আপনাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, বলেন তো একটা বৃত্ততে মোট কত ডিগ্রি থাকে?
প্রশ্ন শুনে যে-কেউ চটপট করে নির্দ্বিধায় বলে দিবে যে 360°।
কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবেছেন বা জানতে ইচ্ছে করেছে যে কেন 360° -তেই বৃত্ত হয়? কেন 100, 200 বা 300 বা 720 হলো না?
কী অন্যায় করেছিল আমার প্রিয় অন্য সংখ্যাগুলো?
360 –সংখ্যাটা কি এমনি এমনিই বেছে নেওয়া হয়েছে, নাকি এর পেছনেও কিছু সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে?
আর বকবক না করে দেখে নেওয়া যাক যে কেন একটা বৃত্তকে 360টি ভাগ করা হয়েছিল।
প্রথমেই বলে নিই 360 সংখ্যাটি বেছে নেওয়ার পেছনে যে সাম্ভাব্য কারণগুলো ধারণা করা হয়, এর মধ্যে তিনটি হাইপোথিসিস সবচেয়ে বেশি যুক্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য।
আমরা এখন সেগুলির দিকেই যাচ্ছি।
.
হাইপোথিসিস-1:
প্রথম হাইপোথিসিসটার পেছনে একটা গাণিতিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। 360 সংখ্যাটি 1 থেকে 10 পর্যন্ত সব সংখ্যা দিয়েই বিভাজ্য, শুধু 7 ছাড়া।
মানে 1, 2, 3, 4, 5, 6, 8, 9 আর 10 দিয়ে বিভাজ্য। 360-কে 1, 2, 3, 4, 5, 6, 8, 9, 10, 12, 15, 18, 20, 24, 30, 36, 40, 45, 50, 72, 90, 120, 180, 360 অর্থাৎ টোটাল 24টি সংখ্যা দ্বারা ভাগ করলে সবসময় পূর্ণসংখ্যা পাওয়া যায়।
অন্যান্য সংখ্যার সাথে তুলনা করলে দেখা যায় 100 মোট 9টি সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য। আবার 216 — 16টি, 252 — 18টি, 336 — 20টি সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায়।
একারণে 360-কে Highly Composite Number বলা হয়। একটি সংখ্যা Highly Composite Number হবে যদি তার Prime Factor (মৌলিক উৎপাদক) গুলি যতটা সম্ভব ছোটো হয় এবং একেকটি Prime Factor খুব বেশিবার ব্যবহৃত না হয়।
1 থেকে 10 এর মধ্যে 7 ব্যাতিত সব সংখ্যা দিয়ে 360 বিভাজ্য হয়। 360 এর Prime Factorization (মৌলিক উৎপাদকে বিন্যাস্ত) করলে হয়,
360 = 2³ × 3² × 5¹
আর একারনেই 360 Highly Composite Number হওয়ায় এবং এর অনেকগুলো devidor (24টি) থাকায় তখনকার ক্যালকুলেটরবিহীন সাধারণ জীবনে খুব সহজভাবেই প্রাচীনকালের মানুষরা তাদের দৈনন্দিন হিসাব-নিকাশ করতে পারত।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একটি সম্পূর্ণ বৃত্তকে,
অর্থাৎ 360 কে 2 ভাগে ভাগ করলে 180,
3 ভাগ করলে 120,
4 দিয়ে ভাগ করলে 90 করে পাচ্ছি।
অর্থাৎ সবসময়ই আমরা একটা পূর্ণসংখ্যা পাচ্ছি, যেটা আমাদের বৃত্ত কেন্দ্রিক সমস্যাগুলো সহজেই সমাধান করে দিচ্ছে। কিন্তু যদি আমরা 100 কে ভিত্তি ধরতাম, তখন 100 কে খুব সহজেই 2 ও 4 দিয়ে ভাগ করা যায়। কিন্তু যখন ঐ বৃত্তটিকে 3 ভাগ করার চিন্তা করি? তখন ভাগ করলে 33.33 করে দশমিকের পুর্নাবৃত্তি ঘটবে। ভগ্নাংশ রূপ ধারণ করায় এখানে উটকো ঝামেলার সৃষ্টি করে জটিলতা বৃদ্ধি করতে পারে।
ধারণা করা হয় যে, সাধারণ ক্যালকুলেশনে অহেতুক ঝামেলা ও জটিলতা এড়িয়ে সহজভাবে হিসাবের সুবিধার কারণেই একটি বৃত্তকে সমান 360টি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। আর এর প্রত্যেকটি ভাগকে 1 ডিগ্রি ধরে বিবেচনা করা হয়।
তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু 360-ই বা কেন? আরও বেশি ডিভাইসর/উৎপাদক আছে এরকম সংখ্যা যেমন, 720 কিংবা 1080 কেন নয়? জানতে চাইলে ধৈর্য ধরে বাকি দুটি ব্যাখ্যাও পড়ে নেওয়া যাক….!
.
আমরা 360 ডিগ্রির পেছনের একটা হাইপোথিসিস দেখলাম। কিন্তু একটি বৃত্তকে 360 ভাগে বিভক্ত করার পেছনে কিন্তু আরও 2টি বেশ জনপ্রিয় মত রয়েছে। ঐ দুটি’ই ব্যাবিলনীয় সভ্যতাকে কেন্দ্র করে। তো আসুন, জেনে নেওয়া যাক বাকি দুটি সম্ভাব্য কারণ।
.
হাইপোথিসিস- 2:
খ্রিস্টপূর্ব 3500 হতে 3000 অব্দের মধ্যে বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদী দুটির মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল মেসোপটেমিয়া নামক এক উন্নত সভ্যতা। আর ব্যাবিলন ছিল মেসোপটেমিয়ার একটি অন্যতম শহর। বর্তমান বাগদাদ থেকে 85 কি.মি. দক্ষিণে ইরাকের বাবিল প্রদেশে এর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল। তখনকার ব্যাবিলনবাসীরা গণনার জন্য 60 ভিত্তিক (Sexagesimal Number System) সংখ্যাব্যবস্থা ব্যবহার করত।
এখন যেমন আমরা 10 ভিত্তিক সংখ্যা ধরে হিসাব করি অর্থাৎ 1, 2, 3, 4, 5, 6, 7, 8, 9 ও 0 এই দশটি প্রতীক দিয়েই সজ্জিত আমাদের এই বিশাল সংখ্যাজগত, কিন্ত ব্যাবিলনীয়রা ছিল এর ব্যতিক্রম। তাদের সংখ্যা ব্যবস্থায় টোটাল 60টি আলাদা আলাদা প্রতীক ছিল। 60 টি ভিন্ন ভিন্ন প্রতীক তারা ব্যবহার করত, অর্থাৎ তাদের তাদের সংখ্যা ব্যবস্থা ছিল 60 ভিত্তিক। হয়তো নিশ্চয়ই প্রশ্ন আসছে, কেন 60 ভিত্তিকই ছিল? কারন 60’ও কিন্তু একটা Highly Composite Number । এর 12টি উৎপাদক রয়েছে, (1, 2, 3, 4, 5, 6, 12, 15, 20, 30 ও 60) যেগুলো দ্বারা খুব সহজেই 60 সংখ্যাটা বিভাজ্য।
যা-হোক, তারা কীভাবে 60 পর্যন্ত গণনা করত?
.
তাদের গোনার পদ্ধতিটা আমাদের কাছাকাছিই বলা যায়, তবে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। আমরা যেরকম হাতের আঙ্গুলের “কর” গুনি, তারা কিন্তু গুনত আঙ্গুলের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা। আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে দুই করের মধ্যবর্তী ফাঁকা অংশ বা আঙ্গুলের হাড় বলা যেতে পারে। এখন একটু আপনার হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকান, দেখতে পাবেন যে করের মধ্যবর্তী অংশ বা হাড় আছে প্রত্যেক আঙ্গুলে মাত্র 3 টি করে। প্রাচীন ব্যাবিলনীয়রা বুড়ো আঙ্গুল বাদ দিয়ে বাকি চারটি আঙ্গুলের ফাঁকা অংশগুলো ধরে গুনত। তাহলে দেখা যাচ্ছে তারা এক হাতে গুনতে পারত হচ্ছে—
আঙ্গুল সংখ্যা × করের ফাঁকা অংশ বা হাড় = 4 × 3 = 12
অর্থাৎ এক হাতে তারা সর্বোচ্চ 12 পর্যন্ত গুনতে পারত। ধরি, তারা ডান হাতে একবার 12 পর্যন্ত গুনল। একবার গোনা হলে বাম হাতের একটা আঙ্গুল মুড়িয়ে রাখত। এভাবে প্রত্যেকবার 12 করে গোনে, আর অপর হাতের একটা করে আঙ্গুল মুড়ে রাখত। তাহলে 12 করে গুনে অপর হাতের 5 আঙ্গুল একবার করে মুড়লে হচ্ছে 12 × 5 = 60 ।
বোঝা গেল ব্যাপারটা?
তা না হয় বুজলাম, 360 উড়ে এসে জুরে বসলো কোত্থেকে?
বলছি।
ব্যাবিলিয়নীরা একটা কোণ আঁকলো, 2টা রেখা দিয়ে, এখন এই কোণ বা অ্যাংগেলটাকে সহজে কোনো জ্যামিতিক আকৃতি দেওয়ার জন্য তারা একটা সরলরেখা দিয়ে আগের কোণের দুই বিন্দু সংযোগ করে দিল। তৈরি হয়ে গেল একটা ত্রিভুজ।
তারা ত্রিভুজটাকে সমবাহু ধরে প্রত্যেক কোণকে 60 ডিগ্রি করে কল্পনা করল। কিন্তু এই 60-ই কেন?
এর পেছনের কারণটা হলো তাদের 60 ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থা।
এখন তারা চমৎকার একটা জিনিস লক্ষ করল।
ব্যাপারটা এরকম যে— তারা যখন এরকম 6টি সমবাহু ত্রিভুজকে একসাথে জুড়ে দিল, তখন এর আকৃতি একটা চক্রের মতো পাওয়া গেল। অন্যভাবে বললে, একটা বৃত্তের মধ্যে 6টা ত্রিভুজ খুব সুন্দর ভাবে এঁটে যায়। 6টা ত্রিভুজের ছয়টা কোণ দিয়ে বৃত্তের কেন্দ্র তৈরি হলো।
কি চমৎকার না?
যেহেতু তারা ত্রিভুজের প্রত্যেকটা কোণকে 60 ডিগ্রি করে ভেবেছিল, তাই 6টি ত্রিভুজের কোণ দিয়ে উৎপন্ন বৃত্তের কেন্দ্র,
6 × 60 = 360 ডিগ্রি হয়। এটাই ছিল ছিল বৃত্ত 360 ডিগ্রি হওয়ার পেছনে একটি অন্যতম ঐতিহাসিক কারণ।
.
হাইপোথিসিস- 3:
সর্বশেষের এই ব্যাখ্যাটি আমার কাছে বেশ দারুণ ও একইসাথে ভালোই লেগেছে। এটার পেছনেও রয়েছে সেই ঐতিহাসিক ব্যাবিলনীদের অবদান। একটা কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে, ওই সময়ের ব্যাবিলনের অধিবাসীরা গনিত ও জ্যোর্তিবিজ্ঞানে অন্যদের তুলনায় মোটামুটি ভালোই এগিয়ে ছিল।
তো ওই সময়ের জ্যোর্তিবিদরা লক্ষ করে দেখল যে চাঁদ একটা দশা থেকে ঘুরে ঘুরে পুনরাই তার সেই আগের দশাতে ফিরে আসতে মোটামুটি 30 দিনের মতো লাগে (যদিও বা আমরা এখন জানি যে এটা কারেক্টলি 30 দিন না, প্রায় 29.5 দিন)। একে তারা নাম দিল 1 মাস। সহজে বুঝতে চাইলে বলা যেতে পারে যে, পূর্ণিমার চাঁদ থেকে ঘুরে ঘুরে অমাবস্যা কাটিয়ে তার পূর্বাবস্থায় অর্থাৎ পূণির্মায় ফিরে আসতে যে সময়টা লাগে, এই নির্দিষ্ট সময়টুকুকে তারা 1 মাস হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করল।
একইসাথে তারা আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করল।
কি ছিল সেটা?
ওয়েট, বলছি।
ওই সময় তারা খেয়াল করে দেখল যে 1টা ঋতু থেকে ঘুরে ঘুরে পুনরায় সেই একই ঋতুতে ফিরে আসতে প্রায় 12 মাসের মতো লাগে। নিঃসন্দেহে এটি একটি চমৎকার ঘটনা ছিল। তাই না?
তবে এই ফাঁকে আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো, তা হচ্ছে তখনকার সময়ের মানুষরা মনে করত সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। একারণে তারা ভাবত সূর্য একবার পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে আসতে 12 মাস সময় নেয়। একে তারা একটা গোলাকার চক্র হিসেবে কল্পনা করত।
কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমি এত বকবক করতে করতে কোথা থেকে কোথায় চলে গেলাম!
আচ্ছা, তাহলে আসল কথা বলছি।
সংক্ষেপে বলি, তারা দেখল 30 দিনে 1 মাস হচ্ছে, আর 12 মাসে এক বছর।
তাহলে এক বছরে কত দিন হচ্ছে?
সহজ হিসাব, চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় 30 × 60 = 360 দিন।
আগেই বলেছি তারা এই চক্রটিকে একটি গোলাকার বৃত্ত হিসেবে কল্পনা করত। তাই তারা একটা মজার কাজ করল। বছরের সাথে মিলিয়ে বৃত্তটিকেও 360টি সমান ভাগে ভাগ করে দিল। অর্থাৎ তারা 360 দিনের চক্রটাকে জ্যামিতিক আকৃতি— বৃত্তের মতো কল্পনা করে, মানে 1 বছরকে একটা বৃত্ত আর প্রত্যেকটি দিনকে একেকটি ডিগ্রির সাথে তুলনা করল। আর সেখান থেকেই জন্ম নিল বৃত্তের 360 ডিগ্রির।
.
You can read this with image: https://docs.google.com/document/d/19fifNirY0iRNRuJcYPnWqbC8TzVP2S1t79LR8XHc5Mg/edit?usp=sharing
.
.
সহায়ক সূত্র:
Writer: Poluk Hasan Sami
Tags:
Mathematics