মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই - মম সাহা

 


"আপনারে দেখলে আমার ভীষণ প্রেম প্রেম কেন পায়, মাস্টারমশাই?"


এমন এক বাক্য, শুভ্রা রাঙা ছোট্ট কাগজে কেউ লিখে একটা নীল রাঙা টিপসহ রেখে দিয়ে গিয়েছে প্লাবনের টেবিলটা'র উপরে। মধ্যাহ্নে প্রাইভেট পড়তে আসা এক ঝাঁক কিশোর কিশোরী তখন বেশ হাসাহাসি করলো মাস্টারমশাই'র টেবিলের উপর থাকা চিরকুট খানা দেখে। হাসাহাসি'র শব্দ শুনে যখন তাদের গম্ভীরমুখো মাস্টারমশাই পাশের রুম থেকে ছুটে আসলো এক রাম ধমক দেওয়ার উদ্দেশ্যে তখন এই চিরকুট দেখে তার শরীর কাঁপিয়ে কাশি শুরু হলো। ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে লজ্জায় জেনো মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। 


চিরকুট খানা নিজের ঢোলা ফতুয়াটা'র পকেটের ভাজে খুব বিরক্তে ছুঁড়ে ফেলে চোখ রাঙিয়ে উঠে মাস্টারমশাই। শ্যামবর্ণা, চাপদাড়ি ওয়ালা এই পঁচিশের যুবকের চোখ রাঙানিতে চুপ হয়ে যায় ভীষণ হাসাহাসি। থেমে যায় কৌতুক মাখানো মজা। সবাই নিজেদের আসনে চুপটি করে বসে পরে। 


মাস্টারমশাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কালোরঙের শক্ত বোর্ডে সাদা চকের আচড় কাটতেই হুড়মুড় করে পাঠশালার দরজায় হাজির হলো,পাঠশালার অতি জনপ্রিয়, চঞ্চল, সপ্তদশী কিশোরী, উড়নচণ্ডী ওরফে তিস্তা। 


পাঠশালা'র মধ্যিখানে অবস্থানরত ছাত্রী ভ্রমরী উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো, 

-'তিস্তা, পঁচা বস্তা আসছে মাস্টারমশাইইইই।'


মাস্টারমশাই এর হাতের চক খানা মাটিতে পড়ে যায়। বিরাট চিৎকারে আর কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া কান্ডে'র ভাবনায় একটু অন্যমনস্ক ছিলো বিধায় চকের এ দশা। 


তিস্তা মাস্টারমশাই এর হতভম্ব অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে দেয়। মাঝ সিঁথিকাটা মাথার দু'টা ছোট ছোট ঘাঁড় অব্দি ঝুলে থাকা বেনী ঘুরাতে ঘুরাতে বলে, 

-'মাস্টারমশাই'র দাঁতে পোকা, 

মাস্টারমশাই বড্ড বোকা।'


তিস্তা'র এই নির্বোধ ছন্দখানি কারো কান অব্দি পৌঁছায় নি। তিস্তা'র কান'ই নিজেকে ধন্য মনে করলো এত সুন্দর ছন্দখানা শুনে। তাছাড়া মাস্টারমশাই'র কান অব্দি ছন্দটা গেলে উড়নচণ্ডী'র গাল দুটো চড়িয়ে ছাল তুলে দিতো। এ জন্য নিজের কন্ঠস্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে তিস্তা। সে ধীর শব্দ প্রদান করে ছন্দখানি বের করেছে বলেই তার গাল দুটো আজ বেঁচে গেলো। 


এতক্ষণ অব্দি ঘটে যাওয়া সবটা বিব্রতকর পরিস্থিতি'র রাগ তিস্তা'র উপর গিয়ে পড়লো। চিকন বেতের লাঠিটা দিয়ে তিস্তার বা'হাতের বাহুতে আঘাত করে মাস্টারমশাই। শাসানি'র স্বরে বলে, 

-'তুই রোজ রোজ পড়তে আসিস দেড়ি করে। বাড়িতে কী কাজ করিস রে? তোর বাবা রে আমার কাছে আসতে বলবি। তোর আর পড়াশোনা হবে না। এতটুকুতেই থামাতে বলবো। বিয়ে করে সংসার ঠেলবি সেটাই ভালো।'


তিস্তা মাথা নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে মাটির মাঝে আচর কাটে। রোজ রোজ মাস্টারমশাই একই কথা বলে, নতুন কিছু বুঝি বলা যায় না? বিয়ে করলে কী আর সে অত দুষ্টুমি করতে পারবে? মাস্টারমশাই টা বড্ড বোকা। বুঝে কম। 


তিস্তা'র প্রাণপ্রিয় সই নিজের কণ্ঠটা সাধারনের থেকে একটু উঁচু করে বললো,

-'মাস্টারমশাই, উড়নচণ্ডী তো আজ অনেক আগে পাঠশালাতে আসবো বইল্যা ঘর থেইকা বের হইছে। তবুও ও অত দেরি করলো ক্যান? কোথায় ছিলো জিজ্ঞেস করেন।'


ভ্রমরীর কথা শুনে প্লাবনের ভ্রু খানিকটা কুঁচকে আসে। বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলে, 

-"কার বাড়িতে আম,জাম,কাঁঠাল এসব চুরি করতে গিয়েছিলি? নাকি বেলীফুল কুড়াতে গিয়েছিলি?'


তিস্তা নিজের সই'র পানে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে। সঠিক সময়, সঠিক বাঁশটা খাওয়াতে মেয়েটা উস্তাদ। 


প্লাবন তিস্তা'র কান টেনে দিয়ে বলে,

-'আর যদি কখনো দেরি হয়,তবে এ'মুখো হবি না। মুখে কী কুলুপ এঁটেছিস? কথা বলিস না কেনো?'


-'কথা বললেই তো আপনি মারবেন মাস্টারমশাই।'


তিস্তা'র সহজ সরল কথাটাতে তার কানে টান খাওয়ার পরিমাণ বাড়লো, সাথে বাড়লো মাস্টারমশাই এর কণ্ঠের তেজ, চেঁচিয়ে বললেন,

-'প্রশ্নের আগে তোর জবাব তৈরী কিন্তু কাজের বেলা কাঁচকলা। যা টেবিলে গিয়ে বস। আর বিরক্ত করবি না কেমন? যা।'


তিস্তা মাথা নাড়িয়ে ধপ করে ভ্রমরী'র পাশে গিয়ে বসলো। তাল মাটিতে পড়ার মতন শব্দ করে মার বসালো সই এর পিঠে। ভ্রমরী ব্যাথাতুর কণ্ঠে 'আহ্' করে উঠলো।


ভেসে এলো মাস্টারমশাই'র আরেক দফা রামধমক। অতঃপর কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলো পুরোটা সময়। কখনো একে,কখনো ওকে বিরক্ত করে গেলো পড়ার সময় টুকু। মাঝে মাঝে পিঠে বেতের আঘাতও খেলো। এ আর নতুন কী! প্রতিদিনে'র পুরাতন রুটিন। 


পড়া প্রায় শেষের দিকে। ভ্রমরী এতক্ষণে পেটে জমিয়ে রাখা কথাটা আর জমিয়ে রাখতে না পেরে বলেই ফেললো,

-'জানিস তিস্তা, মাস্টারমশাই'কে কে জেনো চিরকুট দিয়েছে। তাও আবার প্রেম প্রেম চিরকুট। তুই দেরিতে এলি বলে মজা টা পেলি না। এজন্যেই বলি তোর তাড়াতাড়ি আসার অভ্যাস করা উচিত। কী ভয়ঙ্কর মজা টা থেকে বঞ্চিত হলি।'


তিস্তা মুখ ভেংচি দিয়ে উঠে। ফিসফিস করে বলে,

-'তুই আর তোর মাস্টারমশাই মিলে প্রেম প্রেম চিরকুট পড় আর মজা নে। আমার কী! দাঁড়া, তুই আমায় মার খাইয়েছিস না ডাই'নী? এবার দেখ তোর কী করি।'


তিস্তার এহেন হুমকিময় কণ্ঠে ভড়কে যায় ভ্রমরী। ভয়ভয়  কণ্ঠে কিছু বলার আগেই তিস্তা চওড়া কণ্ঠে বলে উঠলো,

-'মাস্টারমশাই, আপনারে নাকি কেউ চিরকুট দিয়েছে? আমাদের মিষ্টি খাওয়াইবেন না? চিরকুট পাইলে মিষ্টি খাওয়াইতে হয়।'


প্লাবন সবে বোর্ডের শেষ লেখা টুকু সম্পূর্ণ করেছে। তিস্তার দুষ্টুমি মাখা কণ্ঠে সে মনে মনে কিছুটা হোঁচট খায়। নিজেকে ধাতস্থ করে সেকেন্ড বিশের মাঝেই। হাতের মাঝে লিখে ক্ষয় হওয়া অর্ধেক চক টুকুন ছুঁড়ে মারে তিস্তার বরাবর। তর্জনী আঙুলটা উচিয়ে ধমকের স্বরে বলে, 

-'এতটুকু একটা মেয়ে,কী বুজিস চিরকুটের? দিন দিন যে গোল্লায় যাচ্ছিস বাড়ির মানুষ জানে? নাকি জানানোর ব্যবস্থা করবো?'


তিস্তা যতটুকু পারে নিজের মুখ-মন্ডলে নিষ্পাপের ছোঁয়া এনে অসহায় কণ্ঠে বলে, 

-'মাস্টারমশাই আমি তো জানতাম না এসব। এই ভ্রমরী বলেছে সব।'


ভ্রমরীর পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় প্লাবন। রাশভারী কণ্ঠে বলে,

-'বোর্ডে করানো অংক টা তুমি কাল পাঁচবার করে আনবে ভ্রমরী। মনে থাকবে?'


ভ্রমরী কেবল অসহায়দের মতন মাথা নাড়িয়ে বলে,

-'আইচ্ছা মাস্টারমশাই।'

-'এই আইচ্ছা কী? আচ্ছা বলবা। কেমন?'


ভ্রমরী আবার পুতুলের ন্যায় মাথা নাড়ায়। প্লাবন এবার সবার উদ্দেশ্যে বলে,

-'যাও আজ সবার ছুটি। বিকেল তো হয়েছে। মনে হয় পাঁচ টা বাজে। যাও সবাই। কাল ঠিক সময়ে চলে আসবে। আর হ্যাঁ, এই চিরকুট নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা যদি আমায় নিয়ে ছড়িয়েছে তবে খবর আছে।'


সবাই যার যার মতন মাথা নাড়িয়ে দ্রুত বই খাতা নিয়ে ছুট লাগায় নিজেদের গন্তব্যে। তাদের সাথে তিস্তাও যোগ দিতে নিলে প্লাবন গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

-'তিস্তা,তুই কোথায় যাচ্ছিস? আজ তুই দেরি করে এসেছিস। তাই তোর শাস্তি হলো সন্ধ্যা অব্দি এখানে পড়বি। আমি একটু বাজারে যাবো, তোর বাবাকে বলবো যাওয়ার সময় জেনো তোকে নিয়ে যায়। তুই তো ছাড়া গরু,একা ছাড়া যায় না আবার।'


তিস্তা তেতে উঠে। কিন্তু কে পরোয়া করে তার তেজ? ভ্রমরী হাসতে হাসতে "ঠিক হয়েছে" বলে বেরিয়ে যায়। তিস্তা মুখ ভেংচি দিয়ে আবার নিজের জায়গায় বসে পড়ে। পুরো রুমটাতে সে একা। টিনের চালের ঘর। মাস্টারমশাইও তাদের বাড়ির জন্য বাজার করতে গ্রামের হাঁটে চলে গিয়েছে। মাস্টারমশাই এর অসুস্থ মা ছাড়া পুরো বাড়িটাতে আর কেউ নেই। মানুষটা প্রায় শয্যাশায়ী। মাঝেমাঝে একটু হাঁটাহাঁটি করে। কোনো কাজ করতে পারে না। তারা আগে শহরে থাকলেও মাস্টারমশাই একটু নিবিড়ভাবে বাস করার জন্য এই গ্রামে খুঁটি গেড়েছে। শিক্ষিত হওয়ায় গ্রামের স্কুলে পাঠদান করায় সাথে বাড়িতে প্রাইভেট পড়ায় মধ্যাহ্নের দিকে। তাদের বাড়ির কিছু কাজ গ্রামের এক চাচী করে দেয়। মাস্টারমশাই তার বিনিময়ে বেশ কিছু টাকাকড়ি দেয় অবশ্য। আর বাদবাকি গুলো মাস্টারমশাই করে। 


বেশখানিকটা সময় নিজের মাধ্যমিকের বইটা নেড়েচেড়ে  সরু টেবিলটার উপর গভীর নিদ্রায় চলে যায় তিস্তা। সারাদিনের দৌড়ঝাঁপে দেহটা বেশ ক্লান্ত। এবার একটু স্বস্তি মিলুক তারও। 


গ্রামের পথ ধরে বাড়ি ফিরছে প্লাবন। এক হাতে তার বাজারের জিনিসপত্র। ঠিক বাড়ির কাছাকাছি আসার পর তার মনে পড়লো পকেটে থাকা ভীষণ অযত্নের চিরকুট খানার কথা। যা একজন ভীষণ দুষ্টুমি বুদ্ধি  দিয়ে লিখেছে। আদৌও চিরকুটে লিখা ভাষা গুলোর গভীরতা হয়তো তার জানা নেই, তবুও মাস্টারমশাই'কে বিব্রত অবস্থাতে ফেলার জন্য এই কু ব্যবস্থা। প্লাবন চিরকুটটা তে বেশখানিকটা সময় হাত বুলাই। লেখা গুলোর মাঝে তিস্তার ছোট গোলগাল মিষ্টি মুখখানা ভেসে আসে। মেয়েটা চিরকুট লিখেছে মজা করার জন্য কিন্তু সে ভুলেই গেছে মাস্টারমশাই প্রতিনিয়ত তার খাতা দেখে, তার হাতের লেখা চিনে। এমনকি পায়ের নখ হতে মাথার চুল অব্দি সব মাস্টারমশাই জানে। আনমনেই হাসে মাস্টারমশাই। পথিমধ্যে বাড়ির পাশে মতিন চাচা'র সাথে দেখা হলো। মাস্টারের থেকে দ্বিগুণ বয়সী লোকটা মাস্টারকে দেখার সাথে সাথে সম্মানের সহিতে বললো,

-'আসসালামু ওয়ালাইকুম মাস্টারমশাই। কেমন আছেন বাবা?'


প্লাবনও সালামের উত্তর দিয়ে শ্রদ্ধার সাথে বললো,

-'এই তো চাচা ভালো। আপনি?'

-'আমিও ম্যালা ভালো আছি বাবা। কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন। আপনি আসার পর থেইকা গ্রামের ছেলেপেলে ইস্কুলে যাওয়ার আগ্রহ দেখায়। আপনার প্রতি আমাগো কৃতজ্ঞতা রইলো।'


প্লাবন কেবল মুচকি হাসে। দু'বছর যাবত সবার মুখে একই কথা শুনে আসছে। বেশ শান্ত স্বভাবের হওয়াতে রাতারাতি গ্রামের সবার পছন্দের তালিকায় পড়ে গেছে। 


 প্রায় বছর দুই আগেই এ গ্রামে এসেছিল তারা। এরপর থেকেই গ্রামের সবার কাছে মাস্টারমশাই হয়ে গেছে। ছোট বড় সবার সম্মানের পাত্র। কেউ তার মুখের উপর কথা বলে না কেবল একজন ছাড়া। প্লাবন আবারও মুচকি হাসে। 


বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় আট টা বাজলো প্লাবনের। পড়ার ঘরে আলো জ্বলছে দেখে অবাক হলো। ঘরটার ভিতর গিয়ে সে অবাকে হা হয়ে গেলো। তিস্তা মেয়েটা এখনো বাড়ি যায় নি। বরং নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। অন্যান্য দিন হাজার বলে গেলেও মেয়েটা থাকে না আর আজ এত রাত অব্দি এখানে!


প্লাবন হালকা হাসে। ঘুমিয়ে থাকা নিষ্পাপ মুখখানার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা বেশ আদুরে। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতন তাকে ভাবতে পারে না প্লাবন। মেয়েটার অপ্রস্তুতময় দুষ্টুমি টা নজর কাড়ে যে তার। 


নিজের মুগ্ধতা নিজের মাঝে চেপে রাশভারী কণ্ঠে ডেকে তুললো তিস্তা'কে। তিস্তা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরক্ষণেই এত রাত অব্দি ঘুমিয়ে থাকার জন্য কতক্ষণ হা হুতাশ করলো। একা একা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই প্লাবন নিজের টর্চ লাইট টা নিয়ে বের হয়ে এলো৷ একা রাতে কোনো মতেই ছাড়া যাবে না যে। 


___


খুব দ্রুত বাড়ি ফেরার জন্য বাগানের পথ ধরে বাড়ি ফিরছে প্লাবন আর তিস্তা। প্লাবনের বড় বড় স্যান্ডেল জোড়া তিস্তার পায়ে শোভিত আছে। মেয়েটা জুতো পড়ে আসে নি। আধাঁর রাস্তায় কিছু পায়ে বিঁধলে কেঁদেকেটে হয়রান করবে। বেশ আহ্লাদী তো। তাই প্লাবনের জুতো তাকে দিয়েছে। 


বুকের মাঝে বই দুখানা চেপে সাবধানে পা ফেলে চলছে তিস্তা। কেমন গা ছমছমে রাস্তা। তার ভীষণ ভয় করছে। তাই, দ্রুত গিয়ে মাস্টারমশাইয়ের হাতটা চেপে ধরলো সে। 


প্লাবন সাবধানে পা ফেলতে ফেলতে বলল,

-'কিরে, ভয় পাচ্ছিস?'


তিস্তা ভীত স্বরে বললো,

-'হ্যাঁ।'


প্লাবন আর কিছু না বলে তিস্তার হাতটা ধরে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বাগানের অপরপাশ থেকে কিছু একটার শব্দে ভয় পেয়ে যায় তিস্তা। ধীর গতিতে বলে উঠে, 

-'আম্মা গো ভূত।'


প্লবন দ্রুত তিস্তার মুখ চেপে ধরে। হুশিয়ারী কণ্ঠে বলে,

-'চুপ কর। ভূত না। কোনো মানুষ। চুপ কর।'


তিস্তা তবুও ভয়ে কেঁপে উঠে। প্লাবন গাছের পাতা গুলো একটু সরাতেই দেখে মোড়লের বাড়িতে চকচকে ঝকঝকে জামা পড়া কতগুলো মেয়ে ঢুকছে। তিস্তা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও প্লাবনের যা বুঝা তা বুঝা হয়ে যায়। সে তিস্তার হাত ধরে ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলে, 

-'চল তিস্তা, দেরি হচ্ছে৷'


তিস্তা তখনও কৌতূহল চোখে তাকিয়ে প্লাবনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-'এই মেয়ে গুলো মোড়ল চাচার বাড়িতে কেনো? এরা কারা মাস্টারমশাই? আমাদের গ্রামের তো না।'


প্লাবন উত্তর দেয় না। কেবল রাশভারী কণ্ঠে বলে, 

-'যেখানে সেখানে প্রশ্ন করতে নেই তিস্তা। তাড়াতাড়ি চল এখান থেকে। কেউ দেখতে পেলে সর্বনাশ হবে।'


তিস্তার কৌতূহল তবুও মিটে না। এ ব্যাপারে তার জানতে হবে যে। মাস্টারমশাই এর মনে ভয় ঢুকে। মেয়েটা যা কৌতূহল প্রবণ এত দ্রুত ওর কৌতূহল মিটবে না। ওর ঝোঁক না আবার কোনো সর্বনাশ ডাকে। 


আকাশে মেঘ গুলো ক্ষাণিকটা তুলোর মতন লাগছে। শরৎ এর আকাশটা ভীষণ আদুরে হয়। দেখলেই মনে হয় ছুঁয়ে দিতে। এমন এক অদম্য ইচ্ছে নিয়ে সেই আকাশ পানে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তিস্তা সাথে হেঁটে যাচ্ছে গ্রামের সরু পথ দিয়ে। তার সাথে আজ কেবল মাস্টারমশাই আছে। মাস্টারমশাই নিজের সাইকেলটা নিয়ে হাঁটছে গম্ভীরভাবে। 


তিস্তা কতক্ষণ মনের মাঝে হাবিজাবি ভেবে হঠাৎ মাস্টারমশাই'কে প্রশ্ন করলো,

-'আচ্ছা মাস্টারমশাই, আপনারে একটা কথা বললে রাখবেন?'


মাস্টারমশাই ক্ষানিকটা ভ্রু কুঁচকায়। সন্দিহান কণ্ঠে বলে,

-'উল্টোপাল্টা চাইবি নাকি?'


-'আপনার সবসময় মনে হয় আমি উল্টোপাল্টা চাই? থাক,লাগবে না।'


তিস্তার এহেন অভিমানে গোপনে হাসে মাস্টারমশাই। শরৎ এর কোমল বাতাসে ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে অভিমানী সপ্তদশী। মাস্টারমশাই কিছু বলে না, কারণ তিস্তা আবার নিজ থেকেই আসবে কথা বলার জন্য। 


মিনিট পাঁচ পেরিয়ে যায় তিস্তা চুপ রয়। এখন যে পথটি দিয়ে হাঁটছে তার বা'পাশে একটা মরানদী আছে। মৃত নদী হলেও তার রূপের জেনো অন্ত নেই। তিস্তা মৃত নদীটির দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলে,

-'জানেন মাস্টারমশাই, এ গ্রামে অনেক আগে এক জমিদার বাস করতো, তার নাম ছিলো আনন্দমোহর। উনার সহধর্মিণীর এ নদীটা খুব পছন্দ ছিলো। উনার পছন্দকে আরও সৌন্দর্যময় করে তুলতে নদীটির পাড় চিনাপাথর দিয়ে বাঁধানো হয়। একটি বিশাল বসার জায়গা বানানো হয় সুন্দর করে। আনন্দমোহরে স্ত্রী'র নাম ছিলো মধুসখী,সেই নাম অনুসারে নদীটির নাম রাখা হয় মধুসখী। কিন্তু এই প্রিয় নদীই কাল হয়ে দাঁড়ায় মধূসখী'র। একদিন এ নদীতে ডুবেই সে মানবী মারা যায়। এরপর নাকি প্রায় কত যুগ নদীটি মৃত ছিলো। এর পানি শুখিয়ে চর জেগেছিলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন সবাই'কে অবাক করে নদীটিতে আবার পানি আসলো। নদীটি ভরে গেলো,তার রূপ আরও বেড়ে উঠলো।'


প্লাবন খুব মনযোগ দিয়ে সবটা শুনলো। সে এগুলো জানে। গত দু'বছর যাবত অনেকেই এ নদীটিকে জাদুময় নদী বলে আখ্যায়িত করে। অনেকে তো রাতে এখান দিয়ে আসে না। গ্রামীণ কিছু কুসংস্কার তো থেকেই যায়। তবে সে পুরোনো গল্প নতুন করে তিস্তার মুখ থেকে শুনতে ভালোই লাগছে। তাই সে নিরব শ্রোতা হয়ে সবটা শুনলো। এবার সে প্রশ্ন করলো,

-'তাহলে তিস্তা, নদীটি আবার মৃত হলো কীভাবে?'


তিস্তা একটু খুশি হলো। মাস্টারমশাই তার কাছ থেকে কিছু জানবে,শিখবে সেটা যেনো বিশ্বজয় করার আনন্দ দিলো তাকে। সে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো, 

-'এ নদীটা আবার মৃত বলে ঘোষনা দেয়া হয় প্রায় সতেরো বছর আগে। আমি জন্মানোর পাঁচ দিনের মাথায় নাকি নদীটা মারা যায়। এর চর জেগে উঠে। আমি যখন মায়ের পেটে আসি তখনই নাকি নদীটা তার স্রোত হারিয়ে ফেলে,গতি কমিয়ে দেয়। জানেন মাস্টারমশাই আমার কী মনে হয়?'


মাস্টারমশাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-'কী মনে হয়?'

-'আমি জন্ম নেওয়ার সাথে সাথে নদীটা মারা গেছে। বোধহয় আমি মারা গেলে নদীটা আবার বেঁচে উঠবে।'


প্লাবনের পা টা আপনা-আপনি থেমে যায়। কথাটা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছুতেই ক্ষানিকটা নড়ে উঠে সে। ধমক দিতে গিয়েও নিজেতে ধাতস্থ করে বলে,

-'তাহলে এক কাজ কর, তুই বরং তাড়াতাড়ি মরে যা। তুই বেঁচে থেকে তো কারো কোনো কাজে আসছিস না বরং মরে গিয়ে কাজে লাগবি। এই মৃত নদীটা জীবিত হয়ে গেলে এখানে মাছ চাষ করা যাবে। তারপর কত মানুষ সেই মাছ বিক্রি করে তাদের উদরপূর্তি করতে পারবে। কি বলিস?'


তিস্তা মাথা নত করে কেবল ঘাঁড় কাত করে। যার অর্থ 'ঠিক আছে'। প্লাবন অবাক হয়। এত ভদ্র মেয়ে তো তিস্তা না। 


এদিকে সপ্তদশী তিস্তা'র মনে অভিমানের পাহাড়টা আরেকটু বড় হয়। মাস্টারমশাই'কে সে ঐ কথা টা বলেছিলো যেনো মাস্টারমশাই তাকে ধমক দেয়, ধমক দিয়ে বলে এসব কথা বলবি না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মাস্টারমশাই কিনা তাকে মরে যেতে বললো! মাস্টারমশাই কী বুঝে না? তিস্তার ভীষণ আদুরে লাগে মাস্টারমশাই এর বকা। অভিমান অধিক হওয়ায় চোখের কোণে উঁকি দেয় অশ্রুকণা। সে তাড়াতাড়ি বইয়ের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে ছুট লাগায়। 


তিস্তার এহেন কান্ডে প্লাবন বেশ অবাক হয়। পিছন থেকে কয়েকবার ডাক দেয়। কিন্তু কে শুনে কার ডাক। প্লাবনের মনে সামান্য বিষন্নতা কড়া নাড়ে। কিন্তু মেয়েটাকে তখন আহ্লাদ দেখালে সে এসব কথা আবারও বলতো। আর প্লাবনের দেহের মাঝে ছোট্ট হৃদপিণ্ডটায় রক্তক্ষরণ হতো।


____


তিস্তা আজ স্কুল না গিয়ে ফিরে এসেছে। তখন ছুট লাগিয়ে স্কুলে গেট অব্দি গিয়েও স্কুল যায় নি। অন্য রাস্তা দিয়ে বাড়ি চলে এসেছে। হুটহাট মন খারাপ হয় আজকাল। মা বলেছে এ বয়সে ঐ একটু আধটু হয়। 


তিস্তা মন খারাপ করে উঠোনের এক কোণে বসে আছে। তার মা তনয়া চুলোয় ভাত বসিয়ে মেয়ের দিকে এগিয়ে আসে। আদুরে কন্ঠে বলে,

-'কী হলো আজ তিস্তামনির? সে আজ দৌড়ঝাঁপ করছে না যে? আজ যে তোমার আপাই আসবে সে খেয়াল আছে?'


-'আমার হুটহাট মন খারাপ করে আম্মা। আমার ভালো লাগে না কিছু।'


-'এ বয়সে তো মন খারাপ করবোই। বিয়ার বয়স পাড় হইয়া যাইতাছে, অথচ তোমার মা বাপে তোমারে বিয়া দিতাছে না। কত কইরা বুঝাইলাম তাও বুঝে না।'


তিস্তার দাদীর এহেন কথায় তিস্তা ড্যাবড্যাব করে তাকায়। তার বিয়ে করার জন্য মন খারাপ হচ্ছে! ছিঃ এ তাহলে কেমন মন খারাপ! 


তনয়া বেশ বিরক্তের স্বরে বলে,

-'আম্মা,এসব আপনার ছেলে শুনলে কিন্তু আবার রাগারাগি করবে। আপনি ওর সামনে এগুলো বলবেন না দয়া করে।'


বৃদ্ধা মহিলা এবার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে নাতনির কাছে এসে বলে,

-'হ, এহন আমার কথা তো তোমরা কেউ শুনবা না। সংসারে এহন হইলাম গিয়া আমি পুরাতন ভাঙা থালার মতন, যা কাজে আসে না অথচ ফালাতে পারো না মায়ায়। তাও তোমারে বলি বউ, মাইয়া মানুষের শরীর বাড়ার সাথে সাথে মানুষের দৃষ্টির লোভ বাড়ে। তাই কাল বিলম্ব না কইরা মাইয়া শ্বশুড়বাড়িতে পাঠাই দেওয়া উচিত।'


তনয়া ক্ষানিক বিরক্ত হয় শাশুড়ির কথায়। এসব কুসংস্কার এখনো তার শাশুড়ি ধরে রেখেছে। মেয়েটার মাথায় এসব ঢুকলে আর পড়াশোনা করবে! এমনেতেই তো প্রচুর দুষ্টু। 


তিস্তা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,

-'আম্মা, তোমার শাশুড়ির বিয়ে করার শখ জেগেছে। সেটা তো বলতে পারছে না তাই আমার নামে চালাচ্ছে। কি যুবতী? তাই না?'


তনয়া মেয়ের এমন বেসরম কথায় হেসে উঠে। বৃদ্ধ লতিকা ফোঁকলা দাঁতে একটু হেসে,লজ্জা রাঙা কণ্ঠে একটু শাসনের সুর ঢেলে বললো,

-'দিনে দিনে গতর বাড়ে আর ইতরামি বাড়ে মাইয়ার।'


তিস্তা দাদীর গাল টেনে দেয়। ফিঁক করে হেসে উঠে তিনজনে। দাদী'কে সে বেশিরভাগ সময় যুবতী ডাকে। কারণ দাদী পছন্দ করে না তাকে কেউ বৃদ্ধ ভাবুক। তিস্তার ডাকে দাদী বেশ আনন্দিত হয়। 


______


আজ দুপুর তিনটে বাজার আগেই তিস্তা হাজির পাঠশালায়। পড়নে তার নতুন লাল টুকটুকে গোল ফ্রকটা। তিস্তা'র বয়স সতেরো হলেও দেখতে বেশ বাচ্চাদের মতন ছোট। 


প্লাবন সবে স্নান করে এসেছে। খেতে যাওয়ার জন্য রান্নাঘরে যেতেই তার টিনের চালের পড়ার ঘরটি চোখে পড়লো। লাল টুকটুকে ফ্রক পড়া এক কিশোরী মাথা নিচু করে বসে রইল। প্লাবন ক্ষানিকটা অবাক হলো। তিস্তা তো এত তাড়াতাড়ি পড়তে আসার মেয়ে না। প্লাবন নিজের খাবারের কথা ভুলে দ্রুত পায়ে পাঠশালার রুমটিতে চলে যায়। তিস্তার কাছাকাছি আসতে কান্নার শব্দে ভেসে এলো। প্লাবনের বুকটা ক্ষানিক মোচড় দিয়ে উঠলো। 


সকালে মেয়েটা রাগ করে আর স্কুলও যায় নি। এখন এখানে কান্না করছে কেনো?সকালের রাগের জন্য কান্না করছে? 


ক্ষানিকটা ইতস্ততা নিয়ে প্লাবন ভরাট তবে শান্ত কণ্ঠে ডাক দিলো,

-'তিস্তা?'


তিস্তার কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। বরং সে কান্নার গতি আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। প্লাবন আবারও ডাক দিলো আদুরে কন্ঠে, 

-'তিস্তা,কী হলো তোর?'


তিস্তার তবুও নড়চড় নেই। প্লাবন এবার ইতস্ততা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তার ডান হাতটা তিস্তার বাহুতে রাখতেই তিস্তা ভয় পেয়ে ছিটকে দূরে সরে গেলো। ভীত কণ্ঠে বললো,

-'আমি আর এ জামা পড়বো না। আমি আর ছুটোছুটি করবো না। আমি আর ওর সামনে যাবো না। নোংরা মানুষ। সবাই নোংরা।'


তিস্তার আচমকা বলা কথা গুলো প্লাবনের মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতে একটু সময় লাগে। কিন্তু বোধগম্য হতেই শরীরটা একটু কেঁপে উঠে। অনাকাঙ্খিত ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তিস্তা এসব কথা বলছে কেনো! 


প্লাবন ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলে, 

-'কী হয়েছে তিস্তা? কে কী বলেছে তোকে? আমায় বল। কী হয়েছে?'


তিস্তার ততক্ষণে হেঁচকি উঠে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। সে মাস্টারমশাই এর দিকে তাকায়। চোখ গুলো লাল হয়ে ফুলে গেছে। মাস্টারমশাই'কে দেখে ভিতরের সব কান্না বের হয়ে আসে। অভিযোগের স্বরে বলে, 

-'সবাই খারাপ মাস্টারমশাই। অনেক খারাপ। জানেন আমার গাল, পেট, ঘাড় ধরেছে ও বাজে ভাবে। খুব খারাপ ওর হাত।'


প্লাবন আৎকে উঠে। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে, 

-'কে? কে ধরেছে তোর গাল?'


তিস্তা ফুপিয়ে কেঁদে দেয়। অস্ফুটস্বরে বলে,

-'দু-দুলাভাই।'


[যেহেতু উপন্যাস টা একুশ শতকের প্লটে না। কয়েক যুগ আগের প্রেক্ষাপটে সেই সূত্রে সামান্য কুসংস্কার আনা হবে। কেবল আগের যুগের মানুষের ধারণা তুলে ধরার জন্য। আর প্রতিটা কাহিনীর পিছে অবশ্যই রহস্য আছে। রহস্য ছাড়া অহেতুক কিছুই এখানে আসবে না। অতঃপর সবাইকে জানাই ভালোবাসা। ]


ফুলোফুলো চোখ দুটি কিছুক্ষণের বিবর্তনে উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ। প্লাবন দূর হতে উচ্ছ্বাসিত মুখ খানা দেখে তৃপ্তির হাসি হাসে। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,

-'আর খাবি তেঁতুল আচার?'


তিস্তা শেষ পর্যায়ের আচার টুকু মুখে পুরে নেয়। অমৃতের ন্যায় অতিরিক্ত স্বাদে চোখ দু'খানা বন্ধ হয়ে আসে। তিস্তার এমন মুখ ভঙ্গি দেখে চাপা হাসে প্লাবন। আচারের প্রতি তারও ভীষণ লোভ হচ্ছে তিস্তার খাওয়ার অভিনয় দেখে।


তিস্তা মুখের আচার টুকু শেষ করে আঙ্গুল গুলো চাটতে চাটতে বললো,

-'নাহ্ মাস্টারমশাই, আর খাবো না।'

-'তবে কী আমি আচারের বয়াম রেখে আসবো?'


তিস্তা মাস্টারমশাই এর কথা শুনে তৎক্ষনাৎ আচারের বয়ামটা ছিনিয়ে নেয়। প্লাবনের কাছ থেকে একটু আড়াল করে বলে,

-'নাহ্, এই আচার আমি বাড়ি নিয়ে যাবো। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু যদি পরে আবার খেতে ইচ্ছে করে তখন আমি কী করবো? তাই এটা আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। যেদিন আমার খাওয়ার ইচ্ছে শেষ হয়ে যাবে সেদিন দিয়ে যাবো।'


-'তোর ইচ্ছে শেষ হওয়ার আগে না আবার আমার আচার শেষ হয়ে যায় দেখিস।'


মাস্টারমশাই এর এমন কথায় তিস্তা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,

-'আপনি কী চাচ্ছেন আমি এখন রাগ করে আচার না নিয়ে চলে যাই?'


প্লাবন হতভম্ব হয়ে যায় এহেন প্রশ্নে। ক্ষাণিকটা হোঁচট খায় মনে মনে। ব্যতিব্যস্ত স্বরে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তিস্তা বয়ামটা নিজের ব্যাগে রাখতে রাখতে বলে,

-'আপনি এমনটা চাইলেও কিছু করার নেই। কারণ, আচারটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আপনাকে এর জন্য আমি পড়া শিখে দিবো। কেমন?'


প্লাবন এবার শব্দ করে হেসে দেয়। মেয়েটা এত বাচ্চা বাচ্চা কথা কেনো বলে? একটু আগেও এই ছোট্ট মেয়ে টা কেমন যেনো বড় হয়ে গিয়েছিল, ভীষণ অচেনা এক নারীতে রূপান্তরিত হয়েছিলো। কতটা ধৈর্য সহকারে সামলাতে হলো তাকে! 


প্লাবন তিস্তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললো,

-'তোর আপা জানে, তাই না? তুই তোর আপাকেই প্রথম বলেছিলি খারাপ স্পর্শের ব্যাপার টা?'

-'হুম। আমি সবার আগে আপারেই বলছি। দুলাভাই নষ্ট পুরুষ। আমি আপারে অনেক বলেছি কিন্তু, কিন্তু আপা আমাকে চর লাগিয়েছে মাস্টারমশাই। অনেক জোরে মেরেছে।'


শুকনো চোখ গুলো কথার পরিপ্রেক্ষিতে জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। প্লাবনের ভীষণ অবাক লাগলো তিস্তার আপার ব্যবহারে। সে অবাক কণ্ঠে বললো, 

-'তোর আপা আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি তোকে? আর কিছু বলে নি?'

-'হ্যাঁ বলেছে তো, আপা কান্নাও করেছে। আপা বলেছে এ কথা বাড়ির কাউকে না বলার জন্য। তাই তো আপনারে বললাম মাস্টারমশাই। আপনি আর কাউকে বলবেন না কেমন? আপা কষ্ট পাবে। আপা বলেছে, এ কথা আমি কাউকে বললে তার সংসার ভেঙে যাবে। তখন গলায় দঁড়ি দেওয়া ছাড়া নাকি উপায় থাকবে না৷ দুলাভাই রে সে অনেক ভালোবাসে।'


কথা শেষ করে মন খারাপের বিষন্নতায় ডুব দেয় তিস্তা। প্লাবন হতাশার শ্বাস ফেলে বললো,

-'এটা ভালোবাসা না রে, যে ভালোবাসা অন্ধ বানিয়ে দেয়,হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সেটা ভালোবাসা না। তোর আপা'র সংসার করার লোভ তার স্বামী'কে আরও এক ধাপ এই নোংরামির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। বাঙালী নারী জাত ভাবে সংসার বিহীন তারা কিছু না, তাই হাজারো নোংরামি সহ্য করেও সংসার রাখার জন্য মরিয়া হয়ে যায়। আচ্ছা একটা কাজ করবি তিস্তা?'


তিস্তা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। বিষন্ন স্বরে বলে, 

-'কী কাজ মাস্টারমশাই?'

-'তোকে তোর দুলাভাই সবার আড়ালে স্পর্শ করেছে তাই না?'

-'হ্যাঁ।'

-'তাহলে তাকে শাস্তিটা সবার আড়ালে তুই ই দিবি। পারবি না?'


প্লাবনের কথা তিস্তার বোধগম্য হয় না। সে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

-'কি শাস্তি দিবো? আর দুলাইভাই আমার বড়।'


প্লাবন কিছুটা রেগে যায়। ভরাট কণ্ঠে বলে, 

-'বড় বলে তুই শাস্তি দিতে চাস না আর সে তোকে নোংরা চোখে দেখুক সেটা তোর ভালো লাগবে?'


তিস্তা ডানে বামে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ তার ভালো লাগবে না। প্লাবন এবার আশ্বাসের স্বরে বললো,

-'তোর আপা'র অন্ধত্ব তুই ঘুচাবি। আর দুলাভাই এর নোংরামিও তুই দূর করবি। পারবি না?'


তিস্তা'র হঠাৎ কী জেনো হলো। চোখ দু খানা চকচক করে উঠলো। ভীষণ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললো,

-'পারবো মাস্টারমশাই।'


মেয়ে মানুষকে সৃষ্টিকর্তা আলাদা শক্তি দিয়ে হয়তো বানায়। তারা যতটা অবুঝই হোক নিজের নিরাপত্তা বেশ ভালো ভাবে বুঝে। তিস্তাও সেই স্বত্তার বাহিরে না। 


হঠাৎ উঠোন থেকে চওড়া কণ্ঠের ডাক ভেসে এলো,

-'মাস্টারমশাই, বাড়িত আছেন নি? মোড়ল সাহেব আইছে আপনার সাথ দেখা করার জইন্ন।'


প্লাবনের কপাল কুঁচকে যায়। মোড়ল সাহেব তার সাথে দেখা করতে আসছে কেন? হঠাৎ? 


তিস্তাও অবাক দৃষ্টিতে মাস্টারমশাই এর দিকে তাকায়। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে, 

-'মোড়ল সাহেব আপনার সাথে দেখা করতে কেনো আসছে মাস্টারমশাই?'


প্লাবন মাথা নাড়িয়ে "জানিনা" বলে বড় টিনের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। প্লাবনের মাও দুপুরে খেয়ে ভাত ঘুম দিয়ে ছিলো। কিন্তু মোড়লের নাম কানে যেতেই ভীষণ ঘুম যেনো কোথায় উবে গেলো। সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘর থেকে বাহিরে বেরিয়ে এলো। 


তখন শরৎ এর নরম দুপুর। গ্রামে দুপুর বেলাটা থাকে বেশ নিস্তব্ধ। মোড়ল সাহেব'কে দেখে প্লাবন বেশ সম্মানের সাথে সালাম করে। বিনীত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, 

-'আপনি এখানে যে? কোনো প্রয়োজন থাকলে আমাকে ডাকতে পারতেন।'


মোড়ল সাহেব তার সাথের চাকরটার কাছ থেকে হুঁকা পান করে। হুঁকার ধুয়ো আকাশে উড়িয়ে দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলে,

-'এই গেরামে তো অনেক মাস্টারই আছে। কিন্তু আমার মাইয়া কঙ্কণা'র তোমারেই লাগবো পড়ার জন্য। তুমি  সময় কইরা গিয়া পড়াইয়ো। টাকা পয়সার ব্যাপার নিয়া ভাবতে হইবো না।'


প্লাবন তার মাধুর্যতা ময় কণ্ঠে আরও বিনীত ভাব ঢেলে বলে,

-'শিক্ষকদের পড়ানোর বিনিময়ে যেটা দেওয়া হয় সেটাকে সম্মানী বলে, টাকা পয়সা না। আর আপনি তো জানেন দুপুরে আমার একটা শিক্ষার্থীদের দল আছে যাদের আমি পড়াই। সেটা ছুটি দিতে দিতে সন্ধ্যা নামে এরপর তো আর পড়ানো সম্ভব না। আপনি বরং কঙ্কণা'রে এসে পড়ে যেতে বইলেন।'


প্লাবনের কথা শুনে প্লাবনের মা হুঙ্কার দিয়ে বলে,

-'কাকে কী বলছো,প্লাবন? মোড়াল সাহেব যেখানে এত বড় প্রস্তাব দিচ্ছে সেখানে তোমার না করা টা বেমানান।'

-'এটা আমার একান্তই ব্যাক্তিগত বিষয় মা। আপনি কিছু বলবেন না আশা করি!'


প্লাবনের কথায় তার মা চুপ হয়ে গেলেও মোড়েলের সাথে থাকা তার চাকরটা চোখ রাঙিয়ে উঠে। ধমকের স্বরে বলে, 

-'আফনে ভূঁইয়া বাড়ির মাইয়ারে পড়াইতে পারবেন না? এত সাহস কই থেইকা আসে আপনার? গেরামে টিকতে পারবেন তো?'


মোড়ল সাহেব বিশাল এক ধমক দিলে লোকটাকে। শাসানোর ভঙ্গিতে বললেন,

-'তোর এত সাহস কই থেইকা আসে? আমি তো কথা কইতাছি। মাস্টার গো লগে অভদ্রতা করবি না।'


মোড়লের ধমকে চাকরটা মাথা নত করে ফেললো। মোড়ল সাহেব নিজের বিদঘুটে আকৃতির হাসি দিয়ে সাধারণ কণ্ঠে বললো, 

-'আচ্ছা মাস্টার। তুমি যা কও তা'ই হইবো। তাহলে কঙ্কণা কাইল থেইকা তোমার এইখানে আইসাই পড়বো। ভালো থাইকো।'


প্লাবন ঘাঁড় নাড়িয়ে বললো,

-'বসলেন না?'


-'না মাস্টার। ম্যালা কাজ আছে। আজ তাহলে আসি?'


প্লাবন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। মোড়ল বের হতে নিয়েও একটু দাঁড়ালো। পড়ার ঘরটার দিকে তাকালো। ঘরের দরজা ঘেষে তখন তিস্তা দাড়ানো। মোড়ল তিস্তার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে প্লাবনের উদ্দেশ্যে বললো,

-'এ তিস্তা নদী যে এখানে? কঙ্কণা এলে আবার দেখো নদীর জল বহুদূর না গড়ায়। একটা সাপ হলে আরেকটা নেউল।'


মোড়লের কথায় প্লাবন কিছুটা হেসে দেয়। হেসে চোখে ইশারা করে তেমন কিছু হবে না। 


মোড়ল প্লাবনদের সদর দরজা পার হতেই তিস্তা দু'লাফে উঠোনে নেমে এলো। বিরক্ত মেশানো কণ্ঠে বললো,

-'ঐ কঙ্কণা'রে পড়ানোর কী দরকার আপনার মাস্টারমশাই? ও খালি ঝগড়া করে। আমার একদম ভাল্লাগে না ওরে। টাকার গরমে যেনো ও শান্তি পায় না এমন ভাবখানা।'


প্লাবন তিস্তার কথায় কিছু বলতে নিবে তার আগেই প্লাবনের মা মুখঝামটা দিয়ে বললো,

-'হ্যাঁ, আমার ছেলের সুখ তো কারো সহ্য হয় না। স্বয়ং ওরই নিজের সুখ সহ্য হয় না। মোড়লের বাড়িতে গিয়া পড়াইলে কত টাকা পাইতো। নাহ্, হেয় তো আবার দরদী। এখন আবার এই উড়নচণ্ডী মেয়ে ঢং করতে আসছে। যা, বাড়িতে যা।'


প্লাবন অসহায় কণ্ঠে বললো, 

-'আহ্! মা! ওর সাথে কীভাবে কথা বলছো? যা তিস্তা পড়ার ঘরে যা।'


তিস্তা আর এক মুহূর্ত ব্যায় না করে ঘরে চলে গেলো। মাস্টারমশাই এর মা'টা কেমন যেনো। মহিলা বেশ পড়াশোনা জানলেও কেমন জেনো আচার আচরণ। 


প্লাবন ছোট্ট শ্বাস ফেলে মা'কে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তার বাকি শিক্ষার্থী চলে আসলো। ব্যস্ত হয়ে গেলো সে দৈনন্দিন কাজে।


_______


বাড়ির উঠোনে হারিকেনের আলো মিটমিট করে জ্বলছে। তিস্তা রান্নাঘরে মাঝ গুলো ভাজছে। মা পাশের বাড়িতে গিয়েছে, সে বাড়িতে ঝামেলা হচ্ছে বলে। যাওয়ার আগে তিস্তার ঘাঁড়ে মাছ ভাজার বিরাট দায়িত্ব দিয়ে গেছে। 


বাড়িতে এখন সে, তার দাদী আর দুলাভাই আছে। আপাও মায়ের সাথে গিয়েছে। 


তিস্তা গভীর মনযোগ তেলের ভিতর থাকা ফুটন্ত মাছ গুলো দেখছে। এটার মাঝেও ভীষণ আকর্ষণীয় কিছু খুঁজে পাচ্ছে বোধহয় সে। আসলে বয়ঃসন্ধির সময়টাই এমন। অসাধারণও বিরক্ত আসে আবার অতি সাধারণও আনন্দিত করে। 


কিশোরী তিস্তা হঠাৎ অনুভব করলো তার পিঠে নোংরা হাতের ছোঁয়া। সে হাতটা জামার ভিতরে থাকা অতি গোপনীয় পিঠটা বাজে ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে। 


তিস্তা চমকে পিছে তাকায়৷ বিষ্মিত কণ্ঠে বলে, 

-'দুলাভাই!'


পেটমোটা ভারী শরীর যুক্ত মোতালেব হালকা হাসে। হাতের ছোঁয়া আরও গভীর করে। যতটা গভীর করলে পিঠের অন্তর্বাসের কাপড়টা অব্দি ছোঁয়া যায়। বিশ্রী হেসে বলে,

-'বেশ বড় হয়েছিস। এবার দুলাভাই এর খাতির যত্ন কর। চুড়ি,আলতা,আয়না কিনে দিবো।'


তিস্তা উঠতে নিলেও শক্ত হাতের চাপে উঠতে পারে না। দুলাভাই তবে মনুষ্যত্ব একবারে হারিয়ে ফেলেছে! তার দাম কী তিস্তাকে দিতে হবে? 


"আপা কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলো কেনো,আম্মা?"


নিজের ছোট মেয়ের কথায় তনয়া বেগম ফিরে তাকালেন। তার হাতে ছাই লেগে আছে। গতকাল রাতের এঁটো থালাবাসন গুলো ধুচ্ছিলো সে। হাতের পাতিলটা নিচে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

-'ভালো হয়েছে তুমি এসেছো এখানে। তা কাক ডাকা ভোরে উঠার মেয়ে তো তুমি না! কেনো উঠেছো!


-'ঘুম ভেঙে গেলো আম্মা। বললা না তো, আপা চলে গেলো কেন?'


তনয়া বেগম বিরক্তিতে ক্ষাণিকটা ভ্রু কুঁচকে অধৈর্য মাখানো কণ্ঠে বললো, 

-'এখানে এসে একটু পানি তুলে দিয়ে যাও তো। হাঁড়িপাতিল গুলো ধুঁয়ে ফেলি। বাসি কাজ গুলো আগে শেষ করে নেই। আসো, আসো।'


মায়ের তাড়াহুড়ো মাখানো কণ্ঠে বুঝাই যাচ্ছে মায়ের প্রতিটা সেকেন্ডের মূল্য কতটা৷ আর তাছাড়া মা কিছু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তিস্তা আর কিছু না বলে মায়ের হাতে হাতে একটু সাহায্য করে দিলো। তনয়া হাঁড়ি পাতিলে পরিষ্কার পানি ঢেলে পরিষ্কার করতে করতে সেদিকে মনযোগ স্থাপন করে বললো,

-'মেয়ে হয়েছো তুমি, সবার আগে নিজের নিরাপত্তার কথা তোমাকে ভাবতে হবে। আর তা তুমি ভেবেছো,কিন্তু যখন দেখবে তোমার একার পক্ষে নিজেকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হচ্ছে না তখন কাউকে জানাতে হবে। নিজের নিরাপদের জন্য মাঝে মাঝে অন্যের কথা ভুলতে হবে। যাই হোক, কাল মোতালেবের হাতে গরম তেল তুমি মেরেছিলে তাই না?'


মায়ের সবটা কথা এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিলো তিস্তা, কিন্তু শেষের প্রশ্নে তার হাতে থাকা থালের পাঁজা টা পরে গেলো ঝনঝন শব্দে। শরীরের মাঝে অস্থিরতা কাজ করলো। কাল রাতে আধাঁরিয়া প্রতিবাদের কথা তার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। যখন দুলাভাই তার বাহু শক্ত করে ধরে রেখেছিলো সে তখন কড়াই থেকে অনেক খানি গরম তেল গোল চামচের মাধ্যমে নিয়ে দুলাভাই এর হাতে ছুঁড়ে ফেলে। দুলাভাই আৎকে উঠে। সামন্য চেঁচিয়েও উঠে। ততক্ষণে মা আর আপা বাড়িতে এসে পড়েছিলো। দুলাভাই এর অস্থিরতম চিৎকারে তারা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে এসে দেখে দুলাভাই এর হাতের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। যখন সবাই জিজ্ঞেস করলো কীভাবে এমন হয়েছে তখন তিস্তা খুব চালাকি'র সাথে বলে ছিলো দুলাভাই মাছ ভাজতে এসেছিলো আর গরম কড়াইয়ের অনেকখানি তেল উল্টে পড়ে যায় তার উপর। 


তিস্তা ভেবেছিলো,সে ঘটনা হয়তো আর কেউ জানবে না কিন্তু আম্মা কীভাবে জানলো?


তিস্তা'কে চুপ থাকতে দেখে তনয়া উঠে দাঁড়ালো, মেয়ের গালে শক্ত এক চড় বসালো। কর্কশ কণ্ঠে বললো, 

-'তুমি কতটা বড় হয়েছো যে তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা আমাদের জানাতে পারো না? তোমার সাথে মোতালেব খারাপ আচরণ করে সেটা আগে বললে এত দূর ব্যাপার টা যেতো না। নোংরা আচরণ করার সাহস ওর হতো না। তোমারই বা কী দোষ! যেখানে তোমার বড় বোনই সংসার টিকিয়ে রাখার আশায় নিজের ছোট বোনের সাথে হওয়া অন্যায়'কে পশ্রয় দিয়েছে। এমন মেয়েও আমি পেটে ধরেছিলাম! ছিহ্।'


তিস্তার চড়ের ব্যাথায় চোখ টলমল করে উঠে। গালটা যেনো জ্বলে যায়। কিন্তু তার চেয়ে বেশি জ্বলে যায় হৃদয়টা। আম্মা তাকে ভুল বুঝে নি তাহলে!


তনয়া থালাবাসন গুলো একটা একটা করে মাটি থেকে তুলতে তুলতে বলে,

-'আজ থেকে ফ্রক পড়া বন্ধ। আমি তো ভুলেই গেছিলাম, সব মানুষ এক হয় না৷ তোমার দৌড়ঝাঁপ কমাবে। মোতালেব কেবল একটা তো আর না, এ সমাজে অনেক গুলো আছে। যাও ঘরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে স্কুলের জন্য তৈরী হও। বড় হচ্ছো,শরীর বাড়ছে, বুদ্ধিটাও বাড়াও।'


তিস্তা মায়ের উপর অভিমান করে। ছুটে চলে যায় ঘরে। তনয়া ছোট্ট শ্বাস ফেলে। বড় মেয়েটা এত স্বার্থপর ভাবতেই তার গা শিরশির করে উঠে। ভাগ্যিস গতকাল তার শাশুড়ি লতিকা বেগম রান্নাঘরের দৃশ্যটি দেখেছিলো। নাহয় তো এই মোতালেব আরও নোংরামি করতো তার ছোট মেয়েটার সাথে আর তারা জানতেও পারতো না। বড় মেয়েকে সে আড়ালে নিয়ে গিয়ে সব বলার পরে বড় মেয়ে নিজের বোনকে খারাপ বলে। তার বোন নাকি ফ্রক পড়ে ছেলেদের আকর্ষণ করছে। কতটা নিচু মনের হলে এসব বলেছে! তাই তো ঠাটিয়ে দু'খানা চড় দিয়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছে। সংসার যেহেতু তার এত প্রিয়, চরিত্রহীন সঙী নিয়েই যদি সংসার করার এত শখ তবে এ বাড়ির মুখো দর্শনও যেনো না করে। 


______


তীর্যক রোদ খাড়াখাড়ি আকারে শরীরে পড়ছে। গরমে যেনো শরীর জ্বলে যাচ্ছে। স্কুলে বড় মাঠ টার মাঝখানে তিস্তা তার বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করছে। শরীরটা তার আজ ভীষণ খারাপ লাগছে। ভেবেছে না খেয়ে আসার জন্য হয়তো এমন হচ্ছে। 


গোল্লাছুট খেলায় মত্ত তিস্তা'কে ভরাট কণ্ঠে মাস্টারমশাই ডাক দিলো,

-'তিস্তা, এখানে আয়।'


খেলায় মত্ত তিস্তা খেলাতে বিঘ্ন ঘটায় একটু বিরক্ত হলো। তবুও মাস্টারমশাই ডেকেছে বলে কথা। খেলা রেখে সে ছুটে আসলো। ঘর্মাক্ত লাল বর্ণা মুখ খানায় লেপ্টে থাকা ছোট্ট চুল গুলো কপাল থেকে সড়িয়ে হাঁপিয়ে ওঠা কণ্ঠে বলে,

-'কী মাস্টারমশাই?'


মাস্টারমশাই উত্তর দিলো না। বরং, তিস্তার বই বহন করা থলেটা তিস্তার দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,

-'বাড়ি যা তাড়াতাড়ি। আর স্কুলে থাকার দরকার নেই,  যা। পারলে স্কুলের পিছনের রাস্তা দিয়ে বাড়ি যাবি। বড় রাস্তায় উঠবি না কেমন?'


তিস্তা অবাক হয়। হতভম্ব কণ্ঠে বলে,

-'মাত্র তো একটা বিষয় পড়াইলো মাস্টারমশাই। ছুটি হতে তো ম্যালা দেড়ি। এখন গেলে বড় মাস্টার বাবা'র কাছে বিচার পাঠাইবে।'


-'তুই বড় হবি কবে? নিজের শরীরে প্রতি তো অন্তত একটু যত্নশীল হওয়া উচিত। যা বাড়ি যা।'


তিস্তা অবাক হলো। হঠাৎ তার মনে পড়লো তার শরীর অসুস্থ হওয়ার কারণটা। প্রতিমাসের রুটিনমাফিক অসুখটা আবার তাকে ধরেছে আর সে ভুলে গেলো? মাস্টারমশাই কীভাবে জানলো? তিস্তা ভীরু চোখে নিজের পড়নের কাপড় খানার দিকে তাকালো। লজ্জায় সে মিইয়ে গেলো। ব্যাগটা হাতে নিয়ে দৌড়ে ছুটে গেলো স্কুলের পিছন দিকটাতে। কোনো থামা থামি নেই। এ বিশ্রী লজ্জা ঢাকার জন্য প্রাণপনে তাকে ছুটতে হবে। যতদূর গেলে মাস্টারমশাইয়ের চোখে চোখ পড়বে না। 


_____


দীর্ঘ দু'দিন পর বাড়ি থেকে বের হয়েছে তিস্তা। দাদী তাকে এ দু'দিন বাড়ি থেতে বের হতে দেয় নি। বন বাদাড়ে ছুটে বেড়ালে নাকি ভূ*ত পে'ত্নী ধরবে সে ভয়ে। গ্রামের প্রচলিত কিছু যুক্তিহীন নিয়ম সবসময়ই প্রচলিত থাকে। আজ জোড় করে তিস্তা বের হয়েছে। স্কুলে নাকি পরীক্ষা শুরু হবে তাই মাস্টারমশাই এর কাছে পড়তে যেতে হবে। তাছাড়া বাকি সহপাঠীরা জানিয়েছে কঙ্কণা নাকি মাস্টারমশাই এর সাথে অনেক ভাব জমিয়েছে। সেই ভাবও তো দেখতে হবে। 


পাঠশালায় বাকি সহপাঠীরা চলে এসেছে তিস্তার আগেই। পড়ানো প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছে,তন্মধ্যেই হাজির হয় তিস্তা। প্রতিদিন দেরি করে পড়তে আসাটা যেনো তার বদ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। 


প্লাবন তখন কালো বোর্ডটাতে গুটি গুটি অক্ষর লিখতে ব্যস্ত। দরজায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সে দরজার পানে তাকাতেই দু'দিন পর কাঙ্খিত মুখখানা দেখতে পেলো। দু'দিন যাবত এ মুখখানা দেখার আশায় কতবার যে সে দরজার পানে তাকিয়েছিলো। আজ অবশেষে তার তাকানো টা বিফলে গেলো না। 


তিস্তার আজ অন্যরকম রূপ। নীল রাঙা ঝলমলে থ্রি-পিস শরীরে জড়ানো। চুল গুলো ভিজে পিঠের সাথে লেপ্টানো। চোখের নিচে মোটা করে কাজল দেওয়া। গলায় কালো একটা তাবিজ বাধাঁ। ফ্রক পড়া ছোট্ট তিস্তা জেনো থ্রি-পিস পড়ে বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। নিজেকে সাজিয়েছেও ভীষণ সুন্দর করে। কে বলবে মেয়েটা ছোট!


তিস্তা প্লাবনের দিকে তাকিয়ে বিনীত কণ্ঠে বললো, 

-'আসবো মাস্টারমশাই?'


প্লাবন কিছু বলার আগেই কঙ্কণা খোঁচা মারা কণ্ঠে বললো, 

-'কিরে, তিস্তা? এত সাজুগুজু কেনো করেছিস? বিয়ে ঠিক হলো নাকি?'


তিস্তার এতক্ষণে কঙ্কণার দিকে দৃষ্টি গেলো। মেয়েটা কালো রঙের মখমল কাপড়ের জামা পড়ে এসেছে। বেশ সুন্দর লাগছে। দশজনের মাঝে দাড়ালে বেশ নজর কাড়বে তার রূপ নির্দ্বিধায়। 


পরক্ষণেই কঙ্কণার বলা কথাটা মাথায় খেলে যেতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে সে। তেড়ে গিয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই প্লাবন আটকে দেয় তাকে। রামধমক দিয়ে বলে,

-'দু'দিন পর কী করতে এসেছিস এখানে? এমন পড়াশোনা করার চেয়ে না করা'ই ভালো। আর, মুখে এমন রঙচঙ মেখেছিস কেনো? বিয়ের বাতাস শরীরে লেগেছে নাকি?'


প্লাবনের ধমকে সশব্দে হেসে দেয় কঙ্কণা। তিস্তা হা হয়ে যায়। হঠাৎ ই তো তার সাজতে মন চাইলো। তাই বলে মাস্টারমশাই এসব বলবে? তাও কঙ্কণার সামনে? 


ভীষণ অভিমান জাগে তিস্তার। দ্রুত সে বের হয়ে যায়। প্লাবন দু একবার পিছে ডাকলেও সে শুনে না। মন খারাপ হয় প্লাবনের। এভাবে না বললেও হয়তো পারতো। মেয়েটাকে দু'দিন পর দেখলো অথচ ভালো করে দেখতেও পেলো না। 


ছোট্ট একটা আফসোসের শ্বাস ফেলে আবার নিজের পড়ানো তে মনযোগী হবে প্লাবন, এমন সময় তিস্তা আবার দরজার সামনে দাঁড়ায়। লাল টকটকে ফুলো গাল আর নাক টা প্রমাণ করে দিয়েছে মেয়েটা ভীষণ কেঁদেছে। 


প্লাবন এবার দারুণ ভাবে অবাক হয়ে যায়। চোখের নিচে গাঢ়ো কাজল টা ধুঁয়ে এসেছে তিস্তা। এর কালো রঙটা খুব এলোমেলো হয়ে গেছে তবুও এঁটে বসে আছে চোখের কোণে। জামার সামনের অংশ কিছুটা ভিজে গিয়েছে। মেয়েটা তবে মুখ ধুয়ে এলো? এত রাগ! 


প্লাবন ঘরে ঢুকার অনুমতি দিতেই তিস্তা গটগট পায়ে রুমে ঢুকলো। কঙ্কণা খোঁচা মারা কণ্ঠে বললো, 

-'আচ্ছা তিস্তা,পৃথিবীতে এত নাম থাকতেও তোর নাম তিস্তা কেনো রাখলো? তাও আবার আমাদের গ্রামের পাশের তিস্তা নদী থাকতেও তোকে আবার সেই নাম দেওয়ার কোনো দরকার ছিলো?'


প্লাবণ তিস্তার দিকে এক মুহূর্ত তাকালো, তিস্তার মুখ খোলার আগে সে'ই ধমকের স্বরে বললো,

-'কঙ্কণা, উল্টোপাল্টা কথা বললে এখানে পড়তে আসার দরকার নাই। এটা তোমার এসব কথা বলার জায়গা না।'


কঙ্কণা চুপ হয়ে গেলো। তিস্তা নিজের জায়গায় বসতে যাবে এমন সময় বাহির থেকে হৈচৈ ভেসে এলো। প্লাবন ছুটে বের হয়ে আসলো। তার পিছে পিছে সব শিক্ষার্থী ছুটে আসলো। প্লাবন সদর দরজার কাছে দাঁড়াতেই দেখলো গ্রামের অনেক লোক বড় রাস্তার দিকে ছুটে যাচ্ছে। প্লাবণ গ্রামের এক মুরুব্বি'কে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-'চাচা,কী হয়েছে?'


মুরব্বি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললো,

-'তিস্তা নদীতে একটা মাইয়ার লাশ ভাইসা উঠছে। কী সুন্দর মাইয়া নাকি। সবাই তো তা-ই দেখতে যাইতাছে।'


প্লাবণ বিষ্মিত কণ্ঠে বলে , 

-'মেয়ের লাশ!'


-'হ মাস্টার, মাইয়ার লাশ। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখনও এমন লাশ ভাইসা উঠতো। আমরা সবাই ছড়া বাইন্ধা বলতাম,

''নদীর নাম তিস্তা,লাশ আসে ভাইস্যা।"


অনেক বছর পর সেই দিন দেখি আবার আইতাছে। তাইলে আর মাইয়ারা, ছোট বাচ্চা'রা নিরাপদ না।'


চাপা উত্তেজনায় পুরো গ্রাম স্তব্ধ। উত্তেজনা ছড়িয়ে গেছে মাস্টারমশাই'র সকল শিক্ষার্থীর মাঝেও। সবচেয়ে উত্তেজিত হয়েছে তিস্তা। কার লাশ ভেসে এসেছে নদীতে, তা না দেখলে জেনো তার শান্তি হবে না। মাস্টারমশাই সবাই'কে ছুটি দিয়ে দেয়। কারণ, এত উৎকণ্ঠা নিয়ে ছেলেমেয়ের আর পড়াতে মন বসবে না। সবাই যখন বের হয়ে গেলো, মাস্টারমশাই তিস্তাকে ভরাট কণ্ঠে বললো, 

-'তুই কিন্তু ভুলেও নদীর পাড় যাবি না। তুই এখানেই থাকবি এখন। গত দু'দিন যাবত অনেক পড়া পড়িস নি, এখন সব পড়ে শেষ করবি।'


তিস্তার চকচকে উত্তেজনা আকাশ সমান হতাশায় রূপান্তরিত হলো। এক রাশ নতুন কিছু দেখার উদ্দীপনা মিইয়ে গেলো ভরাট কণ্ঠে উচ্চারিত হওয়া শব্দ গুলোর কাছে। তার ভয়ঙ্কর রকমের রাগ হলো। পড়াশোনাটা সৃষ্টি কেনো হয়েছে? এমন ছোট্ট মনের ছোট্ট আশা গুলো খান খান করে দেওয়ার জন্য'ই বুঝি পড়াশোনার সৃষ্টি? পড়াশোনা ম'রে যেতে পারে না? ওর বাঁচার কোনো অধিকার নেই। এমন ডজন খানেক অভিশাপ দিয়ে তিস্তা পড়ার বেঞ্চটার দিকে এগিয়ে গেলো। 


তিস্তার উচ্ছ্বসিত মুখ ভঙ্গির সেকেন্ডের মাঝে বিরাট পরিবর্তে পেট ফেটে হাসি এলো প্লাবনের। এ মেয়ে'র যা আগ্রহ সব ব্যাপারে, এত সহজে লাশ না দেখে মিটবে না। একাই চলে যাবে সুযোগ পেলে। দীর্ঘক্ষণ নিজের মনের মাঝে আকাশ পাতাল ভেবে প্লাবন ঠিক করলো তিস্তার আগ্রহ শেষ করার উপায়। 


তিস্তা ব্যাগ থেকে বই বের করতে যাবে তার আগেই প্লাবন এক রাশ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

-'তুই সত্যিই নদীর পাড়ে যাবি না!'


-'কীভাবে যাবো? আপনি ছুটি দিয়েছেন?'


-'চল,আমি নিয়ে যাবো। কিন্তু সেখানে গিয়ে কোনো কথা বলতে পারবি না। রাজি?'


তিস্তা'র মিইয়ে যাওয়া উৎসাহ দ্বিগুণ আকারে ধারণ করলো। উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে বললো, 

-'সত্যি!'

-'হ্যাঁ সত্যি। এবার চল।'


তিস্তা দিক বেদিক ভুলে ছুটে এলো। বেশ মজা'র কিছু দেখবে ভেবে উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, 

-'চলেন, চলেন। ধন্যবাদ মাস্টারমশাই।'


প্লাবন কিছু না বলে ধীর গতিতে বের হয়ে আসলো। সে জানে, তিস্তা তার মনের উত্তেজনা না মিটিয়ে থাকতো না। এর চেয়ে সে সাথে থেকে মনের উৎকণ্ঠা নিভিয়ে দিবে। 


______


ভিজে বালুর মাঝে সাদা রাঙা ঝলমলে জামা পড়া একটি মেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। হ্যাঁ, এ মেয়েটিই এখন লাশ বলে চারদিকে গন্য হচ্ছে। 


তিস্তা মাস্টারমশাই এর আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ চাপা উত্তেজনা কাজ করলেও এখন ভয় করছে। কেমন বিধ্বস্ত দেহখানা। প্লাবন তিস্তার গুটিয়ে যাওয়া দেখে ফিসফিস কণ্ঠে বললো, 

-'কিরে, ভয় পাচ্ছিস? এ জন্যই বলেছি আসার দরকার নেই। শুনলি না তখন আমার কথা।'


তিস্তা ভীত চোখে মাস্টারমশাই এর দিকে তাকায়। সত্যিই মাস্টারমশাই'র কথা শোনা উচিৎ ছিলো তার। এই যে, এখন কেমন পস্তাতে হচ্ছে কথা না শুনে। অনাকাঙ্খিত উত্তেজনা, ভয় তাকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। নদীর বাতাসে আজ জেনো কেমন ধূসর গন্ধ। এটা কী লাশের গন্ধ? নাকি কোনো পঁচে যাওয়া মস্তিষ্কের নোংরামির গন্ধ? 


মেলার মতন হৈ হৈ করে লোক এলো লাশ দেখতে। এ যেনো কারো মৃত দেহ না, অসাধারণ এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। নিজের চোখে দর্শন না করলে যেনো দুনিয়া টা মিথ্যে হয়ে যাবে, জন্ম বিফলে যাবে। ধাক্কাধাক্কি করে সবাই দাঁড়িয়েছে লাশ দেখার জন্য। 


সদর থেকে পুলিশ আসতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো। ততক্ষণে ভীড় কমার বদলে দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। বাড়ি গিয়ে জমিয়ে নতুন গল্প করার লোভ ছাড়তে পারে নি পথিকরা, তাই তো আগ্রহ আর টানটান উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটাকে দেখার জন্য। কোন গ্রামের মেয়ে, কার মেয়ে এসব চেহারা না দেখলে কীভাবে বলবে! 


তিস্তার ছোট্ট মনও সেই পথিকদের বাহিরে না। সেও অনেক ভয় পাওয়া সত্বেও দাঁড়িয়ে আছে। শেষমেশ কী হয় দেখার জন্য। 


পুলিশ আসতেই সবাই সড়ে দাঁড়ায়। চাপা উত্তেজনায় থম মেরে আছে সবাই। পুলিশদের মাঝেই একজন কনস্টেবল এগিয়ে গেলো বড় অফিসারের আদেশে। সবার অপেক্ষা'র পালা শেষ করে থুবড়ে পড়ে থাকা লাশটা'কে সোজা করলো। চুলে ঢেকে যাওয়া চেহারাটা'কে সড়াতেই আৎকে উঠে সবাই। ভীড়ের মাঝে এক গগণ বিদারক চিৎকার ভেসে আসে। সাথে ঝমঝম করে স্রোত বয় বিষন্নতার আফসোসের। হাজারো চিৎকারের মাঝে একটা কথাই সবাই বলছে,

-'আরে এটা তো গ্রামের পুরোহিতের মাইয়া ভ্রমরী।'


ততক্ষণে তিস্তা লাশটা'র পাশে এসে ধপ করে বসে পড়ে। হৃদয়বিদারক আর্তনাদ করে বলে,

-'আমার ভ্রমর,ও ভ্রমরী তুই এখানে শুয়ে আসিস কেন? ভ্রমর, উঠনা সই। উঠ। তুই ঘুমিয়ে আছিস কেনো? উঠ তাড়াতাড়ি।'


প্লাবন যেনো নিজের বাক্ শক্তি হারিয়ে ফেললো। ভ্রমরীর লাশ দেখার জন্য চারপাশে এত রমরমা? এত উচ্ছ্বাস? তার পাঠশালার আরেকটা দুরন্ত ছাত্রী, এভাবে এখানে শুয়ে আছে! 


পুলিশ কর্মকর্তার কিছু লোক এগিয়ে এলো। ভুড়িওয়ালা বড় কর্তা নাক মুখ কুঁচকে ধমক দিয়ে বললো,

-'এই মেয়ে, উঠ এখান থেকে। লাশ'কে ছুঁয়েছিস কেনো? পরে তো তোর উপর দোষ পরবে। যা উঠ।'


তিস্তা যেনো আরো এঁটে বসলো ভ্রমরীর নিস্তব্ধ দেহখানার সাথে। দু'দিন সে ঘর থেকে বের হয় নি বলে মেয়েটা নিজে গিয়ে দেখা করে এসেছে। কাল দুপুরেও তো দেখা করে এসেছিলো। হ্যাঁ, এ জামাটাই তো শরীরে ছিলো। তবে কী মেয়েটা আর বাড়ি ফিরে নি? 


উৎকণ্ঠায়,উত্তেজনায় ঠান্ডা হয়ে আসে তিস্তার শরীর। জড়ানো কণ্ঠে বান্ধবীর লাশ খানায় হাত বুলিয়ে বলে,

-'দেখেছিস সই, সবাই তোর নাম ভুলে গেছে! কেমন লাশ লাশ করছে! এই শোনো তোমরা, ওর নাম ভ্রমরী। কেউ লাশ বলবে না। আমার সই ঘুমিয়ে আছে। উঠ না সই। উঠবি না?'


আর কণ্ঠনালি থেকে শব্দ নিসৃত করতে সক্ষম হয় নি তিস্তা। বর্ণহীন পানিতে টইটম্বুর হওয়া তিস্তা নদীর পাড়ে লুটিয়ে পড়ে রক্তমাংসের গড়া তিস্তার দেহখানা। সইয়ের নিস্তব্ধতা অসার করে দেয় মেয়েটার শরীর। 


গ্রামে যেকোনো খবর ছড়ায় বাতাসেরও আগে। অপরিচিত লাশ গ্রামের পরিচিত,ছুটন্ত, দূরন্ত মেয়ে ভ্রমরীর এ যেনো কেউ ভাবতেই পারে নি। মানুষজন এবার আরও দ্বিগুণ হলো। সাদা ধূতি পড়া, কপালে চন্দন লেপ্টানো মধ্যবয়স্ক বিপত্নীক পুরোহিত নেপাল ঠাকুর হন্তদন্ত হয়ে দিশেহারার মতন ছুটে আসে। 


ততক্ষণে প্লাবন আর কয়েকজন এগিয়ে আসে তিস্তার জ্ঞান ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টায়। 


মধ্যবয়স্ক নেপাল আহাজারি করে উঠে। নিজের কপাল চাপড়িয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে দিয়ে বলে,

-'ও ঠাকুর গো, আমার কপাল ক্যান পুড়ো তুমি বারবার? আমার ফুলের মতন কন্যা কেন আজ ধূলোয় লুটালো? কোন পশুর ক্ষুধার নিবৃত্তি হলো আমার কন্যা? হে ঈশ্বর, তুমি বুঝি মরারে আবার মাইরা গেলা? আমার মাইয়া ছাড়া আমার যে কেউ নাই। আমি কি নিয়ে থাকবো।'


ভীড়ের মাঝে থেকে দু'একজন এগিয়ে এলো। নেপাল'কে স্বান্তনা দিচ্ছে তার মেয়ের খুবলে খাওয়া লাশটার সামনে। দূর দূরান্ত হতে মানুষ এসেছে লাশ দেখার তীব্র আকাঙ্খায়। এমন পৈচাশিক আকাঙ্খাও থাকতে পারে, এদের না দেখলে বুঝা যেতো না। 


সবার মুখে মুখে আফসোসের স্বর। মেয়ে টা অনেক ভালা ছিলো, কারো মুখে মুখে তর্ক করতো না। একটু দুষ্টামি করতো তিস্তার সাথ দেওয়ার জন্য কিন্তু কোনো বেয়াদবি করতো না। এমন আরও গুনগান শুরু হলো গ্রামের পর গ্রাম। সাথে আফসোস ছিলো সবার মুখে। মা মরা মেয়েটা এমন অকালে মরলো! 


________


ভর সন্ধ্যা তখন। চারপাশ আধাঁর করা বিষন্ন সন্ধ্যা নেমেছে আজ। মধুসখী নদীর কিনারায় রাজকীয় ঘাটের নিচের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে তিস্তা। চুল গুলো তার অদৃশ্য বাতাসে উড়ছে। 


গতকাল সইয়ের লাশ দেখার পর যে জ্ঞান হারালো একবারে রাতে ফিরেছে। জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে খাটে আবিষ্কার করলো সে। বাহির থেকে তখন ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। সাথে ভেসে আসছে আম্মা, বাবা আর দাদীর চাপা কথোপকথনের শব্দ। 


তিস্তা কান খাড়া করলো। এত চাপা গলায় তো কথা বলার মানুষ তারা না। মা - বাবার কথা বাদ দিলেও দাদী! সে কথা বললে কম পক্ষে গঞ্জের দোকান অব্দি কথা যায় আর সে কিনা এত ধীরে কথা বলছে? 


তিস্তা নিজের ঘরের টিনের দরজায় কান পাতলো। বাবা বলছেন,

-'জানো,মেয়েটারে যখন দাহ করতে নিলো, শরীরের কী অবস্থা তার। কুকুরও বোধহয় এমন হিংস্র হয় না।'


বাবা'র কথার পরিপ্রেক্ষিতে মায়ের চাপা স্বর ভেসে এলো,

-'আচ্ছা, কে করেছে এসব! মেয়েটা তো খারাপ ছিলো না। গতকাল দুপুরে আমাদের তিস্তার সাথে দেখা করতে এসেছিলো যে জামাটা পরে সেটাই তো শরীরে দেখলাম। তাহলে কী বাড়ি যায় নি মেয়েটা?'


-'নাহ্। নেপাল ঠাকুরের কথায় যা বুঝলাম, সে গতকাল কুমতি গ্রামে গিয়েছিলো কী পূজার জন্য । বাড়িতে এসেছিল মধ্যরাতে। বাড়িতে মেয়েকে না দেখে ভেবেছিলো তার বড় ভাইয়ের বাড়িতে হয়তো মেয়েটা ঘুমাতে গেছে। প্রায় নাকি সে দেরিতে বাড়ি আসলে মেয়েটা নিজের জেঠুর বাড়ি ঘুমায়। কিন্তু কাল যে অদৃষ্ট নির্মম খেলা খেলবে কে জানতো। মেয়েটাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিলো। কী অ'মানুষ।'


-'পুলিশ কী বললো গো?'

-'ওসব পুলিশ টাকার নিচে থাকে। বলেছে তো অনুসন্ধান করবে উনারা কিন্তু হাবভাবে তা মনে হয় না।'


তারপর কিছুটা সময় চুপ রয় পাশের রুমের মানুষ গুলো। তিস্তার চোখ দিয়ে অঝরে বর্ষিত হয় অশ্রু। দাদী হুশিয়ারি কণ্ঠে বলে,

-'দেখিস, তিস্তারেও এহন থেইকা সাবধানে রাখতে হইবো। ম্যালা বছর পর গ্রামে বোধহয় মানুষ খেকো রাক্ষস এসেছে। ওরে একলা ছাড়িস না।'


দাদী'র কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর কথা আসে না। বাবা-মায়ের মনে ভয় হয়। রাক্ষসটা কে? সে কী মানুষ খেকো না মেয়ে খেকো? বাকি রাতটা পুরো গ্রামবাসীরই বোধহয় নির্ঘুম কাটে। নিষ্পাপের মৃত্যু কেইবা মানতে পারে! 


ভাবনার মাঝে হঠাৎ তিস্তা অনুভব করলো সে ভিজে যাচ্ছে। শরীর বেয়ে পানি পড়ছে। চোখ মেলে দেখে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝপঝপ করে বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছে চারপাশ। কিন্তু হঠাৎ তিস্তার চোখের সামনের দৃশ্যটি দেখে তিস্তার চোখ বড় হয়ে যায় বিষ্ময়ে। 


এতদিন সব পানি শুষে নেওয়া মধুসখী পানি শুষছে না। বৃষ্টির পানি জমছে নদীখানায়। সাথে সজীব হয়ে উঠছে বোধহয় মধুসখী। এ কোন ভয়াবহ ইঙ্গিত!


সেই বিকেল হতে নিশ্চুপ তিস্তাকে খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা পেরিয়েছে। মাস্টারমশাই'র বাড়িতে গিয়ে যখন খোঁজ করলো তিস্তা এসেছে কিনা তখন হতেই সবার ভিতর ভয় জেগে উঠলো। মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে আসে নি মেয়েটা গেলো কোথায়? এ পাড়া ওপাড়া খোঁজ চললো সারা বিকেল। মাস্টারমশাই ও খোঁজ শুরু করলো। 


অবশেষে হঠাৎ বর্ষণে সিক্ত হওয়ার পর মাস্টারমশাই এর মনে পড়লো তিস্তার প্রিয় জায়গা খানার কথা। ছুটে গেলো মধুসখী'র পাড়ে। কতক্ষণ ঝোপঝাড় খুঁজে নিরাশ হলো সে। অতঃপর ঘাটের শেষ প্রান্তে চোখ গেলো তার। ঘাড় অব্দি চুল গুলো ভিজে লেপ্টে থাকা এক সিক্ত নারীর দিকে নজর গেলো প্লাবনের। এইতো, তার হারিয়ে যাওয়া শ্বাসের নতুন আশ্রয়। তার ভীত মনের আপনজন। 


তিস্তা তখনও ঠাঁই ঘাটে বসে ছিলো। বৃষ্টিতে তার ভিজে নাজেহাল অবস্থা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছায় নি। তার মস্তিষ্কের সচল নিউরন গুলো বারবার এটাই জানান দিচ্ছে মধুসখী'র সজীবতা। 


মাস্টারমশাই তিস্তাকে পেছন থেকে বার কয়েক ডাক দিলো। ঝড়ের দাপটে হয়তো ডাক গুলো তিস্তার কান অব্দি আসে নি। হঠাৎ নিজের হাতে টান পড়ায় ধ্যান ভাঙলো তার। কিছুটা বোধগম্য হওয়ার আগেই চড় পড়লো গালে। ছিটকে গেলো সে কিছুটা। বিষ্মিত দৃষ্টিকে সামনে তাকাতেই দেখে মাস্টারমশাই এর বিক্ষিপ্ত মুখখানা। চোখ জোড়া ভীষণ ক্ষুব্ধ। শরীরের সাথে মাস্টারমশাই এর পাঞ্জাবিটা এঁটে সেঁটে আছে। কয়েক সেকেন্ডে মাস্টারমশাই'কে বেশ পর্যবেক্ষণ করা হয়ে গেলো তার। 


হঠাৎ কানে ভেসে এলো অগ্নিবর্ষণ করার মতন কথা। মাস্টারমশাই চেঁচিয়ে বলছেন,

-'এত রাতে এখানে বসে আছিস, ভয় ডর আছে তোর? কাল এত বড় একটা ঘটনায় যেখানে পুরো গ্রাম ভীত সেখানে তুই এত রাতে এই নদীর পাড়ে বসে আছিস! মাথা কী কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তোর? মানলাম ভ্রমরীকে তুই ভালোবাসতিস, তাই বলে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা ভুলে যাবি?'


তিস্তার ততক্ষণে ধ্যান ফিরলো। চারপাশে তাকালো। আসলেই তো, এত রাত হয়ে গেছে! সে অবাক হয়। এত রাত অব্দি সে এখানে বসে ছিলো? 


তিস্তার জবাব না পেয়ে মাস্টারমশাই আরেকটু রেগে যায়। হাত ধরে টান দেয় উপরে যাওয়ার জন্য। কিন্ত তিস্তা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে,

-'মাস্টারমশাই, আমাদের সাথে খুব বড় কিছু হবে বোধহয়।'


মাস্টারমশাই এতক্ষণ পরে তিস্তার এমন রহস্যমাখা বাক্য শুনে হতভম্ব হয়। কী বললো তিস্তা! অনেক বড় কিছু হবে মানে? তিস্তা কী নিজের মাঝে নেই? 


প্লাবনের উত্তপ্ত রাগ হঠাৎ ঝিমিয়ে আসে। নেতিয়ে যায় তার বিশাল তেজ। একটু কোমল হয়। নিজেদের মাঝে অধিক দূরত্বটা খানিক ঘুচান। একটু এগিয়ে এসে স্নেহভরা হাতটা তিস্তার মাথায় রেখে কোমল কণ্ঠে বললো, 

-'কী বলছিস তিস্তা? কী হবে? তোর কী ভ্রমরীর জন্য খারাপ লাগছে? তাই এমন করছিস? কী হয়েছে বল?'


তিস্তা এবার নিজের নিষ্প্রাণ দৃষ্টি জোড়া মাস্টারমশাইয়ের উপর নিবদ্ধ করে। বৃষ্টির মাঝেও তিস্তার চোখের কোণে থাকা অশ্রুর কণা গুলো বেশ বোঝা যাচ্ছে। প্লাবনের টর্চ লাইটের আলোয় তিস্তার চোখের কোণে অশ্রকণা গুলো চিকচিক করে উঠলো। 


মানবী'র চোখের কোণে অপ্রত্যাশিত অশ্রু দেখে ভীত হলো প্রেমে লেপ্টে থাকা পুরুষ। আহ্লাদী স্বরে বললো,

-'কাঁদছিস কেনো তিস্তা? কী হয়েছে? চড় দিয়েছি বলে কাঁদছিস? আচ্ছা আর মারবো না। তবুও কাঁদিস না।'


প্লাবনের কোমল কণ্ঠে আহ্লাদ পেয়ে যায় তিস্তার চোখের অশ্রুকণা গুলো। আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেগে তারা ঝরতে আরম্ভ করলো। তিস্তা ভীত হলো। তার হঠাৎ করে ভীষণ ভয় চেপে ধরলো। সে স্থান, কাল,পাত্র সব ভুলে গেলো এক নিমিষে। দ্রুত গিয়ে মাস্টারমশাইয়ের হাত জড়িয়ে ধরলো। পৃথিবীর সব আকুতি ঢেলে দিলো তার কণ্ঠে। একটু আশার আলোর খোঁজে মাস্টারমশাইয়ের হাতখানা চেপে ধরে, আকুতি মাখানো কণ্ঠে বললো, 

-'আমাকে বাঁচান মাস্টারমশাই। আমি মরতে চাই না। আমাকে বাঁচান। মৃত্যু খুব কঠিন। আমি মরবো না।'


ভুল জায়গায় এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে একটু থমকে যায় প্লাবন। তিস্তা মৃত্যু'র কথা কেনো বলছে! মেয়েটা কী ধীর ধীরে উন্মাদ হচ্ছে? এহেন কথা কেনো বলছে মেয়েটা! অতিরিক্ত শোকে কী তার মস্তিষ্কের সচলতা হারিয়েছে? 


প্লাবনকে চুপ থাকতে দেখে তিস্তার ভীত মনে আরও ভয় ঢুকে গেলো। তবে কী মাস্টারমশাই তাকে বাঁচাবে না? এই পৃথিবীতে হঠাৎ করেই বেঁচে থাকার ভীষণ ইচ্ছে জাগছে তিস্তার। ভ্রমরী'র করুণ মৃত্যু দেখেই হয়তো তার এমন মৃত্যুভীতির উদয়। সে ভীত কণ্ঠে আবার বললো,

-'আমাকে বাঁচাবেন না মাস্টারমশাই? আমাকে বাঁচাতে পারবেন না আপনি? তবে কী আমিও মারা যাবো? জমিদারের বউ মধুসখী'র মতন অত ভালোবাসা না পেতেই আমি মারা যাবো?'


প্লাবন হতভম্ব। মেয়েটা কী বলছে আবোলতাবোল! সে তিস্তার বাহুতে ভরসার হাত রেখে বলে,

-'তুই কেনো মরবি? মৃত্যু কী এত সোজা? এসব বলছিস কেনো!'

-'কারণ মধুসখী জীবিত হওয়া শুরু করছে বোধহয়।'


বৃষ্টির দাপটে কথাটা ক্ষাণিক অস্পষ্ট হয়ে কানে যেতেই ভড়কে যায় প্লাবন। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে, 

-'কী!'


তিস্তা তার ডান হাতের তর্জনী আঙুল টা সামনের দিকে তাক করলো। অদ্ভুত কণ্ঠে বললো, 

-'মধুসখী আজ বৃষ্টির জল শুষে নিচ্ছে না। তার মানে সে জীবিত হতে চাচ্ছে। তার মানে আমাকে মরতে হবে মাস্টারমশাই! আমি জন্ম নিয়েছি আর মধুসখী মৃত ঘোষিত হয়। এখন মধুসখী জীবিত হচ্ছে, তবে কী আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এলো?'


প্লাবন তিস্তার কথার ভিত্তিতে সামনে তাকায়। টর্চের আলো মধুসখী'র উদ্দেশ্যে মারতেই পিলে চমকে উঠে তার। না চাইতেও দু পা পিছিয়ে যায়। মনে ভেসে উঠে কিছু যুক্তিহীন বিশ্বাস। মধুসখী'তে আজ খড়খড়ে মাটি নেই। ভিজে উঠেছে সে। এত বছর পর তার এহেন পরিবর্তন কেনো? তবে কী,,,


নাহ্, আর ভাবতে পারে না প্লাবন। নিজের অবস্থান ভুলে যায় সে। জড়িয়ে ধরে তিস্তাকে। ভীত কণ্ঠে বলে,

-'এসব কী বলছিস তুই? কিছু হবে না তোর। কিসের সাথে কী মিলাচ্ছিস! দেখবি কাল রোদের আলো পড়তেই মধুসখী আবার খড়খড়ে হয়ে গিয়েছে। তুই চিন্তা করিস না।'


তিস্তা কী ভেবে যেনো ক্ষানিক হাসে। নিভু নিভু কণ্ঠে বলে, 

-'আমায় বাঁচাবেন তো মাস্টারমশাই? নাকি মধুসখী বেঁচে যাবে! গ্রামের জেলেদের ঘর কী তবে রমরমা হবে আবারও?'


প্লাবন আর কিছু বলার আগেই অনুভব করলো তিস্তার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। অনেক সময় একটানা বৃষ্টিতে ভিজার ফলে হয়তো এ দশা। প্লাবন আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে তিস্তাকে কোলে তুলে নিলো। ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। তার মনে হচ্ছে মধুসখী পিছন থেকে তার পা টেনে ধরছে। সুন্দর মধুসখী হয়তো রাক্ষসী রূপ ধরে বলছে তিস্তাকে তার কাছে দিয়ে যেতে। 


মাস্টারমশাইয়ের ভীত মন আরও ভীত হলো। সে দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে পাড়ে উঠে গেলো। মধুসখী কেনো, কাউকেই সে দিবে না তিস্তাকে। তিস্তা কেবল তার। 


____


তিস্তার নিস্তেজ শরীরটার দিকে তাকিয়ে বার বার ডুকরে কেঁদে উঠছে লতিকা বেগম। তিস্তার বাবাও মন খারাপ করে বসে আছে চারপায়া টাই। তিস্তার মা কেবল মেয়ের মাথার কিনারায় বসে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। প্লাবন দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। 


এত রাতে গ্রামে ডাক্তার পাওয়া টা অসম্ভব হলেও এত রাতেও তিস্তা ডাক্তারের চিকিৎসা পাচ্ছে। তাও গ্রামের ডাক্তার না। শহুরে ডাক্তার। মোড়ল সাহেবের বড় ছেলে মাহিন। গত সপ্তাহে সে শহর থেকে এসেছে। শহরে সে ডাক্তারি পড়াশোনা করে। গ্রামের লোকে বলে, মোড়লের পুরো উল্টো তার ছেলে। যেমন ভদ্র, তেমন নম্র। অনেক মিশুকও। সে ডাক্তারি পড়াশোনা করছে বর্তমানে। 


তিস্তার এমন অবস্থা দেখে দিক বেদিক ভুলে তিস্তার বাবা শেষমেশ মাহিনের কাছে যায়। এত ঝড়বৃষ্টিতে মোড়ল ছেলেকে আসতে দিতে না চাইলেও মাহিন বাবার কথা অমান্য করে ছুটে আসে। 


নিজের কাছ থেকে কিছু ওষুধপত্র তনয়ার দিকে এগিয়ে দিলো মাহিন। বেশ নম্র কণ্ঠে বললো, 

-'চাচী,এই ওষুধ গুলো ওরে খাইয়ে দিবেন। রাতের মাঝে জ্বর নেমে যাবে আশারাখি।'


তনয়া বেগম দ্রত ওষুধ গুলো নিয়ে মাথা নাড়িয়ে কৃতজ্ঞতার স্বরে বললেন,

-'আপনি বড় উপকার করলেন।'


মাহিন ছোট্ট হাসি দিয়ে বললো,

-'আমি আপনার ছোট। আপনি অন্তত আমাকে আপনি বলে লজ্জা দিবেন না। আপনার ছেলের মতনই আমি। আজ তাহলে আসি।'


তিস্তার বাবা আমান শেখ উঠে দাঁড়ালো। ইতস্ততা ভরা কণ্ঠে বললো,

-'আপনার পারিশ্রমিক টা কত যদি বলতেন,


মাহিন উঠে দাঁড়ালো। বিনয়ী কণ্ঠে বললো,

-'লজ্জা দিবেন না এসব বলে। আপনারা আমরা একই গ্রামের। আমাদের আবার কিসের পারিশ্রমিক? আপনাদের জন্যই ডাক্তারী পড়ছি। আপনাদের কাজে আসার জন্য ই তো এতসব। রাতে কোনো সমস্যা হলে নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবেন। আজ আসি তাহলে।'


অতঃপর মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

-'আপনি তো গ্রামের সবার পছন্দের মাস্টারমশাই প্লাবন তাই না? আপনার অনেক প্রশংসা শুনি। আজ দেখেও নিলাম। একদিন দেখা করবো আপনার সাথে। ভালো থাকবেন।'


মাস্টারমশাই ও বিনয়ের সাথে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ আচ্ছা। 


মাহিন নিজের ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে গেলো। তার পিছে পিছে এগিয়ে দেওয়ার জন্য আমান শেখও গেলো। মাহিন বের হতেই লতিকা বেগম মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন,

-'এতদিন শুইন্যা আইছি এ পোলা নাকি অনেক ভালা। আজ দেখলামও। মোড়লের মতন চা'মাড় বেডার এত ভালা পোলা! তারে উপরওয়ালা বাঁচায় রাখুক।'


তিস্তার মা তনয়া বেগমও তিস্তার মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে কৃতজ্ঞতার হাসি দিলেন। 


কিন্তু মাস্টারমশাই এর মনে চলছে ভিন্ন দ্বন্দ্ব। সে মাহিনের চোখে অন্য কিছু দেখেছে তিস্তার জন্য । মুগ্ধতা বলা যায় সেটাকে। 


গ্রামে ভ্রমরী'র মৃত্যুর খবরের সাথে আলোড়ন জাগিয়েছে আরেকটা খবর, মৃত মধুসখীর খড়খড়ে ভাব উধাও হওয়ার খবর। এখনো পানি আসে নি তবে মৃত ভাবটা এখন নেই। আগের মতন অত খড়া নেই। নদীর বুক এখন কোমল হয়েছে। মাটি নরম। 


জেলেদের মুখে অসাধারণ হাসি। নতুন সুখের দেখা মিলবে বলে। মধুসখী নদীটা বেশ লক্ষী নদী। এ বেঁচে উঠলে জেলেদের ঘরে পরিপূর্ণতা দিবে দু-হাত ভরে। 


দীর্ঘ দু'দিনের অসুস্থতায় মিইয়ে গিয়েছে তিস্তা। আজ সকাল হতে হতেই স্নান করে রোদে এসে দাঁড়ালো তিস্তা। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। মুখে দু এক খানা কালো দাগের উপস্থিতি। শরীরটাও সামান্য শুকিয়ে গিয়েছে। 


হঠাৎ বাহিরের দূরের পথ থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে এলো। গ্রামে অত গাড়ি তো আসে না। কেবল পুলিশের গাড়ি আসে। তবে কী বড় অফিসাররা গ্রামে এলো? ভ্রমরীর সাথে হওয়া অন্যায় এর কোনো খোঁজ মিললো?


তিস্তা ভেজা চুলে গামছা জড়ানো অবস্থায়ই ছুটে গেলো। তনয়া বেগম তখন রান্নাঘরে কেবল ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে ছিলো। গরম ভাত খেয়ে আমান শেখ দোকানে যান। বাজারে তার বড় মুদির দোকান আছে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় তার আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। তিস্তাও আজ স্কুলে যাবে। গরম ভাত পেটে থাকলে মাথা ঠান্ডা থাকবে। পেট শান্তি মানেই দুনিয়া শান্তি। 


মেয়েকে হঠাৎ ছুটে যেতে দেখে তনয়া ডাক দিলো চওড়া কণ্ঠে। কে শুনে কার ডাক! তনয়ার ডাকে ঘর থেকে আমান শেখ বেরিয়ে আসলেন। ছোট্ট কণ্ঠে খানিকটা বিরক্ত ভাব মিশিয়ে বললেন,

-'কী হয়েছে? ষাঁড়ের মতন চেঁচাচ্ছো কেনো? বাড়ির বউয়ের গলা গঞ্জের হাট অব্দি পৌঁছুচ্ছে বোধহয়।'


তনয়া বেগম ক্ষ্যাপে গেলেন। অসন্তোষ জনক কণ্ঠে বললেন,

-'আমি কী করবো? মেয়ে একটা তো হয়েছে উড়নচণ্ডী। এই জ্বরে গোসল দিলো। এখন আবার কই জেনো ভেজা চুলে ছুটে গেলো। কী করবো আমি এ মেয়ে নিয়ে। আগুনে ভাত চড়িয়েছি। আপনি একটু গিয়ে দেখুন না কোথায় গেলো। মাথা আবার ঘুরিয়ে টুরিয়ে পড়ে গেলে হবে আরেক কেলেঙ্কারি।'


আমান শেখের কপালের ভাজ গুলো আরেকটু গাঢ়ো হলো। বিরক্তিটা সরে গিয়ে ভাঁজ পড়লো চিন্তার। মেয়েটা এত অসুস্থতার মাঝে ছুটোছুটি করছে? এ মেয়েটাকে নিয়ে সে যত চিন্তা করে বড় মেয়েটাকে নিয়ে তার এক ভাগ চিন্তাও করতে হতো না। 

-'চিৎকার চেঁচামেচি না করে আগে ওটা বললেই তো পারতে। মেয়েটা যে কার মতন হলো!'


কথা শেষ করে আমান শেখ হন্তদন্ত হয়ে হয়ে মেয়ের পিছে পিছে গেলেন। তনয়া বেগম একটু মুচকি হাসি দিলেন। মেয়েটা তার বাবার প্রাণ যেনো। এই যে, মেয়ের কথা শুনতেই বিরক্ত উবে গিয়ে চিন্তা হানা দিয়েছে মুখে। মেয়েটা অনেক ভাগ্যবতী। 


শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো সে। 


তিস্তা নিজের বাড়ি ছেড়ে বেশখানিকটা এগিয়ে গেলো। পথিমধ্যে ভীষণ ভীড়। সেখানটাই পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার আশেপাশে কত গুলো ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। 


তিস্তা এগিয়ে গেলো, মোড়ল সাহেবও এখানে আছে। নেপাল জেঠুকেও দেখা যাচ্ছে। মানুষটার শরীরে সাদা ধুতি আর একটা বেশ পুরোনো ফতুয়া। ফতুয়াটা'র রঙও সাদা কিন্তু পুরোনো হওয়ায় হলদেটে রঙ ধারণ করেছে। সাদা রংও কেমন ঘেটে যায় পুরোনো হলে! পুরোনো হলে সব কিছুই রঙ বদলায়। হোক জেঠুর ঢিলে ফতুয়া কিংবা রক্তমাংসের মানুষ। 


পুলিশ অফিসারদের কাছাকাছি যেতেই ভুড়িওয়ালা অফিসারের কথা ভেসে এলো,

-'আমরা তো আমাদের মতন খুঁজছি, কিন্তু কোনো কিছুই পাচ্ছি না। কাউকে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না।'


অফিসারের কথার পরিপ্রেক্ষিতে মোড়লের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এলো, 

-'কিছুই পাচ্ছি না মানে কী? গেরাম থেইকা একটা মাইয়া এমন ভাবে মই'রা যাইবো আর আপনি পাচ্ছি না বইলা খালাস হইবেন তা তো হইতে পারে না। যত তাড়াতাড়ি পারেন হেই বেজন্মারে খুইজা বাইর করেন।'


অফিসার যেনো একটু ভড়কে গেলেন। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললেন,

-'আমরা সব দেখছি। সবাই তো অনুসন্ধান করা শুরু করে দিয়েছে এখন দেখি কী করা যায়।'


নেপাল ঠাকুর এবার মুখ খুললেন। অসহায় কণ্ঠে বললেন, 

-'আমার কন্যার আত্মার শান্তির জন্য হইলেও ঐ নরপশুরে ধইরেন সাহেব। আমার আর কোনো চাওয়া নেই। কন্যা আমার শান্তিতে পরলোকে থাকুক। এই পৃথিবী তো আর তাকে শান্তি দিলো না। মা'হারা অভাগিনী টা।'


কথা থামিয়ে'ই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো নেপাল ঠাকুর। তিস্তারও চোখে জলে টইটুম্বুর হলো। পুকুরে আর সাঁতার প্রতিযোগিতা দেওয়া হবে না, ইচ্ছে হলেই ডাই'নী বলা যাবে না। ইচ্ছে হলেও কাউকে জড়িয়ে বলা হবে না, তুই আমার প্রাণের সই। মাঝে মাঝে মানুষ এত অসহায় কেন হয়ে যায়? 


মোড়লের স্বান্তনার কণ্ঠ ভেসে এলো, 

-'আর কাইন্দা কী হইবো নেপাল? একলা মাইয়াটারে বিয়া না দিয়া ঘরে রাইখা শকূণের খাবার বানাইছো। তবে ভ্রমরী আমাগো গ্রামের মাইয়া। ওর সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার হইবো। তুমি বাড়ি যাও।'


মোড়লের কথায় সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া নেপাল জেঠু ছোট্ট বাচ্চাদের মতন মাথা নাড়িয়ে দুর্বল পায়ে হাঁটা ধরে বা'দিকের মাটির সরু রাস্তাটায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় বাবা সে। সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখার মতন অসহায়ত্ব আর কিইবা হতে পারে? 


তিস্তার ছোট্ট মনে আকাশ আধাঁর করা বিষন্নতা হানা দিলো। মৃত সইয়ের জন্য যতটা না কষ্ট হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে নেপাল জেঠুর জন্য। মানুষটার দিন দুনিয়ায় আপন বলতে আর যে কেউ রইল না। 


তিস্তা মাটির পথটার দিকে ছুটে গেলো। নেপাল ঠাকুর একটু হকচকিয়ে গেলো বোধহয় তাকে দেখে। যখন ঠাওর করতে পারলো এটা তিস্তা তখন ছোট্ট শ্বাস ফেললো। বিষন্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-'মা, তুই এইখানে যে?'


জেঠুর কথায় ঠেলে কান্না এলো তিস্তার। জেঠুর হাতটা আঁকড়ে ধরে কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, 

-'তোমার খুব কষ্ট লাগছে তাই না, জেঠু?


নেপাল ঠাকুর মৃত হৃদয়টা নিয়ে খানিকটা হাসে। তিস্তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

-'কষ্ট হবে সেটাই তো স্বাভাবিক রে মা। আমার এত্ত ছোট মেয়েটা এমন অকালে চলে যাবে কে জানতো?'


তিস্তা জেঠুর চোখের কোণে অশ্রু টুকু মুছে দেয়। ছোট্ট তিস্তা বেশ ভরসাময় নারীর মতন বললো,

-'কেঁদো না জেঠু। এই যে তোমার ভ্রমরী তিস্তার মাঝে আছে। যখন ইচ্ছে হবে ছুটে আসবে। দেখবে তিস্তার হাসিতে ভ্রমরীর খিলখিল হাসিখানা।'


মধ্যবয়স্ক নিঃস্ব মানুষটা কেঁদে দেয়। বাচ্চাদের মতন মাথা দুলাতে দুলাতে বলে,

-'ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুক মা। ভ্রমরীর মতন আর কোনো ফুল জেনো ঝড়ে না যায়। আমি আসছি মা।'


তিস্তা আর কিছু বলার আগে পুরোহিত জেঠু ছুটে চলে গেলো। নিজের দুর্বলতা না দেখানোর অদম্য ইচ্ছেয় লোকচক্ষুর আড়াল হলো বোধহয়। 


তিস্তা নিজের অশ্রু টুকু মুছে নিলো। ছোট্ট শ্বাস ফেললো। হঠাৎ পেছন থেকে ভরাট পুরুষালী কণ্ঠে চমকে উঠলো। পিছনে তাকিয়ে দেখে মোড়লের ডাক্তার ছেলে, মাহিন। 


মাহিন হাসিমুখে এগিয়ে এলো। মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো,

-'তুমি তো তিস্তা তাই না? শরীর কেমন এখন?'


তিস্তা মুখ কুঁচকে ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,

-'ভালো।'

-'শুধু ভালো? না, অনেক ভালো?'


মাহিনের এমন কথায় সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় তিস্তা। বিরক্ত কণ্ঠে বললো, 

-'আমার জ্বর কমিয়েছেন বলে কী এত প্রশ্ন করা লাগবে? আমার উত্তর দিবো না। যান।'


মাহিন তিস্তার কথায় আরেকটু হেসে দেয়।হাসিমাখা কণ্ঠে বলে, 

-'না, আমি তো এমনেই জিজ্ঞেস করেছি। তা এখানে কেনো?'


-'মন চেয়েছে তাই আসছি। আপনার সমস্যা?'


মাহিন তিস্তার উত্তর শুনে হা হয়ে গেলো। এত তেজ মেয়েটার! 


তিস্তা বাড়ির পথে হাঁটা ধরে। পথের মাঝে তার বাবার সাথে দেখে হয়। আমান শেখ নিজের মেয়েকে দেখতেই এগিয়ে গেলেন। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,

-'কী রে মা, কোথায় গিয়েছিলি? তোর না শরীর অসুস্থ? চল বাড়ি চল।'


তিস্তা বাবার হাত ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাবা'রা বুঝি এত ভালো হয়? সব বাবাদের সন্তান যেনো বেঁচে থাকে। কারণ বাবাদের প্রাণ যে তাদের সন্তানের মাঝে। 


____


ইচ্ছে না থাকা সত্বেও এক বান্ধবী'র বিয়েতে এসেছে তিস্তা। সব বন্ধু-বান্ধব তাকে জোর করে নিয়ে আসছে বললেই চলে। তিস্তার মন ভীষণ খারাপ। ভ্রমরীর চলে যাওয়ার পর আর কিছুতেই তার মন বসছে না। তার মাঝে গত দু'দিন যাবত মাস্টারমশাই গ্রামে নেই। স্কুলের কাজে সদরে গিয়েছে। 


হঠাৎ তিস্তা অনুভব করলো তার পিছে কেউ দাঁড়িয়েছে। চমকে তাকাতে দেখলো মাস্টারমশাই এর হাসি হাসি মুখ। তিস্তাকে তাকাতে দেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,

-'কিরে, তুই এসেছিস। ভালো হয়েছে ঘর থেকে বের হয়েছিস। সবার সাথে মিশলে ভালো লাগবে।'


কে শুনে কার কথা? দীর্ঘ দু'দিন মাস্টারমশাইকে না দেখার তৃষ্ণা মিটাতে ব্যস্ত তিস্তারানী। এই মানুষটাকে না  দেখে মনের মাঝে মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে। 


তিস্তাকে ড্যাবড্যাব তাকিয়ে থাকতে দেখে প্লাবন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-'কিরে, জ্বর কমেছে?'


তিস্তার ধ্যান ভাঙলো। মাথা নিচু করে বললো,

-'হ্যাঁ কমেছে। কখন এলেন?'

-'এই তো একটু আগে। রিমুর বিয়েতে তো আগেই দাওয়াত দিয়েছিলো। তাই সোজা এখানে চলে আসলাম।'


তিস্তা আর কিছু বলে না। মনের মাঝে ভীষণ মন খারাপটা এখন আর নেই। কেনো!


তিস্তা আনমনেই রিমুর দিকে তাকায়। বধূ বেশে তার ছোট বান্ধবী কত বড় লাগছে। হঠাৎ একটা বিষয় নজর কাড়ে তিস্তার। রিমুর বর, রিমু ঘেমে গেছে বলে তার রুমালটা আড়ালে এগিয়ে দিলো। ভীষণ মিষ্টি একটা দৃশ্য। 


হঠাৎ তিস্তা মাস্টারমশাই এর দিকে তাকিয়ে আনমনেই বললো,

-'আমার না ভীষণ বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে মাস্টারমশাই।'


তিস্তার নিচু কণ্ঠের স্বচ্ছ কথায় হতভম্ব মাস্টারমশাই। এ মেয়ে কী বলছে।  বিয়ে বিয়ে আবার পায় কীভাবে! 


আজ কতদিন যাবত একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির জন্য ঘরের বাহিরে পা রাখা যাচ্ছে না। তিস্তা মুখ ফুলিয়ে পাঠশালার বাহিরে তাকিয়ে রইলো। বরাবরই তার বৃষ্টি প্রিয় কিন্তু এখন বৃষ্টিতে তার রাজ্যের ভয়। বৃষ্টি হচ্ছে আর মধুসখী একটু একটু বাড়ছে। না চাইতেও মন কু ডাকছে। বাহিরের বৃষ্টিময় দৃশ্য টা অবশ্য তার খারাপ লাগছে না। ভিজে মাটি,সিক্ত পাতা। এ জেনো মনোরম কোনো দৃশ্য। যা সারাদিন দেখলেও শেষ হবে না। 


মনের মাঝে আজগুবি ভাবনার ভাঁটা পড়লো মাস্টারমশাই'র ভরাট কণ্ঠে। সে গম্ভীর কণ্ঠে তিস্তার উদ্দেশ্যে বললো,

-'বাহিরে কী দেখছিস তিস্তা? দু'দিন পর তোদের মাধ্যমিক পরীক্ষা। আর তুই বাহিরে তাকিয়ে আছিস! পড়াশোনা করার ইচ্ছে নেই?'


তিস্তার ধ্যান ভাঙে। মাস্টারমশাই'র দিকে তাকায়। মাস্টারমশাই আগে থেকে কেমন যেনো একটু শুকিয়ে গেছেন। দুশ্চিন্তায় চোখের নিচে কালি জমেছে যেনো। আজ প্রায় পাঁচদিন যাবত মাস্টারমশাই এর মায়ের শরীরটা ভালো নেই। মা ছাড়া তো আর কেউ নেই তার, তাই দুশ্চিন্তায় নিজের শরীরে আঁচড় কেটেছে অবহেলা। 


তিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো মাস্টারমশাই। রাশভারী কণ্ঠে বললো, 

-'তুই এখনই পাঠশালা থেকে বের হয়ে যা। পড়াশোনা না করলে এখানে আসবি না। যা, বের হ।'


তিস্তা অবাক হলো। মাস্টারমশাই এর মন মেজাজ খারাপ তা নাহয় সে জানে, তাই বলে সামান্য কারণে বের করে দিবে? আজব! 


তিস্তা উঠে দাঁড়ালো নতজানু হয়ে বললো,

-'আর বাহিরে তাকাবো না। এবারের মতন ক্ষমা করুন।'


মাস্টারমশাই আর কিছু বলেন নি। আজকাল যে তার বড্ড ভয় হয়। ভ্রমরী মারা যাওয়ার পর গুনে গুনে আঠারো দিন পাড় হয়েছে। আর অবাকবশত এই আঠারো দিনের মাঝে পুরো গ্রাম ভুলে গেছে ভ্রমরী নামক মেয়েটার কথা। সেই বিভৎস দৃশ্যের কথা। তিস্তাও আজকাল মোড়লের ছেলে মাহিনের সাথে বেশ ভাব জমিয়েছে। সে ছেলে ডাক্তার হলেও বেশ অসাধারণ ভাবে মিশে যায় বাচ্চা,বুড়ো সবার সাথে। এটাই প্লাবনকে অতিষ্ট করে দিচ্ছে। 


হঠাৎ নিরবতা ভেঙে কঙ্কণা তিস্তার দিকে তাকিয়ে বেশ জোরে বলল,

-'তোর জন্য নাকি বিয়ের প্রস্তাব এসেছে? পরীক্ষায় বসবি না তাহলে?'


পুরো নিশ্চুপ ঘরখানায় টিনের বৃষ্টির শব্দ'কে ছাপিয়ে কথাটা যেনো মাস্টারের মস্তিষ্ক হতে হৃদপিণ্ডে তড়িৎ-গতিতে পৌঁছালো। বাহিরের ঝড়'কে পাল্লা দিয়ে শরীরের ভেতরে এক ভয়ঙ্কর তান্ডবলীলা শুরু হলো। সে ঝড় যেনো হঠাৎ করেই মাস্টারমশাই এর ভীত হৃদয়কে ভেঙে চৌচির করে দিলো। ঝড়ের পর,ভয়ঙ্কর বন্যায় হয়তো ডুবে যাবে হৃদয়খানা। 


কঙ্কণার কথায় বিরক্তি প্রকাশ করলো তিস্তা। অসহ্য রকমের বিরক্ত ছুঁড়ে ফেললো কঙ্কণা'র মুখে। অসন্তোষজনক কণ্ঠে বললো, 

-'তুই কী সারাদিন আমার খবর নিয়ে বেড়াস কঙ্কণা? তোর কী আর কোনো কাজকর্ম নেই?'


কঙ্কণা মুখ ভেংচি দিলো। প্লাবনের দিকে তাকিয়ে বললো,

-'দেখেছেন মাস্টারমশাই,এ মেয়ের মাথায় এখন এসব ঘুরছে বলেই পড়াশোনায় মন নেই। কাউকে জানাতে চাচ্ছে না বিয়ের কথা।'


তিস্তা কঙ্কণার এমন অহেতুক কথায় বিরক্ত হলো। হ্যাঁ, পরশুদিন তার জন্য পাশের গ্রাম থেকে একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো ঠিকই কিন্তু তার বাবা তো সাথে সাথে না করে দিয়েছে। তবে, এটা নিয়ে এত মাতামাতির কী হলো? 


মাস্টারমশাই তিস্তার মুখে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তিস্তা তো তাকে সব বলতো, তাহলে এটা বললো না কেনো? পর করে দিচ্ছে মেয়েটা তাকে? হুটহাট যে মেয়েটা আনমনে তার কাছে অদ্ভুত বায়না ধরে, সেটা কী তবে কেবল বয়ঃসন্ধির প্রভাব? মেয়েটার কেবল আবেগ হয়ে রইলো সে! 


এমন হাজার খানেক গোপন প্রশ্ন নিয়ে হতাশার শ্বাস ফেললো মাস্টারমশাই। হয়তো তাকে এ কথাটা বলতে ভুলে গেছে মেয়েটা। নানান তালবাহানা দিয়ে নিজের মনকে শান্ত করলো সে। কঙ্কণার দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, 

-'তুমি কীভাবে জানলে এ খবর? তিস্তা তো নিশ্চয় তোমাকে বলে নি।'


মাস্টারমশাই এর প্রশ্নে কঙ্কণা মনে মনে খুশি হলো। তার ধ্যান পাওয়ার জন্যই তো এই কথাটা তুলেছিলো। কঙ্কণা বেশ রসালো কণ্ঠে বললো,

-'আমার বড়ভাই বলেছে। মাহিন ভাই এর সাথে তিস্তার তো বেশ ভাব। হয়তো তিস্তা মাহিন ভাইকে বলেছিলো, সেটাই পরে মাহিন ভাই কথায় কথায় আমাকে বলেছে।'


ব্যাস,আগেরপরের কোনো কথা মাস্টারমশাই এর কর্ণ অব্দি পৌঁছায় নি মাহিন নামটার পরে। এতটা পর হয়ে গেলো সে? এখন সব কথা মাহিন জানে কিন্তু সে জানেনা! এত ভাব মাহিনের সাথে? 


অপরদিকে তিস্তার মনঃক্ষুণ্ন হলো। সে তো মাহিনকে যেচে বলে নি। মাহিন সাহেবই তো জিজ্ঞেস করেছিলো তাদের বাড়িতে এত মেহমান কেনো এসেছে। তখনই তো সে বলেছে। নাহয় কী বলতো? মাস্টারমশাইকেই তো সব বলে। এছাড়া কাউকে বলে না কোনো বিষয়। এখন মাস্টারমশাই এর মন মেজাজ খারাপ তাই বলে নি। 


প্লাবনের মনটা হঠাৎ থিতিয়ে গেলো। ভীষণ তিক্ততা ছড়িয়ে গেলো শিরায় শিরায়। আর ভালো লাগছে না কিছু। দাঁড়িয়ে থাকাটাও কেমন অসহ্য লাগছে। কোনো মতে কাঠের চেয়ারটাই গিয়ে বসলো সে। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো, 

-'আজ সবার ছুটি। বাড়ি গিয়ে পড়তে বসো। কিছুদিন পরই মাধ্যমিক পরীক্ষা। সবার তো আর তিস্তার মতন বিয়ে হবে না, তাই সবাই পড়ায় মন দেও।'


মাস্টারমশাই এর এমন কথায় বুকভার করা অভিমান জাগলো সপ্তদশী কন্যার। তার কি বিয়ে হবে নাকি? এ বয়সের মেয়েদের একটু আধটু তো বিয়ের সম্বন্ধ আসেই। পুরো ঘটনা না জেনেই মাস্টারমশাই সবসময় এমন করে। 


ছুটির কথা শুনতেই সকল ছাত্রছাত্রী ছুট লাগালো। তিস্তা সবার শেষে ধীরে ধীরে ঘরের বাহিরে যেতে নিলেই মাস্টারমশাই এর খোঁচা মারা কণ্ঠ ভেসে এলো,

-'তা কবে বিয়ে? দাওয়াত দিবি না?'


তিস্তা একটু থমকালো ৷ মাস্টারমশাই না জেনে এমন করে কেনো? মনের মাঝে একটা শক্তপোক্ত রাগ হলো। মুখটা শক্ত করে বললো,

-'দাওয়াত দিবো না কেনো, অবশ্যই দিবো। খুব শীগ্রই পাবেন দাওয়াত।'


কথা শেষ হওয়ার সেকেন্ডের মাথায় বিশাল এক চড় পড়লো ডান গালে। মাথাটা ঝিমিয়ে এলো। শরীরের প্রতি শিরা কেঁপে উঠলো। মাস্টারমশাই এর হুঙ্কার ভেসে এলো,

-'এ বয়সে এত বিয়ে করার শখ তোর? কত বয়স তোর? হ্যাঁ, কত বয়স! সারাদিন এ পাড়া ঐ পাড়া, এ ছেলে ঐ ছেলের সাথে উড়নচণ্ডী পানা করেও শখ মিটে না? আবার বিয়ে করবি? কিসের বিয়ে করবি এ বয়সে?'


তিস্তা খানিকটা কেঁপে উঠলো। অভিমান জমলো ছোট্ট মনের কোণে। আহত স্বরে বললো,

-'কী বলছেন এসব, মাস্টারমশাই!'

-'কী বলছি তুই বুজিস না? আর, এই, এই মেয়ে, তোর মাহিনের সাথে এত কী? ওর সাথে এত কিসের ঘুরঘুর? তোর হাত পা ভে'ঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো। এখন সব কথা মাহিনকে বলা হয় তাই? এত আপন ও!'


তিস্তার অশ্রু বাঁধ মানলো না। তিস্তা মুখ ঘুরিয়ে বললো,

-'আপনি অনেক খারাপ মাস্টারমশাই। অনেক খারাপ। আমি আর আপনার মুখও দর্শনও করতে চাই না। কখনো না।'


প্লাবনের জ্বলন্ত অগ্নি শিখার ন্যায় রাগটা হঠাৎ ই শীতল বরফে পরিণত হলো। তার মুখদর্শন করতে চায় না মেয়েটা? সে এত খারাপ! 


মাস্টারমশাই দু পা পিছিয়ে গেলো। কাঠের চেয়েরটাই বসে পড়লো বিনা শব্দে। তিস্তা ছুটে দরজা অব্দি চলে গেলো। কিন্তু বের হলো না। কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। নিজেকে ধাতস্থ করলো। মাস্টারমশাই এর দিকে না তাকিয়েই বললো,

-'আমার কোনো বিয়ে ঠিক হয় নি। কেবল প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো। ডাক্তারকে আমি এটা বলি নি। সে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলো এত মেহমান কেনো এসেছে, তাই আমি বলেছিলাম। আপনার কতদিন ধরে মন খারাপ চাচীর অসুস্থতার জন্য তাই আপনারেও বলি নি। আপনি সবসময় কঙ্কণার কথা শুনেন। আর কখনো আসবো না আমি। কখনো না।'


প্লাবন কেবল চুপ করে বসে রইলো। কেমন যেনো অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো নিজের উপর। সে সত্যিই খারাপ? 


_______


স্কুল প্রাঙ্গণে তিস্তা প্রায় ঘন্টাখানেক হলো এসেছে কিন্তু আজ মাস্টারমশাই এর দেখা পায় নি। হয়তো স্কুলে আসেন নি। কাল বাড়ি আসার পর আর মাস্টারমশাই এর সাথে দেখা হয় নি। সে আর বাহিরে বের হয় নি। কাল সারাদিন বৃষ্টি থাকলেও আজ আকাশ পরিষ্কার। রৌদ উত্তপ্ত। 


মন মরা হয় সবটা ক্লাস করলো তিস্তা। মাস্টারমশাইকে কাল কত গুলো খারাপ কথা বলেছে সে। এজন্য মাস্টারমশাই তাকে আর পড়াবে তো? নাকি সত্যিই আর তার মুখদর্শন করবে না? 


এমন ছয় নয় ভেবে পুরো সকালটা পাড় করলো সে। কারো সাথে কোনো কথা বলে নি। ছুটি দিতেই সোজা বাড়ি চলে গেলো। দ্রুত স্নান করে তৈরী হলো পড়তে যাবে বলে। আজ একটু সেজেছেও। মাস্টারমশাই এর পা ধরে ক্ষমা চাইবে দরকার হয়, তবুও সে মাস্টারমশাই এর কাছে পরবে। 


নিজের উড়ন্ত মনে দ্রুত তৈরী হয়ে উঠোনে ব্যাগ নিয়ে আসতেই তনয়া বেগমের কণ্ঠ ভেসে এলো। সে বিষ্ময় মাখানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-'কোথায় যাচ্ছো তিস্তা?'


তিস্তা খানিক বিরক্ত হলো। প্রতিদিন এ সময়ে কোথায় যায় সে, মা জানে না? তবুও জিজ্ঞেস কেন করছে! বিরক্ত হয়ে সে বললো, 

-'পড়তে যাচ্ছি।'


তনয়া বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। অবাক কণ্ঠে বললো, 

-'কার কাছে পড়তে যাচ্ছো? তোমার মাস্টার তো বাড়িতে নেই।'


মায়ের কথা কর্ণকুহরে পৌছুতেই তিস্তার কপাল কুঁচকে গেলো। অবাক কণ্ঠে বললো, 

-'বাড়িতে নেই মানে? কোথায় গেছে?'


তনয়া বেগম বিষ্মিত কণ্ঠে বললো, 

-'কেনো তুমি শুনো নি, তার মা যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে! তারা তো আজ ভোরে শহরে গেছে। বড় ডাক্তার না দেখালে তার মা মারা যাবে। অনেক চিকিৎসার প্রয়োজন। আর হয়তো গ্রামে আসবে না। চিকিৎসার জন্য তারা প্রবাসে যাবে মনেহয়।'


তিস্তা একটু থমকালো। মাস্টারমশাই শহরে গেছে? তাকে একবারও বলে গেলো না যে? মাস্টারমশাই কী তবে তাকে আর দেখবে না? 


ছোট্ট মেয়েটার বুকের মাঝে বিষন্নতার পাহাড় নামলো। সে ছুুটে বেরিয়ে এলো মাস্টারমশাই এর বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পিছন থেকে তনয়া বেগম ডাকলেও শুনলো না। সে মানে না, মাস্টারমশাই তাকে না বলে চলে যাবে। 


মাস্টারমশাইদের সদর দরজাটা বাহির থেকে ছিটকানি দেওয়া। তালা লাগানো না। দরজা টা খুলতেই ফাঁকা বাড়ি চোখে পড়লো তিস্তার। কাক পক্ষীও নেই বাড়িটাই। ধূ ধূ মরুভূমি যেনো। তিস্তা হঠাৎ খেয়াল করলো, এ বাড়িটার মতন তার হৃদপিণ্ড টাও খালি। চোখের কোণে বাঁধ মানলো না অশ্রুকণা। ক্ষেতের সরু মাটির পথটা দিয়ে ছুট লাগালো তিস্তা। মাস্টারমশাই এর নিশ্চয় অনেক অভিমান জমেছে। তাই তো তাকে বলে যায় নি। কবে আসবে মাস্টারমশাই? আর আসবে তো? 


তিস্তার মনে পড়লো, প্রায় দু'বছর আগে ঠিক এ পথটাতেই দেখা হয়েছিলো এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল ওয়ালা, স্নিগ্ধ পুরুষের সাথে। মধ্যাহ্নেই আগমন হয়েছিলো মাস্টারমশাই এর। তবে, দু বছর পর তার বুকের বা'পাশ খালি করেই সে মধ্যাহ্নের মাস্টারমশাই চলে গেলো! একরাশ বিষন্নতার সমুদ্রে ডুবাতেই বুঝি এসেছিলো মানুষটা! আর আসবে তো এমন উত্তপ্ত মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই? নাকি অতিথি পাখির মতনই সে দেখা দিয়েছিলো! 


মাস্টারমশাই এর পড়ার ঘরখানায় দমকা বাতাসে টেবিলের উপর থেকে একটা ছোট্ট চিরকুট পড়ে গেলো। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা ছিলো,

-'তিস্তা, যার মুখ হৃদয়ে অঙ্কিত, তাকে কীভাবে দর্শন না করি! আমি ফিরবো, কোনো মধ্যাহ্নে। অপেক্ষা করিস। করবি তো অপেক্ষা!


আমি ফেলে যাচ্ছি সপ্তদশীর কন্যাকে, 

হৃদয় মাঝে যে প্রতিনিয়ত বসন্ত আকেঁ।'


তাড়াহুড়োতেও চিরকুট লিখতে ভুলে নি মধ্যাহ্নের মাস্টারমশাই। কিন্তু এ চিরকুট খানা যে সে অব্দি পৌঁছাতে পারলো না। তবে কী এক স্নিগ্ধ মধ্যাহ্নের শুরু হওয়া গল্প, এক বিষন্ন মধ্যাহ্ন দিয়েই শেষ হবে! 


ভীষন যত্নে বিষন্নতা মাখানো দিন দুই পাড় করলো তিস্তা। মাস্টারমশাই ছাড়া কেবল মাস্টারমশাই এর বাড়িটা না, এ গ্রামের রাস্তা, স্কুলের মাঠ, মধুসখী'র ঘাট, তিস্তার পাড়, আর সপ্তদশী'র হৃদয় খানা যেনো হাহাকার করে উঠছে। এ কেমন যন্ত্রণা! এ কেমন রিক্ততা? পুরো দুনিয়া যেনো ধূ ধূ মরুভূমি। গ্রীষ্মের চৌচির হওয়া পুকুরের মতন ভীষণ খড়া পড়েছে হৃদয়ে। ইশ, একটু বৃষ্টি, একটু প্রিয় মানুষের দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণায় ছোট্ট লাল হৃদয়টা বিষন্নতায় নীল হয়েছে। বেদনার রঙ যে নীল! 


চারদিকে আধাঁর করা সন্ধ্যা নেমেছে। তিস্তার রুমের দরজাটা হা করে খোলা। চাঁদ উঠেছে আকাশে। বেশ বড়সড় চাঁদ। রাত হলে বিদ্যুৎ থাকে না। এইতো বছর পাঁচেক আগে গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। কেবল নামের আসা আরকি। দিনের বেলায় সূর্য তার উদার হস্তে দু'হাত ভরে অনেক আলো দান করে। আর তখনই ঘরে ঘরে কৃত্রিম আলো মানে বিদ্যুৎও থাকে। কিন্তু যেই সূর্য ঢেকে যায় আধাঁরে তখনই কৃত্রিম আলোও চলে যায়। বিদ্যুৎ টা ঠিক সুসময়ের বন্ধু প্রবাদটার উদাহরণ হয়েছে। 


গ্রীষ্মকালের দিনের উত্তপ্ত রোদ টিনের চালে পড়ে ঘর গরম হয়ে থাকে। রাত হলে ধীরে ধীরে সে গরম কেটে যায়। ঠান্ডা ভাব আসে। তবে আজ চারদিকে বাতাস নেই। কেমন থম মারা আবহাওয়া। তিস্তা হঠাৎ অনুভব করলো পাশের রুম থেকে বাবা,দাদী আর আম্মার কেমন যেনো ফিসফিস কণ্ঠ ভেসে আসছে। তিস্তা কান খাড়া করলো। আজকাল সবাই যেনো তার গোপনে কিছু বলে। কেনো? কী এমন কথা আছে যে সে জানতে পারবে না? 


কোনো বাহ্যিক শব্দ না থাকায়, পাশের রুম থেকে কথা গুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তিস্তার মা রুক্ষ স্বরে বলছে, 

-'না,আমার মেয়ে এখনো ছোট। পাত্র যত সুপুরুষই হোক না কেনো বিয়ে দিবো না।'


তিস্তার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে। তার বিয়ের কথা হচ্ছে কেন আজকাল? সে কাউকে বিয়ে করবে না। মাস্টারমশাই যে অনেক রাগ করবে তার উপর। 


তিস্তার ভাবনার মাঝে দাদীর গলা ভেসে এলো। সে বুঝানোর চেষ্টা করে বলছে,

-'মাইয়া মানুষ পাড় করা হইলো বড় দায়িত্ব। কার, কী, কখন হইয়া যায় কে জানে! এর আগে ঘাঁড় থেকে বোঝা নামানো ভালা।'


-'আম্মা,আপনি উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। আমার মেয়েটা ছোট। আর এসব ও শুনলে কষ্ট পাবে। এ কথা ওর কান অব্দি যেনো না পৌঁছায়।'


তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে। যাক, বাবা মা তো তার পক্ষেই। হঠাৎ দাদীর হেয় কণ্ঠে বলা কথা ভেসে এলো,

-'মাইয়া মানুষ হইলো অল্প সময়ের অতিথি। তাগোরে কয়েকবছর যত্ন কইরা পাইলা মাইনষের হাতে তুইলা দেওয়া হইলো উচিৎ কাম।'


-'আমি তো আমার তিস্তাার মাঝে আপনারে দেখি আম্মা। মেয়ে মানুষ অল্প সময়ের অতিথি কেনো হবে? মেয়ের মাঝে যেখানে আমি আমার মা'কে দেখি!'


তিস্তার চোখ গড়িয়ে সামান্য অশ্রুকণা বালিশের উপর পড়লো। জল গুলো শুষে নিলো নরম তুলোর দল, দাঁগ রেখে দিলো বালিশের কভার খানা। জীবনও ঠিক এমনই। কেউ ক্ষত মুছানোর চেষ্টা করে, আর কেউ আমাদের ত্রুটি গুলো যত্নে রেখে দেয়। সারাজীবন আমাদেরকে সেই ত্রুটি মনে করিয়ে আমাদের মুক্ত হয়ে উড়ার ডানা গুলো কেটে দেয়। 


তিস্তা পাশের বালিশটা নিয়ে মুখের উপর চেঁপে ধরলো। কান্না গুলো যেনো দরজা পেরিয়ে পাশের ঘরে না যেতে পারে। তার চোখের জল যেনো না ঝরে তাই নিয়ে  বাবা-মায়ের কত চিন্তা, আর সে এমন অশ্রু বিসর্জন করছে দেখলে তাদের কতটা না কষ্ট হবে! 


প্রনয় মানে এক ঝাঁক বিষন্নতা। বালিশে মুখ চেঁপে কান্নার নাম প্রনয়। মুখে হাসি রেখে ভিতরে অনলে পু'ড়ে যাওয়া হলো প্রনয়। 


সপ্তদশী বুঝে, মাস্টারমশাই এর জন্য হওয়া অনুভূতি গুলো তাকে আজীবন এক ব্যাথাময় সুখ দিবে। কী লাভ তবে এত ভেবে! নীল রঙটা বেছে নিয়েছে তো সে নিজ ইচ্ছায়। আর সামান্য বেদনা সহ্য করতে পারবে না? 


______


'আজকাল তোমার কী হয়েছে? খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছো দেখি! সারাদিন জানালার শিকলটা ধরে কাটিয়ে দিচ্ছো। পরীক্ষা যে সামনে মনে আছে?'


মায়ের কথায় ধ্যান ভাঙে তিস্তার। মৃত দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকায়। তনয়া বেগম এগিয়ে আসে। একটু আগে রান্না শেষ হলো। গরম ভাত আর গরম ডালের সাথে বড় মাছের এক টুকরো ভাজি নিয়ে মেয়ের রুমে এসেছেন। মেয়েটা আজকাল কেমন মন খারাপ হয়ে থাকে। 


মায়ের মুখখানা লাল হয়ে আছে গরমে। তিস্তা একটু নড়েচড়ে বসলো। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বললো,

-'না তো আম্মা,কী হবে আমার! কিছুই হয় নি।'


তনয়া বেগম চৌকির উপর বসলেন। ভাত মাখিয়ে মাছের কাটা বেছে মেয়ের মুখের সামনে এক লোকমা ধরে বললেন,

-'আমি তোমার পেট থেকে হয় নি, তুমি আমার পেট থেকে হইছো। আজকাল কথা লুকাতেও শিখেছো। তা স্কুল যাও না কেনো?'


তিস্তা ভাতটা মুখে নেয়। চুপ করে থাকার মোক্ষম মাধ্যম এটা। 


তনয়া আবার মাছের কাটা বাছতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কাটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,

-'আবেগের বয়সে আবেগ দেখাতে গিয়ে বিবেকের কাছে লজ্জিত হইও না। মেয়ের জাত এমনেতেই দুর্বল ভাবে মানুষ। তার উপর যদি আবেগ ধরে বসে থেকে সব জলাঞ্জলি দেও তাহলে তুমি মূর্খ। যা হচ্ছে তা বদলানোর সাধ্যি তোমার না থাকলে তা নিশ্চুপে হতে দেও আর নিজের কাজ নিজে করে যাও।'


তিস্তা জানালার বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মা কী তবে কিছু বুঝে গেলো? 


কোনোমতে সে ভাতটা গিলে নিলো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো, 

-'আরে না আম্মা। তুমি ভুলভাল বলছো। কয়দিন পর পরীক্ষা তো, তাই আমি পড়াশোনায় মন বসাতে চাইছি। স্কুল গিয়ে আর কী হবে? সব পড়া তো দাগানো শেষ। এখন বাড়িতে পড়বো। আর মাস্টারমশাইও তো নেই।'


মাস্টারমশাই এর কথা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই কথা থেমে গেলো তিস্তার। মাস্টারমশাই নেই! কে বলেছে নেই? সবসময় স্ব শরীরে থাকাকেই থেকে যাওয়া বলে? না থেকেও যে সারাটা সময় ভীষন গভীরে লেপ্টে থাকে, তাকে থাকা বলে না? 


তনয়া বেগম আর কিছু বললেন না। মেয়েকে চুপচাপ খাইয়ে দিলেন। এঁটো থালাটা নিয়ে উঠে দরজা অব্দি গিয়ে ফিরে তাকালেন। বেশ শীতল কণ্ঠে বললেন,

-'ভালো নাম্বার না করলে মাস্টারমশাই রাগ করবে। তুমি কী চাও, তোমার মাস্টারমশাই অন্য লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসুক রাগ করে?'


তিস্তা উত্তর দেয় না। কেবল ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। মা কি বললো? অন্য বউ মানে! 


তনয়া বেগম চাপা হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের মন মেয়েকে না বুঝলে কাকে বুঝবে? 


_____


বাহিরে রাতের আঁধারে হুতুম পেঁচা ডাকছে। রাতের বিভীষিকাময় আঁধারকে আরও একধাপ ভয়ঙ্কর অবস্থায় রূপান্তরিত করছে এ ডাক। 


হারিকেনের আলোটা উঠোনের মাঝে নিভু নিভু ভাবে জ্বলছে। পিঁড়ি পেতে বসে আছে তিস্তা তার বাবার ফেরার অপেক্ষায়। লতিকা বেগম ক্লান্ত হাতে, তালপাতার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে। তনয়া দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। 


দূর হতে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। লতিকা বেগম বাতাস করতে করতে বললেন,

-'যা তিস্তা, ঘরে গিয়া ঘুমা। এত রাতে মাইয়া মাইনষের বাইরে থাকতে নাই।'


তিস্তা দাদীর কথায় একটু বিরক্ত হলো। সবার বাবার জন্য চিন্তা হচ্ছে আর দাদী কিনা আজগুবি ভাবনায় ব্যস্ত। 


তনয়া বেগম নিজের মেয়ের অভিব্যক্তি বুঝলেন। ছোট্ট কণ্ঠে বললেন,

-'থাক না আম্মা। উনি আসলে নাহয় যাইবো।'


দাদী আর কিছু বলতে যাওয়ার আগে হুড়মুড় করে তাদের বাড়িতে কেউ প্রবেশ করলো। ভড়কে গেলো তারা তিনজন। দাদী ভীত কণ্ঠে বললো, 

-'কে? কে রে?'


ব্যতিব্যস্ত এক পুরুষালী কণ্ঠে কেউ বললো,

-'চাচী, আমি। আমি আলতাফ।'


সবাই একটু ধাতস্থ হলো। তাদের প্রতিবেশী চাচার ছেলে আলতাফ। দাদী বিরক্ত কণ্ঠে বললো, 

-'আঃ মরণ। দাম'ড়া হইছোছ কী বাতাসে? এমন কইরা কেউ আহে?'


লোকটা যেনো গায়ে মাখলো না দাদীর কথা। কেবল উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, 

-'আহা চাচী, আপনারা আমার সাথে বাজারে চলেন। তাড়াতাড়ি।'


এই সময় এমন কথা শুনে সবাই বিস্মিত হয়। দাদী অবাক কণ্ঠে বলে,

-'এই রাইতে আমরা বেডি মানুষ গঞ্জের হাটে গিয়া কী করমু? নেশা করছোছ নাকি রে ছেমরা?'


ছেলেটা নিজের কণ্ঠে আকুতি ঢেলে বললো,

-'না চাচী। আপনাগো সর্বনাশ হইছে। আমান ভাই এর পরাণ যে যায় যায় অবস্থা। বড় পথ দিয়া আসার সময় তার সাইকেল নাকি গাড়ির লগে ধাক্কা খাইছে। পা'টা শেষ। জানটা না আবার চইলা যায়। তাড়াতাড়ি চলেন।'


কথাটা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতেই সবার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। ভুল শুনছে না তো? হুতুম পেঁচা'র কু ডাক বুঝি সত্যি হলো!


উঠানের এক পাশে থাকা ছোট্ট চৌকিখাটে শুয়ে আছে আমান শেখ। তনয়া বেগম স্বামী'র পায়ের মাঝে তেল মালিশ করছেন। ভাগ্যের জোড়ে টানা তিনদিন হসপিটালে থাকার পর বেঁচে ফিরেছেন আমান শেখ, তবে হাঁটাচলা'র শক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। গঞ্জের হাটে এ কয়েকদিন তিস্তা বসেছে। বাবা হলো একটি সংসারের বটবৃক্ষ, যে বৃক্ষ নিজের সর্বাঙ্গ দিয়ে রোদ্র শুষে ছায়া দেয়। কিন্তু সেই বটবৃক্ষের একটু ক্ষতিতে তার ছায়ায় থাকা ছোট্ট ছোট্ট বীজ গুলো নিস্তেজ হয়ে যায় রৌদ্রের উত্তপ্তায়। বাস্তবতার কষাঘাত থেকে বাবা যেভাবে আগলে রাখে তেমন করে আর কে-ইবা পারে! 


বাবা অসুস্থ হওয়ার পর বিভিন্ন দুর্যোগ বয়ে যাচ্ছে পরিবারটার উপর। পরিবারটার হাল ধরলো উড়ন্ত, ছুটন্ত তিস্তা। যে তিস্তার বোকামো দেখে তার মাস্টারমশাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলো, শরীরে যত্ন নিতে কবে শিখবি তুই! আজ সে তিস্তা পুরো একটি সংসারের যত্ন নিচ্ছে। এইতো, পনেরটা দিন সে দিব্যি কাটালো মাস্টারমশাই বিহীন। আর, তার মাঝের দশদিন ধরে টানছে সংসারের বোঝা। বটবৃক্ষের ছায়ায় থাকা সবচেয়ে ছোট্ট আদুরে বীজটা আজ নিজের সবটুকু উজাড় করে একটু ছায়া দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। 


আমান শেখ কতক্ষণ ঝিমিয়ে থাকা আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইলো। খুব গভীর ভাবে কী জেনো ভাবলো। তারপর খুব গোপনে এক অক্ষমতা মাখানো হতাশার শ্বাস ফেললো। 


তনয়া বেগম স্বামীর গোপনীয় শ্বাসটার ভয়াবহ আর্তনাদ শুনতে পেলেন বোধহয়। তেলটা স্বামীর বা'হাতে মাখতে মাখতে বললেন,

-'নিজেকে আপনি এত অসহায় কেনো ভাবছেন? একটু ধৈর্য রাখুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।'


আমান শেখ তাকালেন নিজের অর্ধাঙ্গিনী'র পানে। মানুষটা তাকে কত বুঝে! সেই ষোলো বছরের অবুঝ তনয়া আজ পঁয়তল্লিশের গিন্নী। তিস্তা পুরো ওর মায়ের মতনই হয়েছে। তনয়াও খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলো। সংসারের প্রথম কয়েকবছর তো ওর খেলতে খেলতে গেলো। কিন্তু বড় মেয়েটা গর্ভে আসার সাথে সাথে বদলে গেলো সব। খেলাঘর ভুলে আকড়ে ধরলো বাস্তবতার কাঠিন্য মাখা সংসার। পুতুলের জন্য বায়না করা মেয়েটা কোনো কিছুর অপূর্ণতায়ও কোনো অভিযোগ করতো না। একদম ছটফট করা মানুষটাও তার মেয়েকে দুষ্টুমির জন্য শাসন করতে ভুলে নি। মেয়ে জাত হলো পানির মতন। সময়ের গতিবেগে নিজের স্রোত বদলায়। 


আমান শেখ বেশ হতাশার স্বরে বললো,

-'তুমি বুঝো না, কোনো আমি আমাকে এত অসহায় ভাবছি! মেয়েটা আমার হঠাৎ কেমন বড় হয়ে গেলো দেখলে? আমার যে এমন বড় মেয়ে দেখতে ভালো লাগে না। চারপাশের মানুষ গুলো কেমন শত্রু হয়ে গেলো হঠাৎ করে। মেয়েটা দোকানে বসে দেখে সবার কী হম্বিতম্বি তুমি তো দেখলে। মেয়েটার না কোনো ক্ষতি হয়ে যায়।'


স্বামীর কথায় তনয়া'র খানিক বুকে মোচড় দিলো। এমন চিন্তা যে তার মাথায় আসে না তেমনটা না। যেদিন মেয়েটা প্রথম দোকানে গিয়ে বসলো, পুরো গ্রাম যেনো হুমড়ি খেয়ে পড়লো তাদের বাড়ি। কেউ বলছে মেয়ে মানুষ এত বাড়লে গ্রামে অনাসৃষ্টি হবে, কেউবা বলছে মেয়েটা নষ্টামির পথে পা দিয়েছে, কেউবা ধিক্কার জানাচ্ছে এমন বেলাল্লাপনা'র জন্য। কিন্তু এ মানুষ গুলোই এক মুঠো চাল দিয়ে তাদের ক্ষুদার দিনে পাশে দাঁড়ায় নি। 


তনয়া চুপ রইলো। একটু ধাতস্থ করলো নিজেকে। তার ভয়টা সে নিজের মাঝেই রাখবে। ভয় হলো সংক্রামিত রোগের মতন, যা অনেক কিছু অর্জনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। 


শীতল কণ্ঠে তনয়া বেগম বললেন,

-'আপনি অত চিন্তা করবেন না। ভালো কিছুই হবে।'

-'কয়দিন পর মেয়েটার পরীক্ষা। ভুলে গেছো তনু!'

-'নাহ্, কিছুই ভুলি নি। ও দোকানে যাওয়ার সময় বই সাথে করে নিয়ে যায়। রাত জেগে দেখি পড়াশোনা করে। আপনি ঠিক হয়ে গেলেই তো আবার সব আগের মতন হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না। মেয়ে জাতি সময়ের বিবর্তনে কখনো ফুলের মতন নরম, কখনো কাঁটার মতন ধারালো, আবার কখনো বা পাথরের মতন শক্ত। আমার তিস্তাও সেই জাতেরই।'

-'আমি আর কখনো ঠিক হমু তনু!'


স্বামীর আকুতি মাখানো প্রশ্নে তনয়ার ছোট্ট হৃদপিণ্ড খানা ছলাৎ করে উঠে। উত্তর যে তার জানা নেই। বড় গাড়ির সাথে সাইকেলটা ধাক্কা খেয়ে পাশের খালে গিয়ে পড়ে। ডান পায়ে হাঁটু'র দিকটা বেশ নড়ে গেছে। বা পায়ে হাঁড় খানিকটা ভেঙেছে। সদরের ডাক্তার তো বলেছেন ঠিক হওয়ার আশা খুব কম। বাকিটা তো উপরওয়ালার হাতে। 


______


বিকেল তখন ঠিক সাড়ে পাঁচটা। বিশাল ঝড়োয়া আবহাওয়া দেখে হাটের সব দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে যার মতন ছুটছে নিজের বাড়িতে। রেডিওতে বার বার জানানো হচ্ছে সতর্ক বার্তা। ঝড় নাকি বেশ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে। হতে পারে বন্যা। সাবধান হতে বলেছে সাধারণ মানুষদের। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা হলো তাদের এলাকা। ভীষণ ভয়ের আশংকা আছে। সাথে গ্রামের পাশেই বিশাল প্রলয়ঙ্কারী তিস্তা নদী। বন্যা হলে বাঁচার উপায় নেই। 


তিস্তাও বাবার শখের দোকানখানা বেশ সাবধানে তালা মেরে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো। ধুলোবালিতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। বড় রাস্তাটা থেকে নেমে মাটির রাস্তায় হাঁটা শুরু করলো তিস্তা। উদ্দেশ্য দুইটা। বাড়িও পৌঁছে যেতে পারবে খুব দ্রুত আর মধুসখীকেও দেখা হয়ে যাবে। মাস্টারমশাই গ্রামে নেই গুনে গুনে দিন পনেরো হলো। রোজ নিয়ম করে রেলস্টেশনে আর মধুসখী'র ঘাটে যায় তিস্তা। রেলস্টেশন যখন তাকে এক আকাশ বিষন্নতা, মাস্টারমশাই না আসার শূণ্যতা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় তখন মধুসখী'র ঘাট হয় তার বিষন্নতা নিবারণের আশ্রয়। প্রতিদিনের রুটিনের হেরফের হয়নি আজও৷ ভীষণ খারাপ আবহাওয়া থাকা স্বত্বেও স্টেশনে গিয়েছে। মাস্টারমশাই বিহীন ট্রেণটা দেখে হতাশার শ্বাস ফেলেছে। আবার নতুন উদ্যমে এক বুক আশা জমিয়ে ফিরছে বাড়ির পথে। 


_____


টিনের চালে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। সময়টা আনুমানিক রাত আটটা কী ন'টা হবে। তিস্তা'র বাড়িতে পাড়াপ্রতিবেশি'র ভীড়। দিকে দিকে লোক ছুটেছে তিস্তা'র খোঁজে। এমন ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করেও মানুষজন দাঁড়িয়ে আছে তিস্তাদের বাড়ির উঠোনে। মেয়েটা দোকান বন্ধ করে বাড়িই তো ফিরছিলো, কিন্তু বাড়ি অব্দি শেষ পর্যন্ত পৌঁছুতে কেন পারলো না সেই রহস্য জানার জন্যই  মানুষ ভীড় জমিয়েছে তিস্তাদের বাড়ির উঠোনে। 


হ্যাঁ তিস্তা বাড়ি অব্দি পৌঁছায় নি। কোথায় গেছে কেউ জানেনা৷ গ্রামের সব জায়গায় প্রায় খোঁজ করা হয়ে গেছে কিন্তু কোনো খবর পায় নি কেউ। 


তনয়া বেগম ঠাঁই বসে আছে ঘরের দরজায়। মেয়েটা তার গেলো কোথায়! বাজার থেকে যখন সব লোক বাড়ি ফিরছিলো সে সবাইকে জিজ্ঞেস করছিলো তিস্তা কোথায়। সবার এক জবাব তিস্তা দোকান বন্ধ করে বাড়ির দিকেই আসছে। কিন্তু আধাঘন্টা, একঘন্টা করে যখন কতগুলো ঘন্টা কেটে গেলো তখন মায়ের মন কু ডাকতে শুরু করলো। খোঁজ নিতে শুরু করলো আশেপাশে। এ বাড়ি ওবাড়ি করতে করতে পুরো গ্রাম ছড়ালো, শেখদের বাড়ির ছোট মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। 


মধ্যবয়স্ক পুরোহিত নেপাল ঠাকুর এ কথা শুনে ছুটে আসেন। ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটছেন তিস্তার খোঁজে। সন্তান হারানোর কষ্ট যে সে বুঝে। 


তিস্তার দাদীর মাথায় পানি ঢালছে গ্রামের এক মহিলা। মানুষটা অতিরিক্ত চিন্তায় জ্ঞান হারিয়েছে। যতই সে কঠিন কথা বলুক, নাতনি যে তার চোখের মণি ছিলো। 


পাড়া প্রতিবেশী নানান কথা বলছে। কেউ বলছে, মেয়েটাকে দোকানে বসিয়ে মানুষের লোভ আনিয়েছো, কেউবা করছে হা হুতাশ। কেউবা বলছে সব শত্রুদের চাল। সুখ সহ্য হয় নি।


পাশের বাড়ির আলতাফের মা স্বান্তনার স্বরে বললেন,

-'চিন্তা কইরো না তোমরা। হয়তো বৃষ্টি দেইখা কোথাও আটকাইয়া গেছে। ফিইরা আসবো নে।'


তার সাথে তাল মিলালো আরও দুই এক মহিলা। হঠাৎ আলতাফ ছুটে আসলো ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে আরেক চাঞ্চল্যকর খবর জানালো। "গ্রামের কিনারায় সবচেয়ে ছোট বাড়ির মাইয়েটারেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ সন্ধ্যার দিকে তাদের পালা মুরগী গুলো খুঁজতে বের হয়েছিলো কিন্তু আর ফেরে নি।"


যেমন হুড়মুড় করে তিস্তাদের বাড়িতে ভীড় জমেছিলো, তেমন হুড়মুড় করে ভীড় কমেও গেলো। আবার নতুন কিছু শোনার লোভে গ্রামবাসীরা ভীড় জমাবে সে বাড়িতে। মানুষের কাজ তো এটাই। সাহায্য কম করবে কিন্তু মজা লুটবে পুরো ষোলো আনা। 


সারারাত তুমুল বৃষ্টি হলো। তনয়া বেগম ঠাঁই দরজায় বসে রইলেন। মাঝে গিয়ে শাশুড়ির মাথায় পানি দিলেন। অবাক করা ব্যাপার হলেও সে কাঁদছে না। বরং নিজেকে শক্ত করছে। প্রকৃতির সাথে সাথে যে তাদের জীবনেও বড় ঝড় আসতে চলেছে তা টের পেয়েছে সে। 


______


গত রাতের তুমুল বর্ষণের পরও আকাশ এখনো মেঘলা। সকাল হয়েছে যে বুঝাই যাচ্ছে না। কেমন যেনো প্রকৃতিতে সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব। 


পুরো গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছে ঘোষদের পরিত্যক্ত জমিখানায়। কাল অব্দি জমিটা শুকনো খড়া ছিলো। আজ সে জমিতে হাঁটু সমান কাঁদায় ভরপুর। আর সেই জমিতে কাঁদায় মাখামাখি এক কিশোরীর মৃত শরীর। এইটা সেই পনেরো বছরের কিশোরী, যে মুরগী খুঁজতে গিয়ে ভোজ হয়েছে কোনো নরপশুর। মানুষ নামক পশুদের দারুণ খাবার হয়েছে। শরীরটার সাথে সাথে মেয়েটার জানটাও খেয়েছে। অবশ্য বেঁচে থাকলেও সমাজের মানুষ তাকে বাঁচতে দিতো না। 


গ্রামের মানুষদের মাঝে ভীতি তৈরী হলো। মেয়েরা তাহলে আর নিরাপদ না! 


তিস্তার খোঁজ মিলে নি তখনো। অবশ্য সবাই তিস্তার পরিণতি সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। হয়তো কোনো এক পরিত্যক্ত জায়গায় এমন ভাবেই পরে থাকবে তিস্তা। 


গ্রামে তখন ভীষণ আলোড়িত খবর তিস্তা। তার সাথে সাথে একটা গাঁ কাটা দেওয়া খবরও আছে। পুরো একদিনের তুমুল বর্ষণে মধুসখী এখন পানিতে টইটম্বুর। কী সুন্দর জল তার। রূপ জেনো তার ধরে না। মধুসখী'র বিষ্ময় মাখা জীবন্ত রূপ দেখে জেলেদের মুখে তৃপ্তির হাসি। ঘরে আসবে সুখ। দু'হাত তুলে কেউ শুকরিয়া জানাচ্ছে সৃষ্টিকর্তার দরবারে। 


তিস্তাদের বাড়িতে তখন শোকের ছায়া। বাড়ির অদুরে ছোট কন্যা বাড়িতে নেই। পুরো একরাত কেটে আরেকটা দিন কেটেছে। ধরণীর বুকে নেমেছে আঁধার। মেয়েটা কোথায়! বেঁচে আছে তো? মধ্যাহ্নের মাস্টারমশাই ফিরে এসে পাবে তার তিস্তাকে! নাকি এক আকাশ বিদ্যুৎময় খবর পাবে? আচ্ছা,মধ্যাহ্নের মাস্টারমশাই আদৌও ফিরবে তো?


{সমাপ্ত}💔


[ভালোবাসা পাঠকমহল। মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই উপন্যাস টার প্রথম খন্ডের সমাপ্তি টানলাম এখানেই। প্রায় শ খানেক প্রশ্ন আর ডজন খানিক অনিশ্চয়তা দিয়ে শেষ হলো,প্রথম খন্ড। সব প্রশ্নের উত্তর আর একবারে সমাপ্তি নিয়ে আসবে দ্বিতীয় খন্ড বা অন্তিম খন্ড। প্রায় সপ্তাহ খানেক পর আমি অন্তিম খন্ড আনবো। সেখানেই সব রহস্য জটিলতা খুলবে। প্রথম খন্ডের তুলনায় অন্তিম খন্ড বড় হবে। মাস্টারমশাই আর তিস্তার সকল সমাপ্তি হবে সেখানে। আর হ্যাঁ, অবশ্যই এটাকে কেউ স্যাড এন্ডিং বলে আমায় বকা দিবেন না। কারণ এখানে সব ধোঁয়াশা। ততদিন অব্দি আমার পাঠকমহলের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ ধৈর্য ধরার। এই সপ্তাহে আমি কোনোভাবেই নতুন পর্ব আনতে পারবো না। আশাকরি বকা না দিয়ে ভালোবাসা দিবেন। ভালো থাকুন সবাই। আর দোয়া রাখবেন আমার জন্য। ]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম