১।
ছোটবেলার একটা সময়- মানে এই ধরুন স্কুল-কলেজের সন্ধিক্ষণে- আমার কেন যেন মনে হতে লাগল, আমাকে জগতের সবকিছু জানতে হবে। সবকিছু মানে সবকিছু- সমাজ ধর্ম দর্শন ভাষাতত্ত্ব রাজনীতি বিজ্ঞান যা আছে সবকিছু একধার থেকে চিবিয়ে খাওয়া শুরু করতে হবে। আকাট মুখ্যু হয়ে আর কতদিন।
সেসময় ইন্টারনেট ব্যাপারটা বোধহয় অত ভাল বুঝতাম না। জানার উপায় বলতে ছিল আব্বার বিশাল লাইব্রেরি। সেই শিশুকাল থেকে আব্বার দেওয়ালজোড়া বই দেখে বড় হয়েছি। কাজেই ভাবলাম, সভ্য হওয়ার জন্য এখানকার কিছু বই হাতানো যাক। এসব বইপত্র কয়েকটা হজম করতে পারলে হয়ত আব্বাকেও একটু কথাবার্তায় টেক্কা দেওয়া যাবে। উঠতি বয়েসের ছেলেপিলের চিরাচরিত ফ্যান্টাসি।
আব্বা অর্থনীতির লোক, তার তিন দেওয়ালময় লাইব্রেরি জুড়ে শুধু অর্থনীতি, দর্শন আর কয়েকটা ক্লাসিক। এর বাইরে সেরকম কিছু নেই। পড়াশোনার শুরুটা অবশ্য অত মসৃণ ছিল না। প্রথমদিকে তুলে নিয়েছিলাম দর্শনের দারিদ্র্য আর অল কোয়ায়েট ইন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট- সেগুলো উলেপাল্টে দেখে ভীষণ বিরক্ত লাগল। পুরো বইতে একটাও ছবি নেই। কী আপদ।
অবশেষে একটা পকেট সাইজের হলদেটে পাতাঅলা বইতে থিতু হলাম। দ্যা স্টোরি অফ ফিলোসফি, লেখক উইল ডিউরান্ট।
শুরু করার সময় অবশ্য এর মাহাত্ম্যটা সেরকম বুঝিনি। অনেক পরে গিয়ে জানতে পারলাম- স্কুল-কলেজে বাংলা রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় যেসব ভাষায় লেখককে পাম দিতে হয়- বাংলার সাহিত্যাকাশে অমুকের আবির্ভাব ধুমকেতুর ন্যায়- সেই কথাগুলো সত্যিকার অর্থেই ডিউরান্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ বলছি।
এখনকার যুগে পপুলার সায়েন্স বইয়ের কাটতি অনেক। সায়েন্স জার্নালিস্ট বা কিছু ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা নিজেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন জটিল তত্ত্বকথা সহজ করে লিখে সাধারণ্যের জন্য বইপত্র বের করেন। ডিউরান্ট তার বইতে সেই কাজটাই করেছেন, খালি বিজ্ঞানের জায়গায় দর্শনকে নিয়ে। আরো ঠিক করে বললে পশ্চিমা দর্শন।
বইটার মূল বৈশিষ্ট্য হল এর অসাধারণ বর্ণনার ঢং। বইটা যতটা না বই, তার চেয়ে যেন দাদামশায়ের গল্প- বহুদিন ধরে বহুদেশ ঘুরে তারিণীখুড়ো দর্শনের আশ্চর্য সব কাহিনী নিয়ে নাতিনাতনিদের সামনে বসেছেন। সেই গল্পে সক্রেটিসের গিন্নীর ভালোবাসার কথা আছে, স্টোইক দার্শনিকের পা মুচড়ে ভেঙে ফেলার কথা আছে, ভলতেয়ারের বেয়াদবি আর ছ্যাঁচড়ামোর উদাহরণ আছে, শিক্ষকের মেয়ের কাছে স্পিনোজার প্রেম নিবেদনের এবং ছ্যাঁকা খাওয়ার বিবরণ আছে। আছে ফ্রান্সিস বেকনের মুরগি আর বরফ দিয়ে এক্সপেরিমেন্টের গল্প, গুরুর মৃত্যুতে প্লেটোর আহাজারি। এর মধ্যে মধ্যেই লেখক আশ্চর্য উপায়ে দর্শনের বিভিন্ন আইডিয়ার ছায়া এনেছেন। বিস্তারিত নয় মোটেই, খালি ছায়া পর্যন্তই। সেই ছায়াগুলো পড়লে নিজের মধ্যেও একটা দার্শনিক ভাব আসে। মনে হয় মনের দক্ষিণে একটা জানালা খুলে গেছে, সেখান দিয়ে দর্শন-দর্শন গন্ধঅলা বাতাস আসাযাওয়া করছে।
বইটা পৃথিবীময় পাঠকসমাজের পরম ভালোবাসার একটা বই।
এবং আজ বুঝি, দর্শন শিক্ষার জন্য এরকম ক্ষতিকর বই দুনিয়াতে বোধহয় আর দু'টি নেই।
(আগের অনুচ্ছেদের ন্যাকামোগুলোর জন্য দুঃখিত- আপনারা জানেন এসব আমার ধাতে নেই। কিন্তু শেষ লাইনটার ধাক্কাটা দেওয়ার জন্য কোনমতে বমি আটকে একটু ন্যাকা কথা লিখতে হল)
২।
দর্শন নিয়ে এরকম বই অবশ্য ডিউরান্ট একা লেখেননি। ইয়স্তেন গার্ডারের সোফিস ভের্ডেন (বাংলায় সোফির জগত) আজিজ সুপার মার্কেটে নিশ্চয়ই পাবেন। এই বইটারও কাঠামো একই, গল্পের ঢঙে দর্শনের ইতিহাস বয়ান করা। এবং ডিউরান্টের স্টোরির মত এখানেও আল ফারাবি, ভাস্করাচার্য, সাদিয়া বেন গাওন বা লাওৎযির কোন উল্লেখ নেই- এটাও শুধু পশ্চিমকে নিয়ে।
তো এসব বইয়ের এত জনপ্রিয়তার কারণ কী?
মানুষের মনে দর্শন সম্পর্কে একটা পান্তাভাত মার্কা ধারণা আছে। সেই ধারণাটা সৃষ্টির পেছনে এই বইগুলোর অবদান অনেক, আর বইগুলোতে এই ধারণাটাকে আরো পোক্ত করা হয় বলে এদের কাটতিও বেশি।
পান্তাভাত ধারণাটা হল- আমাদের জীবনে দর্শন জিনিসটার আদৌ কোন গুরুত্ব বা প্রাসঙ্গিকতা নেই। আগেকার দিনের কিছু মানুষের খেয়েদেয়ে সময় একটু বেশি ছিল, এজন্য তারা আরামকেদারায় শুয়ে শুয়ে এটাসেটা নিয়ে চিন্তা করেছে। সেই চিন্তাগুলো পড়তে গেলে মাথার মধ্যে কেমন একটা আলোড়ন হয়, শরীরে একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব আসে। মাঝে মধ্যে দর্শনের উদ্ধৃতি জায়গামত ছাড়তে পারলে শ্রোতামহলের কাছ থেকে একটু আহা উহু শোনা যায়। দর্শনের একমাত্র কাজ এই আলোড়ন, এই আমেজ, আর এই আহা-উহুটা যোগানো।
এই অনুভূতিগুলোকে কোন কারণে আমরা সভ্য জগতের মানুষ অনেক সমাদর করি, জীবসত্ত্বা মানবসত্ত্বা ইত্যাদি বড় বড় কথা বলে। কিন্তু আসলে দৈনন্দিন জীবনে চলতে বা মানুষের অবস্থার উন্নতি করতে এদের ভূমিকামাত্র নেই।
এই বাস্তবতার প্রমাণ হল ডিউরান্ট আর গার্ডারের বইয়ের কাটতি। দর্শন যদি কাজের আলোচনাই হয়ে থাকত, তাহলে বাবা দার্শনিকদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এত কথা কেন? স্পিনোজা যে লেন্স বানিয়ে জীবনযাপন করতেন তা জেনে আমার কী লাভ? কান্ট রোজ বিকেলে হাঁটতে বেরোতেন সেটা ধুয়ে আমি কী পানি খাব? নিচি (Nietzche) যে বড়মাত্রার incel ছিলেন সেটা দিয়ে আমার চলতে ফিরতে কি লাভ হবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজ। এই লেখকেরা আসলে দর্শনের নাম করে সাহিত্য লিখতে বসেছেন। মাঝেমধ্যে দর্শন আনছেন বটে, কিন্তু সেটা সাহিত্যের সেবাদাসী হিসেবে, মাঝেমধ্যে বড় বড় কথা বলে পাঠকের মধ্যে ঐ ভাবটা দেওয়ার জন্য।
অথচ দর্শন, অন্তত অ্যানালিটিক বা বিশ্লেষণাত্মক দর্শন বলতে আমরা যা বুঝি- তার সাথে সাধারণ্যের মনের এই ধারণার আদৌ মিল নেই।
আমার এই আনাড়ি লেখার উদ্দেশ্য একটা ব্যাপার প্রতিষ্ঠা করা। সেটা হল- দর্শন একটা রিসার্চ ডিসিপ্লিন। বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব বা সমাজতত্ত্বের গবেষকেরা যেরকম একটা নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যম বিভিন্ন সমস্যা বা জিজ্ঞাসার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেন, দার্শনিকরা ঠিক সেই লাইনেই আছেন।
পৃথিবীর এত এত বিশ্ববিদ্যালয়ে এত এত দর্শন ডিপার্টমেন্ট- তাদের উদ্দেশ্য গঞ্জিকার চাষ নয়। তাদের উদ্দেশ্য গবেষণা।
৩।
যেকোন কিছুকে গবেষণা আখ্যা দিতে হলে তার দু'টো গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত মানা চাই। প্রথমত, গবেষণার কাঁচামাল হিসেবে কিছু উপাত্ত- তা হোক মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশান, কোষের ভেতরে ডিএনএ মিউটেশানের হার, কিংবা চাঁদপুরের শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়ার প্রকোপ। আর দুই, গবেষণা করার একটা নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
দর্শনকে যদি আমি গবেষণা দাবি করি, তাহলে এর উপাত্ত কী?
এ প্রশ্নের উত্তর আসলে দর্শনের একেক শাখার জন্য একেকরকম। আমি বিজ্ঞানের দর্শন (philosophy of science) থেকে একটা উদাহরণ দেই, তারপর সেটাকে টেনে একটু সার্বজনীন করা যাবে।
বিজ্ঞানের দার্শনিকরা যে ক'টা মূল প্রশ্ন নিয়ে কাজ করেন তার মধ্যে একটা হল- বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সংজ্ঞা আর পূর্বশর্তগুলো কী? অর্থাৎ কখন একটা ধারণাকে আমরা সাধারণ মতামত থেকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বতে প্রোমোশান দেব?
এ ব্যাপারে একজন দার্শনিকের কর্মপ্রক্রিয়া দেখানোর আগে প্রশ্নটার গুরুত্ব সম্পর্কে দু'কথা বলে নেই। অন্তত আধুনিক যুগে আমরা যেকোন নতুন ধারণার গ্রহণযোগ্যতা বিচারে বিজ্ঞানকে প্রাধান্য দেই। কাজেই কোন ধারণা যদি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে সেটা আমাদের কাছে বাস্তবসম্মত বা যৌক্তিক হিসেবে মর্যাদা পাবে। যেমন আজ যদি প্রমাণিত হয় হোমিওপ্যাথিশাস্ত্র কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে- আমরা অবশ্যই সেটাকে আলাদা একটা সমীহের চোখে দেখব, এবং এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হবে। এর অনেক বৈষয়িক তাৎপর্যও আছে। যেমন হোমিওপ্যাথি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পর্যায়ে উঠলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তারা এই লাইনে অনুদান ঢালা শুরু করতে বাধ্য হবেন। শিক্ষাক্রমের কোথাও না কোথাও অ্যালোপ্যাথির পাশাপাশি হোমিওকেও রাখা হবে। ইত্যাদি।
আগের প্রশ্নে ফিরে যাই- এ ধরণের একটা সমস্যার সমাধানের জন্য দার্শনিকরা উপাত্ত হিসেবে কাকে ব্যবহার করেন? এর উত্তর হল, বিজ্ঞানের সার্থক তত্ত্বগুলোকে। বিজ্ঞানের এমন অনেক তত্ত্ব আছে যেগুলোকে আমরা সবাই অবিসংবাদিতভাবে সত্য এবং সার্থক বলে জানি- যেমন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। দার্শনিকরা তাদের সিদ্ধান্তে আসার জন্য এ ধরণের তত্ত্বগুলোকে সামনে নিয়ে বসেন, বসে তত্ত্বগুলোর আকার আকৃতি, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া, এবং তত্ত্বগুলোকে ঘিরে তৎকালীন সমসাময়িক বিতর্ক- ইত্যাদি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। এই প্রক্রিয়া থেকে সার্থক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের একটা চেহারা বা প্রোফাইল তৈরি হয়। এরপর হোমিওপ্যাথি বা জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্ন আসলে তারা নতুন চিড়িয়াকে এই প্রোফাইলের সাথে মিলিয়ে দেখেন।
যেমন ধরুন, একজন দার্শনিক কোপার্নিকাস আর টলেমির মডেলদু'টো মুখোমুখি নিয়ে বসেছেন। দার্শনিক প্রথম যে ব্যাপারটা খেয়াল করবেন তা হল- এই বিতর্কে টলেমির তত্ত্বটা যে ঠিক ভুল প্রমাণ হয়েছিল, তা কিন্তু না। টলেমি হিসাবকিতাব করে কিন্তু পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখে ঠিকই সূর্যকে চারপাশে ঘুরিয়ে একটা মডেল দিতে পেরেছিলেন। সমস্যাটা যেটা দাঁড়াল- টলেমির এই হিসাবগুলো ছিল আশ্চর্যরকমের জটিল। অন্যদিকে কোপার্নিকাসের মডেল ছিল অপেক্ষাকৃত সরল।
সেই সময় থেকেই বিজ্ঞানীরা ঠিক করেছেন, একটা তত্ত্ব যদি সরল হয়- অর্থাৎ কম কথা বলে সেই তত্ত্ব দিয়ে যদি একই পরিমাণ উপাত্ত ব্যাখ্যা করা যায়- তাহলে সেই সরলতার মধ্যে একটা নান্দনিকতা (elegance) আছে। এই নান্দনিকতাটা সার্থক তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
এই একই দার্শনিককে এবার কল্পনা করুন গত শতাব্দীর শুরুতে, যখন আলোর চলাচলের জন্য মাধ্যমের প্রয়োজন হয় কিনা সেটা নিয়ে বিজ্ঞানপাড়ায় বিতর্ক চলছে। একদল বিজ্ঞানী তখনও "ইথার" তত্ত্বের পক্ষে বলে যাচ্ছেন- গোটা মহাবিশ্বটা ইথার নামের এক বস্তু দিয়ে ঠাসা, যদিও তাকে ধরা-ছোঁয়া-দেখার কোন উপায় নেই। টলেমি আর কোপার্নিকাস নিয়ে পড়াশোনা করা দার্শনিক তাদেরকে শুনিয়ে দিতে পারবেন- দেখুন, এরকম অদ্ভুত একটা জিনিসকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা না করে যদি আমরা মেনে নেই আলোর জন্য কোন মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না, তাহলেই আমরা একটা চমৎকার সরল তত্ত্ব পেয়ে যাই। অন্যদিকে ইথারকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে খামোখা ইহাকে দেখা যায়না ধরে যায়না ছোঁয়া যায়না ইত্যাদি হাজারটা উপপ্রমেয় যোগ দিয়ে একটা কঠিন জিলিপি বানিয়ে ছাড়তে হয়। সরলতা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ- কোপার্নিকাসের কথা ভুলে গেছেন?
একইভাবে আজ যদি কেউ বলে- নতুন করোনাভাইরাসকে চাইনিজরা শয়তানি করে তাদের ল্যাবরেটরিতে বানিয়েছে- সেক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের দার্শনিক পইপই করে বলে উঠবেন, বাদুড় থেকে এই ভাইরাস এসেছে এই তত্ত্ব দিয়েই ভাইরাসটার আবির্ভাব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এর জন্য আমাদের আলাদা কিছু ধরে নিতে হয় না, কেহ বা কাহাদের জটিল রাজনৈতিক মোটিভেশান নিয়ে নতুন তত্ত্ব বানানোর দরকার হয় না। বাদুড়ের দেহে যে এর কাছাকাছি ভাইরাস থাকে তা আমরা জানি, এবং আজ থেকে ষোল বছর আগে এই একই কাহিনী আরেকবার হয়েছে। এখন সেই চেনাপরিচিত ঘটনাটাই আবার হচ্ছে, এটা মেনে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিজ্ঞান সরলতার ভক্ত, শক্ত প্রমাণ ছাড়া সে প্যাঁচমার্কা কুটিলতার দিকে যেতে চায় না।
এটা শুধু বিজ্ঞানের দর্শনের উদাহরণ। দর্শনের অন্য শাখার উপাত্ত বাছাই প্রক্রিয়াও এর থেকে আলাদা নয়। একজন জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemologist) যখন বিশ্বাসের যৌক্তিকতা বা justification নিয়ে চিন্তা করেন, তিনি প্রথমে তাকান আমাদের সেইসব বিশ্বাসের দিকে- যেগুলো আমরা সবাই অবিসংবাদিতভাবে সত্য মানি। এটাই তার উপাত্ত বা ডেটা। নৈতিক দার্শনিকও তার নৈতিকতার তত্ত্ব দেওয়ার সময় জানা নৈতিক সত্যগুলোকে উপাত্ত ধরে তারপর আগান। অধিবিদ্যা আর যুক্তিবিদ্যায়ও একই ব্যাপার ঘটে, যদিও সেখানকার উদাহরণগুলো আরেকটু জটিল।
এবার আসি গবেষণার দ্বিতীয় পূর্বশর্তে- নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এটায় এত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে না গিয়ে আপনাদেরকে সরাসরি একটা উদাহরণ দেখাই।
আমার এখনকার ইউনিভার্সিটিতে- অর্থাৎ ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে- রবার্ট কুনস বলে একজন অ্যানালিটিক দার্শনিক গবেষণা করেন। তার কাজের ক্ষেত্র মূলত অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স। ভদ্রলোক বছর বিশেক আগে সমসাময়িক অধিবিদ্যার কিছু সমস্যা নিয়ে বেশ কাঠখোট্টা একটা বই লিখেছেন। বইটার প্রথম অধ্যায়ের আলোচনার বিষয়বস্তু- দর্শনের তত্ত্বগুলো যাচাইয়ের প্রক্রিয়া কী। অর্থাৎ দর্শনশাস্ত্রের কোন সমস্যা সমাধানের জন্য যখন বিভিন্ন তত্ত্ব এসে হাজির হয়, তাহলে তাদের মধ্যে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল- সে সিদ্ধান্তে আমরা কীভাবে পৌঁছব।
কুনস এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে নিচের তালিকাটা দিয়েছেন-
- বাস্তবসম্মত হওয়া (intuitive fit)
- বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাথে খাপ খাওয়া (empirical adequacy)
- তত্ত্বটার সত্য/মিথ্যা পরখ করার উপায় থাকা- বিজ্ঞানীরা যেটাকে বলেন ফলসিফিয়েবিলিটি (epistemic access)
- অন্যান্য তত্ত্বের সার্থকতা ব্যাখ্যা করতে পারা (superseding competitors)
- এই তত্ত্ব দিয়ে নতুন পর্যবেক্ষণ বা ধারণা প্রেডিক্ট করতে পারা (metaphysical fecundity)
- সরলতা বা নান্দনিকতা (simplicity or elegance)।
এই তালিকাটা থেকে দু'টো জিনিস লক্ষ্যণীয়। প্রথমত, দার্শনিক এখানে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কিছু পূর্বশর্ত রেখে দিচ্ছেন, যেটা ব্যবহার করে গবেষণার সময় বিভিন্ন ধারণা বা মতামতকে ঝাড়াইবাছাই করা যাবে। অর্থাৎ, তার কাজের একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে, যেটা কিনা গবেষণার পূর্বশর্ত।
দ্বিতীয়ত, এই তালিকার সাথে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পূর্বশর্তগুলোর যথেষ্ট মিল আছে। যেকোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করতে পারে, এর সত্য/মিথ্যা পরখের সুযোগ থাকে, এটা ব্যবহার করে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়, এবং এর মধ্যে একটা তুলনামূলক সরলতা থাকে- যথাক্রমে তালিকার দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ সদস্য।
আসলে আপনি যদি বিজ্ঞান জিনিসটাকে বেশ বড় করে দেখেন- যেকোন নিয়মতান্ত্রিক গবেষণাকেই বিজ্ঞান মেনে নিতে রাজি থাকেন- তাহলে অবশ্যই অ্যানালিটিক দর্শনকে বিজ্ঞান বলতে হবে। দর্শনের তথ্য-উপাত্ত-কর্মপ্রক্রিয়াতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির একটা স্পষ্ট ছায়া আছে। এজন্যই একুশ শতকের দর্শন পড়তে গেলে প্রায়ই সেখানে সমসাময়িক বিজ্ঞানের আলোচনা দেখবেন- অধিবিদ্যার মধ্যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স, ফিলোসফি অফ মাইন্ডের মধ্যে নিউরোসায়েন্স, মোডাল লজিকের মধ্যে গণিত।*
৪।
উপাত্ত এবং প্রক্রিয়া- এই দুই নিয়ে এতক্ষণের আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা একুশ শতকে দর্শনের একটা ব্যবহারিক সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি।
আজকের দিনে প্রকৃতি সম্পর্কে জানার প্রথম এবং প্রধান উপায় হল বিজ্ঞান। বিজ্ঞান বলতে এখানে পদার্থবিদ্যা থেকে নিয়ে সমাজতত্ত্ব পর্যন্ত সব ধরণের নিয়মতান্ত্রিক গবেষণাকেই বোঝাচ্ছি।
সমস্যা হল, বিজ্ঞান থেকে পাওয়া যাবতীয় তথ্য উপাত্তকে যদি আমরা একটা বিশাল বইয়ের মধ্যে লিখে ফেলি, তাহলেও আমরা জগত সম্পর্কে সবকিছু জানতে পারব না। বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ উন্নতির পরেও কোন তত্ত্ব সঠিক, ভেতরকার কোন স্বীকার্যে ঠিকভুল আছে কিনা, যাচাই করার প্রক্রিয়া কী- ইত্যাদি ব্যাপারে আলোচনার জায়গা থেকে যাবে। সেই খাদগুলো ভরাট করার জন্য মানুষের যে গবেষণাশাস্ত্র বা রিসার্চ ডিসিপ্লিন আছে, তার নাম দর্শন।
এই দর্শনের অবদান রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দর্শনের মত বৈষয়িক পর্যায়েও থাকতে পারে, আবার অধিবিদ্যা আর জ্ঞানতত্ত্বের মত তাত্ত্বিক বিষয়েও থাকতে পারে। বিজ্ঞানের মতই। বিজ্ঞানেও সমাজতত্ত্ব বা জনস্বাস্থ্যের মত ব্যবহারিক শাখা আছে, আবার অন্যদিকে তাত্ত্বিক গণিত বা পদার্থবিদ্যার মত ব্যাপারও আছে।
শেষ করি দর্শন সম্পর্কে সাধারণ্যের ধ্যানধারণা নিয়ে আরেকটু বিরক্তি প্রকাশ করে।
যখন কাউকে বলি- আমি দর্শনশাস্ত্রের ভক্ত, প্রত্যুত্তরে একদম প্রথমদিককার যে প্রশ্নটা শোনা যায় তা হল- তুমি কি প্লেটো/সক্রেটিস/হিউম/কান্ট/অন্য কোন প্রাচীন দার্শনিকের লেখা পড়েছ?
আপনি যদি আমার এই লেখাটা পড়ে আজ থেকে দর্শনকে রিসার্চ ডিসিপ্লিন হিসেবে ভাবতে শুরু করেন, আপনারও এই প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হওয়ার কথা। এর কারণ, দুনিয়ার আর কোন রিসার্চ ডিসিপ্লিনে প্রাচীন লেখকদের বইপত্র পড়তে উৎসাহ দেওয়া হয় না। আপনি যদি পদার্থবিজ্ঞানের ভক্ত হন, দুনিয়ার কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করবে না- তুমি কি নিউটনের অপটিক্সটা পড়েছ? ম্যাক্সওয়েল? ফ্যারাডের লেখা কিন্তু ভাই বেশ ভাল লাগে।
শুধু দর্শনের বেলাতেই এই ব্যাপারটা হয়। এর কারণ মানুষ দর্শনকে দেখে সাহিত্য হিসেবে। সাহিত্য পড়া মানেই যেমন রবীন্দ্রনাথ বা দস্তয়েভস্কি পড়া, একইভাবে দর্শন পড়া মানে মানুষ ভাবে সক্রেটিস পড়া।
কিন্তু দর্শন যদি রিসার্চ ডিসিপ্লিন হয়ে থাকে, তাহলে আপনি বুঝবেন যে অন্য সব গবেষণাশাস্ত্রের মত এরও দিনে দিনে উন্নতি হয়। আজকের দর্শন আজ থেকে একশ' বছর দর্শন থেকে অনেক উন্নত, কারণ প্রত্যেক যুগের দর্শন গবেষকেরা তাদের পূর্বসূরীদের কাজ পড়েছেন, কাটাছেঁড়া করেছেন এবং সেগুলোর উন্নতি করেছেন। সক্রেটিসের ডায়ালগ উচ্চমানের দর্শন সন্দেহ নেই, কিন্তু তার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা একসাথে খিচুড়ি পাকিয়ে আছে। সক্রেটিস আর প্লেটো মিলে সেগুলোর সুতো টানা শুরু করেছেন শুধু, জট খোলেননি। তার পর থেকে কয়েক হাজার বছর ধরে দার্শনিকেরা তার ডায়ালগের ধারণাগুলোকে আলাদা আলাদা করেছেন, প্রত্যেকটাকে ডেভেলাপ করেছেন, কিছু ক্ষেত্রে তাদের সময়কার উন্নত যুক্তিতে না টিকলে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছেন।
আমার ধার্মিক ফলোয়ারদের জন্য লিখছি- মধ্যযুগে ইসলামের কালাম দর্শনের সাথে যদি একুশ শতকের বিজ্ঞান-বিজ্ঞান চেহারার অ্যানালিটিক দর্শনকে মেলাতে যান, ভুল করবেন।
ডারউইন তার তত্ত্ব দিয়েছেন আজ থেকে একশ' ষাট বছর আগে। আমরা কি বিবর্তন বুঝতে গেলে ডারউইনের দ্বারস্থ হই? মোটেই না। আজকে ইউনিভার্সিটি পর্যায়ের একটা বিবর্তন ক্লাসে ডারউইনের নামও উচ্চারণ না হতে পারে। এর কারণ ডারউইনের পরপর মেন্ডেল, কিমুরা, ওহতা, ওহনো, ওয়াডিংটন, ম্যাকক্লিনটক, শাপিরো, এবং আরো অনেক অনেক গবেষক তাদের কাজের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে তার তত্ত্বকে পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জন করেছেন। আজকের দিনে বিবর্তন শিখতে গেলে এই ডারউইন-পরবর্তীদের গবেষণাপত্র নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হয়। এটাই হচ্ছে সময়ের সাথে বিজ্ঞানের ক্রমোন্বতি।
একই জিনিস দর্শনের ক্ষেত্রেও হয়। অবশ্যই হয়।
এজন্যই দর্শন শিখতে গেলে আর প্লেটো অ্যারিস্টটলের নাম করবেন না। অধিবিদ্যার জন্য ধরবেন আর্মস্ট্রং কিংবা প্রুস, লজিকের জন্য ক্রিপকি, বিজ্ঞানের দর্শনের জন্য ভান ফ্রাসেন।
আমি থাকি জীববিজ্ঞান নিয়ে, খোঁজ নিলে হয়ত দেখব এদের প্রত্যেকের কাজও পুরোনো হয়ে গেছে।
Writer: Hassan uz Zaman Shamol