" ম্যাডাম, আমার মেয়েটার ছোটবেলায় কোনদিন একটু সর্দি-জ্বরও হয়নাই৷ সবাই বলত, আলেয়ার কি কপাল, কোনদিন বাচ্চার জন্য হাসপাতালে দৌড়ান লাগেনা! আর আজকে আমার মেয়েটা হাটতে পারেনা.."
বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেদে ফেললেন মেয়ের মা। আমি মেয়েটার চেহারার দিকে ভালমত তাকালাম। কী মিষ্টি একটা চেহারা! বয়স কত হবে? আনুমানিক ১৬-১৭?
— কী নাম তোমার?
— নুসরাত।
— একটু জোরে বল..
— নুসরাত!
— নুসরাত কোন ক্লাসে পড়?
— ক্লাস নাইনে।
— স্কুলে যাও?
নুসরাত মাথা নাড়ল।
— কেন যাওনা?
— হাটতে পারিনা৷
— কবে থেকে?
— শুক্রবার থেকে।
— শুক্রবার থেকে হাটতে পারোনা মানে আজকে পাচ দিন। এতদিন ডাক্তার দেখাওনি?
নুসরাত জবাব দেয়ার আগেই নুসরাতের মা বলে উঠলেন-
– ম্যাডাম, তিন জায়গায় দেখাইসি। মাথার এক্সরে, সিটি স্ক্যান সব করাইসি। সবাই বলসে আপনার মেয়ের পায়ে কিছু হয়নাই। ওরে মানুষিক ডাক্তার দেখান। আমিতো কিছু বুঝতেসিনা আমার মেয়েটার কিছু না হইলে ও হাটতে পারেনা ক্যান!
আলেয়া বেগম আবার কান্না শুরু করলেন..
— ওর বাবা কই?
— “বাবা আসেনাই ম্যাডাম।” আলেয়া বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন।
— কেন?
— ওর বাপ খুব রাগী মানুষ। অন্য ডাক্তাররা যখন বলসে ওর পায়ে কোন সমস্যা নাই, সে আমারে বলসে, “তোমার মেয়ে ঢং করে? ঢং? এগুলা সব বুঝি আমি। আমি কোন চিকিৎসা করাইতে পারবনা!”
— হুম..
— ম্যাডাম আমার মেয়ের সমস্যা কি অনেক বড়?
— বড় না ছোট তা তো এখনই বলতে পারছিনা। তবে সমস্যাতো একটা আছেই। এবং আউটডোরে এটার সমাধান করা সম্ভব না। আপনার মেয়েকে ভর্তি করান। আমরা ওকে দেখব…
এইটুকু শুনে নুসরাতের মায়ের মত আপনাদের মনেও নিশ্চয়ই প্রশ্ন এসেছে, একটা মেয়ে সমস্যা নিয়ে এল পায়ে, তাকে ভর্তি করা হল মনোরোগ বিভাগে! হাটতে না পারার সাথে মনের কি সম্পর্ক?? মন কি আমাদের হাত পা চালায়??
প্রশ্নটা খুবই যৌক্তিক। তবে চলুন, এই যৌক্তিক প্রশ্নের উত্তর খোজার জন্য আমরা একদম গোড়ায় চলে যাই। গোড়া বলতে সেই চতুর্থ শতাব্দী। গ্রীক চিকিৎসক হিপ্পোক্রেটস, যার হাত ধরে পশ্চিমা বিশ্বে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ‘মেডিসিন’ বিষয়টির সূত্রপাত, তিনি তৎকালীন নারীদের মধ্যে একটি অদ্ভত রোগের আবির্ভাব দেখতে পান। রোগটি ছিল খিচুনী রোগ।
তবে সাধারণ খিচুনী রোগের সাথে এর পার্থক্য ছিল এই যে, সাধারন খিচুনীতে রোগীর মস্তিষ্কে কোন না কোন রোগ বা অস্বাভাবিকতা পাওয়া যেত কিন্তু এই খিচুনীর ক্ষেত্রে তেমন কোন সমস্যা পাওয়া যেত না। পরবর্তীতে উনি রোগটির নামকরন করেন- “হিস্টেরিয়া”।
হিস্টেরিয়া শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘হিস্টেরন’ থেকে যার অর্থ ‘ইউটেরাস’ বা ‘জরায়ু’। হিপ্পোক্রেটস এর মতে, জরায়ুর অবস্থানগত সমস্যার কারনেই এই রোগের সূত্রপাত। নারীদেহে জরায়ু ঠিক যেভাবে অবস্থান করার কথা, তার ব্যাতিক্রম কিছু হলেই নারীরা এই রোগে আক্রান্ত হন।
সেই সাথে যেসব নারী অবিবাহিত, বিধবা কিংবা ডিভোর্সী, মোটকথা যে নারীরা যৌনজীবনে সক্রিয় না, তাদের মাঝেও এই হিস্টেরিয়া রোগটির প্রবনতা দেখা যায়। এ ব্যাপারে হিপ্পোক্রেটসের দাবি ছিল এই যে, যৌন সংগমের অভাবে নারীর জরায়ুতে একধরনের টক্সিন তৈরী হয় যার ফলাফল এই হিস্টেরিয়া৷ পরবর্তীতে হিস্টেরিয়ার অন্যান্য অনেক রোগীর মধ্যে তিনি খিচুনি ব্যাতীত আরো অনেক সমস্যা দেখতে পান যেমন, হাত পা কাপা, অবশ হয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।
হিপ্পোক্রেটস এর এই তত্ত্ব মোটামুটিভাবে সতের শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল। মাঝে তের শতাব্দীতে কিছু সময়ের জন্য হিস্টেরিয়াকে ভাবা হত খারাপ আত্মা বা শয়তানের ভর। সেজন্য তখন হিস্টেরিয়ার রোগীদের বিভিন্ন ঝাড়ফুক ও তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে সারানোর চেষ্টা চলত। এরপর ষোল শতাব্দীতে পুনরায় হিপ্পোক্রেটস এর মতবাদ অনুসারে “সেক্সুয়াল স্টিমুলেশন” থেরাপি দিয়ে চলতে থাকে হিস্টেরিয়ার চিকিৎসা।
মূলত আঠার শতক থেকে হিস্টেরিয়ার বৈজ্ঞানিক ভাবে গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যার সূত্রপাত ঘটে। আঠার থেকে শুরু থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে একটি ধারনা জন্মায় যে, যাদের মস্তিষ্কে জন্মগতভাবে কিছু গঠনগত ত্রুটি থাকে পরবর্তীতে তারাই হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত হন৷ পরবর্তীতে, এই ধারনাকে সরিয়ে দেয় বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ নিউরোলজিস্ট জা মার্টিন শারকো’ ( Jean Martin Charcot) এর মতবাদ।
শারকো’র মতে, ‘হিস্টেরিয়া ব্রেইনের স্ট্রাকচারাল না, ফাংশনাল রোগ’। শারকো’ মূলত প্রভাবিত হয়েছিলেন তারই এক ছাত্রী, পিয়েরে জ্যানেট (Pierre Janet) এর চিন্তা দ্বারা।
পরবর্তীতে অস্ট্রিয়ান নিউরোলজিস্ট সিগমুন্ড ফ্রয়েড শারকো’র সাথে দেখা করতে গেলে শারকো’র হিস্টেরিয়া সংক্রান্ত মতবাদ তাকে প্রভাবিত করে এবং তিনি দেশে ফিরে তারই এক কলিগ ব্রিউয়ারের সাথে হিস্টেরিয়ার পেশেন্টদের নিয়ে স্টাডি করা শুরু করেন। তাদের কেস স্টাডিগুলো নিয়ে পরবর্তীতে “Studies on Hysteria” নামক একটি বই প্রকাশিত হয়।
ফ্রয়েড ও ব্রিউয়ারের মতে হিস্টেরিয়া মূলত মানুষের অবচেতন মনে থাকা কোন ইমোশনাল ঘটনারই বহিঃপ্রকাশ যেটা মানসিক লক্ষনরূপে প্রকাশ না পেয়ে শারীরিক লক্ষনরূপে প্রকাশ পায়।
মানসিক কষ্টের এই রূপান্তরিত প্রকাশের কারনেই ফ্রয়েড হিস্টেরিয়া নামটি বদলে নতুন একটি নামের সূচনা করেন- “কনভারশন ডিজঅর্ডার” (Conversion Disorder)।
♣ কনভার্শন ডিজঅর্ডার কাদের হয়?
সাধারনত ১০-৩৫ বছর বয়সের মধ্যে এই রোগ হওয়ার প্রবনতা বেশি থাকে। এর আগে-পরেও হতে পারে। তবে এই বয়সের মানুষের মধ্যে হওয়ার হার বেশি। পুরুষের চেয়ে নারীদের আক্রান্ত হওয়ার হার প্রায় ১০ গুন বেশি।
ঠিক যেকারনে হিপ্পোক্রেটস ধারনা করতেন এটা কেবল নারীদেরই হয়। ব্যক্তিত্বের সাথে এই রোগের সম্পর্ক খুব গভীর। সাধারনত ব্যক্তি হিসেবে যারা একটু ইন্ট্রোভার্ট, লাজুক স্বভাবের, সহজে মনের কথা অন্যকে বলতে পারেন না, সহজে কোন মানসিক চাপ সামলাতে পারেন না তাদের কনভার্শন ডিজঅর্ডার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে৷
♣ কনভার্শন ডিজঅর্ডার কেন হয়?
কনভার্শন ডিজঅর্ডারের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখা হিসেবে সর্বশেষ ফ্রয়েডের মতবাদটাই এখনও পর্যন্ত গ্রহনযোগ্য। ফ্রয়েডের এই মতবাদকে বলে “সাইকোএনালাইটিক থিওরী”। এই থিওরী বোঝার আগে আমাদের দুটি বিষয় একটু জেনে নিতে হবে- কনশাস মাইন্ড এবং কনফ্লিক্ট।
♣ কনশাস মাইন্ড
আমরা কথায় কথায় বলে থাকি, “অমুক কাজটা আসলে কনশাসলি করিনাই” কিংবা “সাবকনশাসলি হয়ে গেছে!”এই কনশাস বা সাবকনশাস ব্যাপারটা কি আসলে? ফ্রয়েডের মতে, আমাদের মনের তিনটা স্তর- কনশাস, প্রি-কনশাস এবং আনকনশাস। কনশাস মাইন্ড ব্যাপারটা হচ্ছে, এই যে আমি এখন লিখছি, বা আপনারা পড়ছেন, কনশাসলি কাজগুলো হচ্ছে।
কিন্তু কিছু কিছু কথা বা কাজ থাকে, যেগুলো সচরাচর আমরা মনে করিনা, কিন্তু একটু চাইলেই মনে করতে পারি। যেমন, হঠাৎ রাস্তায় আপনার এক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল আর আপনি খানিকটা অভিমান নিয়ে বললেন, “দোস্ত! সেই যে রিইউনিয়নে দেখা হল, তারপর তো তোর আর কোন খবরই নাই!”
এই যে বন্ধুর সাথে রিইউনিয়নে দেখা হওয়া, এই তথ্যটা আপনি হয়ত এতদিন একবারো মনে করেননি, মনে করার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু আজকে কথা প্রসংগে মনে করতে পারলেন এবং কনশাসলি বললেন। কারন তথ্যটি ছিল আপনার প্রি-কনশাস মাইন্ডে।
এবার আসি সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পার্ট, ‘আনকনশাস মাইন্ড’ এ। হিউম্যান মাইন্ডের সবচেয়ে বড় অংশই হচ্ছে এই আনকনশাস মাইন্ড। অনেকটা ব্ল্যাক হোলের মত, এখানে যেসব তথ্য জমা হয় সেগুলো চাইলেও আমরা আমাদের কনশাস মাইন্ডে আনতে পারিনা, একেবারে চিরতরে হারিয়ে যায়। ঠিক চিরতরে হারায় বলাটা ঠিক না, স্রেফ কনশাস মাইন্ড থেকে হারিয়ে যায়।
হিপনোসিস বা ক্যাথারসিসের মাধ্যমে এই আনকনশাস মাইন্ডের অজানা কথাগুলো পুনরায় কনশাস মাইন্ডে নিয়ে আসা সম্ভব। একবার ভাবুন তো, আপনার, আমার আনকনসাশ মাইন্ডে হাজারো এমন ঘটনা আছে, তথ্য আছে যেগুলো সম্পর্কে আমাদের কোন ধারনাই নেই, হয়ত বেচে থাকতে থাকতে কোনদিন ধারনা হবেও না। চিন্তা করলেই কেমন অদ্ভুত একটা অনুভুতি হয়, তাইনা?
♣ কনফ্লিক্ট
কনভারশন বোঝার জন্য কনফ্লিক্ট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সোজা বাংলায় কনফ্লিক্ট বলতে আমরা কি বুঝি? “দ্বন্দ্ব “। সাইকোলজিতেও কনফ্লিক্ট মানে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব৷ তবে এই দ্বন্দ্বের আবার প্রকারভেদ আছে-
♦এপ্রোচ-এপ্রোচ কনফ্লিক্ট
দুই বা ততোধিক পছন্দনীয় বিষয়ের মধ্যে কোনটা বাছাই করবেন সেটা নিয়ে দ্বন্দ্ব। যেমন, আপনার পছন্দের একটা ব্র্যান্ডের দোকানে ঢুকলেন, দুটো শার্ট আপনার পছন্দ হল, দুটোই আলাদা আলাদা ভাবে আপনার বাজেটের মধ্যে। সেক্ষেত্রে দুটোর মধ্যে কোনটিকে বেছে নিবেন সেটি নিয়ে আপনার মনে শুরু হয়ে গেল দ্বন্দ্ব।
♦এপ্রোচ-এভয়ডেন্স কনফ্লিক্ট
একটি পছন্দনীয় ও একটি অপছন্দনীয় বিষয়ের মধ্যে কনফ্লিক্ট। উদাহরণস্বরূপ, জন্মদিন উপলক্ষে আপনার ওয়াইফ আপনাকে একটি শার্ট কিনে দিতে দোকানে নিয়ে গেল। তিনি যে শার্টটি দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে গেলেন আপনার সেটি একেবারেই ভাল লাগল না। আপনার ভাল লাগল পাশের হ্যাংগারেই ঝুলতে থাকা আরেকটি শার্ট।
কিন্তু স্ত্রীর মন খারাপ হয়ে যাবে ভেবে বিষয়টি তাকে বলতেও পারছেন না। এখন আপনি কি করবেন? সাহস করে নিজের পছন্দের জিনিসটি বেছে নেবেন নাকি স্ত্রীর মন রক্ষার জন্য অপছন্দনীয় শার্টটা নিয়েই বাড়ি ফিরবেন?
♦এভয়ডেন্স-এভয়ডেন্স কনফ্লিক্ট
দুটো অপছন্দনীয় বিষয়ের মধ্যে কনফ্লিক্ট। ধরুন কিশোর বয়সে আপনি আপনার বাবার সাথে গিয়েছেন শার্ট কিনতে। দোকানী আপনার বাবার বাজেটের মধ্যে দুরকমের শার্ট দেখাল, আপনার বাবা জিজ্ঞেস করছেন কোনটা নিবেন, কিন্তু আপনার আসলে দুটোর একটাও পছন্দ হয়নি৷ কিন্তু বাবাকে বলতে পারছেন না কারন আপনি জানেন আপনার বাবার এর চেয়ে বেশি বাজেট নেই। আপনি তখন কোনটি বেছে নেবেন?
উপরের প্রতিটি উদাহরণ আমাদের জীবনে অহরহ ঘটতে থাকা ছোট খাটো কিছু কনফ্লিক্ট, এগুলো সমাধান করা কিংবা মেনে নেয়া খুব একটা কঠিন হয়না হয়ত। কিন্তু ফ্রয়েডের মতে যখন কোন মানুষ জীবনে এমন কোন কনফ্লিক্টের সম্মুখীন হয় যেটা সমাধান করা বা মেনে নেয়া তার সাধ্যের বাইরে, তখন সেটা তার মধ্যে প্রচন্ড চাপ বা স্ট্রেসের সৃষ্টি করে। এই চাপ মোকাবিলা করার ক্ষমতা সবার সমান না।
একই মানসিক চাপ কেউ হয়ত সহ্য করে নিতে পারে, কেউ পারেনা।
যারা পারে তাদের কোন সমস্যা হয়না, কিন্তু যারা সেটা পারেনা তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই এই মানসিক কষ্টটা শারীরিক কষ্ট হয়ে প্রকাশ পায়। হঠাৎ করেই দেখা যায় মানুষটার হাত পা অবশ হয়ে গেছে, হাটতে পারছেনা, কানে শুনতে বা কথা বলতে পারছেনা। কারো কারো দেখা দেয় খিচুনী। এবং অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও তার এই সমস্যার কোন কারন ধরা পড়ে না। পুরো ব্যাপারটাই ঘটে থাকে পেশেন্টের অবচেতন মনে।
আমাদের মস্তিষ্ক সবসময় চায় আমাদের কষ্ট কমাতে, হোক সেটা শারীরিক বা মানসিক। মস্তিষ্ক যখন দেখে ব্যক্তি তার মানসিক কষ্ট আর নিতে পারছেনা তখন তার শরীরের কোন একটি অংশের মাধ্যমে সেটি “এক্সটার্নালাইজ” করে দেয় যার ফলে ওই ব্যক্তির মনে চেপে রাখা কষ্টটা কমে যায়। এটাকে বলে ‘প্রাইমারি গেইন’। আর পরবর্তীতে অসুস্থতাজনিত কারনে ব্যক্তিকে যখন তার চাপের জায়গা বা দ্বায়িত্বগুলো থেকে সাময়িক মুক্তি পায়, সেটা হল তার ‘সেকেন্ডারি গেইন’।
আমার সেই পেশেন্ট নুসরাতের কেসটা নিয়ে একটু আলোচনা করলেই বিষয়টা বুঝতে আরো সহজ হবে৷ নুসরাত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তার স্ট্রেস সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। নুসরাত পড়ালেখায় একটু দূর্বল ছিল। ক্লাস এইটে ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার পর তার রেজাল্ট খুব একটা ভাল হয়না, ফলস্বরূপ তাকে স্কুল থেকে সাইন্স নিতে দেয়া হয়না। কিন্তু নুসরাতের বাবার প্রবল ইচ্ছা মেয়েকে তিনি সায়েন্সেই পড়াবেন। এজন্য তিনি নুসরাতের স্কুল চেঞ্জ করে দেন। অন্য স্কুলে তাকে সাইন্স নিতে দেয়া হয় কিন্তু সাইন্সের পড়াশুনা নুসরাতের জন্য খুব কষ্টকর হয়ে যায় যার ফলে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় সে তিন সাবজেক্টে ফেল করে।
মেয়ের এইরকম রেজাল্ট জানার পর নুসরাতের বাবা তাকে প্রচন্ড বকাঝকা করেন। নুসরাত সেদিন রাতে খুব কান্নাকাটি করে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নুসরাত আর হাটতে পারেনা। এখানে হাটতে না পারাটা নুসরাতের প্রাইমারি গেইন, আর হাটতে না পারার কারনে নুসরাতকে আর স্কুলে যেতে হচ্ছেনা, পড়াশুনা করতে হচ্ছেনা এটা তার সেকেন্ডারী গেইন।
নুসরাতের ক্ষেত্রে আরেকটি ভালনারেবল ফ্যাক্টর ছিল তার ব্যক্তিত্ব। ছোটবেলা থেকেই নুসরাত খুব চুপচাপ, শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। সহজে মনের কথা কাউকে বলতে পারেনা। নুসরাতের কোন ভাই-বোন নেই, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা প্রচন্ড বদমেজাজী। ছোটবেলার বেশিরভাগ সময় তাই নুসরাতের কেটেছে একা একা, নিজের সাথেই নিজের মনের কথা শেয়ার করে। তেমন কোন বন্ধুবান্ধবও তার ছিলনা।
♣ কনভার্শন ডিজঅর্ডার রোগের ভবিষ্যত
কনভার্শন ডিজঅর্ডারের রোগের ভবিষ্যত বা প্রগনোসিস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাল। বিশেষ করে যদি রোগটি অল্প বয়সেই শুরু হয়, লক্ষন দেখামাত্রই চিকিৎসা শুরু করা যায়, রোগীর স্ট্রেসর খুজে পাওয়া যায় এবং “স্ট্রেস মডিফিকেশন” ও “স্ট্রেস কোপিং স্ট্র্যাটেজি” ভালভাবে শিখিয়ে দেয়া যায় তাহলে রোগী খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে এবং ভবিষ্যতে এই রোগটি পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যায়।
অনেকসময় হয় যে, রোগীর স্ট্রেসর খুজে পাওয়া যায়না৷ রোগী জানেই না কেন তার এই অসুখটা হল, কী তার কষ্ট। সাধারনত বড় ধরনের কোন দূর্ঘটনা বা মানসিক চাপ যেমন সেক্সুয়াল এবিউজ, প্রিয় মানুষের মৃত্যু এসব ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক ব্যক্তির এই কষ্টকর স্মৃতিটা তার “আনকনশাস মাইন্ডে” পাঠিয়ে দেয়। ফলে রোগীকে আমরা যতই এক্সপ্লোর করিনা কেন, রোগী তার কষ্টের কারনটা বলতে পারেন না৷ তবে স্ট্রেসর খুজে না পেলেও কনভার্শনের চিকিৎসা অনুযায়ী সময় নিয়ে চিকিৎসা করে গেলে রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব।
" Unexpressed emotions will never die. They are buried alive and will come forth later in uglier ways."
---------------- Sigmund Freud
কাজেই, কনভার্শন ডিজঅর্ডার কোন ভান বা অভিনয় না। এটাও আর দশটা মানসিক রোগের মতই একটা রোগ। তাই কনভার্শনের রোগীকে ব্যংগ-বিদ্রুপ কিংবা বকাঝকা না করে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন, সম্ভব হলে যথাযথ চিকিৎসা পেতে সাহায্য করুন।
যেই মন নিয়ে আমাদের এত কবিতা, এত গান, এত আবেগ, একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই মন আর মনের অসুখকে কি অবহেলা করলে চলে?
[Reference books:
* Kaplan & Saddocks Textbook of Psychiatry
* Psychology by Andrew B. Crider]
Writer: Mahabuba Rahman