ঘুর্ণিঝড় বিস্তারিত



◼️ ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্টি হওয়া প্রচন্ড বৃষ্টি ও বজ্রপাতসহ ঘূর্ণাবর্ত।
মূলত ঘূর্ণিঝড়গুলো নিরক্ষীয় অঞ্চলে নিম্নচাপের ফলে সৃষ্টি হয় এবং এর মাধ্যমে নিরক্ষীয় অঞ্চলের তাপ মেরু অঞ্চলে স্থানান্তর হয়।ঘূর্ণিঝড় বলতেই আমরা বুঝি বাতাসের ঘূর্ণি,আসলেই তাই, ঘূর্ণিঝড়ে বাতাস প্রচন্ড বেগে ঘুরতে ঘুরতে অগ্রসর হয় জন্যেই এমন নামে ডাকা হয়।

 পৃথিবীর আবহাওয়ায় তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় থাকে ঘূর্ণিঝড়ের মাধ্যমে,যেকারনে উত্তর গোলার্ধের ঘূর্ণিঝড় গুলোর ঘূর্ণনের দিক হয় ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধের ঘূর্ণিঝড় গুলোর ঘূর্ণন হয় ঘড়ির কাটার একই দিকে।পৃথিবীতে প্রতিবছর অনেক ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলেও সবগুলো ক্ষতি করে না,বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড় সমুদ্রেই মিলিয়ে যায় এবং গুটিকয়েক ঝড় তীরের কাছাকাছি আসে এবং মারাত্মক ধ্বংসলীলা চালায়।বিজ্ঞানীদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতিবছর গড়ে ৮০ টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়।
ঘূর্ণিঝড় সমুদ্র তীরের কাছাকাছি আসলে স্থলভাগে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হয় এবং তীরের জনবসতিতে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

 তীব্রতা অনুসারে প্রকারভেদ -
১/ আটলান্টিক অঞ্চলে বাতাসের গতিবেগ ৬২ কিমি/ঘ এর নিচে থাকলে তাকে নিম্নচাপ বলে,৬২কিমি/ঘ অতিক্রম করলে একে একটি নাম দেওয়া হয়,৬২-১১৭ কিমি/ঘ গতিতে বাতাস ধাবিত হলে তাকে বলে ট্রপিক্যাল স্টর্ম,১১৭+ কিমি/ঘ হলে একে "হ্যারিকেন" পর্যায়ে উন্নীত করা হয়।উল্লেখ্য,আবিষ্কারকের নামানুসারে একে "সাফির - সিম্পসন স্কেল" বলা হয়।
২/ বাংলাদেশ - ভারত অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়কে ৪ টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে,বাতাসের গতিবেগ ৬২-৮৮ কিমি/ঘ হলে একে ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বলে,৮৯-১১৭ কিমি/ঘ হলে তাকে বলে "সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম",১১৮-২১৯ কিমি/ঘ হলে একে বলে ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম,২২০ কিমি/ঘ এর বেশি হলে তাকে বলে সুপার সাইক্লোন।


 অঞ্চলভেদে ঘূর্ণিঝড়ের নাম ভিন্ন হয়(হ্যারিকেন/টাইফুন/সাইক্লোন),আবার বোঝানোর সুবিধার্থে প্রত্যেকটি ঘূর্ণিঝড়েরও নাম আলাদা আলাদা হয়।
- ঘূর্ণিঝড় বোঝাতে সাইক্লোন শব্দটা বেশি ব্যবহৃত হয়,শব্দটি গ্রীক "ক্লাই ক্লোস" থেকে এসেছে যার অর্থ বৃত্ত বা চাকা।১৮৪৮ সালে হেনরি পিডিংটন তার "Sailor's Horn Book for the Law of Storms" বইয়ে সর্বপ্রথম ঘূর্ণিঝড় বোঝাতে "সাইক্লোন" শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন!
- আমেরিকা অঞ্চলের ১১৭ কিমি/ঘ এর বেশি গতিসম্পন্ন ঝড়ের তীব্রতা বোঝাতে "হ্যারিকেন" শব্দটা ব্যবহৃত হয়,মূলত মায়ান দেবতা "হুরাকান" এর নামানুসারে বলা হয়ে থাকে হ্যারিকেন ।
- চীন/জাপান অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় "টাইফুন",শব্দটি এসেছে "টাই - ফেং" থেকে যার অর্থ হচ্ছে প্রচন্ড বাতাস।অনেকে মনে করেন ফার্সি শব্দ "তুফান" থেকে টাইফুন এসেছে,তুফান শব্দ দ্বারাও ঝড় জাতীয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে বোঝায়।

▪️আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে যে মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় সে অঞ্চলে অবস্থিত দেশগুলোই ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করেন,মূলত সাধারণ মানুষের কাছে ঝড় সম্পর্কে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্যেই এমন ব্যবস্থা,নইলে একই সময়ে সমুদ্রে একাধিক ঝড় অবস্থান করলে নির্দিষ্ট করে বোঝানো সম্ভব হয় না।
▪️আগেকার দিনে ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করা হতো ওই ঝড়ে ডুবে যাওয়া কোনো জাহাজএর নাম/ঝড়ের আছড়ে পড়া এলাকার নামানুসারে,অথবা অক্ষাংশ/দ্রাঘিমাংশ হিসেব করেও নাম করা হতো,কিন্তু এসব সাধারণ মানুষদের জন্য সহজ হতো না, যার কারণে সতর্কবার্তা পৌঁছানো জটিল হয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে এসব ঝামেলা এড়াতে ২০০০ সালে ঘূর্ণিঝড়ের নির্দিষ্ট নামকরণের জন্যে নিয়ম প্রবর্তন করা হয়!
▪️নিয়মগুলো প্রবর্তিত হয় World Meteorological Organization (WMO) এবং United Nations Economic and Social Commission for Asia and The Pacific এর সদস্যদেশগুলোর মাধ্যমে,এবং তারাই ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করেন।সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে নাম চেয়ে নেওয়া হয় এবং বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার বৈঠকে নাম নির্বাচন করা হয়।যেসব নিয়ম ফলো করা হয় সেগুলো নিম্নরূপ :

১/ প্রস্তাবিত নামসমূহ যেনো কোনো রাজনৈতিক দল/ব্যক্তি/ধর্ম/লিঙ্গ সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট না হয়।
২/ নামগুলো যেনো অসাম্প্রদায়িক হয়,অর্থাৎ কোনো দেশ/জাতি/জনগোষ্ঠীর অনুভূতিতে আঘাত না করে।
৩/ নামের মধ্যে রুক্ষতা/নির্মমতা/নিষ্ঠুরতা প্রকাশ যেনো না পায়।
৪/ নাম হতে হবে ছোট,সহজে উচ্চারণ করা যায় এমন।
৫/ নামের অক্ষর সর্বোচ্চ ৮ টি হবে।
৬/ প্রস্তাবিত নামের সাথে সাথে উচ্চারণ নির্দেশিকা ও ভয়েস রেকর্ড দিতে হবে।
৭/ সর্বশেষ ও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হচ্ছে নাম হতে হবে একক,আগে ব্যবহৃত হয়েছে এমন নয়।

 ২০০৪ সাল থেকে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করে ৮ টি দেশ,দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ,ভারত,মালদ্বীপ,মায়ানমার,পাকিস্তান,শ্রীলংকা, ওমান ও থাইল্যান্ড (পরবর্তীতে আরো ৫ টি দেশকে ২০১৮ সালে এই তালিকায় যুক্ত করা হয়,দেশগুলো হচ্ছে ইরান, কাতার,সৌদি আরব,ইয়েমেন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত)
এই অঞ্চলে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে ৮ টি দেশের প্রত্যেকটি থেকে ৮ টি করে সর্বমোট ৬৪ টি নাম গ্রহণ করে বৈঠকের মাধ্যমে নাম বাছাই করা হতো।যদিও পরে যুক্ত হওয়া দেশগুলোর থেকেও ৫ টি করে মোট দেশপিছু ১৩ টি এবং সর্বমোট ১৬৯ টি নাম থেকে বাছাই করা হয়।
এই অঞ্চলের প্রথম নামকরণ করা ঘূর্ণিঝড়ের নাম ছিল "অনিল" এবং নামটি গ্রহণ করা হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে।তালিকার সর্বশেষ নামটি হচ্ছে "তৌক্তে" যার ইংরেজি বানান হচ্ছে 'tauktae', উচ্চারণ যেমনই হোক!

♠️ 'Tauktae' পর্ব -
এই ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণে নির্বাচিত হয়েছে মায়ানমারের দেওয়া "Tauktae" নামটি যার অর্থ হচ্ছে উচ্চ আওয়াজ করতে সক্ষম একপ্রকার টিকটিকি,মায়ানমারের স্থানীয় ভাষায় একে বলে "গেকো"!
আরব সাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়টি আগামী মঙ্গলবার ভারতের গুজরাট অংশে আঘাত হানবে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।

- সমাপ্তি


Writer: Moshiur Hasan

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম