নিউটন কি ইবনে সিনার ফিজিক্সের সূত্র চুরি করেছিলেন ?


বেশ জটিল প্রশ্ন । ইবনে সিনার পান্ডুলিপিতে কি লেখা ছিল, নিউটন পান্ডুলিপি কোথায় খুজে পেলেন, কত পার্সেন্ট কপি করেছেন সেখান থেকে, গ্যালিলিও , টলেমি, জোহানস কেপলার দের কাছ থেকে নিউটন কত টুকু কপি করেছেন, কাদেরকে ক্রেডিট দিয়েছেন আর কাদেরকে দেননি সেসব জটিল আলোচনায় না গিয়ে, আসুন ,কিছু কমনসেন্স কাজে লাগানোর চেষ্টা করি।
এক জেনারেশনের বিজ্ঞানীর গবেষনার সাহায্য নিয়েই তো পরবর্তী জেনারেশন এগিয়ে যায়। সক্রেটিস এর শিষ্য প্লেটো, তার শিষ্য এরিস্টেটল--এভাবেই গুরু শিষ্য পরম্পরা এগিয়ে যায়।
নিলস বোর, রাদারফর্ড, স্রডিংগার, ওপেনহাইমার ,ম্যাক্স প্লাংক, হাইজেনবার্গ, এনরিকো ফার্মি, পল ডিরাক --আধুনিকা পরমানুবাদের যারা ডেভেলপমেন্টে ছিলেন, সবাই জার্মানির গোয়েটিংগেন ইউনিভার্সিটিতে বিভিন্ন সময়ে পড়েছেন।
আমরাও ডেমোক্রিটাস, ডাল্টন, এভোগেড্রো সবার আবিষ্কার পড়েই তারপর নিজের কাজ শুরু করি (যদি নিজেদের নতুন গবেষনা শুরু করি আরকি)। তবে সবক্ষেত্রেই পুরনো গবেষকদের রেফারেন্স লিংক, কার্টেসি দেই
নিউটন গবেষক হিসেবে খুবই ভাল হলেও, নৈতিকতার দিক দিয়ে অত ভাল লোক ছিলেন না। লিবনিজ কে ক্যালকুলাস এর আবিষ্কার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ফেক আইডি দিয়ে পত্রিকায় গালাগালি মুলক প্রবন্ধ লিখতেন।
সুতরাং নিউটনের পক্ষে মুসলিম বিজ্ঞানীর রচনা থেকে ডাইরেক্ট কপি পেস্ট করা, এবং কার্টেসি স্বীকার না করা একেবারে অসম্ভব না।
তবে গতিবিদ্যা সম্পর্কিত সূত্রাবলীর কথা যদি বলেন, সেক্ষেত্রে এই গতিবিদ্যা নিয়ে সমসাময়িক অনেকেই কিন্তু কাজ করছিলেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি হেলিকপ্টারের পাখা ডিজাইন পর্যন্ত করে ফেলেছিলেন। দেকার্তে, গ্যালিলিও, কেপলার সহ অনেকেই বস্তুকনাদের গতি বা আচরন সম্পর্কে ধারনা রাখতেন। নিউটন সব অবজার্ভেশন গুলোকে ম্যাথমেটিকালি রিপ্রেজেন্ট করেছেন।

২.
ম্যাথে নিউমেরিকাল এনালাইসিস নামে একটা সিস্টেম আছে। বীজগনিত দিয়ে বা জ্যামিতি দিয়ে সমাধান না করে নিউমেরিকাল এনালাইসিস দিয়ে সমাধান করেও সমীকরনের অজানা ভ্যারিয়েবলের মান বের করা যায়।
যেমন ধরুন, x2-5x+6=0 সমীকরনটা মিডল টার্ম ব্রেক করে x এর মান বের করতে পারেন। ভ্যালু আসবে ২ আর ৩। (বীজগাণিতিক পদ্ধতি)
আবার এটাকে গ্রাফে প্লট করে দেখতে পারেন । y অক্ষকে 2 আর 3 এ ছেদ করবে। তাই ভ্যালু হচ্ছে ২ আর ৩
মাঝে মাঝে সমীকরনে আন নোন ভেরিয়েবল বেশি থাকলে এই সব পদ্ধতিতে কুলায় না। নিউমেরিকাল এনালাইসিস তখন খুব কার্যকরী।
এই সমীকরণটাই নিউমেরিকাল এনালাইসিসে সল্ভ করার চেষ্টা করি ।
মনে করি, এই সমিকরনে x এর ভ্যালু কিছু একটা ধরলাম। আন্দাজে। ১০,২০,৩০ , মাইনাস এক হাজার, যা খুশি। আমার পছন্দের সংখ্যা ,৬৬৬ ধরলাম আপাতত। ইলুমিনাতি নাম্বার।
পরের স্টেপে এই ৬৬৬ কেই x এর জায়গায় বসিয়ে x এর মান বের করার চেষ্টা করি।
x2-5x+6=0 কে লিখতে পারি x= square root of 5x+6
কিংবা উপপক্ষকে x দ্বারা ভাগ করলে পাব , x= 6-5/x
এইবার x এর মান বসালে x এর নতুন ভ্যালু পাব। আগেরটাকে xi আর পরেরটাকে xii
এভাবে প্রতি স্টেপে x এর নতুন নতুন ভ্যালু বসাতে থাকুন। দেখবেন ৬৬৬ থেকে এক্স এর ভ্যালু কমে কমে ৩ বা ২ এর কাছাকাছি চলে আসছে।
যেমন দ্বিতীয় স্টেপেই ৬৬৬ থেকে এক্স এর ভ্যালু কমে গিয়ে আসে ৪.৯৯ ,তার পরের স্টেপে ৩.৭৯, তার পরের স্টেপে ৩.৪২ । এভাবে কমতে কমতে একদম ৩ এর কাছাকাছি চলে আসে। ৩.০০০০০০০০০০০০০
০০১ কে কি আপনি ৩ ধরবেন ? নাকি আরো এ্যাকুরেট রেজাল্ট খুজবেন ? মোট কথা ,একুরেসির শেষ নেই। ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯& এ্যাকুরেসি থেকেও কিন্তু আরো ইমপ্রুভ করা যায়।
আপনি অন্য কোনো নাম্বার দিয়েও শুরু করতে পারেন। ঘুরেফিরে ২ বা ৩ ই আসবে ,বেশ কয়েকটা স্টেপ পরে।

৩.
ডেমোক্রিটাস পরমানু সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, সেটা ধরুন ৫০% কারেক্ট। এরপরে ডাল্টন এসে যা বলেছেন, সেটা ৭০% কারেক্ট। রাদারফোর্ড এসে সৌরকেন্দ্রিক যে মডেল দিয়েছেন সেটা ৮৫% কারেক্ট। নিলস বোর সেই মডেল ইমপ্রুভ করে যে মডেলে দিয়েছেন সেটা ধরুন ৯৫% কারেক্ট। এইভাবে আস্তে আস্তে পরমানুর নিখুত অবস্থা সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি। কিন্তু আগের বিজ্ঞানীদেরকে ডাইরেক্টলি ভুল বলা যাবেনা। তাদের মদেলের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, পরবর্তী বিজ্ঞানীরা সেটা ঠিক করে দিয়েছেন।
ইবনে সিনা বলেছিলেন, উটের প্রস্রাবের মধ্যে অনেক রোগ নিরাময় ক্ষমতা আছে। তিনি উটের প্রস্রাব খেতে উপদেশ দিয়েছিলেন। এখন তার বক্তব্যের সীমাবদ্ধতা পাওয়া গেছে। WHO বলছে, উটের প্রস্রাব খেলে MERS রোগ হতে পারে। তাই উটের প্রস্রাব বাদ।
নিউটন লোহার সাথে তুতে মিশিয়ে লোহাকে তামায় রুপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। (Fe+CusO4= Cu+FesO4)
তিনি ভেবেছিলেন, এইভাবে কিছু একটা মিশিয়ে লোহাকে সোনা বানানো যাবে। এই কারনে তিনি দীর্ঘদিন লোহাকে সোনা বানানোর বিদ্যা ( আলকেমি বিদ্যা)র পেছনে দৌড়েছেন। এখন আমরা তার সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরেছি। লোহা খুবই নিষ্ক্রিয় যৌগ। CuSor এর মত AuSO4 জাতীয় কোনো যৌগ নেই । এই কারনে লোহার সাথে কোনো কিছু মিশালে প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ায় সোনা মুক্ত হবেনা।
এছাড়া, ধারুর সক্রিয়তা সিরিজে সোনা একদম নিচে। সো, এইভাবে প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ায় লোহা নিষ্কাষণ সম্ভব নয়।নিউটন হুদাই আলকেমির পিছনে সময় নষ্ট করেছিলেন।
যত সময় যাবে, প্রাচীণ বিজ্ঞানীদের কথার সীমাবদ্ধতা বেশি করে চোখে পড়বে। সবকিছু নির্দিষ্ট বইতে আছে--এই ধারনা যেমন ভুল, তেমনি ডারউইন বা নির্দিষ্ট বিজ্ঞানীর সব কথা ঠিক--এমন ধারনাও সঠিক নয়।
প্রতিমুহুর্তে আমরা আপডেটেড হচ্ছি। আইফোন সিক্স এর চেয়ে আইফোন সেভেন ভাল।তার চেয়ে আইফোন এইট ভাল। আমি বলব না, যে আইফোন সেভেন খারাপ, বা কাজ করবে না। কিন্তু আপনি যখন নতুন মোবাইল কিনতে চাইবেন, নিশ্চয়ই লেটেস্ট মডেলটাই কিনবেন ।
একইভাবে ,জ্ঞানের ক্ষেত্রেও ,আগের বিজ্ঞানী কি বলেছিলেন সেটা ফলো না করে লেটেস্ট বিজ্ঞান কি বলছে, সেটা ফলো করাই কি বেশি যুক্তিযুক্ত নয়?
আমরা এখন যা যা আবিষ্কার করছি, আমাদের নেক্সট জেনারেশন সেটা ইমপ্রুভ করবে। এইভাবেই জ্ঞানের সিলসিলা চালু থাকবে।
গ্রীক-রোমান বিজ্ঞানীরা যে আলোর মশাল জ্বালিয়েছিলেন, সেই মশাল ক্যারি করেছেন আরবের বিজ্ঞানীরা। পরবর্তীতে , রিলে রেসের মত করে, সেই জ্ঞানের শিখা বহন করেছেন ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানীরা । পূর্ববর্তী বিজ্ঞানী কোন দেশের, কোন ধর্মের, নারী-পুরুষ,সাদা -কালো, সিনিয়র-জুনিয়র --কিছুই দেখেননি তারা । জাস্ট তারা গবেষনা কর্মকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
আর এখন পুরা বিশ্ববাসীর হাতেই সেই মশালের দায়িত্ব। বর্তমানে গ্লোবাল ভিজেলের যুগে সবাই সব তথ্য পাচ্ছি, সবার সামনেই সমান সুযোগ। জ্ঞান এখন বিশ্বের সব জায়গায় একসাথেই অগ্রসর হচ্ছে।
ইনশাল্লাহ, আমাদের আগের জেনারেশন যেখানে শেষ করেছেন , আমরা সেই জায়গা থেকে শুরু করে মানব সভ্যতাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাব।

------
তথ্যসূত্র-
১। স্যাপিয়েন্স- এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাউন্ড : ইউভাল নোয়াহ হারারি
৩। Cosmos TV series (2014 ,বাই নেইল ডি গ্রিজ টাইসন)
৪। History of the world, with Andrew marr -TV series
৪। উইকি ইসলাম
৫। উইকিপিডিয়া

Writer: Jahirul Islam

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম