ছোটবেলা থেকেই আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ আমাদের এটাই শেখায় যে জীবনে যদি সুখী হতে চাও তবে বড় কিছু করো, আর যদি বড় কিছু করতে চাও তাহলে কিছু লক্ষ্য পূরন করো। এমনকি স্কুলে থাকতে যখন রচনা লিখতে হত তখন "Aim in life" বা "জীবনের লক্ষ্য" রচনা লেখেনি এরকম মানুষ কিন্তু খুজে পাওয়া যাবেনা।
অথচ সুখী হওয়ার জন্য কি কেবল লক্ষ্যে পৌঁছানোই যথেষ্ট? কিংবা সত্যিকারের সুখী হতে গেলে সবসময় লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারা কি আদৌ প্রয়োজন? এটা বুঝতে গেলে আগে বুঝতে হবে লক্ষ্য কী।
লক্ষ্য বা Goal হল ভবিষ্যতের কোন একটা পরিনতি যেটাকে সফল করার স্বার্থে আমরা বর্তমানে নানারকম পরিকল্পনা করি এবং সেই মোতাবেক কাজ করি। কিছু স্টেরিওটাইপড লক্ষ্য কিন্তু অলরেডি আমাদের সমাজে তৈরীই আছে। যেমন জ্ঞান বুদ্ধি হবার পরপরই ভাল একটা স্কুলে ভর্তি হওয়া, এরপর ভাল রেজাল্ট করা, ভাল ক্যারিয়ার করা, ভাল ইনকাম করা, সবশেষে একটা ভাল বিয়ে করা। আজকাল তো আবার বিয়ের পরেও নতুন নতুন লক্ষ্য তৈরী হচ্ছে- ছেলেমেয়েদের ভাল স্কুলে পড়ানো, মাসে একদিন ব্যুফে ডিনার কিংবা বছরে একটা ট্যুর।
সে যাই হোক, আমরা ধরে নেই যে জীবনের এই যে লক্ষ্য বা goals, এগুলো যে যতবেশি অর্জন করতে পারে সে তার জীবনে ততবেশি সুখী। কিন্তু আসলেই কি তাই? এটা ঠিক যে একটা লক্ষ্যে পৌছুতে পারলে তার পরবর্তী কিছুদিন আমাদের মধ্যে ভীষন আনন্দ কাজ করে, জীবনটাকে স্বার্থক মনেহয়। কিন্তু সেই সময়টা যখন শেষ হয়ে যায় তখন? তখন কিন্তু আবার নতুন আরেকটা লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা, সেটা নিয়ে চিন্তা-দুশ্চিন্তা, স্ট্রেস ইত্যাদি।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে জীবনের যেকোন দুইটা লক্ষ্যের মধ্যবর্তী সময়টা আমাদের আসলে খুব একটা ভাল কাটছেনা। আমরা শুধু ছুটছি আর ছুটছি- এক লক্ষ্য থেকে অন্য লক্ষ্যে, সেখান থেকে আবার আরেক লক্ষ্যে। এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়ে আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই এইচএসসির রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা, আবার সেই রেজাল্টের খুশি শেষ হতে না হতেই ভাল ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার টার্গেট। আর এরমধ্যে কোন একটা টার্গেট যদি মিস হয়েই যায়, তাহলে তো কথাই নেই! পুরো জীবনটাকেই তখন অর্থহীন মনেহয়, তীব্র হতাশায় ডুবে যাই আমরা।
এবার তাহলে নিজেকে প্রশ্ন করুন, শুধুমাত্র লক্ষ্য অর্জনের পিছে দৌড়ে কিংবা লক্ষ্য অর্জন করতে পেরে আপনি কি আসলেই সুখী হতে পেরেছেন?
তাহলে সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র কী? মহাপুরুষদের ন্যায় জাগতিক সকল মায়া ত্যাগ করে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকা? হ্যা কেউ যদি সেভাবে সুখী হতে চায় আপত্তি নেই তবে সুখী হওয়ার জন্য সেটা বাধ্যতামূলক না। আপনি চাইলে জীবনের সকল বস্তুগত চাহিদার মাঝেও সুখী হতে পারেন। সেটার জন্য আপনাকে বুঝতে হবে মূল্যবোধকে।
মূল্যবোধ বা values হচ্ছে সেইসব বিষয় যেগুলো আমাদের জীবনের ছোট ছোট বিষয়গুলোকে উপভোগ করতে শেখায়। দুটি লক্ষ্য অর্জনের মধ্যবর্তী সময়টাকেও সুন্দর করতে পারে। একটা খুব সহজ গল্প দিয়ে বিষয়টা বোঝানো যাক।
ধরুন, আপনি আপনার একজন বন্ধুর সাথে কোন একটি ট্যুরিস্ট স্পটে বেড়াতে যাচ্ছেন। মানুষ হিসেবে আপনি একজন goal focused এবং আপনার বন্ধুটি একজন value focused মানুষ। যাত্রাপথে সারাটা রাস্তা ধরে আপনি কেবল এটাই ভাবছেন কতক্ষনে আপনাদের সেই ট্যুরিস্ট স্পটে পৌছুবেন। আপনি বারবার ঘড়ি দেখছেন, উসখুস করছেন, উচুনিচু রাস্তার জন্য গাড়ির গতি একটু স্লো হলেই বিরক্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে আপনার বন্ধুটিও আপনার মতই কাংক্ষিত জায়গায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব কিন্তু সেই সাথে যাত্রাপথের সবকিছুর প্রতিও সে আগ্রহী। সরু পথ, পথের দুধারে বড় বড় গাছ, গাছের পাতার ফাক গলে বেরিয়ে আসা সূর্যের আলো কিংবা উঁচুনিচু পথের ঝাঁকুনি সবই তার কাছে ভীষন উপভোগ্য।
অবশেষে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন গন্তব্যে পৌছুলেন, তখন আপনারা দুজনেই বেশ খুশি। নতুন জায়গায় দুজনে খুব ঘুরলেন। সারাদিন শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে যখন রওনা হলেন তখন ঘটল নতুন বিপত্তি। কিছুদূর যেতেই গাড়ি আর চলেনা। আপনার বন্ধুটি চলতি পথের একটি পিকআপ ট্রাকের কাছে সাহায্য চাইল যেন সেটি আপনাদেরকে বাড়ি পৌছুতে সাহায্য করে এবং চালক রাজি হয়ে গেল। এরপর আপনি এবং আপনার বন্ধু দুজনেই সেই ট্রাকের পিছনে চড়ে বসলেন।
পুরো ঘটনাটায় আপনি প্রচন্ড বিরক্ত, হতাশ এবং বেশ রাগান্বিত। কারন পিকআপ ট্রাক যে পথে যাবে সেই পথ ধরে আগালে আপনাদের গন্তব্যে পৌছুতে বেশ দেরি হবে। এটা ভেবেই আর আশেপাশের কিছুই আপনার ভাল্লাগছেনা। আপনার মাথায় শুধু ঘুরছে কতক্ষনে বাসায় পৌছুবেন। অন্যদিকে আপনার বন্ধুটির কাছে ট্রাকজার্নি জীবনে একেবারেই নতুন একটা অভিজ্ঞতা। খোলা ট্রাকের পেছনে বসে খোলা আকাশ দেখার যে অনুভুতি, এটা তার কাছে মারাত্মক উপভোগ্য। তার মানসিকতা এই যে, বাসায় তো যাওয়া হবেই কোন না কোন ভাবে, হয়ত কিছুটা দেরিই হবে কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতা হয়ত জীবনে আর দ্বিতীয়বার আসবেনা। এসব ভেবে পুরো যাত্রাপথটাই তার কাটল বেশ ভাল।
গল্পটা থেকে কি কিছু বোঝা যাচ্ছে? এই গল্পে আপনি এবং আপনার বন্ধু দুজনের গন্তব্য কিন্তু এক এবং গন্তব্যে পৌঁছুতে পেরে আপনারা দুজনেই সমান খুশি। কিন্তু এই গন্তব্যে পৌছানোর যে দীর্ঘ পথ সেই পথটা আক্ষরিক অর্থে এক হলেও মানসিকভাবে কিন্তু আপনাদের দুজনের জন্য একইরকম ছিলনা। অর্থাৎ এখানে গন্তব্য যদি হয় goal আর পথটা যদি হয় journey towards goal তাহলে সহজ ইংরেজীতে বলা যায় যে, you & your friend both achieved the goal right but you had a frustrated journey all through the time whereas, your friend had a journey of fulfillment. এটাই goal focused এবং value focused life এর পার্থক্য।
এতক্ষন আমি যা লিখলাম সেগুলো Acceptance & Commitment Therapy বা সংক্ষেপে ACT সাইকোথেরাপির খুব সামান্য একটা অংশ যেটি আমাদের লক্ষ্যকেন্দ্রিক জীবনে মূল্যবোধের গুরুত্ব বোঝায়। জীবনে লক্ষ্য থাকার প্রয়োজন আছে, অবশ্যই আছে। কিন্তু আপনি যদি সারাক্ষন শুধু লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য মুখিয়ে থাকেন তাহলে কখনোই জীবনের আসল স্বাদ পাবেন না, জীবনকে নিয়ে কখনো সন্তুষ্ট হতে পারবেন না। অফিসের এসাইনমেন্টের ডেডলাইন নিয়ে ভাবতে ভাবতে আপনার মনোযোগ হয়ত ল্যাপটপের স্ক্রিনেই আটকে থাকবে আর ওদিকে আপনার দুই বছরের শিশুটি আপনার পাশে বসেই না জানি কী কঠিন একটা বাংলা শব্দ উচ্চারন করে ফেলবে আপনি জানবেনও না!
তাই জীবনে যখন যেখানে আছেন তখন সেই সময়টাকেই উপভোগ করুন, সেই সময়ের জিনিসগুলোকে মূল্যায়ন করুন। ব্যর্থতাগুলোকে লক্ষ্যপূরনের ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে মূল্যবোধের দৃষ্টিতে দেখুন, তবেই আর হতাশা গ্রাস করবেনা। জীবন তো একটাই আর বাচার সুযোগও একবারই। এই এক জীবনের প্রতিটা মূহুর্তেই নতুনভাবে বাচুন।
(Ref: ACT made simple by Russ Haris)
Writer: Mahabuba Rahman