নবায়নযোগ্য শক্তির ইতিবাচক প্রভাব



নবায়নযোগ্য শক্তি কি

সহজভাষায় বলতে গেলে  যে শক্তি বারবার ব্যবহার করার পরও নিঃশেষ হয়ে যায় না অর্থাৎ একবার ব্যবহার করার পর পুনরায় ব্যবহার করা যায় তাকে নবায়নযোগ্য শক্তি বলে। এই শক্তিকে দীর্ঘস্থায়ী শক্তি‌ও বলা হয়।

নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস 

নবায়নযোগ্য শক্তির প্রধান উৎসগুলির মধ্যে রয়েছে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, জোয়ার-ভাটা শক্তি, ভূ-তাপীয় শক্তি, জৈব শক্তি, সমুদ্র শক্তি এবং সমুদ্র তরঙ্গ শক্তি-তাপ শক্তি ইত্যাদি। এছাড়া উদ্ভিদ ও প্রাণীর বর্জ্য পদার্থ থেকে বায়োমাস তৈরি হয় যা নবায়নযোগ্য শক্তি জনপ্রিয় উৎস।

জলবায়ু সংকট নিরসন ও পরিবেশে গ্রীন হাউস গ্যাসের প্রভাব হ্রাস করতে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে হবে এবং নবায়নযোগ্য শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।

পরিবেশবান্ধব শক্তি, সবুজ শক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তির সংজ্ঞায়ন

অল্প কথায় বলতে গেলে পরিবেশ দূষণ ছাড়া যে শক্তি উৎপন্ন হয় তা-ই পরিবেশবান্ধব শক্তি বা ক্লিন এনার্জি। পরিবেশের উপর কোনো ধরণের নেতিবাচক প্রভাব ছাড়াই প্রাকৃতিক উৎস থেকে যে শক্তি উৎপন্ন এবং সেটাই হলো সবুজ শক্তি বা গ্রিন এনার্জি।সবুজ শক্তি একটি উদাহরণ হলো সূর্য। নবায়নযোগ্য শক্তি বলতে সেইসকল‌ শক্তিকে বুঝায় যা কখনো নিঃশেষ হয় না ও পুনরায় উৎপন্ন হয়।

যদিও শক্তির এই সংজ্ঞাগুলি প্রায় সম অর্থ প্রকাশ করে এবং বেশিরভাগ নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলিকে পরিবেশবান্ধব এবং সবুজ শক্তি  হিসাবে বিবেচনা করা হয় তবে তা সবক্ষেত্রে সত্য নয়।

নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য শক্তির পার্থক্য

অনবায়নযোগ্য শক্তি প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে আসে যা তৈরি হতে বিলিয়ন বছর সময় লাগে যেমন কয়লা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদি। তাই এগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানী বলা হয়। তবে প্রকৃতিতে এই সম্পদের পরিমাণ সীমিত এবং মানব জাতির অতিরিক্ত ব্যবহার ও অপচয়ের ফলে একসময় তা নিঃশেষ হয়ে যাবে।

বিখ্যাত গবেষক ম্যাগডা বলেন, "জীবাশ্ম জ্বালানির ফলে প্রযুক্তিগত সাফল্য অর্জন হলেও এর ব্যবহারে বায়ুমণ্ডলে কার্বন মনোঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা বায়ুমণ্ডলকে আবৃত করে রাখে এবং এতে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা উর্ধ্বগামী হয় যার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়।

ম্যাগডা আরো বলেন যে, "আমরা যদি এই গ্রহে 2050 সালের চেয়ে অধিক সময় সময় ধরে বসবাস করতে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি 1.5 ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে চাই তবে আমাদের এখনই কিছু আমূল পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের এমন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করতে হবে যা আমাদের জীবনযাত্রার মানকে অপরিবর্তনীয় ও আরামদায়ক করবে এবং সেই সাথে পরিবেশে কার্বনের পরিমাণকে হ্রাস করবে"

বেশিরভাগ নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলির একটি প্রধান সুবিধা হল যে   যখন এগুলো দিয়ে বিদ্যুৎ বা তাপ উৎপাদন করা হয় তখন তা থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয় না বা বায়ুকে দূষিত করে না।

তবে কিছু কিছু উৎস থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন করতে গেলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হলেও সেটা সামগ্রিক দিক বিবেচনায় জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

যেসকল দেশের নিজস্ব জীবাশ্ম জ্বালানির উৎস নেই, জ্বালানির জন্য অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল হতে হয় সেইসকল দেশে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেই তাদের চাহিদা পূরণ করে থাকে। এছাড়াও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ফলে সেই দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে।

বায়ুকল

বায়ুকল/টারবাইনের পাখার মধ্য দিয়ে যখন বায়ুপ্রবাহ হয় তখন বায়ুর গতিশক্তির কারণে তা ঘুরতে শুরু করে।বায়ুকলের পাখা রোটর ও মোটরের মাধ্যমে গিয়ার বক্সের সাথে সংযুক্ত থাকে। গিয়ার বক্স যুক্ত থাকে জেনারেটরের সাথে।পাখা যখন ঘুর্ণনরত অবস্থায় থাকে তখন পাখার সাথে সংযুক্ত মোটর‌ও অল্পগতিতে ঘুরতে থাকে। গিয়ার বক্স মোটরের সেই গতিশক্তিকে আরো বৃদ্ধি করে। তখন জেনারেটর গিয়ার বক্সের গতিশক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে।এভাবেই বায়ুকল থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। বায়ুকল ভূমিতে ও সমুদ্র উপকূলে উভয় স্থানেই তৈরি করা যেতে পারে। যে স্থানের বায়ুপ্রবাহ শক্তিশালী সেই স্থান বায়ুকল নির্মাণের জন্য আদর্শ।

 বায়ু শক্তি একটি পরিবেশবান্ধব, সবুজ, নবায়নযোগ্য ও অফুরন্ত সম্পদ। কৃষিজমিতে স্বল্প স্থানের মধ্যে অনেক টারবাইন/বায়ুকল স্থাপন যায় বলে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি জমি অপচয়‌ও রোধ করা যায়। বায়ুশক্তির বেশিরভাগ উৎস প্রাকৃতিক হ‌ওয়ায় শক্তি উৎপাদন ব্যয় কম এবং পরিবেশ দূষিত হয় না।

নবায়নযোগ্য শক্তির অন্যান্য উৎসের মধ্যে কার্বন উৎপাদনের দিক দিয়ে বায়ুশক্তির অবস্থান সর্বনিম্নে।

সৌরশক্তি 

সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মূল সরঞ্জাম হলো সৌর প্যানেল।সৌর প্যানেলের মূল উপাদান হলো সৌর কোষ।

সৌর কোষের কাজ হলো সূর্যের আলোক শক্তিকে আলোক-বিভব ক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা।সৌর কোষগুলো সাধারণত দুই টুকরো বিপরীত আধান বিশিষ্ট সিলিকন ধাতু দিয়ে তৈরি। অনেকগুলো সৌরকোষ সুসজ্জিতভাবে গঠিত হয়ে সৌর মডিউল তৈরি হয় এবং কয়েকটা সৌর মডিউল একত্রিত হয়ে সৌর প্যানেল গঠিত হয়। যখন সূর্যের আলো সৌর প্যানেল তথা সৌর কোষের উপর বিকিরিত হয় তখন আলোর ফোটনগুলি সিলিকন পরমাণুর ইলেকট্রনকে আঘাত করে, যা ফটোইলেক্ট্রিট ইফেক্ট হিসেবে পরিচিত আর এই ইলেক্ট্রন প্রবাহের ফলে প্রতিটি সৌরকোষে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।যা পাওয়ার গ্রিডে স্থানান্তর করা হয় এবং পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।যদিও নিরক্ষরেখার কাছাকাছি স্থানগুলোতে অবস্থিত সোলার প্লান্টগুলোতে সৌরশক্তি বেশি গৃহীত হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায় এমন কোনো স্থানে সৌর প্যানেলগুলো স্থাপন করলেও তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে।

সৌরশক্তি ব্যবহারের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ও গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব কমানো সম্ভব। সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সোলার প্লান্ট স্থাপনের যে ব্যয় তা অন্যান্য বৈদ্যুতিক কাঠামোর তুলনায় অনেক কম। এই প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নেই বললেই চলে।সৌর শক্তির প্রধান উৎস‌ই যেহেতু সূর্য রশ্মি তাই তা পৃথিবীর সব স্থানে উপলব্ধ এবং কোনো প্রকার বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্ক ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এছাড়াও সৌরশক্তি ব্যবহারে পরিবেশে কোনো প্রকার শব্দ দূষণ হয় না এবং মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহেও সৌরশক্তি ব্যবহৃত হয়।

জলবিদ্যুৎ 

পানির প্রাকৃতিক উৎস যেমন নদী, হ্রদ, জলপ্রপাত ইত্যাদির মধ্যে বাঁধ স্থাপন করে পানির প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে যে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন করা হয় তাকে জল বিদ্যুৎ শক্তি বলে।

জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে নদীর পানিতে বাঁধ দিয়ে পানির স্রোতকে আটকিয়ে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়।পানির এই উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে পানির মধ্যে অধিক পরিমাণে বিভব শক্তি সঞ্চিত হয়। যখন আবদ্ধ পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ সীমায় পৌছে যায় তখন বাঁধের মধ্যকার একটি নল খুলে দেয়া হয় পানি প্রবাহের জন্য। এর ফলে পানির মধ্যকার বিভবশক্তি গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। পানির এই গতিশক্তি নলের বহির্মুখে স্থাপিত টারবাইনকে ঘুরাতে সাহায্য করে।ঘুর্ণনরত টারবাইন সরাসরি তড়িৎ জেনারেটরের সাথে সংযুক্ত থাকার ফলে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় এবং তারের মাধ্যমে সেই বিদ্যুৎ বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।

জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে যেহেতু জ্বালানির প্রয়োজন হয় না তাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয় না এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়‌ও কম সেইসাথে এই ধরণের বিদ্যুৎ কেন্দ্র জ্বালানি দ্রব্যের উপর অনির্ভরশীল হ‌ওয়ায় গ্রাহকদের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সক্ষম।প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে জলবিদ্যুৎ কার্যভূমিকা পালন করে পাশাপাশি যেসব অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে কৃষিজমিতে সেঁচের প্রয়োজন হয় সেখানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্মিত বাঁধের ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম হ্রদ থেকে পানি সরবরাহ করা যায়। কৃত্রিম হ্রদের এই জমাকৃত পানিতে দূষিত পদার্থ কম থাকায় নদীর স্বাভাবিক পানি থেকে তুলনামূলক উত্তম ফলে জমিতে সেঁচের জন্য তা উপযুক্ত। এছাড়া জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে শ্রমশক্তির প্রয়োজন‌ও কম হয়।

বায়োমাস এনার্জি 

উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবদেহ থেকে প্রাপ্ত হাইড্রোকার্বন জাতীয় জৈব

পদার্থের সঞ্চিত রাসায়নিক শক্তিকে দহন প্রক্রিয়ায় যে শক্তিতে রূপান্তর করা হয় তা-ই বায়োমাস এনার্জি।

 উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহ থেকে প্রাপ্ত জৈব পদার্থকে বার্নারের সাহায্য দহন করা হলে জৈব পদার্থে সঞ্চিত রাসায়নিক গঠনটি রূপান্তরিত হয়ে তাপ শক্তি উৎপন্ন করে এবং এই তাপ শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়।বায়োমাসের বেশকিছু পরিচিত উদাহরণ রয়েছে যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় ও নিত্য ব্যবহার্য। বায়োমাসের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে ইথানল যা ভুট্টা অথবা আখ থেকে উৎপাদন করা যায়। পশুর চর্বি থেকে তৈরি হয় বায়োডিজেল, উদ্ভিজ শস্য থেকে সবুজ ডিজেল তৈরি করা যায় এছাড়াও প্রাণীজ বর্জ্য থেকে বায়ুর অনুপস্থিতিতে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা যায়।

বায়োমাস এনার্জির মূল উপাদান জীবদেহ থেকে তৈরি হ‌ওয়ায় তা পৃথিবীতে সহজলভ্য এবং অল্প খরচে উৎপাদন করা যায়। বায়োমাস এনার্জি ব্যবহারে বায়ুমণ্ডলে যে কার্বন নির্গমন হয় তা জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের ফলে উৎপাদিত কার্বনের থেকে অনেক কম। বায়োমাস পরিবেশ বান্ধব হ‌ওয়ার কারণে এর ব্যবহারে পরিবেশ দূষণ হ্রাস করা যায়। বায়োমাস এনার্জি থেকে প্রক্রিয়াজাত ইথানল, বায়ো-ডিজেল, বায়োফুয়েল ইত্যাদি পাওয়া যায় যেগুলো যানবাহনে ব্যবহার করলে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব।

Source:  https://www.nhm.ac.uk/discover/renewable-energy.html

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম