এমেনসালিজম
এতদিন সিম্বায়োসিসের মাধ্যমে শুধু ভালো ভালো জিনিস হয়েছে, একে অন্যের উপকার করেছে, নিজের ফিটনেস বাড়িয়েছে, ভালো সম্পর্ক স্থাপন করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সবসময় যে ভালো হবে এমন কথা নেই। আজকের পর্ব এমনই একটি সিম্বায়োটিক রিলেশন নিয়ে, যার নাম এমেনসালিজম।কমেনসালিজমের বিপরীত।
কমেনসালিজমে একজনের কিছুই হয়না, কিন্তু আরেকজনের উপকার হয়। আর এমেনসালিজমেও একজনের কিছুই হয়না, কিন্তু আরেকজনের ক্ষতি হয়, মারাও যেতে পারে। এখানে আরেকটু সূক্ষ্ম হওয়া প্রয়োজন, একজনের প্রভাবে বা কাজে আরেকজন মারা যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর আরেকজনের দ্বারা সেই একজন প্রভাবিত হয়না।
এমেনসালিজমকে ভাগ করা হয় দুই ভাগে। কম্পিটিশন আর এন্টিবায়োসিস ।
আগে কথা বলি কম্পিটিশন নিয়ে। এখানে সামগ্রিকভাবে বৃহত্তর ( হতে পারে আকারে, শক্তিতে ইত্যাদি ) একটা জীব তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর জীবের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সাধারণত বড়টার কারণে ছোটটা বিভিন্ন রিসোর্স থেকে বঞ্চিত হয়,খাদ্য, আবাসস্থল ইত্যাদির মতো রিসোর্স থেকে। এখানে লক্ষণীয় যে, বড়টা কিন্তু অতিরিক্ত রিসোর্স পায়না , মানে আলাদা করে কোনো সুবিধা পায়না। সে স্বাভাবিকই থাকে। কিন্তু তার নিতান্ত উপস্থিতি, তার এই নিছক স্বাভাবিক জীবন-যাপনই ছোট জীবটার ক্ষতি করে। একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে আরো, এই ধরুন কুদ্দুস নিজের জমির সীমানা বরাবর কতগুলো বড় বড় গাছের চারা বুনলো। আর হোসুইনও শখ করে একটা ছোট-খাট বাগানের মতো করলো কিউট কিউট ছোট ছোট গাছ নিয়ে। দেখা গেল যে কুদ্দুসের গাছগুলো এত বড় হয়েছে যে হোসুইনের জমিতে সূর্যের আলো মাটি ছোয় না। কুদ্দুসের গাছের ছায়ায় হোসুইনের বাগান অন্ধকার। আবার কুদ্দুসের গাছ বড় বলে মাটি থেকে সব পুষ্টিও টেনে নেয়। ফলে হোসুইনের গাছগুলো দিন দিন শুকাতে শুকাতে বিভৎস রূপ ধারণ করলো। এখানে কুদ্দুসের গাছ কী অতিরিক্ত কিছু পেয়েছে ? না। কুদ্দুসের গাছ তার স্বাভাবিক কাজকর্মই করেছে, কিন্তু তাতেই হোসুইনের গাছের হাল বেহাল, এখানে হয়েছে কম্পিটিশন। (আসলে সম্পর্কটা ঠিক প্রতিযোগিতার মতো না, কিন্তু তাও নাম কম্পিটিশন)
এবার এভাবে চলতে চলতে কী হবে ? হোসুইনের গাছ একদিন মারা যাবে। ফলে সেই গাছ মাটিতে ডিকম্পোজ হতে শুরু করবে, আর ডিকম্পোজ হওয়ার পর নিশ্চই মাটিতে পুষ্টি উপাদান ত্যাগ করবে। এই পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে কুদ্দুসের গাছ। মনে হতে পারে যে এখানেতো কুদ্দুদের গাছের উপকার হয়েছে; আসলে না, উপকার হয়েও হয়নি ঠিক।ছোট গাছগুলো উপকার করতে মারা যায়নি বা কুদ্দুসের গাছও উপকার নিতে মেরে ফেলেনি। যা হয়েছে পুরোটাই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এই ঘটনা ঘটাকালীন হোসুইনের গাছগুলোর ক্ষতি হয়ে গিয়েছে আপনা আপনিই, তারা রিসোর্স থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এটাই কম্পিটিশন।
আরেকটা বাস্তব উদাহরণ দেয়া যায়। স্প্যানিশ ওয়াইল্ড গোট বা বন্য ছাগল আর উইভিল নামের এক প্রকার Beetle এর সম্পর্ককে। এরা উভয়ে একই ধরনের ঘাস-লতাপাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। যেখানে এই উইভিল আর বন্য ছাগলরা একসাথে থাকে, সেখানে ছাগলরাই সব খাদ্য খেয়ে ফেলে, উইভিলদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা বলা যায়।ফলে ছাগলদের অতিরিক্ত কোনো বেনিফিট হয়না, কিন্তু উইভিলদের রিসোর্সের অভাব দেখা দেয়। আবার অনেকসময় ঘাসের সাথে লেগে থাকা উইভিলও ছাগলের পেটে গিয়ে হজম হয়ে যায়, ফলে এখানেও মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে, তবে তাতেও ছাগলের কোনো উপকার হয়না। তাই, এটা কম্পিটিশন।
আরেকটা সবচেয়ে পরিচিত আর দৈনন্দিন উদাহরণ দেবো? আপনি যখন সবুজ মাঠের ওপর ফুটবল খেলেন, তখন মাঠের ঘাসের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু আপনার কিছুই হয়না।
এবার,এন্টিবায়োসিস।এন্টিবায়োসিসে একটা জীবের রাসায়নিক ক্রিয়ার কারণে অপর একটা জীব মারা যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পেনিসিলিয়াম ছত্রাক পেনিসিলিন নামক রাসায়নিক উৎপন্ন করে, যা এন্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে। এখানে পেনিসিলিয়ামের লাভ-ক্ষতি কিছুই নেই। কিন্তু তার রাসায়নিক ক্রিয়ায় বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়র ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাচ্ছে।
আবার, ব্লাক ওয়ালনাট , যাকে বাংলায় আখরোট বলা হয়, এই গাছরা জুগলোন নামের এক বিশেষ রাসায়নিক নিঃসরণ করে মূল থেকে, যা আশেপাশের গাছের বৃদ্ধি, প্রজনন ইত্যাদিতে বাধা দেয়। কখনো কখনো মেরেও ফেলে।
এন্টাগনিজম নামের আরেকটা সম্পর্ককেও এমেনসালিজমের উদাহরণে টেনে আনা হয়। এন্টাগনিজমের নানান ক্ষেত্রে নানান অর্থ আছে, তবে এমেনসালিজমের উদাহরণ হিসেবে ফাইটোপ্যাথলজির এন্টাগনিজমকে বোঝানো হয়। ফাইটোপ্যাথলজি হলো উদ্ভিদের রোগ-ব্যাধি নিয়ে গবেষণা, বিশেষ করে প্যাথোজেন(রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব)দ্বারা সৃষ্ট রোগ। এই প্লান্ট প্যাথোজেনদের স্বাভাবিক কাজকর্মে( যেটা উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর) অন্য কোনো অর্গানিজমের সাহায্যে ব্যাঘাত ঘটানোকে বলে এন্টাগনিজম। আর এই ঘটনাকে বলে বায়োকন্ট্রোল, মানে একটা জীব ব্যবহার করে উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর আরেকটা জীব কন্ট্রোল করা।যাকে ব্যবহার করা হয়, তাকে বলে বায়োলজিকাল কন্ট্রোল এজেন্ট। এক্ষেত্রে সেই ক্ষতিকর জীবের ক্ষতি হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। কিন্তু এজেন্টের কিছুই হচ্ছেনা, লাভ-ক্ষতি কিছুই না।
এমেনসালিজমের আরো অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। আপনি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যদি একটা পিপড়ার ওপর পা দিয়ে ফেলেন, সে মারা যাচ্ছে, আপনার কিছুই হচ্ছেনা।যাই হোক, কিন্তু এই এমেনসালিজমের বিবর্তন হয় কীভাবে? আসলে এর আলাদা করে বিবর্তিত হবার কোনো প্রয়োজনই নেই। একইসাথে যখন একটা শক্তিশালী আরেকটা দুর্বল জীব বাস করবে, এটাই স্বাভাবিক যে দুর্বলটা কোনো না কোনো ভাবে বঞ্চিত হবে। আর একজনের স্বাভাবিক ক্রিয়ায় আরেকজনের ক্ষতি হওয়া প্রকৃতিতে অত্যন্ত স্বাভাবিক।কিন্তু এমেনসালিজমের ফলে বিবর্তন ত্বরান্বিত হতে পারে। কারণ যে প্রজাতিটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার মধ্যে কোনো জীবের যদি এমন কোনো মিউটেশন হয়, যা তাকে তার প্রজাতির অন্যান্যদের থেকে কম ক্ষতিগ্রস্ত হতে সাহায্য করছে, তাহলে তার ফিটনেস বাড়বে, এই মিউটেশন পরের প্রজন্মে পাস হবে, একসময় পুরো প্রজাতিতে ফিক্স হবে, ফলে তারা বিবর্তনের দিকে একধাপ এগিয়ে যাবে।
এভাবে, একই স্থানে যদি দীর্ঘকাল ধরে দুইটি প্রজাতির মধ্যে এমেনসালিস্টিক সম্পর্ক বিরাজ করে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রজাতির মধ্যে বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক মিউটেশন ফিক্স হতে থাকবে, যা তাদের ভিন্ন প্রজাতিকরণের দিকে নিয়ে যাবে।
পরজীবীদের কথা
আজকে আমরা অনেক বিস্তৃত একটা টপিকে ঢুকবো, সেটা হলো প্যারাসাইটিজম। টপিকটা অনেক বিশাল, এ নিয়ে প্রচুর কথা বলা যায়, তবে আমি চেষ্টা করবো কম কথায় কাজ সারতে।
তো, শুরু করা যাক!
একেবারে সোজা ভাষায়, যেই সিম্বায়োটিক রিলেশনশিপে একজনের উপকার হয়, আরেকজনের ক্ষতি হয়, তাকে বলে প্যারাসাইটিজম। যার উপকার হয় , তাকে বলে প্যারাসাইট। যার ক্ষতি হয়, মানে যার থেকে উপকার নেয়া হয়, তাকে বলে হোস্ট।এই প্যারাসাইট হোস্টের সাথে, ওপরে, ভেতরে, বাইরে বাস করতে পারে।
প্যারাসাইট জিনিসটা নতুন কিছু না, সেই মান্ধাতের আমলেও লোকজন এদের সম্পর্কে ভালোই ধারণা রাখতো। হরেক রকম কৃমি, মশা, উঁকুন,ভাইরাস, নানান রকম ছত্রাক সহ বিভিন্ন ছোট-বড় প্রাণী প্যারাসাইট হয়। প্যারাসাইটরা তাদের হোস্ট থেকে ছোট হয়, হোস্টকে মেরেও ফেলে না (ব্যাতিক্রম হলো প্যারাসাইটয়েড, পরে আলোচনা করবো)। বড় বড় হোস্টের প্যারাসাইটরা খুবই স্পেশালাইজড, মানে এরা শুধু নির্দিষ্ট ধরনের পরিবেশে বাঁচে আর নির্দিষ্ট ধরনের জীবন-যাপন করে , এদের ডায়েটও নির্দিষ্ট ।এরা নতুন পরিবেশে মানাতে পারেনা।আবার কিছু প্যারাসাইট আছে জেনারেলিস্ট, মানে বিভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে আর বিভিন্ন হোস্টকে আক্রান্ত করতে পারে।সকল প্যারাসাইটদের প্রজননের গতি মারাত্মক দ্রুত, অন্তত তাদের হোস্টের সাপেক্ষে।
প্যারাসাইটরা নানারকম ফন্দি-ফিকির করে হোস্টের থেকে উপকার শুষে নেয় আর নিজের ফিটনেস বাড়িয়ে হোস্টের কমিয়ে দেয়।এরা আবার এক হোস্ট থেকে আরেক হোস্টে যেতে ইন্টারমিডিয়েট বা সেকেন্ডারী হোস্টের ওপর চড়ে বসতে পারে।অধিকাংশ প্যারাসাইট জীবিত হোস্টের ওপর থাকে, কিন্তু কিছু কিছু ছত্রাক এর ব্যতিক্রম, তারা হোস্টকে হত্যা করার পরেও তার ওপর থেকে যায় আর তার দেহ ভক্ষণ করে।প্যারাসাইটরা ডিজিজ ভেক্টর বা রোগ-জীবাণুর বাহন হিসেবে কাজ করে, আর এই কাজে তারা অনেকটাই দক্ষ।যেমন, মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু,ম্যাল্যারিয়া ছড়ায়।
প্যারাসাইটদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়।
অব্লিগেট প্যারাসাইট হলো তারা, যারা হোস্ট ছাড়া বাঁচতে পারেনা বা প্রজনন করতে পারেনা। জীবনের অন্তত একটা ধাপে হলেও এদের হোস্ট প্রয়োজন।যেসব প্যারাসাইট জীবদ্দশায় মাত্র একটা হোস্ট ধরে, তাদের জীবনচক্রকে বলে ডায়রেক্ট। আর যারা একাধিক ধরে, তাদেরটাকে বলে ইনডায়রেক্ট বা কমপ্লেক্স।এই ইনডায়রেক্ট জীবনের প্যারাসাইটরা তাদের প্রাইমারি বা ফাইনাল হোস্টের ওপরেই জীবনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় অতিবাহিত করে, তবে বিশেষ প্রয়োজনে কিছু সময় সেকেন্ডারি বা ইন্টারমিডিয়েট হোস্টের ওপর আশ্রয় নিতে পারে।
আবার কিছু প্যারাসাইট জীবনের একটা সময় প্যারাসাইটিক আচরণ করে, বাকি সময় করেনা, এদের বলে টেম্পোরারি প্যারাসাইট। আর যারা আজীবন প্যারাসাইট, তারা পার্মানেন্ট।
হোস্টের দেহের বাইরে বাস করলে তাকে বলে এক্টোপ্যারাসাইট,যেমন উঁকুন। আর ভেতরে বাস করলে বলে এন্ডোপ্যারাসাইট, যেমন কৃমি।এরা উভয়েই পার্মানেন্ট আর অব্লিগেট।
আর অব্লিগেটের বিপরীত হলো ফ্যাকাল্টেটিভ প্যারাসাইট, এরা অবলম্বন হিসেবে হোস্ট ধরে , কিন্তু এদের বেঁচে থাকার জন্য হোস্ট অত্যাবশ্যকীয় না।মানে হোস্ট ছাড়াও বাঁচতে পারে।
অব্লিগেট প্যারাসাইটের বিবর্তন কীভাবে হলো তা নিয়ে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত হলো,প্যারাসাইটের দ্বারা ছড়ানো প্রাণঘাতী কোনো রোগে হোস্টের মৃত্যু হলে হোস্টও মারা যায় আর প্যারাসাইটও আবাস হারায়।যেসব হোস্ট এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তাদের দেহে প্যারাসাইট রয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তারা রোগে মারা যায়নি। ফলে প্যারাসাইটেরও তাদের দেহ ত্যাগের প্রয়োজন হয়নি। তাই এটা হলো একটা বিশেষ ইকুইলিব্রিয়াম অবস্থা। হোস্ট মারাও যাচ্ছে না ,আবার প্যারাসাইট থেকে মুক্তও হচ্ছেনা।
এটা টিকে আছে কেন? হোস্ট কী প্যারাসাইটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারেনা?
অন্যভাবে ভাবুন, এতে হোস্টের ক্ষতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মৃত্যুর মতো সর্বনাশ হচ্ছেনা। মারা যাওয়া থেকে ক্ষতি হওয়া ভালো। তাই এটা টিকে আছে।
আবার আছে মেসোপ্যারাসাইট, এরা হোস্টের দেহের অল্পেক্টু অংশ কেটে নিজের দেহের কিছু অংশ সেখানে ঢুকিয়ে দিয়ে বাস করে।যেসব অতিক্ষুদ্র এন্ডোপ্যারাসাইটরা ডায়রেক্ট ,তাদের বলে মাইক্রোপ্যারাসাইট।আর যাদের সাইজ একটু বড় আর এক্টোপ্যারাসাইট,তাদের বলে ম্যাক্রোপ্যারাসাইট। আবার যাদের আচরণ প্যারাসাইটের মতো,তবে আবার পুরোপুরি আদর্শ প্যারাসাইটও না, তাদের বলে সেমিপ্যারাসাইট।
প্যারাসাইটদের সুবিশাল শ্রেণিবিভাগ মোটামুটি জানা শেষ।
প্যারাসাইটরা তাদের পোটেনশিয়াল হোস্ট খুঁজে বের করতে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিশেষ কিছু ইঙ্গিত বা চিহ্ন চিনে নেয়, যেগুলো সাধারণত হোস্টরা তাদের আচরণে প্রকাশ করে থাকে। যেমন- কম্পন, নিশ্বাস, উত্তাপ, আর্দ্রতা, গন্ধ ইত্যাদি। আবার প্যারাসাইটিক উদ্ভিদ আছে, তারা আলো, হোস্টের ফিজিওকেমিস্ট্রি ইত্যাদি চিনে নেয়। এইযে ইঙ্গিত বা চিহ্নগুলো, এদেরকে বলে হোস্ট কিউ (Host Cue)।
পরজীবীদের কথা(২)
গতপর্বে প্যারাসাইটদের নিয়ে কিছু বেসিক আলোচনা করেছিলাম। আজকে আমরা একটু গভীরে প্রবেশ করবো।
প্যারাসাইটরা তাদের হোস্টকে আক্রমণ করার জন্য নানা ধরনের ফন্দি করে, দেখা গেছে যে এই নানান ধরনের ফন্দি বা পদ্ধতিগুলোকে প্রধানত ছয় ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমেই আসে, Parasitic Castration. Castration মানে জননশক্তি নষ্ট করা ,যাকে খাটি বাংলায় “ খোজা করা “ বা “ খাসি করা “ বলা হয়। হ্যা, ঠিক ধারণাই করেছেন, এখানে প্যারাসাইটটা তার হোস্টকে খোজা করে দেয়।ফলে জননকার্যে যে শক্তি ব্যয় হও্য়ার কথা, তা হোস্টের অন্যান্য কাজে ব্যয় হয়।এতে হোস্টের ক্ষতি হয়েও অন্যান্য উপকার হয়,মানে তার দেহের আকার, শক্তি, টিকে থাকা ইত্যাদি বেড়ে যায়। আর তার ফলে প্যারাসাইটেরও স্থায়ীত্ব বেড়ে যায়।কিন্তু হোস্টের সামগ্রিক ফিটনেস মারাত্মক কমে যায়, কারণ সে বিবর্তনের প্রধান একটা ভিত্তি, প্রজনন করতে পারেনা।
অনেক সময় হোস্টের দেহ মাত্রাতিরিক্ত বড় হয়ে যায়, যাকে Gigantism বলে।
এই জননকার্য ধ্বংসের কাজ বিভিন্নভাবে হতে পারে, প্যারাসাইট অনেক সময় সরাসরি হোস্টের জননাংগের ওপর আহার করে, অনেক ক্ষেত্রে কিছু কেমিক্যাল নিঃসরণ করে যা প্রজননের বাধা দেয়, কখনো বা জননকার্যের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিজে শুষে নেয়, ফলে জননকার্য এমনিই বন্ধ হয়ে যায়।
জননকার্য সম্পর্কিত সরাসরি লিঙ্গের সাথে। তাই ,যখন জননকার্যে ব্যাঘাত ঘটে, তখন এই লিঙ্গেও সমস্যা দেখা দেয়। সেক্সুয়াল ডায়মর্ফিজম কমে যায়, আর অনেক সময় বিপরীত লিঙ্গের সেকেন্ডারী সেক্স ক্যার্যাক্টারিস্টিক্স নিজের দেহে ডেভেলপ হতে পারে।
সেকেন্ডারী সেক্স ক্যার্যাক্টারিস্টিক্স হলো সেসব সেক্সুয়াল ডায়মর্ফিজম, যা প্রজননে কাজে লাগেনা। মানুষের বয়ঃসন্ধিকালে আর বিভিন্ন প্রাণীর যৌন পরিপক্বতা এলে এই বৈশিষ্টগুলো প্রকাশিত হয়। যেমন-ময়ুরীর পেখম, সিংহের কেশর।
প্যারাসাইটিক কাস্ট্রেশনের শিকার হলে এক শ্রেণির পুরুষ কাকড়া তাদের প্রজাতির নারীদের মতো এসব সেকেন্ডারী সেক্স ক্যার্যাক্টারিস্টিক্স ডেভেলপ করে।
এরপর আসে ডায়রেক্টলি ট্রান্সমিটেড প্যারাসাইট। এদের ছড়ানোর জন্য কোনো ভেক্টর বা মাধ্যম প্রয়োজন হয়না। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো উকুন।তাছাড়া বিভিন্ন ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস আছে।
এই ডায়রেক্টলি ট্রান্সমিটেডদের একটা বিশেষ ঘটনা হলো এগ্রিগেটেড ডিস্ট্রিবিউশন, মানে পুঁজিত বিন্যাস।এসব প্যারাসাইটদের একটা নির্দিষ্ট হোস্ট প্রজাতি থাকে, মানে এরা স্পেশালাইজড। আর সেই হোস্ট প্রজাতির মধ্যে অধিকাংশ প্রাণীর দেহেই প্যারাসাইট সংখ্যা খুব কম, আর খুব কম প্রাণীর দেহে প্যারাসাইট সংখ্যা মারাত্মক বেশি। এইযে অসম বিন্যাস, মানে কম লোকদের বেশি প্যারাসাইট, এইটাকে বলে এগ্রিগেটেড ডিস্ট্রিবিউশন।
ট্রফিকালি ট্রান্সমিশন, মানে খাওয়ার মাধ্যমে ছড়ানো।এসব প্যারাসাইটদের জীবনচক্র অনেক জটিল, কারণ এরা দুই বা ততোধিক হোস্টের দেহে পরপর বাস করে।অনেকসময় এরা নিজেদের অপরিপক্বকালে সিস্ট গঠন করে (সিস্ট হলো এদের বিশ্রামের অবস্থা, সিস্ট গঠন করলে এদের সহজে মারা যায়না)। সিস্ট গঠনের ফলে এরা হোস্টের হজমক্রিয়ায় বেঁচে যায়, তারপর এরা হোস্টের দেহের ভেতর, অধিকাংশ সময় অন্ত্রে, বাসা বাধে, প্রজনন করে। আর হোস্টের বিহেভিয়র মোডিফিকেশন করে বা আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে( এ নিয়ে পরে লিখবো )। মানে হোস্টকে দিয়ে এমন আচরণ করায় যাতে সে শিকারির দ্বারা আকৃষ্ট হয় ও শিকার হয়, এতে সেই প্যারাসাইটটা আবার নতুন হোস্টের দেহে চলে যায়।এভাবে চলতে থাকে।
এরপর ভেক্টর ট্রান্সমিটেড প্যারাসাইট। এদের ছড়ানোর জন্য একটা থার্ড পার্টি বা ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট প্রয়োজন। তবে মূল কথা হলো, প্যারাসাইটরা সর্বদা তাদের ডেফিনিটইভ হোস্ট বা প্রধান হোস্টের ওপরের প্রজনন করবে, কখনোই ইন্টারমিডিয়েটের ওপর প্রজনন করেনা। মশা-মাছি-ইদুরের মতো প্রাণীদের দ্বারা ছড়ানো বিভিন্ন রোগ এর উদাহরণ হতে পারে।
এবার প্যারাসাইটয়েড, এরা নিজেদের হোস্টকে হত্যা করে ফেলে, ফলে এদের এই আচরণের সম্পর্ক প্রিডেশন বা শিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।এদেরকে দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে, ইডিওবায়োন্ট আর কয়নোবায়োন্ট।
ইডিওবায়োন্টরা তাদের হোস্টকে রাসায়নিক প্রয়োগের মাধ্যমে সরাসরি হত্যা বা প্যারালাইজ করে ফেলে, তারপর তার দেহ নিয়ে নিজের বাসায় যায় , সেখানে সেটা রেখে তার ওপর ডিম পাড়ে আর বাসাটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে রেখে যায়।ডিম থেকে লার্ভা বের হয়, আর সেই লার্ভা ওয়ি হোস্টের দেহ খেয়ে বেঁচে থাকে।তারপর বড় ও পরিপক্ব হওয়ার পর তারা ওয়ি বাসা থেকে বের হয়ে আসে। এখানে প্যারাসাইটটির প্রজনন ঠিকই হোস্টের ওপর ঘটছে আর জীবনের একটা সমও এরা প্যারাসাইটের ওপর নির্ভর করেই কাটাচ্ছে।
কয়নোবায়োন্টরা হোস্টের দেহের ভেতর ডিম পাড়ে বা ডিম পেড়ে তা হোস্টের দেহের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দেয়, ফলে দীর্ঘ সময় ধরে এই ডিম , ডীমের লার্ভা আর হোস্টের বৃদ্ধি একসাথে হয়। লার্ভা ধীরে ধীরে হোস্টের দেহের ভেতরের অংশ খেতে থাকে আর হোস্ট ধীরে ধীরে মারা যেতে থাকে। একসময় এই প্যারাসাইটয়েড লার্ভা হোস্টের ফাঁপা দেহ ছেড়ে পরিপক্ব হয়ে বেরিয়ে যায়।
সর্বশেষে, মাইক্রোপ্রিডেটর।এরা একাধিক হোস্টকে আক্রমণ করে, আর প্রত্যেক হোস্টের ফিটনেস অতি সামান্য পরিমাণে কমিয়ে দেয়। একবারে এরা একটা হোস্টকেই ধরে। অতি পরিচিত উদাহরণ হলো মশা। অধিকাংশ মাইক্রোপ্রিডেটররা রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে।
এই গেল প্যারাসাইটদের প্রধান ছয়টি আক্রমণের স্ট্রাট্যাজি। এছাড়াও এদের আচরণ, ছড়ানোর পদ্ধতিসহ অন্যান্য নিয়ামকের ওপর ভিত্তি করে এদেরকে আরো বেশ কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলো নিয়ে আগামী পর্বে আলোচনা করবো।
শেষে আরো দুইটি জিনিস মনে আসলো, সুপারপ্যারাসাইটিজম হলো একই হোস্ট যখন একাধিকবার একই প্রজাতির প্যারাসাইট দ্বারা আক্রান্ত হয়। আর কোইনফেকশন বা মাল্টিপ্যারাসাইটিজম হলো একই হোস্ট যখন একাধিক প্রজাতির প্যারাসাইট দ্বারা আক্রান্ত হয়।
পরজীবীদের কথা(৩)
পরজীবীদেরকে তাদের আচরণ, প্রকৃতি, স্বভাব ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে আরো কয়েকভাগে ভাগ করা হয়, আজ সেগুলো নিয়েই আলোচনা করবো।
প্রথমেই হাইপারপ্যারাসাইটিজম। প্যারাসাইটের প্যারাসাইটকে সহজ কথায় হাইপারপ্যারাসাইটিজম বলে।হাইপারপ্যারাসাইটরা তাদের হোস্ট , যে নিজেই কিনা প্যারাসাইট, তার ওপর বসবাস করে। মানে অনেকটা চোরের ওপর বাটপারি আরকি।হাইপারপ্যারাসাইটিজমের সর্বোচ্চ পাঁচটি পর্যন্ত স্তর আবিষ্কার হয়েছে, ছত্রাকের মধ্যে। মানে হোস্টের উপর প্যারাসাইট, তার ওপর প্যারাসাইট, তার ওপর প্যারাসাইট,তার ওপর প্যারাসাইট,আবার তারও ওপর প্যারাসাইট।
হাইপারপ্যারাসাইটরা তাদের হোস্টের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে।তাই কৃষিতে কীতপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর ব্যবহার আছে।
সোশ্যাল প্যারাসাইটিজম।এটা পুরোটাই প্রায় মিমিক্রির সাথে সম্পর্কিত, যা নিয়ে আমি এখনো কিছু লিখিনি, সামনে লিখবো। তাই মিমিক্রি নিয়ে কয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন। মিমিক্রিতে একটা প্রজাতির প্রাণী, যেকোনো সুবিধা পাও্যার জন্য আরেকটা প্রজাতির প্রাণিকে নকল করে, মানে তার আকার-আকৃতি, গঠন, রঙ ইত্যাদি নকল করে। উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে একে এগ্রেসিভ, প্রোটেক্টিভ ইত্যাদি ভাগ করা হয়। যাই হোক,য়াপাতত এতটুকু বুঝলেই হবে যে মিমিক্রি মানে অন্য কারো মতো ছদ্মবেশ ধরা।
সোশ্যাল প্যারাসাইটিজমে প্যারাসাইটরা বিভিন্ন সামাজিক প্রাণীদের ইন্টারস্পেসিফিক রিলেশনের সুযোগ নেয়।
সামাজিক প্রানী কারা? যারা সামাজিক গোত্র হিসেবে বেঁচে থাকে, যারা নিজের সমাজের প্রতি কোঅপারেটিভ আচরণ প্রদর্শন করে। যেমন- পিপড়া, বিভিন্ন মৌমাছি।
একধরনের প্রজাপতি আছে যারা লার্ভা অবস্থায় পিপড়াদের মিমিক্রি করে, তাই এই প্রজাপতিদের ডিম থেকে লার্ভা বের হলে সেগুলোকে পিপড়াদের অঞ্চলের রেখে আসে, আর সেগুলো দেখতে পিপড়াদের মতো হয়, মিমিক্রি করে, তাই পিপড়ারা সেগুলোকে নিজেদের প্রজাতির মনে করে পালন-পোষণ করে।কারণ তারা সামাজিক জীব। এতে সেই প্রজাপতির ঠিকই উপকার হচ্ছে, কিন্তু পিপড়া নিজের খাদ্য,বাসস্থান আর শক্তি ওই লার্ভার পিছনে ব্যয় করে নিজের ক্ষতি করছে। এভাবে সোশ্যাল প্যারাসাইটিজম হয়।
ব্রুড প্যারাসাইটিজম।Brood মানে শাবক বা সন্তান-সন্ততি। কাকের বাসায় কোকিল ডিম পাড়ে এ কথা কে না জানে? এইটাই ব্রুড প্যারাসাইটিজম। এই ঘটনাটা আরো অনেক প্রজাতির মধ্যে দেখা যায়। যার ডিম, সে হলো প্যারাসাইট, আর যার বাসায় ডিম পাড়ছে সে হোস্ট।এখানে প্যারাসাইটরা তাদের হোস্টের ডিমের মিমিক্রি করে, ফলে হোস্ট সেই ডিম চিনতে না পেরে তার পালন পোষণ করে যায়, এমনকি অনেকসময় বড় হয়ে গেলেও চিনতে পারেনা! কিন্তু মাঝে মাঝে যদি বুঝে ফেলে, তখন ডিমকে বাসা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, অথবা বাচ্চাকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলে। এজন্য কিছু প্রজাতির ব্রুড প্যারাসাইটরা শক্ত ডিমের খোলস ডেভেলপ করেছে, যাতে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমে যায়। এখানে হোস্ট বেচারা দীর্ঘদিন ধরে প্যারাসাইটের ডিমকে পালন-পোষণ করে বাসস্থান,খাদ্য,শক্তির দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর প্যারাসাইটের ঠিকই উপকার হচ্ছে।
ক্লেপ্টোপ্যারাসাইটিজম, প্যারাসাইট হোস্টের সংগ্রহ করা খাবার চুরি করে। তাই একে অনেকসময় প্যারাসাইটিজম বায় থেফট ও বলে। সাধারণত একই গণ বা জেনাসের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতিদের মধ্যে এটা বেশি দেখা যায়। নিজের প্রজাতির মধ্যেও সবসময়ই দেখা যায়।
সেক্সুয়াল প্যারাসাইটিজম, এখানে সাধারণত পুরুষটা ফ্যাকাল্টেটিভ প্যারাসাইট হিসেবে স্ত্রীদের দেহে লেগে থাকে। স্ত্রীটা পুরুষের থেকে অবিশ্বাস্য রকমের বড় হয়। পুরুষটা এখানে স্ত্রীকে বীর্য দিয়ে সন্তান উৎপাদনে সাহায্য ছাড়া আর কিছু করেনা। কিন্তু স্ত্রীটা নিজে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েও পুরুষের জীবন-যাপনের সবকিছুর ব্যবস্থা করে।
এডেলফোপ্যারাসাইটিজম। গ্রীক ভাষায় এডেলফোস শব্দের অর্থ ভাই। এখানে হোস্ট আর প্যারাসাইট খুবই নিকট সম্পর্কের হয়, একই গোত্র ও গণ বা ফ্যামিলি ও জেনাসের ।
এখানেই আমাদের প্যারাসাইটিজমের ভাগ-বিভাগ নিয়ে পড়া শেষ।
হোস্ট-প্যারাসাইট দীর্ঘদিন একত্রে থাকার ফলে তাদের মধ্যে কোইভোলুশন ঘটে। হোস্ট-প্যারাসাইট কোইভোলুশন নিয়ে অনেক কথা আছে, সেগুলো এখানে লিখবো না, কিছু সাধারণ আলোচনা করবো।
প্যারাসাইট কখন বেশি বেনিফিট পাবে? যখন তার হোস্ট বেনিফিট পাবে বা হোস্টের ফিটনেস বাড়বে, তখন। এজন্য মাঝে মাঝে দেখা যায় কী প্যারাসাইট ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দেয় ( বুঝাচ্ছি যে বিবর্তনের বিভিন্ন মেকানিজমের মাধ্যমে কমে যায়)।ফলে হোস্ট বেনিফিট পায়, আর পরোক্ষভাবে প্যারাসাইটও বেনিফিটই পায়। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে দেখা যায় যে ক্ষতির পরিমাণ কমতে কমতে ঋণাত্মক হয়ে যায়, মানে প্যারাসাইটটা এখন আর প্যারাসাইট নেই, তারা প্যারাসাইটিজম থেকে মিউচুয়ালিজমে বিবর্তিত হয়।
অনেকসময় হোস্টের মধ্যে প্যারাসাইটের ক্ষতি থেকে বাঁচার বিভিন্ন মেকানিজম বিবর্তিত হয়, মানে একপ্রকার মানিয়ে নেয়। আর এই মানিয়ে নেয়া যদি চরম মাত্রায় চলে যায়, তাহলে দেখা যায় যে প্যারাসাইট ছাড়া আর হোস্ট থাকতে পারছেনা।মানে ওই, মিউচুয়ালিজম গড়ে উঠেছে।
আবার প্যারাসাইটদের মাঝেও প্রতিযোগিতা হয়।হবেনা কেন? বিবর্তন মানেই এই, টিকে যাবার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় সেই প্যারাসাইটরা টিকে যায় যারা হোস্টের ক্ষতি করতে পারে বেশি, যারা প্রজনন করতে পারে বেশি আর দ্রুত।এখানে প্রধানত ন্যাচারাল সিলেকশন ক্রিয়া করে। তাই এর মাধ্যমে প্যারাসাইট প্রজাতি আরো ক্ষতিকর হয়ে বিবর্তিত হতে পারে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে হোস্ট আর প্যারাসাইট একইসাথে নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়। এই ঘটনাকে বলে কোস্পিসিয়েশন। অবাক হবার কিছু নেই, হওয়াটা একেবারেই স্বাভাবিক।হবে নাইবা কেন? প্যারাসাইট যদি ক্ষতির মাত্রা বাড়ায়, তাহলে হোস্টের মধ্যেও সেটা সহ্য করার মেকানিজম বিবর্তিত হবে। আবার হোস্ট যদি ক্ষতির হাত থেকে বাচার মেকানিজম আয়ত্ত করে, তাহলে প্যারাসাইটেও নতুন ক্ষতিকর ট্রেইট আসবে। এভাবে চলতে চলতে একে অন্যের ট্রেইট "কাটাকাটি" করবে,আর সাথে সাথে কোস্পিসিয়েশন হওয়া অসম্ভব না।
তাহলে, এভাবেই, প্যারাসাইটিজমের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাণীর বিবর্তন ঘটে থাকে।
অনুকরণের বিবর্তন
কুদ্দুস অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরতে গিয়েছে।
সমুদ্রের পাড়ে একটা হোটেলের বারান্দায় সুন্দর একটা বিকেলে বসে আছে।
হঠাৎ ও দেখলো যে বারান্দায় একটা চিকন গাছের ডাল নিজে নিজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়্গায় হেটে যাচ্ছে।ডালটা মোটামুটি ২০ সেন্টিমিটার বড়। কুদ্দুসের চক্ষু চড়ক গাছে! এ কেমন আজব গাছের ডাল , যে কিনা হাটতে পারে ? ও কিছুক্ষণ হা করে বসে ডালটা পর্যবেক্ষণ করলো। ততক্ষণে ডালটা অর্ধেক বারান্দা চক্কর দিয়ে ফেলেছে। কুদ্দুস এবার নিচে নেমে ডালটার দিকে ভালো করে খেয়াল করলো।
এবার ও দেখতে পেলো যে ডালের মাথায় দুটো চোখ, গায়ে ছয়টা পায়ের মতো অঙ্গ, আবার পেছন দিকটা লেজের মতো উঁচু। ও মোটামুটি নিশ্চিত হলো যে এটা ডাল না, একটা আস্ত প্রাণী, একটা পোকা। এই দেখতে দেখতে অদ্ভুত দেখতে পোকাটা বারান্দার কিনারা থেকে উড়াল দিলো! কুদ্দুস এইবার আরো বড় একটা হা করে আবার বসে পড়লো।
কুদ্দুস যেই পোকাটা দেখেছে সেটা হলো Margin Winged Stick Insect, অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়। এদের দূর থেকে দেখতে হুবহু ডালের মতো, কুদ্দুস যেমন দেখেছিলো। তাই এরা সহজে শিকারি পাখির চোখে ধরা পড়ে না। এরা শিকারি থেকে রক্ষা পেতে এই ডালের মতো দেখতে হওয়ার বিবর্তন ঘটিয়েছে। এইযে একটা জিনিসের অনুকরণ করার বিবর্তন, একে বলে “Mimicry”. এটাও এক প্রকারের সিম্বায়োসিস।
মিমিক্রিতে যে শুধু অজীব বা জড় পদার্থের মতো দেখতে হতে হবে এমন না। মিমিক্রিতে যেকোনো জীব বা জড়ের যেকোনো বৈষিষ্ট্যের অনুকরণ হতে পারে। হতে পারে আকার, রঙ, শব্দ, কাজ বা ইত্যাদি যেকোনো কিছু। যে অনুকরণ করে, তাকে বলা হয় “Mimic” আর যার অনুকরণ করা হয় তাকে বলে “Model”. কুদ্দুসের দেখা ওই পোকাটা হলো মিমিক, আর ওই পোকার মডেল হলো গাছের ডাল।
মিমিক্রিতে অনেকসময় মিমিক আর মডেল উভয়ের উপকার হতে পারে, তখন একে মিউচুয়ালিস্টিক সম্পর্কও বলা চলে, এমন হলে মিমিক আর মডেলকে একত্রে “Co-mimic” বলা হয়। আবার অনেক সময় মিমিক্রির ফলে একজনের অপকার হয়, আরেকজনের উপকার হয়, তখন এটা কিছুটা প্যারাসাইটিক সম্পর্কের মতো আচরণ করে।আবার অনেক সময় শুধু দুইটা না, দুই এর অধিক প্রজাতির প্রানী মিমিক্রিতে অংশ নেয়। মনে হতে পারে যে, মডেল মনে হয় মিমিকের চেয়ে বেশি উন্নত।আসলে সবসময় এমন হয় না, কারণ অনেক উন্নত প্রাণীও অনেকসময় তার চেয়ে নিম্নশ্রেণির প্রাণির বিশেষ কিছু বৈষিষ্ট্যের মিমিক্রি করতে পারে। দেখুন না, কুদ্দুসের দেখা পোকাটা শেষমেষ নির্জীব গাছের ডালকে মডেল বানিয়ে বসে আছে!
মডেল যদি নির্জীব বা জড় হয়, তাহলে একে মিমিক্রি না বলে “Masquerade” বলা হয়, এর অর্থও ছদ্মবেশ। আবার যখন কোনো মিমিক তার আশেপাশের পরিবেশের সাথে মিশে গিয়ে শিকারির চোখকে ফাঁকি দিতে যায়, মানে মিমিকের ব্যাকগ্রাউন্ডই যখন মডেল হয়, তখন একে বলে “Crypsis”. যাই হোক, এগুলো নিয়ে অত মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
প্রায় সব মিমিক্রির বিবর্তিত হওয়ার প্রসেস বেসিকালি একই, ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমে বিবর্তন।
প্রথমে মিমিকে এমন একটা মিউটেশন হবে, যাতে সে কিছুটা মডেলের মতো হবে। কিন্তু তার প্রজাতির বাকিরা স্বাভাবিক থাকবে। ফলে সে বাকিদের চেয়ে সামান্য বেশি বেনিফিট পাবে, বাকি দশ জন শিকার হলেও তার শিকার না হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, সে প্রজনন করবে, তার এই মিউটেশন সন্তানে পাস হবে। প্রত্যেক সন্তানের সাথে একই ঘটনা ঘটবে। যখন ওই প্রজাতির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জীবের মধ্যে মিউটেশনটা ছড়িয়ে যাবে, তখন দেখা যাবে যে এই মিউটেশনওয়ালা গ্রুপ বাকিদের চেয়ে ভালোই বেশি সুবিধা পাচ্ছে। তখন বাকিরা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকবে। এবার সবার মাঝে ওয়ি মিউটেশনটা আছে, এইবার আরেকটা মিউটেশন হবে যার ফলে মিমিক প্রজাতিকে আরেকটু মডেলের মতো দেখাবে।য়াবারও একই ঘটনা ঘটবে, এভাবে চলতে চলতে যখন মিমিক যথেষ্ট পরিমাণে অনুকরণ করে ফেলবে, মানে যখন তার মিমিক্রির উদ্দেশ্য মোটামুটি যথেষ্ট পরিমাণে হাসিল হবে, তখন আর অতিরিক্ত মিমিক্রির মিউটেশন ওই প্রজাতিতে ফিক্স হওয়ার প্রয়োজন নেই।
মিমিক কে যে হুবহু মডেলের মতো হতে হবে তেমন কথা নেই, উদ্দেশ্য হাসিলের মতো মোটামুটি হলেই হচ্ছে।
এখানে প্রক্রিয়াটাকে মারাত্মক ওভার-সিমপ্লিফাই করছি। এখানে কোন ধরনের জিনে মিউটেশন হবে, কীভাবে হবে, মিমিক্রি কত ধাপে হবে, ইত্যাদি নিয়ে অনেক ঝামেলাপূর্ণ আলোচনা আছে। তাই সেগুলো এভয়েড করলাম আপাতত।
মিমিক্রিকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মিমিকের উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে, মডেলের ধরনের ওপর ভিত্তি করে, মিমিক আর মডেলের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সেসব ভাগ-বিভাগ নিয়ে আলোচনা করবো পরের পর্বে। আপাতত এইটুকুই।
অনুকরণের বিবর্তন(২)
মিমিক্রি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যদি তা আত্মরক্ষার জন্য হয়, তাহলে তাকে বলবো ডিফেন্সিভ মিমিক্রি।
এখন, একটা ক্ষতিকর শিকারির থেকে আত্মরক্ষার জন্য মিমিকের মডেল কে হতে পারে? নিশ্চই কোনো “আতেল” প্রাণি হবে না, যাকে দেখে শিকারি আরো তেড়ে আসবে! মডেল হবে আরো ক্ষতিকর কোনো প্রাণি, যাকে দেখে শিকারির “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” স্মরণে আসবে।
তো, এই ডিফেন্সিভ মিমিক্রির কতগুলো প্রকারভেদ আছে, সেগুলো আলোচনা করবো।
প্রথমেই আসে Batesian mimicry. এখানে মিমিক তার মডেলের মতো দেখায় বা আচরণ করে,আর মডেল হলো এমন কোনো প্রাণি, যাকে শিকারি খেতে চায়না, কারণ খেলে তার ক্ষতি হবে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মিমিক শুধু মডেলের মতো দেখায়, কিন্তু মডেলের মতো সে শিকারির ক্ষতি করতে পারেনা।মানে “A sheep in wolf’s clothing” এর মতো ব্যাপার আরকি।
আসলে ঘটে কি,প্রথমে শিকারি মডেলকে খায় । ফলে কোনো না কোনো ক্ষতি হয়, খাবার পর বুঝতে পারে যে একে খাওয়া উচিত হয়নি, ফলে সে পরবর্তীবার শিকার করার সময় ওই মডেলকে এড়িয়ে চলে। এবার এই সুবিধা নেয় মিমিক।সেও মডেলের মতো সাজে, ফলে শিকারি দূর থেকে দেখলে তাকেও মডেল মনে করে এড়িয়ে চলে।
কিন্তু সমস্যা আছে, এই পদ্ধতি তখনই কাজে দেয়, যখন মডেলের সংখ্যা মিমিকের চেয়ে বেশি হয়। কারণ ভাবুন, যদি মিমিকের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়, তাহলে এই সম্ভাবনা বেড়ে যাবে যে শিকারি কোনো একদিন মিমিককে মডেল ভেবে খেয়ে ফেলবে। তখন কী হবে ? শিকারিতো মনে করবে যে সে মডেল প্রজাতিকে খেয়েছে, কিন্তু আসলেতো খেয়েছে মিমিককে। আর মিমিকতো শিকারির কোনো ক্ষতি করতে পারেনা, ওপরেই বলেছি। ফলে সেই শিকারি মনে করবে যে এই মডেল প্রজাতিতো ক্ষতিকর না! এতে মডেল আর মিমিক, উভয়েরই ক্ষতি হবে।মিমিকের ক্ষতি হবে বেশি।
তাই, প্রকৃতিতে যতক্ষণ মডেল বেশি আর মিমিক কম থাকে, ততক্ষণ এই মিমিক্রি ভালো কাজে দেয়।
এবার, Mullerian mimicry. এখানে, উভয় মিমিক আর মডেলের কমন একটা শিকারি থাকে, ব্যাটেশিয়ানের মতোই, কিন্তু উভয়েরই এমন কিছু ট্রেইট থাকে যা শিকারির জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু ব্যাটেশিয়ানে মিমিকের কোনো ক্ষতিকর ট্রেইট ছিলোনা। এবার, দেখা যায় কী মডেল আর মিমিক একে অন্যের সেইসব ট্রেইটের মিমিক্রি করে! তাই এখানে এদেরকে আর মডেল-মিমিক বলা হয়না, এদের বলে কো-মিমিক।
প্রথমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন না যে কেন এরা একে অন্যের মিমিক্রি করবে? উভয়েইতো ক্ষতিকর। তাহলে এই অতিরিক্ত মিমিক্রি হয়ে লাভ কী?
তারপর তাদের মাথায় এলো, যদি শিকারি ওই দুই কো-মিমিক প্রজাতির মধ্যে কনফিউজ হয়ে যায়, তাহলে এক প্রজাতির প্রাণিকে খাবার পরে সে ওই দুই প্রজাতির কাওকেই পরেরবার খেতে চাইবেনা।কারণ দুইজনই একই রকম দেখতে। এতে উভয় প্রজাতির সার্ভাইভাল রেট বেড়ে যায়। আর এজন্যই এর বিবর্তন হয়েছে। অনেক সুন্দর একটা ম্যাথমেটিকাল মডেলও আছে এর, যেটা সবারই বোধগম্য হওয়ার মতো সহজ, কিন্তু আপাতত ওটায় গেলাম না আর।
মুলেরিয়ান মিমিক্রিতে কিন্তু শিকারিরও উপকার হয়, কারণ এক প্রজাতিকে টেস্ট করেই সে দুইটা প্রজাতিকে এভয়েড করে চলবে। ফলে অপর প্রজাতিকে চিনতে এর আলাদা করে আরেকবার টেস্ট করা লাগেনা।ফলে ক্ষতিও একবারই হয়, দুইবারই হয়না। এতে সে ও বেনিফিট পায়।শিকারি দুইটা প্রজাতির কথা আর আলাদা করে স্মরণে রাখেনা, যেহেতু উভয়ে একই রকম দেখতে। তাই মানসিক শ্রমও কম হয়। এজন্য মুলেরিয়ান মিমিক্রি তিনটা প্রজাতির জন্যই মঙ্গলজনক।
এরপর আছে Emsleyan/Mertensian mimicry. এই মিমিক্রিটা একটু আজব, আলাদা আর বুঝতে কঠিন। কারণ, এখানে মিমিক তার মডেলের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। ওপরে বলেছিলাম যে একটা প্রাণি তার চেয়ে ক্ষতিকর কোনো প্রাণির মতো সাজতে পারলেই শিকারি তাকে এড়িয়ে চলবে। কিন্তু এখানে একটা বেশি ক্ষতিকর প্রাণি তার চেয়ে কম ক্ষতিকর কারো মিমিক্রি করে। কিন্তু এমন কেন হয়?
ধরুন, একটা প্রজাতি মারাত্মক ক্ষতিকর, এতই ক্ষতিকর যে শিকারি একে খাওয়া মাত্রই মারা যায়। যখন শিকারি তার শিকারকে খাওয়ার সাথে সাথে মারা যাচ্ছে, তখন সে আর ওই শিকারকে ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করার সময় পাচ্ছেনা। ফলে শিকারি প্রজাতির মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠছে না।কারন সে তো চেনারই সময় পাচ্ছেনা, ফলে বারবার আক্রমণ করছে, শিকার করার পর মরে যাচ্ছে।কেউই জানতে পারছে না যে অমুক প্রজাতি ক্ষতিকর, ওকে আক্রমণ করা যাবেনা। এতে কিন্তু শিকার প্রজাতিরই বেশি ক্ষতি হচ্ছে, কারণ সে বারবার শিকারে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু যদি শিকারি তাকে চেনার সুযোগ পেত, তবে বারবার আক্রমন করতোনা।
এজন্য সেই শিকার প্রজাতি কী করে ? তার চেয়ে কম ক্ষতিকর কোনো প্রজাতির মিমিক্রি করে। কারন কম ক্ষতিকর প্রজাতি শিকার হবার পরেও শিকারিকে মেরে ফেলে না, ফলে শিকারি তাকে চেনার যথেষ্ট সময় পায় ও পরবর্তীবার আক্রমণ করেনা।ফলে এমন একটা প্রজাতির মিমিক্রি করলে বেশি ক্ষতিকর প্রানিটিও বারবার আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে যায়। এজন্যই এই অদ্ভুত ধরনের এমস্লেয়ান মিমিক্রির বিবর্তন ঘটেছে।
অনুকরণের বিবর্তন(৩)
গতপর্বে ডিফেন্সিভ মিমিক্রি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজ কিছু সাধারণ শ্রেণিবিভাগ নিয়ে আলোচনা করবো।
Wasmannian mimicry, এখানে মডেল মিমিকের কলোনিতেই থাকে বা বাসার আশেপাশে থাকে। এইটুকুই। এই নিয়ে আসলে আর বেশি কিছু বলার নেই। মডেল উপযুক্ত যে কেউ হতে পারে, কিন্তু যখন মডেল হোস্টের বাসার আশেপাশে থাকে তখন তাকে এই বিশেষ নামে ডাকা হয়। আর এক্ষেত্রে মডেলরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সোশ্যাল ইনসেক্ট হয়। সোশ্যাল প্যারাসাইটিজমে এই নিয়ে কিছুটা আ্লোচনা করছিলাম।
Vavilovian mimicry.এই মিমিক্রিটা ঘটে মানুষের কারণে আর মানুষের দ্বারাই, কিন্তু মানুষ ইচ্ছা করে এটা করেনা। মানুষের অজান্তে বা অনিচ্ছায় এটা ঘটে।অর্থাৎ এটা একপ্রকার অনিচ্ছাকৃত আর্টিফিশিয়াল সিলেকশন বা সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর ফলাফল।অনিচ্ছাকৃত বলে অনেকে এটাকে আর্টিফিশিয়াল না বলে ন্যাচারাল বলতে চেয়েছেন।
কৃষকরা ফসল চাষ করেন, আর জমিতে হুধু ফসল না, আগাছাও জন্মায়। যখন কৃষকরা ফসল তুলে বীজ উৎপাদন করেন, তখন তার মধ্যে অনেকসময় আগাছার বীজ থেকে যায়। এটাই স্বাভাবিক নয় কি? ভুল করে কয়েকটা আগাছার বীজ থেকে যেতেই পারে। এখন কৃষক যদি একটু খেয়াল করেন, তাহলে তিনি এইসব বীজ বেছে ফেলে দিতে পারবেন।কিন্তু রক্ষা পাবে কোন বীজগুলো? যারা দেখতে আসল ফসলের মতো ও দূর থেকে দেখে যাদের আলাদা করা যায়না। ফলে এধরনের আগাছা বেঁচে যায়। যত নতুন প্রজন্ম আসে, তত বেশি মিমিক হও্য়া বীজগুলো বেঁচে যেতে থাকে। ফলে একসময় খুব ভালো করে দেখলেও এসব আগাছার বীজকে ফসলের বীজ থেকে আলাদা করা যায়না। এভাবেই ভ্যাভিলোভিয়ান মিমিক্রি ঘটে।
অনেকে ভ্যাভিলোভিয়ান মিমিক্রিকে ডিফেন্সিভ মিমিক্রির পর্যায়ে ফেলতে চান, কারণ এই মিমিক্রি ডেভেলপ্ না হলে আগাছার বীজগুলো ফেলে দেয়া হতো আর সেগুলো নষ্ট হয়ে যেতো।
ভ্যাভিলোভিয়ান মিমিক্রির মাধ্যমে অনেক আগাছাই এমন বিবর্তিত হয়েছে যে তা ডমেস্টিকেটেড খাদ্যশস্যে রূপান্তরিত হয়েছে।তখন এই আগাছাকে আর আগাছা বলেনা, সম্মান করে “সেকেন্ডারি ক্রপ” বলা হয়। সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো Rye , যা Wheat এর মিমিক। প্রথমদিকে এই Rye অপ্রয়োজনীয় হলেও এই ভ্যাভিলোভিয়ান মিমিক্রির ফলে দিন দিন তা Wheat এর মতো হয়ে গিয়েছে, আর এখন একে নানান খাদ্য উপাদান তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
Gilbertian Mimicry. এর বিশেষত্ব হলো, এর মডেলরা হলো প্যারাসাইট আর মিমিক হলো হোস্ট। প্যারাসাইট থেকে বাঁচতে হোস্ট মিমিক্রি করে, খোদ প্যারাসাইটের মিমিক্রি! একটা উদাহরণ দিলে ভালো বোঝা জাবে।
Passiflora নামক জেনাসের একধরনের উদ্ভিদ, এদের ফুলগুলো দেখতে অদ্ভুত সুন্দর। এদের দেহে বিশেষ কিছু ধরনের টক্সিন উৎপাদিত হয় ,যা বিভিন্ন উদ্ভিদভোজী প্রাণিকে এদের থেকে দূরে রাখে, বিশেষ করে কীট-পতঙ্গ কে। যেমন-প্রজাপতি। কিন্তু Heliconius জেনাসের প্রজাপতিরা বিশেষ ধরনের এনজাইম ডেভেলপ করেছে বিবর্তনের মাধ্যমে, যা এদেরকে লার্ভা অবস্থায় ওই টক্সিন ভাঙতে সাহায্য করে।
এই প্রজাতির প্রজাপতির লার্ভা আবার ক্যানিবালিস্টিক,মানে এরা স্বজাতিকে ভক্ষণ করে। ফলে হয় কি, একই স্থানে যদি অনেকগুলো ডিম থাকে, তাহলে আগে যেই লার্ভাগুলো বের হবে, তারা পরের লার্ভাগুলোকে খেয়ে ফেলবে। এজন্য এই প্রজাপতিরা তাদের সন্তানের সার্ভাইভাল রেট বাড়ানোর জন্য খালি জায়গায় ডিম পাড়ে, যেখানে আগে থেকে অন্য কোনো ডিম নেই।
এই সুযোগ নিয়েছে ওই Passiflora ! এই উদ্ভিদদের পাতার কাছে কিছু বিশেষ ধরনের বর্ধিত অঙ্গ বিবর্তিত হয়েছে যা দেখতে প্রজাপতির ডিমের মতো।ফলে প্রজাপতিরা দূর থেকে দেখে মনে করে ওখানে আগে থেকেই অন্য কারো ডিম আছে, তাই নিজের সন্তানকে বাঁচাতে সে অন্য জায়গায় ডিম পাড়ে। আর এই গাছ বেঁচে যায়।
এখানে উদ্ভিদটা হলো মিমিক আর হোস্ট, প্রজাপতিটা হলো মডেল আর প্যারাসাইট। এখানে ঘটেছে গিলবারটিয়ান মিমিক্রি।
এই উদাহরণটা কিন্তু আরেকটা বিষয়ও বুঝিয়ে দেয়, তা হলো বিবর্তন চির-চলমান আর উদ্দেশ্যহীন একটা প্রক্রিয়া।
বিবর্তনের যেসব সাধারণ উদাহরণ দেয়া হয়, “ সবুজ মাঠে বাদামি কচ্ছপ, তাই কচ্ছপরা সবুজ রঙে বিবর্তিত হবে”, এই ধরনের উদাহরণগুলো বিবর্তনকে একটা উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার ভ্রম তৈরি করে, এখানে উদ্দেশ্য হলো কচ্ছপের আত্মরক্ষা।
কিন্তু বিবর্তনতো এমন না।
গিলবার্টিয়ান মিমিক্রির উদাহরণটায় দেখুন, উদ্ভিদ প্রাণি থেকে বাঁচতে টক্সিন বিবর্তিত হয়েছে, প্রাণি আবার সেই টক্সিন থেকে বাঁচবে বলে এনজাইম বিবর্তিত হয়েছে, আবারো উদ্ভিদ সেই প্রাণি থেকে রক্ষা পেতে মিমিক্রির আশ্রয় নিয়েছে!
বিবর্তন এখানে কারো পক্ষে নেই, উভয় পক্ষই বিবর্তিত হয়েছে, মানে বিবর্তন উদ্দেশ্যহীন। একবারমাত্র বিবর্তন হয়ে থেমে যায়নি, উদ্ভিদ টিকেছে বলে কি প্রাণি টেকার চেষ্টা করবেনা? তাই বারবার বিবর্তন হয়েছে,সবার বিবর্তন হয়েছে, বিবর্তন চিরচলমান।
আরেকটা বিষয়ও বোঝা গেলো, সেটা হলো বিবর্তনের পেছনে কাজ করে র্যান্ডম মিউটেশন, একেবারেই র্যান্ডম। কারণ ,উদ্ভিদের টক্সিনের বিরুদ্ধে যখন প্রজাপতি এনজাইম ডেভেলপ করলো, তখন উদ্ভিদ কিন্তু টক্সিনের টক্সিসিটি বাড়ায়নি বা নতুন কোনো টক্সিন ডেভেলপ করেনি! কমন সেন্স তো সেটাই বলে, যে, আগেরবার যখন টক্সিন তৈরি হয়েছিলো, এইবারও তাহলে তেমনই কিছু হবারর কথা! কিন্তু না! সে করলো মিমিক্রি! যা টক্সিনের সাথে একেবারেই অসংলগ্ন!
কেন এমন হলো?
র্যান্ডমনেস!
প্রথমবার টক্সিন তৈরির মিউটেশন হয়েছিলো দেখে টক্সিন তৈরি হয়েছিলো, কিন্তু এইবার তা হয়নি, এইবার এমন একটা মিউটেশন হয়েছে যা মিমিক্রির দিকে যায়, তাই মিমিক্রি হয়েছে! সবকিছুই কি র্যান্ডমনেসের প্রমাণ নয়?
অবশ্যই হ্যা! বিবর্তন ঘটে র্যান্ডম মিউটেশন এর কারণে।
এরপর আছে Browerian Mimicry.এটা একপ্রকার Automimicry.অর্থাৎ এখানে মিমিক নিজের প্রজাতিরই অন্য কাওকে মডেল বানায়। মানে উভয়ে একই প্রজাতির আরকি।কেন এমন হয়?
একই প্রজাতিতে অনেকসময় বিশেষ কিছু বৈশিষ্টয়ের কারণে দুইটা বা তার চেয়ে বেশি আলাদা দল তৈরি হয়। যেমন মৌমাছিদের মধ্যে রানী মৌমাছি আর কর্মী মৌমাছি। অনেক সময় দেখা যায় যে এইক্ষেত্রে একদল আরেকদলের চেয়ে শিকার কম হয়, তখন ওই আরেকদল ,একদলের মিমিক্রি করে।দুইদলই কিন্তু একই প্রজাতির।এই মিমিক্রির আর বাদবাকি সবকিছু ব্যাটেশিয়ান মিমিক্রির মতো।
অনুকরণের বিবর্তন(৪)
এমন না যে শুধু আত্মরক্ষার জন্যই মিমিক্রি হয়। অনেক সময় প্রাণিরা শিকার করার জন্য বা অন্যের ক্ষতি করে নিজের উপকার করার জন্যও মিমিক্রির আশ্রয় নেয়। একেই বলে Aggresive Mimicry.
যেই মিমিক্রিতে কোনো প্রিডেটর, প্যারাসাইট বা প্যারাসাইটয়েড(এরাই মিমিক) তাদের শিকার বা হোস্টকে আক্রমণ করতে এমন কোনো প্রাণির বা অন্য এমন কিছুর(মডেল) মিমিক্রি করে যেটা শিকার বা হোস্টের কছে ক্ষতিকর না, তাকে এগ্রেসিভ মিমিক্রি বলে। সহজ কথায় এক্ষেত্রে মডেল হলো এমন কিছু, যা শিকার বা হোস্টের কাছে উপকারী বা নিউট্রাল ধরনের, মানে ক্ষতিকর না হলেই হলো।এক্ষেত্রে পরিস্থিতিভেদে মডেল উপকৃত,অপকৃত বা অপ্রভাবিত থাকতে পারে।মিমিকের তো উপকার হচ্ছেই।কিন্তু বেচারা শিকার বা হোস্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এইযে শিকার বা হোস্ট, এদেরকেবলে সিগন্যাল রিসিভার। যেকোনো মিমিক্রিতেই , যার কারণে মিমিক্রি হয় বা যাকে প্রভাবিত করতে মিমিক্রি ঘটে, সে হলো সিগন্যাল রি্সিভার। কারণ সে ই মিমিকের থেকে প্রাপ্ত সিগন্যাল কে মডেলের থেকে প্রাপ্ত সিগন্যালের সাথে গুলিয়ে ফেলে, সে যাতে গুলিয়ে ফেলে সেজন্যই মিমিক্রি সংঘটিত হয়, এই গুলিয়ে ফেলার মাধ্যমেই মিমিক উপকৃত হয় আর ওয়ি সিগন্যাল রিসিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ডিফেন্সিভ মিমিক্রিতে মিমিক ক্ষতিকর প্রাণির অনুকরণ করে, মানে মডেলের ক্ষতিকর সিগন্যালের অনুকরণ করে। সিগন্যাল রিসিভার মিমিকের থেকে প্রাপ্ত সিগন্যাল কে মডেলের সিগন্যাল মনে করে,এতে সে মিমিককে ক্ষতিকর প্রাণি মনে করে তার থেকে দূরে দূরে থাকে, ফলে মিমিক রক্ষা পায়।
আর এগ্রেসিভ মিমিক্রিতে মিমিক ভালো সিগন্যালের অনুকরণ করে, অর্থাৎ মডেল সিগন্যাল রিসিভারের কাছে ক্ষতিকর না। ফলে সিগন্যাল রিসিভার (শিকার বা হোস্ট) মিমিক হতে প্রাপ্ত সিগন্যালকে আর ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত করতে পারে না, ভালো মডেলের সিগন্যাল হিসেবে চিহ্নিত করে, ফলে মিমিকের কাছে চলে আসে আর শিকার হয় বা আক্রান্ত হয়।
সিগন্যাল রিসিভার নিয়ে আগেই লেখা উচিত ছিলো, মনে ছিলোনা।
আশা করি বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন।
এগ্রেসিভ মিমিক্রিতে অনেক সময় মিমিক এমন কিছুর মিমিক্রি করে, যা সিগন্যাল রিসিভারের জীবন-ধারণের জন্য একেকবারে অপরিহার্য । এই মডেল হতে পারে প্রজননের সঙ্গী, পুষ্টিকর খাদ্য ইত্যাদি। অবশ্যই এমন কিছু হতে হবে যা দেখা মাত্র সিগন্যাল রিসিভার আর লোভ সামলাতে পারবেনা, দৌড়ে চলে আসবে, এতই গুরুত্বপূর্ণ কিছু। কারণ কম গুরুত্বের কিছু হলে রিসিভার রিস্ক নিতে চাইবেনা, কারণ তাদের মধ্যে ততটুকু স্মৃতি থাকে যার ফলে তারা মনে রাখতে পারে এই লোভের ঠ্যালায় এক সময় জীবন নিয়ে টানাটানি বেধে গিয়েছিলো।তাই মডেল এমনকিছু হতে হবে যা দেখে সিগন্যাল রিসিভার আসবেই আসবে, আর সেই “অতি লোভে তাঁতি নষ্ট” ঘটনা মনে করতে পারবেনা বা মনে করার সময়টুকু পাবেনা।
এক ধরনের কচ্ছপ আছে, Aligator snapping turtle. এদের জিহ্বার সামনের অংশ দেখতে Worm এর মতো, গোলাপি রঙের আর আকৃতিও ঠিক ওরকম। এরা পানিতে নেমে জিহ্বা বের করে নাড়াচাড়া করতে থাকে। ফলে মাছ মনে করে যে কোনো পোকা, সে দ্রুত খেতে আসে, আর পোকা মনে করে জিহ্বার কাছে আসা মাত্রই কচ্ছপ মাছটাকে খেয়ে ফেলে।
কিছু কিছু সাপও তার লেজ আর জিহ্বা কে এভাবে ব্যবহার করে থাকে।
কিছু কিছু কার্নিভোরাস উদ্ভিদ, যারা পোকা-মাকড়কে বন্দি করে তাদেরকে হজম করে পুষ্টি শুষে নেয়, এরা অনেকসময় বিশেষ ধরনের তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে , উজ্জ্বল রঙের মাধ্যমে পোকা-মাকড়কে আকৃষ্ট করে। এটাকেও এগ্রেসিভ মিমিক্রির মধ্যে আনা যায়।
ক্লিনিং সিম্বায়োসিস এর কথা মনে আছে নিশ্চই?
সেখানেও অনেক সময় শিকারি মাছেরা বা প্যারাসাইটরা ক্লিনারদের মিমিক্রি করে ক্লিনিং স্টেশনে গিয়ে বসে থাকে, যখনই ক্লায়েন্ট মাছ ক্লিন হতে আসে, সে খপ করে তাকে ধরে ফেলে। শিকারি হলে খেয়ে ফেলে আর প্যারাসাইট হলে আক্রান্ত করে।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে সিগন্যাল রিসিভার নিজেই মিমিকের কাছে গিয়েছে।তবে এর উল্টোটাও হয়।
অনেক সময় মিমিক এমন কিছুর মিমিক্রি করে যাতে সিগন্যাল রিসিভার তাকে পাত্তা না দেয়, মানে তার উপস্থিতিই টের না পায়। ফলে মিমিক ধীরে ধীরে রিসিভারের দিকে এগোতে থাকে, যথেষ্ট কাছে গেলে আক্রমণ করে। এই ঘটনাকে ফলে মিমেসিস।
এখানে মিমিক সিগন্যাল রিসিভারের কাছে যাচ্ছে।
কিছু কিছু প্যারাসাইট নিজের হোস্টের শিকারের মিমিক্রি করে। মানে মডেল হলো সিগন্যাল রিসিভারের শিকার, আর মিমিক হলো সিগন্যাল রিসিভারের প্যারাসাইট।সিগন্যাল রিসিভার হলো হোস্ট। ফলে হোস্ট নিজের প্যারাসাইটকে শিকার মনে করে খেয়ে ফেলে, তারপর প্যারাসাইট হোস্টের দেহের ভেতরে গিয়ে বংশবিস্তার করে, বৃদ্ধি পায়।
লিউকোক্লোরিডিয়াম নামক ফ্লাটওয়ার্মরা সংবার্ড নামক পাখিদের অন্ত্রে গিয়ে বাস করে।এই ফ্লাটওয়ার্মের ডিম পাখির মলের সাথে বের হয়ে যায়, সেই মল আবার খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এম্বার স্নেইল নামক শামুকরা। এই শামুক কাজ করে ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট হিসেবে। শামুকের দেহের ভেতর ওয়ি প্যারাসাইটের লার্ভা বেড়ে ওঠে।এভার জীবনধারণের জন্য একে পাখির অন্ত্রে পৌছাতেই হবে, যেকোনো ভাবেই হোক। কিন্তু সমস্যা হলো, ওই সংবার্ডরা শামুক খায়না। এই প্যারাসাইট করে কি, বিশেষ একটা প্রক্রিয়ায় শামুকের চোখে প্রবেশ করে। শামুকের চোখের অংশটুকু দেহের থেকে বর্ধিত থাকে, এই প্যারাসাইট সেটাকে আরো বর্ধিত করে্ আর এর বৈশিষ্ট্য হলো, এই ফ্লাটওয়ার্মের রঙ অনেক উজ্জ্বল, আর রা খুব দ্রুত গতিকে Pulse করতে পারে। শামুকের চোখে প্রবেশ করে এরা তাই করে। য়াবার এই ফ্লাটওয়ার্মরা Affecting Host behaviour এ সক্ষম। মানে এরা হোস্টের আচরণকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। এই শামুকরা সাধারণত আর্দ্র অন্ধকার জায়গায় বাস করে। কিন্তু এই প্যারাসাইট একে সূর্যের আলোতে নিয়ে যায়। ফলে এই সংবার্ড শামুকের চোখে প্যারাসাইটের উজ্জ্বল রঙ আর দ্রুত Pulse দেখে একে অন্য কোনো পোকা মনে করে খেয়ে ফেলে।
বাস!
প্যারাসাইটের উদ্দেশ্য হাসিল।সে পাখির অন্ত্রে পৌছে গিয়েছে, এবার সেখানে ডিম পাড়বে আর একই প্রক্রিয়া ঘটতে থাকবে!
বিবর্তন প্রাণিজগতে কত অদ্ভুত অদ্ভুত বৈচিত্র সৃষ্টি করেছে !
এই গেলো এগ্রেসিভ মিমিক্রি নিয়ে কথা-বার্তা।
একরকম মিমিক্রিকে বলা হয় অটোমিমিক্রি। এক্ষেত্রে মিমিক নিজের দেহেরই কোনো বিশেষ ওংগের মিমিক্রি নিজের দেহে ঘটায়। যেমন- কিছু কিছু আপের লেজ সেই সাপেরই মাথার মতো দেখতে, ফলে পেছন থেকে কোনো শিকারি আক্রমণ করতে ভয় পায়।এটা অটোমিমিক্রি।
প্রজননের স্বার্থেও মিমিক্রি ঘটে, যাকে বলে রিপ্রোডাক্টিভ মিমিক্রির আবার বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে।
কিছু স্ত্রী ফুলরা নিজের প্রজাতির পুরুষ ফুলের মিমিক্রি করে। এই পুরুষ ফুলরা পলিনেটরদেরকে নেক্টার দিয়ে থাকে। তাই পলিনেটররা সেই লোভে চলে আসে, ফলে পুরুষ ফুলের পলেন স্ত্রী ফুলে প্রবেশ করে।এটা কিছুটা চিটিং ও বটে, কারণ স্ত্রী ফুলরা পলিনেটরদের সাথে ছলনা করছে, নেক্টারের লোভ দেখিয়ে কাছে আনছে পলেন পাও্যার উদ্দেশ্যে, কিন্তু নেক্টার দিচ্ছেনা। যাই হোক, এই মিমিক্রিকে বলে ব্যাকেরিয়ান মিমিক্রি।
আবার আছে ডডসোনিয়ান মিমিক্রি। এক্ষেত্রেও সব ব্যাকেরিয়ান মিমিক্রির মতোই, শুধু মডেল আর মিমিক ফুলদ্বয় আলাদা প্রজাতির। আলাদা প্রজাতির হলে লাভ কী? পলেন দিয়ে প্রজননতো হবে না।
আসলে একটা স্থানেতো এক প্রজাতির ফুল থাকেনা। সব রকমের ফুলই থাকে, তাই পলেন ছড়াতে আর গ্রহণ করতে পারলেই হলো। দেখা যায় যে । ওই স্থানের পলিনেটররা মডেল ফুলের প্রতি আকৃষ্ট হয় বেশি, তখন মিমিকরা তার মিমিক্রি করে।
মিমিক্রি নিয়ে আমাদের সব কথাবার্তা শেষ। পাশাপাশি সিম্বায়োসিস নিয়েও যে দীর্ঘদিন আলোচনা করলাম, তাও শেষ। সিরিজের অর্ধেকে সম্ভবত সিম্বায়োসিসের আলোচনায়ই কেটে গিয়েছে! যাই হোক, আগামী পর্বে নতুন বিষয়ে ঢুকবো।
অনেক সময় দুটো একেবারে ভিন্ন প্রজাতি, যাদের মাঝে বিন্দুমাত্র যোগযোগ নেই, সম্পর্ক নেই, তাদেরকে দেখে মনে হয় যে একে অন্যের মিমিক্রি করছে। কীভাবে ?
Convergent Evolution! আমাদের আগামী পর্বের আলোচনার বিষয়।
Writer: Tahsin Ahmed Omi