পয়-পরিষ্কার করে বিবর্তন
আমরা সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশনশিপের তিনটা প্রকারের মধ্যে একটা, পলিনেশন বুঝে নিয়েছি। আজ আরেকটা নিয়ে জানবো।
পরিষ্কার পানির উন্মুক্ত জলাশয়ে Lobster বা গলদা চিংড়ির মতো দেখতে একধরনের মাছ পাওয়া যায়, যাদেরকে Crayfish বা Freshwater Lobster বলে। তো, এদের বহিঃকঙ্কাল আর ফুলকায় নানা ধরনের মাইক্রোঅর্গানিজমরা বাসা বাঁধে, বা কলোনাইজ করে ফেলে। দেখা যায় কী, Branchiobdellida বর্গ বা Order এর এক প্রকার জোঁক-সদৃশ ক্ষুদ্র পোকা,ওইসব মাইক্রোঅর্গানিজম ধরে ধরে খেয়ে ফেলে।এজন্য এদেরকে Crayfish Worm ও বলে।
এটা নিশ্চই সিম্বায়োসিস, কারণ সম্পূর্ণ দুই প্রজাতির অংশগ্রহণ আছে। আবার মিউচুয়ালিজম, কারণ উভয়ের উপকার হচ্ছে। এটা সার্ভিস-রিসোর্স সম্পর্ক, কারণ পোকাটা সেবা করছে, আর মাছটা খাদ্য-সামগ্রী দিচ্ছে। এতটুকুতে সন্দেহ নেই নিশ্চই?
এবার, পোকাটা মাছের দেহের মাইক্রোঅর্গানিজম খেয়ে কী ধরনের সেবা দিচ্ছে?
মাছটাকে পরিষ্কার করছে, Clean করছে।
এজন্য এই ধরনের ঘটনাকে বলে Cleaning Symbiosis. এইখানে যে সেবা নেয় বা পরিষ্কৃত হয়, তাকে বলে Client বা গ্রাহক; আর যে সেবা দেয় বা পরিষ্কার করে, তাকে বলে Cleaner বা পরিষ্কারক।
এর অসংখ্য উদাহরণ দেখা যায়।যেমন-
ভারত মহাসাগরের প্রবালপ্রাচীরসমৃদ্ধ এলাকায়, Cleaner Wrasse নামের একপ্রকার ছোট মাছ আছে। এরা Wrasse গোত্রের(Family) Labroides গণের(Genus) মাছ। Labroides জেনাসটাই খানদানি ক্লিনার, এদের সব প্রজাতিই ক্লিনিং এর সাথে জড়িত। এরা বিভিন্ন বড় মাছ, পটকা মাছ, Sweetlips, Groupers, প্রভৃতি মাছের দেহের বাইরের বিভিন্ন পরজীবী খেয়ে থাকে।
আবার Goby নামের এক মাছের কথা বলেছিলাম, মনে আছে? সামুদ্রিক ছোট গবিদের একটা জেনাস হলো Elacatinus. এদেরকে Neon goby ও বলে, তবে বেশি পরিচিত Cleaning Gobies নামে।এরা থাকে পশ্চিম আটলান্টিকের প্রবালপ্রাচীরে।বড় বড় মাছদের দেহের ওপরের প্যারাসাইটগুলো খায়।
Cleaner shrimp নামে অনেকটা চিংড়ি মাছের মতো দেখতে একটা মাছ আছে, এরা ইন্দো-প্যাসিফিক আর ক্যারিবিয়ানের প্রবাল প্রাচীরে থাকে।এরাও বড় মাছের দেহের ওপর বসবাসকারী বিভিন্ন মাইক্রোঅর্গানিজম খায়।যদিও এরা সর্বভূক,মানে সবই খায়।
আজ এইটুকুই থাক।
ক্লিনিং সিম্বায়োসিস নিয়ে অনেএএএক কথা আছে। সেই অনেক কথা বুঝতে গেলে আবার আরো অনেএএএএক কথা বলা লাগবে। তাই আগামী পর্বগুলোর বিষয়বস্তুর ক্রম একটু উল্টা-পাল্টা হতে পারে, মানিয়ে নিয়েন। পিডিএফ এ সব সাজিয়ে লিখবো।
কুদ্দুস Returns
আমরা ক্লিনিং সিম্বায়োসিস নিয়ে পড়ছিলাম, কিন্তু সামনে আগানোর আগে বিবর্তন নিয়ে আরো কিছু কথা জেনে নিতে হবে। আজ থেকে সেগুলোই জানবো, তারপর উপযুক্ত সময়ে আবার ক্লিনিং সিম্বায়োসিসে ঢুকবো।
আজকে আমরা আবার আমাদের কুদ্দুসকে ডেকে এনেছি! ইয়েএএএ!
শুরু করা যাক!
কুদ্দুস আর হোসুইনের মাঝে তখনো গফ নিয়ে মারামারি হয়নি, ওরা অনেক ভালো বন্ধু, একদমগলায় গলায় খাতির।
একদিন কুদ্দুস জানতে পারলো যে হোসুইনের টাকার দরকার, কী করবে কে জানে! কিন্তু দরকার।
কুদ্দুস আমাদের বড় দিল-দরিয়ার মানুষ। ওর কাছে মাসের হাত-খরচের টাকা ছিলো, সেই টাকা ও হোসুইনকে দিয়ে দিলো।
এই আশায় যে "হোসুইন ও ওকে ভবিষ্যতে একইভাবে বিপদে সাহায্য করবে।"
আগের লাইনটা আবার পড়েন।
তো, কুদ্দুস দিয়ে দিলো টাকা। পরে দেখলো যে হোসুইন ওই টাকা দিয়ে গফকে নিয়ে পদ্মা সেতু দেখতে গেছে।বেচারা! কুদ্দুস নিজে সারা মাস টেনে-হিঁচড়ে পাড় করলো! কিন্তু ও আশা ছাড়লো না, ওর অগাধ বিশ্বাস যে হোসুইনও ওকে ভবিষ্যতে সাহায্য করবে।
ও কী আর জানতো, এই হোসুইনই একদিন ওর গফকে বিয়ে করে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে!
যাই হোক, মূল ঘটনা ঘটে গেছে। যাকে ইভোলুশনারী বায়োলজিতে বলে "Reciprocal Altruism". বাংলায় "পারস্পরিক পরার্থপরতা"।
দেখা যায় যে একটা প্রজাতির জীব অনেক সময় আরেক প্রজাতির জীবের বা নিজের প্রজাতির আরেক জীবেরই ফিটনেস বাড়ানোর জন্য, বা উপকারের জন্য কিছু কাজ করে, যদিও সেই কাজে তার নিজের কিছুটা ক্ষতি হয়! তাহলে সে এই ক্ষতি সহ্য করে অন্যের উপকার কেন করে?
খালি খালি? না।
সে করে, কারণ, সে আশা করে যে, সেই জীবটাও ভবিষ্যতে তার প্রতি একই আচরণ করবে, মানে সে ও তার উপকার করবে।
মানে, উপকারের আশায় উপকার, একেই বলে রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজম।এর অনেক উদাহরণ দেয়া যায়, তবে প্রায় সবগুলোই একটু অনিশ্চিত। কোনটা যে আসলে রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজম, তা জানা আসলে একটু কঠিন।
Vampire Bat নামে একধরনের বাদুড় আছে, এদের নাক অনেকটা ছোট ছোট পাতার মতো দেখতে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এরা শুধুমাত্র রক্ত খেয়ে বাঁচে, শুধু রক্ত, অন্য কিছুই না! আর যদি টানা ৭০ ঘণ্টা এরা রক্ত খেতে না পায়, মারা যাবে!
কিন্তু, দেখা যায় যে এরা একে অন্যকে খাওয়ার জন্য রক্ত দিয়ে সাহায্য করে! এক্ষেত্রে গ্রহীতার অনেক বড় উপকার হয়, কিন্তু দাতা জেনে-শুনে খুব বড় একটা রিস্ক নেয়,কারণ যদি আগামী ৭০ ঘণ্টার মধ্যে সে রক্ত না পায়, নিশ্চিত মৃত্যু! তাও সে রক্ত দেয়, কেন? কারণ সে আশা করে যে এই দাতাও একদিন তাকে রক্ত দিয়ে সাহায্য করবে। হ্যা, এইটা গবেষণা করে জানা গেছে যে যেই বাদুড়রা সাহায্য করে, তারাই ভবিষ্যতে সাহায্য বেশি পায়।
কিন্তু, একটু অনিশ্চয়তা আছে। রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজম হতে হলে আরেকটা শর্ত আছে, সাহায্যকারীরা যেমন সাহায্য পাবে, একইভাবে, যারা উপকার করে না, তারা উপকার পাবেও না। এইযে যারা সাহায্য গ্রহণ করে ঠিকই, কিন্তু পরে আর সাহায্য করেনা, তাদেরকে বলে Cheater। রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজমের মাধ্যমে এই চিটার বা বিশ্বাসঘাতককে শনাক্ত করা যায়।
কিন্তু গবেষণায় এই বাদুড়দের মধ্যে এইটা দেখা যায়নি, মানে তারা বিশ্বাসঘাতকদের শনাক্ত করতে পারেনি ঠিক মতো। তাই গবেষকরা এখনো নিশ্চিত নন যে এইটা আসলেই রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজম কিনা, কিন্তু অধিকাংশের মত এর পক্ষে।
সে যাই হোক, আমরা মূল জিনিসটা বুঝলেই হলো।
প্রাইমেটদের মধ্যে Grooming Behaviour রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজমের শর্তগুলো পূরণ করে বলে ধরা হয়।
Grooming মানে তো সবাই জানেন, সাজ-সজ্জা করা,দেহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ইত্যাদি।
আচ্ছা, বানররা একে অন্যের মাথা থেকে উঁকুন মারে, দেখছেন নিশ্চই ডিস্কভারি চ্যানেলে? এই একে অন্যের উঁকুন মারার মতো কাজগুলোই গ্রুমিং বিহেভিয়ার, একে অন্যকে পরিষ্কার করা।
তো দেখা গেছে যে, যেসব প্রাইমেটদের মধ্যে এই গ্রুমিং বিহেভিয়ার আছে, তারা যখন ভবিষ্যতে বিপদে পড়ে, সাহায্য পায় বেশি। আবার এইখানে সূক্ষ্মভাবে সিলেকশনও কাজ করে, কারণ দেখা যায় যে এই গ্রুমিং বেশিরভাগ সম্পন্ন হয় নিজের আত্মীয় বা দলের প্রাণিদের মধ্যে।
কিন্তু, এখানেও ওই চিটার শনাক্ত হয় কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পরার্থপর জীবেরা
আমরা জানি যে বিবর্তন হল নিজে টিকে যাও্রয়ার খেলা, প্রত্যেক প্রাণী চেষ্টা করবে নিজেকে বাঁচানোর।ডকিন্সের ভাষায়, আমাদের সবার ভেতরে সেই “”সেলফিস জিন” রয়েছে যা সর্বদা চেষ্টা করছে নিজেকে টিকিয়ে দিয়ে রেপ্লিকেট হওয়ার।তাহলে, কেন একটা প্রাণী অন্যের প্রতি দরদ দেখাবে? কেন সে নিজের ক্ষতি সহ্য করে অন্যের উপকার করতে যাবে? বিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সাথে ব্যাপারটা কেমন সাংঘর্ষিক না?
এর সমাধানে উঠে আসে কয়েকটা বিষয়।
রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজম যদি বিবর্তনের স্বাভাবিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে চায়, তাহলে এর মধ্যেও সেলফিসনেস ঢূকাতে হবে, মানে প্রাণীর সাহায্য করার মধ্যেও তার নিজের স্বার্থ থাকতে হবে। জানা গেল যে ,হ্যাঁ, ঠিকই তার নিজের স্বার্থ আছে! সেটা কী? সেটা হলো ভবিষ্যতে ফেরত সাহায্য পাবার আশা।
এখন, ভবিষ্যতে ফেরত সাহায্য পেতে হলে প্রাণীটা যাকে সাহয্য করেছে, সেই প্রাণীর কিছু ক্ষমতা থাকতে হবে।সেটা হলো সাহায্য পেয়ে কৃতজ্ঞ হবার ক্ষমতা আর কে তাকে সাহায্য করেছিলো, তাকে চেনার ক্ষমতা। এক কথায় তাদের ব্রেইন এতটূকু উন্নত হতে হবে যাতে তারা চেহারা মনে রাখতে পারে বা মেমোরি উন্নত হতে হবে আর অন্যের আচরণ উপলব্ধি করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
আমরা সাধারণত মনে করতে পারি যে মানুষ আর তার কয়েকজন প্রাইমেট নিকটাত্মীয় ছাড়া মনে হয় কারো এই ক্ষমতা নেই।কিন্তু আসলে না, বিভিন্ন গবেষণায় বিভিন্ন প্রাণীদের মধ্যে এই দুটো ক্ষমতাই দেখা গেছে, ইদুঁরের মধ্যেও!
তাহলে প্রথম সমস্যার সমাধান হলো।
এবার, দেখা গেলো, আমি একজনকে সাহায্য করলাম, কিন্তু সে ভবিষ্যতে আমাকে সাহায্য করলো না, তখন কী হবে? তখন সে নিশ্চই নিজের ফিটনেস বাড়িয়ে নিয়ে আমার চেয়ে বেশি টিকে যাবে, য়ার এদিকে আমার ফিটনেস কমে যাবে। এমন হলেতো বিবর্তনের ছাকনির মাধ্যমে এই চিটারদের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজম বিলুপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু তা তো হয়নি, কীভাবে?
এইখানে আসে চিটার শনাক্ত করার ক্ষমতা, যা পরোক্ষভাবে ওই চেহারা মনে রাখা বা উন্নত মেমোরিরই খেলা।চিটার শনাক্ত করে তাকে ভবিষ্যতে আর সাহায্য না করলে তার ফিটনেস কমে যাবে, তখনই আমার লাভ হবে।এভাবে বিবর্তনের মূলনীতি এখানেও রক্ষা হবে,”চাচা ,আপন প্রাণ বাঁচা”
এখন আরেকটা প্রশ্ন ওঠে, প্রথমবার একটা প্রাণী কেন আরেকজনকে সাহায্য করে, সে কি তার মস্তিষ্কে এই নীল-নকশা অঙ্কন করে রাখে যে আমি সাহায্য করবো, ও সাহায্য করবে ? না, প্রাণির মস্তিষ্কে এমন কিছু হয়না।তাহলে কী হয়?
এই সমস্যার সমাধান করে Game Theory’র Prisoner’s Dilemma. [এইটা কী জিনিস তা না জানলে একটু অনুগ্রহ করে এই লিংকটা দেখে নিন, ব্যাখ্যা করতে গেলে আরো কয়েক পর্ব লেগে যাবে- https://en.m.wikipedia.org/wiki/Prisoner%27s_dilemma ]
তো, প্রিজনার্স ডিলেমার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, একটা প্রাণী অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই, সহজাতভাবেই অপরকে সাহায্য করতে চাইবে বা করবে। আর সেই প্রাণীর মধ্যেও তখন ফেরত সাহায্য করার প্রবণতা বেড়ে যাবে।এভাবে পরপর কয়েকবার সাহায্য-সাহায্য খেলা হলে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়, Tit for tat এর মতো।কিন্তু টিট ফর ট্যাট এর সাথে এর একটা পার্থক্য আছে, টিট ফর ট্যাট এ আমি তার সাথে যা করবো, সেও আমার সাথে তাই করবে, মানে ভালোর বদলে ভালো, খারাপের বদলে খারাপ। কিন্তু রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজম এ যেই মুহূর্তে আমি লক্ষ করবো যে সে আমাকে সাহায্য করছেনা, তখনই আমি তাকেও সাহায্য করা বন্ধ করে দেবো, ক্ষতিত কনসেপ্ট এখানে নেই।মানে টিট ফর ট্যাটে সম্পর্ক বজায় থাকে, ভালো-খারাপ যেভাবেই হোক, কিন্তু রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজমে খারাপ সম্পর্ক থাকে না, হয় ভালো, নাহলে নেই।
এবার, আমি তাকে সাহায্য করলাম প্রথমে, সেও কৃতজ্ঞ হলো, আমাকে চিনে রাখলো,আমি বিপদে পড়লে আমাকেও সাহায্য করলো,ফলে আমিও তাকে চিনে গেলাম। এভাবে যদি আমাদের উভয়ের প্রজাতিতে বা আমাদের প্রজাতিতে একাধিক এল্ট্রুইস্ট বা সাহায্যকারীর একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়,তাহলে খুব সহজেই রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজমের ইভোলুশনারী ভ্যালু বেড়ে যাবে আর তা একটা বা অংশগ্রহণকারী দুইটা প্রজাতিতে ছড়িয়ে যাবে।
ওকে, আমাদের তত্ত্বালোচনা শেষ, এবার আরো একটা উদাহরণ -
পাখিদের মধ্যে Warning call বা সতর্ককারী ডাক এক প্রকার রেসিপ্রোকাল এলট্রুইজম। একটা পাখি যখন দেখে যে কোনো শিকারি আরেকটা পাখিকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে, তখন সে ওয়ার্নিং কল দেয়। এতে তার নিজের অবস্থান প্রকাশ হয়ে যায় আর অনেক বড় একটা আশংকা থাকে যে শিকারি তাকে এসে ধরবে, কিন্তু তাও সে এই ডাক দেয়।
দেখা গেছে যে শিকারিরা নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিকভাবে নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণিদের শিকার করার বিশেষ বিশেষ কৌশল রপ্ত করে, তাই আমি যদি আমার সমপ্রজাতির কাওকে শিকার হতে দেই, তবে ভবিষ্যতে আমার শিকার হওয়ার আশংকা আরো বেড়ে যাবে। তাই আমার সতর্ক করার জন্য দেয়া ডাক যদিও আমাকে কিছুটা বিপদের সম্ভাবনায় ফেলে, তাও নিজেরই বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষায় আমি ডাক দেই।
দেখা যায় যে যেসব পাখির মধ্যে ওয়ার্নিং কল প্রচলিত, তারা বাকিদের থেকে বেশি টিকে যায়। কিন্তু এখানে একটু সমস্যা আছে, এখানে চিটার শনাক্ত হয় এমন কোনো প্রমাণ নেই। তবে ওয়ার্নিং কল যে রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজম, তার প্রমাণ হিসেবে দুইটা বিষয় আছে
১. এই ওয়ার্নিং কল বা সতর্কমূলক ডাকের কম্পাঙ্ক শিকারির শ্রাব্যতার সীমার মধ্যেই।মানে বলা যায় যে ডাকগুলো এমনভাবেই দেয়া হয় যাতে শিকারি শুনতে পায় ও তার বিপদের আশঙ্কা বাড়ে।
২.কলিং বার্ডরা বা এই আচরণ করে এমন পাখিদের শিকার হওয়ার হার অন্যদের তুলনায় কম, মানে এই ডাক দেয়া তাদের জন্য ইতিবাচক।
Underwater beauty parlour
Red-winged Black Bird নামে একপ্রকার পাখি আছে, যাদেরকে প্রধানত উত্তর আর মধ্য আমেরিকায় দেখা যায়।এরা নিজের প্রতিবেশিদের অনেক ভালোবাসে, প্রতিবেশির বাসায় কোনো বিপদ হলে, মানে শিকারি আক্রমণ করলে এরা আগায় গিয়ে রক্ষা করে। এরা এমন কেন করে তা নিয়ে কয়েকটি হাইপোথিসিস আছে।
একটা হলো যে পাশের বাসায় তার নিজের “এক্সট্রা পেয়ার অফস্প্রিং” বা নিজেরই আরেক সন্তান থাকতে পারে। [ সাধারণত অনেক প্রাণীরা একটা সঙ্গীর সাথেই সহবাস করে আর তার সাথেই আজীবন কাটায়, যাতে নির্দিষ্ট সন্তানদের ভালো করে পালন-পোষণ হয়। কিন্তু যখন অন্য কারো সাথে প্রজনন ঘটায় তখন তাকে বলে এক্সট্রা পেয়ার কপুলেশন বা অতিরিক্ত জোড়া সহবাস, আর সেই প্রজননে উৎপন্ন সন্তানদের বলে এক্সট্রা পেয়ার অফস্প্রিং বা অতিরিক্ত জোড়া সন্তান] তাই নিজের ডিএনএ বা নিজের ট্রেইটকে রক্ষা করার জন্যই হয়তো তারা এমন আচরণ করে।
আরেকটা অনুকল্প হলো এটা রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজম, মানে যারা আমার বাসা রক্ষা করবে আমিও ভবিষ্যতে তাদের বাসা রক্ষা করবো, এমন মনোভাব।
আর শেষ অনুকল্প হলো নিজের আত্মীয়দের রক্ষা করা, যেটাকে বলে কিন সিলেকশন, এক প্রকার এল্ট্রুইজম। এই রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজম শেষ হলে একদিন ওটা নিয়ে লিখবো।
তো, গবেষণা করে আসলে রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজমেরই প্রমাণ পাওয়া যায়।আর খুশির খবর হলো, এরা চিটার শনাক্ত করে। মানে যারা সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায়, তাদের বাসা আক্রান্ত হলে তারাও সাহায্য কম পায়!
রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজমের উদাহরণ দেয়া শেষ।
এইবার আসি আসল কথায়, যার জন্য এত কথা বলা। মনে আছে ক্লিনিং সিম্বায়োসিসের কথা? যেটা সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশনশিপ?যেটা আবার মিউচুয়ালিজম ? যেটা আবার সিম্বায়োসিস?
তো, অনেক বিজ্ঞানী আবার বলেছেন যে ক্লিনিং সিম্বায়োসিস আসলে মিউচুয়ালিজম কম, রেসপ্রোকাল এলট্রুইজম বেশি।এখানে ক্লিনার তার হোস্টকে সাহায্য করে , আর হোস্ট খুব দ্রুত সেই ফেরত সাহায্যটা করে তাকে খাদ্য দেয়ার মাধ্যমে।খুব দ্রুত মানে সাথে সাথেই!
আরেকটা মজার জিনিস আছে, যার নাম “ক্লিনিং স্টেশন”। এই ক্লিনিং স্টেশন হলো নির্দিষ্ট সেইসব জায়গা যেখানে তুলনামূলক বড় প্রাণীরা বা হোস্টরা গিয়ে নিজেদের পরিষ্কার করায়, ক্লিনারদের দ্বারা।এগুলো মিষ্টি পানির তুলনায় সমুদ্রে বেশি দেখা যায়।মাছ, কচ্ছপ,জলহস্তির মতো প্রাণীরা সাধারণত হোস্ট হয়।হোস্টরা নির্দিষ্ট ক্লিনিং স্টেশনে পৌছে এমন কিছু দেহভঙ্গিমা করে যাতে ক্লিনাররা বুঝতে পারে যে সে ক্লিন হতে এসেছে। তারপর ক্লিনাররা হোস্টের দেহের ভেতর-বাইরে থেকে বিভিন্ন ময়লা,অণুজীব ইত্যাদি খেয়ে হোস্টকে একদম চকচকে করে দেয়।
তাই ক্লিনিং স্টেশনকে অনেকটা সমুদ্রতলের বিউটি পার্লার বলতে পারেন!
ক্লিনিং স্টেশন যে ক্লিনিং সিম্বায়োসিস তা আর বলা লাগবে না নিশ্চই।
এইযে ক্লিনিং স্টেশন একটা নির্দিষ্ট স্থানে হয়, তার জন্য নিশ্চই হোস্টকে স্মরণে রাখা লাগে যে কোন জায়গায় কোন প্রাণী তার দেহকে পরিষ্কার করেছিলো, মনে রাখার ফলেই যে পরের বারও একই জায়গায় যেতে পারে। আবার হোস্টরা নির্দিষ্ট অঙ্গভংগি করে, সেটা হোস্টেরও মনে রাখা লাগে, ক্লিনারেরও মনে রাখা লাগে।মানে মনে না রাখলে বা স্মৃতিতে সংরক্ষণ না করলে এই ক্লিনিং স্টেশন নামের কিছুর অস্তিত্ব থাকতো না। তাই এটাকে রেসিপ্রোকাল এল্ট্রুইজম বলাটা অনেকটাই যুক্তিযুক্ত।কারণ স্মৃতিতে রেখেই এই সাহায্য দেয়া-নেয়া ঘটে।
আচ্ছা,এই বিশেষ অঙ্গভঙ্গির জিনিসটা হলো কীভাবে? ব্যাপারটা এভাভাবে চিন্তা করা যায়-
ক্লিনারা খাবার খুজছিলো, এখন বড় প্রাণীদের দেহে খাবার আছে, মানে এই ময়লা বা অণুজীব টাইপের জিনিস। এখন বড় প্রাণীতো ক্ষতিকরও হতে পারে, মানে কাছে গেলেই খেয়ে ফেলতে পারে।এখন যারা ক্ষতিকর মাছের কাছে গেল, তারা মারা গেল। বাকি থাকলো তারা যারা শিকারি মাছের কাছে যায়নি।এখন তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে এই সম্পর্কটা গড়ে উঠতে থাকলো, তারা একে অপরকে চিনতে থাকলো। ক্লিনাররা হোস্টদের বিশেষ কিছু অঙ্গভঙ্গি দেখে চিনে রাখলো। এখন যেই মাছরা সেই অঙ্গভঙ্গি করতো, তারা ক্লিন হও্য়ার সুযোগ পেলো বেশি। ফলে তাদের ফিটনেস কিছুটা বাড়লো।ফলে দীর্ঘদিনের পারস্পরিক সম্পর্ক আর কোইভোলুশনের ফলে মাছেরাও যখন ক্লিন হওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো তখন সেই অঙ্গভঙ্গিগুলোই করলো যেগুলো দেখে ক্লিনাররা তাদের চিনে রেখেছে। তারপর ধীরে ধীরে এটা একপ্রকার নিয়ম হয়ে তাদের আচরণে গেঁথে গেল।
এভাবে, ক্লিনিং স্টেশনের বিবর্তন হলো।
এই গেল।
আরেকদল বিজ্ঞানী বলেছেন যে ক্লিনিং সিম্বায়োসিস আসলে প্যারাসাইটিজম, ক্লিনাররা আসলে প্যারাসাইট।এই প্যারাসাইটদের কাজের ফলে হোস্টরা একটু বাড়তি সুবিধা পায় শুধু, আর কিছু না।যদিও এই মতকে কেউ তেমন দাম দেয়নি।
প্যারাসাইটিজম নিয়ে সামনে আমাদের আলোচনা আছে।
দেয়া-নেয়ার বিবর্তন
অন্নেএএক আগে আমরা মিউচুয়ালিজম নিয়ে লিখেছিলাম, মনে আছে? তার মধ্যে সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশনশিপ নিয়ে লিখতে গিয়ে এতদিন চলে গেল, তাও শেষ হলোনা।
যাই হোক, সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশনশিপের আবার প্রকারভেদ আছে, তার মধ্যে পলিনেশন আর ক্লিনিং সিম্বায়োসিস আমাদের পড়া শেষ।আজ থেকে আবার ধারাবাহিকভাবে শুরু করবো।
তো, আরেকপ্রকার সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশনশিপ হলো জুকোরি, Zoochory. প্রাণীরা যখন উদ্ভিদের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে তার বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করার মাধ্যমে সেবা করে,আর সেই বীজ বা উদ্ভিদের অন্য কিছু নিজে ব্যবহার করে সামগ্রী হিসেবে, তখন তাকে বলে Zoochory.আমাদের আজকের আলোচনা এই নিয়েই।
এই বীজ বিভিন্ন প্রাণীর মাধ্যমে, বিভিন্নভাবে ছড়াতে পারে। তাই এই জুকোরির নানান রকম প্রকারভেদ আছে। যখন উদ্ভিদের বীজ কোনো প্রাণীর, বিশেষ করে ভার্টিব্রাটদের, আরো বিশেষ করে স্তন্যপায়ীদের, দেহের বাইরে লেগে ছড়িয়ে যায়, তখন তাকে বলে এপিজুকোরি। যেসব উদ্ভিদ এই এপিজুকোরির সাহায্যে বংশবিস্তার করে, তাদের বীজে কিছু বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা দেখা যায়, যার সাহায্যে বীজগুলো প্রাণীদের দেহে লাগতে পারে। যেমন- আঠালো মিউকাস, আংটা, কাঁটা ইত্যাদি। এখানে বিবর্তন কীভাবে ঘটেছে?
Simple!
মিউটেশন হয়ে যেই বীজের ওপরে একটুখানি আঠালো তরল জমেছে, সেই বীজই কোনো প্রাণীর দেহে লেগে থাকার সুযোগ পেয়েছে, ফলে সেই বীজই ছড়িয়ে গিয়ে বংশবিস্তার করেছে আর তার সন্তান উদ্ভিদদের মধ্যেও সেই মিউটেশন রয়ে গিয়েছে। এভাবেই বীজদের মধ্যে এই বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থার বিবর্তন ঘটেছে।
এই এপিজুকোরির মাধ্যমে খুবই দ্রুত আর দূর-দূরান্তে উদ্ভিদের বংশবিস্তার ঘটতে পারে, যদিও মাত্র <৫% উদ্ভিদ এই এপিজুকোরির ব্যবহার করে।
আবার, অনেক সময় দেখা যায় কী, অনেক প্রাণী, বিশেষ করে পাখি, এরা উদ্ভিদের ফল খেয়ে বীজটুক আর হজম করতে পারে না, ফলে মলের সাথে বীজ ত্যাগ করে। আর সেখানেই জন্ম হয় আরেক উদ্ভিদের! একে বলে এন্ডোজুকোরি।আমরা এইযে আম-কাঠালের মতো ফলগুলো খাই, এরাও কিন্তু এই এন্ডোজুকোরিরই ফলাফল। কারণ, যেসব বীজের চারপাশে পুষ্টিকর উপাদানের আবরণ গড়ে উঠেছে, প্রাণীরা সেটাকেই খেতে পছন্দ করেছে, আর এতে সেই বীজেরই বংশবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে সেই উদ্ভিদগুলোই টিকে গিয়েছে যাদের বীজের চারপাশে সুস্বাদু আর পুষ্টিকর উপাদানের আবরণ গড়ে উঠেছে, যাকে আমরা "ফল" বলি।এই পদ্ধতিতে বংশবিস্তার উদ্ভিদদের মাঝে খুবই কমন।
আবার বিভিন্ন পাখি আর কাঠবিড়ালির মতো Seed predator বা "বীজ শিকারি" প্রাণীরা বিভিন্ন বীজ সংগ্রহ করে তাদের বাসায় বা বিভিন্ন গোপন গর্তে লুকিয়ে রাখে তাদের একান্ত সম্পদ হিসেবে। কিন্তু দেখা যায় কী, এরা অনেকসময় কিছুদিন পর ভুলে যায় যে কোন জায়গায় বীজগুলো লুকিয়েছে। ফলে বীজ থেকে গাছের জন্ম হয়। এই পদ্ধতিটা জুকোরি হলেও মিউচুয়ালিজম কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ কিছু কিছু সময় সিড প্রিডেটররা বীজ কাজে লাগালেও অধিকাংশ সময়ই ভুলে যায়, এতে বীজ তাদের কাজে আসেনা।
এছাড়া পিপড়া, পাখি, বাদূর, শামুক সহ একেক প্রাণীর জুকোরি কে একেক নামে ডাকা হয়, অত আমাদের না জানলেও চলবে।
আমাদের জুকোরি নিয়ে পড়াশোনা এখানেই শেষ।
সার্ভিস-রিসোর্সের আরেকটা চমৎকার উদাহরণ হলো Ant-Aphid relationship. Ant তো চেনেন, এই Aphid এর বাংলা জানিনা।ছবি দিচ্ছি, দেখে নিয়েন। তো এই পিঁপড়া আর এফিড নামের পোকাদের একটা অদ্ভুত রিলেশন আছে। এফিডরা গাছের রস শুষে খায়, আর খাওয়ার পর যে মল ত্যাগ করে,সেটা খুবই উৎকৃষ্টমানের শর্করা সমৃদ্ধ জিনিস, তাকে বলে Honeydew. এই জিনিসটা আবার পিপড়ারা খুব আয়েশ করে খায়। বিনিময়ে কী হয়? এফিডরা যখন ওই গাছের রস খায়, তখন দল বেধে একসাথে খায়। এতে যদি শিকারি( বিশেষত Ladybug) আক্রমণ করে, তখন দল শুদ্দ মরা ছাড়া কিছু করার থাকেনা।এখানে এগিয়ে আসে পিঁপড়া। এফিডরা যখন এই রস খায়, তখন পিঁপড়ারা এদের পাহাড়া দেয়। এভাবে পিঁপড়ারা এফিডদের থেকে রিসোর্স নিয়ে আর এফিডদের সার্ভিস দিয়ে এই মিউচুয়ালিস্টিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
পিঁপড়া আর এফিডদের মধ্যে এই সম্পর্কের বিবর্তন ঘটলো কীভাবে? এ নিয়ে এখনো ধোয়াশা আছে। এরকম কিছু একটা হতে পারে, পিঁপড়ারা দেখেছে যে এফিডরা শিকারির হাতে মারা গেলে তাদেরই খাদ্যের অভাব দেখা দেবে, তাই তারা এফিডদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, আর এর বদলে এফিডরা পিঁপড়াদের honeydew দেয়।
আমাদের সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশনশিপ নিয়ে পড়াশোনা এখানেই শেষ।
শিম-কথন
আজকে আমাদের আলোচনা রিসোর্স-রিসোর্স রিলেশনশিপ নিয়ে। মানে এখানে উভয় সিম্বায়োন্টই একে অন্যকে কিছু সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো মাইকোরাইযা। আগে একদিন এই নিয়ে অল্পকিছু লিখেছিলাম ,আজকে আরেকটু বিস্তারিত লিখবো।
মাইকোরাইযার বিবর্তন কীভাবে হলো? এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত না, তবে বেশ কিছু যৌক্তিক হাইপোথিসিস আছে।
স্থলজ উদ্ভিদের বিবর্তন ঘটে জলজ শ্যাওলা জাতীয় জীব থেকে। এই স্থলজ উদ্ভিদের বিবর্তন পৃথিবীর ইতিহাসে একটা বিশাল বড় প্রভাব বিস্তার করে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমান বৃদ্ধি আর কার্বন ফিক্সেশন [ যে প্রক্রিয়ায় অজৈব কার্বন, বিশেষ করে কার্বন ডাই অক্সাইড, জৈব কার্বনে রূপান্তরিত হয় ]। এই স্থলজ উদ্ভিদের দরকার ছিলো আর্দ্রতা আর পুষ্টি উপাদান, যা পানির মধ্যে থেকে সহজেই শোষণ করা যায়। কিন্তু মাটির ওপর থেকে তা শোষণ করতে গেলে মাটির ভিতরে দেহের কোনো একটা অঙ্গ ঢোকানো লাগবে, যা একেবারে প্রথম দিকের সেই শ্যাওলা জাতীয় জীবদের ছিলোনা। মূলের বিবর্তন আরো পরে হয়েছে। তাই এই প্রথম দিকের উদ্ভিদরা ছত্রাক জাতীয় জীবদের সাথে সিম্বায়োসিসে লিপ্ত হলো। মাটিতে উঠে যাওয়া যেসব শ্যাওলা জাতীয় সেই জীবরা বা উদ্ভিদরা ছত্রাকের সংস্পর্শে আসলো, সেসব উদ্ভিদরা ছত্রাক হতে পুষ্টি উপাদান আর আর্দ্রতা শোষণ করতে পারলো। আর ছত্রাক সেই উদ্ভিদের দেহ থেকে শর্করা সংগ্রহ করতে পারলো নিজের খাদ্য হিসেবে। এভাবে উভয়েরই একত্রে কোইভোলুশন ঘটতে থাকলো। পরবর্তীতে বিভিন্ন উদ্ভিদের মধ্যে স্বতন্ত্র ভাবেও মাইকোরাইযার বিবর্তন ঘটেছে। যেসব স্থানে পুষ্টি উপাদান আর খাদ্যের অভাব ছিলো, সেখানে উদ্ভিদ আর ছত্রাক একে অপরকে সামগ্রী দিয়ে মিউচুয়াল বেনিফিট পেলো। এভাবেই মাইকোরাইযার বিবর্তন ঘটোলো।
মাইকোরাইযাল ছত্রাকের আকার উদ্ভিদের মূলের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মূলরোম থেকেও ছোট, ফলে উদ্ভিদ যেসব জায়গায় পৌছাতে পারেনা , এই ছত্রাকরা অনায়াসে সেসব জায়গায় যেতে পারে।ফলে উদ্ভিদের শোষণক্ষেত্র বৃদ্ধি পায়।এই ছত্রাকদের কোষঝিল্লী মাটি থেকে আয়ন এক্সচেঞ্জ করে উদ্ভিদকে সরাসরি আয়ন সরবরাহ করে।এছাড়াও মাইকোরাইযার ফলে উদ্ভিদ বিভিন্ন পোকা-মাকড়ের আক্রমণ, রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা পায়।
এই গেল মাইকোরাইযা। আরেকটা বিখ্যাত উদাহরণ হলো রাইযোবিয়া। এই রাইযোবিয়ার নাম একদিন উল্লেখ করেছিলাম, কিন্তু একটুও ব্যাখ্যা করিনি, তাই আজকেই বিস্তারিত লিখবো।
রাইযোবিয়া হলো ডায়াযোট্রফিক ব্যাকটেরিয়া, মানে যারা পরিবেশ থেকে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে সেটাকে ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন রূপে রূপান্তর করতে পারে, যেমন- এমোনিয়া, এই ঘটনাকে বল নাট্রোজেন ফিক্সেশন । এই রাইযোবিয়া শিম গাছের মূলে আক্রমণ করে মূলজ অর্বুদ [ Root nodule ] গঠন করে আর সেখানে বাসা বাঁধে।কারণ, নাইট্রোজেন ফিক্সেশনের জিন এক্সপ্রেশনের জন্য রাইযোবিয়ার কোনো উদ্ভিদ হোস্ট দরকার। মানে, উদ্ভিদের সাহায্য ছাড়া এরা নাইট্রোজেন ফিক্স করতে পারেনা।বাসা বাধার পর এরা নাইট্রোজেন ফিক্স করে ত্যাগ করে, আর সেই নতুন নাইট্রোজেন গ্রহণ করে শিমগাছ, নিজের বৃদ্ধিতে কাজে লাগানোর জন্য। শিমগাছ মারা গেলে এই অর্বুদ ভেঙে যায় ,আর রাইযোবিয়া মাটিতে ফিরে যায়।
[ উল্লেখ্য যে শিমগাছ বলতে আসলে শিমজাতীয় যত উদ্ভিদ আছে সবার কথা বুঝিয়েছি ]
রাইযোবিয়া ও শিম গাছ থেকে জৈব এসিড টেনে নেয় যা তার দরকার। কিন্তু, অনেক সময় দেখা যায় কী, চিটার রাইযোবিয়া এসে নিজে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব এসিড গ্রহণ করলেও বিনিময়ে ফিক্সড নাইট্রোজেন উৎপাদন করে কম। এতে উদ্ভিদের ক্ষতি হয়। অর্বুদ গঠনের ঝামেলা আর এই চিটিং এর পরিমাণ বিবেচনা করে দেখা যায় যে এই রাইযোবিয়া আর শিমের মধ্যে এমন সিম্বায়োসিস টিকে থাকাটাই বড় বিস্ময়!
তাই,এই শিম আর রাইযোবিয়ার মধ্যে কীভাবে সিম্বায়োটিক রিলেশনশিপ কীভাবে টিকে আছে তা নিয়ে দুইটি বিখ্যাত হাইপোথিসিস আছে।
[ এদের মধ্যে সিম্বায়োসিস গড়ে উঠলো কীভাবে তার ব্যাখ্যা ওয়ি মাইকোরাইযার মতোই অনেকটা ]
একটি হলো The sanction hypothesis.
অর্বুদ নিশ্চই একটা থাকেনা, অনেকগুলো থাকে। আর ওইযে চিটার রাইযোবিয়ার কথা বলেছিলাম না? এরা কয়েকটা অর্বুদে বাসা বাঁধে। তো, এই হাইপোথিসিস অনুযায়ী, শিমগাছ কিছু জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে কোন অর্বুদে চিটার আছে তা শনাক্ত করতে পারে। আর তারপর গাছটি সেই নির্দিষ্ট অর্বুদের বিরুদ্ধে একশন নেয়, সেই অর্বুদে অক্সিজেন,কার্বন ইত্যাদির সাপ্লাই কমিয়ে দেয়। ফলে সেই মূলে রাইযোবিয়া বংশবৃদ্ধির হার কমে যায়।
যদি এই হাইপোথিসিস সত্য হয়, তাহলে শিম গাছের পক্ষে চিটিং এর ক্ষতির পরিমাণ কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক সিম্বায়োটিক রিলেশন রক্ষা করা সম্ভব।
আরেকটা হাইপোথিসিস হলো The partner choice hypothesis. এখানে বলা হয় যে অর্বুদে বাসা বাঁধার পূর্বে রাইযোবিয়া উদ্ভিদকে কিছু রাসায়নিক সিগন্যাল পাঠায়। আর এই সিগন্যাল থেকে উদ্ভিদ শনাক্ত করে যে একে নডিউল বানাতে দেয়া উচিত কিনা, এভাবেও চিটার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
তো,এভাবেই জীব জগতে রিসোর্স-রিসোর্স রিলেশনশিপের মাধ্যমে মিউচুয়ালিজম দেখা যায়।
জীবের জীব সেবা
আমরা সার্ভিস-রিসোর্স জেনেছি, রিসোর্স-রিসোর্স জেনেছি, এখন বাকি সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশনশিপ জানার। মানে এখানে উভয় সিম্বায়োন্টই একে অপরের সেবা করবে। আসলে প্রকৃতিতে এমন সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশন খুব একটা দেখা যায়না।কিন্তু কেন? তা আমরা এখনো জানিনা। তবে এর কয়েকটা সুন্দর উদাহরণ দেয়া যায়।
Sea anemones নামের Actiniaria বর্গের আর নিডারিয়া জগতের প্রাণীরা সমুদ্রে বাস করে , এরা শিকারি স্বভাবের। এদের সাথে সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশন গড়ে তুলেছে Pomacentridae গোত্রের Anemone fish বা Clownfish নামে খ্যাত মাছেরা।
তো এই সি এনিমোনিস নামের প্রাণীরা দেখতে একটু অদ্ভুত।এদের দেহ হলো মূলত একটা ফাঁপা টিউবের মতো অংশ যা নিচে কোনো শক্ত ভিত্তির সাথে লেগে থাকে।এই টিউবের ওপরের অংশে থাকে কতগুলো Tentacle ,বাংলায় সম্ভবত কর্ষিকা, আর এই টেন্ট্যাকলের মাঝে থাকে এদের মুখ। এই টেন্ট্যাকলগুলো দেহের ভেতরে সংকুচিত হতে পারে, আবার দেহের বাইরে প্রসারিতও হতে পারে শিকার ধরার জন্য। আর এই টেন্ট্যাকলের মধ্যে থাকে নিডোসাইট নামের সেল, যা হলো একপ্রকার দংশনকারী কোষ। কিন্তু, এনিমোনি ফিশ নামের ওই মাছেরা এই টেন্ট্যাকলের বিরুদ্ধে সহনশীলতার বিবর্তন ঘটিয়েছে [ নিশ্চই সিম্বায়োটিক কো ইভোলুশনের মাধ্যমে ], ফলে শিকারি থেকে রক্ষা পেতে এই ক্লাউনফিশরা সি এনিমোনিস এর কাছে চলে আসে, এতে শিকারি কাছে আসলে ওি টেন্ট্যাকলের নিডোসাইটের আক্রমণে সে চলে যায় আর ক্লাউনফিশ শিকারি থেকে রক্ষা পায়।বিনিময়ে সি এনিমোনিসরা কী পায়?
আসলে সি এনিমোনিসদের এই টেন্ট্যাকল দেখে সবাই ভয় পায়না, বাটারফ্লাই ফিশ নামের মাছেরা তো এদের ধরে খেয়েই ফেলে! কিন্তু ব্যাপারটা হলো, এই বাটারফ্লাই ফিশ আবার ক্লাউনফিশদের ভয় পায়! তাই ক্লাউনফিশ গৃহীত সেবার বিনিময়ে সি এনিমোনিসদের এই বাটারফ্লাই ফিশ থেকে রক্ষা করে! এভাবে এদের মধ্যে সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশনশিপ গড়ে উঠেছে একে অপরকে রক্ষা করার মাধ্যমে, নিরাপত্তা দেয়ার মাধ্যমে।
কিন্তু এখানে আরেকটা মজার ঘটনা ঘটে, সি এনিমোনিসের টেন্ট্যাকলে একধরনের শৈবাল বাস করে।আর ক্লাউনফিশ নিজ দেহ থেকে বর্জ্য হিসেবে যে এমোনিয়া ত্যাগ করে, তা আবার গ্রহণ করে এই শৈবালরা। মানে এখানে এনিমোনিস-এনিমোনির সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশনের একটা বায়-প্রোডাক্ট হিসেবে কিছুটা পরোক্ষ সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশন গড়ে উঠেছে। কারণ দেখা গেছে যে এই শৈবালরা আবার সি এনিমোনিসের নানা উপকারে আসে! অদ্ভুত ব্যাপার না?
দ্বিতীয় উদাহরণ হলো Acacia জেনাস এর গাছ [ যাকে বাংলায় বাবলা বলে ] আর Pseudomyrmex জেনাসের পিপড়াদের মধ্যে সিম্বায়োসিস। বাবলার কাটার মধ্যে এই পিপড়া বাসা বানায়, মানে আশ্রয় নেয় , আর বিনিময়ে এরা গাছকে রক্ষা করে বিভিন্ন উদ্ভিদভোজী প্রাণী থেকে [ অবশ্যই সাধ্যের মধ্যে থেকে, কারণ গরু-ছাগলের মত বড় প্রাণী থেকে নিশ্চই রক্ষা করবেনা। এই, ছোট-খাট বিভিন্ন পোকা-মাকড় থেকে রক্ষা করে আরকি ]। আবার, এই পিপড়ারা আবার অনেক সময় সেই উদ্ভিদভোজীদের হত্যার পর খেয়ে ফেলে,পাশাপাশি বাবলা গাছে বিদ্যমান Beltian Body নামের একধরনের স্নেহ-সমৃদ্ধ খাদ্য-অঙ্গের ওপরও এই পিপড়ারা আহার করে। তাই এইটা একইসাথে সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশনশিপ।
Lemon Ant নামের এক প্রজাতির পিপড়া আর এমাজন জঙ্গলের একটা গাছ, Duroia hirsute, এদের মধ্যে সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশনশিপের বেশ মারাত্মক রূপ দেখা যায়। এই পিপড়ারা ওই গাছে বাসা বানায়, আর সেই এলাকায় অন্য যত প্রজাতির গাছ আছে, সবগুলোকে ফর্মিক এসিড প্রয়োগ করে হত্যা করে। ফলে দেখা যায় কি, জঙ্গলের ভেতর বিশাল এলাকা জুড়ে শুধু এই এক প্রজাতির গাছ আর সেগুলো সব এই লেমন এন্টদের দ্বারা কলোনাইজ করা। এই বিশাল এলাকাগুলকে স্থানীয়রা বলে Devil’s Garden. এই ডেভিল’স গার্ডেন এর সর্বোচ্চ রেকর্ড হলো, ৬০০ গাছ আর প্রায় ৩ মিলিয়ন পিপড়া!
কিন্তু, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিপড়াদের থেকে এই সাহায্য নেয়ার বিনিময়ে গাছদের চড়া দাম দিতে হয়।
এমাজনেরই আরেক প্রকার সপুষ্পক উদ্ভিদ কর্ডিয়া, আর তাদের সিম্বায়োন্ট এলোমেরাস নামের পিপড়া।এই পিপড়ারাও গাছকে নিরাপত্তা দেয়, বিনিময়ে গাছের বিশেষ ধরনের পাতায় বাসা বানায়। কিন্তু, যাতে পিপড়াদের বাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় সেজন্য এরা গাছের ফুল কেটে ফেলায়, ফলে সেখানে নতুন পাতা জন্মে এদের বা বৃদ্ধি পায়!
কিন্তু গাছেরাও কোনো অংশে কম না। হিরটেলা নামের একধরনের গাছও এই এলোমেরাসদের দখলে থাকে, কিন্তু এই হিরটেলায় ফুল ফোটার আগে গাছের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা শুকিয়ে ঝড়ে যায়,ফলে পিপড়ারা গাছ ছাড়তে বাধ্য হয় আর ফুল ফোটে, পরে আবার শাখা গজালে পিওড়ারা বাসা বানায়।
তো,এভাবেই মূলত প্রকৃতিতে সার্ভিস-সার্ভিস রিলেশনশিপ টিকে আছে।
আমাদের মিউচুয়ালিজমের পড়ালেখা শেষ করবো আরেকটা জিনিস জানিয়ে,কীভাবে মিউচুয়ালিজম গড়ে ওঠে তার অনেকগুলো উদাহরণ আমরা দেখেছি, কিন্তু এই মিউচুয়ালিজম শেষও হতে পারে, বা সম্পর্ক ছিন্নও হতে পারে। কীভাবে ?
১.একটা সিম্বায়োন্ট যদি হঠাৎ কোনো কারণে প্যারাসাইটের মতো আচরণ করে, মানে নিজে উপকার নিয়েও অপরকে কোনো উপকার করে না বা ক্ষতি করে, তখন সেটা আর মিউচুয়ালিজম থাকবেনা।
২.একজন সিম্বায়োন্ট যদি স্বতন্ত্রভাবে থাকা শুরু করে।
৩.একটা সিম্বায়োন্ট নানা কারণে বিলুপ্ত হতে পারে।
৪.একটা সিম্বায়োন্ট প্রজাতির বিবর্তন হয়ে সে অন্য প্রজাতিতে পরিণত হতে পারে।
এভাবে, মিউচুয়ালিস্টিক রিলেশনশিপ শেষ হয়ে যেতে পারে। আর আমাদের মিউচুয়ালিজম নিয়ে জানা-শোনাও এখানেই শেষ!
একপাক্ষিক বিবর্তন
কুদ্দুস আর হোসুইনের বাড়ি পাশাপাশি। দুইজনেরই বাপের জমি আছে, সেখানে চাষ-বাষ করে দুইজনের সংসার চলে। কিন্তু, কুদ্দুস আবার কয়দিন আগে গরুর খামার করেছে।এখন খামারটা হলো একেবারে হোসুইনের জমির পাশে। ফলে গরু যখন গোবর ত্যাগ করে, তা গড়াতে গড়াতে গিয়ে হোসুইনের জমিতে চলে যায়। হোসুইন আবার জেএসসি তে জিপিএ ফাইভ পাওয়া লোক, ও জানে যে গরুর গোবর উৎকৃষ্ট মানের সার। তাই ও ফ্রিতে এত ভালো জিনিস পেয়ে ভালোই দিন কাটাতে লাগলো। কুদ্দুস এদিকে আর খেয়াল করলো না। হোসুইনের জমি কুদ্দুসের গরুরু গোবর পেয়ে ভালো ফসল দিতে লাগলো, হোসুইনের লাভের ওপর লাভ হলো।
এখানে, কুদ্দুসের না হলো লাভ, না হলো ক্ষতি। কিন্তু কুদ্দুসের কারণে হোসুইনের ঠিকই লাভ হচ্ছে। এখন কুদ্দুস আর হোসুইনকে দুইজন সিম্বায়োন্ট ধরলে আর তাদের মধ্যকার এই ঘটনাকে সিম্বায়োসিস ধরলে একে ইভোলুশনারী বায়োলজিতে বলা হয় কমেনসালিজম।এক পক্ষ আরেক পক্ষ দ্বারা উপকৃত হবে, কিন্তু আরেক পক্ষের উপকার-অপকার কিছুই হবেনা। যে উপকৃত হয়, তাকে বলা হয় কমেনসাল। আর যে উপকার করে, কিন্তু নিজে অপরিবর্তিত থাকে, তাকে বলা হয় হোস্ট।
কমেনসালিজমের হোস্টের কোনো ট্রেইটের পরিবর্তন হয়না, মানে তার ওপর কোনো বিবর্তনীয় চাপ কাজ করেনা। কিন্তু যে কমেনসাল, তার মধ্যে বিভিন্ন এডাপশন দেখা যায়, বা বিবর্তন লক্ষ্য করা যায় কমেনসালিজমের প্রভাবে। কেন?
কুদ্দুসের গরুর গোবর যাতে ভালো ভাবে সংগ্রহ করে ভালো ভাবে কাজে লাগানো যায়, সেজন্য হোসুইন বিভিন্ন কাজ করতে পারে। কিন্তু কুদ্দুসেরতো খেয়ালই নাই এদিকে, ও কেন কিছু করবে?
একইভাবে, উপকার আরো ভালো করে নেয়ার চিন্তা কমেনসালের, সে নিজেকে এডাপ্ট করবে, মোডিফাই করবে হোস্টের থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নেয়ার আশায়।কিন্তু হোস্টের এখানে কী করার? সে না পাচ্ছে উপকার, না অপকার, তার কী প্রয়োজন পরিবর্তন আনার?
কমেনসাল তার হোস্ট থেকে বিভিন্ন উপকার নিতে পারে, খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপত্তা অথবা চলাচল। হ্যা, চলাচলের জন্য কমেনসাল তার হোস্টের গায়ে চেপে বসে, তারপর হোস্ট যখন ঘুরতে ঘুরতে একেক জায়গায় যায়, তখন কমেনসাল সুবিধামতো জায়গায় আবার নিজেই লাফ দিয়ে নেমে যায়। এই যে কী উপকার নেয়া হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে কমেনসালিজমকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলো হলো - ফোরেসি, ইনকুইলিনিজম আর মেটাবায়োসিস।
মানুষের সাথে বিভিন্ন প্রাণীর কমেনসালিজম ধীরে ধীরে প্রাণীদেরকে গৃহপালিত প্রাণীতে রূপান্তরিত করেছে।মানুষ প্রাচীনকালে শিকার করে উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলে দিতো, সেই উচ্ছিষ্ট খেতে আসতো কিছু বন্য প্রাণী। তারা এখানে কমেনসাল,মানুষের ফেলে দেয়া খাবার খেয়ে তাদের উপকার হচ্ছে, কিন্তু মানুষের উপকার-অপকার কিছুই হচ্ছেনা।কিছু কিছু অহিংস্র প্রাণী লোকালয়ের প্রতি আকর্ষিত হতো, আর সেই অহিংস্র প্রাণীদের ওপর আহার করতো বিভিন্ন বন্য প্রাণী। মানে লোকালয় তাদের কাছে খাবারের উৎস্যে পরিণত হয়েছিলো। এমনই একটা প্রাণী হলো কুকুর।
কুকুরদের আদিপিতা ছিলো নেকড়ে। এখন মানুষ তার খাবারর উচ্ছিটাংশ ফেলে দিতো, ফলে এক শ্রেণির নেকড়ে তা খেতে লোকালয়ে চলে আসতো। এই এক শ্রেণি কোন শ্রেণি? স্বাভাবিক চিন্তা করুন, কারা আসতে পারে ? যারা হিংস্র বেশি, যারা অন্য প্রাণীদের প্রতি আক্রমণাত্মক বেশি, তারা? নিশ্চই না ! যাদের হিংস্রতা কম ছিলো, যারা দলের অন্যান্যদের থেকে একটু বলদ টাইপের ছিলো, তারাই লোকালয়ের এত কাছে আসতো। ফলে তারা ছিলো ডমেস্টিকেটেড হওয়ার জন্য উপযুক্ত। এভাবে তারা বারবার মানুষের অঞ্চলে আসতে লাগলো, একসময় তারা খাদ্যের জন্য প্রায় পুরোপুরি মানুষের ওপর নির্ভর হয়ে গেল। কিন্তু এইযে বন্যতা থেকে গৃহপালিত হও্যা, এটা ঠিক কেন আর কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে এখনো ডিবেট আছে।
যাই হোক, মানুষ কিন্তু তখনো সেই নেকড়েদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেনি, ততদিনে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, যেমন- দেহের আকৃতি ছোট হওয়া, দাঁতের আকার ছোট হওয়া, হিংস্রতা প্রায় লোপ পাওয়া, ইত্যাদি। এসব পরিবর্তন কমেনসালিজমের প্রথম দিকেই হয়েছিলো, ডমেস্টিকেশন শুরুর আগেই। গবেষণা করে দেখা গেছে এই শ্রেণির নেকড়েরা এই সময়ে তাদের প্রজাতির অন্যান্যদের সাথে, মানে যে নেকড়েরা পরিবর্তন হয়নি, তাদের সাথেই বসবাস করেছে, তাদের মধ্যে জিন ফ্লো ও হয়েছে। কিতু তাদের খাদ্যাভাস আর আচরণগত পরিবর্তন তাদের মধ্যে ভিন্ন প্রজাতিকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এভাবে চলতে চলতে একসময় মানুষ এই বিশেষ শ্রেণির নেকড়েদের প্রতি খেয়াল করেছে, তাদের সাথে ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে,তাদেরকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেছে। আর যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়ার পর সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে নানান প্রজাতির কুকুর তৈরি করেছে।
মোরগ,শুকোর,বিড়াল ইত্যাদি প্রাণীর ডমেস্টিকেশনও এরকম একটা প্রক্রিয়ায় হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া আর ছত্রাকের সাথেও মানুষের এমন কমেনসালিস্টিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যারা আমাদের দেহে বসবাস করে ঠিকই, কিন্তু আমাদের উপকার-অপকার কিছুই করেনা।
এবার কমেনসালিজমের প্রকারভেদগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
ফোরেসি হলো একটা “ অস্থায়ী “ কমেনসালিস্টিক রিলেশনশিপ যেখানে কমেনসাল প্রাণী শুধুমাত্র ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বা যাতায়াতের উদ্দেশ্যে নিজেকে হোস্টের দেহে “ হান্দায় দেয়” । এখানে কমেনসালকে, মানে যে হোস্টের দেহে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে , তাকে বলে ফোরন্ট। সিড ডিসপার্সাল ( উদ্ভিদের বীজ ছড়ানো ),সিজনাল মাইগ্রেশন ( বিশেষ কিছু ঋতুতে বিভিন্ন প্রাণীর নতুন জায়গায় স্থানান্তর ) , এফিমেরাল হ্যাবিটেট ত্যাগ ( স্বল্পস্থায়ী আবাস ত্যাগ ), আর ইনব্রিডিং ডিপ্রেশন (আপনজনদের মধ্যে তাদের সাথেই প্রজনন ঘটানোকে বলে ইনব্রিডিং, আর এই ইনব্রিডিং এর ফলে সৃষ্ট কোনো সমস্যার কারণে যখন কোনো প্রাণীর ফিটনেস কমতে থাকে তখন তাকে বলে ইনব্রিডিং ডিপ্রেশন ) থেকে রক্ষা পেতে সাধারণত বিভিন্ন প্রাণী এই ফোরেসি করে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে নতুন নতুন প্রাণী আমদানির ফলে ফোরেসির মাধ্যমে ইকোলজিকাল ডাইভার্সিটি আর কমপ্লেক্সিটি বৃদ্ধি পায়।
ফোরেসির সংজ্ঞায় পরিষ্কার করে বলা আছে যে এই সম্পর্কটা হবে অস্থায়ী আর কমেনসাল। মানে কোনো জীব যদি আজীবনের জন্য তার হোস্টের দেহের সাথে লেগে থাকে বা হোস্টের কোনো রকম উপকার বা অপকার করে, তখন সেটা আর ফোরেসি থাকবেনা। ফোরন্ট যদি কোনোভাবে তার হোস্টের উপকার বা অপকারের পথ পেয়ে যায়, তখন সেটা আর কমেনসালিজম থেকে যথাক্রমে মিউচুয়ালিজম বা প্যারাসিটিজম হয়ে যাবে।যদি দেখা যায় যে ফোরন্ট হোস্টের দেহে চড়ে ট্রাভেলের পর হোস্টের ক্ষতি করছে বা উপকার করছে, তখনও তাকে ফোরেসিসই বলা হবে। কারণ ট্রাভেলের সময় সে কিছু করেনি, ট্রাভেলের পরে করেছে, এই সময়ের ব্যবধান সংজ্ঞায় প্রভাব ফেলে।পরিবেশের ওপর নির্ভর করে ফোরেসি ঐচ্ছিক বা বাধ্যতামূলক হতে পারে।
প্রধানত আর্থ্রোপডরা ফোরন্ট হয়, যেমন-বিভিন্ন mite, beetle, flies, bee. আবার স্তন্যপায়ীদের দেহে চড়ে বসে স্যুডোস্কর্পিয়ন নামের এক প্রাণী, যাকে স্কর্পিয়ন বা বিচ্ছুর মতো দেখতে, এজন্যই নামের আগে স্যুডো বা ভুয়া। পাখিদের দেহে ফোরন্ট হয় মিলিপেডরা ( সেসব আর্থ্রোপড যাদের দেহের অংশগুলোতে দুইজোড়া করে যুক্ত পা থাকে)।
ইনকুইলিনিজম হলো বাসস্থানের কমেনসালিজম। এখানে একটা প্রাণী অন্য একটা প্রাণীর দেহে বা আবাসস্থলে বাস করে। যে বাস করে, মানে কমেনসাল, তাকে ইনকুইলিন বলে। একটা হোস্টের সাথে অনেকগুলো প্রজাতির ইনকুইলিনের সম্পর্ক থাকতে পারে।এর উদাহরণ দেয়া যায় এপিফাইট, বা পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ, যেমন- অর্কিড, এরা অন্য গাছের ওপর বেঁচে থাকে। আবার গাছে বসবাসকারী পাখিরাও ইনকুইলিন। মানুষের ঘরে বাসকারী বিভিন্ন পোকা-মাকড়, ইঁদুর বা এমন প্রাণীরাও ইনকুইলিন।
মেটাবায়োসিস হলো একটু পরোক্ষ কমেনসালিজমের মতো। এখানে একটা জীব আরেকটা জীবের বেঁচে থাকার মতো পরিবেশ তৈরি করে দেয়, অথবা এমন কিছু করে যাতে আরেকটা জীবের উপকার হয়,তারপর সেই কমেনসাল জীবটা সেখানে জন্ম নেয় বা বসবাস করে বা সেই উপকার গ্রহণ করে।এতে যে জীবটার দ্বারা উপকার হচ্ছে, তার আলাদা করে কিছু করা লাগেনা, প্রাকৃতিকভাবেই তার সাথে কিছু ঘটনা ঘটে, ফলে কমেনসাল জীবটা এসে সেই ঘটনার ফলাফলকে উপকার হিসেবে গ্রহণ করে।মেটাবায়োসিসের উদাহরণ হলো ম্যাগট বা মাছির লার্ভা, যারা মৃতদেহে জন্ম নেয়। আর হার্মিট ক্র্যাব নামের কাকড়া, যারা মৃত গ্যাস্ট্রোপড নামের শামুকদের খোলসকে আত্মরক্ষার্থে ব্যবহার করে। এখানে মৃতদেহ কিন্তু প্রাকৃতিক কারণেই তৈরি হয়, মৃত্যুর কারণে, আর তার ফল ভোগ করে ম্যাগটরা কমেনসাল হিসেবে। একইভাবে এই শামুকের মৃত্যুও প্রকৃতিরই নিয়ম, আর তার মৃত্যুর পর তার খোলস ব্যবহার করে হার্মিট ক্র্যাব।
এবার, সর্বশেষে, মানুষের পরিপাকতন্ত্রে বসবাসকারী বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের সাথে মানুষের সম্পর্ক কমেনসালিস্টিক কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে। কিছু কিছু বায়োলজিস্ট এইও বলেন যে দুইটি জীবের মধ্যে সম্পর্ক হলে কোনো এক পক্ষের বা উভয় পক্ষেরই নিউট্রাল থাকা অসম্ভব, মানে সামান্যতম উপকার বা অপকার হলেও হবেই। কিছুই হবেনা, এ অসম্ভব।তারা বলেন যে কমেনসালিস্টিক বলে খ্যাত রিলেশনশিপ গুলোতেও সূক্ষ্ম উপকার-অপকার জড়িত, যা আমরা খেয়াল করিনা। যেমন- পরগাছা, যেসব জীব গাছের ওপর জন্মে গাছ থেকে পুষ্টি শুষে নেয়। এদের পরিমাণ কম হলে গাছের কিছু যায় আসেনা, কিন্তু বেশি হলে সমস্যা। গাছের ডাল ভাঙতে পারে, খাদ্যসংকট হতে পারে। আবার ফোরন্টরা যখন হোস্টের দেহের ওপর চড়ে বসে ,তখন তা হোস্টের ওজন বাড়িয়ে তার চলাচল, শিকার , প্রভৃতিকে বিঘ্নিত করতে পারে।তাই, কমেনসালিজম আদও আসল কিনা, ত নিয়ে কিছুটা তর্ক-বিতর্ক চলমান।
Writer: Tahsin Ahmed Omi