা।ছোট ছোট চুল গুলো ঘাঁড় অব্দি বেণী। সে কিশোেী মুখে কী মায়া যে সে দেখেছিলো সেদিন, সে জানে না। কেবল এতটুকু জানে, এরপর আর কারও মুখ তাকে টানে নি। মায়া আসে না। মেয়েটা কেমন আষ্টেপৃষ্টে রেখেছে তাকে। এ মায়া বুঝি ছাড়ানো যায়! 


মধুসখী'র পাড়ে,দুজনের কত স্মৃতি। এসব কী আদৌও ভুলা যায়! তিস্তার বিরহে, হঠাৎ করেই মাস্টারমশাই এর সব খালিখালি লাগছে। প্রিয় সানুষটাকে একবার দেখতে চাওয়ার তৃষ্ণা, পৃথিবীর সব তৃষ্ণা'কে হার মানায়। 


প্লাবন চোখ বন্ধ করে। তার ব্যাথা গলায় সুর হয়ে আসে। চোখের কোণে ভেসে উঠে তিস্তা৷ খিলখিল হাসি। সেই হাসি প্লাবনের গলায় তাল দেয়। প্লাবন আনমনেই গেয়ে উঠে,

-'উষ্ণ দুপুরে, দেখিয়াছি তারে, মায়া লাগাইয়াছে সে,,

আমি তিস্তার ঢেউয়ে তাকে দেখি,হৃদয়ে বাসা বাঁধিয়াছে যে,,,'


গানের সুরে ভেসে গেলো সবটুকু আকুলতা। নিজেকে শোপে দিলো প্রণয়ীনির কাঠগাঁড়ায়। মনের জ্বলন্ত লেলিহান শিখা ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে। কিন্তু তা বেশিক্ষণ হলো না। ডাক পরলো তার। সুরে ভাঁটা পড়লো। ছন্দ কেটে গেলো সুরের। 


একটু একটু করে সঞ্চয় করা শীতলতা নিমিষেই রাগে পরিণত হলো। বিরক্তে কুঁচকে গেলো কপালের ভ্রু জোড়া। সে মেয়েদের সম্মান করে বলে এখনো এ মেয়েটাকে সহ্য করছে। আর নাহয় কবেই পুঁতে ফেলতো মাটিতে। 


প্লাবনকে চুপ হতে দেখে বিষাদিনী এগিয়ে গেলো। পড়নের নীল রাঙা শাড়িটার আঁচল ঘাঁড়ের উপর যত্ন করে উঠিয়ে, রিনরিনে মেয়ে কণ্ঠে বললো, 

-'মাস্টারমশাই, প্রেমের পরিণতি সুখকর নাহলে বড্ড কষ্ট মেলে তাই না?'


অনেকদিন পর,ঠিক কতদিন পর এ ডাকটা শুনলো,প্লাবন? আটাশ দিন বোধহয়। ঠিক আটাশ দিন না, হরপ্রসাদও তো সেদিন একবার ডেকেছিলো। কিন্তু এখন, ভুল জায়গায়, অপছন্দের পাত্রী থেকে এমন ডাক আশা করে নি প্লাবন। এত পছন্দের ডাকটাও, ভীষণ বিষাক্ত মনে হলো। 


চোয়াল শক্ত হলো প্লাবনের। মেয়েটার সাথে আর ভালো আচরণ করা যাবে না। অনেক তো হলো। প্লাবন বিরক্তি'র সুরে বললো,

-'সেটা আপনি জেনে কী করবেন, বিষাদিনী? আপনি তো কেবল বিষাদ ছড়াতে জানেন। এতটুকুই আপনি জেনে রাখুন।'


প্লাবনের উত্তরে বিষাদিনী হাসে। মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়ে বলে,

-'দেখলি তো, বিষাদিনী! তুই তোর বিষাদমাখা মন নিয়ে বিষাদ'ই ছড়িয়ে গেলি। জীবন বুঝি এমন বৃথাই গেলো তোর?'


বিষাদিনী'র মন উত্তর দেয় নি। সে যে পরিপূর্ণ বিরহে আচ্ছন্ন। 


হঠাৎ প্লাবন আর বিষাদিনী ছাড়াও আরেকজনের গলার স্বর পাওয়া গেলো। আশালতা,প্লাবনের মা এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। বিষাদিনী'র মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে গদগদ হয়ে বললো,

-'বাহ্ রে মা,আমার ছেলেটা দেখছি আজকাল তোমার সাথেই থাকে। একদিন ঠিকই বুঝবে ও, ওর মা ওর জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নেই নি।'


প্লাবনের শক্ত চোয়াল আরও শক্ত হলো। তাচ্ছিল্য হেসে বললো,

-'সন্তানের জীবন থেকে দীর্ঘস্থায়ী ভাবে সুখ কেড়ে নিয়ে, কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আমি সত্যিই জানিনা। আর আমি জানতেও চাই না। নিজের অবস্থানকে দুর্বলতা বানিয়ে আরেকজনকে সে দুর্বলতা দেখিয়ে কোনো স্বার্থ হাসিলের মানে আমার মস্তিষ্কে বোধগম্য হয় না।'


আশালতা নিজের ছেলে কথায় ভিষণ ভাবে অপমানিত বোধ করলেন। প্লাবণ গটগট পায়ে চলে গেলো সে জায়গা থেকে। পরিস্থিতি অন্য দিকে ঘুরলে বিষাদিনী যদি রাজি নাহয়! সে ভেবে আশালতা তাড়াতাড়ি বিষাদিনী'র কাছে যায়। বিনীতভাবে বলে,

-'তুমিই পারবে সবটা ঠিক করতে। আমার ছেলেকে সঠিক পথে নিয়ে এসো।'


বিষাদিনী ভরসা মাখা কণ্ঠে বললো,

-'বিশ্বাস রাখুন,আমি সব ঠিক করে দিবো।'


আশালতা স্বস্তির শ্বাস ফেলে। এ মেয়েটাকে একটু ভালো জায়গায় নিতে না পারলে সে যে মরেও শান্তি পাবে না। মেয়েটাকে ভালো রাখার কথা দিয়েছিলো যে। 


__


বিষাদিনী তাদের বাড়ি'র লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস নিয়ে বসেছে। সে বড্ড রবীন্দ্র প্রেমী। রবীন্দ্রনাথ এর এমন কোনো বই নেই যেটা তার কাছে নেই,এমন কোনো গান নেই যেটা সে জানেনা। তার জীবনের দু'টি পুরুষের প্রতি সে দুর্বল। এক, তার বিষাদ ঢেলে দেওয়া প্রেমিক আর দুই,তার বিষাদ দূর করা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 


হঠাৎ তার সামনের টেবিলের উপর কিছু রাখার শব্দ হলো। দৃষ্টি দিতেই দেখলো, কফির কাপ। বাংলায় এখনো তেমন কফির চলাচল নেই। বাহিরদেশ থেকেই আনাতে হয়। তার ভীষণ পছন্দ বিধায়, বাহির দেশ থেকে এসব আনানো হয়। 


বিষাদিনী কফির কাপটাতে চুমুক দেওয়ার সময় তাদের বাড়ির অল্পবয়সী ঝি'টা আমতা আমতা শুরু করলো। বিষাদিনী খেয়াল করলো সেই ভাব। কফির কাপে আরামদায়ক এক চুমুক দিয়ে,কাপটা আবার আগের জায়গায় রাখলো। গম্ভীর কণ্ঠে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো,

-'কিরে সরলা? কিছু বলবি?'


সরলা যেনো এমন একটা প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিলো। সে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বললো,

-'দিদিমণি, আপনারে একটা কথা বলিতে চাই।'

-'বলিয়া ফেলুন।'


কথাটা বলেই ফিক করে হাসে বিষাদিনী। সরলা মেয়েটা তার ছোট। কথা বার্তায় একটু শুদ্ধতা বেশি। পশ্চিমবাংলা'র কোনো গ্রাম থেকে এসেছে। খেয়াল নেই তার, গ্রামের নামটা। বাড়িতে এমন কত গুলোই ঝি,কেয়ারটেকার আছে। সবার নাম-ই বড় কষ্ট করে মনে রাখে সে। 


কতক্ষণ আমতা-আমতা করে অবশেষে সরলা বললো,

-'আপনার বাবা বলিতেছে,পেটের সন্তানটা নষ্ট করিয়া দিতে। কিন্তু আমি রাখিতে চাইতেছি। আপনি একটু বুঝিয়ে বলিয়েন তাকে।'


এমন উদ্ভট কথায় সামন্য হোঁচট খেলেও,নিজেকে সামলে নেয় বিষাদিনী। এ আর নতুন কী! এমন কত-শত ঘটনা ঘটে আসছে। বাবা'র কী চরিত্র বলে কিছু আছে নাকি? কেবল টাকার সাম্রাজ্য আছে বলেই এখনো শুদ্ধ পুরুষ হয়ে বেঁচে আছে। আর মা! তার কথা নাহয় বাদই দেওয়া যাক। স্বামী-স্ত্রী'র চরিত্রের "চ" ও নেই। বিলাসিতার নামে কতগুলো নষ্টামো ছাড়া কিছু কী হয়!


এমন অদ্ভুত কত আবদার'ই বিষাদিনী'কে শুনতে হয়। আগে ভীষণ খারাপ লাগলেও,এখন লাগে না। সয়ে গেছে শরীরে সবটা। 


বিষাদিনী ধীরে সুস্থে কফিটা শেষ করলো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, 

-'সামান্য টাকার জন্য, শরীরটা না বিকালেও পারতি।'

-'মা-বাবা টাকার জন্য অনেক চাঁপ দেয়। আমাদের মতন মানুষের যে পেট চালানোর আগেই,পিঠে দ্বায়িত্ব চাপিয়া দেয়।'


বিষাদিনী ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,

-'এ পাপ রেখেও বা কী করবি? এর চেয়ে ফেলে দে। ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিবে ঐ লোক। মানে আমার বাবা, বিশাল চৌধুরী।'

-'আমার যে অনেক শখ, প্রথম সন্তানটি মানুষ করিবো।'

-'তবে,পাপের সন্তান কেনো গর্ভে ধরতে গেলি? লাভ নেই এসব বলে। এর চেয়ে ঐ লোক যেমন চায়, তেমন কর। তোরই লাভ। তোরাও না টাকার জন্য কী যে করিস!'


সরলা মাথা নিচু করে বললো,

-'আপনার তো অনেক টাকা আছে,তাই বুঝিতে পারিবেন না আমাদের অসহায়ত্ব। আপনারা তো অনেক সুখেই থাকিতেছেন ।'


বিষাদিনী আর কিছু বলে না। কিছুক্ষণ মৌণ রয়। তাচ্ছিল্য হাসে মনে মনে। 

-'অনেক সুখে আছে! টাকা থাকলেই কী সুখী! কই, সে তো সুখী হতে পারছে না। এমন নরকে থাকলে কেইবা সুখী হতে পারে?'


নিজের প্রশ্ন নিজের মাঝেই রাখে সে। হঠাৎ অদ্ভুত স্বরে বলে, 

-'সরলা,তোর সাথে যে বিশাল চৌধুরী অন্যায় করলো,তার বিচার চাইবি না? চল, আমরা বড় পুলিশ অফিসারদের সাহায্য নিবো। আমার বাবা'র কেচ্ছা কাহিনী ছড়িয়ে দিবো। যাবি?'


ভীতু সরলা কেঁপে উঠে। দু হাতে না না করে বলে,

-'কখনোই না, দিদিমণি। আমি বরং বাচ্চাটা নষ্ট করিয়া ফেলবো, তবুও ঐ ভেজালে যাবো।'


বিষাদিনী সরলাকে বুঝানোর চেষ্টা করে। ভীতু সরলা। ছুটে বের হয়ে যায়। পরক্ষণেই বিষাদিনী'র গালে শক্ত চড় পড়ে। বিষাদিনী অবাক হয়ে তাকাতেই দেখলো ছোট হাতা যুক্ত বক্ষবন্ধনী'র সাথে, পাতলা মসলিন শাড়ি পড়া তার তথাকথিত "মা" নামক মহিলা। 


বিষাদিনী যেনো থাপ্পড়টা গায়েই মাখলো না। আরাম করে নরম কেদারায় বশে, আয়েসি ভঙ্গিতে বললো,

-'আরে, মিসেস রঞ্জিতা? লাইব্রেরী'তে পা রেখেছেন কোনো? ইশ,আমার লাইব্রেরী টা অপবিত্র করে দিলেন।'


তার সামনে অতি সুন্দরী মহিলা ফুঁসে ওঠে বললেন,

-'খাইয়ে, খাইয়ে,একটা কালসাপ পুষছি। শীগ্রই তোমাকে বিদায় করবো। এ বাড়িতে থেকেই নিজের বাবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করো? অকৃতজ্ঞ মেয়ে।'


বিষাদিনী উত্তর দেয়না। মানুষকে উত্তর দেওয়া যায়, অন্যকিছুকে না। নিজের মনে তীব্র ঘৃণা জন্ম নেয়। এ কেমন ভাগ্য তার! 


শুভ্র রাঙা মেঘ ভেসে যাচ্ছে আকাশ পথে। তাদের নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই। যখন যেখানে ঠাঁই মেলে তখন সেখানেই থেকে যায়। তিস্তা'র জীবনে আজকে একটা নতুন ভোর,নতুন সকাল আর নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার দিন। 


গতকাল রাতে দাদী বারবার বলেছে তার নাকি সতীত্ব কেড়ে নিয়েছে, তাকে আটকে রাখা জানোয়ার গুলো। সে শত চেষ্টা করেও দাদীকে বুঝাতে পারে নি যে, তার সাথে খারাপ কিছুই হয় নি৷ দাদী ভেবেছে,সে হয়তো খারাপ জিনিসটা বুঝে না তাই তার সাথে যে খারাপ হয়েছে তা বুঝতে পারছে না।


কত রকমের নোংরা প্রশ্ন করেছে দাদী। তিস্তা শেষমেশ কেঁদে দিয়েছে ক্লান্ত হয়ে। তার সাথে কোনো নোংরামি হয়নি,অথচ দাদী মানতেই চাইছে না!


তনয়া বেগম তখন বুজেছিলো মেয়ের মনোভাব। শাশুড়ীকে তখন সে'ই এসব প্রশ্ন করতে বারণ করে। ছুটন্ত তিস্তা সামন্য মূর্ছে যায়। কী হচ্ছে তার সাথে! এসবের সাথে কোনো কালেই সে পরিচিত না। বাড়ির মানুষই তাকে বিশ্বাস করছে না। বাহিরের মানুষের সাথে কীভাবে লড়বে সে! 


সকাল হতে না হতেই তিস্তা উঠে হাতমুখ ধুয়ে, স্নান করে নেয়। রোজকার মতন বাড়ির উঠানে এসে চুল শুকােচ্ছিলো। তনয়া বেগম তখন বাড়ির উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। সকাল সকাল মেয়েকে স্নান করতে দেখে অবাক কণ্ঠে বললো, 

-'তুমি এত সকালে স্নান করলে যে!'


তিস্তা চুল মুছায় মনোনিবেশ করে বললো,

-'এই রবিবার থেকে তো আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু,আম্মা। পড়াশোনাও তো করতে হবে। তাই,বকুলগো বাড়িতে যাবো,কোনো পড়া দাগিয়ে দিছে না কিনা সেটা দেখে আসবো।'


তনয়া বেগমের হাতে থাকা ঝাড়ুটা পড়ে গেলো। মেয়েটা যদি এখন বাহিরে যায়, গ্রামবাসীর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে! ওর দাদী'ই তো মানতে চাইছে না মেয়েটার মুখের কথা, গ্রামবাসী মানবে?


মানুষ বরাবরই অদ্ভুত প্রাণী। অন্য কারো খারাপটা শুনতে তারা মনে মনে পৈচাশিক আনন্দ পায়। ভালোটা যেনো মানতেই পারে না। খারাপটা শুনে আফসোস করার মতন মজার কাজ হাতছাড়া করতে চায় না তারা। 


তনয়া বেগম মেয়েকে "না" করার আগেই মেয়ে ছুট লাগালো বকুলদের বাড়ি। তনয়া বেগমের ভয় হচ্ছে,মেয়েটা এখনও দুরন্তপনা করছে। কিন্তু হয়তো আর বেশিক্ষণ পারবে না এই দুরন্তপনা দেখাতে। 


___


'বকুল,ও বকুল, কোথায় তুই? একটু বাহিরে আয় তো।'


এমন চার-পাঁচ বার ডাকার পরও বকুল নামের মেয়েটি বাহিরে এলো না। আশ্চর্য! বকুল তো এক ডাকেই সদা হাজির থাকতো, তবে আজ কোনো আসছে না? এত জোড়ে ডাকার পরও ওরা ডাক শুনছে না কেনো?


তিস্তা বিরক্ত হলো। সেই কতক্ষণ যাবত ডেকে যাচ্ছে মেয়েটাকে, কিন্তু মেয়েটার কোনো খোঁজখবরই নেই? 


তিস্তা আরেকবার ডাকার জন্য প্রস্তুতি নিতেই ঘর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো বকুলের মা। তিস্তাকে দেখে তিনি যেনো সাত আসমান থেকে পড়লো। অবাক নয়নে, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো, 

-'এই, এই মেয়ে,তুই এ শরীর নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিস কেনো? যা, যা তাড়াতাড়ি বাড়ি। গ্রামের ছেলেমানুষ বা অন্য কেউ দেখলে কী হবে! ছিহ্! যা বাড়ি যা।'


বকুলের মায়ের কথায় অবাক হলো তিস্তা। তাকে দেখলে কী এমন হবে, ভেবে পাচ্ছে না সে। বিষ্মিত কণ্ঠেই তিস্তা বললো,

-'জেঠিমা,কী হবে আমায় দেখলে? এভাবে বলছো কেনো?'


বকুলের মা আরেকটু এগিয়ে এলেন তিস্তার দিকে। গলা ছেড়ে ভীষণ নাক মুখ কুঁচকে বললেন,

-'কিরে,তোর কী লজ্জা শরম নেই? আবার জিজ্ঞেস করছিস কী হবে তোকে দেখলে! তোর বাড়ির মানুষের কী আক্কেল জ্ঞান নেই? তুই নাহয় কিছু বুজিস না, তারা তো বুঝে। কীভাবে একা ছাড়লো তোকে?'


তিস্তা যেনো অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। বকুলের মায়ের কথার ধরণের সাথে কাল রাতের দাদীর কথার ধরণের মিল পাচ্ছে সে। তবে কী বকুলের মাও ভাবছে, তার সতীত্ব নেই?


তিস্তার অবুঝ মাথায় বকুলের মায়ের অহেতুক আচরণের কারণটা বোধগম্য হলো। সে ব্যাতিব্যস্ত কণ্ঠে বকুলের মায়ের ভুল ধারণাটা ভাঙাতে বললো,

-'না না জেঠিমা, তুমি বোধহয় ভুল ভাবছো। আমার সাথে ওরা কিছু করে নি। কোনো নোংরামি করে নি, বিশ্বাস করো।'


তিস্তার এহেন কথায় বকুলের মায়ের মনোভাব আরও গাঢ়ো হলো। মেয়েটা কী এখানে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে এলো? ধূর,এ মেয়ের সাথে কথা বলতেও রুচিতে বাঁধছে। না, না, বকুলকে ওর সাথে মিশতে দেওয়া যাবে না। 


ভদ্র মহিলা তিস্তার থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘরে যেতে যেতে বললো,

-'তোর সাথে কী হয়েছে না হয়েছে তা আমার ভালো করেই জানা। একদম বকুলের ধারে কাছে ঘেষবি না। ভ্রমরী তারপর আরেকটা মেয়ে, কী জেনো নাম খানা?  ওদের তুলে নিয়ে মেরেই ফেললো, আর তুই বলছিস তোকে কিছু করেনি। আমরা কী এতই অবুঝ? যা দেখি,তোর বাড়ি যা। তোর সাথে মিশলে আমার মেয়েটার আর ভালো সম্বন্ধ পাবো না। আর কয়েকদিনের মাঝেই বিয়ে দিয়ে দিবো ওরে। বিয়ের সময় হয়ে গেলে মেয়েছেলে ঘরে রাখাও এখন যন্ত্রণা। পরে পাপ হয়ে যাবে। যা,বাড়ি যা। আমার মেয়ের সাথে আর কোনোদিনও দেখা করবি না। যা।'


তিস্তা হতবাক! চেনা মানুষের,চেনা ব্যবহার, আজ যেনো বড্ড অচেনা। তার মুখের কথা কেউ বিশ্বাসই করছে না? দোষ না করেও আজ সে কেনো কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে! কিসের শাস্তি পাওয়া শুরু হলো তবে! 


তিস্তার বুকে চাঁপা ব্যাথা অনুভব হয়। এই জেঠিমা'ই তো কত আদর করে মাঝে মাঝে তাকে খাইয়ে দিয়েছিলো! এই জেঠিমা'ই তো কত আদর করে গাছের কাচা আম মাখিয়ে দিয়ে ছিলো! তবে আজ তার বিরাট পরিবর্তন কেনো? 


তবে কী সেই আধাঁর ঘরের পাঁচদিন, তিস্তার পুরো জীবনটাকে আধাঁর করে দিবে! 


তিস্তার হাঁটার শক্তি যেনো লোপ পায়। বকুল,বকুলও কী তবে আর তিস্তার সাথে খেলবে না?


যেই উচ্ছ্বাস নিয়ে ছুটে এসেছিলো তিস্তা,সে উচ্ছ্বাস হঠাৎ করেই বিষন্নতায় রূপ লাভ করলো। মিইয়ে গেলো তার ফুটন্ত চঞ্চলতা। ধীর পায়ে সে বকুলদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। এখন তার লজ্জা লাগছে, ভীষণ লজ্জা৷ সে কী নোংরা মুখ সবাইকে ঢেং ঢেং করে দেখাতে বেরিয়েছে! রাস্তার সবাই তবে তার দিকে তাকিয়ে আছে কেনো? 


সবার অদ্ভুত চোখের দৃষ্টি দেখে মিইয়ে যায়, তিস্তা। চোখ মুখ খিঁচে ছুট লাগায় বাড়ির উদ্দেশ্যে। সবাই কেমন বদলে গেলো, পাঁচ দিনের বিবর্তনে! তাকে দেখে সবাই কানাকানি করে কী যেনো বলে। সে কী এতটাই নোংরা হয়ে গেলো? 


পাহাড় সমান অবিশ্বাস্য কাহিনী কুড়িয়ে বাড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে তিস্তা। এখন সত্যিই মনে হচ্ছে,তার বাহিরে বের হওয়াটাই ভুল ছিলো।


___


বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই থমকে যায় তিস্তা। এতদিন পর তাদের বাড়িতে কাকে দেখছে সে! তার আপা এসেছে! 


কত দিন পর আপা এলো। আপাকে দেখে তিস্তার মন খারাপের আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলো। পথ থেকে যে বিষাদ কুড়িয়ে এনেছিলো তা জেনো পথেই হারালো। বাহিরে মানুষ যা-ই বলুক, তার বাড়ির মানুষ তো তাকেই বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। 


এক আকাশ আনন্দ নিয়ে যখন তিস্তা তার আপার দিকে পা বাড়ায়,তখন ভেসে আসে আপার কিছু তিক্ত কথা। আপা ঘৃণিত মাখা কণ্ঠে বলছে,

-'দেখেছো তো,আম্মা,তোমার এত অবুঝ মেয়ের শেষমেশ কী হলো! ও ই হয়তো কিছু ইশারা করেছে,তাই ওরে তুলে নিয়ে গেছে। কই,আমরা যে এত বড় হোলাম,আমাদের সাথে তো কেউ কিছু করলো না। তোমার মেয়ের বেলায় সব ব্যাটাছেলে খারাপ! সেদিন আমার স্বামীর উপরও কেমন আঙ্গুল তুলছিলা। এবার দেখো কে খারাপ।'


নিজের বড় মেয়ের এমন লাগামহীন কথায় ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় তনয়া বেগম। হুংকার ছেড়ে বলে,

-'কে খারাপ তা ভালো করেই বুঝা যাচ্ছে। তুই এমন হবি জানলে, জন্মের পরই তোকে মেরে ফেলতাম। যাকে ছোটবেলা থেকে বড় করলি, মানুষ করলি,তাকে এসব বলতে লজ্জা করে না তোর? এ শিক্ষা পেলি? স্বামীর জন্য অন্ধই হয়ে গেছিস।'


আম্মার চেয়েও আপা দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বললো, 

-'আমি অন্ধ হয়েছি না তোমরা? ঐ মেয়েকে এখনো কীভাবে বাঁচিয়ে রাখছো মানুষের কথা থেকে? নোংরা মেয়ে তোমার। একদম ঠিক হয়েছে ওর সাথে।'


তিস্তা যেনো ভাষা হারিয়ে ফেললো এসব শুনে। তারই আপন বোন,তাকে এসব বলছে! এসবও শোনার ছিলো? এতক্ষণ পথের মানুষের কথায় সে মূর্ছে গিয়েছিলো, আর এখন ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। সে নোংরা মেয়ে! দুলাভাই ভালো,আর সে নোংরা! আপা কীভাবে বললো এসব? 


তবে,আজ মেয়ে বলেই কী এত ঝঞ্জাট? মেয়ে হয়ে জন্মানোটা কী ছিলো অভিশাপ! 


সপ্তাহ প্রায় মাঝের দিকে। এইতো আজ মঙ্গলবার। আর দু'দিন পর ঘরোয়া ভাবে হবে প্লাবনের বিয়ে। তারপর,তারপর প্লাবন আর তিস্তার দূরত্ব হবে ঐ মহাকাশের চেয়েও দূর পরিমাণ। কিন্তু মনের দূরত্ব! সেটা তো হবে না আদৌও। 


প্লাবন কেবল পুতুলের ন্যায় হয়ে আছে। মাঝে মাঝে কিছু করার না থাকলে,চুপ থাকতে হয়। চুপ থেকে দেখে যেতে হয় ভাগ্যের খেলা। প্লাবনও আজ সে মন্ত্রে পথ চলছে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তিস্তাকে নিজের করে পাওয়ার প্রার্থনা বুকে পুষে রেখে নাহয়, মরার আগে আরেকবার মরবে। যে মৃত্যু টা হবে বিয়ে নামক শব্দে,সম্পর্কে। 


___


বিষাদিনী'র হাতে সেই গোপন মানুষের ছবিখানা, যাকে সে লুকিয়ে রেখেছে সবার আড়ালে, হৃদয় মাঝে। 


রাজকীয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে ভাবনা বিলাস করতে ব্যস্ত সে। ছবিখানায় খুব যত্নে হাত বুলিয়ে যায়। নিরন্তর চেয়ে থাকে সুপুরুষটির দিকে। চোখের পলক পড়ে না, শ্বাসও যেনো থেমে থাকে। মানুষটাই এমন! তাকে দেখেই যেনো পাড় করা যাবে জনম জনম। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, হায়! এ জনম'ই তো মানুষটা তার না৷ ভীষণ আফসোসের সমুদ্রে ডুবিয়ে মানুষটা আজ অন্য কারো। 


বিষাদিনী অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায় ছবিটির দিকে। যেনো মনে হচ্ছে মানুষটা তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। শুকিয়ে যাওয়া পাতা পায়ে পিষে গেলে যে মড়মড় শব্দখানা হয়,ঠিক তেমন শব্দে বিষাদিনী হাতে থাকা চুড়িখানা ভেঙে ফেললো। হাতেও সামান্য আঁচ লাগলো,ক্ষত হলো সেই ভাঙার জন্য। হোক ক্ষত। এর চেয়ে কত বড় ক্ষত পুষে রেখে, যত্নে বড় করছে হৃদয় মাঝে। 


হৃদয় আঙিনার প্রেম নামক কলিটা হঠাৎ মূর্ছে গেলো। শুকিয়ে গেলো তার ডালপালা। বিষাদিনী প্রেমোফুলের এমন দশা দেখে তাচ্ছিল্য হাসে৷ নিদারুণ কষ্ট মাখা কণ্ঠে বলে,

-'আপনার জন্য তৈরী হওয়া ভালোবাসাটা কখন যে আমার আফসোসে পরিণতি হলো, তা টেরই পেলাম না। আহা,আপনাকে না পেয়ে আমার হৃদয় মাঝে সে কী আর্তনাদ! মাঝে মাঝে ভীষণ করুণা হয় এই মৃত হৃদয়টা'র জন্য। সেধে সেধে ভালোবাসতে গিয়ে, কত যন্ত্রণা'ই না পেলো শেষমেশ। 


আমার ভালোবাসা আমায় সুখের থেকে বিষাদ'ই বেশি দিয়েছি। আমার ভালোবাসা আজন্ম আফসোস হয়েই রইলো। আপনাকে ভালোবেসে কী নিষ্ঠুর ভাবেই না মেরে ফেললাম আমি,আমার প্রেম পায়রাকে। 


আমার লিখে যেতে ইচ্ছে হয়, এক মহাকাব্য। যেখানে সাবধান বাণী হিসেবে থাকবে,"ভালোবাসা বারণ।" আমি চাই না, আমার মতন কেউ পুড়ুক। ভীষণ কষ্ট হয় যে।'


একটি বিষন্ন কন্যার আকুতি ভরা কণ্ঠের বিচ্ছেদের গল্প কেউ শুনে না। কেবল ছবির ভেতর থাকা মানুষটা নিরলস তাকিয়ে রয়। তবুও শান্তি, মানুষটা রক্তে-মাংসে না হোক তবুও তো আছে!


ছোট্ট শ্বাস ফেলে বিষাদিনী বাড়ির গেটের দিকে তাকাতেই একটু অবাক হয়। তার বাবা কোথায় যেনো বের হয়ে যাচ্ছে। এ আর নতুন কী! আজ এখানে,কাল ওখানে,এমন করেই নিজের পৈচাশিক সুখ খুঁজে নিচ্ছে সে। 


নিজের ঘরখানায় আরেকজন মানুষের উপস্থিতি টের পায় বিষাদিনী। তাৎক্ষনাৎ এক মুহূর্ত ব্যয় না করেই ছবিটা লুকিয়ে ফেলে তার আঁচলে। কিছু মানুষ, কিছু ব্যাথা,কিছু বিষন্নতা গোপনে থাক। একান্তই নিজের থাকুক। 


নিজের ছোট বোনকে এ সময়ে এখানে দেখে অবাক হলো সে। কণ্ঠে অবাকের রেশ ধরে রেখেই বললো,

-'আরে বিলাসিনী যে! এখানে কেনো? কিছু প্রয়োজন বুঝি?'


আপুর প্রশ্নে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো বিলাসিনী। কয়েক পা এগিয়ে এসে বড় বোনের মাথার গুছানো চুল গুলো গুছাতে গুছাতে বললো,

-'তুমি সত্যিই চলে যাবে, আপুনি? থেকে গেলে হয় না?'


চুপ করে যায় বিষাদিনী। এই জীবনে কেবল এ মেয়েটাই তাকে থেকে যেতে বলেছে বলেই,সে থেকে গেছে। নাহয় কবেই এই পাপ মহল থেকে পালিয়ে যেতো। 


বিষাদিনী কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে,

-'থেকে গিয়ে কী হবে বিলাসিনী? আমার থেকে যাওয়াতে আদৌও কিছু আসে যায়?'


নব কিশোরী বিলাসিনী, উত্তর দেয় না। কী উত্তরই দিবে? সত্যিই আপুর থেকে যাওয়াতে কারোই কিছু আসে যায় না। তবুও ক্ষীণ স্বরে বললো,

-'আমার যে বড্ড একা একা লাগবে। তুমি ছাড়া আমার থাকতে যে ভালো লাগে না আপুনি। মনে হয় কথা গুলো জমে জমে পেট ফুলে যাচ্ছে। তোমার অভাবে কথা

গুলো প্রকাশ করতে না পেরে বোধহয় মরেই যাবো।'


-'কিছুই হবে না তোমার। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে, আমি বিহীন থাকার। একা থাকার অভ্যাস করো বিলাসিনী। এ পৃথিবীতে সব মানুষই তোমাকে কিছু মুহূর্তের জন্য আনন্দ দিবে,পাশে থাকবে। কিন্তু শেষ অব্দি জীবনের পথ পাড় করতে হয় একাই। মনে রেখো,সবাই থেকে যাওয়ার জন্য আসে না।'


বিলাসিনী ছোট হলেও খুব বুদ্ধিমতী। বিষাদিনী'র থেকে হাতে গুণে গুণে সাত-আট বছরের ছোট হবে। কিন্তু সব কিছু সে দ্রুত বুঝে যায়। 


দু বোন যখন নিরবতায় আচ্ছন্ন, তখন বিষাদিনী'র হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে। দ্রুত বোনকে জিজ্ঞেস করে,

-'তুমি যে ছেলেটাকে পছন্দ করতে তার কী খবর? জানিয়েছো সে কথা খানা? পত্র না দিবে বলেছিলে?'


-'সে-ই আমাকে পত্র দিয়েছে, আপুনি।'


বিষাদিনী অবাক হয় বোনের সাধারণ কথায়। অন্যান্য সময় হলে বোন অতি উৎকণ্ঠায়, আনন্দে লাফালাফি করতো। তবে আজ এত নিশ্চুপ কেনো?


বোনের বয়স সবে পনেরো। কিন্তু সে একজনকে ভীষণ পছন্দ করে। ছেলেও খারাপ না। তাদের এলাকারই বড় বাড়ির ছেলে। পড়াশোনা জানা। বোন যখন সে ছেলের কথা বলতো, বিষাদিনী তখন খেয়াল করতো বোনের চকচক করা চোখ খানা। 


তবে আজ সে চোখে উচ্ছ্বাস নেই। এত বড় খুশির খবরও বোনের উচ্ছ্বাস নেই কেনো? 


অবাক কণ্ঠে বিষাদিনী বললো,

-'চিঠি দিয়েছে! কবে? তুমি আমায় বললে না যে? আর তুমি নিশ্চয় ভীষণ খুশি?'


-'বলি নি, কারণ এটা বলার মতন কিছু না। ভালোবাসা বলে কিছু নেই আপুনি। ভালোবাসলে পুড়তে হবে। সবাই পুড়ার ক্ষমতা নিয়ে আসে না। তুমি নাহয় নিজেকে সামলে নিতে পারছো অপূর্ণতায়, আমি পারবো না। ছেলে জাতটাই ভরসা নেই আমার। ভালোবাসলে যদি-লুকিয়ে কাঁদতে হয়,ছোট বাক্সে যত্ন করে ছবি আগলে রাখতে হয়, সে ছবিতে নিজের সুখ খুঁজে নিতে হয়, তবে এ ভালোবাসার প্রয়োজন নেই আপুনি।'


বিষাদিনী যেনো চমকের উপর চমক খায়। তবে কী তার বিষণ্ণতা কেউ বুঝলো!


__


আর কয়েকদিন পরই শুরু হবে তিস্তাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা। কিন্তু তিস্তার কোনো হেলদোল নেই। গ্রামের লোক সাথে তার আপুর ও দাদীর পরিবর্তনে যেনো সে স্তম্ভিত। 


মধুসখী'র রাজকীয় ঘাটে বসে আছে সে। দৃষ্টি তার মধুসখী'র জলে নিবদ্ধ। কী সুন্দর জল! দেখলেই শরীর জুড়িয়ে যায়। কিন্তু তিস্তার আজ জুড়াচ্ছে না। সে বার বার ভাবছে,হাজার বার ভাবছে, কী হচ্ছে তার সাথে? কেউ-ই তো তাকে বিশ্বাস করছে না, মাস্টারমশাই! সে বিশ্বাস করবে তো? 


তিস্তার ভিতর থেকে কান্নারা ছিটকে আসছে। কিন্তু সে কাঁদবে না। সে জানে,মাস্টারমশাই তাকে কখনোই অবিশ্বাস করবে না। কিন্তু সমাজ? বাঁচতে দিবে! 


তিস্তা মধুসখী'র জল স্পর্শ করে দারুণ একটা প্রতিজ্ঞা করলো। যদি মাস্টারমশাইও মুখ ফিরিয়ে নেয় তার থেকে, তবে সে এই মধুসখীতেই প্রাণ বিসর্জন দিবে। কিন্তু মাস্টারমশাই না আসা অব্দি সে বাঁচবে,লড়াই করে টিকে থাকবে। তার যে বাঁচার অনেক সখ।


'এই এই আমাদের তিস্তা নদী না?'


গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে ফিরে তাকালো তিস্তা। সামান্য চমকে উঠে দাঁড়ালো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো, 

-'হরপ্রসাদ দাদা! কবে এলে শহর থেকে?'


হরপ্রসাদ ঘাটের দুইটা সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে এলো। সরল সোজা মানুষটা তিস্তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

-'ভালে আছিস,তিস্তা?'


তিস্তার হুট করেই কান্না এলো। গ্রামের মানুষ বা তার পরিবারের কেউ এখনো অব্দি এ প্রশ্নটা করে নি। সে ভালো আছে কি না এটার চেয়েও চাঞ্চল্যকর ঘটনা যে তাদের কাছে আছে। 


হরপ্রসাদ সামান্য বিচলিত হলো। তড়িঘড়ি করে তিস্তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-'কাঁদছিস কেনো বোকা মেয়ে?'

-'তুমি আমায় দেখে হাসাহাসি করো নি হরপ্রসাদ দাদা।  জানো,সবাই না আমার সাথে কেমন করে। কীভাবে যেনো তাকায়। আমার আপাও আমাকে অনেক খারাপ কথা বলেছে।'


হরপ্রসাদ তিস্তার মাথায় স্নেহের হাত বুলায়। অভিমানী মেয়ের সব অভিযোগ ঢেলে দেয় হরপ্রসাদের কাছে। তার এই একা মধুসখী'র ঘাটে,হরপ্রসাদ এর সাথে থাকতে ভয় করছে না বরং ভরসা মিলছে। কী অদ্ভুত তাই না! নিজের বোন জামাই ঘরের মানুষ হয়েও কেমন নরপিচাশ। আর হরপ্রসাদ কেউ নাহয়েও কত আপন। 


তিস্তার কান্নার গতি যখন একটু কমলো,হরপ্রসাদ শান্ত স্বরে তখন বললো,

-'জানিস তিস্তা, মাস্টারমশাই এর সাথে আমার দেখা হয়েছিলো শহরে কয়েকদিন আগে।'


তিস্তার ঝিমিয়ে আসা কান্নাটা পুরোপুরি থেমে গেলো। নিস্তব্ধ হলো পরিবেশ। উত্তেজিত কণ্ঠে সে বললো,

-'সত্যি! মাস্টারমশাই কেমন আছে গো? কবে ফিরবে গ্রামে? আমার যে আর ভালো লাগে না। আমার কথা জিজ্ঞেস করে নি মাস্টারমশাই? নিশ্চয় অনেক জিজ্ঞেস করেছে তাই না?'


ছোট্ট মেয়েটার উৎফুল্লতা নষ্ট করতে মন চায় না হরপ্রসাদ এর। তবুও সত্যি জানাতে হবে। তাই খুবই ক্ষীণ স্বরে বললো,

-'এই সপ্তাহের পরেই হয়তো ফিরবো। আর,তোর কথা জিজ্ঞেস করে নি উনি।'


তিস্তার রগরগে উৎফুল্লতা শান্ত হয়ে গেলো। তার কথা মাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করে নি? এটাও সম্ভব! 


নিজের অশান্ত মনকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য তিস্তা নরম কণ্ঠে হরপ্রসাদকে বললো,

-'হয়তো চাচী'র প্রতি চিন্তার জন্য বলার সুযোগ পায় নি। যাক, মাস্টারমশাই তাড়াতাড়ি ফিরবো সেটাই অনেক।'


-'মাস্টারমশাই কিন্তু একা ফিরবো না, তিস্তা।'


হরপ্রসাদ এর বাক্য টুকু বোধগম্য হলো না তিস্তার। মাস্টারমশাই একা ফিরবেন না মানে? ছোট্ট মস্তিষ্কের তখনো বোধগম্য হয় না কথাটুকু। অবুঝ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-'একা না ফিরলে কার সাথে ফিরবো? শহর থেকে কেউ সাথে আসবো তাই না?'


হরপ্রসাদ চুপ থাকে। তার কণ্ঠনালী কাঁপছে। মেয়েটা কীভাবে সহ্য করবে কথা খানা? তবুও বলা উচিত। এখন থেকেই শক্ত হোক মেয়েটা। 


নিজেকে ধাতস্থ করে হরপ্রসাদ সিঁড়ির কোণা থেকে উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার পথে পা বাড়িয়ে বললো,

-'এই শুক্রবারই মাস্টারমশাই এর বিয়া। অনেক সুন্দর শহরের মাইয়ার সাথে। দেখতেও যেনো সাক্ষাৎ লক্ষী। হয়তো একবারে বউ নিয়াই ফিরবো। তুই সামলা নিজেরে তিস্তা। ভাগ্য তোরে অনেক ঘুরাইবো। তোর মাস্টারমশাই আর তোর নাই রে।'


হরপ্রসাদ দাঁড়ালো না আর এক মুহূর্ত। খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলো জায়গা থেকে। সে হয়তো মেয়েটার ভেঙে যাওয়া টা সহ্য করতে পারবে না। তাই চলে গেছে। 


হরপ্রসাদ এর কথাটা যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাত এর মতন লাগলো। কতটা সময় লাগলো কথাটা বুঝার জন্যই। কিন্তু কথাটা যখন মস্তিষ্কের নিউরণ অব্দি পৌঁছালো তখন যেনো শরীর অসাড় হয়ে এলো। শ্বাসও কেমন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। 


মাস্টারমশাই বিয়ে করবে? আর দু'দিন পরই বিয়ে! মাস্টারমশাই আর তার না? মাস্টারমশাই বেইমানি করলো? 


না না, মাস্টারমশাই কখনোই তিস্তাকে কষ্ট দিতে পারে না। কিন্তু হরপ্রসাদ'দা ও তো মিথ্যা বলবে না। শহুরে মেয়ের সাথ পেয়ে মাস্টারমশাই গ্রামের ছুটন্ত তিস্তাকে ভুলেই গেলো? 


নতুন বউয়ের সাথে মাস্টারমশাইকে সহ্য কীভাবে করবে তিস্তা? তবে কী মধুসখী'র কোলেই বিসর্জিত হতে হবে তিস্তাকে? 


হঠাৎ তিস্তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। একটু আগে করা প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়লো। সে তো মাস্টারমশাই এর জন্য বাঁচবে ভেবেছিলো। কিন্তু মৃত্যুর পথ তো মাস্টারমশাই দেখিয়ে দিলো। তবে কী আর মাস্টারমশাই কে দেখা হবে না? 


তিস্তা এক পা একপা করে মধুসখী'র কোলে এগিয়ে গেলো। কাল হয়তো মধুসখী'র কোলে ভেসে উঠবে গ্রামের চঞ্চল মেয়েটার দেহ। কেউ হয়তো জানবে না, মেয়েটা ভালোবেসে মরেছে। কেউ জানবে না,সপ্তদশী'র সবটা জুড়েই বিচরণ করা মানুষটার কথা। একটা মেয়ে তুমুল বাঁচার সখ নিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছে, এ কথা সবার অজানাই থাকবে। 


আচ্ছা, মাস্টারমশাই তিস্তার মৃত্যুর কথা শুনে কাঁদবে তো? নাকি নতুন বউ এর সৌন্দর্যে মত্ত রবে? 


'এই চিঠিটা তুই সত্যিই মাস্টারমশাই এর বাড়ি থেকে পেয়েছিস, বকুল?'


ঘর্মাক্ত মুখ খানা আরেকবার ওড়না দিয়ে মুছে বকুল উপর নিচ মাথা নাড়ালো। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে হাঁপিয়ে উঠা কণ্ঠে বললো, 

-'হ্যাঁ রে বাবা,হ্যাঁ। মাস্টারমশাই এর পড়ার ঘরেই পেয়েছি।'


তিস্তা ছোট্ট চিরকুটটার গুটি গুটি অক্ষর গুলো আরও কয়েকবার পড়লো। চিরকুটটা'র লেখা গুলো কেমন একটা ঘেঁটে গেছে। হয়তো ভীষণ যত্নে লিখা চিরকুটখানা অযত্নে পড়ে ছিলো। ইশ,সে আগে কোনো দেখলো না? তবে লেখাগুলো ঘেঁটে গিয়েও মাস্টারমশাই এর আকুতি গুলোর ক্ষমতা একচুল পরিমাণও কমাতে পারে নি। বরং তা ভীষণ ভাবে ফুটে উঠেছে। 


তিস্তা হাতের ভাঁজে থাকা চিরকুট টা আবারও পড়লো। এ নিয়ে কয়েক মিনিটের মাঝেই গুণে গুণে সাতবার পড়া হয়ে গেছে। প্রতিবারই সে প্রশ্ন করেছে এটা মাস্টারমশাই এর বাড়িতে সত্যিই পেয়েছে কিনা। আর বকুল প্রতিবারই বিরক্ত না হয়ে উত্তর দিয়ে গেছে। 


কিন্তু এবার তিস্তা আর একই প্রশ্ন করলো না। বরং তার কৌতূহল অন্য দিকে গেলো। সে কপালে তিনটা ভাঁজ ফেলে বললো,

-'কিন্তু তুই হঠাৎ মাস্টারমশাই এর বাড়ি গেলি কেনো? আর আমি তো সেদিন গিয়েছিলাম,তখন তো দেখলাম সব ঘর আটকানো। কেবল সদর দরজায় তালা দেয় নি। অবশ্য মাস্টারমশাই'র বাড়িতে কেউ চুরি,ডাকাতি করবেও না। পড়ার ঘরও বুঝি খোলা ছিলো? ইশ, আরেকটু ভালো করে দেখলেই হতো। সেদিনই পেয়ে যেতাম মন বশ করার ওষুধ।'


কথাটা বলেই চিরকুট খানায় আবার চোখ বুলালো তিস্তা। চেঁপে ধরলো নিজের সিক্ত শরীরের বক্ষ মাঝে। হৃদয়ে এখন আর তেমন জ্বালা পোড়া করছে না। কেবল শীতল অনুভব হচ্ছে।


বকুল বান্ধবী'র এমন কান্ড-কারখানা দেখে মিটমিট করে হাসলো। বান্ধবীর ঠান্ডায় ফ্যাকাসে হওয়া মুখটায় সযত্নে হাত বুলিয়ে বললো,

-'শুনিস নি? মাস্টারমশাই'র বিয়ের খবর ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে। হরপ্রসাদ দাদা বলেছে। গ্রামের সবাই তো বেজায় খুশি। তাদের গ্রামে শহুরে বউ আসবে। আর এতদিনের অযত্নে নিশ্চয় মাস্টারমশাই এর বাড়ির উঠোনে শুকনো পাতার ভীড় জমিয়েছে। ধূলো পড়েছে দরজা-জানলায়। পিঁড়েটারও মাটি ক্ষয়েছে। নতুন করে আবার লেপে দিতে হবে ভালো মাটি দিয়ে। তাই সবার ভাবনা দেখে আমার মা-ই উৎফুল্ল হয়ে বললো আমিই সবটা পরিষ্কার করবো। আমি গেলাম পরিষ্কার করতে। তখন গিয়ে দেখি মাস্টারমশাই এর টেবিলের পাশে সমতল জায়গা টাই এ চিরকুট খানা। সব দরজা জানালা বন্ধ ছিলো বিধায় উড়ে যায় নি কোথাও।'


তিস্তা স্বস্তি পেলো। মাঝে মাঝে হিমশীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। সে কিছুটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মধুসখী'র টলমলে পানি ছুঁয়ে করা প্রতিজ্ঞা টা সে রাখতে পারে নি। ঐ যে,বাঁচার লোভ। আর সাঁতার জানা মানুষ কী কখনো নদীতে ডুবে মরতে পারে? তাও স্ব-ইচ্ছায়? তাই তিস্তাও পারে নি। তন্মধ্যেই, বকুল চিরকুট নিয়ে নদীর পাড়ে হাজির হয়। 


তিস্তা টলমলে চোখে, শীতল কণ্ঠে বললো, 

-'তুই আমার সাথে কখনো কথা বলবি আমি ভাবি নি রে। আমি তো নষ্ট মেয়ে। নষ্ট মেয়েদের সাথে কথা বললে তুইও তো নষ্ট হয়ে যাবি। তাই না, বকুল?'


বকুল ভিজে শরীরে থাকা তিস্তাকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

-'তুই তো নষ্ট না। নিজেকে এসব কেনো বলিস? তুই সব থেকে পবিত্র। একদম সদ্য ভোর কিংবা ফুটন্ত ফুলের মতন। আমার মা নিজেই জানে না তার আচরণের মানে। তাই তোর সাথে এমন আচরণ করেছে। সৃষ্টিকর্তার এমন সৃষ্টি কখনো নষ্ট হতে পারে?'


তিস্তা'র যেনো মনের ভেতর গড়া নিজের প্রতি ঘৃণার কার্তুজ ভেঙে গুড়িয়ে গেলো। কেটে গেলো দুই বান্ধবী'র নিরব কিছুটা সময়। প্রকৃতির বুকে আধাঁর করা সন্ধ্যা নামলো। তারা বাড়ির পথে রওনা হলো। তিস্তা পুরো ভেজা জামাটা এখন শুকিয়ে গেছে প্রায়। 


বকুল তিস্তাকে তার বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিলো। বাড়িতে প্রবেশ করার ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ বকুল ক্ষীণ স্বরে ডেকে উঠলো,

-'তিস্তা।'


তিস্তা ফিরে তাকালো। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-'বল?'


-'মৃত্যু কী এতই সোজা? তোর বাবার এখনো তো সংসারে উপার্জন করার ক্ষমতা নেই। কেবল,নিজের কথা ভাবলে হবে? স্বার্থপর তো তুই ছিলি না। তবে আজ কেনো? ভালোবাসার জন্য? আমি যতদূর জানি,ভালোবাসা উদার করতে শেখায়। নিঃস্বার্থ ভাবে বাঁচায়। তবে তোর ভালোবাসা উল্টো শেখালো যে? নাকি ভুল শিখলি সব?'


তিস্তা চুপ থাকে। বকুল বুজে ফেলেছে তবে! আশেপাশে তখন ঝিঁঝিঁ পোঁকার ডাক শোনা যাচ্ছে। তিস্তা অর্ধ ভেজা ওড়নাটা জড়িয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বললো,

-'কই আর স্বার্থপর হলাম? ভালোবাসার কৃতিত্বে মরে গিয়েও তো বাঁচার আশা কুড়িয়ে আনলাম। সেটা দেখলি না?'


বকুল হাসে। সে আজ একটা মৃত হৃদয়ের মেয়েকে আবার বাঁচাতে পেরেছে বলে খুশি হয়। তিস্তার মাঝে সে নিজের স্বপ্ন পূরণ করার ইচ্ছে পোষণ করে। কঠোর বাস্তবতার কাছে তো,তার স্বপ্ন হেরে গেলো। অনেক পড়াশোনা করা যে আর হলো না। এই মেয়েটা অনেক পড়ুক। ভীষণ বড় কিছু হোক। ওর কলঙ্ক যেনো মুছে নেয় সাফল্য। 


তিস্তা বিদায় নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। বকুল সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গান ধরলো। কি ভীষণ মিষ্টি সে সুর। নিরব প্রকৃতি আরও নিরব হলো। সময় করলো মধুময়। বকুল মিহি স্বরে তখনো গেয়ে যাচ্ছে,


"প্রণয়ের শিখা আবার প্রাণে দিলো আশা

তুমি আমার প্রিয় বিষাদ,নীল ভালোবাসা,,


আমি হারায়ে খুঁজেছি পথ

নিরলস নিরন্তর, 

তবুও নির্বাসিত প্রেম দিয়েছে 

মরীচিকার বালুচর।


প্রণয়ের শিখা আবার প্রাণে দিলো আশা

তুমি আমার প্রিয় বিষাদ,নীল ভালোবাসা।"

~মম

___


আগামীকাল বিয়ে,কিন্তু বিয়ে বাড়ি হিসেবে কোনো জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন নেই বিষাদিনীদের বাড়িতে। তবে একটা ভিন্ন জিনিস আছে। আজ রাতে বিষাদিনী একা ঘুমায় নি। তার সাথে আজ বিলাসিনীও আছে। 


বারান্দা থেকে একটা বিদেশী ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে।  কিছু মাস আগেই বাবা আনিয়েছিলেন। বাবা তাকে সবই দিয়েছে, কিন্তু যেটা দেওয়ার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো সেটা দেয় নি। 


আকাশে বিশাল গোল চকচকে চাঁদ উঠেছে। বারান্দা তখন জোৎস্না বিলাস করতে ব্যস্ত। বারান্দায় জোৎস্নার আলো তে স্নান করছে নীল বিষাদে আচ্ছাদিত যুবতী। 


চোখের কোণ থেকে টপটপ ধারায় অশ্রু ঝড়ে পড়ছে তার। ইশ,বিষাদ এত কষ্টের কেনো? ভালোবাসা অশ্রু ছাড়া আর কিছু দিলোই না তাকে। আহা! ভাগ্য তার বেলাতেই এত নিষ্ঠুর কেনো?


গলা ছেড়ে গান এলো তার। আরেকবার সে গেয়ে নিবে বিষাদমাখা সুরে। অপূর্ণতার তিক্ততা থেকে সে নিজেকে মুক্তি দিবে খুব শীগ্রই। এইতো,কাল হতে ভাগ্য না, সে রটবে নতুন এক উপন্যাস। যেখানে বিষাদিনীর কেবল বিষাদ না, অনুভূতির অন্যান্য বস্তু গুলোই থাকবে। 


কণ্ঠে সুর এলো। গানের প্রথম লাইন গুলো সে গাইলো না বরং বেছে বেছে রবীন্দ্র সংগীতের মাঝের লাইনের বিষাদ। বেছে নিয়ে গলা ছেড়ে গাইলো,


"তুমি সুখো যদি নাহি পাও,

যাও সুখেরও সন্ধানে যাও 

আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে,

আরও কিছু নাহি চাই গো..."


-'এত উদারতা তোমায় কী দিলো আপুই? তাকে সুখের সন্ধানে পাঠাতে গিয়ে সারাজীবন অশ্রু বিসর্জনের পথ টুকু যে বেছে নিলে। কান্না বুঝি তোমার এত প্রিয়? জানো আপুই,আজ আমার মনে হয় - কারো সুখ কারো অশ্রু হয়ে ঝড়ে। এমন বিষাদ অশ্রু না আসুক। কিছু মানুষ সুখী না হোক।'


বিষাদিনীর ধ্যান ভাঙলো। সামন্য চমকে উঠলো। বিলাসিনী কথা গুলো বলেছে? ঘুমায় নি মেয়েটা এখনো? সে তো উঠে আসার সময় দেখে এসেছিলো মেয়েটা গভীর ঘুমে। তবে! মেয়েটা অভিনয় করছিলো?


বড় বোনকে চুপ থাকতে দেখে এগিয়ে গেলো বিলাসিনী। অসহায় কণ্ঠে বললো, 

-'কে সে দূর্ভাগা? যে এত বেশি ভালোবাসা পায়ে ঠেললো?'

-'সে আমার বিষাদের আকাশ। লুকিয়ে রাখা অশ্রু। তারে আমি প্রকাশ করি কেমনে?'

-'তাহলে বিয়েটা কেনো করছো? বিষাদ হৃদয়ে পুষে,কাউকে আবার নতুন করে ভালোবাসা যায়? তবে ঠকাচ্ছো কেনো তাকে?'


-'আমি তো দিবানিশি অপ্রাপ্তির দহনে পুঁড়ি। তাই সবাইকেই তার আঁচ দিতে চাচ্ছি।'


বিলাসিনী কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না। তার বোন তো স্বার্থপর না। তবে আজ কেনো? ভালোবাসার অপ্রাপ্তি বুঝি বদলে দেয় মানুষকে?


দুই বোনের নিরবতার মাঝে বাড়ির বড় লোহার গেট টা খোলার শব্দ হলো। বাড়িতে গাড়ি প্রবেশ করলো। দু বোনই দৃষ্টি দিলো সেখানে। মিনিট খানেক পেরুতেই গাড়ি থেকে বাবা নেমে এলো। 


কোনো রকম ঢুলতে ঢুলতে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। কাল যার মেয়ে বিয়ে, আজ সে মধ্য রজনীতে নেশা করে বাড়ি ফিরছে। এমন বাবার মেয়ে, কতই বা ভালো থাকবে? গাড়ির শব্দ বন্ধ হলো। আবার সব চুপ। গাড়ির সামনের লাইট টা বন্ধ হতেই আবার প্রাকৃতিক আলোয় আলোকিত হলো রাস্তা। চাঁদনী রাত তো। নিরব চারপাশ। 


বিষাদিনীর ভিষণ দরকারী কথা মনে পড়লো। বোনকে যদি আর বলা না হয়? এখনেই বলে ফেলা উচিত। 


যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বোনের হাতটা টেনে সামনে দাঁড় করালো। চুল গুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বললো,

-'ভালো থেকো। জীবন একটাই। একটা জীবন খারাপ থেকে কাটাবে কেনো? ভালো থাকতে হবে তোমায়। নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব কারো উপর দিবে না। নিজেকে নিজে ভালো রাখবে। বাবা-মা কি করছে,না করছে তা না দেখে ভালো থাকবে। বেঁচে থাকার জন্য ভালো থাকার প্রয়োজন। বিষাদ নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। মৃত মনের মানুষ বেঁচে থেকেও লাশ।'


কথা শেষ করেই ঘরে চলে যায় বিষাদিনী। চোখে তার অশ্রুকণা ছিলো। এ রাত তাকে যন্ত্রণা দেয় কেবল। ভালোবাসা এত তিক্ত কেনো?


____


আজ তিস্তাদের বাড়ির উঠানেও চাঁদের আলো পড়েছে। চাঁদের আলোয় মাস্টারমশাই এর ঘেটে যাওয়া লেখা গুলোকে স্পষ্ট করছে। সাথে প্রশান্তি দিচ্ছে তিস্তার মনে। ভালোবাসা এত মিষ্টি কেনো?


কী অদ্ভুত তাই না? একই রাত, একই শব্দ দু'জনকে দু'রকমের অনুভূতি দিচ্ছে। এমন ভাবেই তো মানুষ বেঁচে থাকে। কেউবা সুখে,কেউবা বিষাদ নিয়ে বুকে। 

___


আজ গ্রামে বাজার বসবে। পুরো সপ্তাহের শুক্রবারই বেচাকেনা দারুণ চলে। তিস্তা সকাল বেলা উঠেই স্নান করে তৈরী হলো। 


তনয়া বেগম মেয়েকে তৈরী হতে দেখে অবাক কন্ঠে বললো,

-'কোথায় যাচ্ছো তুমি এত সকালে?'


তিস্তা ঝরঝরে ফকফকে উত্তর দিলো,

-'আজ তো হাট বসবে। দোকানটা খুললে একটু বিক্রি ভালো হবে। তাই হাঁটে যাচ্ছি।'


তনয়া বেগম কিছুক্ষণ থ বনে রইলো। পেছন থেকে লতিকা বেগমের ভীষণ ঘৃণিত কণ্ঠে বলা কথা ভেসে এলো,

-'ছেঃ মুখ পুড়িয়ে শান্তি মেলে নি? তোর মতন নোংরা মেয়ে দেখি নি। এত জ্বালা তোর? নোংরা মেয়েছেলেদের দলে নাম লেখা।'


তিস্তা থমকে যায়। এসব দাদী বলছে? হঠাৎ শরীরটা ঘিনঘিন করে উঠলো তার। মানুষ গুলো তাকে ভালো থাকতে দিবে না? 

হাঁটে অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ দ্বিগুণ মানুষ। "কন্যার সুখ" ভান্ডারের সামনে উপচে পড়া ভীড়। কারণ দোকানে বসে আছে সাদা রঙের থ্রি-পিস পড়া তিস্তা। হাতে তার মাধ্যমিকের 'সাহিত্য কণিকা' বই। বাংলা বলেই জানি যাকে। খুব মনযোগ দিয়ে পড়ছে বইটা। তার দোকানের সামনে যে অগণিত মানুষের ঢেউ, সেটা যেনো সে দেখেও দেখছে না। 


মানুষ গুলো কী আর ভালো কাজে ভীড় জমিয়েছে? তারা তো কৌতূহল মিটানোর জন্য ভীড় জমিয়েছে। এদের দেখেও কী লাভ? ক্যাশ বাক্সে কী আর লক্ষী আসবে? 


গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে তিস্তার লজ্জাহীন কাজের কথা। মানুষ তো অর্ধেকই আসছে কথা সত্যি কিনা সেটা যাচাই করে চক্ষু স্বার্থক করতে। 


আর তো ভালো লাগে না। এত ভীড় করার কোনো মানে আছে? এগুলার কী খেয়ে কাজকর্ম নেই? নাকি তিস্তাকে এর আগে কখনো দেখে নি? আজব!


তিস্তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। ভীড়ের মাঝে তখন মানুষের কানাকানি চলছে। কেউবা বাজারের পন্যের মতন তিস্তাকে ক্রয় করা যায় কিনা সেই ছক কষতে ব্যস্ত। 


হাতের বইটা শব্দ করে ক্যাশবাক্সের উপর রেখে উচ্চস্বরে বললো,

-'কী সমস্যা আপনাদের? কী চাই এখানে? কিছু লাগলে নেন, নাহয় পথ ছাড়ুন।'


এবার যেনো মানুষ গুলো কথা বলার সুযোগ পেলো। বিশ্রী হেসে কয়েকজন বললো,

-'এ দোকানে তোরেই খালি ভাল্লাগছে। তোরেই কিনতে চাই। ভরা বজারে, এ ব্যবসা করতে নামছোছ নাকি?'


তিস্তা ক্ষাণিকটা থমকে যায় কিন্তু দমে যায় না। সে তো তৈরী হয়েই এসেছে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য। বাড়িতে যেভাবে ঘরের মানুষের সাথেই লড়ে আসলো, বাহিরে পারবে না?


দাদীর কুৎসিত কথা দাদীকেই ফিরিয়ে দিয়েছে। মাও আজ এই প্রথম দাদীর সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেছে। দাদী চুপ হয়েছে। এখন চুপ হওয়ার পালা এদের। 


তিস্তা একটু আগের কথাটা একদম গায়ে মাখে নি ভাব করে বললো,

-'ওমা! মানুষ বুঝি বিক্রি করা যায়? তবে নাহয় তোমার ঘরের মা, বোন,বউ,মেয়েকেই আগে বিক্রি করো।'


ভীষণ সমাগম চুপ হয়ে যায়। কিছু মানুষ তো তাজ্জব বনে যায় তিস্তার হাবভাব দেখে। এ মেয়েটার এখনো এত তেজ?


যে লোকটা তিস্তাকে খারাপ কথা বলেছে সে-ই আবার তেড়ে এসে বললো,

-'এই, এই, তোর মতন আমার ঘরের মাইয়া,বউ বেহায়া নাকি? না,বাজারের মেয়েছেলে? নষ্ট মেয়ে মানুষ। আবার আমার বাড়ির মেয়েছেলের সাথে নিজের তুলনা দেস? তোর কাছ থেইকা কেউ কিছু কিনবো না। মাইয়া মানুষ হইয়া গঞ্জের হাঁটে বহস আবার এত কথা।'


রীতিমতো মানুষ আরও বেশি জড়ো হয়ে গেলো। তিস্তা কণ্ঠে তেজ রেখে বললো,

-'চাচা,মানুষ কথাটা তো সবার জন্যই প্রযোজ্য। ছেলে মেয়ে সবাই মানুষ। কিন্তু আমাদের সমাজ মানুষ শব্দটি কেবল ছেলেদের জন্যই ব্যবহার করে। আর মানুষ শব্দটির আগে খুব সন্তর্পণে "মেয়ে" নামক শব্দটি যোগ করে মানুষ নামক জাত থেকে আলাদা করে দেয় নারী জাতটাকে। কেবল "মেয়ে" নামক বিশেষণটি যোগ করে নারীদের চরম দুর্বল জাত হিসেবে প্রকাশ করে। 


যদি আলাদা করতেই হয় তবে,পুরুষ জাতদের মানুষ শব্দটির আগে "ছেলে" বিশেষণটি কেনো যোগ করা হয় না?


তবে,মানুষ কী শুধুই পুরুষরা? নারী কেবল এক অসহায় জাত হয়েই থাকবে? নারীরা কখনো ঝলমলে চকচকে "মানুষ" হতে পারবে না? নারীরা কেবল মেয়ে মানুষ হয়েই থাকবে? বিশেষণটির এমন সৎ ব্যবহার বুঝি আমাদের সমাজের চেয়ে ভালো কেউ করতেই পারবে না। 


আজ মেয়ে বলেই আমি সবটা সহ্য করার পরও দোষীর কাঠগড়ায়। ঘরে খাবার নেই চাচা, আজ পরিবারের মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে চেয়েছি মেয়ে হয়ে,সেটাই কী অপরাধ?


আমায় কিনবেন, চাচা? আপনার মেয়ের বয়সীই তো আমি। আমাকে এসব বলার আগে ওর কথা মাথায় এলো না? আমাদের মাঝে তো তফাত নেই। 


নাকি আপনার ঘরের মেয়েরাই কেবল মেয়ে। আর,আমরা কোনো পণ্য?'


একদম চুপ পুরো জনসমুদ্রের ঢেউ। নিরব কথার বিস্ফোরণ যে সবার গহীনে কতটা স্পর্শ করেছে তা এ বিস্ফোরণ না দেখলে বুঝা'ই যেতো। 


ভীড় ঠেলে নেপাল ঠাকুর তিস্তাদের দোকানের সামনে এলো। ভীষণ মমতাময় কণ্ঠে বললো, 

-'তিস্তা, আমারে আধা কেজি চিঁড়া দেও। সাথে এক খন্ড গুড়ও দিও।'


তিস্তার চোখে উপচে পড়া জল গুলো তিস্তা ঝড়তে দেয় নি। হাসিমুখে সে নেপাল ঠাকুরকে চিঁড়ে,গুড় দিলো। তার বিনিময়ে নেপাল ঠাকুর মূল্য পরিশোধ করলো। 


আর কেউ দাঁড়ালো না দোকানের সামনে ভীড় করে। যে যার মতন নিজের গন্তব্যে পা বাড়ালো। নেপাল ঠাকুর প্রাণ ভরে তিস্তাকে আশীর্বাদ করলো। এই তিস্তা কী কেবল তিস্তা? 


এ তিস্তার মাঝে আছে তার চঞ্চল ভ্রমরী,সব বাবা-মায়ের কন্যা। 


নেপাল ঠাকুর যেতেই তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে টুলটাতে বসে পড়লো। মনে পড়লো সকালের কথা। দাদী তাকে যখন বললো সে নোংরা মেয়ে ছেলের খাতায় যেনো নাম লেখায়,তখন তিস্তা হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় ক্ষ্যাপে গেলো। 


চোখ গুলো ঘৃণায় লাল হয়ে গেলো। একদলা থুতু উঠোনের মাঝে ফেলে বলেছিলো,

-'তোমার কথার ধরণে আমার ঘৃণা হচ্ছে দাদী। তুমিও তো মেয়ে। নিজের নাতনীকে এমন কথা বলতে বিবেকে বাঁধলো না?'


দাদীও দ্বিগুণ রেগে গেলো। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললো,

-'তোর লগে কথা কইতে আবার বিবেক কিসের? ডুইবা মরতে পারোস নাই? নিলর্জ মেয়ে।'


এমন এক কথা দু কথায় দাদীর ভাষা শৈলী খারাপ হলো। অবশেষে দিক না পেয়ে তনয়া বেগম মেয়ের হয়ে কথা বলেন। 


সকালের কথা ভাবতেই তিস্তার শরীরে আবার ঘিনঘিন ভাবটা জেগে উঠলো। কিছুক্ষণ মৌন থাকতেই মনে পড়লো আরও দরকারী একটা কথা। আজ তো মাস্টারমশাই এর বিয়ে। মানুষটা আর তার আছে তো?


___

'বিয়েটা আমি করবো না, মা।'


কিছুক্ষণ পর যে ছেলের বিয়ে, সে ছেলের মুখে এমন কথা শুনেও আশ্চর্য হয় না আশালতা। মুখে আগের ন্যায় গাম্ভীর্যতা জড়িয়ে রেখেই বললো,

-'এখানে তোমার অনুভূতির দাম আমি দিতে পারছি না।'

-'কেনো,মা? আজ আমার চেয়েও আপনার জেদ বড় হলো?'


ছেলের প্রশ্নে ক্ষাণিকটা ব্যাথিত হলো আশালতা, কিন্তু প্রকাশ করলেন না বরং ক্ষীণ স্বরে বললেন,

-'আমার জেদ না এটা। ধরতে পারো শেষ ইচ্ছে।'

-'আপনার শেষ ইচ্ছে, আপনার ছেলের জীবনটা শেষ করতে পারে। তা জানেন তো?'


-'কাউকে বাঁচাতে মাঝে মাঝে নিজে শেষ হলে ক্ষতি কী?'


মায়ের প্রশ্নে অবাক হলো প্লাবন। মা তো বেশ ছেলে ভক্ত। তবে আজ ছেলের শেষ হওয়াটাও মায়ের শরীরে লাগছে না? 


ভাগ্য কী তবে, অন্য রকম খেলা খেলবে? 


___


বিষাদিনী খুব যত্নে নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নিলো। এ বাড়িতে আজই তো তার শেষ দিন। এরপর সে চলবে সুখের ঠিকানায়। বিলাসিনী টা ভালো থাকতে পারবে তো?


অবশ্য বিলাসিনী খুব বুদ্ধিমান। সে নিজের ভালো থাকা খুঁজে নিবে। সবাই কী আর বিষাদিনীর মতন বিষাদ প্রেমী হয়?


___


গতকাল বিকেল অব্দি বাজারে ছিলো তিস্তা। বেচাকেনা খারাপ হয় নি। অনেকেই তার থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনেছে। 


সন্ধ্যের পর ক্লান্ত হয়ে বাড়ি এসে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।


এখন ভোর। চারপাশে সদ্য আলো ফুটেছে। তিস্তা তখন বেঘোর ঘুমে। 


তনয়া বেগম বাহির থেকে ছুটে এলেন। তিস্তাকে ধাক্কা দিয়ে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,

-'তিস্তা,তাড়াতাড়ি উঠো। গ্রামে যে এক নতুন ঘটনা ঘটেছে।'


হঠাৎ ধাক্কায় ধড়ফড়িয়ে উঠে তিস্তা। ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কের বোধগম্য হয় না মায়ের আচরণ। ভীত কণ্ঠে সে বললো,

-'কী হয়েছে,আম্মা?'


তনয়া বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণের অশ্রু মুছলেন। অসহায় কণ্ঠে বললেন,

-'তোমার মাস্টারমশাই যে গ্রামে আসছে। সাথে তার নতুন বউ।'


তিস্তা কিছুটা সময় নেয় কথাটা বোঝার জন্য। কথাটা মস্তিষ্ক অব্দি যেতেই বিদ্যুৎ খেলে যায় তার শরীরে। কেবল কানে আর মস্তিষ্কে একটা কথায় বাজছে, "মাস্টারমশাই গ্রামে ফিরেছে নতুন বউ নিয়ে।"


তিস্তা চুপ রয়। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,

-'তবে কী সব, 

ছিলো মিছে কলরব?'


-'জানিস তিস্তা, বকুল ফুলের মতন ঘ্রাণ আসতেছিলো ঐ শহুরে বউ এর শরীর থেকে। এত দারুণ ঘ্রাণ আমি এর আগে কখনো,কোথাও পাই নি। কী সুন্দর তারে দেখতে। এমন মেয়ে পুরো গ্রামে খুঁজে পাবি না। এ জন্য ই বুঝি মাস্টারমশাই ভুলে গেলো গ্রামের তিস্তাকে?'


নিজের বান্ধবী বকুলের কথায় তিস্তার হৃদয় কোণে রক্তক্ষরণ হলো। সেই সকালে মাস্টারমশাই এসেছে কিন্তু  তিস্তা ঘর থেকে বের হয় নি এ অব্দি। না গিয়েছে মাস্টারমশাই এর কাছে ছুটে। হাত পা সব যেনো বাঁধা পড়ছে অদৃশ্য শিকলে। 


এখন তেজস্বী দুপুর পরিবেশে। মাস্টারমশাই এর খবর নিয়ে বকুলই এসেছে তিস্তার কাছে। গ্রামে তো যেনো উৎসব লেগেছে। সবার শখের মাস্টারমশাই এর শহুরে বউ এসেছে,সেটা কী কম আনন্দের? 


তিস্তা কিয়ৎপরিমাণ সময় মৌন থেকে বিধ্বস্ত কণ্ঠে বললো, 

-'বউ বুঝি অনেক সুন্দর? তোর সাথে কথা বলেছে? গম্ভীর হবে শহরের মেয়ে,তাই না?'


-'না,না। তার আচরণ যেনো মাখনের মতন। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে। কোনো অহংকার নেই। আমার সাথেও কথা বলেছে।'


তিস্তা বকুলের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। তার বেহায়া মন যে বার বার ছুটে যেতে চাচ্ছে মাস্টারমশাই'র কাছে। কিন্তু নারীর শরীরের আত্মমর্যাদা যেতে দিচ্ছে না তিস্তার কিশোরী শরীরটাকে। নারীর যদি আত্মসম্মানই না থাকে,তবে সে পথের ধূলো হয়ে কেবল পদতলে গড়াগড়ি খাবে। 


বকুল কিছুক্ষণ বান্ধবীকে বুঝিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো। তাকেও তো আজ দেখতে আসবে ছেলের বাড়ির লোক। কারো প্রিয় মানুষ হারাচ্ছে,কারো বা স্বপ্ন। ব্যাথা তো কোনোটাতেই কম না। তবে,কাকে দেখাবে সে ব্যাথা? হারানো জিনিস কী আর ফেরানো যায়? 


____


'তিস্তা তো চরিত্র হারাইছে। গ্রামের লোক তো তার নাম কলঙ্কিনী রাখছে।'


পাশের বাড়ির চাচীর এমন কথা শুনে সামান্য থমকে গেলো প্লাবন।


আশালতা ব্যাগ থেকে জামাকাপড় গুছোচ্ছিলেন। কথাটা শুনে তিনি অবাক হলেন।অবাক নয়নে ছেলের দিকে তাকালেন।


প্লাবন কেবল ভ্রু কুঁচকালো। সেও হালকা ভাবে কথাটা শুনেছে। তবে কথাটা কতটা ঠিক? অবাক নয়নে মায়ের দিকে তাকায়।  মাও তো শুনেছে একই কথা। তবে কী বড় কোনো বিপদ হয়েছে তিস্তার? আসছে পর থেকে এ অব্দি মেয়েটাকে দেখে নি। অন্যান্য বার দু একদিনের জন্য সদরে গেলেই মেয়েটা স্টেশনে অপেক্ষা করতো,তবে আজ কেনো ঘরের দ্বার অব্দি এলো না? 


তবে কী মেয়েটা ভুলে গেছে অভ্যাস গুলো? নাকি বদলে গেছে? 


প্লাবনকে চুপ থাকতে দেখে আশালতা জানার আগ্রহ প্রকাশ করার সুযোগ পেলো। হাতের জামাকাপড় আলনা'র মাঝে রেখে বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,

-'আহা,তারপর মেয়েটার কী হলো!'


আশালতার প্রশ্নে চাচীও যেনো মজার কিছু বলার সুযোগ পেলো। তাই রসিয়ে রসিয়ে বললো,

-'পাঁচদিন ধরে ওরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। ওর সাথে আরেকটা মেয়েও উধাও হয়েছিলো গ্রাম থেইক্যা। ঐ যে গ্রামের শেষ মাথায় বাড়িটা আছে না? তাদের বাড়ির মাইয়া। ওরে পরেরদিনই পরিত্যক্ত ক্ষেতের মাঝখানে পাইছিলো মরা অবস্থায়। কিন্তু তিস্তারে পাওয়া যায় নাই। পরে পাঁচদিন পর সোহাগ গো কাছারি বাড়ির বাগানে পাওয়া গেছিলো। কী অবস্থা আছিলো তখন মাইয়াটার। এর আগে ওর বাপের সাইকেলটা খাদে পইড়া পা ভাইঙা গেছিলো। মাইয়াটা তখন দোকানে বসা শুরু করছিলো। মাইয়া মানুষ হইলো গিয়া মিষ্টি,তাগোরে ঢাইকা রাখা লাগে। ভরা বজারে খোলা মিষ্টি দেখলে বেডাগো তো নজর যাইবো'ই। লোভ লাগবোই। এক হিসাবে নিজের ইচ্ছায় নষ্ট হইছে।'


-'কেনো? মেয়ে হয়ে সংসারের হাল ধরতে চাওয়াটাই কী ভুল ছিলো, খালা? মেয়েটার বাবা অসুস্থ হওয়ার পর নিশ্চয় বাধ্য হয়েই বাজারে বসতে হয়েছিল মেয়েটাকে, তাই না? কেউ কী যেচে লোভের স্বীকার হতে চায় খালা?'


ভীষণ গম্ভীর কণ্ঠে সামান্য ভড়কে গেলো মহিলাটা। এমা, এ যে মাস্টারমশাই এর নতুন বউ। 


প্লাবন পুরো থম মেরে গেছে। তার ছোট্ট মানবীর উপর এত কিছু বয়ে গেছে? সে টেরও পায় নি? গত আড়াইটা বছর যে মেয়েটাকে আগলে রেখেছিলো,তার একমাসেই এত বিধ্বস্ত অবস্থা! মহিলার কথার ধাঁচে তো খুব ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে গ্রামের মানুষের প্রতিক্রিয়া। মেয়েটা একটুও ভালো নেই তবে! 


চাচী তখন ভড়কে যাওয়া কণ্ঠে আমতা-আমতা করে বিষাদিনী'র উদ্দেশ্যে বললো, 

-'আরে না,না নতুন বউ। তুমি আমারে ভুল বুজছো। কিন্তু তুমিই ভাইবা দেখো,মাইয়া হইয়া কী বেডা গো ভীড়ে যাওয়া উচিত ছিলো?'


বিষাদিনী তার সদ্য ধুয়ে আসা মুখটা মুছতে মুছতে বললো,

-'মানলাম, সে বাজারে বসাতেই তার সাথে এমন হয়েছে। আপনাদের ভাষায় তার বাজারে বসা কাজ টা অনুচিত ছিলো। আচ্ছা, সে যদি বাজারে না বসতো তবে তার ঘরের রেশন কী আপনারা দিতেন?'


যে উদ্যম ইচ্ছে নিয়ে কথা শুরু করেছিলো মহিলা, সে উদ্যমতা আর নেই চাচীর ভেতরে। শহরে মেয়ের সাথে কথা বলে পারবে না। আজকালকার মেয়েছেলে তর্ক করতে পারলেই যেনো জিতে যায়। এরা কী আর ভালো মন্দ বুঝে! 


প্লাবন উঠে দাঁড়ালো। নাহ্,এখন এখানে বসে থাকাটা বোকামি। এমনেতেই অনেক কিছু বোধহয় হারিয়ে ফেলেছে। এখন যতটুকু আছে তা-ই আগলে ধরতে হবে। 


প্লাবনকে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে, পিলে চমকে উঠে আশলতার। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলে, 

-'কই যাও আব্বা? কই যাও?'


ভুল সময়ে, মায়ের এমন অবুঝ প্রশ্ন শুনে অবাক হয় প্লাবন। সাথে মাথায় ভোঁতা রাগে অনুভূতি গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মা-ই তো তাকে কত নাটক করে ঐ শহরে আটকে রেখেছিলো। নাহয় এত বড় ক্ষতি আদৌও হতো! ছোট্টো মেয়েটার উপর দিয়ে এত ঝড় বইতো?


প্লাবন মায়ের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো। আশলতার ক্ষাণিকটা মনোক্ষুণ্ণ হলো। ছেলেটা তার এমন ছিলো না। যেদিন থেকে তিস্তা নামক মেয়েটার সাথে দেখা, সেদিন থেকেই ছেলেটা বদলে যায়। তাই তো মেয়েটাকে দু'চোখে সহ্য হয় না তার। 


বিষাদিনী আশালতার মনোভাব বুঝে। শীতল কণ্ঠে, স্বান্তনার স্বরে বলে,

-'ফুপিমণি, এত উত্তেজিত হচ্ছেন যে? প্লাবন দা কী ছোট্ট মানুষ? সে যা করবে বুঝেশুনেই করবে।'


আশালতার ভয় হয়। ছেলেটা যা তিস্তা ভক্ত,নষ্ট মেয়েকেই না আবার দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলে। ভয়ে মায়ের প্রাণ আতঙ্কিত হয়। আকুতি ভরা কণ্ঠে, সামনের মেয়েটার উদ্দেশ্যে বললো, 

-'তুমি আমার ছেলেটাকে একটু বেঁধে রেখো,মা।'


-'আপনার ছেলে কী বাঁধন মানবে,ফুপিমণি? আর না, আমি কারো জীবনে শিকল হয়ে থাকি। একটু ধৈর্য্য ধরুন। ভালো কিছু হবে।'


আশালতা খাটের এক কোণে বসে পড়ে। বিষাদিনী মেয়েটা এত ছন্নছাড়া কেনো? একজন নারী'ই তো পারে একজন পুরুষকে বাঁধতে। তবে,মেয়েটার এত অনীহা কেনো বাঁধনে? 


বিষাদিনী তার জন্য বরাদ্দ করা রুমটাই চলে গেলো। জানালার রঙ উঠে যাওয়া লোহার শিকে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকে। জানালার বাহিরের জায়গাটায় একটু গাছপালা বেশি। শুকনো পাতা জানালার বরাবর পুকুরটাতে ভাসছে। পুকুরের পানি গুলো ভীষণ চকচক করছে মধ্যাহ্নের সূর্যের তাপে। বিষাদিনী বেশ আকর্ষণ অনুভব করে সেই দৃশ্য দেখে। আজকাল তার বিষন্নতা বোধ হয় না। তার আজকাল ভবঘুরে হতে ইচ্ছে হয়। বাঁধন তো আর সবার জন্য না। বিষাদিনীর মনে ভাবনার উদয় হয়। মূর্ছে যাওয়া হৃদয়টা ছন্দ পাতে, "কেউ কেউ উড়ে গেলে,কেউ কেউ মুক্তি পায়।" 


পরক্ষণেই মনে হলো, বাহ্ দারুণ তো! মোটা কালির দোয়াত নিয়ে সাদা চকচকে কাগজে লিখে ফেলে ছন্দখানা। সাথে মিশিয়ে দেয় বিষাদ। বিষাদিনী হয়ে,বিষাদ লেপন করবে না, তা কী হয়? ছন্দখানা জ্বলজ্বল করছে। দারুণ হাতের লেখা দিয়ে বিষাদিনী লিখে ফেলে ব্যাথাময় কয়েকটা শব্দ,


"শিকল আমি নাহি হলাম,না-ই বা কাটলাম তার ডানা,

আমি পাখি রঙহীন বলে, রঙিন পাখির কী উড়তে মানা!"


কবিতাটার দু লাইন লিখে কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঝড়া পাতার মাঝখানে। কেউ জানবে না,সে যে মানুষকে উড়তে দিতে চায়। কেউ না জানুক, শক্ত খোলশের আড়ালে কোমলতা। জেনে গেলেই তো জ্বালিয়ে যাবে।


_


আজ আকাশে চাঁদ নেই। ভীষণ আঁধার চারপাশে। সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি তিস্তা। মাস্টারমশাই দেখা করতে এসেছিলো কিন্তু সে বের হয় নি। মাস্টারমশাই তো তার মানুষ না এখন। মাস্টারমশাই হলো পর মানুষ। পর মানুষের প্রতি মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? শূণ্য'ই যার ফলাফল। 


হঠাৎ জানালার পাশে খুব ধীরে শব্দ হলো। তিস্তা সামান্য চমকে গেলো। সে উবুড় হয়ে শুয়েছিলো এতক্ষণ। তার পায়ের দিকে দক্ষিণ বরাবর জানলা দিয়ে শব্দটা হলো। তিস্তা সামান্য ভয় পেয়ে গেলো। চমকে উঠে জানলার দিকে তাকাতেই দেখলো বাক্সবন্দি সুখ। 


একটা দারুণ রাজকীয় বয়ামে ভরা জোনাকি পোঁকা। তিস্তার কলিজাটা সামান্য ছলাৎ করে উঠে। পুরোনো সুখ নতুন করে,নতুন রূপে তার জানালায়! 


মধুসখী এখন জলে পরিপূর্ণ। একটু আগে চাঁদ ছিলো না গগণে কিন্তু এখন যেনো ভরা পূর্ণিমা। চাঁদের যেনো যৌবন উপচে পড়ছে। পরিবেশেও এখন একটা মুগ্ধতা কাজ করছে। এতদিন পর একটু দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণায় আচ্ছাদিত মানব মানবী যে আজ মুখোমুখি। এতদিন পর তৃষ্ণার সমাপ্তিতে প্রকৃতি মাঝেও যেনো আনন্দের ঢেউ। 


মধুসখী'র ঘাটে বসে আছে তিস্তা। তার সাথেই কিছুটা দূরে বসে আছে মাস্টারমশাই। দু'জনই চুপচাপ। 


কত আকুতি মিনতি করে অবশেষে তিস্তাকে এ ঘাট অব্দি এনেছে প্লাবন। আর নয় দূরত্ব। এত কাছে থেকেও সে দূরত্ব মানবে না। 


তিস্তা হাঁটুর উপর মাথা রেখে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকায় নি মাস্টারমশাই এর দিকে। সে কঠিন হতে চাচ্ছে। যতটা কঠিন হলে মাস্টারমশাই এর থেকে মুখ ফেরানো যায়, ঠিক ততটা কঠিন। 


মুখ নাহয় ফেরানো যায় কিন্তু হৃদয়? হৃদয় কী আদৌও ফেরানো সম্ভব? সম্ভব না বলেই তো এত রাতে এ মানুষটার সাথে চলে এসেছে এত দূর। হৃদয় তো চায় মানুষটার সান্নিধ্য। বোঁকা হৃদয় কী আর কাঠিন্যতা বোঝে?


নিরবতা ভাঙলো প্লাবন। ক্ষীণ স্বরে ডেকে উঠলো, 

-'তিস্তা?'


তিস্তার শরীরের ভিতর হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো। এইতো,তার ভিতর রাজ্যের প্রশান্তি। এতদিনের দহন যেনো এক নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। তিস্তা মনে মনে আওড়ালো "ভালোবাসা সুন্দর"।


তিস্তার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে প্লাবন এগিয়ে এলো। তিস্তার হাতটা বিনা সংকোচে নিজের হাতের ভাজে নিয়ে বেশ আদুরে স্বরে বললো,

-'মান করেছিস নাকি রাগ?'


তিস্তার মন আহ্লাদ পেয়ে যায় কিন্তু তিস্তা তাদের আহ্লাদের মূল্য দেয় না। নিজের বা'হাতটা টান দিয়ে ছড়িয়ে নেয় মাস্টারমশাই'র হাত থেকে। কয়েকটা অমলিন শব্দ উচ্চারণ করে বলে, 

-'আমি নষ্ট মেয়ে মানুষ। পাপ লেগে যাবে।'


কয়েকটা শব্দ গুচ্ছ ক্ষতবিক্ষত করে প্লাবনকে। সবসময় কী ছুরি লাগে আঘাত করতে? বাক্যের আঘাত যে কী ভয়ঙ্কর। ছুরিও মাথা নত করবে নির্দ্বিধায়। 


আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্লাবন করুণ স্বরে বললো,

-'চাঁদের কী কলঙ্ক লাগে! যতই লোকে তারে কলঙ্কিনী বলে? তুই তো আমার চাঁদ।'


-'আচ্ছা? তা এ আকাশে তো দুটি চাঁদ উঠে না, তবে মাস্টারমশাই এর হৃদয় মাঝে দুই চাঁদের আনাগোনা যে?'


আবার,আবার মেয়েটা তাকে ক্ষত-বিক্ষত করলো। বড্ড বড় হয়ে গেলো নাকি সে?  আজকাল কথা বলতেও ভাবে না যে? নাকি হৃদয়ের কোমলতা জমে পাথর হয়ে গেছে? 


নিজেকে ধাতস্থ করে প্লাবন। তিস্তার হাত'টা আবারও টেনে নিতে চায়। কিন্তু তিস্তা হাত'টা দ্বিগুণ শক্ত রেখে বললো,

-'যখন এই হাতটার আপনাকে প্রয়োজন ছিলো,তখন তো ছিলেন না। তবে আজ কেনো? আজ তো তার কিছুই নেই। সব হারিয়েছে সে। তবে আজ কেনো তাকে ধরতে আসছেন? শূণ্যতা ধরে লাভ নেই। এর চেয়ে নতুনে যেমন মত্ত হয়েছেন,সেখানেই তেমন থাকুন।'


প্লাবনের এবার রাগ হলো। মেয়েটা তাকে কথা'ই বলতে দিচ্ছে না। একেক টা জবাব দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিচ্ছে। 


প্লাবন এবার জোর করে আঁকড়ে ধরলো তিস্তার হাত। শক্ত কণ্ঠে বললো, 

-'চড় চিনিস? ভালো ব্যবহার করছি তাই ভালো লাগে না, তাই না? আমি কী ইচ্ছে করে হাতটা ছেড়ে ছিলাম? নিত্যান্তই বাধ্য হয়ে তোকে ছেড়ে দূরে যেতে হয়েছে। আবার তোর টানে ফিরে এসেছি তো আমি। আসি নি? শুধু তোর জন্যই তো আমার এ বেহাল দশা। তোর বিরহে প্রতি নিয়ত মরছিলাম। বুজেছিলি সেসব তুই? নিজের অভিমান, অভিযোগ আমার উপর ছেড়ে দে। কিন্তু একদম তিক্ততা দিবি না। মে'রে ফেলবো। একদম মে'রে ফেলবো। বেশি বড় হয়েছিস?'


-'ম'রেই তো গেছি। আর কী মা'রবেন? মৃত আত্মা নিয়ে তবুও তো ছিলাম আপনার অপেক্ষায়। কিন্তু আপনি, আপনি আমায় আরও দারুণ ভাবে মেরে ফেললেন। মুখ'ই যদি ফিরিয়ে নেওয়ার ছিলো,তবে অপেক্ষা করতে কেনো বলেছিলেন?'


প্লাবন কাল বিলম্ব না করে জড়িয়ে ধরলো তিস্তাকে। মধুসখী সাক্ষী হলো দারুণ মুহূর্তের। নিরব চারপাশে হঠাৎ কান্নার শব্দ ভেসে এলো। তিস্তা কাঁদছে। এতদিনের অভিযোগ, অভিমান সব উজাড় করে দিয়ে বললো,

-'কেনো শহুরে বউ নিয়ে এলেন এখানে? আমাকে মে'রে ফেলার জন্য তাই না? কেনো ছোট্ট কিশোরীর মনে এমন অনুভূতির সৃষ্টি করেছিলেন? শেষমেশ অনলে পুড়িয়ে মা'রার জন্য তাই না?'


তিস্তার মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে প্লাবন উচ্চারণ করলো ভয়ঙ্কর সুখকর বাক্য, 

-'বিয়েটা হয় নি। তুই ছাড়া এই প্লাবনের সাথে আর কাউকে মানায় বল?'


তিস্তা যেনো ভুল কিছু শুনে ফেলেছে বোধ করলো। অবাক কণ্ঠে বললো, 

-'ওরা যে বললো,শহুরে বউ এসেছে। তবে?'


প্লাবন তিস্তার কেঁদে ঢোল হওয়া চোখ মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-'ওরা না বুঝেই তো লাফিয়েছে। আর,বাকিটা আমার মায়ের জন্য বোঝাতে পারি নি। বিয়েটা হবে হবে করেও শেষ মুহূর্তে হয় নি।'


-'কেনো?'


-'বিষাদিনী, মানে যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো সে মেয়েটার জন্য। ও শেষ মুহূর্তে এসে বললো ও নাকি এখন বিয়েটা করবে না। আগে ও আমাদের গ্রামে আসবে তারপর এখানে এসে বিয়েটা করবে।'


তিস্তা প্রথম কথাটা অবাক হয়ে শুনলেও পরের কথাটাতে বিষন্নতা ভর করে। আজ হোক, কাল হোক,বিয়েটা তো হবেই। 


আবারও অভিমান বাঁধে মানবী'র মনে। শক্ত কণ্ঠে বলে, 

-'ওহ্, তবে বিয়েটা একবারের জন্য বন্ধ হয় নি? বিয়েটা তবে শেষ পর্যন্ত হবে! আজ না হোক কাল,একদিন তো আপনার ঘরে বউ হয়ে ঐ মানুষটা আসবেই। তবে আর মায়া বাড়িয়ে কী লাভ!'


-'বিয়েটা আর হবে না। একবার যেহেতু আমি তোর কাছ অব্দি এসেছি, বিয়েটা আর করছি না। তুই বিহীন আমি তো অসম্পূর্ণ।'


-'কিন্তু আমিই যে এখন পঁচে গেছি। শুনেছেন তো। বড্ড দেরিতে এলেন যে।'


প্লাবনের ধৈর্যের সীমা আর বাঁধ মানলো না। মেয়েটাকে সত্যিই শাসন করা দরকার। তৎক্ষনাৎ চড় বসিয়ে দিলো তিস্তার গালে। রুক্ষ কণ্ঠে বললো, 

-'বেশি বুজতে শিখেছিস আজকাল? জিহ্বা টা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। অহেতুক কথা বলার জন্য এইটা থাকার প্রয়োজন নেই।'


তিস্তা এবার জড়িয়ে ধরলো মাস্টারমশাইকে। ভীষণ গভীর ভাবে আগলে নিলো প্রেম পায়রাকে। এইতো, মাস্টারমশাই তার। মাস্টারমশাই তো তার গায়ে কালী লেপন করে নি। তবে গ্রামের মানুষের কথায় কী আসে যায়? 


_


বিষাদিনীও আজ চন্দ্র বিলাস করছে। জানালার লোহার মরচেপড়া শিকটা ধরে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে সাদাকালো ছবিটার দিকে। এইতো তার প্রাণের মানুষ। এইতো তার না হওয়া আপন মানুষ। 


ছবিটাতে হাত বুলিয়ে যায় বিষাদিনী। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, মুখভর্তি ঘন দাঁড়িওয়ালা সুপুরুষটির ভেতর কী যাদু আছে সে জানেনা। তবে,মানুষটির শূণ্যতা তাকে পোড়ায়। ভীষণ পোড়ায়। মানুষটি তো তার না। সৃষ্টিকর্তা যদি তার জন্য মানুষটাকে না-ই বানিয়েছিলেন তবে মানুষটার প্রতি মায়া জন্মাতে দিয়েছিলো কেনো? 


সৃষ্টিকর্তার বুঝি দারুণ লাগে কাউকে পুড়তে দেখে? 


বিষাদিনী খাতা নেয়। গোটা গোটা অক্ষরে লিখে,

"আপনি আমার ভীষন কাছে, সবটা হৃদয় জুড়ে,

ছুঁতে গেলে আপনি যেনো, আকাশ সমান দূরে।"


বরাবরের ন্যায় ছিঁড়ে ফেলে কাগজটা। ছুঁড়ে ফেলে শুকনো পাতার মাঝে। মানুষ জানবে না বিষাদিনীর আর্তনাদ। কেবল শুকনো পাতা গুলো জানবে, প্রেম বড় জ্বালাময়। 


বিষাদিনী ছবি খানা জড়িয়ে ধরে বক্ষ মাঝে। 


গভীর রাতে সবারই তো প্রিয় মানুষ সাথে আছে। শুধু তফাৎ একটায়। কারো সাথে কেবল স্মৃতি হয়ে, কারো কাছে বা রক্তমাংসের মানুষ হয়ে। 


_


তিস্তা আর প্লাবনের নিরবতার মাঝে হঠাৎ ঝোঁপ থেকে শব্দ হয়। ভয় পেয়ে যায় তিস্তা। কেউ তাদের দেখে ফেলবে না তো?


প্লাবনও ক্ষানিকটা চমকে চায়। কত গুলো পায়ের শব্দ হয়। তিস্তা ছিটকে যায় প্লাবন থেকে। এই চাঁদনী রাত কী আবার ভয়ঙ্কর অমাবস্যা আনবে তার জীবনে? 


মানুষ গুলোর পায়ের শব্দ আরও নিকটে শোনা যাচ্ছে সাথে তরতর করে ঘামছে তিস্তা। নতুন কালরাত্রি যোগ হবে কী তার জীবনে? 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম