আমাদের বর্তমান মহাজাগতিক মডেল অনুসারে, মহাবিশ্ব প্রায় 13.8 বিলিয়ন বছর আগে একটি বিগ ব্যাং দিয়ে শুরু হয়েছিল। মহাবিশ্ব তার প্রাথমিক অবস্থার একটি পর্যায়ে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় প্লাজমার একটি অস্বচ্ছ মেঘ দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল, সেই অবস্থা কোনো সাধারণ এবং চার্জবিহীন পরমাণুর গঠনে বাধা দিতো। প্রায় 380,000 বছর পরে মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত ও শীতল হতে শুরু করে এবং সমগ্র মহাবিশ্ব জুড়ে আলোর বন্যা বয়ে যায়। সেই আভা এখন মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB) হিসাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে দৃশ্যমান, যা 1963 সালে আবিষ্কৃত হয়।
CMB সম্পর্কে একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য যা অনেক মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল তা হল তাপমাত্রার ক্ষুদ্র ওঠানামা বা ফ্ল্যাকচুয়েশন। এটি প্রাথমিক মহাবিশ্ব সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করতে পারে। বিশেষ করে, CMB তে একরকম বড় স্পট রয়েছে যা আশেপাশের আভা থেকে শীতল, যা CMB Cold Spot নামে পরিচিত। কয়েক দশক ধরে CMB-এর তাপমাত্রার ফ্ল্যাকচুয়েশন সম্পর্কে অধ্যয়ন করার পর বিজ্ঞানীদের একটি টীম সম্প্রতি CMB -এর আভায় সবচেয়ে বড় শীতল দাগের অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছেন। এমনিতে CMB -এর তাপমাত্রা 2.725 কেলভিন। কিন্তু এই Cold Spot অংশের তাপমাত্রা তার পারিপার্শ্বিক অঞ্চলের তুলনায় সামান্য (70 µK or 0.00007 কেলভিন) ঠান্ডা। CMB কোল্ড স্পটটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি অত্যাশ্চর্য গঠন খুঁজে পেয়েছেন। সেটি হলো Eridanus Supervoid. সাতটি দেশের 300 জন বিজ্ঞানী নিয়ে গঠিত গবেষকদের একটি আন্তর্জাতিক দল Dark Energy Survey (DES) এর মাধ্যমে সম্প্রতি এই গবেষণাটি সম্পন্ন করেন।
CMB আবিষ্কারের পর থেকে এর সম্মন্ধে আরও বিস্তারিতভাবে অধ্যয়নের জন্য একাধিক মিশন পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সোভিয়েত RELIKT-1 মিশন Prognoz 9 কৃত্রিম উপগ্রহ (1983 সালে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল) এবং নাসার Cosmic Background Explorer (COBE) মিশন (সময়কাল 1989 থেকে 1993)। পরবর্তী কালে Wilkinson Microwave Anisotropy Probe (WMAP) (মিশনের শুরু 2001, শেষ হয় 2010 সালে) আরও বিস্তারিত গবেষণা করে। এরপর আরও নিখুঁত ভাবে CMB এর আভায় তাপমাত্রার পার্থক্য এবং ঘনত্বের ছোট আকারের তারতম্য পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে ESA -এর প্ল্যাঙ্ক মহাকাশযান (2009-2013) দ্বারা। যেটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিস্তারিত CMB তাপমাত্রার মানচিত্র প্রদান করেছে। দুর্ভাগ্যবশত, এই মানচিত্রগুলি সিএমবি কোল্ড স্পটের উপযুক্ত ব্যাখ্যা করতে পারে নি। তাই এই অসামঞ্জস্যতা অনেক ধরণের ব্যাখ্যার জন্ম দিয়েছে। তার মধ্যে সমান্তরাল মহাবিশ্বের সম্ভাব্য অস্তিত্ব পর্যন্ত ভাবা হয়েছিল!
বিজ্ঞানীরা CMB তে যে গভীর কোল্ড স্পটের সন্ধান পেয়েছেন তা তুলনামূলকভাবে বড় স্কেলে আশেপাশের অঞ্চল থেকে প্রায় 70 মাইক্রোকেলভিন কম তাপমাত্রা সম্পন্ন। সেই ঠান্ডা স্থানটি CMB এর গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশ গরম অঞ্চল দ্বারা বেষ্টিত। বিজ্ঞানীদের কাছে এই শীতল স্থানটি স্ট্যান্ডার্ড মহাজাগতিক মডেল ও মহাজাগতিক স্ফীতি তত্ত্বের (cosmic inflationary theory) সাথে মেলে না।মহাবিশ্বের প্রারম্ভিক পর্যায়ে সমগ্ৰ মহাবিশ্ব ছিলো isotropic (যথেষ্ট বড় স্থানিক স্কেলে নির্দিষ্ট সময়ে, মহাবিশ্ব প্রতিটি দিকে একই রকম দেখায়) এবং homogeneous (যথেষ্ট বড় স্থানিক স্কেলে মহাবিশ্ব প্রতিটি অবস্থানে একই রকম দেখায়)। কিন্তু CMB তে কোল্ড স্পটের অস্তিত্ত্ব ক্ষুদ্র অসাম্যতাকে নির্দেশ করে। তাহলে কি আমাদের মহাবিশ্ব কোনোভাবে এই অস্বাভাবিক নিম্ন-তাপমাত্রার অঞ্চল নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলো?
এই তাপমাত্রার ওঠানামা কোথা থেকে আসে তা সনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। উত্তপ্ত বিগ ব্যাং এর শুরুতেও মহাবিশ্বের সর্বত্র সত্যিই একই তাপমাত্রা ছিল। স্থানভেদে মহাবিশ্বের ঘনত্বে শুধুমাত্র অতি অল্প মাত্রায় (প্রায় 30,000 ভাগের এর মধ্যে 1অংশে) অসম্পূর্ণতা ছিল যা মহাস্ফীতি তত্ত্ব অনুযায়ী স্বীকৃত। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে দেখেছেন মহাকাশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন তাপমাত্রা পাওয়ার কারণটি হোল মহাকর্ষীয় রেডশিফ্টের ঘটনা। বস্তুর উপস্থিতি স্পেসকে বাঁকিয়ে দেয়। যেখানে স্থানটি আরও তীব্রভাবে বাঁকা হয়, আলোকে সেই মহাকর্ষকে "কাটিয়ে উঠতে" আরও শক্তি হারাতে হয়। এটি Sachs-Wolfe effect নামে পরিচিত। এবং এটি CMB-তে তাপমাত্রার পার্থক্যের প্রাথমিক কারণ।
কিন্তু আরেকটি আরো সূক্ষ্ম প্রভাব আছে, তা হোল integrated Sachs-Wolfe effect. মহাবিশ্বে কাঠামো তৈরি হওয়ার সাথে সাথে মহাকর্ষ যখন আরও বেশি ভরকে একত্রিত করে তখন ক্লাস্টার ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং শূন্যতা তৈরি হয়। বিকিরণ, পদার্থ এবং ডার্ক এনার্জির আপেক্ষিক অনুপাত একে অপরের সাথে পরিবর্তিত হয়। এর কারণে কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে প্রবেশ করার মহাকর্ষীয় প্রভাব সেই অঞ্চল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার মহাকর্ষীয় প্রভাব সমান নাও হতে পারে। মহাবিশ্ব বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে তার কাঠামো তৈরি তৈরি হয় এবং কিছু অঞ্চল আরও বেশি পদার্থ-সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, আর কিছু অঞ্চলে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এই পার্থক্য সেই অঞ্চলগুলির মধ্য দিয়ে যাওয়া কোনও আলোকে প্রভাবিত করে।
মহাকাশে সাধারণত দুটি গ্যালাক্সি অথবা দুটি গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের মধ্যে অবস্থিত বিশাল শূন্য অঞ্চলগুলিকে মহাজাগতিক শূন্যতা (Cosmic void) বলে। যেগুলি (ডার্ক ম্যাটার সহ) মহাবিশ্বের বৃহৎ আকারের কাঠামো তৈরি করে। সেই আন্তঃছায়াপথ অঞ্চলে (intergalactic space) নক্ষত্র, ধূলো ও গ্যাসের [ Intergalactic Medium (IGM) ] তুলনামূলক অনুপস্থিতিতে রয়েছে কসমিক ভয়েড।
কল্পনা করুন, আপনার কাছে দুটি ভিন্ন স্থান রয়েছে, একটি বৃহৎ পরিসরে খুব বেশি ঘনত্ব (যেমন একটি সুপারক্লাস্টার) এবং একটি বৃহৎ পরিসরে খুব কম ঘনত্ব (মহাজাগতিক শূন্যতার মতো)। এর সঙ্গে রয়েছে কিছু ডার্ক এনার্জি। এই তাত্ত্বিক অস্তিত্বের ঘনত্ব মহাবিশ্বের প্রসারণের সাথে পরিবর্তিত হয় না। এবার আরও কল্পনা করা যাক একটি ফোটন মহাকাশের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে একটি বিশাল অত্যধিক ঘনত্ব বা একটি বিশাল নিম্ন ঘনত্বের সম্মুখীন হয়। সেই ফোটনটির মোট শক্তি এই পরিবর্তনশীল ঘনত্বের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে উপস্থিত ডার্ক এনার্জির সম্ভাব্য প্রভাবে পরিবর্তিত হয়। একে মহাকর্ষীয় রেড শিফট প্রভাব (gravitational redshift effect) বলে। এর কারণে যথেষ্ট বৃহৎ শূন্যতার মধ্যে প্রবেশ করে তারপরে নির্গত হওয়ার পর তার মোট শক্তির পরিমাণ কমে যায়। (সমগ্র বিষয়টি অত্যন্ত জটিল, তাই বর্ণনা করছি না)
এখানে তাত্ত্বিক ধারণাটি পরীক্ষাযোগ্য হয়ে ওঠে। Dark Energy Survey (DES) এর বিজ্ঞানীরা ঠিক এই কাজটিই করেছেন। তাঁরা নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন যে, হ্যাঁ, সেখানে একটি সুপারভয়েড রয়েছে এবং এটিতে খুব কম ঘনত্বের মতো অনেক বেশি মাত্রার integrated Sachs-Wolfe effect দেখা যায়। যদিও এর আগে 6-10 বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে কিছু নিম্ন ঘনত্ব সম্পন্ন সুপারভয়েড পাওয়া গিয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রে এই এফেক্টের প্রভাব বেশ কম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। এখন Eridanus নক্ষত্রপুঞ্জে আমাদের থেকে প্রায় 1.9 বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে একটা বিশাল সুপারভয়েডের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর নাম Eridanus Supervoid. এরিডেনাস সুপারভয়েড সম্ভবত বর্তমান বিশ্বের বহত্তম শূন্যস্থান। বিজ্ঞানীদের এই গবেষণাটির মতে (আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও প্রমাণিত হয় নি) এই সুপারভয়েড এবং CMB -এর কোল্ড স্পটের একটি কার্য-কারন সম্পর্ক রয়েছে।
অনেক বিজ্ঞানীরা অবশ্য CMB -এর কোল্ড স্পটের পেছনে Lambda Cold Dark Matter (Λ CDM) model এর সম্ভাবনাকে নির্দেশ করেন। এই মডেল অনুযায়ী ডার্ক ম্যাটার বৃহৎ, ধীর গতিশীল কণা ("ঠান্ডা") দ্বারা গঠিত যা একটি সম্প্রসারণমূলক শক্তি – ডার্ক এনার্জি দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়। তবে সেই পথে ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জির সম্পর্কে বিশদভাবে গবেষণার প্রয়োজন।
মহাবিশ্বের বৃহৎ আকারের কাঠামো পরিমাপ করার বিভিন্ন উপায় রয়েছে, গ্যালাক্সি গণনা থেকে শুরু করে মহাকর্ষীয় লেন্সিং (gravitational lensing) এবং তার পটভূমির আলোর রেডশিফটের ওপর কাঠামোটির সামগ্রিক প্রভাব ইত্যাদি। এই বিশেষ ক্ষেত্রে, একটি মহাকর্ষীয় লেন্সিং মানচিত্রের নির্মাণই এই সুপারভয়েডের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিল। যদিও এখনও আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত নই এই সুপারভয়েডটি CMB -এর কোল্ড স্পটটির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করে, তবে অদূর ভবিষ্যতে তার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি।
বর্তমানে কাজ করে চলেছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। 2023 সালে ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সির ইউক্লিড মিশন শুরু হওয়ার জন্য প্রস্তুত, ভেরা রুবিন অবজারভেটরি এবং নাসার ন্যান্সি গ্রেস রোমান টেলিস্কোপ শীঘ্রই চালু হতে যাচ্ছে। এর প্রতিটিই আমাদের অনুসন্ধানকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। আপাতত আমাদের কাছে CMB কোল্ড স্পটটির কারণ সম্পর্কে যথেষ্ট সম্ভাব্য উত্তর আছে।
লিখাঃ সরোজ নাগ
তথ্যসূত্র – 1) The DES view of the Eridanus supervoid and the CMB cold spot. Monthly Notices of the Royal Astronomical Society, Volume 510, Issue 1, February 2022, Pp. 216-229
2) এছাড়া নাসা ও অন্যান্য ওয়েবসাইট।
চিত্র পরিচিতি – 1) তিনটি পৃথক মিশন থেকে প্রাপ্ত CMB. সৌজন্যে NASA/COBE/DMR; NASA/WMAP science team; ESA and the Planck collaboration.
2) দক্ষিণ গ্যালাকটিক গোলার্ধের ইরিডানাস নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত কোল্ড স্পট। ইনসেটে মহাবিশ্বের এই প্যাচের মাইক্রোওয়েভ তাপমাত্রার মানচিত্র দেখা যাচ্ছে, যেমনটি ESA প্ল্যাঙ্ক স্যাটেলাইট দ্বারা ম্যাপ করা হয়েছে। প্রধান চিত্রটি DES বিজ্ঞানীদের দ্বারা তৈরি ডার্ক ম্যাটার বিতরণের মানচিত্রকে চিত্রিত করে। সৌজন্যে Gergö Kránicz এবং András Kovács.