মহাবিশ্বে ব্ল্যাক হোল তৈরী হওয়ার বেশ কয়েকটি উপায় রয়েছে। যেমন কেন্দ্রীয়-পতন সুপারনোভা বা কোর-কোলাপ্স সুপারনোভা (core-collapse supernovae) থেকে শুরু করে দুটি নিউট্রন তারার একত্রিত (merging) হওয়ার ফলে প্রচুর পরিমাণে ভরের সরাসরি পতন (direct collapse) পর্যন্ত। আমাদের জানা সবচেয়ে ছোটো ব্ল্যাকহোল আমাদের সূর্যের ভরের প্রায় মাত্র 3.8 গুণ হতে পারে, যেমন “the Unicorn”, আবার বড়ো ব্ল্যাকহোল গুলো 10 বিলিয়ন সৌর ভরের বেশিও হতে পারে, যেমন গ্যালাক্সিগুলির কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল।
মহাবিশ্বের এই সবচেয়ে ঘন বস্তুগুলো ধ্বংস করা সবচেয়ে কঠিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্ল্যাকহোলেরও মৃত্যু হয়।
প্রথমে আমরা দেখবো একটি ব্ল্যাক হোলের স্থায়িত্ব। মহাবিশ্বে যেকোনো বস্তুর ক্ষেত্রে এরকম শক্তি কাজ করে যা তাকে স্থায়ীভাবে রাখতে সাহায্য করে, নাহলে তারা ধ্বংস হয়ে যেতো। একটি হাইড্রোজেন পরমাণু তার গঠনকে ধরে রাখে। একটি একক অতিবেগুনী ফোটন তার ইলেকট্রনকে আয়নিত করে পরমাণুকে ধ্বংস করতে পারে। একটি পারমাণবিক নিউক্লিয়াসকে বিস্ফোরিত করার জন্য একটি উচ্চ-শক্তির কণার প্রয়োজন হয়, যেমন একটি মহাজাগতিক রশ্মি, একটি ত্বরিত (accelerated) প্রোটন বা একটি গামা-রশ্মি ফোটন।
কিন্তু বৃহত্তর কাঠামোর জন্য, যেমন গ্রহ, নক্ষত্র বা এমনকি গ্যালাক্সির জন্যও, মহাকর্ষীয় শক্তি তাদের একসাথে ধরে রাখে। সাধারনত এই ধরনের মেগাস্ট্রাকচারকে ছিঁড়ে ফেলতে একটি অনিয়ন্ত্রিত ফিউশন বিক্রিয়া (runaway fusion reaction) অথবা একটি অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী, বাহ্যিক মহাকর্ষীয় টানের দরকার হয়। এই বাইরের মহাকর্ষীয় টান আসতে পারে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কোনো বড়ো নক্ষত্র, ব্ল্যাক হোল বা কোনো গ্যালাক্সি থেকে।
ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু জিনিষ মৌলিকভাবে আলাদা। তাদের ভর একটি আয়তনের উপর বিতরিত হওয়ার বদলে একটি সিঙ্গুলারিটিতে সংকুচিত হয়। এর সঙ্গে একটি ব্ল্যাক হোলের সমস্ত ভর-এবং-শক্তি-সম্পন্ন বিষয়বস্তু গুলো একটি ঘটনা দিগন্তের (event horizon) মধ্যে থাকে। ব্ল্যাক হোল হল মহাবিশ্বের একমাত্র বস্তু যার একটি ঘটনা দিগন্ত রয়েছে। এটি এমন একটি সীমানা যেখানে, যদি আপনি এটির মধ্যে পিছলে যান তবে ব্ল্যাকহোল থেকে পালানো অসম্ভব। যেকোনো বল যতই শক্তিশালী হোক না কেন, কখনোই বস্তু, ভর বা শক্তিকে সেই ঘটনা দিগন্তের বাইরে থেকে ব্ল্যাকহোলের বাইরের দিকে টানতে সক্ষম হবে না।
তাই যুক্তি অনুযায়ী যেকোন উপায়ে একবার ব্ল্যাকহোল তৈরি হলে, তা কেবল নিরলসভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে আমরা তাদের ঘটনা দিগন্তের ফিজিক্যাল মাপ জানতে পারি তার পার্শ্ববর্তী এলাকার ঘটনা প্রবাহ থেকে। যেমন সেটি থেকে নির্গত জেট, আ্যক্রিয়েশন বলয় (accretion disk), সক্রিয় গ্যালাকটিক কেন্দ্র (active galactic nuclei), কোয়াসার ইত্যাদি। ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের সঙ্গে যে কোন জিনিস ধাক্কা খায় বা এর মধ্যে অতিক্রম করে, তাহলে সেটা অনিবার্যভাবে ভিতরে পড়ে যাবে। তারপরে শক্তির সংরক্ষণের মাধ্যমে এটি অনিবার্যভাবে ব্ল্যাক হোলের ভর বাড়াতে থাকবে।
এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা বর্তমানে পরিচিত মহাবিশ্বের প্রতিটি ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রেই ঘটছে। অন্যান্য নক্ষত্রের উপাদান, মহাজাগতিক ধূলিকণা থেকে, আন্তঃনাক্ষত্রিক পদার্থ থেকে, গ্যাসের মেঘ, এমনকি বিগ ব্যাং থেকে অবশিষ্ট বিকিরণ এবং নিউট্রিনো সবই এখানে তাদের অবদান রাখতে পারে।
ব্ল্যাক হোলগুলি তাদের চারপাশে থাকা পদার্থ-এবং-শক্তির ঘনত্বের উপর নির্ভর করে বৃদ্ধি পায়। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন আমাদের মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাকহোলটি প্রতি 3,000 বছরে প্রায় একটি সৌর ভরের হারে বৃদ্ধি পায়, সোমব্রেরো গ্যালাক্সির (Sombrero galaxy) কেন্দ্রে অবস্থিত ব্ল্যাক হোল প্রতি দুই দশকে একটি সৌর ভরের হারে বৃদ্ধি পায়। ব্ল্যাক হোল যত বড় এবং ভারী হবে, গড়ে তত দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। অবশ্য এটি যে অন্যান্য উপাদানের মুখোমুখি হয় তার উপর নির্ভর করে। সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধির হার কমে যাবে কিন্তু মাত্র 13.8 বিলিয়ন বছর বয়সী একটি মহাবিশ্বের সময়ের তুলনায় তা শুধুই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
অন্যদিকে, ব্ল্যাক হোল শুধু সময়ের সাথে বাড়ছে না। এছাড়াও একটি প্রক্রিয়া রয়েছে যার মাধ্যমে তারা উবে যায় হয়, তা হলো হকিং বিকিরণ (Hawking radiation)। একটি ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্তের কাছাকাছি স্থানটি অনেক বেশি বক্র, কিন্তু আরও দূরে তুলনামূলক ভাবে চ্যাপ্টা। মহাকাশের ভিন্নভাবে বাঁকা অঞ্চলে কোয়ান্টাম ভ্যাকুয়ামের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে ঘটনা দিগন্তের কাছাকাছি বাঁকা অঞ্চল থেকে একটি নগণ্য পরিমাণ বিকিরণ নির্গত হতে থাকে। আপনি যদি যথেষ্ট পরিমাণ দূরত্বের একজন পর্যবেক্ষক হন, তাহলে আপনি সেই বিকিরণকে দেখতে পাবেন। অবশ্য ব্ল্যাকহোলের আ্যক্রিশন বলয়ের উপস্থিতির কারণে সেই বিকিরণকে প্রত্যক্ষ করা প্রায় অসম্ভব।
ব্ল্যাক হোলগুলি তার চারপাশের সমস্ত দিক থেকে তাপীয়, ব্ল্যাকবডি বিকিরণ (বেশিরভাগই ফোটনের আকারে) নির্গত করে। এই বিকিরণ নির্গত হয় ব্ল্যাক হোলের অবস্থানের প্রায় দশটি শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের সম-আয়তনের স্থান জুড়ে। এবং সম্ভবত সহজ ধারণার বিপরীতে (counterintuitively) দেখা যায় ব্ল্যাক হোল যত ছোট হবে, তত দ্রুত উবে যাবে।
হকিং বিকিরণ একটি অবিশ্বাস্যভাবে ধীর প্রক্রিয়া। আমাদের সূর্যের সমান ভর বিশিষ্ট একটি ব্ল্যাকহোল মিলিয়ে যেতে 10^64 বছর সময় নেয়। মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলটির জন্য সেই সময় লাগবে 10^87 বছর। আর মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্ল্যাকহোলটি উবে যাওয়ার জন্য 10^100 বছর সময় লাগতে পারে৷
বিজ্ঞানীরা তাত্ত্বিক গণনায় দেখেছেন যে পৃথিবীর ভরের একটি ব্ল্যাক হোল 10^47 বছর বেঁচে থাকবে। গিজার গ্রেট পিরামিডের ভরের ( প্রায় 6 মিলিয়ন টন) সমান একটি ব্ল্যাক হোল প্রায় এক হাজার বছর ধরে থাকবে। একটি এম্পায়ার স্টেট ভবনের ভরের ব্ল্যাক হোল (365,000 টন) প্রায় এক মাস স্থায়ী হবে। সেভাবে একজন গড় মানুষের ভরের সমপরিমাণ ভরের ব্ল্যাক হোল মাত্র এক পিকোসেকেন্ডের [10^(-12) সেকেন্ড] নিচে স্থায়ী হবে। ব্ল্যাকহোলের ভর কমে যাওয়ার সাথে সাথে সেটি আরও দ্রুত মিলিয়ে যেতে থাকে।
বিজ্ঞানীরা যা মনে করেন, মহাবিশ্বে ব্ল্যাক হোলের ভরের অস্বাভাবিক বিস্তৃত সীমা থাকতে পারে। যদি তা কম পরিমাণ ভর সম্পন্ন হয় (আনুমানিক এক বিলিয়ন টনের নিচে), তাহলে সবই বর্তমান দিনে মিলিয়ে গিয়েছে বলা চলে। এর পরের স্কেলে প্রথম ব্ল্যাকহোলের দেখা মেলে তত্ত্বগতভাবে 2.5 গুণ সৌর ভরের ব্ল্যাক হোল থেকে। সেগুলো দুটি নিউট্রন নক্ষত্রের একত্রীভবন থেকে সৃষ্ট হতে পারে। তার পর থেকে মহাবিশ্বে ক্রমশ আরও বৃহত্তর ব্ল্যাক হোলের সন্ধান পাওয়া যায়।
বর্তমানে যে সমস্ত ব্ল্যাক হোল প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান, তারা প্রত্যেকে হকিং বিকিরণের চেয়ে অনেক বেশি হারে ভর বৃদ্ধি করছে। এমনকি আন্তঃ-ছায়াপথের স্থানের (intergalactic space) গভীরে থাকা একটি বিচ্ছিন্ন ছোট ব্ল্যাক হোলকেও তার বৃদ্ধির হার হকিং বিকিরণের হারের নিচে নেমে যাওয়ার আগে মহাবিশ্বের বয়স প্রায় 10^20 বছর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়কাল তার বর্তমান বয়সের এক বিলিয়ন গুণেরও বেশি।
আসলেই একটি বাস্তবসম্মত ব্ল্যাক হোলকে মহাবিশ্বের অবশিষ্ট পদার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আন্তঃছায়াপথ মাধ্যমে (intergalactic medium) যদি কোনো ব্ল্যাকহোল থেকে থাকে তাহলেও সেখানে মহাজাগতিক রশ্মি, নক্ষত্রের আলো, নিউট্রিনো, ডার্ক ম্যাটার ইত্যাদি বস্তু এবং শক্তি রয়েছে। আরও রয়েছে মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমির (cosmic microwave background) বিকিরণ। সুতরাং একটি ব্ল্যাকহোল ক্রমাগত পদার্থ এবং শক্তি শোষণ করছে এবং ফলস্বরূপ ভর এবং আকার উভয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে। হ্যাঁ, ব্ল্যাকহোল হকিং বিকিরণের আকারে শক্তিকেও দূরে বিকিরণ করে, কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বে যে সমস্ত ব্ল্যাক হোল আসলে বিদ্যমান, তার জন্য বৃদ্ধির হার বিকিরণের হারের নিচে নামতে কমপক্ষে 100 কুইন্টিলিয়ন বছর সময় লাগতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। এরপর তাদের শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে যাওয়ার জন্য আরও অনেক বেশি সময় লাগবে।
ব্ল্যাক হোলগুলি শেষ পর্যন্ত 'অস্থিতিশীল' হয়ে উঠবে এবং বিকিরণের মাধ্যমে অদৃশ্য হয়ে যাবে। কিন্তু যদি খুব কম ভরের ব্ল্যাকহোল না হয, তাহলে বর্তমান মহাবিশ্বের আর কিছুই সেই ঘটনার সাক্ষী হতে পারবে না।
লিখাঃ সরোজ নাগ।
কাল্পনিক ছবিটি ESA/Hubble এর সৌজন্যে প্রাপ্ত। তথ্যগুলি নাসা, ESO, উইকিপিডিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।