সময় সম্পর্কে কিছু কথা



সময় সম্পর্কে আমদের বেশ কিছু ধারণা রয়েছে। তাদের মধ্যে বেশ কিছু ধারণা খুবই চিত্তাকর্ষক। সময় আপেক্ষিক, পরম (absolute) নয়। সময় সবসময় এগিয়ে যায়, পিছিয়ে যায় না। যদিও সময়ের সেই একমুখী তীরের ব্যাখ্যা আজও আমাদের কাছে নেই। তাপগতি বিদ্যা অনুযায়ী (Thermodynamically), মহাবিশ্বের একটি সময়ের তীর রয়েছে, যা এনট্রপি বৃদ্ধির মতো একই দিকে "প্রবাহিত" হয়। এবং যখন আমরা একটি মৌলিক স্তরে মহাবিশ্ব সম্পর্কে অনুসন্ধান করি, তখন দেখা যায় যে সময় মৌলিক নাও হতে পারে। কিছু বিজ্ঞানীর মতে আমাদের পর্যবেক্ষণ করা জগতের মধ্যে সময়ের অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে!

অবশ্যই আমরা এটিকে পরিমাপ করতে পারি, এটিকে গণনা করতে পারি এবং এর প্রবাহ ও প্রবাহের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করতে পারি। কিন্তু তার সাথে এটাও চিন্তা করতে হবে যে কোনো একটি ঘটনার শুরু এবং শেষের মধ্যে আপনার "কত সময় কেটে গেছে" - এর পরিমাপ সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে আপনি কোথায় আছেন এবং আপনি যখন এই পর্যবেক্ষণগুলি করছেন তখন আপনি কীভাবে চলছেন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন আমাদের দেখিয়েছেন অন্য কোনো নির্দেশ তন্ত্র সাপেক্ষে বেশী ভরযুক্ত বস্তুর কাছে সময় ধীরে চলে এবং বেশী গতিসম্পন্ন বস্তুতেও সময় ধীরে চলে। তাই সময় আপেক্ষিক। মহাবিশ্বে কোথাও কোনো পরম নির্দেশ তন্ত্র না থাকার জন্য সময় পরম নয়।

হ্যাঁ, আপনি "কত সময় অতিবাহিত হয়েছে?", "এই ঘটনাটি কখন ঘটেছে?" বা এমনকি "কোন ঘটনাটি প্রথম ঘটেছিল?" এই ধরনের প্রশ্নগুলোর বিভিন্ন উত্তর পাবেন। তবে উত্তরগুলোর কোনোটাই অন্য উত্তরের চেয়ে বেশি "সঠিক" বা "ভুল" নয়। আপনি কোথায় আছেন এবং আপনি কীভাবে চলছেন তার উপর নির্ভর করে।

এটা বোঝা যায় আপেক্ষিক সময় সম্পর্কে ধারণা "সময়ের অস্তিত্ব নেই" - এই ধারণাটি দাবি করার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু এটা কি এমন হতে পারে যে, "সম্ভবত আমরা শুধুমাত্র সময়ের অস্তিত্ব উপলব্ধি করি, তা আসলে বাস্তব নয়?" 

আমরা এটিকে একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে পারি, তা হলো পদার্থবিজ্ঞানে প্রতিসাম্যের ধারণা (notions of symmetries)। এখনো পর্যন্ত আমার যেমন জানি, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলি সময়-প্রতিসম (time-symmetric)। আপনি যদি একটি বলকে অভিকর্ষের প্রভাবে পড়তে দেখেন, সেক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে। প্রথমত সময় যখন সামনের দিকে চলে তখন মাধ্যাকর্ষণ বলটিকে "উঁচু" স্থান থেকে "নিচের" দিকে টেনে নামায়। অথবা দ্বিতীয়ত, সময় যখন পিছনের দিকে ছোটে তখন বলটি নীচের অবস্থান থেকে উপরের দিকে ওঠার সাথে সাথে মাধ্যাকর্ষণ তার গতিকে প্রতিহত করতে থাকে।

এই দুটো আলাদা দৃষ্টিকোন বৈজ্ঞানিক ভাবে ঠিক। প্রকৃতপক্ষে, পদার্থবিদ্যার প্রায় সমস্ত সূত্র যেমন গতি, মহাকর্ষ, তড়িৎচুম্বকত্ব, এমনকি শক্তিশালী পারমাণবিক বল  সম্পূর্ণরূপে উল্টানো সময়েও (time-reversible) সত্য থাকে। তারা সময়ের সামনে বা পিছন অভিমুখে একইরকম থাকে। শুধুমাত্র একটি ভৌত ​​ব্যবস্থার পরিবর্তন দেখে সময়ের অভিমুখ বোঝা সম্ভব নয়।

তবে সময়ের মধ্যে এগিয়ে যাওয়া এবং সময়ের মধ্যে পিছিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটি সিস্টেমের পার্থক্য সনাক্ত করার দুটি উপায় রয়েছে। প্রথমটি হল তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মতো দুর্বল পারমাণবিক বলের (weak nuclear force) মাধ্যমে যেভাবে ঘটনাগুলি এগিয়ে যায়।

কল্পনা করা যাক একটি ভারী পারমাণবিক নিউক্লিয়াস আছে, প্রোটন এবং নিউট্রন পূর্ণ। প্রদত্ত সংখ্যক প্রোটনের জন্য যদি সেই নিউক্লিয়াসে প্রচুর পরিমাণে নিউট্রন থাকে, তবে নিউক্লিয়াসটি একটি নির্দিষ্ট ধরণের তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা হলো বিটা-মাইনাস ক্ষয়। বিটা-মাইনাস ক্ষয় হল যখন নিউক্লিয়াসের একটি নিউট্রন একটি প্রোটন, একটি ইলেকট্রন এবং একটি অ্যান্টি নিউট্রিনোতে ক্ষয় হয়ে যায়। এমনকি এই ঘটনা মুক্ত নিউট্রনের ক্ষেত্রেও ঘটে যা কোনো বৃহত্তর পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের অংশ নয়। কিন্তু এটি কখনই ঘটে না যেখানে একটি প্রোটন, একটি ইলেকট্রন এবং একটি অ্যান্টি নিউট্রিনো স্বতঃস্ফূর্তভাবে একসাথে মিথস্ক্রিয়া করে একটি নিউট্রন তৈরি করে। প্রকৃতপক্ষে দুর্বল পারমাণবিক বল পদার্থবিজ্ঞানে সময়-অসামঞ্জস্যতার (time-asymmetric) প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

দ্বিতীয় উপায়টি আমাদের কাছে আরও বেশি পরিচিত। যখন আপনি একটা পাত্রে ডিম ভেঙে গুলবেন, জল ভর্তি গ্লাস ঘরের মেঝেতে ফেলে ভাঙবেন অথবা একটি উত্তপ্ত ঘর এবং একটি ঠান্ডা ঘরের মধ্যবর্তী একমাত্র দরজা খুলবেন - প্রতিটি ক্ষেত্রেই আপনি এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করবেন যেখানে সময়ের একটি থার্মোডাইনামিক তীর থাকবে।

আপনি অবশ্যই আগে এনট্রপির ধারণার কথা শুনে থাকতে পারেন, যাকে অনেক সময়েই সরলীকরণ করে সিস্টেমের বিশৃঙ্খলার পরিমাপ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। প্রকৃত পক্ষে যা ঘটে তা হলো, যে কোনও ফিজিক্যাল সিস্টেমের ভিতরে কিছু শক্তি গ্রেডিয়েন্টের সীমা থাকবে। একটি না ঘাঁটা ডিমে অ্যালবুমেন (সাদা অংশ) এবং কুসুমের মধ্যে একটি শক্তি গ্রেডিয়েন্ট থাকে।কুসুমের চারপাশের শক্তিসীমার বাধা ডিমের ভিতরের জিনিসগুলিকে সমানভাবে মিশ্রিত করা থেকে বিরত রাখে। একটি রান্না না করা ডিমে রাসায়নিক পোটেনশিয়াল শক্তি রয়েছে। যখন আপনি ডিমটি রান্না করেন সেই শক্তি মুক্তি পেয়ে নতুন বন্ধন তৈরি হবে।আবার কাচের গ্লাসের কাঠামোতেও এই পোটেনশিয়াল শক্তি রয়েছে যে শক্তি গ্লাসটি চূর্ণবিচূর্ণ হলে মুক্তি পায়।

তবে সম্ভবত এনট্রপি সম্পর্কে কথা বলার সবচেয়ে স্মার্ট উপায় হলো পাশাপাশি থাকা একটা ঘরের দুটো পৃথক অংশ, গরম ঘর এবং একটা ঠান্ডা ঘর। ঘরটির কোনো দিকে জানালা বা সেই রকমের ফাঁকা স্থান নেই, শুধু দুটো অংশ একটা ডিভাইডার দিয়ে আলাদা করা রয়েছে। ঘরের উত্তপ্ত অংশটিতে যদি প্রচুর সংখ্যায় গ্যাসীয় অনু থাকে তবে সেগুলি সবই একে অপরের সাথে তাপীয় ভারসাম্য (thermal equilibrium) অবস্থায় থাকবে। যখন তারা একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে, তখন গরম দিকের কোন অংশই গরম বা ঠান্ডা হবে না। কারণ সেই ঘরের এক অংশ থেকে অন্য অংশে তাপ প্রবাহের জন্য কোনো শক্তি গ্রেডিয়েন্ট নেই। আবার ঠান্ডা দিকে অবিকল একই বৈশিষ্ট্য রয়েছে, শুধু তাপীয় ভারসাম্য অনেক কম তাপমাত্রায় ঘটে।

কিন্তু এখন, আপনি যদি ঘরের গরম ও ঠান্ডা অংশের মাঝের ডিভাইডারটিকে সরিয়ে দেন, তাহলে কী ঘটবে? উত্তর হল গরম কণা এবং ঠান্ডা কণা মিশে যাবে, "সিস্টেমের বিশৃঙ্খলার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে", এবং একটি মধ্যবর্তী-তাপমাত্রা বিশিষ্ট ঘর তৈরি করবে যেখানে সমস্ত কণা একই ভারসাম্য তাপমাত্রায় আসবে। ভারসাম্য পৌঁছানোর আগে সিস্টেম থেকে শক্তি বের করা যেতে পারে। কিন্তু তার পরে, শক্তি বের করা সম্ভব নয়। যখন আমরা সর্বাধিক এনট্রপির অবস্থা সম্পর্কে কথা বলি, তখন আমরা এমন একটি অবস্থার কথা বলি যেখান থেকে আর কোনো শক্তি আহরণ করা যায় না। পদার্থ বিজ্ঞান অনুযায়ী একটি সর্বোচ্চ এনট্রপি সিস্টেম কার্য করতে পারে না।

কার্য ফিজিক্যালি বাস্তব, এনট্রপি এবং তাপগতিবিদ্যা বাস্তব, সময়ও এদের থেকে আলাদা নয়। এই আলোচনায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা রয়েছে। যদিও এটি সত্য যে সময় বাস্তব, তবুও নিম্নলিখিত তথ্যগুলি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ৷

1) আমরা জানি না কি কারণে সময়ের তীর একটি অভিমুখে চলে। আমরা সর্বদা সময়কে সামনের দিকে প্রবাহিত হিসেবে লক্ষ্য করি, পিছনের দিকে নয়। আমরা সময়ের গতিকে বুঝতে পারি। আমরা দেখি সমস্ত ভৌত বস্তু এবং পরিমাণের মতোই সময়ের সাথে এগিয়ে যাওয়া পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের অধীন। কিন্তু যখনই সিস্টেমের এনট্রপি স্থির থাকে, ধীরে ধীরে বাড়ে, দ্রুত বৃদ্ধি পায়, অথবা কৃত্রিমভাবে এতে বাইরে থেকে শক্তি প্রবেশ করিয়ে এনট্রপিকে কমানো হয়, সকল ক্ষেত্রেই সময়ের তীরটি কখনো থেমে যায় না অথবা বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয় না।

2) যদিও সময় অবশ্যই বাস্তব, এটি মৌলিক হতে পারে বা নাও হতে পারে। সাধারণত আমরা এনট্রপিকে derived পরিমাণ হিসাবে দেখি এবং সময়কে মৌলিক হিসাবে বিবেচনা করি। অবশ্য অন্তত গাণিতিকভাবে এনট্রপিকে একটি মৌলিক পরিমাণ হিসাবে বিবেচনা করা সম্ভব। তখন সময় emergent পরিমাণের মতো ব্যবহার করতে পারে। যদিও সে বিষয়টি বড়ো জটিল অঙ্ক।

সময় মহাবিশ্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা বলা যেতে পারে "এখন" বা "বর্তমান" বলতে পর্যবেক্ষণ করা বা পরিমাপ করা ঘটনাগুলির সঙ্গে এখনও পর্যবেক্ষণ বা পরিমাপ না করা ঘটনাগুলোর মধ্যবর্তী সীমানাকে বোঝানো যায়। যাইহোক সময়কে  আমরা পরিমাপ করতে, পর্যবেক্ষণ করতে পারি এবং গণনা করতে পারি। পরম সময় বলে কিছু নেই। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, আপনি কত দ্রুত গতিতে চলেছেন বা আপনার চারপাশে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রটি কতটা শক্তিশালী, আপনার কাছে থাকা যেকোনো ঘড়ি সবসময় একই হারে সময়কে রেকর্ড করবে, প্রতি সেকেন্ডে এক সেকেন্ড। যেকোনো পর্যবেক্ষকের কাছেই তাঁর সময় বহমান। 


লিখাঃ সরোজ নাগ।

চিত্র পরিচিতিঃ- বাম দিকে প্রাথমিক অবস্থায় সেট আপ করা একটি সিস্টেম, গরম এবং ঠান্ডা ঘরগুলি আলাদা করা। প্রতিটি কক্ষ নিজস্ব তাপীয় ভারসাম্যে রয়েছে। দুটি কক্ষকে পৃথককারী ডিভাইডারটি খোলা হলে কক্ষের গ্যাসগুলি মিশে যাবে, প্রক্রিয়ায় এনট্রপি বৃদ্ধি পাবে। সৌজন্যে Htkym and Dhollm/Wikimedia Commons.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম