মহাশূন্যে গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ বল নেই।
(পুরোপুরি ভুল উত্তর)গ্র্যাভিটি হচ্ছে সেই সার্বজনীন শক্তিমান বল যেটা এই ইউনিভার্সের প্রত্যেকটা কোনাকাঞ্চিতে জুড়ে আছে। আপনি এই অন্তত মহাবিশ্বের যেখানেই যান, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমান হলেও গ্র্যাভিটি সবখানে পাবেন।
ভেবে দেখুন। আমাদের পৃথিবী চাদকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে গ্র্যাভিটি দিয়ে, জমিদার সূর্য আমাদের পৃথিবীসহ পুরো সোলার সিস্টেমকে ঘোরাচ্ছে তার নিজস্ব গ্র্যাভিটির মাধ্যমে, খোদ সূর্যসহ আমাদের পুরো সৌরজগত আবার আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এই গ্র্যাভিটির টানে। আবার পুরো মিল্কিওয়েও ঘুরছে সুপার ক্লাস্টারের অন্য গ্যালাক্সিদের সাথে।
সবই গ্র্যাভিটির খেলা। যেখানেই যান, কিছু না কিছু আপনাকে আকর্ষন করছেই।
যেখানে আড়াই লক্ষ কিলোমিটার দূরে থেকেও চাদঁ মামা পৃথিবীর গ্রাভিটির আদেশ মোতাবেক বাধ্য ছেলের মতো দিবানিশি আবর্তন করে যাচ্ছে সেখানে মাত্র ২৫০-৩০০ মাইল দূরে থাকা স্যাটেলাইট বা স্পেস স্টেশনে গ্রাভিটি থাকবে না কেনো?
অবশ্যই থাকবে। পৃথিবীর অভিকর্ষ সীমা বিশাল দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
সত্যি বলতে, মাটির উপর পৃথিবীর গ্র্যাভিটি বলের মান আর পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইটগুলোর উপর অনুভূত গ্র্যাভিটি বলের মানের পার্থক্য খুবই কম। বলা যায়, প্রায় সমান গ্র্যাভিটি উভয় জায়গায় বিদ্যমান। পৃথিবীর মতো অতিকায় দানবীয় বস্তুর গ্র্যাভিটি ২৫০ মাইলের জন্য তেমন একটা হেরফের হয়না। আপনি নাইন টেনে শিখে আসা নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র থেকেই g এর মান বের করে ফেলতে পারেন কক্ষপথের। পৃথিবীতে কারো ওজন ১০০ কেজি জলে ISS এ অজন হবে ৯০ কেজি। শূন্য হবে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে স্পেস স্টেশনের ভেতর এস্ট্রোনটরা ভাসে কেনো? বেচারাদের স্ট্র দিয়ে পানি খেতে হয় কেনো? কেনোই বা সাকশনবিশিষ্ট কমোড না হলে তাদের পটি চারপাশে উড়ে বেড়ায়?
ওয়েল, এর কারন একেবারেই সহজ। ক্লাস এইটে পড়ে আসা লিফটে ওজনহীন অনুভূত হবার উদাহরনটা মনে আছে?
লিফট যখন হুট করে নিভে নামতে শুরু করে,সাথে সাথে আমরা নিজেদের ওজনহীন অনুভব করি। সবাই জানেন। আমি খেয়াল করেছি, সেইম ঘটনা বাসেও হয়। ভাঙাচোরা খানাখন্দে ভরা রাস্তায় কিংবা সড়কের মাঝে গতি কমানোর জন্য দেয়া উচু আইল্যান্ডের উপর দিয়ে বাস যাবার সময় হুট করে যখন বাস নিচে নামে, তখন পেটের মধ্যে অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব হয়; ওজনহীন অনুভূতি এটা। অনেকেই হয়তো খেয়াল করেন নি এটা, তাই এই উদাহরণ কাজে লাগবে না।
আরো চমৎকার উদাহরণ দেয়া যাক। প্রিয় পাঠক, ধরুন আপনাকে আমি এবং আমার কিছু চ্যালাপ্যালা মিলে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে বিশ তলার ছাদের উপর থেকে ফী আমানিল্লাহ বলে ফেলে দিলাম। ব্যাপারটা অন্যভাবে নেবেন না। ওজনহীন অনুভূতিটা পার্সোনালি বোঝানোর জন্য এই এক্সপেরিমেন্ট।
বিশ তলা থেকে পরতে পরতে আপনি নিজেকে ওজনহীন অনুভব করবেন। বস্তুত, পৃথিবী যে দিকে আপনাকে আকর্ষন করছে, আপনার গতিও সেদিকে বলে আপনি আর পৃথিবীর টান অনুভব করবেন না। পৃথিবীর টান অনুভব না করলেই ওজনহীন মনে হবে আপনার।
Airbus A310 Zero-G নামে একটা উড়োজাহাজ টাকার বিনিময়ে আপনাকে এই পৃথিবীতেই ওজনহীনতার স্বাদ দেবে। এই প্লেনে টম ক্রুজের মিশন ইম্পসিবল সহ আরো বেশ কয়েকটা মুভির জিরো গ্র্যাভিটির শ্যুটিং হয়েছে।
মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তু পৃথিবীর কোন টান(গ্রাভিটি) অনুভব করে না বিধায় সে নিজেকে ওয়েটলেস হিসেবে আবিষ্কার করবে।
মজার ব্যাপার হলো, আমাদের প্রত্যেকটা স্যাটেলাইট একেকটা মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তু। ফ্রী ফলিং অবজেক্ট।
একটা টেনিস বল পৃথিবীর কয়েকশো কিমি উপরে নিয়ে ছেড়ে দিলে কি সেটা সেখানে ভেসে থাকবে? না, গ্র্যাভিটির দরুন টুপ করে পৃথিবীতে পরতে শুরু করবে।
তেমনিভাবে ২৫০ কিমি উপরে থাকা আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের উপরও পৃথিবীর গ্রাভিটি বল কাজ করে। তাকে তো আর পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়নি অতো উপরে। টেনিস বলটার মতো সেটাও প্রতিমুহূর্তে পৃথিবীর উপর মুক্তভাবে পরে যাচ্ছে বলে তার মধ্যে ওজনহীন একটা অবস্থা তৈরী হয়। স্পেস স্টেশনের পেটের মধ্যে থাকা মহাশূন্যচারীরাও এই পড়ন্ত যানের মধ্যে নিজেদের ওজনহীন মনে করেন, ঠিক লিফটে থাকা ব্যাক্তির মতো।
নতুন প্রশ্ন হচ্ছে, স্যাটেলাইটগুলো যদি গ্র্যাভিটির কারনে পৃথিবীতে মুক্তভাবে পরে যাচ্ছে, তো সেগুলোকে মাটির উপর আছড়ে পরতে দেখছিনা কেনো?
মনে মনে একহাতে একটা টেনিস বল আরেক হাতে একটা ইঞ্চি দুয়েক লম্বা প্লাস্টিকের খেলনা রকেট। খেলনা ছোট রকেটটাকে টেনিস বলের কাছে নিয়ে মনে মনে ভাবুন, টেনিস বলটা রকেটটাকে অদৃশ্য জাদু বলে টেনে নিয়ে খেয়ে ফেলতে চাচ্ছে। এদিকে রকেটটা ভয়ে গতি বাড়িয়ে টেনিস বলকে অতিক্রম করে পালিয়ে যেতে চাচ্ছে। এতে করে দেখা যাবে রকেটটা বলটাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
এখানটা একটু ভালোভাবে চিন্তা করতে হবে।
মহাশূন্যচারীদের অবশ্যই পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে মরার ইচ্ছা থাকেনা। এই বিষয়ে আমরা মুটামুটি নিশ্চিত। সেজন্য স্যাটেলাইট বা স্পেস স্টেশনের ড্রাইভার একটা সহজ বুদ্ধি ফাদে। পৃথিবীতে যাতে পরে যেতে না হয় সেই পতন এড়ানোর জন্য ড্রাইভার সাহেব ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে স্যাটেলাইটকে সামনের দিকে একটা বেগ দেয়।(টম এন্ড জেরি কার্টুনে টম উপর থেকে পরে যাবার সময় যেভাবে হাচড়ে পাচড়ে সামনে এগিয়ে যেতে চায়)
এই বেগের মান ২৭৫০০ কিমি/ঘন্টা। এই বেগ স্যাটেলাইটকে একবার দিলেই চলে। বারবার দিতে হয় না। ঘর্ষন বল বা বায়ুর বাধা না থাকায় প্রাথমিক বেগেই দিনের পর দিন স্যাটেলাইট চলবে।
পৃথিবীর আকর্ষনে স্যাটেলাইট নিচে নামছে আর নিজস্ব ইঞ্জিনের গতিতে সামনে আগাচ্ছে। তার গতি দুই দিকে। নিচে এবং সামনে। এই দুই দিক বরাবর গতির কারনে স্যাটেলাইট নতুন লব্ধি একটা দিক বরাবর এগিয়ে যায়, যেটা সামনে এবং নিচে- এই দুদিকের মাঝামাঝি নতুন এক রাস্তা। চলার এই নতুন রাস্তাটাকেই আমরা কক্ষপথ বা অরবিট বলি।
অন্যভাবে বলা যায়- every satellites are free falling towards earth, but they keep missing it. স্যাটেলাইটগুলা পৃথিবীর দিকে পরে যাচ্ছে, কিন্তু পৃথিবী গোলাকার বলে স্যাটেলাইটটা সামনে যেতে যেতে পৃথিবীর মাটিও ঠিক ততটাই দূরে সরে যায়৷ ফলে পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটের উচ্চতা একই থাকে।
প্রায় আটাশ হাজার কিমি/ঘন্টা গতি থাকার পরেও ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (iss) কয়েক ঘন্টা পর পর কক্ষপথ থেকে পৃথিবীর দিকে কিছুটা নিচে নেমে যায়। নির্দিষ্ট সময় পর পর তাই iss কে কক্ষপথে উঠিয়ে আনা হয়।
স্যাটেলাইটের মতোন চাদও পৃথিবীকে একই কৌশলে প্রদক্ষিন করে যাচ্ছে। পৃথিবীর গ্র্যাভিটির কারনে চাদও মুক্তভাবে পৃথিবীতে এসে পতিত হতো যদিনা চাদের নিজস্ব একটা কৌনিক গতি না থাকতো। একই কথা, সূর্য, মিল্কিওয়েসহ গ্র্যাভিটির কারনে আবর্তিত থাকা অনন্ত নক্ষত্রবীথির প্রতিটা বস্তুর ক্ষেত্রে।
লিখাঃ আকাশ আব্দুল্লাহ
Tags:
Aerospace