বর্তমান বিশ্বে ব্যাপক হারে প্রসার ঘটছে "বস্তুবাদের"। শুধু যে বর্তমান তা কিন্তু নয়, বরং অতীতেও এর চাহিদা ছিল ব্যাপক।গড হাইপোথিসিস মূলতঃ নাস্তিকতা নিয়েই একটা বিশ্লেষণমূলক বই।
👉 প্রথম পয়েন্ট " নাস্তিকতা "। এটা আসলে কি? কেন কিভাবে এর উৎপত্তি? কাদের আচরণের ফলস্বরূপ এটা প্রসার লাভ করেছে? এ সম্পর্কে ক্ষুদ্র আলোকপাত করা হয়েছে বইয়ে।
👉প্রতিটি যুগেই নাস্তিক্যবাদের উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে চার্লস ডারউইনের " ন্যাচারাল সিলেকশন। " যখন হিটলারের "মাইন কাম্ফ ", মাক্সের " ড্যাস ক্যাপিটাল " ডারউইনকে উৎসর্গ করা কিংবা ডারউইন সম্পর্কে স্ট্যালিনের লেখনী ইত্যাদি বিষয়ের দিকে তাকাই, তখন স্পষ্টভাবেই এর প্রভাব দেখতে পাই। নাস্তিক্যবাদের এসব নির্মম ইতিহাস সম্বন্ধও কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হয়েছে।
👉 মূল একটা পয়েন্ট, "বস্তুবাদ "। বস্তুবাদ আসলে কি? জগতে , " বাদ" বলতে কিছু নেই। জড় আছে বা নাই অথবা যেভাবে আছে তো আছে, নাই মানে নাই। জগতে জড়ের অস্তিত্ব আছে, তাই আছে, ব্যস।এই দেখা বস্তুবাদই সত্য। কিন্তু আসলেই কি তাই? , যে জিনিস জড়, তার আবার কিসের "বাদ"? " বাদ" না থাকার কারণেই তো এটা জড়। এটাকে আবার আলাদা বিশ্বাস করতে হবে কেন? লেখক এখানে ফিলোসোফিক্যাল দৃষ্টিতে সাবলীলভাবে এই অসারতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
👉 মূলতঃ বিজ্ঞান,স্রষ্টা আছে কি নাই, এ প্রশ্নের উত্তর দেয় না। কারণ একটা বিষয় ঘটলে প্রথম প্রশ্ন আসে "এটা কেন ঘটেছে? " এর উত্তর আমরা কখনও বিজ্ঞানের কাছে পাবো না। কারণ বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করে "এটা কিভাবে ঘটেছে?" ;; কাজেই "কেন?" এর উত্তর খুজতে আমাদেরকে বিজ্ঞান নয় বরং ফিলোসোফির আশ্রয় নিতে হবে। দর্শনে কোনো নির্দিষ্ট বিশ্বাসের স্থান নেই। এখানে পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয় শুধু, দিন শেষে যার যার যুক্তি অনুযায়ী একটা মত গ্রহণ করে নেয়। স্রষ্টার ক্ষেত্রেও একই!! ★ যে স্রষ্টায় বিশ্বাসী সে আস্তিক, যে বিশ্বাস করে না সে নাস্তিক, সে সন্দেহে আছে যে স্রষ্টা আছে কি না সে সংশয়বাদী, সে এটাকে চিন্তার বাহিরে মনে করে সে অজ্ঞেয়বাদী আর যে এই বিষয়কেই অপ্রাসঙ্গিক মনে করে সে মুক্তমনা।
👉প্রতিটি শিশু সহজাতভাবেই "স্রষ্টায় বিশ্বাসী" হয়ে জন্মগ্রহণ করে। এরপর পরিবেশের প্রভাবে সে বিভিন্ন মতের দিকে ঝুকে পড়ে। আর পরবর্তী সময়ে এসে "স্রষ্টার অস্তিত্ব " অস্বীকার করা এবং বস্তুর উপর অগাধ বিশ্বাস এক ধরনের ব্যাধি বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। বিষন্নতায় ভোগা, misfik syndrome রোগে আক্রান্ত হওয়া, আত্মহত্যার প্রবনতা, অযথা হত্যাকাণ্ড ঘটানো এসব বিষয় নাস্তিকদের মাঝেই অধিক পরিলক্ষিত হচ্ছে। (এ সম্পর্কে বইয়ে যথেষ্ট রেফারেন্স দেওয়া আছে)
👉 এবার আরেকটা মূল পয়েন্টঃ বিজ্ঞান। বিজ্ঞান আসলে কি? কোনো একটা বিষয় পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে একটা অনুকল্প উপস্থাপন করা এবং এর বিপরীতে পরীক্ষা নীরিক্ষার মাধ্যমে একটা থিউরি উপস্থাপন করা যা পূর্বের অবজারভেশনকে ব্যাখ্যা করে। বিজ্ঞান উপকারী, এর থেকে আমরা সবাই উপকৃত হই। তবে এটি কখনও আমাদেরকে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তায় পৌছায় না। তার কারণ দুইটিঃ
১. The Problem of induction (সীমাবদ্ধ পর্যবেক্ষনের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া, অথচ এর বিপরীতেও কোনো বিষয় থাকতেই পারে যা পর্যবেক্ষনের বাহিরে রয়ে গেছে)
২.একই অবজারভেশন থেকে একাধিক থিউরি গঠিত হতে পারে।
আবার প্যারাটাইম শিফটের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত থিউরির বিপরীতও থিউরি আসতে পারে যা পূর্ববর্তী থিউরিকে বাতিল প্রমাণিত করে। যেমন নিউটনের গ্রাভিটিকে এক সময় পুলিং ফোর্স হিসেবে ধরা হতো কিন্তু পরবর্তীতে আইন্সটাইন প্রমাণ করেন যে এটা আসলে একটা পুসিং ফোর্স যা স্থান কালের চাদরে বক্রতার কারণে ঘটে। তবে একটা বিষয় লক্ষনীয় ;; একটা থিউরি ভুল হলেও অনেক সময় তা কাজ করে। যেমন ফ্লোজিস্টন থিউরি যা মূলতঃ নাইট্রোজেন বানাতে ব্যবহৃত হতো। এটা ভুল হলেও এর দ্বারা কিন্তু নাইট্রোজেন আবিষ্কার হয়েছিল।
আর মনে রাখতে হবে যে সাইন্স বলতে সচরাচর বুঝানো হয় "সাইন্টিফিক থিউরিকে "। অবজারভেশন তো অলওয়েজ সার্টেইন।
👉 প্রকৃতিবাদঃ এটা মূলতঃ দুই প্রকার।
১. মেথডলজিক্যাল ন্যাচারালিজম ( প্রতিটি বিষয়কে প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করা, অতিপ্রাকৃত বলতে কিছু নেই)
২. মেটাফিজিক্যাল ন্যাচারালিজম ( প্রকৃতির বাহিরে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই)
👉 আসলে আমরা মনে করি বিশ্বাস বোধ হয় শুধু ধর্মেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আসলে বিজ্ঞানও কিন্তু বিশ্বাসের উপরেই দাড়িয়ে আছে " আমরা বিশ্বজগতকে বুঝতে পারি এবং আমাদের মেধা-ক্ষমতার দ্বারা আমরা এক সময় সব জেনে যাবো "। এখানে বেশ কিছু প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছেঃ
১. আমরা কি যৌক্তিক চিন্তাসম্পন্ন জীব?
২. আসলেই কি মহাবিশ্বের সবকিছু জানা সম্ভব?
.৩. মহাবিশ্ব কি সবসময় একই নিয়মে ছিল নাকি সময়ের প্রেক্ষিতে নিয়মও বদলেছে?
৪. আমাদের চারপাশের সব ঘটনা কি প্রাকৃতিক নিয়মে ব্যাখ্যা করা সম্ভব?
আসলে বিজ্ঞান এগুলোর একটি অনুমান হিসেবে ধরে নিয়েছে। কিন্তু এগুলোর ব্যাখ্যা কি বিজ্ঞান দিতে সক্ষম? উত্তর হলো " না "। কারণ একটা বিষয় ঘটার পর কিভাবে ঘটেছে সেই ব্যাখ্যা দেয় বিজ্ঞান। এর আগে পরে কোনো কাজ নেই তার।
👉 সিমুলেশন। এ হাইপোথিসিস সম্পর্কে কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করছি শুধুঃ
💥💥 (a)১. সাবজেক্টিভ রিয়েলিটি
(২) আন্থপিক প্যারাডক্স (৩) ভিজিবল ফ্লস
(৪)ডিলেশন অব প্রোগ্রাম (৫)সমান্তরাল ব্রাহ্মন্ড
💥💥(b) আমাদের অস্তিত্ব কি আসলেই বাস্তব? আমাদের ব্রেইন, দেহ থেকে পুষ্টি এবং প্রয়োজনীয় ইনপুট পেয়ে থাকে। এখন কোনো আর্টিফিশিয়াল সিস্টেম থেকে যদি রি দুইটা জিনিস ব্রেইনকে দেওয়া যায় তাহলে তো সে সবকিছুকে বস্তু হিসেবে দেখবে! তাহলে আমরা কেন কিভাবে বাস্তব?
এ পর্যায়ে লেখক " নাস্তিক"দের সাথে করা তার বিতর্কের কিছু শিক্ষনীয় অংশ তুলে ধরেছেন।এখানেও বেশ কিছু বিষয় আলোচিত হয়েছে যেমন -- স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে কুরআনের একটি আরগুমেন্ট, ইমাম গাজ্জালীর কিছু আরগুমেন্ট, মহাবিশ্বের অসীমতা এবং স্রষ্টার প্রয়োজনীয়তা( অর্থাৎ অসীম মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে স্রষ্টার কি প্রয়োজন? এখানে;; অসীমতা বাস্তবে কেন সম্ভব নয়, অসীমতাকে নিয়ে বিভিন্ন প্যারাডক্স এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং তার খন্ডন ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে) ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে।
👉শেষের দিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিগব্যাং। এর সম্পর্কে ধারণা, পেছনের ইতিহাস, বিগব্যাং মডেল, বিগব্যাং এর অসীমতা প্রভৃতি ব্যাখ্যা এবং নাস্তিকীয় যুক্তি খন্ডন করা হয়েছে শেষ কিছু অধ্যায়ে।
👉এবার "ফাইন টিউনিং "। এর মূল কথা হলো মহাবিশ্বের প্রত্যেকটা উপাদানই একদম নির্দিষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। এর একটু কম-বেশি হলেই ধ্বংস হয়ে যেত সবকিছু। অর্থাৎ এই প্যাটার্ন -মহাবিশ্বের মডেল প্রতিটি বস্তুর দূরত্ব, পরিমাণ, ক্ষমতা,বিদ্যমান ধ্রুবকসমূহ ইত্যাদি একদম পারফেক্টরূপে রয়েছে যার একটু হেরফের হলেই মহাবিশ্ব ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়ে যেতো। এখানে নির্দিষ্ট পরিবেশ ব্যতীত কোনো প্রাণীর সুবিধা লাভ, ফাইন টিউনিংয়ের পক্ষে বিপক্ষে পদার্থ এবং জীববিজ্ঞানের অবস্থান, মহাবিশ্বের এসব কিছু ধ্রুবক পরিবর্তন সম্ভব প্রভৃতি নাস্তিকীয় যুক্তির ব্যাখ্যা এবং তার খন্ডন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
👉শেষ পর্ব-তে জীবদেহের কোষের জটিলতা, এর উপাদানসমূহ এবং এদের কাজ করার সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া, কোষের গঠন এবং পরিবর্তন ডিএনএ -আরএনএর বৈশিষ্ট্য, এদের প্রোগ্রামসমূহ, প্রোটিন এনকোডিং ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যা বিস্ময়করভাবে ম্যাক্রো এভলিউশনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়।
মোটকথা পুরা বইয়ে নাস্তিক্যবাদের অসারতাকে বিজ্ঞান এবং ফিলোসোফির দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা এবং খন্ডন করা হয়েছে । শেষে একটা অমর লেখনী দ্বারা শেষ করছি, " সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের ক্ষেত্র হচ্ছে আমাদের মন, যুক্তি তার বাহন, আবেগ তার চালিকাশক্তি , বিবেক তার চালক এবং তার গন্তব্য হলো 'সত্য'। " (সমাপ্ত)
[এই বইয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রতিটি বিষয়ের উপর একাধিক নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে। তবে পাঠকের মনে রাখা উচিৎ যে,এটার লেখক -প্রকাশক-প্রকাশনা সবই নতুন। তাই অপ্রত্যাশিত ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]
রিভিউ লেখকঃ তোহফাত তুরান খাঁন