আমাদের মহাবিশ্বে সর্বব্যাপী একটি অস্তিত্ব হলো শক্তি। আমরা যাই দেখি না কেন, তা শক্তির অস্তিত্ব, প্রবাহ আর তার রূপের পরিবর্তন হিসাবে দেখা যায়। অন্তত আমাদের সাধারণ দৃষ্টিতে শক্তি সর্বদা পজিটিভ হয়। তবে গতি (kinetic) শক্তির দুনিয়ায় শক্তি পজিটিভ বা ধ্বনাত্মক। কিন্তু স্থিতি (potential) শক্তির ক্ষেত্রে সবসময় তা হয় না।
মনে করুন একটি খুব উঁচু পাহাড়ের গভীর খাদের প্রান্তে একটি বড় পাথর অবস্থিত রয়েছে। যে কেউ যদি পাথরটিকে খাদের প্রান্ত থেকে ঠেলে দেয়, এটি ক্রমবর্ধমান গতিতে নীচে পড়ে যাবে। নীচের জমির সঙ্গে সংঘর্ষে একটি বিকট শব্দ হবে, তাপ উৎপন্ন হবে এবং সম্ভবত ভেঙে যাবে। পাহাড়ের শীর্ষে মাধ্যাকর্ষণ অনুভব করা শিলার স্থিতিশক্তি দ্রুত চলমান, ভারী শিলার গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হবে, এবং নীচের দিকে পড়বে।
এখন কল্পনা করুন যে দুইজন লোক সেই পাথরের দিকে তাকিয়ে আছেন, একজন লোক পাহাড়ের নীচে এবং অন্যজন উপরে। তাঁরা উভয়ই একই জিনিস দেখতে পান, তবে পাথরটি পড়ার ঘটনা সম্মন্ধে তাঁদের বর্ণনা হবে আলাদা।
পাহাড়ের নীচে থাকা ব্যক্তিটি তাঁর চারপাশের অঞ্চলটিকে 'শূন্য স্থিতিশক্তি' (zero potential energy) হিসাবে উপলব্ধি করেন। তিনি মাটিতে দাঁড়িয়ে আছেন। এই ব্যক্তির কাছে, তাঁর পাশের মাটিতে পড়ে থাকা একটি বস্তুতেও স্থিতিশক্তির পরিমাণ শূন্য। তবে পাহাড়ের উপরে, তাদের উপরে থাকা পাথরটিতে প্রচুর পজিটিভ স্থিতিশক্তি রয়েছে।
পাহাড়ের শীর্ষে থাকা ব্যক্তির কাছে কিন্তু ঘটনাটা আলাদা। পাহাড়ের নীচে থাকা ব্যক্তির মতোই তিনি জোর দিয়ে বলবেন যে "তাঁর স্থিতিশক্তি শূন্য"। পাথরটি পাহাড়ের নীচে পড়ার পরে, শীর্ষে থাকা ব্যক্তি বলবেন যে এটি শীর্ষে থাকাকালীন যে পরিমাণ স্থিতিশক্তি ছিল তার চেয়ে অনেক কম শক্তি রয়েছে। এইভাবে সেই ব্যক্তি এই সিদ্ধান্তে আসবেন যে শিলাটির পাহাড়ের শীর্ষে শূন্য স্থিতিশক্তি ছিল কিন্তু নীচে পড়ার পরে তার একটি ঋণাত্মক স্থিতিশক্তি হবে।
এবার তৃতীয় ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে (ধরুন আপনি) দেখতে পাচ্ছেন যে দুই পর্যবেক্ষক উভয়েই একমত যে শিলাটির শীর্ষে বেশি স্থিতিশক্তি ছিল এবং নীচে কম। পার্থক্য হল যে শীর্ষ পর্যবেক্ষক বলেছেন যে শিলাটি মাটিতে আঘাত করার সময় ঋণাত্মক স্থিতিশক্তি ছিল, যখন নীচের পর্যবেক্ষক বলেছেন যে শিলায় কখনই ঋণাত্মক শক্তি ছিল না। অর্থাৎ আপনি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারেন যে শক্তির সংখ্যাগত মান যা খুশি হতে পারে। আসলেই যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো দুটি অবস্থানের শক্তির পার্থক্য।
তাহলে কি তথাকথিত নেগেটিভ এনার্জি সম্পর্কে আর কিছুই বলার নেই? তা নয়, এর সংখ্যাগত মানের মধ্যে আরও কিছু বিষয় রয়েছে। দেখা যাক।
সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে, আমরা সাধারণত অনুমান করি যে শক্তির মান শূন্যের চেয়ে বেশি। এই অনুমান মহাকর্ষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শক্তি E=mc² সূত্রের মাধ্যমে ভরের সাথে যুক্ত। তাই নেগেটিভ শক্তির অর্থ নেগেটিভ ভরও হবে। পজিটিভ ভর একে অপরকে আকর্ষণ করে, কিন্তু নেগেটিভ ভরের ক্ষেত্রে, মহাকর্ষ একটি বিকর্ষণকারী শক্তিতে পরিণত হয়ে যাবে।
1935 সালে, আলবার্ট আইনস্টাইন এবং তাঁর ছাত্র নাথান রোজেন ব্ল্যাক হোল নিয়ে গবেষণা করার সময়ে ওয়ার্মহোল নামক একটি টানেলের তাত্ত্বিক ধারণা খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই ওয়ার্মহোলের মধ্যে দিয়ে বস্তু বা শক্তি যেতে পারে, যা অতিক্রম করতে অল্প বা শূন্য সময় নেয়। কিন্তু সমস্যা হল ওয়ার্মহোলটি নিজেই তৎক্ষণাৎ ভেঙে না গিয়ে স্থিতিশীল হওয়ার জন্য তাঁদের নেগেটিভ শক্তির প্রয়োজন ছিল।
1994 সালে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী মিগুয়েল অ্যালকুবিয়ের একটি গবেষণা পত্র লিখেছিলেন যা এক ধরণের ওয়ার্প ড্রাইভের প্রস্তাব করেছিল, যাকে এখন অ্যালকুবিয়ের ড্রাইভ বলা হয়। সেটি একটি বস্তুর সামনে এবং পিছনে স্থানকে বাঁকিয়ে দিতে পারে। আবারও সেই ধারণার জন্য নেগেটিভ শক্তির প্রয়োজন হয়েছিল।
ওয়ার্মহোল বা ওয়ার্প ড্রাইভের ক্ষেত্রে, পদার্থবিদরা "নেগেটিভ ভর" নামে একটি ভরের রূপ কল্পনা করেন যা নেগেটিভ মাধ্যাকর্ষণ এবং তার ফলে নেগেটিভ শক্তি তৈরি করবে। কিন্তু এটি একটি সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক গঠন। প্রসঙ্গত আপনি হয়তো একটি সাম্প্রতিক খবর পেয়েছেন, যেখানে বিজ্ঞানীরা ওয়ার্মহোলের একটি কোয়ান্টাম অ্যানালগ তৈরি করার কথা জানিয়েছেন। যদিও রিপোর্টগুলি সত্য, এটি একটি গণনামূলক আ্যনালগ ছিল, একটি বাস্তবিক ওয়ার্মহোল নয়। সিমুলেশনে নেগেটিভ শক্তি প্রকৃত নেগেটিভ শক্তি ছিল না।
ব্ল্যাক হোলেও তাত্ত্বিক ভাবে নেগেটিভ ভরের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়। সেই ভরের কারণে নেগেটিভ শক্তির ঘনত্ব সহ স্থান-কালের একটি অঞ্চল উৎপন্ন হতে পারে। এই নেগেটিভ শক্তি ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষীয় টান এবং মহাজাগতিক স্কেলে মহাবিশ্বের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।
ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী পল ডিরাকের (Paul Dirac) সমীকরণে নেগেটিভ শক্তির ধারণা পাওয়া যায়। সেই প্রথম পদার্থবিজ্ঞান ঋণাত্মক শক্তির অস্তিত্বের দিকে ইঙ্গিত করেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো কিভাবে শক্তি নেগেটিভ হতে পারে? এবং যদি নেগেটিভ শক্তি বিদ্যমান থাকে তবে কেন আমরা এর উপস্থিতি দেখতে বা অনুভব করি না? ডিরাক বলেছিলেন যে প্রকৃতিতে পজিটিভ (বা সাধারণ) শক্তির কোয়ান্টাম অবস্থাগুলি নেগেটিভ শক্তির কোয়ান্টাম অবস্থার দ্বারা ঠিক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকে। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে যদি একটি আদর্শ ভ্যাকুয়াম তৈরি করা যায় যেখানে পজিটিভ শক্তির সমস্ত প্রভাব দূর করা যায়, তবে ডিরাক সমুদ্রের (Dirac sea) উপস্থিতি এবং নেগেটিভ শক্তির উপস্থিতি যাচাই করা যেতে পারে।
যদিও তাঁর সমীকরণটি নেগেটিভ শক্তির অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, বিজ্ঞানীরা অনেক দিন পরীক্ষামূলকভাবে তার অস্তিত্ব যাচাই করতে পারেন নি। এই নেগেটিভ শক্তি শুধুমাত্র একটি তত্ত্ব হিসাবে থেকে গিয়েছিল যতক্ষণ না 1948 সালে ডাচ বিজ্ঞানী হেনড্রিক ক্যাসিমির (Hendrik Casimir) একটি পরীক্ষার প্রস্তাব করেছিলেন যা সেই ঋণাত্মক শক্তি দ্বারা উৎপাদিত প্রভাবগুলি প্রদর্শন করতে পারে।
একটি ভ্যাকুয়ামে অসীম সংখ্যক ভার্চুয়াল কণা জোড়া থাকতে পারে। সেই কণাগুলো ভ্যাকুয়ামের শক্তি থেকে র্যান্ডম ভাবে উদ্ভুত হয় আবার পুনরায় বিলীন হয়ে যায়। তারা একসাথে ডিরাক সমুদ্র (Dirac sea) তৈরী করে। এই কণাগুলির প্রতিটির সাথে একটি তরঙ্গ যুক্ত রয়েছে, যা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো কল্পনা করা যেতে পারে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে এই ক্যাসিমির এফেক্টে (Casimir effect) ভ্যাকুয়ামের মধ্যে দুটি সমতল ধাতব প্লেট একসাথে খুব কাছাকাছি রাখা রাখা হয়। এত কাছাকাছি যে প্লেট দুটির মধ্যে থাকা কোয়ান্টার তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে সীমিত করে। এর ফলে সেই ভ্যাকুয়ামে উৎপন্ন হওয়া ভার্চুয়াল কণা জোড়ার সংখ্যা এবং ঘনত্ব কমে যায়। যেহেতু প্লেট দুটির বাইরের দিকে কোনো বাধা থাকে না, তাই প্লেটের বাইরের শক্তিগুলি প্লেটের মধ্যে থাকা শক্তিগুলির চেয়ে বেশি হয়। এর ফলে প্লেটগুলি একে অপরের উপর টানতে দেখা যায়, যা পরবর্তীকালে 1997 সালে পরিমাপ করা সম্ভব হয়েছে। আরও সঠিকভাবে বললে, ভার্চুয়াল কণা জোড়ার কারণে সৃষ্ট ভ্যাকুয়াম শক্তি প্লেটগুলিকে একত্রে ঠেলে দিচ্ছে। প্লেট দুটির মধ্যে প্রতি একক আয়তনে তাদের বাইরের দিকের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক ভার্চুয়াল কণা থাকতে পারে। প্লেট দুটির মধ্যে ভ্যাকুয়াম শক্তি এই প্রভাবকে আটকানোর জন্য খুব কম।
বিজ্ঞানীদের মতে ক্যাসিমির প্রভাবে দুটি চার্জবিহীন ধাতব প্লেটের মধ্যে এবং চারপাশে শক্তির ঘনত্বের পার্থক্য তাদের একে অপরের দিকে আকর্ষণ করে। যেহেতু পুরো সিস্টেমটি মূলত শূন্য শক্তির অবস্থায় ছিল এবং এতে কোনও পজিটিভ শক্তি প্রবর্তিত হয়নি, তাই প্লেটগুলিকে একসাথে সরানোর কাজ করতে ব্যয় করা শক্তি অবশ্যই নেগেটিভ হতে হবে। এইভাবে বিজ্ঞানীদের মতে ক্যাসিমির প্রভাব একটি ভ্যাকুয়ামে নেগেটিভ শক্তির ঘনত্বের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে।
অর্থাৎ নেগেটিভ শক্তি হল পদার্থবিজ্ঞানের একটি ধারণা যা ভ্যাকুয়াম অবস্থায় ন্যূনতম শূন্য-বিন্দু শক্তির (zero-point energy) চেয়ে কম শক্তি সহ একটি ক্ষেত্র বা কণার উপস্থিতি বোঝায়। এটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্ষেত্র বা মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রগুলির মতো ফিল্ডের হেরফেরের মাধ্যমে ঘটতে পারে।
আরও একটি বিষয় রয়েছে। আমরা বহুবার দেখেছি কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান বারবার আমাদের সাধারণ ধারণার বিরোধীতা করে এবং এটি এই ক্ষেত্রেও সত্যি! কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে, একটি নির্দিষ্ট স্থানে একটি ভ্যাকুয়াম থেকে শক্তি ধার করা সম্ভব, ঠিক যেমন একটি ব্যাঙ্ক থেকে অর্থ ধার করা হয়। তবে এর জন্য কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ে তা শোধ করতে হবে। এই তথাকথিত "Quantum Null Energy Condition" (QNEC) আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যাকে সংযুক্ত করে শক্তির "ধার নেওয়ার" জন্য নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে। এভাবে অন্তত গাণিতিকভাবে শূন্যের চেয়ে ছোট একটি শক্তির ধারণা পাওয়া যায়। তবে তা কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট পরিসর এবং শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। যাইহোক এই বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে গাণিতিক হাইপোথিসিস।
এটি উল্লেখ করা দরকার যে নেগেটিভ শক্তির ধারণাটি এখনও একটি তাত্ত্বিক গঠন, এবং এর অস্তিত্ব পরীক্ষামূলকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি। এই ঋণাত্মক বা নেগেটিভ শক্তি আসলে বিদ্যমান কিনা তা নির্ধারণ করতে এবং এর বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
লিখাঃ সরোজ নাগ
তথ্যসূত্র – 1) Traversable wormhole dynamics on a quantum processor, Jafferis, D., Zlokapa, A., Lykken, J.D. et al. Nature 612, 51–55 (2022). https://doi.org/10.1038/s41586-022-05424-3
2) First-Principles Plasma Simulations of Black-Hole Jet Launching, Kyle Parfrey, Alexander Philippov, and Benoît Cerutti, Phys. Rev. Lett. 122, 035101 – Published 23 January 2019.
3) Local Quantum Energy Conditions in Non-Lorentz-Invariant Quantum Field Theories, Daniel Grumiller, Pulastya Parekh, and Max Riegler, Phys. Rev. Lett. 123, 121602 – Published 20 September 2019.
চিত্র পরিচিতি – কাসিমির এফেক্ট। ছবিটি উইকিপিডিয়া থেকে পাওয়া।