An Evolving Life বিবর্তন নিয়ে ধারাবাহিক গল্প ১




ভূমিকাঃ

বিবর্তন বিষয়টা যেমন সুন্দর, কাওকে বোঝানো ততটা কঠিন। যখন ভাবলাম যে বিবর্তন নিয়ে কিছু লিখবো, মাথায় ডিপজলের ডায়লগটা বেজে উঠলো,
"তুই কিন্তু বহুত বড় জায়গায় হাত দিছস।"
তাও,সাহস করে লেখা শুরু করলাম, ভুল হলে অনুগ্রহ করে ধরিয়ে দেবেন আর ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

পৃথিবীতে ৮.৭ মিলিয়ন প্রজাতির জীব আছে। আরেকবার শুনুন, ৮.৭ মিলিয়ন!!!প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য আলাদা! কারো ২ টা হাত, কারো ৪ টা,কারো ৮ টা।কারো ৮ টা চোখ, কারো চোখই নাই। কেউ মাটিতে,কেউ পানিতে,কেউ বাতাসে।কেউ দৌড়ায়, কেউ হাটে,কেউ ঘোরে,কেউ ওড়ে,কেউ কিছুই পারেনা! এত্তকিছু আসলো কোথা থেকে?
এত প্রাণী কী আকাশ থেকে পড়লো, নাকি মাটি চিড়ে উঠলো? এই প্রশ্নটাই একসময় ভাবিয়েছে মানুষকে।নানান মানুষ নানান কল্পনা করেছে, বহুযুগ ধরে চলেছে রূপকথার রাজত্ব।
কিন্তু, Science always wins.
আজ আমরা পেয়েছি "বিবর্তন তত্ত্ব", যা সফল ভাবে ব্যাখ্যা করে রঙ-বেরঙের প্রাণীদের উৎপত্তি,পরীক্ষণ আর পর্যবেক্ষণ দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত একটি তত্ত্ব। যদিও বিবর্তন খুব নতুন কোনো তত্ত্ব না,বহু আগে এক আরবীয় বিজ্ঞানী, আল জাহিয, এই বিবর্তনের ধারণা দিয়েছিলেন।তিনি তার বই, "কিতাব-আল-হায়াওয়ান" বা "প্রাণীদের বই" এ লিখেছেন,
"একজন কালো রঙের চুলওয়ালা যুবকের মাথার উঁকুনগুলো কালো, আর একজন ধূসর রঙের চুলওয়ালা বৃদ্ধের মাথার উঁকুনগুলোও ধূসর।"
এইটা মাইক্রো-ইভোলুশনের সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ, যা আমরা দৈনন্দিন জীবনেই দেখতে পাই, কিন্তু অতটা খেয়াল করিনা।আল জাহিয এরপর ন্যাচারাল সিলেকশন ও টিকে থাকার লড়াই বা সার্ভাইভাল ফর এক্সিস্টেন্স নিয়ে সামান্য বর্ণনাও দিয়েছেন।কিন্তু, অতটা সাড়া ফেলতে পারেননি।

বহুযুগ পরে,সভ্যতার হাল যখন ইংরেজদের হাতে, জর্জ ক্যাভিয়ার, চার্লস ল্যায়ল,জন ব্যাপ্টিস্ট লামার্ক ও থমাস ম্যালথাস সহ অনেকে বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেন। তারা এইটুকু সঠিক ধরতে সক্ষম হন যে, সকল প্রজাতির প্রাণীই একটা প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছে।কিন্তু সেই প্রাণীটা কে, কীভাবে বিবর্তন হলো, কোথায় ,কখন, কেন,ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি।
যেমন লামার্ক,তিনি বললেন," জিরাফের আদিপিতারা ছোট ছিলো, কিন্তু ওরা যেখানে থাকতো, সেখানে গাছের পাতা ছিলো উঁচুতে, ফলে ওরা গলা লম্বা করে খাওয়ার চেষ্টা করতো। এভাবে লম্বা করতে করতে ধীরে ধীরে আজকের জিরাফের গলা এত লম্বা!" মানে, বৈজ্ঞানিক ভাষায়, উনি জিনের ওপর পরিবেশ প্রভাবকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। বসবাসের পরিবেশ জিনকে অতি সামান্য প্রভাবিত করলেও, গলা লম্বা করে নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করতে পারেনা।

তাই, লামার্ক,তুমি ভুল বলেছিলে।

১৯ শতক
একজন সাদা দাড়িওয়ালা ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী,চার্লস ডারউইন, আর তার বন্ধু ওয়ালেস। একই প্রশ্ন তাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, "এত্তকিছু কইত্থে আইলো?" আগের বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু বলে গেছেন, কিন্তু তা মনে ধরেনি এই দুইজনের। শুরু করলেন গবেষণা,শুরু করলেন বিশ্বভ্রমণ।ডারউইন চলে গেলেন দক্ষিণ আমেরিকার গ্যালাপ্যাগাস আইল্যান্ডে,১৮ টা দ্বীপের সমষ্টি। আর ওয়ালেস দক্ষিণ আমেরিকার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায়ও যান। শোনা যায় যে এমাজন জঙ্গলেও গিয়েছিলেন। বহুদিন চিন্তা-ভাবনা,পরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ করার পর, দুই বন্ধু তাদের নোট মিলাতে লাগলেন। তারপর আগের বিজ্ঞানীদের গবেষণার দিকে তাকালেন। তাদের মাথায় বাতি জ্বলে উঠলো,
"বিবর্তন"!!!
১৮৫৮ সালে লন্ডনে বিজ্ঞানীদের সভায় উপস্থাপন করলেন তাদের গবেষণা।অনেকে মেনে নিলো,অনেকে বিরোধিতা করলো।প্রতিষ্ঠিত হলো জীববিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি,বিবর্তন তত্ত্ব। পরবর্তীতে গ্রেগর জোহান মেন্ডেল, হার্ডি, ওয়েইনবার্গ, মরগান সহ অনেকে জড়িয়ে যাবেন বিবর্তন তত্ত্বের সাথে।জানতে হলে, পরবর্তী পর্বগুলো পড়তে থাকুন…...





খুটি-নাটি থেকে "ইউনিক কুদ্দুস"

বিবর্তন তত্ত্বের এক্কেবারে বেসিকে আছে ডিএনএ, জিন, এলিল, ক্রোমোজোম এর মতো জিনিস। এগুলো নিয়ে প্রায় সবারই একটা ধারণা আছে, তাও, একবার ঝালাই করতে সমস্যা কী!

A,G,C,T, এই চারটা অক্ষর ঠিক করবে যে আমার চুল কেমন হবে, চোখ কেমন হবে, আমি জিরাফের মতো লম্বা হবো, নাকি খচ্চরের মতো খাটো হবো, ইত্যাদি সব বৈশিষ্ট্য। এদেরকে বলে নিউক্লিওটাইড। এরা পরপর বসে তৈরি করে ডিএনএ এর পলিনিউক্লিওটাইড বা একটা সুঁতা, দুইটা সুঁতা কুণ্ডলীর মতো প্যাচায় যাবে, তৈরি করবে ডাবল হেলিক্স।এইপাশে A থাকলে তারসাথে যুক্ত হবে ওইপাশের T। একইভাবে, C এর সাথে G। এভাবে এরা পরপর বসে তৈরি করে তথ্য এনকোড করবে। সেই তথ্য অনুযায়ী প্রোটিন উৎপাদন হবে।আমার চুলের আগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সব হচ্ছে প্রোটিন। (এই "সব" মানে ওই "সব" না)

তো, ডিএনএ বহুত লম্বা হয়। আমার সারা বডির ডিএনএ খুলে ফেললে তা দিয়ে নাকি প্লুটো পর্যন্ত যাওয়া-আসা করা যায়। অন্নেএএক লম্বা!!!
এই ডিএনএ এর একেক অংশ একেক কাজ করে। অনেকগুলো নিউক্লিওটাইড মিলে যদি একটা নির্দিষ্ট প্রোটিনের জন্য কাজ করে, ডিএনএ এর সেই অংশটুকুকে একটা জিন বলে।ধরলাম, আমার মাথার সবচেয়ে ওপরের ডানদিকের কোষটায় ২ মিটার ডিএনএ আছে।এর গোড়া থেকে শুরু করে ২০ সেন্টিমিটার(এমনি ধরলাম) পর্যন্ত নিউক্লিওটাইডগুলোতে আমার একটা চুলের রঙ কী হবে, তা লেখা। লেখা বলতে এনকোড করা, এই অনুযায়ী পিগমেন্টের প্রোটিন তৈরি হবে, আর তা গিয়ে আমার চুলে ঢুকবে।এই ২০ সেন্টিমিটার হলো একটা জিন।

আচ্ছা, আমার চুল কাকের মতো কালো বলে কী সবার চুল কালো নাকি? ব্রিটিশ প্রিন্স হ্যারি, ওনার চুলের রঙ, কী সুন্দর লালাভ।এমন হলো কেন? ওনার গায়ে কী জিন নাই? আছে। তাহলে? যেই জিন আমার চুলের রঙ ঠিক করছে, সেই একই জিনই ওনারও চুলের রঙ ঠিক করছে। কিন্তু, ওনার জিন উৎপাদন করবে লাল রঙের পিগমেন্টের প্রোটিন। এইরকমভাবে, একই ধরনের জিনের ভিন্ন ভিন্ন রূপকে বা ভিন্ন ধরনের প্রোটিন উৎপাদনকারী একই ধরনের জিনকে বলে এলিল। আমার হলো কালো এলিল, আর প্রিন্স হ্যারির লাল এলিল। কিন্তু জিন একটাই, চুলের রঙের জিন। বুঝছেন?

এবার, ফিরে যাই ডিএনএ তে।হিস্টোন নামের একটা প্রোটিন আছে। এক একটা হিস্টোন চাকতির চারপাশে ডিএনএ এর ১৪৬ টা বেস-পেয়ার প্রায় ১.৭ টা প্যাচ দেয়।বেস পেয়ার মানে দুইটা নিউক্লিওটাইডের একটা জোড়া, ওই A-T, C-G। তাহলে, এইভাবে প্যাচাতে প্যাচাতে অনেকগুলো হিস্টোনের চারপাশে বিশাল পরিমাণে ডিএনএ প্যাচায়, আর একটা দড়ির মতো তৈরি করে। একে বলে ক্রোমাটিন। এই ক্রোমাটিন আবার ওলট-পালট হয়ে নিজের মধ্যে নিজে ঘোর-প্যাচ দিয়ে আরো মোটা একটা দড়ির মতো হয়, একে বলে ক্রোমাটিড। মানে ক্রোমাটিন যদি মশারি টাঙানোর দড়ি হয়,ক্রোমাটিড হবে গরু বাঁধার দড়ি। আচ্ছা, এবার দুইটা ক্রোমাটিড যুক্ত হবে একটা সেন্ট্রোমিয়ার দিয়ে। তৈরি হলো ক্রোমোজোম।

এতক্ষণের লেখায় বিবর্তনের গন্ধ-বাস আসেনি, এইবার আসবে। মানুষের ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম আছে। ২৩ টা পিতা হতে, আর ২৩ টা মাতা হতে আসবে। এবার পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্যতো এক না।

কুদ্দুসের আব্বা আদর করার সময়ও ঝাড়ি দেয়,মা কথা বলতে গেলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। আব্বা ৬ ফুট, মা সাড়ে ৫ ফুট । আব্বা কালোজামের মতো, মা সন্দেশের মতো।আব্বার নাক একদম তীরের আগার মতো, মায়ের নাক বোঁচা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার "কুদ্দুস উৎপাদন প্রক্রিয়ায়" পিতা-মাতার ক্রোমোজোম লাগবে। কিন্তু এই ক্রোমোজোম রিকম্বিনেশন হবে ২ বার। গ্যামেট তৈরি হওয়ার সময় একজনের ৪৬ টা ক্রোমোজোমের যেকোনো ২৩ টা চলে আসবে,একদম র‍্যান্ডমলি। আবার গ্যামেট মিলে জাইগোট তৈরি হওয়ার সময় আরেকবার রিকম্বাইন হবে।

কুদ্দুস রাগী,ফর্সা,নাক বোঁচা আর ৬ ফুট লম্বা। এখানে কিন্তু কেউ বা কিছু ওই ক্রোমোজোমকে বলে দেয়নি যে কোন কোন ক্রোমোজোম গ্যামেটে আসবে, বা জাইগোটে কীভাবে কে-কার সাথে গিয়ে লাগবে। এক্কেবারে র‍্যান্ডমলি আমরা পেয়ে গেলাম ইউনিক পিস, কুদ্দুসকে। এই প্রক্রিয়াকে বলে "হেরেডিটি" বা "বংশগতি"। আর সারা দুনিয়ায় একপিস কুদ্দুস, এই অনন্য বৈশিষ্ট্য তৈরি হওয়া, পিতা-মাতার থেকে সন্তানের আলাদা গুণাবলি হওয়া, একে বলে "ডিসেন্ট উইথ মোডিফিকেশন" বা " বিশেষায়িত বংশধর"।কিন্তু, দেখা গেল, কুদ্দুসের মুখ লম্বা।
বড়ই চিন্তার বিষয়!
কুদ্দুসের আব্বার গোল আলুর মতো মুখ, মা'র ও গোল আলুর মতো। কুদ্দুসের মুখ কেন লম্বা হবে?

এই রহস্য উদ্ধার করবো পরবর্তী পর্বে, পড়তে থাকুন


কুদ্দুসের ইউনিকত্বের চুল-চেড়া বিশ্লেষণ

গত পর্বে একটা বড় ধরনের পাপ হয়ে গেছে! বংশগতির কথা বললাম, জিনের কথা বললাম, কিন্তু গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের নাম নেয়া হয়নি।এ বড় অন্যায়!
তিনি যাতে রাগ না করেন, তাকে নিয়ে কয়েকটা কথা বলে নেই,তারপর কুদ্দুসের লম্বা মুখের রহস্যে যাবো।

চেক মংক, গ্রেগর মেন্ডেল। আধুনিক জেনেটিক্সের প্রতিষ্ঠাতা। ইনি গবেষণা করেছিলেন মটরশুটি গাছ নিয়ে। বাংলাদেশে থাকলে মটরশুটির ব্যাবসা করে উদ্যোক্তা হতেন, ৩ বছর পর ঢাকায় ১০ টা ফ্লাট থাকতো।যাই হোক, গ্রেগরের ওইসব লোভ নাই। তিনি গবেষণা করেই খুশি। তো, তিনি গাছের ৭ টা বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরীক্ষণ করলেন। উচ্চতা,রঙ ইত্যাদি। তিনি লক্ষ্য করলেন, পিতা-মাতার একই ধরনের জিনের ভিন্ন দুইটা এলিলের যেকোনো একটা সন্তানের ওপর আধিপত্য করবে। যে আধিপত্য করবে, তাকে বলা হবে ডমিনেন্ট এলিল, আর যে চুপচাপ থাকবে, তাকে বলা হবে রিসেসিভ এলিল। এইসব নিয়ে আরো গবেষণা করে ১৮৬৬ সালে গ্রেগর তার গবেষণা প্রকাশ করলেন, ও প্রতিষ্ঠিত হলো,"মেন্ডেলিয়ান ইনহেরিটেন্স" তত্ত্ব।

গ্রেগর-কথন এখানেই শেষ করলাম।এই ডমিনেন্ট-রিসেসিভ নিয়ে আরো কাহিনী আছে,সেগুলো এখন না জানলেও চলবে, পরে লিখবো। এখন গতপর্বে যান আর ভাবুন, কুদ্দুসের দেহে ডমিনেন্ট এলিল কোনগুলো আর রিসেসিভ এলিল কোনগুলো?

এবার, কুদ্দুসের মুখ লম্বা হবে কেন?এখানে আলোচনায় হাজির হবে "মিউটেশন"। গতকাল যে ডিএনএ,জিন, ক্রোমোজোমের কথা বলেছিলাম, তা মনে আছে নিশ্চই। তাহলে এই মিউটেশন বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা না।

মিউটেশনের খাটি বাংলা হলো পরিব্যক্তি বা পরিবর্তন। কীসের পরিবর্তন? জিনের অথবা ক্রোমোজোমের। কীসের পরিবর্তন হবে, তার ওপর ভিত্তি করে মিউটেশন ২ প্রকার।

◑ক্রোমোজোমাল মিউটেশন- সংজ্ঞা আর কী দেবো?ক্রোমোজোম যেমন হওয়ার কথা ছিলো, তেমন না হয়ে অন্যরকম হলে বলে ক্রোমোজোমাল মিউটেশন। ক্রোমোজোমের একটা অংশ পরিবর্তন হয়ে যায়। এটা আবার কয়েকভাবে হয়। ডুপ্লিকেশনে ক্রোমাটিডের একটা অংশের দুইটা কপি চলে আসে, ফলে ক্রোমাটিড লম্বা হয়,ডিলেশনে একটা অংশ ডিলেট বা বাদ হয়ে যায়,ইনভার্শনে একটা অংশ উলটো হয়ে যায়,ট্রান্সলোকেশনে দুইটা ক্রোমাটিডের মধ্যে নির্দিষ্ট অংশের অদল-বদল হয়- এরটা ওর ঘাড়ে,ওরটা এর ঘাড়ে।
◑জিন মিউটেশন-এখানে জিনের রূপ পরিবর্তন হয়। ফলে, জিনটা ভিন্ন প্রোটিন উৎপাদন করে।এটাও কয়েকভাবে হয়,সাবস্টিটিউশনে দুইটা ভুল বেস জোড়া লেগে যায়,ইনসার্শনের একটা অতিরিক্ত বেস চলে আসে আর ডিলেশনে একটা বেস বাদ হয়ে যায়।
এতকিছু মনে রাখা লাগবেনা,শুধু এইটুকু বুঝলেই হবে যে মিউটেশন মানেই নতুন বৈশিষ্ট্য।

এভাবে মেইনলি মিউটেশন হয়। নানা কারণে হতে পারে। ডিএনএ রেপ্লিকেশনের সময় আর মিয়োসিসের সময় এক্কেবারে র্যান্ডমলি, মানে খুশিতে-ঠেলায়-ঘোরতে, রেডিয়েশনের কারণে, বিভিন্ন মেডিসিনের কারণে ইত্যাদি।মিউটেশনের ফলে ভিন্ন প্রোটিন উৎপাদন হবে, ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে।ফলে, পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্যের বাইরেও অনেক নতুন নতুন ট্রেইট বা বৈশিষ্ট্য আমদানি হবে।

মানে, এতটুকু বোঝা গেল যে কুদ্দুসের মুখ লম্বা হওয়ার কারণ হলো মিউটেশন। কিন্তু প্যাচ এখানেই শেষ না। কুদ্দুস চিন্তায় পড়ে গেল, ওর লম্বা মুখ পছন্দ না। তাই, ও চায় না যে ওর বাচ্চা-কাচ্চা হলে তাদের মুখও লম্বা হোক। একটু বৈজ্ঞানিক ভাষায় বললে, কুদ্দুস নিজের মিউটেশনকে তার হেরেডিটিতে পাস করতে চায়না। কুদ্দুস চাইলেই কি, না চাইলেই কি। ২৫ বছর পর দেখা গেল কুদ্দুসের বাচ্চারও মুখ লম্বা! কুদ্দুস চিন্তায় পড়ে গেল। ও চিন্তা করতে থাকুক, আমরা বিজ্ঞানটা বুঝে আসি।

মিউটেশন দুইটা জায়গায় হতে পারে।গ্যামেটে , অথবা দেহকোষে।
পিতা-মাতার গ্যামেট তৈরি হওয়ার সময় মিউটেশন হতে পারে। গ্যামেট মিলিত হওয়ার পর জাইগোটে ক্রোমোজোম জোড়া লাগবে, সেখানে মিউটেটেড ক্রোমোজোম বা জিন আছে,ফলে পরবর্তী যতগুলো কোষবিভাজন হবে,প্রত্যেক কোষে ওই মিউটেটেড ক্রোমোজোমের কপিই থাকবে। ফলে, সন্তান যখন আবার বংশবৃদ্ধি করবে, তার দেহ থেকে যে ক্রোমোজোমগুলো যাবে, সেখানে ও---ই মিউটেটেড ক্রোমোজোম চলে যাবে। আর মিউটেশনর ফলে যে ভিন্ন এলিল তৈরি হয়েছিলো, সেটা ডমিনেন্ট হলে সেই বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাবে। একে বলে জার্মলাইন মিউটেশন, যেটা জাইগোট তৈরির আগে হয়।

কুদ্দুসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। ওর আব্বা বা আম্মার গ্যামেট তৈরি হওয়ার সময় মিউটেশন হয়ে গেছে,কুদ্দুসের জাইগোট তৈরি হইছে,দেহের প্রতি কোষে লম্বা-মুখ এলিলের কপি চলে আসছে। ফলে, কুদ্দুস যখন আবার সন্তান উৎপাদন করছে, তখন ওর দেহ থেকে এই এলিল জাইগোটে চলে গেছে, ডমিনেন্ট হয়ে গেছে, ফলাফল হলো কুদ্দুসের বাচ্চার মুখ লম্বা!সুতরাং, জার্মলাইন মিউটেশন হলো হেরিটেবল বা সন্তানের মধ্যে পাস করা যায়।

আরেকটা হলো দেহকোষে মিউটেশন।একে বলে সোমাটিক মিউটেশন।এটা জাইগোট তৈরির পরে, দেহকোষে হয়। নির্দিষ্ট এলাকায় হয় বলে হেরিটেবল না।যেমন ক্যান্সার হলে প্রথমে একটা একটা কোষে হবে, তারপর সেই ডিএনএ নিজের কপি তৈরি করবে ও ক্যান্সার ছড়ায় দেবে। কিন্তু সারা দেহের সব কোষেতো আর এই মিউটেশন হয়নি বা এই মিউটেটেড জিন চলে যাবেনা।মূল দেহকোষে আগে থেকেই ক্রোমোজোমে সব তথ্য রয়ে গেছে,সেখানে চেঞ্জ হয়নি। ফলে সন্তান উৎপাদনের সময় ক্যান্সারের তথ্যওয়ালা জিন গ্যামেটে যাবেনা।

ধরি, এক্সিডেন্টে কুদ্দুসের হাত-পা ভেঙে গেলে কেটে বাদ দেয়া লাগলো, কিন্তু তার সন্তানের ঠিকই হাত-পা হবে।কারণ অন্যান্য জিনে হাত-পা'র তথ্য রয়ে গেছে।এভাবে, সোমাটিক মিউটেশন কখনো হেরিটেবল না।

কুদ্দুসের ইউনিকত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেক বকবক করা লাগলো।


আরেকটু খুটি-নাটি ও কুদ্দুসের জিন-চেড়া বিশ্লেষণ।

ভাবলাম যে ন্যাচারাল সিলেকশনে ঢুকে যাবো, কিন্তু নাহ্, এখনো বাকি, অনেএএএক বাকি।এইসব বেসিক বোঝা দরকার, এগুলো না বোঝার কারণেই বিবর্তনকে "জাস্ট এ থিওরি" বলা মহাজ্ঞানীরা ম্যা ম্যা করে। আমরা তেমন মহাজ্ঞানী হতে চাইনা।
তাহলে শুরু করা যাক।

গতপর্বে ডমিনেন্ট এলিল আর রিসেসিভ এলিলের কথা বলেছিলাম, নিশ্চই মনে আছে।আজকে এই বিষয়টা নিয়েই নাড়াচাড়া করবো।
আমরা জানি, মানুষের দেহে একই বৈশিষ্ট্য নির্ধারণকারী জিনের জন্য দুইটা এলিল থাকে। কারণ আমরা ডিপ্লয়েড জীব, মা থেকে একটা আসে,বাবা থেকে একটা আসে। জোড়া তৈরি হয়, জোড়ায় একটা প্রকাশ পায়, একটা চুপচাপ থাকে।আবার জোড়ায় দুইটাই ডমিনেন্ট বা দুইটাই রিসেসিভ হতে পারে। কুদ্দুস ফর্সা, কারণ ওর গায়ের রঙের জিনের ক্ষেত্রে ডমিনেন্ট ফর্সা এলিল উপস্থিত ছিলো,রিসেসিভ কালা এলিল থাকলেও প্রকাশ পায়নি, অথবা ছিলোই না।
(এইসব কথা পড়ে নিশ্চই মাথা ঘুরাচ্ছে, সমস্যা নাই, নিচে সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছি)
এইবার, ডমিনেন্ট এলিলকে প্রকাশ করা হবে ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে, যেকোনো এলফাবেট। আর রিসেসিভকে প্রকাশ করা হবে একই এলফাবেটের স্মল লেটারে। আমরা কুদ্দুসের গায়ের রঙের এলিলকে "ডি" ধরলাম।আর, কোনোভাবে জানতে পারলাম যে ফর্সা এলিল ডমিনেন্ট হবে।

কুদ্দুসের জন্মের আগে ওর আব্বা জানতে চাইলো যে ছেলের গায়ের রঙ কী হবে। কুদ্দুসের চাচার কথা শুনে তারা চলে গেল তান্ত্রিকবাবা আদুচাঁনের কাছে।
কিন্তু আমরা বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ, ওইসব ভণ্ডামিতে আমরা মানিনা, আমরা বিজ্ঞান দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করবো।

ডমিনেন্ট ফর্সা এলিল D
রিসেসিভ কালা এলিল d
একই জিনের জন্য দুইটা এলিল জোড়া লাগবে
এই দুইটা দিয়ে কয়ভাবে জোড়া বানানো যায়?
DD, Dd,dd (dD আর Dd একই জিনিস, কিন্তু মানুষ বড়টার দিকেই আগে নজর দেয়)
মানে, আমরা এলিলের গঠনে তিনটা সম্ভাব্য ঘটনা দেখতে পারি। এই তিনটাকে বলে "জিনোটাইপ"।
জিনোটাইপ দুই প্রকার। হোমোজাইগাস আর হেটেরোজাইগাস। হোমো মানে একই,হেটেরো মানে আলাদা। তাহলে DD,dd হলো হোমোজাইগাস। কিন্তু দুইটা জিনিস আলাদা, তাই এদেরকে যথাক্রমে হোমোজাইগাস ডমিনেন্ট ও হোমোজাইগাস রিসেসিভ বলে। আর Dd হলো হেটেরোজাইগাস।

যাদের এলিল জোড়া হোমোজাইগাস,তাদের বলে হোমোজাইগোট। মানে,আমি যদি বলি কুদ্দুস হোমোজাইগোট, তার মানে ওর দেহে একই এলিলের জোড়া আছে,DD অথবা dd।
আবার আমি যদি বলি কুদ্দুস হেটেরোজাইগোট,মানে ওর দেহে এলিলের জোড়ায় দুইটা আলাদা এলিল, Dd আছে।
জোড়ায় যদি ডমিনেন্ট এলিল থাকে, সে রিসেসিভকে ডর-ভয় দেখায় চুপ করায় রাখবে। কিন্তু, যদি জোড়ায় ডমিনেন্ট এলিলই না থাকে? ঠেকায় পড়ে রিসেসিভই প্রকাশ পাবে, কারণ ও ছাড়া আর কেউ ইন-চার্জ নেই।

মানে,উপরের তিনটা জিনোটাইপের জন্য আমরা ফলাফল পাবো কয়টা? দুইটা।
DD=Dd=ফর্সা
dd=কালো
এই দুইটা হলো "ফিনোটাইপ"।ওকে?

এই গেলো এলিলালাপ। এইবার, কুদ্দুসের গায়ের রঙ কী হবে?তা জানার জন্য আমাদেরকে ওর আব্বা-আম্মার জিনের দিকে তাকাতে হবে। জানা গেল, কুদ্দুসের আব্বার জিনোটাইপ হলো dd,মানে ওর আব্বা হোমোজাইগোট, হোমোজাইগাস রিসেসিভ ধারণ করে।ফলে, আব্বার প্রকাশিত ফিনোটাইপ হলো কালা।আর ওর আম্মার জিনোটাইপ হলো Dd, মানে ওর আম্মার হেটেরোজাইগোট, সে হেটেরোজাইগাস ধারণ করে। এইবার,আব্বা-আম্মার কুদ্দুস উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এই এলিল মিক্স হবে। মিক্স হয়ে কী কী সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে?
Dd X dd = Dd,Dd,dd,dd. কার্তেসীয় গুণজের মতো।মানে, কুদ্দুসের হেটেরোজাইগোট হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% আর হোমোজাইগোট রিসেসিভ হওয়ার সম্ভাবনা ৫০%। হেটেরোজাইগোট মানেই ডমিনেন্ট এলিল প্রকাশ পাবে।
আর আমাদের কুদ্দুসের ক্ষেত্রে ওই হেটেরোজাইগাস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাটাই ফলে গেছে! ফলে, কুদ্দুস হেটেরোজাইগোট, তার জিনোটাইপ Dd,তার ফিনোটাইপ ফর্সা।

কেস খতম। আর ওইযে কার্তেসীয় গুণজ করলাম না? ওইটাকে একটা বর্গাকৃতির বক্সের মাধ্যমে প্রকাশ করাকে বলে "পানেট স্কয়ার"। নিচে ছবি দেখলেই বুঝে যাবেন,কিন্তু ওখানে এলিলকে "আর " দিয়ে প্রকাশ করেছে।

তো, আমাদের খুটিনাটি এখানেই শেষ। আগামীকাল হার্ডি-ওয়েইনবার্গ ইকুইলিব্রিয়াম দিয়ে ন্যাচারাল সিলেকশনে ঢুকে যাবো।


বিবর্তনের ফালতু অঙ্ক

আমরা বিবর্তন তত্ত্বের এক্কেবারে বেসিকের জিনিসগুলো মোটামুটি জেনে নিয়েছি। এইবার, একটু অঙ্ক করা সময়। দুই ভদ্দরলোক, ম্যাথমেটিশিয়ান হার্ডি ও গাইনোকলজিস্ট ওয়েইনবার্গ মিলে এই গণিতটা গড়ে তোলেন,দুইটা সমীকরণ, নাম হার্ডি-ওয়েইনবার্গ ইকুইলিব্রিয়াম।
তাহলে, শুরু করা যাক।

আমরা কল্পনা করি একটা লোকালয়,যার নাম ডারউইনগর, যেখানে মাত্র ১০০০ জন থাকেন। কল্পনা করতে টাকা লাগে না, যা ইচ্ছা ধরে নেয়া যায়।আমরা নিজেদের সুবিধার্থে ধরে নিলাম। মানুষের হাজারো বৈশিষ্ট্য বা ট্রেইট আছে, আমরা চুলের রঙ ধরলাম।

ডারউইনগরে শুধু দুইরকমের চুলের রঙের মানুষ থাকে। কালো,লালাভ। আমরা চুলের রঙের এলিলকে "এইচ" দিয়ে প্রকাশ করবো, আর কালো এলিল হবে ডমিনেন্ট।
তাহলে, কালো চুল=H
লালাভ চুল=h
সরকার কয়েক কোটি টাকা বাজেট ধরে বিশেষজ্ঞের দল পাঠালো তাদের চুলের রঙ দেখার জন্য।
জানা গেল, ৭৫০জনের চুল কালো, ২৫০ জনের লালাভ।
যে কয়জনের চুল কালো, তাদের মধ্যে HH ও আছে, Hh ও আছে। কিন্তু লালাভ চুলওয়ালাদের শুধু hh আছে,তাই আমরা এটা নিয়ে কাজ করবো।

hh=২৫০/১০০০=২৫%। আর বাকি দুইটা মিলে ৭৫%।
আচ্ছা, দুইটা h একসাথে আসার সম্ভাবনা ২৫ % বা ০.২৫। তাহলে একটা h আসার সম্ভাবনা কত? Root over ০.২৫ বা ০.৫ বা ৫০%
এলিল আছে দুইটা, h আর H, তাহলে H আসার সম্ভাবনা কত? ১-০.৫=০.৫ বা ৫০%।
একে বলে এলিল ফ্রিকোয়েন্সি।মানে, ডারউইনগরের ১০০০ জনের ২০০০টা এলিলের মধ্যে ১০০০টা লাল,১০০০টা কালো।
এখানে কিন্তু হেটেরোজাইগাসদের Hh সহ এই ফ্রিকোয়েন্সি বের করা হয়েছে।
f(H)=50%,f(h)=50%
এখানে f মানে ফাংশন না, ফ্রিকোয়েন্সি।দুটার ফ্রিকোয়েন্সি যোগ করলে হয় ১০০ % বা ১।
আমরা কী সমীকরণ পাবো?
H+h=1
সাধারণত p, q দিয়ে প্রকাশ করা হয়, আমি সরাসরি এলিলের নাম দিয়েই করলাম।এখানে বোঝাচ্ছে যে H এর হার আর h এর হারের যোগফল সর্বদা ১ হবে।হতেই হবে। এক্কেবারে কমন সেন্স,ব্যাখ্যা করলাম না।

এই সমীকরণটা ছিলো এলিল ফ্রিকোয়েন্সির সমীকরণ। মানে, এই সমীকরণটা দিয়ে জানা যায় যে দুইটা এলিল শতকরা কতভাগ আছে।এবার, আমরা আরো তদন্ত করতে চাই। মানে সূক্ষ্মভাবে জানতে চাই যে, হোমোজাইগাস রিসেসিভ কয়জন, ডমিনেন্ট কয়জন, আর হেটেরোজাইগাস কয়জন।মানে, আমরা জিনোটাইপ ফ্রিকোয়েন্সি জানতে চাই তাহলে আমরা কী করবো?

(H+h)(H+h)=1•1
HH+Hh+hH+hh=1
H^2+2Hh+h^2=1

কী করলাম? উভয় পাশে বর্গ করে দিলাম। কিন্তু বীজগণিতটা না হয় বুঝলাম, এর বাস্তবতা কী?
H^2 মানে দুটো H একসাথে,h^2 মানে দুটো h একসাথে।মানে, হোমোজাইগাস ডমিনেন্ট আর হোমোজাইগাস রিসেসিভ। স্বাভাবিকভাবেই Hh মানে হেটেরোজাইগাস।কিন্তু তার আগে ২ গুণ মানে কী?

পিতা থেকে একটা আর মাতা থেকে একটা এলিল আসবে। Hh হওয়ার জন্য কী কী ঘটনা ঘটতে পারে? পিতা থেকে H আর মাতা থেকে h, অথবা পিতা থেকে h আর মাতা থেকে H আসতে পারে।দুইটা সম্ভাবনা যোগ করলে 2Hh. বাকি দুটো, পিতা থেকে H আর মাতা থেকে H, অথবা পিতা থেকে h আর মাতা থেকে h.উল্টায় লিখলে যেই লাউ সেই কদু, H^2 আর h^2 ই থাকবে।

এবার অঙ্ক করি।একটা H আসার সম্ভাবনা কত ছিলো? ৫০% বা ০.৫।দুটো H একসাথে আসলে? H^2 বা ০.২৫বা ২৫%। একটা h আসার সম্ভাবনা ৫০% বা ০.৫। দুটো একসাথে আসলে ০.২৫ বা ২৫%। একইভাবে 2Hh= ০.৫ বা ৫০%।যোগ করলে? ১ বা ১০০%
মানে, ডারউইনগরের শতকরা ২৫ জন হোমোজাইগাস ডমিনেন্ট, শতকরা ৫০ জন হেটেরোজাইগাস আর শতকরা ২৫ জন হোমোজাইগাস রিসেসিভ।মানে, কালো চুল হবে শতকরা ৭৫ জনের,লাল চুল হবে শতকরা ২৫ জনের। যা আমাদের দেয়া তথ্যের সাথে মিলে যায়।
মানে, অঙ্ক ঠিক আছে।

কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করছেন?এখানে আমরা এলিল ফ্রিকোয়েন্সিকে ধ্রুবক ধরেছি, মানে তা চেঞ্জ হবেনা,যত প্রজন্মই যাক। আবার জিনোটাইপ এর হারকেও ধ্রুবক ধরেছি,যত প্রজন্মই যাক। যদি সামান্যতম চেঞ্জ হয়, তাহলে অঙ্ক মিলবে না। কিন্তু, জিনোটাইপ আর এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতো চেঞ্জ হওয়াটাই স্বাভাবিক, আর হবেই,এগুলো আজীবন ধ্রুব থাকা সম্ভব না। তাহলে এই অঙ্কের ভিত্তি কী?

আসলে, হার্ডি-ওয়েইনবার্গ ইকুইলিব্রিয়ামের কতগুলো শর্ত আছে। সে সকল শর্ত পূরণ না হলে বামপক্ষ আর ডানপক্ষ সমান হয়না।অনেকগুলো শর্ত, সবগুলোর মূলকথা একই, কোনোকিচ্ছু চেঞ্জ হতে পারবেনা, কোনোভাবেই না,সব ধ্রুব থাকবে,আর চেঞ্জ না হওয়া মানে বিবর্তন হবেনা।তাই, এই সমীকরণগুলোর বাস্তব উদাহরণ দেখা অসম্ভব।

তাইলে এই জিনিসখান কোন কামে লাগে?এইডা এক্কেবারে ফালতু হইয়া গেল না?

না,আসলে এই গণিতটাই প্রমাণ করে যে বিবর্তন হচ্ছে।দেখুন, আমরা ওপরে যেসব যুক্তি দিয়ে অঙ্ক করেছি, সবগুলো শতভাগ সত্য আর প্রমাণিত।মানে গাণিতিকভাবে আমরা সঠিক,শর্তগুলো পূরণ করলে উভয়পক্ষ সমান হবে, মানে বিবর্তন হবেনা। কিন্তু বাস্তবে এগুলো সত্য হওয়ার জন্য শর্তগুলো কোনোদিন পূরণ হয়না, জিনোটাইপে আর এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে চেঞ্জ সর্বদাই হয়।মানে, উভয়পক্ষ সমান না।
মানে বিবর্তন হচ্ছে,Congrats!



কুদ্দুসের চাকরি ও সিলেকশন

কুদ্দুসের বয়স এখন ২৫ বছর। ইনকামের বয়স, পরিবারের হাল ওকে ধরতে হবে। রাস্তায় রাস্তায় চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু, ওর উল্টা-পাল্টা স্বভাবের জন্য কেউ ওকে চাকরি দেয়না। সেদিন,
চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেল, রুমে ঢুকতেই বলে উঠলো,
" আম্মেগো টয়লেটের বাত্তি জ্বলে না ক্যা? আন্ধারে ক্যাম্নে কাম সাড়েন?"
–"গেট আউট"
এভাবেই, কুদ্দুস চাকরি পায়না।
চাকরি না পেয়ে ও শেষমেষ অনুপ্রেরণা নিলো স্বাস্থ্যের ডিজির গাড়ির ড্রাইভারের থেকে। এখন ও চেষ্টায় আছে কোনো হত্তা-কর্তার চাকর-বাকর হওয়ার।
ও নিজের ধান্ধায় থাক, আমরা বিজ্ঞানটা বুঝে আসি।

কুদ্দুস চাকরি পাবেনা।ফলে? গার্লফ্রেন্ডের বাবা রিজেক্ট করে দেবে।ফলে? কুদ্দুসের বংশ শেষ। ফলে?কুদ্দুসের বৈশিষ্ট্যগুলো ওর কারো মাঝে ট্রান্সফার হবেনা।ফলে? বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে যাবে।
মানে,কুদ্দুসের যেসব বৈশিষ্ট্য সমাজে টিকে থাকার জন্য প্রতিকূল, যেই বৈশিষ্ট্যগুলো ওকে চাকরি পেতে বাধা দিয়েছে,সেগুলো হারিয়ে যাবে। এভাবে ঘটে সিলেকশন বা নির্বাচন। কোন ট্রেইটগুলো থাকবে, আর কোনগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তার নির্বাচন। এখানে কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো ব্যাক্তি বা বস্তু এই নির্বাচন করেনি, সমগ্র ব্যবস্থাটা মিলে একটা এমার্জেন্ট কোয়ালিটি হিসেবে নির্বাচকের মতো আচরণ করেছে। একই বৈশিষ্ট্য একরকম পরিবেশে অনুকূল, আরেকরকম পরিবেশে প্রতিকূল হতে পারে। পরিবেশ নিজের সাপেক্ষে কোন ট্রেইট গুলো টিকবে, তা নির্বাচন করে দেয়। একই ঘটনা যদি প্রকৃতিতে ঘটে, আর একটা সাধারণ প্রজাতি থেকে আলাদা প্রজাতির উৎপত্তি ঘটায়,তাহলে তাকে আমরা বলবো ন্যাচারাল সিলেকশন,প্রাকৃতিক নির্বাচন।

মহামতি ডারউইন, ভ্রমণ করতে করতে পৌছালেন গ্যালাপ্যাগাস আইল্যান্ডে।১৮ টা দ্বীপের সমষ্টি গ্যালাপ্যাগাস যেন এক জীবন্ত বিবর্তনের সাক্ষী! ডারউইন দেখলেন বিভিন্ন রকমের প্রাণীদের।
১৮ টা দ্বীপে একটার পরিবেশ অন্যটা থেকে সামান্য আলাদা, আর, প্রত্যেক দ্বীপে বসবাসকারী একই প্রজাতির প্রাণী সেই সামান্যতম পার্থক্যের সাথে মানিয়ে নেয়ার মতো করে আলাদা আলাদাভাবে তৈরি। যেমন- কচ্ছপের কথা বলি।
গ্যালাপ্যাগাসের বড় দ্বীপগুলোতে ঘাস বেশি হয়।সেখানে কচ্ছপরা বড়,ভারী,তাদের শেল গম্বুজাকৃতির।
ছোট দ্বীপগুলোতে ঘাস কম হয়। ফলে, সেখানে কচ্ছপরা বাধ্য হয়ে ক্যাক্টাস খায়। ভালো ক্যাক্টাসগুলো থাকে গাছের ওপরে।আর, সেখানে কচ্ছপদের সামনের পা লম্বা, গলা লম্বা, আর শেলের সাম্নের দিকটা একটু উঁচু ও খোলা! মানে এক্কেবারে পরিবেশের সাথে খাপে খাপ মেলানো!
ডারউইন দেখলেন ফিঞ্চ পাখিদেরকে। যেসব পাখি পোকা খায়, তাদের চঞ্চু লম্বা, মাটির ভেতরে থেকে পোকা বের করার জন্য উপযুক্ত। আবার, যারা শস্যদানা খায়, তাদের চঞ্চু মোটা, শস্যদানা ভাঙার জন্য। এভাবে,একই ফিঞ্চ পাখির ১৪ টা প্রজাতির ১৪ রকমের বৈশিষ্ট্য, ১৪ রকমের পরিবেশের জন্য উপযুক্ত।
ডারউইন "হা" করে রইলেন! "ক্যাম্নে সম্ভব?"
এক্কেবারে র‍্যান্ডমলিতো এত খাপে-খাপ মিলে যাওয়া প্রাণীর আবির্ভাব অসম্ভব।
এজন্যই প্রাচীন গ্রীসে অনেক দার্শনিকরা বিবর্তনকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আসলেই, এক্কেবারে র‍্যান্ডমলি মিউটেশন মাধ্যমে পরিবেশের সামান্যতম প্রতিকূলতার সাথে মানিয়ে নেয়ার মতো বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব কীভাবে ঘটে? ডারউইন ভাবতে থাকলেন।
ওনার মাথায় বাত্তি জ্বলে উঠলো, কৃষকদের সিলেক্টিভ ব্রিডিং!



কুদ্দুসের দাদা ও ব্রিডিং

ডারউইনের মাথায় ব্রিডিং এর বাত্তি জ্বলতেই সবটা তার কাছে বুড়িগঙ্গার পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। তাই, আমাদের এখন ব্রিডিং জিনিসটা বোঝা দরকার।

কুদ্দুসের দাদা, কৃষক ছিলেন। নাম শক্কর আলি। একদিন তার ইচ্ছা হলো আমের বাগান করবেন। বেশ ভালো জিনিস, খাইতে খুব ট্যাশ।
তাই,১০ টা চারা কিনে এনে লাগালেন। গ্রীষ্মকালে আম হলো, দেখলেন যে ১ টা গাছের আম ইয়া বড় বড়। বাকি নয়টা গাছের আম নর্মাল। শক্কর আলি চালাক মানুষ। ওই গাছের থেকে যত আম হলো, প্রত্যেকটার আটি বুনলেন, বাকিগুলো ফেলে দিলেন।
পরের বছর আবার আম হলো। এইবার, সব গাছের আম ইয়া বড় বড়। কিন্তু একটা গাছের আম মধুর মতো মিষ্টি। হাত ধোয়ার পরেও ঘ্রাণ যায়না, খাওয়ার ৩-৪ দিন পরেও জিহ্বায় মিষ্টি ভাব থাকে। শক্কর আলি এই গাছের সব আটি বুনলেন, বাকিগুলো ফেলে দিলেন।
পরের বছর আবার আম হলো,এইবার সব আম ইয়া বড় বড় আর সেই রকমের মিষ্টি। কিন্তু, একটা গাছের আমে রোগ-বালাই কম হয়। এইটা রাখলেন,বাকিগুলো ফেললেন।পরের বছর, আমগুলো বড়,মিষ্টি,রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।

কুদ্দুসের দাদা এই আমের নাম দিলেন "শক্করাম"। কুদ্দুসের দাদা আম বিক্রি করে এখন গ্রামের সবচেয়ে পয়সা-ওয়ালা লোক।
এইবার যদি আমরা ৩ বছর আগের আম আর ৩ বছর পরের আমের তুলনা করি, উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখতে পারবো। এইভাবে যদি আরো কয়েক প্রজন্ম পার হয়? এইভাবে করতে করতে ১০,২০,৫০,১০০ বছর পর দেখা যাবে, দেখে বোঝাই যায় না যে বর্তমানের আমটা ওই ১০০ বছর আগের আমেরই বংশধর।
এমন সময় একদল মুরুব্বি এসে শক্কর আলিকে বলবে,
"মিছা কথা কন ক্যা মিয়া? ওই আম থিকা এই শক্করাম হইতেই পারেনা। বান্দরের বাচ্চা কী মানুষ হয় কোনোদিন? আচ্ছা,মানলাম ওই আম থিকাই শক্করাম আইছে। তাইলে এহনো ওই আমগাছ রইছে কেম্নে? সব আম শক্করাম হইয়া যাইতোনা?"
এনাদের বংশধররাই এখন বলে,
"বানর থেকে মানুষ আসলে এখনো বানর আছে কীভাবে?"
(বানর থেকে মানুষ আসেনি)
যাই হোক, কুদ্দুসের দাদা নতুন আমের প্রজাতি সৃষ্টি করলেন। এভাবে হয় ব্রিডিং।

র‍্যান্ডম মিউটেশনের ফলে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব ঘটে।এরপর কৃষক নির্ধারণ করেন যে কোন বৈশিষ্ট্য লাভজনক, সেটাকে পালন-পোষণ করে পরবর্তী প্রজন্মে নিয়ে যান। আবার একই ঘটনা ঘটে।এভাবে করতে করতে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়,যাদের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা।

এখন একদল মহাজ্ঞানী চিল্লায় উঠবেন,
"প্রমাণ কই?"
দিচ্ছি।
বর্তমানে আমরা যে ব্রকলি,ফুলকপি,বাধাকপি খাই, এরা প্রকৃতিতে ছিলোনা। এরা সবাই Brassica oleracea প্রজাতিরর এক প্রকার জংলি গাছের ব্রিডিং এর ফল। বর্তমানেও এরা আছে, একে wild mustard বলা হয়।

তারপর এত ধরনের কুকুর, এরাও প্রকৃতিতে ছিলোনা। এরা সব নেকড়ের বংশধর। আদিম মানুষেরা ধীরে ধীরে নেকড়েদের পোষ মানিয়ে কুকুর প্রজাতির সৃষ্টি করেছে। তাদের মধ্যে কেউ বড় কুকুর, কেউ মোটা কুকুর, কেউ ছোট কুকুর, কেউ লোমশ কুকুর পছন্দ করে, পছন্দ অনুযায়ী বাছাই করতে করতে এত ধরনের কুকুরের আবির্ভাব। Gray wolf কে বলা হয় সব কুকুরের কমন এন্সেস্টর।

এমনকি বর্তমানেও প্রতিনিয়ত ব্রিডিং হচ্ছে।তবে কৃষকদের দ্বারা না, বিজ্ঞানী আর গবেষকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ব্রিডিং হয়। নাইলোটিকা মাছ, হরি ধান, ব্রাহমা গরু, বয়লার মুরগি, এরা সবাই একপ্রকার ব্রিডিং এর ফল।IRRI নামের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণার সংস্থা এখনো ধানের ব্রিডিং ঘটায়, বাংলাদেশেও ধানের ব্রিডিং হয়। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে ব্রিডিং এর।

প্রকৃতিতেও এই ব্রিডিংই হয়। কোন বৈশিষ্ট্য টিকে যাবে, আর কোনটা বাদ যাবে, প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়।
আচ্ছা,ব্রিডিং না হয় বুঝলাম।কিন্তু, এখানেতো নির্বাচক হিসেবে মানুষ আছে। মানুষের চেতনা আছে, সে বুঝতে পারে যে তার কোনটা দরকার।কিন্তু প্রকৃতিরতো জ্ঞান-বুদ্ধি কিছুই নাই, সে কীভাবে ব্রিডিং করে? তার দরকারই বা কী ব্রিডিং করার?


প্রকৃতিতে ব্রিডিং

গতপর্বে ব্রিডিং কী জিনিস তা আমরা ভালো করে বুঝেছি। এবার সময় ন্যাচারাল সিলেকশন বোঝার। এই টপিকটা বিবর্তন তত্ত্বের অন্যতম একটা ভিত্তি, আর দুঃখের বিষয়, এটা নিয়েই অনেক সূক্ষ্ম ভুল ধারণা আছে সবার মাঝে। তাই আমরা চেষ্টা করবো খুটে খুটে বোঝার।

মহামতি ডারউইন গ্যালাপ্যাগোসে ফিঞ্চদের হরেক রকম প্রজাতির উৎপত্তির চিন্তা করতে করতে তার মাথায় উদয় হলো "ব্রিডিং", সাথে সাথে সব তার কাছে একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। আমরা প্রবেশ করবো ডারউইনের চিন্তার জগতে!

অমাবশ্যার রাত, প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ঝড়ো বাতাসে বড় বড় গাছ গুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। এমন সময়, একদল ফিঞ্চ পাখি উড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ, প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটা এল,বাতাসের টানে তারা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উড়ে গ্যালাপ্যাগোসে চলে আসলো। বাস!
সকালে উঠে তারা দেখলো এ যেন "ফিঞ্চদের স্বর্গ"। খাবারের অভাব নেই, কোনো শিকারী নেই, গাছ-পালা ভরা এক Finch-Heaven এই গ্যালাপ্যাগোস। এখন ফিঞ্চ পাখিরা খালি খায়,ঘুমায় আর ইচ্ছামতো বংশবিস্তার করে।দিন যেতে লাগলো, গ্যালাপ্যাগোসের আকাশ ভরে গেল ফিঞ্চ পাখি দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই ভোক্তা বাড়তে থাকলে আর উৎপাদনের হার ধ্রুব থাকলে খাদ্যসংকট দেখা দেবে। ঠিক সেটাই হলো।

এখন, ওদের নিজেদের মাঝে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি মারামারি লেগে গেল। যারা সাইজে বড়, শক্তি বেশি,দামড়া টাইপের, তারা এক প্রকার জিতে গেল।আর দুর্বলরা খাবারে ভাগ না বসাতে পেরে মারা গেল। কিন্তু তাও সমস্যার সমাধান হলোনা, খাদ্যাভাব রয়েই গেল।
এখানে ঢুকে যাবে র‍্যান্ডম মিউটেশন। র‍্যান্ডম মিউটেশনের ফলে ওই ফিঞ্চদের দলের কয়েকটা পাখির চঞ্চু ছিল একটুখানি লম্বা, আর কয়েকটা পাখির চঞ্চু ছিল একটুখানি মোটা। এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক! ক্লাসে ৬০ জন ছেলে-মেয়ে থাকলে দেখা যাবে ২০ জন বেশি লম্বা, ১০ জন বেশি খাট, ৩০ জন মাঝারি। আর এখানেতো ফিঞ্চ ছিলো হাজারে-হাজারে।তাই, এক্কেবারে র‍্যান্ডমলি যে কয়েকজনের চঞ্চু লম্বা আর কয়েকজনের মোটা হওয়া অসম্ভব, তা বলাটা পাগলের প্রলাপ।
আবার এমন মনে করেন না যে অর্ধেকের মোটা আর অর্ধেকের লম্বা ছিলো, "কিছু কিছু পাখির"। হরেক রকম ভ্যারাইটিও ছিলো, কারো চ্যাপ্টা, কারো ছোট, কারো বাঁকা ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু, সুবিধা পেয়ে গেল মোটা আর লম্বা চঞ্চুর পাখিরা।তারা আবিষ্কার করলো যে তাদের মারামারির দরকার নাই। মোটা চঞ্চুর ফিঞ্চরা শস্যদানা ভেঙে খেতে পারে বেশ ভালো করে, আর লম্বা চঞ্চুর ফিঞ্চরা মাটি থেকে পোকা-মাকড় তুলে খেতে পারে বেশ ভালো করে। এবং এর বিপরীতটাও সত্য, মোটা চঞ্চুর ফিঞ্চদের পোকা খেতে অসুবিধা হবে,আর লম্বা চঞ্চুর ফিঞ্চদের শস্য খেতে অসুবিধা হবে। এভাবে, তারা একপ্রকার অঘোষিত সমঝোতায় চলে আসল।খাবারের সুষম বণ্টন হলো, আর এই দুই বিশেষ র‍্যান্ডম ট্রেইটের পাখিরা অন্যদের থেকে বেশি টিকে গেল।

এবার, কুদ্দুস মুন্সীগঞ্জ থাকে।শহরের বাইরে যায় না বেশি। স্বাভাবিকভাবেই মুন্সীগঞ্জের কোনো মেয়েই ওর গার্লফ্রেন্ড হবে। কিন্তু কুদ্দুস বেকার বলে চৌধুরী সাহেব নিজের মেয়েকে কুদ্দুসের কাছে দেননি। থাক, ওর দুঃখের কথা না বলি!

একইভাবে, লম্বা চঞ্চুর ফিঞ্চরা বেশিরভাগ সময় একসাথে থাকে।কারণ, খাবারের জন্য তারা একই জায়গায় যায়, একই সাথে খায়। ফলে,তাদের গ্রুপ অন্যদের থেকে একটু আলাদা হয়ে গেল। ফলে,তাদের নিজেদের মধ্যে বংশবিস্তার করার প্রবণতা আর সম্ভাবনা বেড়ে গেল।একই ঘটনা ঘটলো মোটা চঞ্চুর ফিঞ্চদের ক্ষেত্রেও।
যখন তারা নিজেদের মধ্যেই বংশবিস্তার করলো, তখন মোটা চঞ্চুর ফিঞ্চদের সন্তানের মোটা চঞ্চু, আর লম্বাদের লম্বা চঞ্চু হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গেল। কারণ ব্যাখ্যা করলাম না, পানেট স্কয়ার নিয়ে আগে কথা বলেছিলাম। পিতা-মাতা উভয়েরই একই ট্রেইট থাকলে সন্তানের মধ্যে সেই ফিনোটাইপ প্রকাশের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

মানে, সার্বিকভাবে লম্বা চঞ্চুদের সন্তান লম্বা চঞ্চু আর মোটা চঞ্চুদের সন্তান মোটা চঞ্চুই হতে থাকলো।আর, এখানে শুধু চঞ্চুই যে গুরুত্বপূর্ণ তা না। যারা পোকা খাবে, তাদের পুষ্টিমান আর যারা শস্য খাবে তাদের পুষ্টিমান আলাদা হবে, তাদের থাকা-খাওয়া যাবতীয় সবই ধীরে ধীরে আলাদা হবে। এভাবে কয়েক হাজার প্রজন্ম পাড় হওয়ার পর তাদের মাঝে বৈশিষ্ট্যের এতটাই পার্থক্য দেখা দেবে যে তারা সম্পূর্ণ আলাদা দুটি প্রজাতি হয়ে যাবে।মানে তাদের নিজেদের মধ্যে উৎপাদিত সন্তান প্রজননক্ষম হবে না।

ফিঞ্চ-কথন এখানেই শেষ। ফিঞ্চদের এই ঘটনায় প্রকৃতি তাদের মধ্যে আলাদা প্রজাতি সৃষ্টি করেছে।
কীভাবে? ব্রিডিং করে। কাদের? মোটা চঞ্চু আর লম্বা চঞ্চুর পাখিদের। কীভাবে? খাদ্যাভাবের মাধ্যমে। কেন? এই "কেন" প্রশ্নটা এক্কেবারে ফালতু। আসলেই যদি আমরা ঘটনাটা অনুধাবন করে থাকি, তাহলে বুঝতে পেরেছি যে এখানে যা ঘটেছে তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই এখানে কারো কোনো উদ্দেশ্য নেই। সমগ্র ব্যবস্থা আর ফলাফল দেখে মনে হয় যে এখানে সিলেকশন ঘটেছে, আর তাকেই আমরা বলি ন্যাচারাল সিলেকশন।

আর এখানে আমি শুধু একটা বৈশিষ্ট্য,চঞ্চু নিয়ে কথা বলেছি, তাও মাত্র ২ ধরনের চঞ্চু। তাই মনে হতে পারে যে মাত্র একটা বৈশিষ্ট্যের কারণে একদম আলাদা, আস্ত দুইখান প্রজাতি সৃষ্টি হবে? না। ফিঞ্চদের ১৪ রকমের প্রজাতি আছে, তাদের মধ্যে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে কয়েকশ।এসকল বৈশিষ্ট্যই তাদেরকে আপন পরিবেশের সাপেক্ষে অন্যদের তুলনায় বেশি সুবিধা দিয়েছে। ফলে, এই ট্রেইটধারীরা টিকে গিয়েছে, বাকিরা হারিয়ে গিয়েছে।সবগুলো নিয়ে বলা সম্ভব না।

আর, এত্ত কাণ্ডকারখানা কিন্তু কয়েকবছরে হয়নি।কয়েক হাজার প্রজন্মের পর প্রজাতি আলাদা হয়েছে। ফিঞ্চদের এক প্রজন্মের আয়ু ৭-১১ বছর। মাত্র ১০০০ প্রজন্ম ধরলেও সর্বোচ্চ ৭-৮ হাজার বছর সময় আছে আমাদের হাতে।আর ফিঞ্চরা বছরে ৪-৫ টা সন্তান উৎপাদন করে। ৭ বছরে ধরলাম প্রায় ২০ টা। ফিঞ্চ আছে কয়েক হাজার, সময় আছে ৭-৮ হাজার বছর।এবার ভাবুন এত বিশাল সময়ে,এত বিশাল জনসংখ্যায় র‍্যান্ডম মিউটেশনের লীলা কত আজব পর্যায়ে যেতে পারে! আর তাতে ন্যাচারাল সিলেকশন ক্রিয়া করলে কত কী ঘটতে পারে!
Nature is amazing!


Writer: Tahsin Ahmed Omi



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম