বিজ্ঞানভিত্তিক আর্টিকেলগুলো আমার বেশ ভালোই লাগে পড়তে। কাটখোট্টা শব্দ ও পরিসংখ্যানের জটিলতা এড়িয়ে খুব সুন্দর ও সহজভাবে বিজ্ঞানের নানান বিষয় সম্পর্কে জানার ও বোঝার জন্য এদের জুড়ি নেই। মাত্র শেষ করে ওঠা এটাই সায়েন্স বইটিও আমার কাছে সেরকমই সুখপাঠ্য তবে বিশাল আর্টিকেল মনে হয়েছে, যার মূল বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের প্রাণে হওয়া পানিবাহিত রোগ সম্পর্কিত নানান গবেষণার গল্প, এদের সম্ভাবনা ও জটিলতা নিয়ে আলোচনা ও কীভাবে একটি পৃথিবীব্যাপী মহামারী সাধারণ মানুষের মূলধারার বিজ্ঞান আলোচনার বিষয়বস্তু রাতারাতি পাল্টে দিল।
লেখকের আইসিডিডিয়ার,বির অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি শুরু করেছেন তার বইয়ের প্রথম অংশ। ওলাইচন্ডীর বিপদসংকেত অধ্যায়ে তিনি বলেছেন মরণব্যাধি কলেরা সম্পর্কে কীভাবে আগে থেকেই বিপদসংকেত দেয়ার বুদ্ধিটা বের করেছিলেন একদল বিজ্ঞানী। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া সমুদ্রে শ্যাওলার সালোকসংশ্লেষণের হারের সাথে আদতে হিমালয়ের পাদদেশে বাতাসের তাপমাত্রার তথ্য কীভাবে মিলিয়ে আমরা কলেরার প্রকোপের ব্যাপারে আগে থেকেই জানতে পারি তা বুঝতে হলে আপনাকে এই অধ্যায়টা অবশ্যই পড়তে হবে।
এরপরের অধ্যায়েই লেখক শুরু করেছেন এক দানবের গল্প যার ঘুম ভাঙানোর দায় বর্তায় আমাদের ওপরেই। মাটির নিচে এক ভয়ানক দানবের বাস জানেন তো? সত্তুরের শতকে পানবাহিত রোগ-শোকের হাত থেকে বাঁচতে পরিষ্কার পানির খোঁজে পাতালের বুকে খোড়া হয়েছিল কোটি কোটি গর্ত, নলকূপে ছেয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ।
দানব অবশ্য দেখছিল একগাদা জানালা মর্ত্যে উঠে আসার জন্য !
পাতালের দানব অধ্যায়ে লেখক গল্প শুনিয়েছেন সেই দানবের গল্প যাকে আমরা এখন আর্সেনিক নামে চিনি। আর্সেনিক কী করে আমাদের মাটির নিচে এসে জমা হল এবং কীভাবেই বা পানির সাথে মিশে গেল সেসব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। পুরো বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানি কী করে পরীক্ষা করা হল এবং কী কী পদক্ষেপ গ্রহন করলে আর্সেনিক সমস্যার সমাধান করা যাবে তা চমৎকারভাবে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা সহকারে ব্যাখা করেছেন লেখক। আবার সমস্যার সমাধান কী করে নতুন সমস্যার জন্ম দিল তাও জানা যাবে এই অধ্যায়ে।
পরের অধ্যায়ে আবারো কলেরার জীবাণুর কথা ফিরে এসেছে তবে কিছুটা রয়ে সয়ে। শাড়ি বনাম ওলাইচণ্ডী অধ্যায়ে লেখক শুরু করেছেন গবেষণার গুরুত্ব দিয়ে। দীর্ঘ ষোলো বছর চায়নায় একগাদা বাদুরের ওপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা আমদের কী উপকার করেছেন সে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে মূল বিষয় ছিল, বিজ্ঞানীরা যা কিছু নিয়েই গবেষণা করুক না কেন সেটা কোনো না কোনো কাজে লাগেই। যেমন, চায়নার বাদুড়ের ওপর হওয়া গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা আমাদের গত এক দশক আগে থেকেই করোনা ভাইরাস মহামারীর ব্যাপারে সতর্ক করে আসছিলেন, এটা কি আপনারা কেউ জানতেন? আমিও জানতাম না। দেশীয় পটভূমিতে লেখক উল্লেখ করেছেন কলেরার জীবাণু পানিতে কার সাথে থাকে সেটা বের করার জন্য গবেষণার কথা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, কী দরকার বাপু এ নিয়ে গবেষণা করার? তারচে’ বরং বের করার চেষ্টা কর কীভাবে একে প্রতিরোধ করা যায় সেটা নিয়ে।
কিন্তু এই চমৎকার গবেষণার ফল কিন্তু অনেকবছর পর ঠিকই কাজে লেগেছিল। কলেরা থেকে বাঁচতে খুবই সাধারণ একটা আইডিয়া ব্যবহার করা হয়েছিল যাতে একটী পয়সাও খরচ হয়নি। সেই আইডিয়াতে কাজে লেগেছিল কলেরা জীবাণূ পুকুরে কাদের মাঝে থাকে সে ব্যাপারে গবেষণা।
লেখকের এই অধ্যায়টা মনে হয়েছে সবচেয়ে যত্ন করে লেখা। গবেষণার গুরুত্ব অংশটুকু পাঠকরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন। এমনকি কোটি কোটি টাকা খরচ করে স্পেস রিসার্চ করার প্রয়োজন কী সেটার উত্তরও নিজেই দিতে পারবেন। সামানু শাড়ির ব্যবহার কীভাবে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে ভূমিকা রাখল সে অংশটুকু অনেক রোমাঞ্চকর। বিজ্ঞানীদের সুপারহিরো মনে হয়। এখানে উল্লেখিত কলেরার জীবাণুর হোস্ট খুঁজতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার সম্ভবত এই বইয়ের সবচেয়ে সুন্দর অংশ, কারণ এখানে আমরা দেখি সামান্য কিছু জীবাণূ, প্লাঙ্কটন ল্যাবে চাষ করতে গেলে কী পরিমাণ ঝামেলা পোহাতে হয় এবং কী কী জটিলতার মোকাবেলা করতে হয় সেসব নিয়ে আলোচনা আমার মনে হয় সাধারণ পাঠকদের কিছু হলেও বিজ্ঞানের পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেবে, এবং ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীদের কোনো গবেষণার কথা সামাজিক মাধ্যমে দেখলে হাহা দেয়ার আগে সামান্য চিন্তা করবে। তবে তার আগে সেসব মানুষের কাছে বইটি পৌছাতে হবে বৈকি !
শৌচ সমাচার হচ্ছে আমার সবচেয়ে প্রিয় অধ্যায়। লেখকের সতর্কীকরণ উপেক্ষা করে অধ্যায়টি আমি পড়েছি দুপুরের খাবারের সময়ই। ঘেন্না লাগেনি, বরং মজা পেয়েছি। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর অবস্থা জানেন? কত শতাংশ মানুষ খোলা মাঠে হাগে তা জানেন? তার বিপরীতে আমাদের দেশে কী তেমন চোখে পড়ে খোলা মাঠে হাগা? পড়ে না। কেন বলুন তো?
দাড়ান দাড়ান, লেখকের মত আমি এত বিনয়ী নই বলেই মলত্যাগের সভ্য জগতের ভাষা পরিহার করার আগে সতর্ক করার জন্য বা ক্ষমা চেয়ে একটা প্যারাগ্রাফ অপচয় করিনি। তবে আত্মপক্ষ সমর্থনে আমি জানিয়ে রাখি মলত্যাগের পরিবর্তে এই এক হাগা শব্দের কারণেই বাংলাদেশের মানুষ খোলা আকাশের নিচে মনের সুখে প্রাকৃতিক কাজ সারতে ঘেন্না করেন। কীভাবে? তা জানতে বইটি পড়ুন।
সত্য বলতে, এই অধ্যায়টা আমার সবচেয়ে পছন্দের হওয়ার পেছনে কারণ হল ডক্টর কমল করের চমৎকার টেকনিক কাজে লাগানোর উপায়। সারা বাংলাদেশ ঘুরে তিনি মানুষের মনে খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করার প্রতি ঘৃণা জন্মাতে পেরেছিলেন বলেই আজ তার টেকনিক কাজে লাগাচ্ছে বিশ্বের অর্ধশত দেশ।
এই অধ্যায়ে ডক্টর কমল করের গ্রামবাসীর সাথে কখোপকথনের যে অংশ লেখক তুলে ধরেছেন তা বেশ মজার ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে। আরেকটি বিষয় যেটি লেখক এই অধ্যায় এবং গত অধ্যায়ে পরিষ্কার করেছেন তা হল, রোগ বালাই রোধে নতুন পদ্ধতি শুধু আবিষ্কার করলেই হয় না, সেই পদ্ধতি একইসাথে সাধারণ মানুষের ব্যবহারযোগ্য হতে হবে। সেই পদ্ধতি অনুসরণ করতে সাধারণ মানুষের যদি সামান্য সমস্যাও হয় বা দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ বিপত্তিও তারা অনুভব করে তাহলে তাদের দ্বারা সেটা অনুসরণ করানো কখনোই যাবে না। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টির দিকে আমাদের সম্মানিত বিজ্ঞানীরা নজর দিতে পেরেছেন বলেই কলেরা, টাইফয়েড বা ডায়েরিয়ার মত রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।
পরবর্তী অধ্যায়ে রোহিঙ্গাদের পানি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই যে আমাদের ছোট্ট দেশের ছোট্ট অংশে লাখ দশেক রোহিঙ্গা শরণার্থী আছেন তাদের কলেরা হয় না কেন? গাদাগাদি পরিবেশ, পানি সমস্যা, এক বাথরুম হাজারজন ব্যবহার করা, সবই তো কলেরা হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে?
আমাদের বিজ্ঞানীরা অতি চালাকির সাথে আগেই অনুমান করতে পেরেছিলেন এমন কিছু হতে পারে, তাই শুরুতেই ধরে ধরে সবাইকে ভ্যাক্সিন দেয়ানো হয়েছিল, যার ফলে কলেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি।
এই যে একটি ক্ষুদ্র জায়গায় অনেক মানুষের বসতি, এই জায়গা বিজ্ঞানীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা এখানের পানির ওপর গবেষণা করলেন বহুদিন। উদ্দেশ্য, পিট ল্যাট্রিনের ব্যবহার কী ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করে কীনা তা বের করা। সেই গবেষণার গল্প পাবেন আপনি এই অধ্যায়ে।
ট্যাবলয়েড বিজ্ঞান অধ্যায়ে এসেছে কী করে খবরের চ্যানেল দেখার ওপর নির্ভর করতে পারে মহামারীতে আপনার মৃত্যুর ঝুঁকি। অবাক হবেন না, তবে মিডিয়া যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বেশ বড় প্রভাব রাখে তা বলাই বাহুল্য। সেই মিডিয়াতেই যদি প্রচার করা হয় করোনা ভাইরাস এতটাও খারাপ কিছু না, হালকা সর্দি জ্বরের মত, তাহলে যারা এই চ্যানেলের প্রচার দেখবে তাদের দৈনন্দিন জীবনে কীরূপ প্রভাব পড়বে?
তারা ঠিকমতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন না, মাস্ক পড়বেন না, হাত ধোবেন না। এরফলে তাদের এলাকায় তারা করোনা আরো ছড়িয়ে দেবে। এর বিপরীতে যদি মিডিয়াতে করোনা ভাইরাসকে গুরুত্ব দেয়া হয় তাহলে আপনি এসব করবেন না, আপনার এলাকায় সংক্রামণের হার কমে যাবে অনেকখানি।
লেখক এই অধ্যায়ে গুরুত্ব দিয়েছেন মিডিয়া ও করোনায় মৃত্যুর হারের মাঝে কোনো যোগসূত্র আছে কীনা তা নিয়ে হওয়া গবেষণা। আমাদের দেশেই করোনার শুরুতে অনেকেই প্রচার করেছিলেন করোনা এতটাও ভয়াবহ না। সেটা কতজন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে, তা কী তারা জানেন? অথচ এনাদের মাঝে আছেন অনেক ডাক্তার, ধর্মীয় বক্তা ও সেলেব্রিটি। অথচ তাদের কারো উক্ত বিষয়ে কথা বলার মত যথেষ্ট জ্ঞান, পড়াশোনা বা গবেষণা নেই। বইটি পড়ে পরবর্তীতে পাঠকরা হয়তো যে কারো কথা শোনার আগে ভাববেন।
লেখক তার বইটি শেষ করেছেন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সকল গবেষকদের উদ্দেশ্য করে। আপনি অণুজীব, উদ্ভিদ, পানি, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা, নৃ, সমাজ ইত্যাদি যা কিছুই নিয়ে গবেষণা করছেন না কেন তা নিয়ে লিখুন। আপনারা লিখলেই দেশের মানুষের বিজ্ঞানচিন্তার উন্নতি ঘটানো সম্ভব। বিজ্ঞানীদের নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করা জাতি থেকে বিজ্ঞানী তৈরী জাতিতে পরিণত করা সম্ভব।
এছাড়াও লেখক ছোট্ট করে আলোচনা করেছেন কীভাবে বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নালগুলো কাজ করে এবং সেগুলো কীভাবে লেখা হয় আর কী কী জটিলতা থাকে। তিনি খোঁজ দিয়েছেন কীভাবে গবেষণাপত্র পড়তে হয় তা নিয়ে চমৎকার আর্টিকেল।
পরিশেষে বলতে চাই, বিজ্ঞানের নানাবিধ গবেষণার গল্প নিয়ে লেখা বই এমন চমৎকার করে উপস্থাপন করা যায় তা লেখক বেশ পারদর্শীতার সাথেই দেখিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে এটা এই ধাঁচের প্রথম বই হলেও এটাই শেষ নয় সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাকি গবেষকদের। আর পাঠক হিসেবে আমদের দায়িত্ব বইটি পড়ার, ছড়িয়ে দেয়ার।
বইয়ে সবচেয়ে অদ্ভুত লেগেছে “মায়” শব্দটির ব্যবহার। চার জায়গায় অন্তত এই শব্দটি দেখেছি, কিন্তু বাক্যে তার গুরুত্ব বা তাৎপর্য কিছুতেই বুঝিনি। এটা কী আদৌ কোনো শব্দ নাকি টাইপো তা আমি সঠিক জানি না। একটা উদাহরণ দেই,-
“এভাবে দিনের পর দিন,মায় বছরের পর বছর তাদের কাজ চলতে থাকে।”
যাইহোক, এটা এমন কোনো বড় বিষয় না। আর লেখকের মন ভাল করার জন্য বলতে পারি, আমার বাবা আমি ক্লাস টু তে পড়ার সময় গল্পগুচ্ছ কিনে দিয়েছিলেন।
(সমাপ্ত)
মনিফ শাহ চৌধুরী
Tags:
Book Review