নৈশ ভোজন করে রুমে এসে বিছানায় শরীটাকে এলিয়ে দিলাম।পাশের ফ্ল্যাটের আংকেল-আন্টি ঝগড়ার আওয়াজ আমার রুম পর্যন্ত চলে আসছে। এদের চেঁচামেচিতে পড়ার ইচ্ছে উধাও। বিছানার পাশের টেবিলের উপর থেকে রুবিকস কিউবটা হাতে নিয়ে সলভ করা চেষ্টা করছি এমন সময় রুমে আমার বোন তিথীর প্রবেশ।
রুমে এসেই বলে, "দাদা, **ডায়াবেটিস রোগীদের রাতে কী ভাতের পরিবর্তে রুটি খাওয়া উচিত?"**
আমি বললাম, "হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?"
– "আর বইলো না পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি আংকেলরে রাতে ভাতের পরিবর্তে রুটি খেতে দেয়। এখন আংকেল রুটি খেতে চায় না, এই নিয়ে ওনাদের ঝগড়া।"
– "ক্লাস টেনে পড়িস এখনো এটা জানিস না। তোদের জীববিজ্ঞান বইয়ে এই ডায়াবেটিস নিয়ে টপিক আছে না?"
– "আরে ওখানে বিস্তারিত নেই। তুমি বলো না **কেন ডায়াবেটিস হলে রুটি খাওয়া উচিত?"**
– "বলবো, তার আগে বল দেখি **ডায়াবেটিস কী**? দেখি কেমন পড়াশোনা করেছিস।"
তিথী টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারটা টেনে আমার সামনাসামনি মুখ করে বসলো। আমি রুবিকস কিউব সলভ করতে করতে ওর উত্তর শুনতে লাগলাম।
তিথী একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলতে শুরু করলো, **"অগ্ন্যাশয়ের মাঝে অবস্থিত আইলেটস অফ ল্যাংগারহ্যানস গ্রন্থিতে বিটা কোষ নষ্ট হওয়ার কারণে মানব দেহের শর্করা নিয়ন্ত্রণকারী 'ইনসুলিন' নামক হরমোন প্রয়োজনমতো উৎপাদিত হয় না। ফলে রক্তে শর্করা তথা গ্লুকোজের পরিমাণ স্থায়ীভাবে বেড়ে যায়। এই অবস্থাকে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস বলে।"**
আমি তখনো রুবিকস কিউব সলভ করতে ব্যস্ত। কিউব সলভ করতে করতেই বললাম,
-- এটাকে **মধুমেহও** বলে। আচ্ছা এবার বলতো **ডায়াবেটিস কয় ধরণের হয়**? একটু বিস্তারিত বলিস।
তিথী আমার দিকে এক মুহুর্ত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, "এতো বিস্তারিত বলতে পারবো না। যেটুকু জানি সেটা হলো, **ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরণের হয়, টাইপ-1 এবং টাইপ-2।
টাইপ-1 ডায়বেটিসের রোগীর অগ্ন্যাশয়ে ইনসুলিন তৈরি হয় না তাই নিয়মিত ইনজেকশনের মাধ্যমে কৃত্রিম ইনসুলিন নিতে হয়।
টাইপ-2 রোগীর দেহে ইনসুলিন তৈরি হয় কিন্তু সেটা দেহের জন্য কার্যকর হয় না। এক্ষেত্রে ঔষধ খেয়ে শরীরের জন্য ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে হয়।"**
এতক্ষণে আমার রুবিকস কিউব সলভ করা শেষ। টেবিলের উপর রুবিকস কিউবটা রেখে তিথীর উদ্দেশ্যে বললাম,
"শোন **টাইপ-1 হচ্ছে তোর মতো বাচ্চা/অপ্রাপ্তবয়স্কদের ডায়াবেটিস। যেটার পোশাকি নাম হচ্ছে জুভিনাইল ডায়াবেটিস *(Juvenile Diabetes),* এইধরণের ডায়াবেটিসে অটোইমিউন বিক্রিয়ার কারণে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ ধ্বংস হয়ে যায় ফলে দেহে চিরস্থায়ী ভাবে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।তাই টাইপ-1 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী যতদিন বাঁচবে সকাল-সন্ধ্যা ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন নিতে হবে। এই ডায়াবেটিসের হওয়ার পিছনে বয়স, বংশগত ও পরিবেশগত কারণকে দায়ী করা হয়।**
– আর **টাইপ-2** ?
– বলছি, **টাইপ-2 ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয়ে ইনসুলিন উৎপন্ন হলেও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স থাকার কারণে সেটা সঠিকভাবে শর্করা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হয় না, এটারে এডাল্ট অনসেট ডায়াবেটিসও বলে। মানে এই ডায়াবেটিস সাধারণত আংকেলের মতো বয়স্ক ব্যক্তিদের হয়ে থাকে।এবং আমরা সাধারণত ডায়াবেটিস বলতে যা বুঝি সেটাই টাইপ-2 ডায়াবেটিস।তোর মতো যারা স্থূলকায়, সারাদিন শুয়ে বসে দিন কাটায়, কায়িক পরিশ্রম কিছু করে না আর ফাস্টফুড বেশি খায় তাদেরই ডায়াবেটিস হয়।**"
এতটুকু বলতে না বলতেই তিথী রেগে গিয়ে রুবিকস কিউবটা নিয়ে আমার উপর ঢিল ছুড়ে মারলো। যদিও বাড়তি কিছু না বলে মূল টপিক নিয়েই বললো, "আচ্ছা তাহলে **এই দুই ধরণের ডায়াবেটিসে তো চিকিৎসা হিসেবে '*Rule-D*' অনুসরণ করা যেতে পারে। মানে *Discipline*(শৃঙ্খলা), *Diet*(খাদ্য নিয়ন্ত্রণ), *Drug*(ঔষধ গ্রহণ)।**
আমি বললাম, "হ্যাঁ, **তবে আমি *Gestational Diabetes *অথবা গর্ভকালীন মেধুমেহ নামে ডায়বেটিসের আরো একটি বিশেষ ধরণ সম্পর্কে পড়েছি। নাম শুনেই বুঝতে পারছিস এটা গর্ভবতী নারীদের হয়ে থাকে। ইতিপূর্বে যে নারীদের ডায়াবেটিস থাকে না কিন্তু গর্ভধারণ করার পর ইনসুলিন প্রতিরোধী হরমোনের প্রভাবে দেহে ইনসুলিন উৎপাদন ব্যাহত হলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, রোগীর এই অবস্থাকে গর্ভকালীন মেধুমেহ নামে অভিহিত করা হয়। যদিও সন্তান জন্মদানের পর এই ডায়াবেটিসের প্রভাব থাকে না। দেহে আবার স্বাভাবিকভাবে ইনসুলিন উৎপন্ন হয়। আরেকটা আছে প্রি-ডায়াবেটিস। ওটাকে যদিও নির্দিষ্ট করে ডায়বেটিসের মধ্যে ধরা হয় না। টাইপ-2 এর পূর্বাবস্থা হচ্ছে এই প্রি-ডায়বেটিস (*Pre-diabetes)*।"**
এতটুকু বলে একটু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।তিথীও বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনেছে বুঝতে পারলাম, আমি আবার বলতে শুরু করেছি, "**পৃথিবীতে ডায়বেটিসে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে টাইপ-2 ডায়াবেটিসের আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা শতকরা 90, বাকি 10% হলো টাইপ-1 ও জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য ডায়বেটিসে আক্রান্ত রোগী।"**
তিথী এবার একটু নড়েচড়ে বসে বললো, "আচ্ছা এবার আমাকে বলো, **ডায়াবেটিস হলে ভাত নাকি রুটি কোনটা খাওয়া ভালো?** সেই তখন থেকে শুধু এগুলো বলে যাচ্ছো।"
বেশ তাচ্ছিল্যের সুরেই বললো কথাটা। একটু আগেই এতো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো এখন আবার এভাবে বলছে।
আমিও আর কথা না বাড়িয়ে গ্লাসে রাখা পানি খেয়ে গলাটা হালকা ভিজিয়ে বলতে লাগলাম, "**ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে ভাত নিয়ে বলা যাক। ডায়াবেটিস রোগীদের শর্করা/কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার কম খাওয়া উচিত। সব ধরনের ডায়াবেটিস রোগী যেসকল খাবার খায় তার মধ্যে শর্করার মাত্রা কতটুকু তা জেনে খাওয়া উচিত এবং সেই সকল খাবার খেলে তাদের জিআই স্কোর কত হয় তা পর্যবেক্ষণ করা উচিত**।"
আরো বলতে যাবো এর মাঝেই তিথী থামিয়ে দিয়ে বললো,
"দাদা, **জিআই স্কোর কি**?"
-- **কোনো শর্করাযুক্ত খাবার খেলে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তার পরিমাপ হলো জিআই স্কোর বা গ্লাইসেমিক ইনডেক্স *(Glycaemic Index) *স্কোর । যেসব খাদ্যের জিআই স্কোর বেশি সেগুলো খেলে খুব দ্রুত রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়।
**
– আচ্ছা গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের বানানটা বলো আমি খাতায় নোট করে নিচ্ছি।
অগত্যা বলতেই হলো, "লেখ, জি এল ওয়াই সি এ ই এম আই সি, গ্লাইসেমিক। ইনডেক্স বানান তো পারবি?"
"হ্যাঁ পারবো। এবার তুমি কনটিনিউ করতে পারো।", তিথী বললো।
–** "ভাত উচ্চ শর্করা সমৃদ্ধ খাদ্য এবং এর জিআই মানও অনেক বেশি তাই যাদের ডায়াবেটিস আছে রাতের খাবারে তাদের ভাত খাওয়া পরিহার করা উচিত। তবে তার মানে এই নয় যে একেবারে ভাত খাওয়া বন্ধ করতে হবে, বেশি বেশি ভাত খাওয়া উচিত না।"**
**"ডায়াবেটিস রোগীদের ভাত খাওয়া নিয়ে গবেষণা কি বলে?**" তিথী জিজ্ঞেস করলো।
"**ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যাদের খাদ্য তালিকায় বেশি পরিমাণে ভাত রয়েছে তাদের টাইপ-2 ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া যাদের প্রি-ডায়াবেটিস আছে তাদের ভাত খাওয়ার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের রাতের বেলা খাবারে কোন খাদ্য কতটুকু গ্রহণ করতে হবে সেই নিয়ে আমেরিকার কৃষি সংস্থার তৈরি করা "দ্যা ক্রিয়েট ইওর প্লেট" পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে পারে। এই পদ্ধতি অনুসারে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির রাতের খাবারের মধ্যে অর্ধেক খাদ্য হবে শর্করা বিহীন শাকসবজি, বাকি অর্ধেকের মধ্যে ২৫ শতাংশ আমিষ ও বাকি ২৫ শতাংশ শস্য অথবা শর্করাজাতীয় খাদ্য খাওয়া উচিত।এর পাশাপাশি ফলমূল ও দুগ্ধজাত খাবারও খেতে পারবে।ছোট দানার সাদা চালে জিআই এর মান ৭০ বা তার থেকেও বেশি থাকে। এছাড়া বাসমতি, ব্রাউন এবং ওয়াইল্ড রাইসের জিআই এর মান ৫৬ থেকে ৬৯। **" এতটুকু বলেই এবার একটু হাঁপিয়ে উঠেছি। গ্লাস থেকে আবার পানি খাচ্ছি পাশ থেকে তিথী বললো, "আচ্ছা **এবার রুটি নিয়ে বলো**?"
"বলবো তার আগে তুই বল, **এতক্ষণ যেগুলো বলেছি সেগুলো থেকে কি বুঝেছিস?"
**
তিথী বেশ সহজভাবেই বললো, "**ভাত উচ্চ শর্করাসমৃদ্ধ খাদ্য হওয়ায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের তা খুব কম পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে অন্যথায় রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যাবে। **এবার তাড়াতাড়ি রুটি নিয়ে বলো।"**
**
"আচ্ছা বেশ বলতো, **রুটি তৈরির মূল উপাদান কি**?"
তিথী ভেংচি কেটে বললো, "কি আবার, **ময়দা/ফ্লাওয়ার।**"
-- "**হ্যা ময়দা/ফ্লাওয়ার। বেশ কয়েক ধরনের ফ্লাওয়ার আছে যেগুলোতে কার্বোহাইড্রেট/শর্করার পরিমাণ অনেক কম। প্রথমে এলমন্ড ফ্লাওয়ার *(Almond flour) *এর নাম বলা যায়। এটি গ্লুটেন মুক্ত এবং শর্করার মাত্রা কম। এটাতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ফাইবার এবং হার্টের জন্য উপযোগী ফ্যাট আছে। এরপর কোকোনাট ফ্লাওয়ার *(Coconut flour)* আছে যা নারকেলের শাঁস শুকিয়ে তৈরি করা হয়। এতে সাধারণ ময়দার থেকে কার্বোহাইড্রেট অনেক কম এবং ফাইবার অনেক বেশি থাকে। **এরপর আছে"
"আচ্ছা একটা প্রশ্ন আছে আমার।" তিথী কথার মাঝে থামিয়ে বললো।
আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, কি প্রশ্ন?"
"**আমরা যে আটা/ময়দা দিয়ে রুটি বানাই সেগুলোতে কি সমস্যা?? যেমন- ভুট্টার আটা, সাদা চালের আটা।** তুমি যেগুলোর নাম বলছো এগুলো তো এই প্রথম শুনলাম।"
"বলছি শোন, **আমরা সাধারণত যে আটা/ময়দার রুটি খাই মানে বাজারে যেগুলো সহজলভ্য সেগুলোতে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে এবং ফাইবার, প্রোটিন ও হার্টের উপযোগী ফ্যাট কম থাকে। এগুলো খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাবে যদিও সেটা ভাতের তুলনায় কম।"**
তিথী বেশ বড়সড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,"হুমমম, বুঝলাম।এই **এলমন্ড ও কোকোনাট ফ্লাওয়ার ছাড়া ডায়াবেটিসের জন্য আর কী কী ময়দা/ফ্লাওয়ার আছে?**"
"**চিকপিয়া ফ্লাওয়ার *(Chickpea flour) *আছে যা শুকনো মটরশুটি থেকে তৈরি হয়। এটি অনেক প্রোটিন সমৃদ্ধ। দেহে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হলে তা নিরাময়ে সহায়তা করে। এছাড়াও ওট*(Oat)*এবং স্পেল্ট*(Spelt) *নামে দুই ধরনের ফ্লাওয়ার আছে। দুটোতেই ফাইবার এবং প্রোটিন অনেক বেশি পরিমাণে আছে। ওট ফ্লাওয়ার এর 'বিটা গ্লুকান' নামের বিশেষ ধরণের ফাইবার আছে যা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর রক্তে শর্করার পরিমাণকে হ্রাস করতে সক্ষম। তাই ডায়বেটিস আক্রান্ত রোগীর ভাতের থেকে এই পাঁচ ধরণের ময়দা/ফ্লাওয়ার দিয়ে তৈরি করা রুটি খাওয়া উত্তম। **বুঝতে পারলি??"
"হ্যা বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি যে এতো কিছু বলেছো তার **সোর্স কী**??"
"এই নে বিসিবি টিমের আফনান ভাইয়ার দেয়া জার্নাল লিংকগুলো যেগুলো পড়ে এই বিষয়ে জানতে পেরেছি।" এটা বলেই ফোনটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নৈশ নিদ্রার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।
https://www.healthline.com/health/diabetes/diabetes-rice
https://www.healthline.com/nutrition/flour-for-diabetics
https://www.hsph.harvard.edu/news/hsph-in-the-news/eating-white-rice-regularly-may-raise-type-2-diabetes-risk/
ছবি প্রস্তুতকারী: M. Samiul Hasnat