ভিন গ্রহবাসীর যান


একটিবার রাতের আকাশের দিকে তাকান, আপনি সহসাই বুঝতে পারবেন এই বিশাল মহাবিশ্বে আপনার অবস্থান কতটুকু।

শুরুতে আপনার নিকট মনে হতে পারে, এই মহাবিশ্বে আপনার কোন অস্তিত্বই নেই। মনে হতে পারে মহাবিশ্বে বিদ্যমান বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহের মধ্যে পৃথিবী আর দশটা সাধারণ গ্রহের মতই একটি গ্রহ, এটির তেমন কোন বিশেষত্বই নেই।

কিন্তু একটু গভীরভাবে ভাবলে পৃথিবী আপনার নিকট বেশ ব্যতিক্রমী গ্রহ হিসেবেই আবির্ভূত হবে। এর প্রধাণ কারণ হল, পৃথিবীতে বিদ্যমান বিভিন্ন  জীবপ্রজাতির অস্তিত্ব, কালের পরিক্রমায় বুদ্ধিমান প্রজাতি হিসেবে মানুষের আবির্ভাব যারা কীনা প্রাকৃতিক সূত্রাবলি অনুধাবন করতে পারে, নিজেদের অস্তিত্বের কারণ অনুসন্ধান করতে পারে, প্রশ্ন করে থাকে সব কিছু কীভাবে সৃষ্টি হল, কেন সৃষ্টি হল, বৃহৎ স্কেলে এই মহাবিশ্বের কোন উদ্দেশ্য আছে কী না।

উপরের প্রশ্নগুলো আমাদের দ্বারা বার বার জিজ্ঞাসিত সবচেয়ে রহস্যময় প্রশ্নগুলোর মধ্যে কয়েকটি। এখনও কেউ জানে না এসব প্রশ্নের আদৌ কোন উত্তর আছে কী না, থাকলেও আমরা কোন দিন সেই উত্তরগুলি জানতে পারব কী না।

হতে পারে এই বিশাল মহাবিশ্বে মানুষই একমাত্র বুদ্ধিমান প্রজাতি যারা মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে, প্রাকৃতিক সূত্রাবলি কীভাবে মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেসবের দ্বার উন্মোচনে নিরলস গবেষণা করে চলেছে।

আবারও এমনও হতে পারে, ইতোমধ্যেই কোন একটা প্রজাতি আমাদের চেয়ে বিজ্ঞান ও টেকনোলজিতে লক্ষ লক্ষ গুন এগিয়ে গিয়েছে, যারা মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণকারী সূত্রাবলির ব্যাখ্যাসমূহ অলরেডি জেনে ফেলেছে, যারা বিজ্ঞান ও টেকনোলজি দিয়ে তাদের বসবাসরত গ্যালাক্সিসহ আশেপাশের অনেক অংশ ইতোমধ্যে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। এই ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের ফিকশন লেখক অর্থার সি. ক্লার্কের একটা কথা মনে পড়ছে,

"Two possibilities exist: either we are alone in the Universe or we are not. Both are equally terrifying."

আরেকটা সম্ভাব্যতাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। হয়ত অনেক গ্রহেই প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে, তবে তারা বিকশিত হয়ে এখনও মানুষের মত বুদ্ধিমান পর্যায়ে উন্নীত হয় নি। তাই আমরা শত চেস্টা করেও মহাকাশে বিভিন্ন সিগন্যাল প্রেরণ করেও আজ পর্যন্ত সেসব সিগন্যালের কোন ফিডব্যাক বা প্রতিউত্তর কারো কাছ থেকে পাই নি।  

যদি সমগ্র মহাবিশ্বে আমরাই একমাত্র বুদ্ধিমান প্রজাতি হই, তবে সেটি যেরকম ভয়ংকর, একই রকম ভয়ংকর অন্য গ্রহে আমাদের মত বা আমাদের চেয়ে উন্নত কোন প্রজাতির অস্তিত্ব থাকা। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে এখন পর্যন্ত আমরা কোন এলিয়েনের দেখা পাই নি। আমাদের এক হাত বলছে পৃথিবী বাদে অন্য গ্রহেও প্রাণ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, অন্যদিকে তাদের অস্তিত্বের প্রমাণস্বরূপ কোন কিছু এখন পর্যন্ত আমাদের অন্য হাতে নেই। ইংরেজিতে এটির একটি সুন্দর নাম রয়েছে- Fermi Paradox.

আজকাল প্রায়ই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও নিউজ চ্যানেলে কারো কারো কর্তৃক ফ্লায়িং সসার বা UFO (Unidentified Flying Object) দেখার কথা শোনা যায়। তাদের ভাষ্যমতে, চাকতির মত এক ধরণের মহাশূন্যযান হঠাৎ করেই তাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, আবার হঠাৎ করেই তারা অদৃশ্যে মিলিয়ে গিয়েছে। অনেক বিজ্ঞানীই বরাবর তাদের দাবীকে অপটিক্যাল ইল্যুসন হিসেবে হেসে উড়িয়ে দিয়ে আসছে। তবে কিছু বিজ্ঞানী বিভিন্ন সময় ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্বের সাথেই আমলে নিয়েছে।

প্রশ্ন হল, এমন একটা প্রজাতি যদি সত্যিই থেকে থাকে, তাহলে কেন তারা ওরকমটি করবে? কেন তারা মানুষের সাথে hide and clap গেইম খেলে নিজেদেরকে এভাবে আড়ালে রাখবে? 

এসব প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। তবে কতগুলো সম্ভাব্য কারণ অনেকেরই মাথায় এসেছে। একটি হল, তারা চায় না আমরা তাদের ব্যাপারে জেনে ফেলি। এজন্য নিজ থেকেই তারা আমাদের নিকট ধরা দেয় না, দৃষ্টির আড়ালে থাকে। কেন চায় না? কারণ, এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে সেই দীর্ঘকাল যাবৎ বহন করে আসা মানুষের বিভিন্ন প্রথাগত বিশ্বাস, বিভিন্ন ধর্ম ও সেই সকল ধর্মের আলাদা আলাদা ঈশ্বরীয় মতবাদ। যদি মানুষ তাদের জেনে ফেলে, তবে প্রচলিত অনেক ধর্মই বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মূখীন হবে, এথিক্যাল অনেক জিনিসেই হঠাৎ আমূল পরিবর্তন আসবে, ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও ঈশ্বরে বিশ্বাসী লোকজনের মধ্যে দেখা দেবে ব্যাপক উত্তেজনা। এই ধরণের ক্যাটাসট্রপির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবার সক্ষমতা মানুষ কী এখন পর্যন্ত অর্জন করতে পেরেছে? মনে হয় না, মানুষের আরও সময় প্রয়োজন। হয়ত বা তারা দিন গুনছে সেই সময়টি পর্যন্ত। তবে তারা সর্বদাই চোখ রাখছে এই নীল গ্রহটির উপর এবং ভাবছে, Let them grow till that point.

অনেকেই আবার একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করে থাকেন, এলিয়েনরা হয়ত পৃথিবীকে দেখে থাকে সাফারি পার্কের মত একটা সংরক্ষিত জু (zoo) হিসেবে। পৃথিবীতে বিদ্যমান স্বয়ংক্রিয় ইকোলজিকাল সিস্টেমে তারা হয়ত নিজ থেকে হস্তক্ষেপ করতে চায় না, যেটা হতে পারে তাদের এথিকসের বিরুদ্ধে যায়। যেমন ধরুন, আপনি মহাশূন্যযানে করে চলতে চলতে পৃথিবী থেকে ১২০ আলোকবর্ষ দূরে পৃথিবীর মতই আরেকটা গ্রহের সন্ধান পেলেন, যেটিতে মানুষের মতই একটা প্রজাতি তিলে তিলে গড়ে তুলেছে উন্নত সভ্যতা, দেখতে পেলেন একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে গভীর আলিঙ্গনে চুমু খাচ্ছে। দেখতে পেলেন একটা মা হরিণ তার বাচ্চার জন্য নিজেকে একটা সিংহের নিকট সমর্পণ করছে। আপনি কী অমন একটা গ্রহে ইন্টারভেন (intervene) বা হস্তক্ষেপ করতে চাইবেন? নিশ্চয়ই না। আপনার নিকট গ্রহটাকে মনে হবে বায়ো ডাইভার্সিটির একটা সুন্দর নমুনা, আপনি ওটাকে ওইসব প্রাণীর অভয়ারণ্য (sanctuary) হিসেবেই ছেড়ে দিতে চাইবেন। হয়তবা একই ঘটনা ঘটে চলেছে পৃথিবীর ক্ষেত্রেও। তাই শত চেস্টা করেও আমরা আজ পর্যন্ত এলিয়েনদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি নি। 

আরেকটা অদ্ভুত ভাবনা অনেক বিজ্ঞানীই ভেবে থাকেন। সেটি হল, অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন, আমাদেরকে হয়তবা কোন এক higher intelligent species বা উচ্চতর বুদ্ধিমান প্রজাতি পরীক্ষার টুল হিসেবে ব্যবহার করছে। অর্থাৎ জীববৈচিত্র্যসহ পুরো পৃথিবীটাই হতে পারে কোন একটা ম্যাসিভ এক্সপেরিমেন্টের অংশ। আর এই এক্সপেরিমেন্ট চালনা করছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও টেকনোলজিতে লক্ষ লক্ষ গুন এগিয়ে থাকা কোন এক এলিয়েন সভ্যতা। বিষয়টি শুনতে অনেকটা হাস্যকর ও মেটাফিজিক্যাল/আধ্যাত্মিক মনে হলেও এটি একেবারেই হাস্যকর নয়, এমনকি এখানে কোন আধ্যাত্মিকতারও ছোয়া নেই, পুরো ব্যাপারটিই বৈজ্ঞানিক। একটু লক্ষ্য করলেই আপনি দেখতে পাবেন, আমরা মানব প্রজাতি আমাদের নিজেদের স্বার্থে গিনিপিগ নিয়ে বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকি। কখনো কখনো আমরা দুটো গিনিপিগকে দু'টো ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বড় করে তুলি। তারপর তাদের থেকে আমরা আমাদের প্রয়োজনে বিভিন্ন ড্যাটা সংগ্রহ করে থাকি। যদি পৃথিবীর সমস্ত জীববৈচিত্র্য উচ্চতর কোন সভ্যতার দ্বারা পরিচালিত পরীক্ষায় গিনিপিগের মতই ভূমিকা পালন করে থাকে, তবে নিঃসন্দেহে এটি বেশ আশ্চর্যজনক হবার মতই ঘটনা। এমনও হতে পারে তারা একটা ইল্যুশন সৃষ্টি করে আমাদেরকে একটা জগতে আবদ্ধ করে রেখেছে, যে জগতটিতে আমরা নিজদেরকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে উপলদ্ধি করে চলেছি, অথচ বাস্তবে আমরা তাদের হাতের গিনিপিগ ছাড়া আর কিছুই নই। 

বিঃদ্রঃ আমার এই লেখার সাথে ভূত, জিন, ডেমন, এঞ্জেল বা বিভিন্ন ধর্মীয় ঈশ্বরের কোন সম্পর্ক নেই। এলিয়েনদের সাথে শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওটা ওসব সত্তার কোন সম্পর্ক নেই। লেখাটি সম্পূর্ণভাবে বিজ্ঞান ও ফিলোসোফিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা।

Ripan Biswas

ছবিঃ সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম