মজুদ পন্যের হিসাবরক্ষণ

এইটা এডমিশন টেস্টের জন্য হিসাববিজ্ঞানের শুরুর দিকের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি টপিক। তোমাদের অনেকের এটা বুঝতে একটু সমস্যা হতে পারে। এখান থেকে ঢাবিতে প্রতিবছর প্রশ্ন আসে, তাই চেষ্টা করছি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। ধৈর্য সহকারে শেষ পড়ে দেখো, কনসেপ্ট ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

মজুদ হিসাবরক্ষণের জন্য আধুনিক আমেরিকান হিসাববিজ্ঞানীগণ ২ টি পদ্ধতি বর্ণনা করেন ।একটি হলো “কালান্তিক বা কালীন মজুদ পদ্ধতি” এবং অপরটি “অবিরত বা নিত্য মজুদ পদ্ধতি”। নিচে আলাদাভাবে ২ টি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ

মজুদপণ্যের হিসাবরক্ষণ


কালান্তিক মজুদ পদ্ধতিঃ
তোমরা এসএসসি,এইচএসসিতে এবং এখন পর্যন্ত এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই অংক করে এসেছো। এই পদ্ধতিতে পণ্য ক্রয়কে খরচ মনে করা হয় (ক্রয় হিসাবে ডেবিট করা হয়) এবং “হিসাবকাল শেষে একবারই বিক্রিত পণ্যের ব্যয় বের করা হয়”। ফলে এই পদ্ধতি অনুসরণকারী প্রতিস্ঠানের রেওয়ামিলে বিক্রিত পণ্যের ব্যয় থাকেনা(যেহেতু হিসাব কাল শেষে বিক্রিত পণ্যের ব্যয় বের করা হয়)।

রেওয়ামিলে প্রারম্ভিক মজুদ এবং ক্রয় থাকে কিন্তু সমাাপনী মজুদ থাকেনা কারণ সমাপণী মজুদ পণ্য, ক্রয় এবং প্রারম্ভিক মজুদেরই একটা অংশ। একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা একদম ক্লিয়ার করিঃ

মনে করো,
কালান্তিক পদ্ধতি অনুসরণকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্রয়ের পরিমাণ ৫০,০০০ টাকা এবং প্রারম্ভিক মজুদ ৩০,০০০ টাকা। তাহলে বিক্রয়যোগ্য পণ্যের ব্যয় হবে ৮০,০০০ টাকা। এই ৮০,০০০ টাকার পুরাটাই কিন্তু আমরা রেওয়ামিলে দেখাচ্ছি। সমাপনী মজুদও(৮০,০০০ টাকার মধ্যে, যত টাকার পণ্য অবিক্রিত থাকবে) কিন্তু এই ৮০,০০০ টাকারই একটা অংশ। সমাপনী মজুদ যদি আমি রেওয়ামিলে দেখাই তাহলে সেটা ডাবল হয়ে যাবে। তাই কালান্তিক পদ্ধতি অনুসরণকারী কারবারের রেওয়ামিলে সমাপনী মজুদ থাকেনা।

কালান্তিক পদ্ধতিতে প্রতিটি লেনদেন যেমন “পণ্য ক্রয়, ক্রয় পরিবহণ, ক্রয়ফেরত, ক্রয় বাট্টা ইত্যাদির জন্য আলাদা আলাদা হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। “হিসাবকাল শেষে বিক্রিত পণ্যের ব্যয় বের করার সময় সবগুলো সমন্বয় করা হয়”।

এবার আসো এই পদ্ধতি ফলো করলে জাবেদা কিরকম হবে সেটা দেখিঃ

১। নগদে বা ধারে পণ্য ক্রয় ১০,০০০ টাকা :-
ক্রয় হিসাব - ডেবিট ১০,০০০
নগদান বা প্রদেয় হিসাব ক্রেডিট ১০,০০০
(তোমরা এতদিন যা করে এসেছো)

২। ক্রয় ফেরত ২,০০০ টাকা : -
নগদান/প্রদেয় হিসাব ডেবিট ২,০০০
ক্রয় ফেরত ক্রেডিট ২,০০০

৩। ধারে ক্রীত ৮,০০০ টাকা পণ্যের মূল্য বাবদ ৫% বাট্টায় ৭,৬০০ টাকা পরিশোধ করা হলো :-
প্রদেয় হিসাব ডেবিট ৮,০০০
ক্রয় বাট্টা বা প্রাপ্ত বাট্টা ক্রেডিট ৪০০
নগদান ক্রেডিট ৭,৬০০

৪। ধারে বা নগদে পণ্য বিক্রয় ৫,০০০ টাকা :-
প্রাপ্য হিসাব/নগদান হিসাব ডেবিট ৫,০০০
বিক্রয় হিসাব ক্রেডিট ৫,০০০

৫। বিক্রিত পণ্য ৫,০০০ টাকার মূল্য বাবদ ৩% বাট্রায় ৪,৮৫০ টাকা পাওয়া গেল :-
নগদান হিসাব ডেবিট - ৪,৮৫০
বিক্রয় বাট্টা বা প্রদত্ত বাট্টা ডেবিট - ১৫০
প্রাপ্য হিসাব ক্রেডিট - ৫,০০০

অবিরত বা নিত্য মজুদ পদ্ধতিঃ
এই পদ্ধতিতে “পণ্য ক্রয়কে সম্পদ” মনে করা হয় (মজুদপণ্য হিসাবে ডেবিট করা হয়)।তোমরা এসএসসি বা এইচএসসিতে এই পদ্ধতিতে অংক করোনি। এই পদ্ধতিতে “প্রতিবার পণ্য বিক্রয়ের সময় বিক্রিত পণ্যের ব্যয় বের করে নেওয়া হয়”। পণ্য ক্রয়, ক্রয় পরিবহণ, ক্রয় বাট্টা, ক্রয় ফেরত ইত্যাদির জন্য “একটাই হিসাব সংরক্ষণ করা হয়(মজুদপণ্য হিসাব)”।যেহেতু প্রতিটি বিক্রয়ের সময় বিক্রিত পণ্যের ব্যয় বের করে নেওয়া হয় সেহেতু এই পদ্ধতি অনুসরণকারী প্রতিস্ঠানের রেওয়ামিলে “বিক্রিত পণ্যের ব্যয় এবং সমাপণী মজুদ থাকে” কিন্তু “প্রারম্ভিক মজুদ পণ্য থাকেনা”। প্রারম্ভিক মজুদ থাকেনা কারণ সেটা বিক্রিত পণ্যের ব্যয়েরই একটা অংশ, রেওয়ামিলে যেহেতু বিক্রিত পণ্যের ব্যয় দেখানো হয় সেহেতু প্রারম্ভিক মজুদ পণ্য আবার আলাদাভাবে দেখানোর দরকার হয়না। কিন্তু, সমপনী মজুদ রেওয়ামিলে দেখাতে হয় কারণ এটা বিক্রিত পণ্যের ব্যয়ের মধ্যে থাকেনা।

জাবেদাঃ
১। নগদে বা ধারে পণ্য ক্রয় ২০,০০০ টাকা।

মজুদপণ্য হিসাব ডেবিট ২০,০০০
নগদান/প্রদেয় হিসাব ক্রেডিট ২০,০০০
[পণ্য ক্রয়কে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাই মজুদপণ্য হিসাবে ডেবিট করা হল]

২। ক্রীত পণ্য ফেরত দেওয়া হল ৩,০০০ টাকা :-

নগদান/প্রদেয় হিসাব ডেবিট ৩,০০০
মজুদপণ্য হিসাব ক্রেডিট ৩,০০০
[পণ্য ফেরত দেওয়ার কারণে মজুদপণ্য নামক সম্পদ কমে গেল..আর সম্পদ কমলে হয় ক্রেডিট।তাই মজুদপণ্য হিসাবকে ক্রেডিট করা হল]

৩। ধারে ক্রীত ১৭,০০০ টাকার পণ্যের মূল্য বাবদ ১০% বাট্টায় ১৫,৩০০ টাকা প্রদান করা হল :-

প্রদেয় হিসাব ডেবিট– ১৭,০০০
নগদান হিসাব ক্রেডিট– ১৫,৩০০
মজুদপণ্য হিসাব ক্রেডিট –১,৭০০

[১৭,০০০ টাকার ১০% হয় ১,৭০০ টাকা। এটা তুমি ছাড় পেলে পাওনাদারের কাছ থেকে। তো, ১৫,৩০০ টাকা তো নগদান হিসাব থেকেই কমিয়ে ক্রেডিট করেছো আর বাকী ১,৭০০ টাকা মজুদ পন্যকে সম্পদ হ্রাস বাবদ ক্রেডিট করে দেখিয়ে দিবে]

৪। ধারে পণ্য বিক্রয় ১২,০০০ টাকার যার ক্রয়মূল্য ছিল ১০,০০০ টাকা : -

#জাবেদা_০১ :
প্রাপ্য হিসাব ডেবিট ১২,০০০
বিক্রয় হিসাব ক্রেডিট ১২,০০০

#জাবেদা_০২ :
বিক্রিত পণ্যের ব্যয় হিসাব ডেবিট ১০,০০০
মজুদপণ্য ক্রেডিট ১০,০০০

[এখানে ২ টা জাবেদা কেন হল বলতো? ২ টা জাবেদা হল কারণ একটি জাবেদার মাধ্যমে বিক্রয় আয় লিপিবদ্ধ করা হল এবং আরেকটির মাধ্যমে বিক্রিত পণ্যের ব্যয় বের করে নেওয়া হল....যেই পণ্য তুমি ১০,০০০ টাকায় কিনেছিলা সেটা তুমি ২,০০০ টাকা লাভে ১২,০০০ টাকায় বিক্রি করলা। ১২,০০০ টাকার পণ্য বিক্রয় করতে খরচ হয়েছে ১০,০০০ টাকা যাকে বিক্রিত পণ্যের ব্যয় বলা হয়। তুমি যখন ১০,০০০ টাকার পণ্য কিনেছিলা তখন মজুদপণ্য হিসাবকে ডেবিট করে দিছিলা আর এখন সেই ১০,০০০ টাকার পণ্যই বিক্রি করে দিচ্ছো, যার ফলে মজুদপণ্য নামক সম্পদ কমে যেয়ে ক্রেডিট হয়ে যাচ্ছে আর বিক্রিত পণ্যের ব্যয় নামক খরচ বেড়ে যেয়ে ডেবিট হয়ে যাচ্ছে]

৫। ধারে বিক্রিত পণ্য ফেরত আসল ৮,০০০ টাকা যার ক্রয়মূল্য ছিল ৫,০০০ টাকা :

#জাবেদা_০১
বিক্রয় ফেরত হিসাব ডেবিট ৮,০০০
প্রাপ্য হিসাব ক্রেডিট ৮,০০০

#জাবেদা_০২

মজুদপণ্য হিসাব ডেবিট ৫,০০০
বিক্রিত পণ্যের ব্যয় ক্রেডিট ৫,০০০

[জাবেদা ২ টা লক্ষ্য করো, আগের ২ টা জাবেদা বুঝতে পারলে এগুলা এমনি পারবা। প্রথম জাবেদায়, বিক্রিত পণ্য ফেরত আসার নরমাল জাবেদা দেওয়া হল বিক্রয়মূল্য দ্বারা। দ্বিতীয় জাবেদায়, পণ্য ফেরত আসার কারণে মজুদ আবার বেড়ে গেল তাই মজুদ ডেবিট করা হল ক্রয়মূল্য দ্বারা আর পণ্য ফেরত আসার কারণে বিক্রিত পণ্যের ব্যয় কমে যেয়ে ক্রেডিট হয়ে গেল।]

গুদাম থেকে নির্গত মালের হিসাবরক্ষণ পদ্ধতিঃ
[বেশ কয়েকটি পদ্ধতি আছে আমরা শুধু গুরুত্বপূর্ণ ৩টি পদ্ধতি আলোচনা করবো]

💠১. FIFO—First In First Out:
এই পদ্ধতির মূল কথা হলো, যে কাঁচামাল আগে ক্রয় করে গুদামজাত করা হবে সেগুলোই আগে বিক্রয় করা হবে। “বাজারে পন্যর মূল্য নিন্মগামী বা ক্রমাগত কমতে থাকলে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে অধিক মুনাফা অর্জন করা হয়”। মুদ্রাস্ফীতির সময়কালে FIFO পদ্ধতি সর্বোচ্চ নিট আয় সৃষ্টি করবে।

💠২. LIFO–Last In First Out:
এটি FIFO পদ্ধতির বিপরীত ধারণা।
এই পদ্ধতিতে যেই কাঁচামাল সবার শেষে গুদামে আসবে সেগুলোই আগে বিক্রয় করে দিতে হয়। এতে মজুদ মালের মূল্য কম দেখানো হয় বলে মুনাফাও কম দেখানো হয়। মুদ্রাস্ফীতির সময়কালে সর্বনিম্ন আয়কর সৃষ্টি করবে LIFO পদ্ধতি। “পন্যের বাজারমূল্য যখন ক্রমাগত বাড়তে থাকবে বা ঊর্ধ্বগামী হবে তখন LIFO পদ্ধতি বেশি কার্যকরী”।

💠৩. ভারযুক্ত গড় পদ্ধতিঃ
এই পদ্ধতিতে মজুদ মালের মূল্য ও পরিমানের ভিত্তিতে গড় মূল্য নির্ণয় করা হয়। মানে, দোকানে সংরক্ষিত মোট কাঁচামালের মূল্যকে মোট কাঁচামালের পরিমান দিয়ে ভাগ করে একটি গড় বিক্রয়মূল্য নির্ণয় করে সেই মূল্যে পন্য বিক্রয় করা হয়। যখনই নতুন করে পন্য ক্রয় করা হবে তখনই এই পদ্ধতিতে গড় মূল্য নির্ণয় করে নিতে হবে। “বাজারে পন্যেত মূল্য যখন খুব বেশি উঠানামা করে বা পরিবর্তন হয় তখন এই পদ্ধতি ব্যবহার করা অধিক কার্যকর”।

উদাহরণঃ আবির স্টোরে ১২ টাকা দরে ২০০ কেজি আলু আছে। সে যদি ১৪ টাকা দরে আরো ১৫০ কেজি আলু করে করে তাহলে গড় বিক্রয়মূল্য কত হবে?

সমাধানঃ
ইস্যুদর বা বিক্রয়মূল্য= (মোট কাঁচামালের মূল্য ÷ মোট কাঁচামালের পরিমান)
= {(১২×২০০)+(১৪×১৫০)} ÷ (২০০+১৫০)
= (২,৪০০+২,১০০) ÷ ৩৫০
= ৪,৫০০ ÷ ৩৫০
=১২.৮৬ টাকা

কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ
১. দ্রুত পঁচনশীল দ্রব্যের ক্ষেত্রে উপযোগী — FIFO পদ্ধতি।

২. বিনকার্ডে উল্লেখ থাকেনা — মালের দর/মূল্য।

৩. মজুদ সংরক্ষণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি — নিত্য বা অবিরত মজুদ পদ্ধতি।

৪. মুদ্রাস্ফীতির কালে সর্বনিম্ন আয়কর সৃষ্টি করে — LIFO পদ্ধতি।

৫. পন্যের দাম কমতে থাকলে FIFO, পন্যের দাম বাড়তে থাকলে LIFO আর পন্যের দাম অধিক উঠানামা করলে “ভারযুক্ত গড় পদ্ধতি” অধিক কার্যকরী।

এই ছিল এই অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সব টপিকের বিস্তারিত আলোচনা। আশাকরি বুঝতে পেরেছো, কোথাও না বুঝলে আবার পড়ে দেখো। কোন প্রশ্ন বা কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করে জানিয়ে দাও।

"সবার জন্য শুভকামনা রইলো🖤"

সহযোগিতায়,
মোস্তাকিম মামুন রানা ভাই

Maruf Hossain Munna
Instructor of Accounting
Executive of SILSWA

BBA, Department of Marketing
Faculty of Business Studies
University of Dhaka

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম