পরিচিতি: অশ্বগন্ধা আমাদের দেশে অন্যতম ভেষজ উদ্ভিদ। নিয়মিত এই মহৌষধিটি গ্রহণ করলে মস্তিষ্কের সার্বিক কর্মক্ষমতাও চোখে পরার মতো বৃদ্ধি পায়। গাছের গন্ধ ঘোড়া বা অশ্ব এর মত বলেই সংস্কৃতে একে অশ্বগন্ধা বলে। বাংলায়ও আমরা অশ্বগন্ধা-ই বলে থাকি। বাত ব্যথা, গাটের ব্যাথা, শরীর ফোলার ক্ষেএে ব্যবহার করে থাকি। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভেষজ অ্যাডাপটোজেন অশ্বগন্ধা শক্তিবর্ধক হিসেবে এবং এ্যাফ্রোডেসিয়াক হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলেই ইংরেজিতে একে Indian Ginseng বলে। মূল এবং পাতা স্নায়ুর বিভিন্ন রোগে ব্যবহৃত হয়। এ গাছ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকায় পাওয়া যায়। নিদ্রা আনয়নকারী ঔষধ হিসেবে প্রচীন মেসোপটেমিয়া এবং মিশরে এর ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। নিয়মিত অশ্বগন্ধ গ্রহণ করা হলে অশ্বের মতো শক্তি ও পুরুষকার অর্জন করা যায়।
অশ্বগন্ধার ঔষদি গুনাগুন গুলি হলোঃ
➢ ক্যান্সারবিরোধী: বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার দমনে অশ্বগন্ধার অন্নান্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে থাকা উইদাফেরিন-এ অ্যাঞ্জিওজেনেসিস দমন করে কয়েক ধরনের ক্যান্সার থেকে যে সুরক্ষা দেয় । উইদাফেরিন-এ বিশেষ কিছু ক্যান্সার কোষ বা ক্যান্সার সেলের বৃদ্ধি দমন করতে সক্ষম। এই কারণেই গত তিন হাজারেরও বেশি সময় ধরে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ক্যান্সার নিধনে এর সুপারিশ হয়ে চলেছে। অশ্বগন্ধার মধ্যে মানুষের প্রস্টেট, কোলন, কিডনি, ফুসফুস, স্তন, রক্ত (লিউকেমিয়া), প্যানক্রিয়েটিক, মাথা ও ফাইব্রোসার্কোমা (তন্তুকার যোগ কলা), রেনাল এবং মাথা ও ঘাড়ের ক্যান্সার বিরোধী ধর্ম আছে। অশ্বগন্ধার অ্যান্টি-ক্যান্সার ক্ষমতা ও জীবদেহে কার্যকরী (বায়োঅ্যাক্টিভ) উইদানোলয়েডস নিয়ে বিশ্বব্যাপি যে গবেষণা হয়েছে বা হচ্ছে তাতে বিভিন্ন গবেষণাগারে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই ভেষজটি মানবদেহে ক্যান্সারকোষ ধ্বংস, ক্যান্সার তৈরির সময় কোষীয় পার্থক্যকরণ এবং ক্যান্সার কোষ প্রতিরোধী প্রক্রিয়ার কাজ করে।
➢ শুক্রানু উৎপাদন বৃদ্ধি: পরীক্ষামূলক ভাবে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সেমিনিফেরাস টিবিউলসকে প্রভাবিত করে, সেরাম টেস্টোস্টেরন মাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি রোজকার স্পার্ম বা শুক্রানু উৎপাদন বাড়িয়ে এবং যৌন মানসিকতার উন্নতি ঘটিয়ে অশ্বগন্ধা টেস্টিকুলার উন্নয়ন ও স্পার্মাটোজেনেসিসে সাহায্য করে। এ ছাড়াও এরা স্পার্মের অক্সিডেটিভ ক্ষতি প্রতিহত করে। উইদেনিয়া সোমনিফেরা যে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে সিমেন বা বীর্যের গুণমান এবং বন্ধ্যা পুরষ রোগীর রিপ্রোডাক্টিভ হর্মোন মাত্রার উন্নতি ঘটায় তার তথ্যসমৃদ্ধ প্রমাণ সাম্প্রতিক কালে পাওয়া গেছে।
যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করে শুক্রাণু বৃদ্ধির কাজে, ভ্যাজাইনাইটিস রোগের প্রতিকারে এবং স্তন বিকাশের প্রযোজনে অশ্বগন্ধাকে ব্যবহার করা হয়। বহু প্রাচীনকাল থেকে উইদেনিয়া সোমনিফেরা নার্ভ টনিক, কামোদ্দীপক, অ্যাডাপটোজেন, অ্যান্টি-রিউম্যাটিক এজেন্ট, অ্যাসট্রিনজেন্ট এবং স্মৃতিবর্ধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
➢ অ্যালজাইমার্স, হান্টিংটন এবং পার্কিনসন রোগে আক্রান্তদের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমে যায় বা হারিয়ে যায়। এই রোগগুলির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের অংশ এবং এর সঙ্গে সংযোগকারী পথগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা থেকে স্মৃতিশক্তি এবং মস্তিস্কের কার্যকারিতা নষ্ট হয়। আগেই জানা গিয়েছিল যে, অশ্বগন্ধার স্নায়ুসুরক্ষাগত কার্যকারিতার পেছনে আছে গ্লাইকোউইদানোলয়েডস। এরা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টধর্মী কাজের সূত্রে লিপিড পারক্সিডেশনকে দমন করে।অশ্বগন্ধা মস্তিস্কের ক্ষমতা বাড়িয়ে মস্তিস্কের বৌদ্ধিক ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়।
➢ মৃগীরোগ: মৃগীরোগের চিকিৎসায় অশ্বগন্ধা বহুদিন ধরেই স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। বহু গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই গাছে থাকা উইদানোলয়েডস নানা ক্রিয়াকৌশলের সাহায্যে মৃগী রোগের আকস্মিক আক্রমণ কমাতে সাহায্য করে। এদের মধ্যে একটি হল মস্তিস্কে গামা অ্যামিনো বিউটিয়ারিক অ্যাসিড গ্রহীতা বা রিসেপটারের সামঞ্জস্যবিধান করা। এছাড়া উইদানোলয়েডস-এ গ্লুটামার্জিক নিউরোট্রান্সমিশনের পরিবর্তন করে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে স্থানিক স্মৃতিশক্তি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম। কারণ এর ফলে স্থানিক স্মৃতিশক্তি অপচয়ে মুখ্য ভূমিকা গ্রহনকারী এন-মিথাইল-ডি-অ্যাপারেট (এন এম ডি এ) গ্রহীতার ক্ষমতা খর্ব করা হয়। অশ্বগন্ধার পাতার নির্যাসও মানুষের নিউরোব্লাস্টোমা কোষের গ্লুটামেট প্রণোদিত বিষক্রিয়া বা টক্সিসিটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অশ্বগন্ধার যথেষ্ট পরিমানে খিঁচুনি বিরোধী ক্ষমতা রয়েছে, যা নানা ধরনের এপিলেপ্সি বা মৃগীরোগ সারাতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
➢ অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি: অশ্বগন্ধার মধ্যে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটারি ও অ্যান্টি-আর্থারাইটিক ক্ষমতাও কার্যকরভাবে উপস্থিত আছে। যার অন্যতম মুখ্য উপাদান উইদাফেরিন-এ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, অশ্বগন্ধা প্রস্টাগ্ল্যান্ডালিন, হিস্টামিন, ইন্টারলিউকিন ও সাইটোকাইনেজের মতো ইনফ্ল্যামেটরি মেডিয়েটরের উত্পাদন কমানোর পাশাপাশি মোটর কার্যকারিতার উন্নতি ঘটিয়ে আর্থারাইটিসের তীব্র যন্ত্রণাকে তাত্পর্যপূর্ণভাবে কমাতে পারে। তাই এই ভেষজকে বেদনানাশক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। এরা স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব বিস্তার করে বেদনার সঙ্কেত পাঠাতে দেয় না। এ ছাড়াও আর্থারাইটিক ইনফ্ল্যামেশন, সিস্টিক ফাইব্রোসিসের ইনফ্ল্যামেশন এবং এই ভেষজ রিউম্যাটেড আর্থারাইটিস চিকিৎসায় দারুণ কার্যক্ষম। মেনোপজাল অস্টিওপোরেসিস ও হাড়ের আঘাতের ক্ষেত্রে অস্টিওব্লাস্টের বৃদ্ধিতে উইদাফেরিন-এ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।
➢ মানসিক, শারীরিক দুর্বলতা ও মনোযোগ বাড়ায়: যেমন মাথা ঝিমঝিম করে ওঠা, সংজ্ঞাহীনতা, অবসাদ প্রভৃতি দূর করে অশ্বগন্ধা। ক্লান্তি দূর করে সঞ্জীবনী শক্তি পুনরুদ্ধার করে।
➢ ভালো ঘুমের জন্য অশ্বগন্ধা গুঁড়ো চিনিসহ ঘুমানোর আগে খাওয়া যেতে পারে। সর্দি-কাশি থেকে মুক্তি পেতে অশ্বগন্ধার মূল গুঁড়ো করে খাওয়া যেতে পারে। চোখের ব্যথা দূর করতে অশ্বগন্ধা বিশেষ উপকারী।
➢ ক্রনিক ব্রংকাইটিসের ক্ষেত্রেও অশ্বগন্ধা একটি কার্যকর ওষধু। অশ্বগন্ধার মূল অন্তর্ধুমে পুড়িয়ে (ছোট মাটির হাঁড়িতে মূলগুলো ভরে সরা দিয়ে ঢেকে পুনঃমাটি লেপে শুকিয়ে ঘুটের আগুনে পুড়ে নিতে হয়। আগুন নিভে গেলে হাঁড়ি থেকে মূলগুলো বের করে গুঁড়ো করে নিতে হয়) ভালো করে গুঁড়িয়ে নিয়ে আধা গ্রাম মাত্রায় একটু মধুসহ চেটে খেলে ক্রনিক ব্রংকাইটিসে উপকার হয়।
➢ থাইরয়েড রোগে: কারণ অশ্বোগন্ধার রস শরীরে প্রবেশ করার পর থাইরয়েড হরমোনের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রোগের প্রকোপ কমতে সময়ই লাগে না।
➢ ডায়াবেটিস রোগকে দূরে রাখে: ইতিমধ্যেই আমাদের দেশ সারা বিশ্বের মধ্যে ডায়াবেটিস ক্যাপিটালে পরিণত হয়েছে। এমন পরিস্থিততে “সাইলেন্ট কিলার” নামে পরিচিত ডায়াবেটিস রোগ থেকে দূরে থাকতে অশ্বগন্ধাকে কাজে লাগানো যেতেই পারে।
➢ স্নায়ুরোগ সারাতে পারে: অশ্বগন্ধা আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসাবে খুব ভাল স্নায়ুর সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এটি স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতেও সাহায্য করে। আসলে অশ্বগন্ধার মধ্যে উপস্থিত শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাতের সমস্যায় এমন বহু ওষুধ আছে, যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এছাড়াও, হাঁটু এবং কনুই ফুলে যাওয়া ও ব্যাথা দূর করতে অশ্বগন্ধার জুড়ি মেলা ভার।