ধীরে ধীরে খুব নিকটে আসা পায়ের শব্দ গুলো আবার ধীরে ধীরেই যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। তিস্তা তো ভীষণ রকমের ভয়ে মূর্ছে গিয়েছিলো। তার নাহয় আগে থেকেই কালি লেপন করা চরিত্রে, কিন্তু মাস্টারমশাই? মাস্টারমশাই তো শুদ্ধ পুরুষ, সম্মানিত মানুষ। তার শরীরে কালিটা যে ভীষণ বিদঘুটে লাগতো। মানী'র অসম্মান অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়।
পায়ের শব্দ গুলো একটু দূরে চলে যেতেই প্লাবন উঠে দাঁড়ালো। তিস্তা কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলো। প্লাবনকে উঠতে দেখে, থতমত খেয়ে গেলো। উৎকণ্ঠায় মুখ থেকে উচ্চারিত শব্দ গুলো জোড়ে বের হলো। অগোছালো শব্দ গুলো আকুতি করে বললো,
-'যাবেন না কোথাও। আমার ভীষণ ভয় করছে।'
প্লাবন শীতল চোখে তাকালো। মেয়েটা এত বাতাস থাকা স্বত্বেও কেমন ঘামছে। ভয় পেয়েছে কী বেশি!
প্লাবন আদুরে হাতে স্পর্শ করলো তিস্তার মাথায়। খুব যত্নে হাত বুলিয়ে নিবিড় ভরসায় বললো,
-'আমি আছি তো। ভয় কিসের?'
"আমি আছি তো" কথাটিই যেনো তিস্তার ভয়কে গোড়া থেকে উপড়ে ফেললো। সে শান্ত হলো। বন্ধ হলো তার উৎকণ্ঠা। তার নিজের মানুষ তো আছে তার সাথে। তবে চিন্তা কিসের?
তিস্তা শান্ত হতেই প্লাবন ছুটে গেলো। শব্দ বিহীন পায়ে দৌড়ে গেলো।
তিস্তা তখনও নিরব চোখে চেয়ে রইলো জলের দিকে। চাঁদের আলোয় আজ স্নান করছে জল। মধুসখী কি সুন্দর! এত আকর্ষণীয়! এই সুন্দর মধুসখী'ই বুঝি জমিদারের প্রাণ ভোমরা প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী'কে কেঁড়ে নিয়েছিলো! মধুসখী আমাদের কিছু কাছের মানুষের প্রতিচ্ছবি যেনো। যারা ভীষণ সুন্দর আর উপর উপর ভালোবাসে আমাদের। কিন্তু অন্তরে তাদের ভীষণ হিংস্রতা।
মিনিট পাঁচ পেরুতেই ফিরে এলো প্লাবন। কিছুক্ষণ আগের আর এখনের প্লাবনের মাঝে ভীষণ তফাত। প্লাবন উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
-'তিস্তা, তাড়াতাড়ি উঠ। বাড়ি ফিরতে হবে।'
-'আপনি এমন করছেন কেনো? ওখানে কী দেখেছেন? কে ছিলো?'
তিস্তার ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে ভ্রম ভাঙে প্লাবনের। ধাতস্থ করে নিজেকে। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-'কিছু হয়নি। চল, বাড়ি যাবো। তোর আর কয়েকদিন পর পরীক্ষা না? পড়াশোনাও তো মনে হয় সিকে তুলেছিস। আজ গিয়ে ঘুমাবি। কাল থেকে সব শুরু।'
তিস্তা হেসে মাথা নাড়ালো। মনে মনে বললো, "আপনার অপূর্ণতায় বিদ্বেষ তৈরী হয়েছিল পুরো দুনিয়ায়। আপনি এবার এসে গেছেন,আমার সব ঠিক হয়ে যাবে। কারণ আপনিই তো আমার দুনিয়া।'
প্লাবন ভাবছে অন্য কিছু। অন্যমনষ্ক তার মনোভাব। গ্রামে কী আবার নতুন কিছু হবে। এত রাতে এ মানুষটা এখানে যে?
_
আজ অনেকদিন পর আমান শেখ গ্রামের হাটে বসেছে। এখন সে প্রায় সুস্থ। কেবল হাঁটার সময় ধীরে হাঁটতে হয়। তিস্তাও আজ স্নান করে তৈরী হচ্ছে। আজ থেকে আবার মধ্যাহ্নের পড়াশোনা শুরু। মাস্টারমশাই আবার পড়াবেন। পড়তে হবে তাকে। নাহয় মাস্টারনী হবে কীভাবে?
তিস্তা গটগট পায়ে তৈরী হয়ে ছুটে গেলো পাঠশালার উদ্দেশ্যে। লতিকা বেগমও নাতনির পিছে ছুটলেন। তিনি নাতনির আচরণে রিতীমতো অবাক। এমন নষ্ট চরিত্রের মেয়ে এত মুক্ত ভাবে উড়বে তা যেনো সে মানতে পারছে না। সবার সামনে যখন মেয়েটাকে ঠাটিয়ে দু'টো চড় দিতে পারবে তখনই মেয়েটা শান্তি হবে। এর আগে না।
তনয়া বেগম শাশুড়ীকে মেয়ের পিছে ছুটতে দেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। শাশুড়ীর মতিগতি আজকাল তার ভালো ঠেকছে না। কেমন যেনো করে সে। পারে না তিস্তাকে খেয়ে ফেলে।
_
'আপনার কাছে তো মেয়েছেলে পড়ানোর জন্য দিছিলাম, মাস্টারমশাই। আপনি নষ্ট মেয়েমানুষও পাঠশালায় রাখেন জানতাম না তো!'
প্লাবনের পাঠশালার এক ছাত্রীর মায়ের এমন কথায় তিস্তার ঝুঁকে থাকা মাথা আরেকটু ঝুঁকে গেলো। ডান বাম গাল ফুলে লাল হয়ে আছে, দাদীর শক্ত চড়ে। পাঠশালায় প্রবেশ করার আগেই লতিকা বেগম নাতনির চুলের মুঠি ধরেই নোংরা গালাগালি আর চড় থাপ্পড়ের বর্ষণ করে।
হৈ চৈ শুনে আশেপাশের মানুষসহ প্লাবন, বিষাদিনী সবাই বের হয়ে আসে। তনয়া কোনো মতে ছুটে এসে মেয়েকে আগলে নেয়। দাদীর নোংরা ভাষায়, আচরণে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে তিস্তার।
লতিকার আচরণে পাড়ার লোকও সাহস পেলো এবার। ছুঁড়ে মারলো তাদের নোংরা কথার অস্ত্র। প্লাবন উত্তর দেওয়ার আগে আরেক মহিলা এগিয়ে এলো। বিশ্রী গালি দিয়ে বললো,
-'এ মেয়ের মুখে কালি লাগাইয়া পুরা গেরাম ঘুরা। ওর উড়ার স্বাধ মিইটা যাইবো।'
তিস্তার কান্না আসে। ভীষণ কান্না। মহিলার কথার পরিপ্রেক্ষিতে সবাই সম্মতি দিয়ে বলে উঠলো,
-'হ,হ। এই নোংরা মাইয়ারে শাস্তি দেওয়া উচিত।'
মিনিট দুয়েক এর মাঝে কালি নিয়ে হাজির গ্রামবাসী। তিস্তার সামনে আসতে নিলেই রুখে দাঁড়ালো প্লাবন। ধিক্কার জানিয়ে বললো,
-'ছিঃ! আপনারা মানুষ? এতটুকু মেয়েটার সাথে এমন আচরণ করতে বাঁধলো না আপনাদের? আপনাদেরও তো ঘরে মেয়ে আছে।'
প্লাবনের কথায় হেলদোল হলো না কারো। বরং তাদের সবচেয়ে সম্মানিত মাস্টারমশাই'র বিবেকহীন কথার জন্য তারা মুখ চোখ বাঁকালো।
ভীড়ের মাঝে একজন মহিলা বলে উঠলো,
-'মাস্টারমশাই সরল সোজা মানুষ। উনি ভদ্রতা দেখাবেই। তুমি যাও তো, গিয়ে আচ্ছা মতন কালি লেপে দেও ঐ পতি'তার মুখে।'
চেনা কণ্ঠে এমন নোংরা কথা শুনে তিস্তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঘৃণার অনুভূতি বয়ে গেলো। কণ্ঠটা তার বড্ড চেনা। তাকে খুব যত্নে ভাত মেখে খাইয়ে দেওয়া বকুলের মায়ের কণ্ঠ এটা।
সবার সম্মতি পেয়ে যখন একটা মহিলা এগিয়ে যাচ্ছিলো তিস্তার দিকে, তখন তিস্তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ালো এক অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন নারী। ব্যাক্তিত্ব যেনো তার হিমালয় পর্বতের চেয়ে উঁচু। তার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হলো কিছু শব্দ কণিকা। এক দলা থু সমাগমের মাঝে ফেলে বললো,
-'এ থুতু টা ফেললাম আপনাদের নোংরা মন মানসিকতার উপরে। কালি যদি মাখতেই হয় তবে আপনাদের মানসিকতায় মাখুন। এর চেয়ে নোংরা যে আর কিছু হতেই পারে না। পদ্মফুল দেখেছেন? গোবরে কিন্তু পদ্ম ফুল ফুটে। তাই বলে কী পদ্মফুলের পবিত্রতা নষ্ট হয়? তিস্তাও সেই পদ্মফুল। যার পবিত্রতা কখনোই নষ্ট হবে না।'
সমাগম থমকে গেলো। এমন প্রতিবাদী কণ্ঠ তাও আবার মেয়ে মানুষের,কখনোই দেখে নি তারা। থমকে গিয়েও দমে যায় না মহিলারা। বিষাদিনীকে বুঝানোর চেষ্টা করে বললো,
-'তুমি শহুরে মেয়েমানুষ। তাই তো বিয়া না কইরা জামাইর ঘর দেখতে আইছো, থাকতাছো, খাইতাছো। তোমাগো শহরের নিয়ম কানুন আলাদা। গেরাম আর শহর কী এক হইলো? আর এ বিষয়ে তোমার কথা কেউই শুনবো না। ওরে শাস্তি না দিলে গ্রামে বালা লাগবো। অলক্ষী ঢুকবো গেরামে।'
বিষাদিনী তাচ্ছিল্য হাসলো। ডান ভ্রু টা উঁচু করে বললো,
-'ওহ্ তাই না-কি! কথা শোনানোর বেলায় তো কাউকে ছাড়ছেন না আপনারা। আপনাদের চেয়ে বড় অলক্ষী বোধহয় আসবে না গ্রামে। আর যদি,আমার কথা না শুনে ওর শরীরে কেউ একটু স্পর্শ করে, তবে পুরো গ্রামের লোককে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াবো। আমার বাবা'র ক্ষমতা ব্যবহার করে আপনাদের শাস্তি দিতে আমার এক মুহুর্তও লাগবে না। তা,আপনারা কী চান?'
এবার দমে গেলো মানুষ। শহরের মেয়ে,বাপ অনেক ক্ষমতাবান লোক। পরে সত্যিই যদি হিতে বিপরীত হয়!
এবার রাসেলের মা উচ্চস্বরে হাঁক ছেড়ে বললো,
-'রাসেল,চল। এই মাস্টারমশাই'র বাড়িতে আর পড়তে হইবো না। যতসব নোংরামি।'
রাসেল তিস্তার সহপাঠী। এবার এক এক করে সব মহিলা রাসেলের মায়ের সাথে যুক্ত হলো। সবার এক কথা। কেউ তাদের ছেলেমেয়ে এখানে পড়াবে না।
এতক্ষণে মুখ খুললো তিস্তা। মাথা নিচু করে ধীর কণ্ঠে বললো,
-'আমিই আর পড়বো না, মাস্টারমশাই। আপনি সবাইকে পড়ানো শুরু করুন।'
মাস্টারমশাই এর রুক্ষ স্বর ভেসে এলো। ধমক দিয়ে বললো,
-'তুই পড়বি না কেনো? তোর কী সমস্যা? যাদের সমস্যা তারা না পড়ুক। কারো পড়ার প্রয়োজন নেই। তবুও তুই পড়বি।'
এবার মহিলারা কানাঘুষা শুরু করলো। মাস্টারমশাই এর বুঝি আক্কেল জ্ঞানের মাথা খেয়েছে!
হঠাৎ ভীড় ঠেলে একটা মেয়ে এগিয়ে এলো। মেয়েটি আর কেউ না, কঙ্কণা। মোড়লের মেয়ে।
সবাই ভাবলো এবার জমবে মজা। কঙ্কণা যা মেয়ে, ছাড় দিবে না তিস্তাকে।
কঙ্কণা তিস্তার দিকে এগিয়ে গেলো। তিস্তার চোখের জল ক্ষাণিকটা মুছে দিয়ে বললো,
-'আমিও পড়বো মাস্টারমশাই। আমায় পড়াবেন না?'
সবাই যেনো ভুল কিছু শুনে ফেলেছে এমন মুখ ভঙ্গি করলো। কঙ্কণার মতন মেয়ে এসব বলছে!
তিস্তা নিজেও অবাকে হা হয়ে রইলো। আবারও ভীড়ের মাঝে আরেকটা কণ্ঠ ভেসে এলো। রিনরিনে কণ্ঠে সে বললো,
-'মাস্টারমশাই, আমিও পড়বো। আমায় পড়াবেন না?'
তিস্তা আবার তাকালো ভীড়ের মাঝে। অস্ফুটস্বরে বললো,"বকুল!"
বকুলের মা নিজের মেয়েকে দেখে অবাক হলেন। পরক্ষণেই জ্বলন্ত শিখার ন্যায় জ্বলে উঠলেন। মেয়ের চুলের মুঠি টেনে বললেন,
-'বড্ড পড়ার শখ হয়েছে না তোর? চল আজ বাড়ি। কিসের এত পড়াশোনা? তোর না বিয়ে ঠিক করেছি? মান সম্মান খেতে চাস আমাদের? চল, বাড়ি।'
বকুল দাঁত কিড়মিড় করে মায়ের হাতটা এক ঝটকায় চুল থেকে ছাড়িয়ে নিলো। রক্তবর্ণ দৃষ্টি মায়ের উপর ফেলে বললো,
-'আমি পড়বোই। আমি অনেক বড় হবো। ঐ শহুরে দিদিটার মতন বড় হবো আমি। তোমাদের বাঁধা নিষেধ আর মানছি না। আমি শুধু মেয়ে মানুষ না মানুষের মতনও বাঁচতে চাই।'
বকুলের মা থমকে গেলেন। কাল অব্দি যে মেয়ে কথার উপর কথা বলে নি, আজ সে মেয়ে তেজ দেখাচ্ছে!এইতো, এভাবেই শুরু হলো যুগবদল। আর মানুষ এবার খবর ছড়ালো,'শহুরে মেয়ে মাথা খেয়েছে গ্রামের মেয়েদের। পড়াশোনা জানা মেয়ে সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর।'
"যুগবদলের পালা এলো,মানুষ হতে চায়,মেয়ে,,,
এভাবেই মানুষ হওয়ার মন্ত্র, সমাজে গেলো ছেয়ে।"
"তুমি ভীষণ সুন্দর। শহরে যারা থাকে, তারা বুঝি এমন পরীর মতন হয়?'
বকুলের প্রশ্নে হেসে দেয় বিষাদিনী। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। অবশেষে অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে,
-'তোমরাও তো ভীষণ সুন্দর। তোমরা তো শহরে থাকো না, তবে এত সুন্দর কেনো?'
বকুল লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
-'সত্যি আমরা সুন্দর!'
-'হ্যাঁ, অনেক সুন্দর। তোমাদের সৌন্দর্যের কাছে আমি কেবলই তুচ্ছ।'
বকুল এহেন প্রশংসায় লজ্জায় নুইয়ে গেলো। কঙ্কণা মিটিমিটি হেসে ঠাট্টার স্বরে বলে,
-'আরে বকুল,এত লজ্জা পাচ্ছিস যে? বিষাদিনী কন্যা তোর সাথে মজা করছে।'
বকুলের লজ্জা মিশ্রিত মুখে ভর করলো অবাক। কঙ্কণা'র কথা সে রীতিমতো বিশ্বাস করে অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললো,
-'তুমি আমার ছোট্ট হৃদয় টা খন্ড খন্ড করতে পারলা শহুরে দিদি! এটুকু মেয়ের এটুকু হৃদয়টা'র সাথে এমন মজা?'
বকুলের কথার ধরণে আবার হেসে দেয় বিষাদিনী। তার তো হুটহাট হাসা'র স্বভাব না। তবে আজ এই সপ্তদশীদের সাথে মিশে এত চঞ্চলতা ভর করলো যে? কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া উচ্ছ্বাস আবার ফিরে আসছে যে?
তাদের হাসি ঠাট্টার মাঝে একজন থম মেরে বসে আছে। যার আপাতত এই হাসিখুশি মুহূর্তে মনযোগ নেই। তার কেবল কিছুক্ষণ আগের ঘটনা নিয়ে ভীষণ ঝড় হচ্ছে হৃদয়ে। হুটহাট অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে চোখ থেকে। অশ্রুকণাদের আর্তনাদ নেই বলে তা গোপনে রয়।
বিষাদিনী'র হাসি'রা হঠাৎ থেমে যায়। ধ্যান ভাঙে। সুতো ছিঁড়ে ভাবনার। তার সামনে মেয়েটা এমন চুপচাপ বসে আছে,আর সে কিনা হেসে যাচ্ছে!
বিষাদিনী উঠে এলো। তিস্তার সাথে থাকা জায়গা টুকু দখল করে বসলো। প্রায় ফিসফিস কণ্ঠে বললো,
-'কী প্লাবন দা'র উচ্ছ্বসিত প্রেয়সী,মন খারাপ কেনো?'
তিস্তারও এবার ধ্যান ভাঙলো। বাঁধ ভাঙলো কান্নার। বিষাদিনী'কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-'আপন মানুষ কেনো বদলে যায় বুবু? আজ দাদী'র জন্য সবাই আমার মুখে চুন কালি ছিটানোর সাহস পেলো। কিন্তু আগে এই দাদী'র সামনে আমায় কেউ কিছু বললে তার রক্ষে থাকতো না। মানুষ গুলো বদলে না গেলে খুব বড় ক্ষতি হতো বুঝি?'
বিষাদিনী থমকায়। আসলেই,মেয়েটার দাদী আজ যা করলো তা সত্যিই আঁচড় কাটার মতন। এটুকু মেয়েটাকে কত কিছুই না সহ্য করতে হলো! অবশেষে গ্রামের মানুষ সিদ্ধান্ত নিলো,মাস্টারমশাই'র কাছে কোনো ছেলেমেয়ে পড়বে না। কিন্তু কঙ্কণা আর বকুল সে সিদ্ধান্তের বিপরীতে গেলো। ওদের সমবয়সী আরও কয়েকটা মেয়েও তিস্তার পক্ষে ছিলো। কিন্তু অভিভাবকদের নির্দয়তা'র কারণে টিকতে পারে নি। বকুল'ই তো কত মার খেলো। তবুও সিদ্ধান্তে ঠাঁই অটল রইলো। অবশেষে ওর মা সারাজীবনের মতন মেয়ের মুখ দেখবেন না পণ করে বাড়ি ফিরে গেলো।
বিষাদিনী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। নাহ্, এখন তার দুঃখ বিলাস করার সময় না। এই ছোট্ট মেয়েটা'কে বুঝাতে হবে। হতাশার শ্বাস ফেলে নতুন উদ্যমে বিষাদিনী বললো,
-'এর জন্য কান্না করা লাগে? যে তোমার চোখের জলের কারণ, সে কখনোই তোমার আপন না। আপন মানুষ কখনো ব্যাথা দিতে পারে? বলো?'
তিস্তা ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-'নাহ্।'
-'তবে! এত কান্না কিসের? কথায় কথায় কান্না করলে মানুষ নরম ভেবে খামচে যাবে। কেনো মানুষকে সে সুযোগ দিবে?'
এবার তিস্তার কান্না থামলো। হ্যাঁ, সত্যিই তো। মানুষকে কেনো কাঁদানোর সুযোগ করে দিবে সে? নাহ্, আর না। সে আর কাঁদবে না।
চোখের জল তৎক্ষনাৎ মুছে ফেললো তিস্তা। ফোলা ফোলা চোখ গুলো নিয়ে বিষাদিনী'র দিকে তাকিয়ে করুণ হেসে বললো,
-'তুমি এত ভালো কেনো? আমি আরও ভেবেছি তুমি অনেক গম্ভীর হবে। এত ভালো হবে যে ভাবি নি।'
বিষাদিনী হাসে। আগের চেয়ে কণ্ঠ আরেকটু খাঁদে নামিয়ে বলে,
-'কেনো? আগে খারাপ ভেবেছিলে বুঝি? তোমার মাস্টারমশাই'কে বিয়ে করবো বলে খারাপ হয়ে গিয়েছিলাম নাকি?'
তিস্তা চোখ বড় বড় করে তাকায়। এই নারী কী সর্বজান্তা? মনের কথা জানলো কীভাবে?
তিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে মিটিমিটি হাসলো বিষাদিনী। তিস্তার বাহুতে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বললো,
-'কী ভাবছো? কীভাবে জানলাম তাই তো? তুমি তীব্র ভাবে ভালোবাসতে জানলেও ভালোবাসা'র সবটুকু বিশ্লেষণ জানো না। কোনো রমনী তার প্রিয় মানুষটার পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারে না। তা সে রমনী প্রাপ্তবয়স্ক হোক বা তোমার মতন সপ্তদশী হোক। নিজের ভালোবাসার ভাগ কেউ দিবে না।'
তিস্তা মুগ্ধ হয়ে শুনে বিষাদিনী'র কথা। মানুষটার মাঝে এত তৃপ্ততা!
পরক্ষণেই তিস্তা মুগ্ধ কণ্ঠে বললো,
-'তুমি না অনেক ভালো।'
-'মাস্টারমশাই'কে যদি আমি নিয়ে যাই,বিয়ে করি, তখনও এমন বলবে তো?'
বিষাদিনী'র কথায় ভড়কে যায় তিস্তা। ভয় জাগে হৃদয় কোণে।
কঙ্কণা আর বকুলও এবার এগিয়ে এলো। বকুল'কে দেখে তিস্তা'র এক ভাবনা কেটে আরেক ভাবনার উদয় হলো। সাথে সাথে সে প্রশ্ন করলো,
-'বকুল,তুই এখন কোথায় থাকবি? জেঠিমা যে তোকে বাড়ি যেতে না করলো?'
-'কেনো,আমার সাথে থাকবে। ওর মায়ের কাছে এখন যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ওর যে সদ্য প্রতিবাদী মনোভাব টা জন্মেছে তা ভোঁতা হয়ে যাবে তাহলে। ও নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে অবশ্যই। মেয়ে বলেই কী পিছিয়ে যাবে নাকি?'
বিষাদিনী'র কথায় সবাই অবাকে হা হয়ে গেলো। বকুল বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-'সত্যিই তোমায় সাথে আমাকে রাখবে!'
বিষাদিনী মুচকি হেসে বকুলের গাল টেনে বললো,
-'একদম সত্যি। তোমার থাকতে সমস্যা হবে না তো?'
বকুল জলে টইটুম্বুর হওয়া চোখ নিয়ে ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বললো,
-'একদম সমস্যা হবে না। তুমি যে আমার মাথার ছাদ হয়ে দাঁড়িয়েছো সেটাই অনেক।'
বিষাদিনী হেসে এবার কঙ্কণা'র দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে বললো,
-'কী কঙ্কণা? তুমি কোথায় থাকবে? তোমার মা বাড়িতে প্রবেশ করতে দিবে তো? না-হয় আমার সাথে থাকতে পারো।'
-'আমার তো নিজের মা নেই। তবে,বাড়িতে বাবা'র দ্বিতীয় পক্ষের বউ আছে। তার অবশ্য আমার সম্পর্কে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। মোড়লের মেয়ে বলে সবাই ভাবে কী রাজকীয় ভাবে আমি থাকি। কিন্তু যার মা নেই, তার তো দুনিয়া অন্ধকার। এটা কী সাধারণ মানুষ বুঝে?'
বিষাদিনী'র বুকের বা'পাশে ক্ষাণিক মোচড় দিলো৷ মেয়েটা'র মা নেই?
হঠাৎ করে বিষাদিনী'র রাজ্যের মায়া জন্মালো কঙ্কণা'র জন্য। মেয়েটাকে জাপ্টে ধরলো বক্ষ মাঝে। মেয়েটার কী দারুণ কষ্ট! বকুল আর তিস্তাও জড়িয়ে ধরলো ওদের। মানুষের উপর দেখে ভিতর বিচার করা সত্যিই সম্ভব না।
____
রাত নেমেছে ধরণীর বুকে। বকুল আর কঙ্কণা রয়ে গেছে বিষাদিনী'র সাথে। কঙ্কণা'র বাবা অবশ্য সন্ধ্যার দিকে লোক পাঠিয়ে ছিলো কিন্তু কঙ্কণা যায় নি। রয়ে গেছে বিষাদিনী'র সাথে। মোড়ল সাহেব অবশ্য কোনো হেলদোল দেখান নি। মেয়ে যেভাবে চলতে চায় সেভাবেই চলে। এতে বিশেষ বাঁধা তিনি দেন না। দিয়েই বা লাভ কী? সংসারে দারুণ ঝামেলা ছাড়া বিশেষ কিছুই হবে না।
তিস্তাকে প্লাবন দিয়ে এসেছিলো। মেয়েটাও হয়তো থাকতো যদি কলঙ্কিনী না হতো।
আজকে আকাশে বড় রূপোর থালার মতন একটা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় বিষাদিনী কলমে ফুটিয়ে তুলেছে বিষাদ। আবারও দু'লাইনের কবিতা জ্বলজ্বল করছে সাদা কাগজটাতে। কী বেদনা সেথায়। সাথে দু ফোঁটা চোখের জল। বিষাদিনী লাইন গুলো আবার পড়লো,
"মানুষ দেখলো বিশাল হাসি,দুঃখ তো অন্তরে চাপা,,
ভীষণ অশ্রু না ঝড়লে,কষ্ট নাকি যায় না মাপা!"
যথারীতি পৃষ্ঠা টা ছিঁড়ে গুটিয়ে ফেললো হাতের ভাজে। ছুঁড়ে ফেললো জানালার বাহিরে। বিষাদ কমানোর নতুন উপায় যেনো এটা।
'এভাবে বুঝি দুঃখ কমানো যায়?'
হঠাৎ চমকে উঠলো বিষাদিনী। অবাক কণ্ঠে বললো,
-'কঙ্কণা! ঘুমাও নি?'
কঙ্কণা এবার বিষাদিনী'র পাশে এসে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে বললো,
-'ঘুম যে আসে না। তুমি যে আমার ঘুম কেড়েছো।'
বিষাদিনী অবাক হয়। অবাক কণ্ঠে বলে,
-'আমি ঘুম কেড়েছি! কীভাবে?'
কঙ্কণা হঠাৎ যেনো ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। শক্ত কণ্ঠে বললো,
-'আমার মাস্টারমশাই'কে কেড়ে নিতে চেয়ে।'
বিষাদিনী অবাক হয়। কঙ্কণার হঠাৎ এহেন পরিবর্তন কেনো? হঠাৎ করে গভীর রাতে এত হিংস্রতা কেনো?
"বাবা,হাঁট থেকে আমার জন্য আজ আলতা আনবে? আমার অনেকদিনের শখ আলতা দিবো।"
এতদিনের মিইয়ে যাওয়া তিস্তা'র রঙিন আবদার শুনে ক্ষাণিক চমকে উঠে আমান শেখ। এতদিন পর মেয়েটা আবদার করলো? কাঠফাটা রোদ্দুর মাথার উপর থাকা স্বত্তেও বাবার হৃদয়ে শীতল স্রোত বইলো। সন্তানের অনাকাঙ্খিত নির্জীবতা কোনো বাবা-মা'ই যে সহ্য করতে পারে না।
বাবা'কে চুপ থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেলো তিস্তা। ভুল আবদার করে ফেললো না তো সে? হয়তো ভুল আবদারই। নষ্ট মেয়ের রঙিন আবদার করা মানায়? বিষাদিনী বুবু যতই তাকে পবিত্র বলুক,সবার চোখে তো সে নষ্ট। আচ্ছা, মানুষ কখনো নষ্ট হয়? আর যে পুরুষ নষ্ট করে একজন মেয়ে'কে,সে কখনো নষ্ট হয় না? আমাদের সমাজ টা এত নড়বড়ে কেনো? সব নিয়ম কেমন উলোট পালোট।
তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে। এক বুক হতাশা নিয়ে সে বলে,
"আমার আলতা লাগবে না,বাবা।"
আমান শেখ মেয়ের দ্বিতীয় কথায় বিচলিত হয়। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
''কেনো, আম্মা? তুমি পড়বা না আলতা? আমি বাজারে গিয়েই কারো হাত দিয়ে পাঠাবো। সুন্দর করে পা সাজিয়ো। আমি রাতে এসে দেখবো। রেশমি চুড়ি আছে তোমার? আচ্ছা, এক মুঠো লাল রেশমি চুড়ি পাঠাবো কেমন?''
সপ্তদশী'র হৃদয় খানা ছলাৎ করে উঠে। বাবা'র কাছে ভুল আবদার করে নি ভেবে আনন্দে টইটুম্বুর হয় হৃদয়ের আঙিনা। জড়িয়ে ধরে বাবা'কে। বাবার বক্ষ মাঝে মুখ লুকিয়ে বলে,
"না। আমার রেশমি চুড়িও নেই। তুমি পাঠিয়ে দিও বাবা।''
আমান শেখ মুচকি হেসে মেয়ে'র মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তন্মধ্যেই তনয়া বেগম রান্নাঘর থেকে এক বাটি পায়েস হাতে নিয়ে উঠোনে আসে। রান্নাঘর থেকে সে অবশ্য সবটুকু ব্যাপার খেয়াল করেছে। মেয়েটাকে আবার আবদারের ঝুলি হতে দেখে শান্তি পায় সে।
মিছে মিছে অভিমান দেখিয়ে বলে,
''হয়েছে বাবা মেয়ের ভালোবাসা? আমি তো কেউ না। পরের মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। আমাকে আর ভালোবেসে কি হবে।''
মায়ের এহেন অভিনয়ে ফিক করে হেসে দেয় বাবা মেয়ে। আমান শেখ ঠাট্টার স্বরে বলেন,
''আসলেই তো। তোমায় ভালোবেসে আর কী হবে? বুড়ি মহিলা।''
তিস্তা এবার শব্দ করে হেসে দেয়। তনয়া বেগম গাল ফুলিয়ে বলেন,
''হ্যাঁ, হ্যাঁ। এখন তো বুড়ি'ই হবো। গ্রামে কত সুন্দর মানুষ দেখেন। আমারে তো বুড়ি'ই লাগবো।''
মায়ের অভিমানী বুলি শুনে খিলখিল করে হাসে তিস্তা। বাবা আবার সে অভিমান ভাঙাতে বলে,
''কে বললো,তুমি বুড়ি? কার বুকে এত বড় কলিজা? কে এই চরম সত্যি কথাটা বললো? তার আজ গ'র্দা'ন নেবো।''
বাবা-মায়ের টক মিষ্টি ঝগড়া দেখে ছোট্ট হৃদয়টাতে শীতল অনুভূতি হয় তিস্তার। চোখ জুড়িয়ে যায়। আপনমনে বিড়বিড় করে বলে,"ভালোবাসা সুন্দর।"
তিস্তার ধ্যান ভাঙে মুখের সামনে পায়েস দেখে। অবাক দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকিয়ে বলে,
"পায়েস! আজ?"
"হ্যাঁ, পায়েস। এত বছর তো জন্মদিনের সকাল পায়েস খেয়েই পালন করলে। আজ ব্যাতিক্রম হবে কেনো? যতদিন আমি আছি ততদিন এ নিয়ম চলবেই।"
মেয়ের মুখে পায়েস দিতে দিতে তনয়া বেগম বললেন।
তিস্তা'র চোখে অশ্রুকণা ভীড় করলো। মা-বাবা'র নিবিড় ভালোবাসায় কেঁপে উঠলো হৃদয় কোণ। অতি আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বেরিয়ে এলো চোখের জল। মুখে খাবার থাকায় নাকে মুখে হেঁচকি উঠলো তার।
মেয়ের হেঁচকি দেখে ব্যস্ত হলো বাবা। তাড়াতাড়ি কল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। মেয়ের মুখের সামনের জলের গ্লাস ধরে বার কয়েক ফুঁ দিয়ে দিলেন মেয়ের মাথায়।
বাবা'র যত্নে হেঁচকি থামলো কন্যার। তনয়া চোখ রাঙিয়ে বললেন,
"খাবার মুখে কাকে চোখের জল ফেলতে দেখছো তুমি? খাবার অভিশাপ দেয় জানো না? আজ জন্মদিন বলে বেঁচে গেছো। দিন দিন বড় হচ্ছো না ব'ল'দ হচ্ছো?'
"বাহ্,তোমার তো অনেক সাহস হয়েছে দেখছি! আমার সামনে আমার মেয়েকে বকছো? আজ'ই বিতারিত করা হবে তোমাকে এ বাড়ি থেকে। কী বলো, আম্মা?'
আমান শেখের মিছে ধমকে হেসে ফেলে তিস্তা। বাবা'কে জড়িয়ে ধরে বলে,
"আমায় তোমরা এত ভালো ক্যান বাসো, বাবা?'
"ভালোবাসার কোনো কারণ থাকে না, তিস্তা। শুধু এটা মনে রেখো,তোমার বাবা কিংবা আমার প্রাণ ভোমরা তুমি।"
মায়ের কথায় আনন্দে মাথা নাড়ে সে। বাবার স্নেহতলে আর মায়ের আদরের জীবন সব সন্তান বুঝে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাওনা হলো বাবা-মা। তাদের একেক টা চাওয়া যেনো সন্তানের সবচেয়ে বড় সুখের জন্য। কিন্তু আফসোস! বেশিরভাগ সন্তান বুঝে না বাবা-মায়ের স্বার্থকতা।
_
শরীরে জড়ানো গাঢ়ো জলপাই আর লাল রাঙা মিশ্রিত শাড়ি। পায়ে টকটকে আলতা লেপিত,হাতেও আলতা দ্বারা আবৃত দারুণ নকশা, চোখে মোটা কাজল,হাতে দুমুঠো রেশমি চুড়ি পড়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে তিস্তা।
বাবা বাজার থেকে আলতা আর এক ডজন রেশমি চুড়ি পাঠানোর পরেই জাঁকজমক ভাবে সেজেগুজে তৈরী হয়েছে তিস্তা। বাবা অবশ্য যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলো বাজার থেকে এসে মেয়ের লাল টুকটুকে সাজ দেখবো, মেয়ে যেন যত্নের সাজখানা মুছে না ফেলে।
প্রতি জন্মদিনে'ই বেশ সাজগোজ করে সে। এবার যে তেমন সাজগোজ করতে পারবে ভাবতে পারে নি সে। কিন্তু বাবা-মায়ের তীব্র ভালোবাসায় আবার আশ্বাস পেয়েছে রমনী। এখন কী আর সে সপ্তদশী আছে? এখন সে হলো গিয়ে অষ্টাদশী'র রঙিন রমনী। তার কী রঙহীনতা মানায়? মানায় না তো।
_
মাস্টারমশাইদে'র উঠোন মাঝে যেনো রঙের মেলা বসেছে। তিনজন কিশোরী আর একজন তেজস্বী নারী'র রঙিন সমাহার। তারা যেন কী বলছে আর হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
প্লাবন সবে বাজার থেকে এসেছে। কিন্তু উঠোনের দৃশ্য দেখে তার চোখ আটকে গিয়েছে। কঙ্কণা,বকুল আর মাস্টারমশাই এর মানবী'র এ কী নতুন সাজ! এ কী রূপ?
মাস্টারমশাই অবাক কণ্ঠে বলে,
"সবাই এভাবে সেজেগুজে বসে আসিছ যে? আজ কোনো উৎসব আছে?"
রমনীদের আলোচনায় ভাঁটা পড়ে। গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে সামান্য কেঁপে উঠে বিষাদিনী। যার ফলে কঙ্কণা'র পা'য়ে ভীষণ যত্নে আঁকতে থাকা আলতার সরু দাঁগটা বেঁকে যায়।
বিষাদিনী সামান্য বিরক্ত হয়। ভ্রু যুগল কুঁচকে সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
"কেনো? উৎসব না থাকলে বুঝি সাজা যায় না? মেয়েরা বারো মাসই সাজতে পারে। এর জন্য উৎসবের প্রয়োজন হয় না।"
বিষাদিনী'র কাঠ কাঠ উত্তরে বিরক্ত হয় প্লাবন। বকুল আর কঙ্কণা চুপ হয়ে যায়। মাস্টারমশাই'কে তারা যথেষ্ট সম্মান করে। আর মাস্টারমশাই এর সামনে এমন সাজগোজ নিয়ে থাকতেও অস্বস্তি অনুভব হয় তাদের। তাই তারা মিনমিন কণ্ঠে বিষাদিনী'র উদ্দেশ্যে বলে,
"আজকে বলো না মাস্টারমশাই'কে,আমাদের যেন ছুটি দেয়। আমরা আজ পড়বো না। পুরো গ্রাম ঘুরবো।"
"হ্যাঁ, তোমরা আজ ঘুরবো। এটা আবার প্লাবন দা'কে বলার কী আছে? আজ তিস্তার জন্মদিন উপলক্ষে সবার ছুটি।"
বিষাদিনী'র কথায় প্লাবন ভ্রু কুঁচকে বলে,
"দু'দিন পর না তোদের পরীক্ষা? আর আজ না পড়ে তোরা ঘুরবি? আর,ওর জন্মদিন হয়েছে তো কী হয়েছে? এ জন্য পড়াশনা কেনো শিকেয় তুলবি?"
মাস্টারমশাই'র শক্ত জবাবে বোঝা গেলো আজ ছুটি মিলবে না। তিস্তা সামান্য মন খারাপ করলো। মুখখানা ছোট করে বললো,
"তবে কী আজ,ছুটি নেই?"
প্লাবন "না" বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। তার মানবী'কে সে সরাসরি কীভাবে না বলবে? মেয়েটার মন খারাপ হবে না? ছোট্ট মনটা'কে কষ্ট দেওয়া কী প্রেমিক পুরুষের সাজে? যতই হোক, সে সবার আগে আদর্শ প্রেমিক। আর আদর্শ প্রেমিক কখনো প্রেয়সীর মনোক্ষুণ্ণ করতে পারে না।
অবশেষে প্লাবনের মুখো ভঙ্গি বদলালো,সাথে জবাবও বদলালো। ছোট কণ্ঠে বললো,
"আচ্ছা, যা আজ তোদের ছুটি।"
মাস্টারমশাই'র একটা কথায় উচ্ছ্বাসে ভরে উঠলো পরিবেশ। কঙ্কণা,বকুল দৌড়ে মাস্টারমশাই'কে পাশ কাটিয়ে বাহিরে চলে গেলো। উদ্দেশ্য তাদের মধুসখী'র ঘাট। বিষাদিনী আপু আজ তাদের এত সুন্দর সাজিয়ে দিয়েছি নিজের শাড়ি,অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে। তা গ্রামবাসী'কে না দেখালে হবে? আর দেখাতে হবে না তাদের বাড়ির মানুষকে,একটা বাহিরের মেয়ে আপন না হয়েও কেমন খেয়াল রাখছে তাদের। কেমন পাঁচদিনের মাঝে সপ্তদশীদের দুনিয়া পাল্টে ধূসর থেকে রঙিন করেছে।
বকুল'রা বেরুতেই তিস্তা উঠে দাঁড়ালো। বিষাদিনী আলতা রাখার জন্য নিজের ঘরে প্রবেশ করলো। তিস্তা মাস্টারমশাই'র পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তার পথ আগলে দাঁড়ালো মাস্টারমশাই। পাঞ্জাবী'র পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজের প্যাকেট বের করে তিস্তা'র হাতে দিলো। অবাক হলো তিস্তা। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
"কী এটা!"
"খুললেই দেখতে পাবি। এটার অপূর্ণতা আছে শরীরে। তাই নিয়ে এলাম।"
"আচ্ছা।"
ছোট্ট বাক্যব্যয় করে তিস্তা বেরিয়ে যেতে নিলেই প্লাবন শীতল কণ্ঠে ডাক দিয়ে বললো,
"অষ্টাদশী'র স্রোতস্বিনী, শুভ জন্মদিন। জন্মদিনের প্রেমময় শুভেচ্ছা নিও।"
তিস্তা থামকালো। তুমি! মাস্টারমশাই তাকে তুমি বললো! শরীরে বয়ে গেলো শিহরণ। এই অনুভূতির সাথে সে পরিচিত না। নতুন অনুভূতি। ভালোবাসলে বুঝি প্রেমিকের কথায় এমন শরীরে শিহরণ বয়! তুমি ভাষাটাও বুঝি এত মিষ্টি লাগে?
লজ্জায় লাল হয় গাল, পশম দাঁড়িয়ে যায়। বাকশক্তি লোপ পায়। উত্তেজনায় কাঁপে শরীর।
তিস্তার কাহিনী দেখে হাসে মাস্টারমশাই। নিবিড় হাসি। ছোট্ট কণ্ঠে আদুরে মাখা শব্দে বলে,
"তোমার অষ্টাদশী'র জীবনের জন্য দোয়া রইলো। সবটা সুখকর হোক। আর অনুভূতি প্লাবনময় হোক।"
তিস্তা আর দাঁড়ায় না। তার লজ্জা লাগছে। ভীষণ লজ্জা। ছুটে চলে যায় মাস্টারমশাই'র সামনে থেকে। কাঁপা কাঁপা পায়ে ছুটতেও পারছে না ঠিকমতন। প্লাবন হাসে। সাবধানী কণ্ঠে বলে,
"ধীরে যাও।"
ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বিষাদিনী। গুনগুনিয়ে গায়,
"ভালোবেসে সখী,নিভৃতে যতনে,
আমার নামটি লিখো তুমি, মনেরও মন্দিরে।"
প্লাবন পাত্তা দেয়না সে গান। অগ্রসর হয় ঘরের দিকে। বিষাদিনী নিজের বড় বেণীটা কোমড়ে ফেলে বেশ তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
"শাড়িটা তো শহর থেকে এনেছিলেন তাই না,প্লাবন দা? তিস্তাকে দারুণ মানিয়েছে। তা মেয়েটার মনে যে এত রঙ লাগাচ্ছেন, টিকিয়ে রাখতে পারবেন তো প্রেম? দেখবেন,বিষাদিনী'র বিষাদই না আবার শেষমেশ জুটে। অমন একটা শাড়ির জন্য হলেও,আমার আপনাকে চাই, প্লাবন দা।"
বিষাদিনী আর দাঁড়ায় না। গটগট পায়ে বেরিয়ে যায়। প্লাবনের কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ। বিষাদিনী মেয়েটা তার কাছে কেমন অস্বচ্ছ। তিস্তাকে এর সাথে মিশতে দেওয়া যাবে না। ওষুধ রোগ সারানোর জন্য দারুণ জিনিস কিন্তু সুস্থ শরীরের জন্য বিষ। আর বিষাদিনী সেই ওষুধ।
_
মধুসখী'র ঘাটে চার নারী'র রমরমা আড্ডা। এর মাঝে তিস্তা'র পায়ে নূপুরের শব্দ। মাস্টারমশাই এর তরফ থেকে উপহার।
কঙ্কণা আর বিষাদিনী'র সক্ষ্যতা যেন একটু বেশিই। একজনের প্রতি আরেকজনের প্রেম যেন আকাশ ছোঁয়া।এতে অবশ্য কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
হঠাৎ মধুসখী'র ঘাটে উপস্থিত হলো ক্লান্তময় প্লাবন। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
"তিস্তা,তাড়াতাড়ি তোর বাড়ি চল।"
তিস্তা অবাক হলো। সাথে উপস্থিত সবাই। বিস্মিত কণ্ঠে তিস্তা বললো,
"কেনো, মাস্টারমশাই?"
প্লাবনের যেন উত্তর দেওয়ার সময় নেই। তিস্তা'র হাত ধরে ছুটতে থাকে তিস্তার বাড়ির দিকে। তাদের পিছে পিছে ছুটে বাকি তিনজনও। তিস্তার বাড়ি'র কাছে আসতেই ভীষণ ভীড়ের দেখা মেলে। ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই আৎকে উঠে তিস্তা।
বাড়ির ছোট উঠান জুড়ে খাটিয়া। সাদা কাপড়ে মোড়ানো কে যেন শুয়ে আছে সেথায়।
তিস্তা'র সামনে সাদা কাপড়ে মোড়ানো লা'শ খানা। তবুও তিস্তার মুখে দুঃখের কোনো রেশ নেই। সে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের এক কোণায়। তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা বকুল অব্দি কেঁদেকেটে ভাসাচ্ছে অথচ মেয়েটা কাঁদছে না। কী আজব! মেয়েটা কী পাথর হলো?
উঠোনের মাঝে নেতিয়ে আছে আহ্লাদী। এতক্ষণ সে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদেছে। আর দেহে কুলচ্ছে না কাঁদাকাটি। আহ্লাদী'কে ধরে বসে আছে দাদী। মেয়েটা'র পেটে তিন মাসের সন্তান অথচ তার স্বামী আজ খাটিয়া'তে ঠাঁই পেয়েছে। কী দুর্ভাগ্য! হাহ্!
গ্রামের লোক কত স্বান্তনা দিলো। মেয়েটা সবসময় শান্ত শিষ্ট থাকতো। আহারে মেয়েটার কপাল পুড়লো শেষমেশ!
বোন জামাইয়ের লা'শ দেখার পরও তিস্তা'র হেলদোল না দেখে অবাক হয় বিষাদিনী। সবার অগোচরে ফিসফিস করে বলে,
"তুমি কাঁদছো না যে? খারাপ লাগছে না দুলাভাই'র জন্য?"
তিস্তার ভাবলেশহীন উত্তর,
"নাহ্ তো।"
বিষাদিনী অবাক হয়। তারপর নিজেকে সামলে নেয়। সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
"কেনো? বাজে লোক ছিলো নাকি সে?"
এবার অবাক হওয়ার পালা তিস্তার। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে অঢেল বিস্ময় নিয়ে বলে,
"তুমি জানলে কীভাবে, বুবু?"
"নারী আমি। পুরুষের প্রতি একজন নারী'র ঘৃণা'র দৃষ্টি, বুঝতে পারি আমি। আমারও এমন দৃষ্টি আছে কোনো না কোনো পুরুষের জন্য। তোমায় না বুঝলে হবে?"
তিস্তা থামকায়। বিষাদিনী'র প্রতি তার ভালো লাগা আরও দ্বিগুণ বাড়ে। হঠাৎ করেই বাড়ির পরিবেশে তার বিতৃষ্ণা জন্মায়। সবার অগোচরে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। মাস্টারমশাইটা অকারণেই তাকে ধরে নিয়ে এলো এখানে। এর চেয়ে মধুসখী'র ঘাট বেশি ভালো ছিলো।
তিস্তা বেরিয়ে যেতেই তর পিছে পিছে বিষাদিনীও বেরিয়ে যায়। তিস্তাকে সে যতটা চিনেছিলো, মেয়েটা যে এত পাষাণ হবে সে ভাবে নি। যতই হোক,নারী শরীরেে অপমানের আঁচড় কেটেছিলো সে মানুষ। দয়ামায়া না থাকাটাই তো স্বাভাবিক।
গ্রামের পথে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে তিস্তা আর বিষাদিনী। কথা'র এক পর্যায়ে বিষাদিনী অদ্ভুত স্বরে বললো,
"তোমার দুলাভাই কীভাবে মারা গিয়েছে, শুনেছো কিছু?"
"হ্যাঁ। হৃদরোগের কারণে। তবে,শ'য়'তা'ন গো শাস্তি এমন ভাবেই দেন সৃষ্টিকর্তা।"
"শাস্তি টা সৃষ্টিকর্তা দিলো না তার সৃষ্টির সেরা জীব দিলো সেটা পরিষ্কার না আমি।"
বিষাদিনী'র কথায় অবাক হয় তিস্তা। ভ্রু কুঁচকে বলে,
"মানে!"
"ও কিছু না। আচ্ছা, তুমি নাহয় তোমার দুলাভাই'কে অপছন্দ করতে। কিন্তু তোমার আপু? তাকে তো তুমি ভালোবাসো, তার দুর্দিনে তোমার এত কাঠিন্যতা মানায়? আর তাছাড়া,তার তো কোল জুড়ে অন্য কারো আগমনী বার্তা বইছে।"
"আপা তো আমার দুর্দিনে দাঁড়ায় নি,বুবু। অবশ্য এ নিয়ে আমার রাগ নেই। এখন ওখানে আমার দমবন্ধ লাগছিলো। আমার এত কান্নাকাটি ভালো লাগে না। ভয় হয় কেবল। হৃদয় মাঝে কেমন ভয়ঙ্কর প্রলয় হয়। কাউকে দেখাতে পারি না। তাই ছুটে চলে এসেছি। মানুষটাকে আমি অপছন্দ করতাম ঠিকই, কিন্তু কখনো চাই নি সে আমার আপা'র সুখ কেড়ে নিয়ে মৃত্যু'র মুখ দেখুক। তবুও উপরওয়ালার ইচ্ছে বুঝি অন্য কিছু ছিলো।"
বিষাদিনী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। এতটুকু মেয়েও চায় নি কখনো, তার সাথে খারাপ আচরণ করা ব্যাক্তিটা মারা যাক। কিন্তু সে,এত বড় মেয়ে হয়েও প্রতিনিয়ত নিজের বাবার মৃত্যু কামনা করতো। বাবা হয়তো তার জীবনে নোংরামির আঁচড় কাটে নি। কিন্তু সহজ সরল মেয়েদের যে ক্ষতি করতো। যতই সে বাবা হোক, আগে তো তাকে মানুষ হতে হবে। মানুষ রূপে অ'মানু'ষ হয়ে বেঁচে থেকে আদৌও কোনো লাভ আছে?
বিষাদিনী আর তিস্তা'র নিরব মুহূর্তের মাঝে হাজির হয় দারুণ এক সুপুরুষ। তিস্তাকে দারুণ রঙিন রূপে দেখে পুরুষটা এগিয়ে আসে। মিষ্টি স্বরে বলে,
"ভালো আছেন, তিস্তা?"
তিস্তা অবাক নাহয়ে পারে না। এতদিন পর এ মানুষটার সম্মুখে পরবে ভাবে নি। এ মানুষটার কাছ থেকে অনেক কিছু জানা বাকি তার।
তিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে মাহিন আবার প্রশ্ন করলো,
"চিনতে পারেন নি আমায়?"
"না চেনার কী আছে? আমার জীবনে দারুণ ক্ষতির কারণ হলেন গিয়ে আপনি। আপনাকে না চিনলে হবে?"
তিম্তার কাঠ কাঠ জবাবে সামান্য ভড়কে গেলো মাহিন। কিন্তু সে উত্তর দেওয়ার আগেই হঠাৎ তার নজর গেলো তিস্তা'র পাশে দাঁড়ানো রমনী'র দিকে। বিস্ফোরিত কণ্ঠে সে বললো,
"বিষাদিনী, আপনি!"
বিষাদিনী মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিনের অবাক দৃষ্টি দেখে সামান্য হাসলো। খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
"হ্যাঁ, আমি। কেমন আছেন, ডাক্তার সাহেব?"
"এইতো,ভালো। আপনি?
"আমি তো সবসময়ই ভালো থাকি,তাই না? তা,এখন কী গ্রামেই থাকেন?"
"না,না,সদরে থাকি। মাঝে মাঝে আসি।"
"তো,আমাদের বাড়িতে যাবেন। আপনার কথা এখনো অনেকে আলোচনা করে।
"হ্যাঁ, যাবো সময় করে।"
"তিন-চার বছরেও আপনার সময় হয়ে উঠে নি!"
বিষাদিনী'র প্রশ্নে হাসে মাহিন। প্রশ্নটা এড়িয়ে বলে,
"আপনি আগের চেয়ে বেশিই সুন্দর হয়েছেন।"
"তখন বুঝি ভীষণ অসুন্দর ছিলাম?"
এহেন প্রশংসায়ও আর পাঁচটা মেয়ের মতন লজ্জায় কুঁকড়ে যায় নি বিষাদিনী। স্বাভাবিক ভাবো আরও টুকটাক কথা হলো দু'জনের মাঝে। তিস্তা কেবল হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। তার বোধগম্য হলো না ব্যাপার টা। দু'জন দুই মেরুর প্রাণী হয়েও পরিচিত কীভাবে?
অবশেষে বিষাদিনী'র আলাপ আলোচনা শেষ হলো। মাহিনকে বিদায় জানিয়ে সে তিস্তা'র হাত ধরে আবার হাঁটা ধরলো গ্রামের পথ ধরে। তিস্তা ফিরে চাইলো মাহিনের দিকে। মাহিন এখনো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহিনের দৃষ্টিতে কেবল মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। উপচে পড়া মুগ্ধতা। কিন্তু কার জন্য সে মুগ্ধতা? বিষাদিনীর নাকি তিস্তার?
মাহিনের থেকে বেশ কিছুটা দূরে যেতেই বিষাদিনী'র কিছু মনে পড়লো। থেমে গেলো তার পা। হঠাৎ সন্দিহান কণ্ঠে সে তিস্তাকে বললো,
"তুমি তখন ডাক্তার সাহেব মানে মাহিনকে কী বললে? তোমার দারুণ ক্ষতির কারণ সে কীভাবে?"
তিস্তারও এবার হুঁশ হলো। সে বিষাদিনী আর মাহিনের আলোচনায় এতই মত্ত হয়েছিলো যে নিজের প্রশ্ন গুলো ছুঁড়তে পারে নি মাহিনের দিকে। তিস্তাকে চুপ থাকতে বিষাদিনী আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লো,
"বললে না, কী ক্ষতি?"
"আমার চরিত্র নষ্ট হওয়ার মিথ্যে খবরটা উনিই ছড়িয়ে ছিলো, বুবু। অথচ আমার সাথে তেমন কিছুই হয় নি।"
বিষাদিনী ভারী অবাক হলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
"তার মানে? সবাই যা বলে, তোমার সাথে আসলে তা ঘটে নি?"
"নাহ্। আমাকে কেবল পাঁচদিন অন্ধকার একটা ঘরে আটকিয়ে রেখেছিলো। এছাড়া কিছুই করে নি। কিন্তু গ্রামের মানুষ সেটা বিশ্বাস করে নি একমাত্র এই ডাক্তারের জন্য। উনিই আমাকে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বলেছিলো আমার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে।"
বিষাদিনী সামান্য হোঁচট খেলো বোধহয়। ডাক্তার সাহেব মিথ্যে কেন বলেছে? নিশ্চয় এর ভিতরে কাহিনী আছে।
_
রাত নেমেছে চারপাশে। তিস্তা বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে কেবল পড়তে বসেছে। হারিকেনের আলোটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে পড়ায় মনোনিবেশ করেছে মাত্র। হঠাৎ তার ঘরে ধীর গতিতে কেউ প্রবেশ করলো। তিস্তা সামান্য চমকে তাকাতেই দেখলো একদম সাদা ধবধবে শাড়ি পড়া তার আপা।
তিস্তা নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নিলো। সাদা শাড়িতে আপাকে কেমন ভয়ঙ্কর লাগছে! তিস্তার ভাবনার মাঝে আহ্লাদী'র কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
"কিরে,কথা বলবি না আমার সাথে?"
তিস্তা চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,
"ওমা,কথা কেন বলবো না? তুমি বসো এখানে।"
"না না। বসতে আসি নি। তোরে একটা দায়িত্ব দিলে পালন করতে পারবি?"
তিস্তা ভ্রু কুঁচকে বললো,
"কী?"
"আমার সন্তানকে তুই মানুষ করতে পারবি?"
আপার কথায় তিস্তা বিচলিত হলো। আপার মাথায় কী অন্য কিছু ঘুরছে? তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে আপাকে জড়িয়ে ধরলো তিস্তা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
"নাহ্, পারবো না। তুমি থাকতে আমি মানুষ করতে যাবো কেন? কীসব বলছো আপা!"
"আচ্ছা, তুই আগের মতন আমায় ভালোবাসিস তো? নাকি আর মনে পড়ে না আমায়?"
"আমি তোমাকে সবসময় ভালোবাসি, আপা। এমন করে বলছো যে!"
আর উত্তর দেয় না আহ্লাদী। কেবল মনে মনে কী যেন ভাবে।
_
আজকে থেকেই তিস্তার মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু। মাস্টারমশাই আর বিষাদিনী'র সাথে তিস্তা, কঙ্কণা,বকুল পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। তিস্তা তার সাথে নিজের মাকে আনতে ভুলে নি। চোখ গুলো ফুলে ঢোল হয়ে আছে মেয়েটার।
আজ দিন দুই যাবত সে কারো সাথে কথা বলছে না। কিন্তু যতটুকু মনে হয় মেয়েটা খুব কাঁদছে। কিন্তু কেনো?
প্লাবনের ক্ষানিকটা খটকা লাগে। ওর দুলাভাই যেদিন মারা গেলো, মানে গত তিনদিন আগেও মেয়েটা ঠিক ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে কী হলো মেয়েটার? তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে কেনো?
স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সবাই। প্লাবন সবাইকে ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। তিস্তা তাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। প্লাবন বকুল আর কঙ্কণাকে বুঝিয়ে তিস্তার দিকে গেলো।
প্লাবনকে দেখে তিস্তা মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। প্লাবন বেশ অবাক হলো তিস্তার আচরণে। এমন করছে কেনো মেয়েটা?
প্লাবন অবাক কণ্ঠে বললো,
"এমন করছিস কেনো তুই? কথা বলছিস না যে আমার সাথে? আমি কিছু করেছি?"
তিস্তা তবুও চুপ৷ প্লাবনের একটু রাগ উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
"বে'য়া'দ'ব হয়েছিস? একটা কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে হয় জানিস না? কী হয়েছে তোর? নাটক করছিস কেনো?"
"আমার কিছু হয় নি। আপনি আমার সামনে আর কখনো আসবেন না। চলে যান এখান থেকে।"
প্লাবন তাজ্জব বনে গেলো। এ কেমন কথার ধরণ মেয়েটার!
"কিগো,তিস্তা রানী'র যে বড্ড মন বেজার? পরীক্ষা কী অনেক খারাপ হলো?"
বিষাদিনী'র কথায় ধ্যান ভাঙে তিস্তা'র। মুচকি হেসে মাথা ডানে বামে ঘুরিয়ে বলে,
"নাহ্,পরীক্ষা তো মন খারাপ করার মতন হয় নি। পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছে।"
"তবে যে আজ বড্ড চুপচাপ?"
"তেমন কিছু না। তোমরা আড্ডা দেও। আমি তো শুনছি। মাস্টারমশাই এলে কিন্তু আর আড্ডা দিতে পারবে না।"
তিস্তা'র কথায় সবাই আবার আড্ডাতে মনযোগী হলো। মেতে উঠলো নতুন উন্মাদনায়। তবে এটাকে আড্ডা বলা যায় না। বিষাদিনী কথার ছলে যা-ই বলে, সবটা থেকেই বাংলা'র ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি সম্পর্কে। কিছু না কিছু জানাই যায়।
সময়টা তখন পানসে,ক্লান্ত বিকেল। পাখিরা ফিরে এসেছে তার নীড়ে। সূর্য সারাদিন তার উত্তপ্ততা ছড়িয়ে এখন বাড়ি ফিরছে। চারপাশের আবহাওয়া টা থম মারা। যেন ঝড় হবে খুব।
তিস্তা'র মনেও চলছে উথাল-পাথাল ঝড়। বিবেকের তাড়নায় আর মনের পীড়ায় সে দিক ভ্রষ্ট। বিবেকের কথা শুনলে হৃদয়ের অভ্যন্তরে হবে র'ক্ত ক্ষরণ। আবার যদি হৃদয়ের কথা শুনে তবে বিবেকের কাছে হবে সবচেয়ে ঘৃণীয় মানুষ। কী করবে সে?
তিস্তা নিজের বই খাতা গুলো গুটিয়ে নিলো। উঠে দাঁড়ালো নিবিড় ভাবে। তিস্তার আকষ্মিক উঠে দাঁড়ানোতে আলোচনায় ভাঁটা পড়লো। কঙ্কণা অবাক কণ্ঠে বললো,
"কিরে, কোথায় যাচ্ছিস? মাস্টারমশাই পড়ানো শুরুই করলো না, আর তুই চলে যাচ্ছিস!"
তিস্তা উত্তর দিলো না। এর আগেই বাহিরের ঘর থেকে আশালতা বেগমের কণ্ঠ ভেসে এলো। সে কর্কশ গলায় বললো,
"আজ বোধহয় পড়াইবো না, বাবু। তারে একটু ঐ গ্রামের বাজারে পাঠিয়েছে। বিষাদিনী'র জন্য ভালো শাড়ি আনতে। কাল তো গ্রামে অনুষ্ঠান আছে, মধুসখী'র ঘাটে মেলা। আর তাছাড়া কয়দিন পর বউ হইবো,তখন তো কিনতেই হবে। তাই আগে আগে কিনে অভ্যাস করুক।"
আশালতা'র কথা থামলো। চুপ হয়ে গেলো আড্ডার আসর। নিজের মাঝে হাজার খানেক ভাবনা মাটিচাপা দিয়ে বিষাদিনী'র দিকে ধ্যান দিলো তিস্তা। মেয়েটা খুব সুন্দর। প্রাপ্তবয়স্ক আর খুব স্বাধীন চেতনার মেয়ে। এমন একটা মেয়েকে ফেরানো মাস্টারমশাই এর জীবনে সবচেয়ে বড় বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না।
তিস্তা দাঁড়ালো না আর। বের হয়ে গেলো বিনা বাক্যে। পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলো সবাই কিন্তু কোনো আশানুরূপ ফল পেলো না। তিস্তা সদর দরজা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরই একজনের মুখে দারুণ হাসির ঝিলিক দেখা দিলো।
_
প্রতি জৈষ্ঠ্যমাসে মধুসখী'র কোল ঘেষে দারুণ উৎসব উদযাপিত হয়। শোনা যায়, জমিদারের বিবাহ বার্ষিকী নাকি অনেক যুগ যাবত উদযাপিত হয়ে আসছে। জমিদার ভালোবাসা আর নিজের সম্পর্কের প্রতি ছিলেন খুব যত্নশীল আর শৌখিন। তিনিই সবসময় জৈষ্ঠ্য মাসের পঁচিশ তারিখ বড় করে একটি উৎসব উদযাপন করতেন। গ্রামের সব মানুষকে খাওয়াতেন, মেলা বসতো এখানে। সবাই ভরপুর আনন্দ করতো। তার স্ত্রী'র মুখের হাসিটা'ই ছিলো জমিদারের জন্য স্বর্গ। তাই এত আয়োজন। কালের গহব্বরে হারিয়ে গেছেন জমিদার ও তার শৌখিন সম্পর্ক। কিন্তু রয়ে গেছে সেই ধারাবাহিকতা।
তিস্তা মধুসখী'র সামনে দিয়ে হেঁটে আসছে। মন তার এখন আগের চেয়ে ভালো। কি সুন্দর রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো হচ্ছে নদীর আশপাশ। কি সুন্দর লাগছে! সজীব মধুসখী'র সাথে সাজটা যেন দারুণ মানিয়েছে। আগে এ অনুষ্ঠান হলেও মধুসখী তখন ছিলো মৃ'ত। দারুণ অনুষ্ঠান হলেও এমন সজীবতা এতদিন দেখা যায় নি। ভাবনার মাঝেই তিস্তাকে কেউ ডেকে উঠলো,
"এই তিস্তা, না পড়ে কোথায় যাচ্ছিস? আমি চলে এসেছি তো।"
তিস্তার মুগ্ধতা কেটে যায়। বহুল পরিচিত কণ্ঠে ধ্যান ভাঙে। অতি পরিচিত ভাবে ছলাৎ করে উঠে হৃদপিণ্ডটা। তিস্তার চিত্ত জানে এ ডাকের মানুষটা কে। তিস্তা নিজেকে ধাতস্থ করে। কঠিন হতে হবে তাকে। অনেক কঠিন। যতটা কঠিন হলে প্রিয় মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিবে, ঠিক ততটা কঠিন।
তিস্তা'কে চুপ থাকতে দেখে প্লাবন এগিয়ে এলো। হতাশ কণ্ঠে বললো,
"ফিরে যাচ্ছিস যে? আমি চলে এসেছি তো। চল এবার।"
"নাহ্, যাবো না। আপনি তো নাকি আজ আর পড়াবেন না। নতুন হবু বউয়ের জন্য শখ করে শাড়ি কিনতে গিয়েছেন।"
তিস্তার কাঠ কাঠ জবাবে সামান্য হকচকিয়ে যায় প্লাবন। আশেপাশে মানুষজনের দৃষ্টি অনুসরণ করে, কণ্ঠ সামান্য খাদে নামিয়ে বললো,
"কে বলেছে পড়াবো না? তোদের তো এখন পরীক্ষা চলছে। এখন না পড়ালে কখন পড়াবো?"
তিস্তা উত্তর দেয় না। থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। প্লাবন সামান্য নরম হয়। অসহায় কণ্ঠে বলে,
"এমন করছিস কেনো? আমি কী কোনো ভুল করেছি?"
প্রশ্নের পরিবর্তে কোনো উত্তর মিলে না। তিস্তা যেন কথা না বলার শপথ নিয়েছে। প্লাবণ কতক্ষন চুপ থেকে নিজের হাতে থাকা একটা প্যাকেট তিস্তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
"তোমার ভীষণ অভিমানের পানসে রাগ হাওয়ায় মিলিয়ে যাক,স্রোতস্বিনী। আমরা আবারও উচ্ছ্বাসের সাথে উড়ে বেড়াবো, এই গ্রামের আনাচে-কানাচে। আর হ্যাঁ, আমি হবু বউয়ের জন্যই শাড়ি কিনতে গিয়েছিলাম। তুমিই তো আমার সবটার অধিকারীনি।"
তিস্তা থেমে যায়। কঠিন রাগের পাহাড় সামান্য গলে যায়। নিবিড় হয় রাগের তেজ। মাস্টারের আকুতি মাখা চাহুনির জন্য নিতে হয় যত্নের উপহার খানা। প্যাকেট টা হাতে নিয়েই গটগট পায়ে চলে যায় বাড়ির উদ্দেশ্যে। এখানে আর থাকা যাবে না। যে প্রেমিকের জন্য গ্রীষ্মের কঠিন উত্তাপ সাজিয়ে রাখা,তাকে কোমল গলে যাওয়া প্রেম দেওয়া যাবে না। বিবেকের কাছে ছোট কখনোই সে হবে না।
_
"বাহ্ তিস্তা! ডুমুর রাঙের শাড়িটা তো তোমায় বেশ মানিয়েছে! কখন কিনেছো?"
বিষাদিনী'র প্রশ্নে সামান্য হোঁচট খায় তিস্তা। আমতা-আমতা করে বলে,
"কাল কিনেছি। আজকে মেলা উপলক্ষে আরকি কেনা হলো।"
বকুল শব্দ করে হেসে উঠলো। ঠাট্টার স্বরে বললো,
"মনে হচ্ছে বিবাহ বার্ষিকী টা জমিদারের না। তোর।"
আরেকদফা লজ্জা পেলো তিস্তা। কোনোরকমে লজ্জা পাশে রেখে বললো,
"জমিদারের মতন এমন পা'গ'ল প্রেমিক পেলে নাহয় এ কথা টা মানা যেতো।"
এবার তিস্তার কথায় সায় জানালো বিষাদিনী। মধুসখী'র ঘাটে চার কন্যা বেশ রমরমা আড্ডা দিচ্ছে। কথার প্রেক্ষিতে কথা বাড়ে।
বিষাদিনী হঠাৎ বলে উঠলো,
"জমিদার আসলেই পা'গ'ল প্রেমিক ছিলো। নাহয় নিজের কষ্ট এভাবে কমাতেন?"
তিস্তা, বকুল আর কঙ্কণা অবাক হয় বিষাদিনীর কথায়। অবাক কণ্ঠে বলে,
"নিজের কষ্ঠ কীভাবে কমাতেন?"
"আচ্ছা, সেটা পড়ে বলবো।আগে বলো, তোমাদের কী মনে হয়? জমিদার তার স্ত্রীকে কতটুকু ভালোবাসতেন?"
"আকাশের চেয়েও বেশি পরিমাণ। হিসেব করা সম্ভব না।
তিন কিশোরীর ঝটপট উত্তর। তাদের উত্তর শুনে বিষাদিনী বেশ উচ্চ স্বরে হেসে উঠে। প্রায় কতক্ষন হেসে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে বললো,
"যদি আমি বলি,জমিদারের বউ নিজে পড়ে গিয়ে মা'রা যায় নি। তাকে মে'রে ফেলা হয়েছে। তখন তোমাদের অনুভূতি কেমন হবে!"
"বিয়ে করবেন আমায়, বিষাদিনী?"
বিষাদিনী ক্ষাণিকটা চমকালো,থমকালো। ভীড়ের মাঝে ভুল শুনেছে ভেবে কপাল কুঁচকালো। বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,
"জ্বি? বুঝি নি। কী বলেছেন?"
মাহিন আবার সামান্য শ্বাস নিলো। তাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে। সামান্য ঘামছে। উত্তেজনায় নাকি অতিরিক্ত চিন্তায় তা বুঝা যাচ্ছে না। বিষাদিনী উত্তরের আশায় নিষ্পলক চেয়ে রইলো। কিছুটা সময় দু'জনের মাঝে নিরব ভাবে অতিবাহিত হলো। মাহিন সঞ্চয় করলো নতুন উদ্যম। আবার বললো,
"বিয়ে করবেন আমায়?"
এবারের প্রশ্ন বিষাদিনী'র কান হতে মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতে পেরেছে। এবার আর হকচকিয়ে যায় নি সে। বরং স্বাভাবিক রইলো। তারা দাঁড়িয়ে আছে মধুসখী'র ঘাটের ঠিক পেছনের বটগাছটার দিকে। এখানে মানুষজন কম। মাহিন হঠাৎ তাকে ডাক দিয়ে এখানে এনেছিলো জরুরী তলবে। কিন্তু জরুরী কথা টা যে এটা হবে, বিষাদিনী বুঝে নি।
বিষাদিনীকে চুপ থাকতে দেখে মাহিন অধৈর্য হয়ে গেলো। উৎকণ্ঠা নিয়ে চেয়ে রইলো বিষাদিনী'র পানে। বিষাদিনী ক্ষাণিক সময় নিলো। ধাতস্থ করলো নিজেকে। পরক্ষণেই প্রশ্নের তীর ছুঁড়ে মারলো,
"বিয়ে করবেন আমাকে? কিন্তু কেনো?"
"আমি জানিনা। সেদিন আপনাকে মধ্যাহ্নে দেখার পর আমার আর কিছু দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আপনি বিহীন সবটাই রঙহীন মনে হয়। এ কয়েকটা দিন কেবল আপনার চিন্তায় মগ্ন থেকেছি। আপনাকে আমার চাই।"
"কিন্তু আপনাকে আমার চাই না।"
বিষাদিনী কঠোর জবাবে থম মেরে যায় মাহিন। অসহায় কণ্ঠে বলে,
"কেনো? আমার অপরাধ কী?"
"আপনি আমাকে অনেক আগে থেকেই তো চিনতেন। তখন আমার জন্য আপনার কোনো অনুভূতি সৃষ্টি হলো না অথচ এখন এক দেখাতেই বিয়ে করতে ইচ্ছে হচ্ছে, ব্যাপারটা কেমন ঘোলাটে না?"
মাহিন চুপ করে থাকে। আসলেই তো! তার হঠাৎ এমন লাগছে কেনো? কিছুদিন আগ অব্দি যা স্বাভাবিক ছিলো আজ তা অন্যরকম লাগছে কেনো!
মাহিনের উত্তর না পেয়ে বাঁকা হাসে বিষাদিনী। ফিসফিসিয়ে বলে,
"তিস্তা তবে রুচি থেকে উঠে গেছে, ডাক্তার সাহেব?"
মাহিন এবার কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। ঘাবড়ালো সামান্য। বিষাদিনী আর কিছু বললো না। বাঁকা আর রহস্যময় হাসি দিয়ে স্থান ত্যাগ করলো। এ গ্রামে ঘটা সকল রহস্যের সমাধান খুব শীগ্রই হবে।
-
তিস্তা'র আর মন বসছে মেলার মাঝে। বিষাদিনী আপা কী বলে গেলো? জমিদারের অর্ধাঙ্গিনী'র মৃত্যু টা স্বাভাবিক না! তবে কী তাকে মে'রে ফেলা হয়েছে? জমিদারের এত প্রিয় মানুষটাকে কেউ মেরে ফেলবে আর জমিদার বুঝবেও না, এটা ভীষণ অদ্ভুত ঠেকছে তিস্তা'র কাছে। তিস্তার ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে পরিচিত ডাক ভেসে এলো,
"তিস্তা?"
তিস্তা সাথে সাথেই ফিরে তাকালো। চোখে মুখে বিন্দু পরিমাণের উচ্ছ্বাস নেই। দৃষ্টি তার নিষ্প্রাণ। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,
"বলুন, মাস্টারমশাই?"
"তুই আমার সাথে কথা কেনো বলছিস না?"
কী উত্তর দিবে মাস্টারমশাই'র প্রশ্নে! উত্তর দেওয়ার পথ যে বন্ধ। তবুও নিজেকে কঠোর করে বললো,
"এই যে কথা বলছি।"
"কথা ঘুরাচ্ছিস?"
"উদ্ভট প্রশ্ন করলে, কথা ঘুরাতেই হয়।"
"তুই নিজেও জানিস,আমি উদ্ভট প্রশ্ন করছি না। তাহলে কথা কেনো ঘুরাচ্ছিস? আমার সাথে কথা বলতে কেউ না করেছে?"
তিস্তার বুক কেঁপে উঠলো। মাস্টারমশাই কিছু আঁচ করতে পারলো না তো? কণ্ঠনালীর মাঝে শব্দ কণিকারা আটকে গেলো। তন্মধ্যেই পেছন থেকে বিষাদিনী বলে উঠলো,
"আপনার সাথে তিস্তা'র কিসের কথা,প্লাবন দা? দু'দিন পর আপনি আমার হবেন। পর মানুষের সাথে কিসের কথা?"
আবার,আবার তিস্তা ভেতর ভেতর ভেঙে গেলো। মাস্টারমশাইকে সে কখনোই পর মানুষ ভাবতে পারবে না। তাহলে কেনো এখন ভাবতে হচ্ছে! সম্পর্কের সমীকরণ এত গড়মিল হয় কেনো?
প্লাবন কিছু বলার জন্য উদ্যোত হতেই পেছন থেকে হৈচৈ ভেসে এলো। ওরা তিনজনই দ্রুত পিছে তাকালো। তাকিয়ে ক্ষানিকটা চমকে গেলো। বকুলের মা বকুলের হাত ধরে টানছে আর কি যেন বলছে। দূর থেকে কথা অস্পষ্ট।
তৎক্ষনাৎ বিষাদিনী ছুট লাগালো। পিছে পিছে ছুটে গেলো প্লাবন আর তিস্তা।
বকুলের কাছাকাছি আসতেই বকুলের বিরক্ত ভরা কণ্ঠ ভেসে এলো। সে বেশ চেঁচিয়েই বলছে,
"আমি যাবো না বাড়ি। তোমরা আমাকে জোড় করে বিয়ে দিয়ে দিবে আমি জানি। আমি পড়াশোনা করতে চাই। আমি বড় মানুষ হতে চাই। দয়া করো মা।"
বকুলের কথার বিপরীতে তার মা বলে উঠলো,
"আমরা তোকে বিয়ে দিবো না, মা। চলে আয় আমাদের কাছে। তুই ছাড়া বাড়ি যে আমার শূণ্য। তুই যতটুকু ইচ্ছা পড়বি। আমরা আর আটকাবো না।"
"না মা, আমি যাবো না। আমি বিষাদিনী আপা'র কাছেই থাকবো।"
বকুল কোনোমতে মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বিষাদিনী'র দিকে ছুটে গেলো। বিষাদিনী আগলে নিলো বকুলকে। বকুলের মা আবার বকুলের কাছে আসতে নিলেই বিষাদিনী থামিয়ে দেয় তাকে। বেশ শান্ত স্বরে শুধায়,
"আপনি কী ওরে সাথে নিতে চান?"
বকুলের মায়ের তৎক্ষনাৎ উত্তর,
"হ,আমার মাইয়ারে আমি নিয়া যাবো।"
"তাহলে জোর করে নিতে পারবেন না। যদি আপনার মেয়ে আপনার সাথে যেতে চায়,তবেই নিবেন। কেমন?"
বকুলের মা চুপ করে থাকে। তারপর উদাসীন কণ্ঠে বলে,
"ও তো আমাদের সাথে যেতে চায় না।"
"সেটা তাহলে মা হিসেবে আপনার ব্যর্থতা। আপনার সন্তান এখন আপনার কাছেই নিরাপদ বোধ করছে না। বুঝুন এবার। যেখানে বাবা-মা হবে নিরাপদ আশ্রয়স্থল, সেখানে ভয়ের কারণ হচ্ছে বাবা-মা। ওদের বয়সটা টিনেজার বয়স বলা হয়। মানে বয়ঃসন্ধিকাল। এ সময় ওদের আবেগ,অনুভূতি কাজ করে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। তখন ওদের প্রয়োজন কোমল আচরণ। রুক্ষতা কখনোই টিনেজাররা মানতে পারে না। অনেকসময় তারা মানতে পারে না বলে নিজেদের মে'রে ফেলে। ওদেরকে ওদের মতন সময় দিন, সুযোগ দিন। ও যখন নিজেই আপনাদের অভাব বুঝবে তখন আর জোর করার প্রয়োজন হবে না। ও নিজ ইচ্ছায় আপনার কাছে যাবে। আর তো দুটো পরীক্ষা। দুটো দিন। তারপর আর বাঁধা নেই।"
বকুলের মা যেন শান্ত হলো,ক্ষান্ত হলো। আর জোর করলো না বরং টলমল অশ্রু চোখে নিয়ে রাজ্যের আকুতি মাখা কণ্ঠে বললো,
"ফিরে আসিছ, মা। তোর আশায় পথ চেয়ে থাকবো।"
বকুলের হঠাৎ কি যেন হলো। সে দাঁড়ালো না আর বিষাদিনীর সাথে। হুড়মুড় করে চলে গেলো মায়ের কাছে। বকুলের এই আচরণে কারো মনে কোনো দ্বিধা রইলো না। বিষাদিনী হাসলো। এই তো,সমাজের বদল শুরু হলো। নারীরাও এখন অধিকার পাবে সমান। একটু জেদ,সাহস,ধৈর্য থাকলেই নারীরা উচ্চস্বরে বলতে পারবে,"আমরা নারী,আমরাই সব পারি।"
-
"মেলা থেকে কী আনলি,উড়নচন্ডী?"
অনেক গুলো দিন,অনেক গুলো প্রহর পর এই নামটায় কেউ ডাকলো তিস্তাকে। তিস্তা ভীষণ খুশি হলো। ব্যাগ থেকে আপার জন্য কেনা কয়েক ডজন রেশমি চুরি এগিয়ে দিয়ে বললো,
"এই যে আপা,এত গুলা চুড়ি আনছি তোমার জন্য।"
আহ্লাদী হাসিমুখে চুড়ি গুলো হাতে নিলো। দু মুঠো চুড়ি হাতে পড়ে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
"দারুণ মানিয়েছে তো।"
তিস্তা বোনের আদল খানায় নিরলস চেয়ে রইলো। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
"জানো আপা,বিষাদিনী আপা কি বলেছে!"
আহ্লাদী চুড়ি গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললো,
"কী বলেছে ঐ শহুরে আপা?"
"তোমার আর জমিদারের মাঝে নাকি কোনো পার্থক্য নেই। তুমিও দুলাভাইকে অনেক ভালোবাসতে আর জমিদারও মধুসখী মানে নিজের স্ত্রী'কে অনেক ভালোবাসতো। জমিদারের স্ত্রী'র মৃত্যু নাকি স্বাভাবিক না। তবে কী দুলাভাই এর মৃত্যুও স্বাভাবিক না, আপা?"
আহ্লাদী'র হাসি থেমে যায়। সাথে সাথে ঘাম ছুটে শরীর থেকে। চারপাশ হাতরে নানান শব্দ খুঁজেও উত্তর দিতে পারে না সে। কী উত্তর দিলে বিশ্বাসযোগ্য হবে, ভেবে পায় না সে।
-
এখন প্রায় মধ্যরাত। বকুল তো ওদের বাড়িতেই চলে গেছে। কেবল কঙ্কণা শুয়ে আছে বিষাদিনী'র সাথে। শুয়ে আছে বললে ভুল হবে। ঘুমিয়ে আছে বলা যায়। বিষাদিনীর শরীরে প্লাবনের আনা টিয়ে রঙের শাড়িটা এখনো জড়ানো। হাতে লাল চুড়ি রিনঝিন শব্দ তুলছে।
চুড়ি গুলো হাতে রেখেই একটা কাগজ বের করলো টেবিলের ভেতর থেকে। গোটা গোটা অক্ষরে আধাঁর কালো রঙের দোয়াতের সাহায্যে লিখলো,
"আজ মনের রঙ খুইয়ে, তোমায় দিলাম বসন্ত,
তুমি বুঝলে না প্রিয়,আমার সকাল সন্ধ্যা তোমাতেই আসক্ত"
আবার ছিঁড়ে ফেললো কাগজটা। হাতের মাঝে মুঠো করে ধরে, মুচড়ে ফেলে দিলো জানালার বাহিরে। আজ আকাশে চাঁদ নেই। ঝড় হবে সম্ভবত। মাস্টারমশাই এর বাড়ির পিছে পাতা ভর্তি পুকুরটার দিকে তাকিয়ে আনমনেই সে বলে উঠলো,
"তোমার সময় হয়েছে মানুষ। পাতার পুকুরে লাশ হয়ে ভাসার। খুব শীগ্রই তুমি ভাসবে।"
আঁধার মাঝে পৈচাশিক হাসি দিয়ে কণ্ঠে গান করলো বিষাদিনী,
"কত প্রণয়, হারায় আঁধারে,,
যেমন করে শুকনো পাতা নির্বিঘ্নে ঝড়ে পড়ে,
কেউ বুঝে না রে,
কেউ খোঁজে না রে,,
কত প্রেম হারায় আঁধারে।
নিশি রাইতে হারায় চোখের পানি,
কেউ জানেনা কেবল আমি জানি,
আঁধার যে কত দামি,
কেউ বুঝে না রে
কেউ খুঁজে না রে,
কত প্রণয় হারায় আঁধারে।
"তুই কী পাগল হলি? পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চাচ্ছিস? তাও আবার আমি না অন্য কারো সাথে? এতটা পর হয়ে গেলাম আমি?"
ধূ ধূ পরিবেশ। নিঃশেষ করা বাতাস, প্রবাহমান মধুসখী আর হৃদয়ের কিছু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিস্তা। নিশ্চুপ,নিষ্প্রাণ তার দৃষ্টি ও ভাষারা। প্লাবন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কন্ঠ তার নির্জীব। হৃদয়ে তার হারানোর ভয়। সেই ভয়কে সাথে নিয়েই সে আবার বললো,
"আমার অন্যায় টা বল।"
"বিয়ের পিঁড়িতে বসার চিন্তা আপনি আগে করেছেন, মাস্টারমশাই। আমাদের পরীক্ষার জন্য ই এতদিন বিয়ে করেন নি তাই তো? আপনি বিয়ে করতে পারলে,আমি কেনো পারবো না? আমার অপরাধ কী!"
প্লাবন থামলো। বিয়েটা সে যথেষ্ট ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু পারলো না৷ এইতো আজ তাদের গায়ের হলুদ, কাল বিয়ে। এরপর? এরপর সব শেষ। কিন্তু প্লাবন এখনো ভরসার বীজ বুকে পুষে রেখেছে। তবে তিস্তা কেনো ভরসা হারাচ্ছে!
প্লাবনের শিরা উপশিরা ভেদ করে রাগ উপঁচে পড়ছে। তার সব কিছু ধ্বংস করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তিস্তার সামনে নিজেকে এতটা কঠোর ভাবে প্রকাশ করবে না। তাহলে মেয়েটা হয়তো আরও জেদ করবে।
তিস্তা কতক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করলো,
"আপনার আর আমার এ জন্মে এক হওয়া হলো না। আমার কিশোরী বয়সের প্রেম এভাবে ধূলিসাৎ হবে আমি ভাবি নি। তবে,পরের জন্ম বলে যদি কিছু থাকে, সে জন্মে আপনি আমার হবেন। একান্তই আমার। সেখানে কেউ থাকবে না। কেউ না।"
কথা থামলো মানবীর। কণ্ঠনালী কাঁপলো৷ কান্নারা আর বারণ শুনলো না। শাষন শুনলো না। ছিটকে বেরিয়ে এলো। দিক ভুললো প্লাবন। আঁকড়ে ধরলো মানবীকে বাহুডোরে। কতখানি সময় ব্যয় হলো একান্ত ব্যাক্তিগত ভাবে। কান্নার বেগ মানবীর বেড়েই চলছে। থামছে না আহ্লাদ পেয়েও। মানবীকে এতটা নিকটে পেয়ে অসংযমী হয়ে পড়লো প্রেমিক পুরুষ। উষ্ণ ছোঁয়া একে দিলো মানবীর অধরে। সময়টা আরেকটু ব্যাক্তিগত হলো। কিশোরী বয়সের প্রথম এত গোপনীয়, নরম, কোমল অনুভূতির সাথে পরিচিত নয় তিস্তা। আবেশে বন্ধ হলো চোখ। গাল লাল হলো। লজ্জা আকাশ ছুঁয়েছে। অভিমান কী পাথর হতে পারে আর? সে তো আদুরে ছোঁয়ায় গলে পানি।
-
"তুমি তোমার কথার খেলাপ করছো না, বুবু?"
কঙ্কণার প্রশ্নে ক্ষাণিক হাসলো বিষাদিনী। ঠাট্টার স্বরে বললো,
"তুই বলছিস,অন্যায় করেছি?"
"তা নয় তো কী? এটা অন্যায় হচ্ছে না? তুমি তো বলেছিলে, মাস্টারমশাই কে বিয়ে করবে না। তবে,তুমিও কী স্বার্থপর হলে?"
"মাঝে মাঝে স্বার্থপর হতে ক্ষতি কী?"
কঙ্কণা আর উত্তর দিলো না। বিষাদিনী'র স্বার্থপরতা মানতে পারছে না সে। একদিন আধাঁর রাতে তাদের মধ্যে যে কথা হয়েছে সে কথা এখন আর বিষাদিনী রাখছে না। তবে কি নিজের ভালোবাসার জন্য মানুষ স্বার্থপর হয়?
বাহিরে তখন রঙিন কাপড় দিয়ে উঠোন সাজানো হচ্ছে। কাল দুপুরে বিয়ে। বিষাদিনী নিরলস জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। কঙ্কণা আর দাঁড়ালো না সেখানে। গটগট পায়ে বের হয়ে যাচ্ছে বিষাদিনী'র ঘর থেকে। তার মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল একটা কথা ই ঘুরপাক খাচ্ছে, "বিষাদিনী বিশ্বাসঘাতক নারী।"
কঙ্কণার ঠেলে কান্না আসছে। সে বিষাদিনীকে কত বিশ্বাস করেছিলো। আর বিষাদিনী কিনা এমন করলো?
কঙ্কণা দরজা অব্দি পৌঁছানোর পরই বিষাদিনী চিকন স্বরে ডাক দিলো,
"কঙ্কণা?"
কঙ্কণা থামলো। না চাইতেও সে থামলো। এই একটা মানুষ, যে জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে শিখিয়েছে। তবে কেনো মানুষটার পিছু ডাকে সে থামবে না!
কঙ্কণা থামতেই বিষাদিনী হেসে বললো,
"রাতের দিকে একবার মধুসখী'র ঘাটে ঢু মারিস তো। তোদের একটা সত্যি জানাবো।"
"কিসের সত্যি? আমরা আর কোনো সত্যি জানতে চাই না। তুমি পুরোটাই মিথ্যে ঘেরা।"
কঙ্কণার এমন রুক্ষ জবাবেও বিষাদিনীর হাসি একবিন্দু কমলো না। বরং হাসিটা আরও প্রশস্ত করে বললো,
"বকুল আর তিস্তা আসবে। তুই তোরটা ভেবে দেখিস। আমি আবার এখন একটা চিঠি লিখে বাসায় পাঠাবো জরুরী তলবে। কাল সকালে পৌঁছে যাবে নিশ্চিত। এখন আমার অনেক কাজ। তুই এখন যেতে পারিস।"
কঙ্কণা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। গটগট পায়ে চলে গেলো। কঙ্কণা চলে যেতেই ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে কেউ বিবাদিনী'কে ডাক দিলো।
বিষাদিনী প্রথমে ক্ষাণিকটা চমকে গিয়েও ঘাবড়ালো না। পেছন ফিরে হাসিমুখে বললো,
"কখন এলেন?"
মাহিন হেসে বললো,
"মাত্রই।"
"কাল কি হবে মাথায় আছে তো?"
"হ্যাঁ।"
বিষাদিনী বাঁকা হাসলো। কাল ঘটবে অনেক কিছু।
-
"তুই কী তোর দাদীর সাথে পা'গ'ল হলি?তোর চেয়ে তিনগুণ বয়সে বড় লোককে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছিস?"
তনয়া বেগমের প্রশ্নে জানালা থেকে ঘাঁড় ঘুরালো তিস্তা। প্রভাতের সেই মিষ্টি স্মৃতি তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাদের ব্যাক্তিগত সময় টুকু। তখনই মন বিদ্রোহী হয়ে বলে উঠছে মাস্টারমশাই কেবল তিস্তার। কিন্তু নিয়তি যে বলছে অন্য কথা।
তিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে তনয়া বেগম মেয়ের পাশে এসে বসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
"কেনো পা'গলামি করছিস, মা?"
"আমি যে মাস্টারমশাইকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবো না, আম্মা।"
তনয়া বেগমের কলিজাটা ছোট হয়ে এলো। মেয়েটা তার একজনের মায়ায় খুব বাজে ভাবে পড়েছে। এই মায়া কী আর কাটানো যায়? খরস্রোতা নদীর মতন মেয়েটা, ভালোবেসে ম'রা নদীর মতন হয়ে গেলো। ভালোবাসা বুঝি এমন! আশালতা বেগমের পা'টা ধরা বাকি ছিলো তনয়া বেগম আর তার স্বামীর। এ কথা কেউ জানলো না।কেউ জানবে না। বিষাদিনী'র কাছেও তো কত আকুতি মিনতি করেছে। কিন্তু পাথর মেয়েটা শুনে নি সে আকুতি।
-
মধুসখী'র ঘাটে বসে আছে চার রমণী। বকুল অধৈর্য হয়ে বললো,
"আপা,কি বলার জন্য ডেকেছো? বলবে না!"
বিষাদিনী হেসে বললো,
"হ্যাঁ, অবশ্যই বলবো।"
তিস্তার তখন মনে চলছে ঝড়। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বললো,
"যা বলার, বলো আপা। সন্ধ্যা নামছে যে।"
"সন্ধ্যা তো দেখছি তোমার মনে বেশি নামছে। তাই না, তিস্তা!"
বিষাদিনী'র ঠাট্টার স্বরে বলা কথা টা তিস্তাকে চুপ করিয়ে দিলো। বিষাদিনী হাসতে হাসতে বললো,
"শুনো, আজ মধুসখী'র কাহিনী বলবো। মধুসখী কীভাবে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে তার কাহিনী বলবো। কারো জীবনের সাথে হয়তো মিলে যেতে পারে।"
সবাই এখন অধীর আগ্রহ নিয়ে শোনা শুরু করলো। বিষাদিনী বললো,
"মধুসখীকে তার স্বামী প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। মধুসখী'র সকল আবদার এক কথায় পূরণ করতো জমিদার। সম্পর্কের প্রতি সে ছিলো যত্নশীল। কিন্তু সেই জমিদারই মধুসখী কে মে'রে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিলো।"
শেষের কথা শুনে বুক কেঁপে উঠলো তিনজনের। অবাক কণ্ঠে বললো,
"কী!"
"আপা,তুমিই তবে দুলাভাইকে মে'রেছো? কেনো আপা? এত ভালোবাসা স্বত্তেও কেনো মেরেছো?"
তিস্তার প্রশ্নে ক্ষাণিক কেঁপে উঠলো আহ্লাদী। ভোরে আজান ভেদ করে এমন প্রশ্ন সে মোটেও আশা করে নি।
আহ্লাদীকে চুপ থাকতে দেখে তিস্তা আবার প্রশ্ন করলো,
"কেনো মারলে,আপা?"
"তুই এসব কীভাবে জানলি? কে বলেছে তোকে এসব?"
তিস্তা হাসলো। আপার ঘর্মাক্ত মুখ খানা মুছে দিলো। চারপাশে তখন সদ্য ভোর। নতুন সকাল। পাখির কিচিরমিচির চারদিকে। তিস্তা বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো। ভোরের হিমশীতল বাতাস ছুঁয়ে গেলো তাদের দু'জনকে। উঠোনের মাচার উপর বসে আছে দু'জন। তিস্তা-ই তার আপাকে ঘুম থেকে তুলে এখানে নিয়ে এসেছে কথা বলার জন্য। কিন্তু এমন প্রশ্ন করবে,কে ভেবেছে!
তিস্তার মুখে রহস্যময় হাসি দেখে আহ্লাদী নিজের মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম টুকু মুছে ফেললো। ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বললো,
"বল,তোকে কে বলেছে এসব?"
"সে একজন বলেছে। তার আগে তুমি একটা গল্প শুনবে?"
আহ্লাদীর ভয়ে অন্তর আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা। তবুও কোনো মতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
"বল।"
"জানো বুবু, বিষাদিনী আপা কী বলেছে?"
"তুই অত বিষাদিনী, বিষাদিনী করিস কেনো? যাই হোক,যা বলার বল।"
"আমাদের গ্রামের মধুসখী নদী আছে না! সেখানে জমিদারের বউ পা পিছলে পড়ে মারা যায় নি। জমিদার তাকে মে'রে ফেলেছে।"
আৎকে উঠলো আহ্লাদী। বোন এসব কী বলে? জমিদার সাহেব নিজের স্ত্রী'কে জানের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। তাদের গ্রামে প্রচলিত কথা আছে "প্রেম করিলে জমিদারের মতন করো, বধূ হলে মধুসখী হও।" দুজনের ভালোবাসার দৃষ্টান্ত হিসেবে এ ছড়া খানি। তবে, বোন এসব কী বলে?
আহ্লাদী'র বিরক্ত লাগলো এবার। ধমকে বললো,
"এই শহুরে দিদি'র সাথে থেকে তুইও পা'গ'ল হচ্ছিস? জমিদারের ভালোবেসে পা'গলামীর কথা আমরা সবাই জানি। তবুও এসব কথার মানে কী? আর বিষাদিনী দিদি এসব কথা কীভাবে জানে?"
"জমিদারকে নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছে বিষাদিনী। এমনকি জমিদার বাড়ির আনাচে কানাচে কী আছে সেটাও তার জানা। সে কোনো একটা বই পড়েছে। আর জমিদারদের বংশধরেরাই হলো বিষাদিনী বুবুদের পরিবার। তাই সে সব কিছু জেনেছে নাকি।"
এবার আহ্লাদীর আগ্রহ জাগলো। আগ্রহী কণ্ঠে বললো,
"এরপর বল? এরপর কী হলো? জমিদার কেনো মা'রলো মধুসখীকে?"
"জমিদার তার স্ত্রীর সকল চাওয়া পাওয়া পূরণ করতো। একবার জমিদার শহরে যায় মধুসখীকে রেখে। জমিদারের কোনো সন্তান ছিলো না৷ জমিদারের শারীরিক সমস্যার জন্য। কিন্তু মধুসখী এটা জানতো না। আসলে জমিদার ভেবেছে মধুসখী এসব জানলে কষ্ট পাবে। সেবার জমিদার শহর থেকে এসে দেখে জমিদারনী মানে মধুসখী অনেক অসুস্থ। ডাক্তার, বৈদ্য ডাকা হলো। সবাই জানালো জমিদারের ঘর আলো করে বংশধর আসতে চলেছে। জমিদারের তখন মাথায় হাত। এত ভালোবাসার পরও বে'ইমানী করলো মধুসখী! যার জন্য জমিদারের জান হাজির ছিলো। তার জান ই অবশেষে কেড়ে নিলো জমিদার। সে ভেঙে পড়েছিলো। মানতে পারে নি সে ঘটনা৷ একদিন রাতে প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্ত্রীকে মে'রে মধুসখীতে ভাসিয়ে দেয়। সবাই ভাবে পা পিছলে মারা গেছে। কিন্তু যে মানুষ সাঁতার জানে সে কী কখনো ডুবতে পারে, আপা?"
আহ্লাদী বিষ্মিত,হতবাক। আধ্যাত্মিক ভাবে তার আর জমিদারের ঘটনা মিলে গেলো প্রায়। তবে কী তিস্তা বুঝে ফেলেছিলো?
"আপা,একদম সুস্থ মানুষ হঠাৎ হৃদরোগে মারা যেতে পারে?"
যে ভয়টা পেয়েছে তা-ই ঘটলো। আহ্লাদীর কণ্ঠ ছোট হয়ে আসছে। কণ্ঠনালি কাঁপছে। চোখ থেকে অশ্রুকণা ঝড়িয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
"হ্যাঁ, আমিই মে'রে'ছি ঐ নরপিশাচকে। জানিস ও আমাকে টাকার জন্য বিক্রি করতে চেয়েছিলো। প্রেমে অন্ধ ছিলাম বলে প্রথমে বুঝি নি। কিন্তু যখন বুজেছি অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তাই মে'রে দিছি। একবারে শেষ করে দিছি জা'নো'য়া'রকে।"
কথা থামলো। কান্নায় ভেঙে পড়লো আহ্লাদী। তিস্তা জড়িয়ে ধরলো বোনকে। আদুরে স্বরে বললো,
"তুমি ভুল করো নি, আপা। কোনো ভুল করো নি। তবে তোমার পরিণতি যেন জমিদারের মতন না হয়। সে তো নিজের স্ত্রীর শোকে ফাঁসি দিয়ে ছিলো।"
তিস্তা আর আহ্লাদীর কথার মাঝে ছুটে এলো কঙ্কণা। হাঁপিয়ে উঠা কণ্ঠে বললো,
"তিস্তা,বিষাদিনী আপা চলে গেছে। অনেক দূরে।"
তিস্তা যেনো থ বনে রইলো। আহ্লাদী সাথে সাথে দৌড় দিলো। তিস্তা অবাক কণ্ঠে বললো,
"বিষাদিনী বুবু যাকে ভালোবাসতো,তার সাথে গিয়েছে?"
"নাহ্। বুবু যাকে ভালোবাসতো তাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে।"
তিস্তা অবাক হলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
"কাকে ভালোবাসতো?"
কঙ্কণা মাথা নিচু করে। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে বলে,
"মাস্টারমশাই।"
অন্তিম পর্ব
"প্রিয় অষ্টাদশী,
পত্রের প্রথমে আমার এক আকাশ ভালোবাসা নিও। তুমি যখন পত্রখানা হাতে পাবে, তখন আমি তোমার থেকে অনেক, অনেক দূরে। উহুম, মরবো না। বেঁচে থাকার জন্যই অনেক দূরে চলে যাবো। জানো অষ্টাদশী, প্লাবন'দা কে নিয়ে আমি কত স্বপ্ন সাজিয়ে ছিলাম? তুমি আসার পর, সেই আশার সমুদ্রে ভাঁটা পড়লো। দোষ তোমার না। আবার আমারও না। ভালোবাসা কী আর দোষের হয়? আমিও ভালোবেসে ছিলাম তুমিও ভালোবেসেছো। পার্থক্য শুধু একটাই,তোমার ভালোবাসার মানুষটা কখনোই আমার না। পর মানুষকে ভালোবেসে ছিলাম।
আমাকে দেখলে কখনো মনে হয় আমি দুঃখ পোষা নারী? মনে হয় না। কিন্তু হৃদয় মাঝে অগাধ দুঃখ পুষে রেখেছি বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। আমার মা নেই। মা হারা সন্তানের যে সারাজীবন কষ্টই পেতে হয়, নিজেকে না দেখলে জানতামই না। বেশ প্রতিবাদী ছিলাম বলে সৎ মায়ের মার খেয়েছি। বাড়ি তে চলতো শরিরের ব্যবসা সব চুপ করে সহ্য করেছি। একটা সময় পর চুপ তো হতেই হতো। তারপর কী হলো জানো? মায়ের বন্ধু একদিন আমায় একা পেয়ে খুব নোংরা আচরণ করেছে। ছোট ছিলাম। দশ এগারো বয়সের বাচ্চা আর কতটুকুই বা বুঝতো! এরপর থেকে গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। আমার একাকীত্বের সঙ্গী হলো আমার বোন বিলাসিনী।
জানো,ছোট বেলা থেকে শুনেছি প্লাবন দা আর আমার বিয়ের কথা। আমার মায়ের নাকি ইচ্ছে ছিলো। এরপর থেকেই কোঁকড়া চুলের, সুঠাম দেহী পুরুষকে জায়গা দিয়েছি মনের জমিনে। তিল তিল করে গড়ে তুলেছি ভালোবাসা। কিন্তু হাহ্! ভাগ্য যে আমার বেলা বড্ড নির্মম,নিষ্ঠুর। কিন্তু বুঝতে দেই নি কাউকে। পর মানুষকে ভালোবেসে কষ্ট পেতে হবে আজীবন। তাই চলে যাচ্ছি৷ তোমাদের মুক্ত করে। তোমার পবিত্রতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছি। ভালো থেকো তিস্তা। আমার প্লাবন'দাকে নিয়ে।
ইতি
নীল কষ্টের "বিষাদিনী"
তিস্তা থমকে গেলো কঙ্কণার হাতের চিঠিটা পড়ে তার যেনো কিছু বলার ভাষা নেই। বিষাদিনী বুবু এতটা আত্মত্যাগ করলো! আর সে কিনা স্বার্থপরের মতন আশপাশে দেখলেও না! সে অবশ্য মাস্টারমশাই এর মায়ের কথামত মাস্টারমশাই এর কাছ থেকে দূরে যেতে চেয়ে ছিলো। কিন্তু তার আগে বিষাদিনী বুবুই চলে গেলো!
তিস্তা এবার নিজেও মাস্টারমশাই এর বাড়িতে ছুটে গেলো। সবটা কাহিনী নিজের চোখে না দেখলে তার বিশ্বাস যে হবে না।
-
"তনয়া, তোমার মাইয়া তো নিরপরাধ। এই যে, মোড়লের পোলা আর তার বন্ধুরা সব স্বীকার করছে। তারা সব মাইয়ার সাথে খারাপ আচরণ করলেও তোমার মাইয়ারে ধইরাও দেখে নাই। ডাক্তার সাহেব নিজে মিথ্যা বলছে। সব লিখিত দিয়া গেছে। ঐ পোলা গো রে ধরছে। কিন্তু ডাক্তার সাহেব তো শহুরে দিদির সাথে পলাইছে।"
গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এক কথা। বিষাদিনী আর মাহিন নাকি পালিয়েছে। তিস্তা কেবল হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো? বিষাদিনী তো মাহিনের সাথে পালানোর মেয়ে না। তবে?
গ্রামে গ্রামে ছড়ালো নতুন খবর।
-
পরিশিষ্টঃ
"আর ক'টা দিন পরই তো আমাদের ঘরে ছোট পুতুল আসবে, মাস্টারমশাই। যার নাম হবে বিষাদিনী।"
তিস্তার কথায় নাক ফুলালো প্লাবন। কপাল কুঁচকে বললো,
"তোমায় কতবার বলেছি মাস্টারমশাই না বলতে?"
"কিন্তু আমি তবুও বলবো। আমার কাছে আপনি যেন মাস্টারমশাইয়ে মানানসই।"
প্লাবন কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকলো গোলগাল মেয়েটার দিকে। সাত মাসের উঁচু পেট নিয়ে মেয়েটা মধুসখী'র ঘাটে আসার জন্য সে কী বায়না। প্লাবন এগিয়ে গেলো। তিস্তার মাথায় কিছুক্ষণ আদুরে হাত বুলিয়ে দিলো।
তিস্তা কতক্ষণ চুপ থেকে আনমনেই বললো,
"মাহিন সাহেব পালিয়ে যায় নি, তাই না মাস্টারমশাই?"
প্লাবন হকচকিয়ে গেলো। আমতা আমতা স্বরে বললো,
"তাহলে কোথায় গেছে?"
"তা তো আপনি ভালো জানেন।"
প্লাবন কিছুক্ষণ মৌন থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
"চার বছর যাবত তোমায় একটা কথা বলবো, বলবো করে আর বলা হয় নি, তিস্তা।"
"কী কথা?"
তিস্তার গোল গোল উৎসুক দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে অনেক কিছু জানার আকাঙ্খা। প্লাবন ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
"মাহিন পালিয়ে যায় নি। তাকে মে'রে ভাসিয়ে দিয়েছি আমি আর বিষাদিনী।"
কথা থামিয়ে প্লাবন তিস্তার দিকে ভীতু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কিন্তু প্লাবনকে অবাক করে দিয়ে তিস্তা স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
"কীভাবে মেরেছেন? আর সত্যি টা জেনেছেন কীভাবে?"
"এ সবকিছুতে আমায় সাথ দিয়েছে, বিষাদিনী। মাহিন ছিলো মেয়ে খেঁকো। মেয়েদের প্রতি লোভ। গ্রামের মেয়েদের ও ই তুলে নিয়ে গিয়ে বন্ধুদের সাথে ফূর্তি করে মেরে ফেলতো। কিন্তু তোমার বেলা ও তেমনটা করে নি। তোমার বাবাকে ও বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো। কিন্তু তোমার বাবা সেটা না করে দেয়।"
কথাটুকু বলে থামলো প্লাবন। তিস্তা আৎকে উঠলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
"কই? আমি এসব কিছু জানতাম না তো!"
"আমিও জানতাম না। সব মাহিন স্বীকার করেছে বিষাদিনীর কাছে৷ তোমার বাবার দুর্ঘটনা কাকতালীয় ছিলো না। মাহিনেই করিয়েছিলো জিদের বশে। তাও তোমার বাবা বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না বলে তোমার চরিত্রে লেপন করেছিলো কলঙ্কের কালী। ভেবেছিলো তুমি তার নাহলে, কারো হবে না। কিন্তু তার নরপিশাচ মনেও প্রেমের ফুল ফুটেছিলো বিষাদিনীকে দেখে। অবশেষে বিষাদিনী তার সাথে একদম মিলেমিশে গিয়ে সব সত্যি বের করেছিলো। তাকে কথা দিয়েছিলো বিয়ের আগের দিন রাতে তারা পালাবে। কিন্তু আমার আর বিষাদিনী'র প্ল্যান ছিলো অন্যকিছু। মাহিন আসতেই তাকে আমরা গলায় দড়ি দিয়ে মেরে পাথরের সাথে বেঁধে আমাদের বাড়ির পিছে পরিত্যক্ত পুকুরে ভাসিয়ে দেই। এমন মানুষের বেঁচে থাকা উচিৎ না।"
তিস্তা সবটা কথা মনযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর উঁচু পেটটা নিয়ে ধীর গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
"চলুন আপার, আর দাদীর কবরটা দেখে আসি।"
প্লাবনও সাবধানে তিস্তার হাতটা ধরে হাঁটা ধরলো। তিস্তার বোন বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। তার পর পরই দাদীও মারা যান।
তিস্তা কবরস্থানের সামনে দোয়া-দরুদ পড়ে গ্রামের সরু পথটা দিয়ে হাঁটা শুরু করে। অনেক বছর আগে এই পথেই প্রথম দেখা হয়েছিলো মাস্টারমশাই এর সঙ্গে। এমনই রোদ্দুর ছিলো পরিবেশে।
তিস্তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো। প্লাবন হঠাৎ দাঁড়াতে দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
"কী সমস্যা?"
তিস্তা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
"আপনারে দেখলে আমার প্রেম প্রেম পায়,
ও আমার মধ্যাহ্নের মাস্টারমশাই।"
সমাপ্ত
[অবশেষে মনমতন শেষ করেছি। কারো অভিযোগ থাকলে নির্দ্বিধায় বইলো। আর সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবে আশাকরি। এরপর আসবো নতুন উপন্যাস নিয়ে। তবে সেটা দীর্ঘ ছুটির পর। আর বিষাদিনী আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র। কখনো বই বের করবো সৃষ্টিকর্তার কৃপায়। একটা বইয়ের নাম হবে বিষাদিনী।]