ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রণজিৎ গুহ স্মরণে



শতবর্ষ পূরণের কিছুদিন আগে চলে গেলেন বিশ শতকের ইতিহাস চর্চার অন্যতম স্তম্ভ অধ্যাপক রণজিৎ গুহ। অধ্যাপক গুহ এবং তাঁর সঙ্গীরা মিলে "নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা" নামে যে ইতিহাস রচনার ধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন তার প্রভাব আমাদের দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও পৌঁছেছিল। এই কাজে অধ্যাপক রণজিৎ গুহর বিশিষ্ট সহকারীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক গৌতম ভদ্র, অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী, অধ্যাপক জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, অধ্যাপক শাহিদ আমিন, অধ্যাপিকা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রমুখ। 

নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা বিপ্লবী রাজনীতি থেকে তার প্রেরণা সংগ্রহ করেছিল। ষাট সত্তর দশকের নকশালবাড়ি আন্দোলন যে তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, সেকথা অধ্যাপক রনজিৎ গুহ নিজেই জানিয়েছেন।

ছাত্র অবস্থা থেকেই বাম এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন রণজিৎ গুহ। তবে ১৯৫৬ সালে স্তালিনের মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় ক্রুশ্চেভ ঘোষিত নিস্তালিকীরণের দিনগুলিতে সোভিয়েত রাশিয়া যখন হাঙ্গেরি আক্রমণ করল, সারা বিশ্বের নানা দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী নিজ নিজ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো থেকে সেইসময় সরে আসলেন। অধ্যাপক রণজিৎ গুহও ছিলেন তাঁদের মধ্যে।

অধ্যাপক রনজিৎ গুহ আবারো সক্রিয় রাজনীতির দিকে ঝুঁকলেন ৭০ এর দশকে। তিনি নিজেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং চারু মজুমদার তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। সে সময় অধ্যাপক গুহ ইংলণ্ডের সাসেক্সে অধ্যাপণা করছিলেন ও এই সুবাদে তিনি অবিভক্ত সিপিআই (এম এল) এর বিদেশ দপ্তরের কিছু দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে দিল্লিতে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়ানোর সময় তিনি আন্দোলনের সঙ্গীসাথীদের গোপন আস্তানার ব্যবস্থা করা সহ নানাভাবে পার্টিকে সাহায্য করেছিলেন। 

সি পি আই এম এল রাজনীতির প্রথম ধারাটি ভেতরের কিছু ভুলভ্রান্তি এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে পড়ে দমিত হলো, কিন্তু অধ্যাপক রনজিৎ গুহ এই রাজনীতি থেকেই খুঁজে পেলেন ইতিহাসচর্চার নতুন দৃষ্টিকোণ। তাঁর মনে হল ইতিহাস চর্চা মূলত উচ্চ বর্গর দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখা হয়েছে। দরকার নিম্নবর্গের দৃষ্টিতে ইতিহাস লেখা, যা সেভাবে এতাবৎ হয় নি। এই ভাবনা থেকেই নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা নামক একটি নতুন ধারার জন্ম দিলেন তিনি ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা।

অধ্যাপক রনজিৎ গুহর ইতিহাস চর্চার দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাবো সেখানে অধ্যাপক রনজিৎ গুহ ভীষণভাবেই নজর দিয়েছেন কৃষক প্রশ্নের দিকে, জমির অধিকার এবং তার সুষম বন্টনের দিকে। আমরা সবাই জানি যে কৃষক আন্দোলন এবং জমি আন্দোলন ভারতবর্ষের বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন তথা নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল।

‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রপাত’ নামে একটি ছোট কিন্তু বীজগর্ভ বই লিখেছিলেন অধ্যাপক গুহ। বঙ্কিমচন্দ্র যাকে বলেছিলেন 'আধুনিক বাঙালি সমাজের ভিত্তি' সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নির্মাণ কীভাবে হয়েছিল এই বইটিতে অধ্যাপক রণজিৎ গুহ সেইটা দেখান। অধ্যাপক রনজিৎ গুহ যখন ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনগুলির ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের পেছনে লুকিয়ে থাকা কৃষক চৈতন্য বা মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবছিলেন তখন আমরা বুঝতে পারি সেখানেও তাঁর কমিউনিস্ট শিকড়, নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং চারু মজুমদারের প্রতি তাঁর আগ্রহের প্রভাব পড়েছে। 

Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India বইটি ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে একটি মাইলস্টোন। তাঁর অন্যান্য বইপত্রের মধ্যে আছে 

History at the limit of world history, 

Dominance without Hegemony: History and Power in Colonial India, 

The Small Voice of History ইত্যাদি।

জীবনের শেষ সিকি শতকে রণজিৎ গুহ মূলত লিখেছেন বাংলা ভাষাতেই। ইতিহাসের পরিধি ছাড়িয়ে সাহিত্য, দর্শন, বাঙালি মনীষার অবদানের নানা দিককে ছুঁতে চেয়েছে তাঁর লেখালিখি৷ এগুলির সংকলন প্রকাশিত হওয়ার পর তার আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর শিষ্যপ্রতিম অধ্যাপক গৌতম ভদ্র দেখিয়েছেন কীভাবে রামমোহন রায় ভাবিত দয়া ও বঙ্কিমচন্দ্র ভাবিত বাহুবলের বৈপরীত্য বিচারে রণজিৎ গুহ এগিয়েছিলেন। এই আলোচনাই কীভাবে প্রসারিত হয় উত্তররামচরিতের বিদ্যাসাগরী ও বঙ্কিমী পাঠের বিতর্কে, পারিবারিক ন্যায়ধর্ম ও লোকোত্তর রাজধর্মের নৈতিক বিচারে সেই পাঠও এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। শরীরে বৃদ্ধ হয়েও মননে সজীব থেকে অধ্যাপক গুহর খোঁজ চলতে থাকে। তারই ফল দেখি ধর্মনীতি ও রাজনীতির চিরায়ত ভারতীয় গ্রন্থের একটি মৌলিক পাঠে, ভারত যুদ্ধের ‘দু’-তিন দিন’-এর কথনে ও বিশ্লেষণে।

ইতিহাসের পাশাপাশি রণজিৎ গুহর সাহিত্য আলোচনার বিষয়তালিকাও দীর্ঘ, আলোচনাও নানামুখী। যৌবনে লেখা ম্যাকবেথের অনুবাদ বিতর্ক থেকে প্রৌঢ়ে তিনি তাঁর অভিনিবেশ নিবদ্ধ করেছিলেন বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির নানা দিকে। এর মধ্যে ছিল 'সমর সেনের কাব্যচৈতন্যে দায়বোধ ও জীবনানন্দ দাশের কবিতার সময়বোধের সঙ্গ ও অনুষঙ্গ বিচার।' ছিল 'রবীন্দ্রনাথের ‘ত্রিগীত’ (গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতালি) থেকে রবীন্দ্রোত্তর পর্বের তিন বিশিষ্ট কবি - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙখ ঘোষ, উৎপলকুমার বসুর আমিত্বের বিশ্লেষণ।' এই লেখার সময় অধ্যাপক রণজিৎ গুহর বয়েস প্রায় নব্বই, একথা ভাবলে আমাদের অবাক হতে হয়। 'বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃতি ও সাহিত্যভাবনায় স্বকাল থেকে মহাকাল, স্থানিক থেকে বিশ্ব তথা অধ্যাত্মজগতের চিন্তার অভিমুখে যাতায়াত' নিয়ে তিনি যখন লিখছেন তখন তিনি নব্বই পেরিয়েছেন। ভাষার নানা নির্দেশ, যেমন নাম ও সর্বনামের খেলার নিয়ম নিয়ে এই বয়সে কীভাবে তিনি এত শাণিতভাবে ভাবতে পেরেছেন তা বিষ্ময় জাগায়।

কমিটেড বুদ্ধিজীবী বলতে যা বোঝায় অধ্যাপক রণজিৎ গুহ ছিলেন তাই। কমিটেড বুদ্ধিজীবীর মননচর্চাও যে সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তকে ছুঁতে পারে, নানা দিকে অগ্রসর হতে পারে তার প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে রণজিৎ গুহর রচনাসংগ্রহ।


তথ্যসূত্রঃ

ইংরাজী আকরগুলির নাম লেখার মধ্যে আছে। গৌতম ভদ্রের উক্ত পুস্তক সমালোচনাটি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। 

দুই খণ্ডে রণজিৎ গুহর রচনাসংগ্রহের প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম