মানুষ আর প্রযুক্তির (অ?)শুভ বিবাহ

Biotechnology

(১)
ম্যাকের বয়স মাত্র ১০। অথচ এই ছোটবেলাতেই তার এডভেঞ্চারের ঝুড়িতে যে কত গল্প তার ইয়ত্তা নেই। বজ্জাত প্রতিবেশী বুড়োর বাগান থেকে আম চুরি করা থেকে শুরু করে খরস্রোতা নদীতে সাতারের প্রতিযোগিতা, ক্ষ্যাপা ষাড়ের পিঠে চড়ে পাড়া বেড়ানো, সন্ধ্যাবেলায় শ্মশান থেকে বল আনা, কীংবা রাজহাসের তাড়া খেয়ে কাদার মাঝে লুটোপুটি খাওয়া, কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি?
আজ সে আরেকটা দুঃসাহসিক কাজ করতে বেড়িয়েছে। একটু পরেই সাইসাই করে ছুটে আসবে ট্রেন। সে আর তার বন্ধু ট্রেনের দুইপাশে দৌড়াবে। যে ট্রেনের আগে ছুটতে পারবে সেই বিজয়ী। ওই যে, ঝিকঝিক আওয়াজ পাওয়া যায়।
বাতাসের ধাক্কা মুখে লাগছে, রেললাইনের পাতগুলো কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। আরেকটু, তাহলেই ট্রেনের চেয়ে এগিয়ে যেতে পারবে ও... আ!
প্রচন্ড ব্যাথায় কুকিয়ে উঠল ম্যাক। তার বন্ধু ট্রেন চলে যেতেই তার দিকে দৌড়ে আসছে। ম্যাক ঝাপসা চোখে একবার তার বন্ধুর দিকে তাকায় একবার তার পায়ের দিকে, যেটা তার থেকে পাচহাত দূরে লাইনের অন্যপাশে পরে আছে।
ম্যাক ওখানেই জ্ঞান হারালো।

(২)
রাস্তায় বের হলেই অনেক গরিব মানুষ চোখে পড়ে যাদের অঙ্গহানি হয়েছে। সাধারনত হাত কীংবা পা ছাড়া মানুষ আমাদের আশেপাশেই থাকেন। কী কঠিন জীবন তাই না তাদের? অনেকে পায়ে Prosthetics পড়েন তবে তা তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার অনুভূতি কখনোই দিতে পারে না।
Bionics হল এক শব্দ যা দ্বারা বোঝায় জীববিদ্যা অথবা প্রকৃতির সাথে প্রযুক্তির সংমিশ্রন। এটারই একটা অংশ নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কীভাবে যাদের অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে তাদের সাহায্য করা যায়।
সেই শুরুঃ
১৯৯৩ সালে প্রথম বায়োনিক অপারেশন করা হয় রবার্ট ক্যাম্পবেল নামে এক ব্যাক্তির ওপর যিনি ১১ বছর আগে পেশীর ক্যান্সারের কারণে পুরো হাতটাই খুইয়েছিলেন। এডিনবার্গের মার্গারেট রোজ হাসপাতালের পাচজন বিশিষ্ট বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার মিলে তৈরী করেছিলেন এই আশ্চর্যের প্রসথেটিক্স। আসল চামড়ার মত দেখতে বাইরের লেয়ারের নিচে ছিল অনেক গিয়ার, চিপ আর মোটর যা দ্বারা রবার্ট বিভিন্ন পজিশনে হাত নাড়াতে পারত।
পরের বছর গুলোতে রবার্ট প্লেন চালানো শিখেছে কীনা কিংবা শ্যুটিং প্রতিযোগিতায় ট্রফি পেয়েছে কীনা সেটা নাহয় লিংকে যেয়েই দেখে নিলেন, তবে এই প্রথম বিজ্ঞান এমন এক শাখার শুরু করেছিল যা মানুষের সাথে প্রযুক্তিকে আক্ষরিক অর্থেই জুড়ে দেয়। ম্যান-ওয়েড-মেশিন।

(৩)
ম্যাক তার ঘরে বসে আছে। বীভৎস অপারেশন থিয়েটারের স্মৃতি মনে আসছে বারবার। তবে মন্দের ভাল একটা প্রস্থেটিক লাগিয়ে দিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি, কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি বলে বেশ হালকা ওটা। ভেতরে থাকা মোটরগুলো ঘুরলে কম্পনটা টের পাওয়া যায়। সহজেই খোলা যায় আবার লাগানোর সাথে সাথেই ওটা "অনুভব" করতে পারে। অনেকটা আসল পায়ের মতই। প্রতিটা আঙুল আলদা করে নাড়ানো যায়। এমনকি যেটা তার আসল পা দিয়েও করতে পারত না সেটাও করতে পারে। যেমন পায়ের গোড়ালি আর হাটু পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরাতে পারে। মাঝে মাঝে অসুবিধে হয় যদিও।
জিনিসটা আরেকটু শক্ত হতে পারত না? স্টীলের তৈরী? ফ্যাটবয় ডাডলির পেট বরাবর আচ্ছামত লাথি বসানো যেত, হাহা।

(৪)
অবশ্যই যারা অঙ্গহারা বলে কাজ পান না, বা সাধারন জীবনযাপনের জন্যেও নির্ভর থাকতে হয় অন্যের ওপর, তাদের আর নিজেদেরকে অন্যদের ওপর বোঝা ভাবতে হবে না। ধীরে ধীরে প্রযুক্তির যত উন্নতি হবে তারা তাদের প্রস্থেটিক আরো ভাল করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। একজন স্বাভাবিক মানুষ যা যা করতে পারে তারা আর সেগুলো থেকে বঞ্চিত হবেন না। তাদেরকে বুলির শিকারও হতে হবে না।
আধুনিক বিজ্ঞান শুধু স্মার্ট বায়োনিক হাত পা বানিয়েই বসে থাকেনি। বায়োনিক চোখ অন্ধদের কি পরিমাণ উপকারে লাগবে তা বলার প্রয়োজন নেই। এখন যেই বায়োনিক চোখগুলো আছে সেগুলো সরাসরি অপটিক্যাল নার্ভে ইলেক্ট্রিকাল ইমপালস পাঠিয়ে একটা দৃশ্যের ধারণা দিতে পারে। এটাকে Phosphene বলে। অনেকটা চোখে জোরে চাপ দিলে আমরা যেমন বিভিন্ন রঙের আলো দেখতে পাই, সেরকম। তবে হ্যা, এটার অর্থ হচ্ছে মানুষটার অপটিক্যাল নার্ভ কিছুটা হলেও সচল থাকতে হবে। জন্মান্ধদের ক্ষেত্রে এটা কাজে দেবে না। এমন প্রস্থেটিক লাগানো মানুষ চোখে আসলে কেমন দেখে সেটা রেফারেন্স লিংক ৩ এ যেয়ে দেখতে পারবেন।
তাহলে যারা জন্মস্নধ, তাদের আশা নেই?
ইসরায়েল একটা বায়োনিক লেন্সের প্রপোজাল দিয়েছিল অনেক আগে, সেই ২০১৩ সালে। একটা ডিভাইস থাকবে ক্যামেরা লাগানো, যেমন চশমা, যেটা ছবিগুলোকে হাই রেজুলেশন পিক্সেলে ওয়্যারলেসে কন্টাক্ট লেন্সে পাঠাবে। কন্টাক্ট লেন্সের কাজ হল সেই ইমেজগুলো নিয়ে কর্নিয়ায় থাকা হাজার হাজার সেনসরি পয়েন্টসে ছোট্ট ইলেক্ট্রোড ব্যবহার করে ইলেক্ট্রিক স্টিমুলাস দিবে। সেই সেনসরি পয়েন্ট স্টিমুলাস নিয়ে যাবে মস্তিষ্কের ভিজুয়াল প্রসেসিং অংশে, এবং এরফলে অপটিক নার্ভ ঠিক না থাকার পরও মস্তিষ্কের কাছে ভিজুয়াল স্টিমুলাস পাঠাতে কোনো সমস্যা হবে না। রেফারেন্স লিংক ৪ এ এটা নিয়ে বলা। প্রফেসর জিভ জালেভস্কির মতে এটা অনেকটা ব্রেইলের মত।
নিল হার্বিসনের নাম শুনেছেন? ছোটবেলায় ডিসকভারির নেক্সট ওয়ার্ল্ড শো তে মনে হয় প্রথম দেখেছিলাম। ওনার মাথায় একটা আজব যন্ত্র লাগালো। সেটাইয় একটা ক্যামেরা আছে যা বিভিন্ন রঙের স্টিমুলাস তার মস্তিষ্কের সাউন্ড প্রসেসিং অংশে পাঠায়। যার ফলে তিনি রঙ শুনতে পান, আক্ষরিক অর্থেই। আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম এটা দেখে। সায়েন্স ফিকশন বইয়ের সাইবর্গ! ভাবা যায়?
শুধু তাই নয়, তিনি তার পাচজন বন্ধুকে পারমিশন দিয়ে রেখেছেন যারা চাইলে বিভিন্ন ছবি, রঙ তার মস্তিষ্কে সরাসরি পাঠাতে পারে। তিনি ঘুমালে তারা তার স্বপ্নও প্রভাবিত করতে পারে।
সময় বোঝার জন্যেও তিনি আলাদা সেটিং করে রেখেছেন। যেমন, একটা গরম অনুভূতি তার খুলির চারপাশে ঘুরতে থাকে। মধ্যদুপুরে এই গরম অনুভূতি মাথার একদম সামনে মাঝখানে থাকে।
তার একটা দাত একটা ব্লুটুথ ডিভাইস। যেটা দিয়ে তিনি আরেকটা বন্ধুর দাতে সিগন্যাল পাঠাতে পারেন। আর অপর দাতটি হালকা কাপতে থাকে। এভাবে মর্স কোড ব্যবহার করে তারা যোগাযোগ করতে পারেন। তার ব্যাপারে উইকিপিডিয়াতেই পড়তে পারবেন।

(৫)
নিজের ঘরে বসে কাদছে যুবক ম্যাক। অলিম্পিকস থেকে তার নাম কাটা পড়েছে। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে তার পা। এটা তাকে বাড়তি সুবিধা দেয়। কত আশা, কত স্বপ্ন, সব জলে গেল। কোথায় সে ডাক্তার যে তাকে বলেছিল সে সাধারণ মানুষদের সব সুবিধাই উপভোগ করতে পারবে?
ধীর পায়ে আলমারি থেকে স্টীলের পা টা বের করল। মেজাজ চরম বিগড়ে আছে তার। সে সাধারণ মানুষের জীবন চেয়ে ভুল করেছিল। সে অসাধারণ, উন্নত!

(৬)
এইযে বায়োনিক্সের গুণগান গেয়ে যাচ্ছি তখন থেকে, একটু থেমে এবার কি প্রশ্ন করা যায় না যে এর ভবিষ্যৎ কী? মানে বিষয়টা সুদূর ভবিষ্যতে কোনদিকে গড়াবে?
প্রস্থেটিক্সগুলো ব্যবহার করে কী কোনো অপরাধ সংগঠিত হতে পারে? ভাবুন তো, টাইটানিয়ামের তৈরী প্রস্থেটিক কীংবা এক্সো আর্ম দিয়ে এক ঘুষি মেরে আপনার বাড়ির দেয়াল ভেঙে আপনার ঘরে আততায়ী প্রবেশ করল, তখন? সমস্যা না? তখন কী সবাই এমন "আপগ্রেড" চাইবে না? আমিও তো চাইব।
উপরে যে নিলের কথা বললাম, এরকম ব্যাপার ভবিষ্যতে সাধারণ হয়ে যাবে না?
এটা বাধা দেয়ার কোনোই উপায় নেই। আমরা আসলে এখন নবজাতক সাইবর্গ। ধীরে ধীরে আরো বড় সাইবর্গ হব। তখন আমাদের শৃঙ্খলায় রাখার জন্য প্রয়োজন পড়বে নতুন আইনের। যেখানে আমাদের মস্তিষ্ক হ্যাকিংয়ের রিস্কে থাকবে সেখানে আইন কানুন, নিরাপত্তা সবকিছুর সংজ্ঞাই নতুন করে লেখা হবে। ৬ নাম্বার লিংকের আর্টিকেল বেশ বড় তবে এটা এসব আইন আর পলিসির ব্যপারেই কথা বলেছে।

(৭)
অলিম্পিক্সের প্রধান নির্বাচক সিগমন্ড গাড়ি করে বাসায় ফিরছিলেন। আজ রাত একটু বেশি হয়ে গেছে। স্ত্রীর তিক্ত কটুক্তিমাখা কথার কারণে বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিয়েছিলেন। ড্রাইভারকে তাড়াতাড়ি চালাতে বলতেই যাবেন তখনই গাড়ির গতি কমে আসল।
সামনে ভাল করে তাকিয়ে দেখেন অন্ধকার গলির মাঝে ভাঙা ল্যাম্পপোস্টের নিভু নিভু আলো মেখে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। মাথায় হুড পড়া। ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল। কি মুশকিল! ড্রাইভার গাড়ি আবার স্টার্ট দিল।
হটাৎই গাড়ির ভনেটে প্রচন্ড শক্তিতে লাথি মারল লোকটা। গাড়ির ভনেট থেকে ধোয়া উঠতে লাগল। জানালার কাচেও লাথি মেরে দরজা খুলে বের করে আনল সিগমন্ডকে। ড্রাইভার বেচারা জান নিয়ে পালিয়ে গেল।
বেশ কিছুদুর যাওয়ার পর পিছু তাকিয়ে দেখল তার মালিকের শরীর সেটে আছে গাড়ির সাথে। কুজো, নিথর।
ড্রাইভার পালিয়ে গেল।

(৮)
আমার কাছে শুরু থেকেই মনে হয়েছে প্রযুক্তির আসল উদ্দেশ্যই হল এটা। প্রকৃতির সাথে মেলবন্ধন। আমরা আর অপেক্ষা করব না আমাদের অঙ্গহানি হওয়ার। আমরা সেটা ছাড়াই বায়োনিক্স ব্যবহার করব। এতদিন আমরা যে প্রকৃতিকে বাইরে ব্যবহার করেছি এখন সেটার ব্যবহার হবে আরো গভীরভাবে, সেটা মিশে যাবে আমাদের অস্তিত্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে। এতটাই যে কোনোদিন আমাদের ধ্বংস সভ্যতার খনন করতে থাকা কোনো এলিয়েন এটা বলতে বাধ্য হয় যে আমরা এমন এক বুদ্ধিমত্তা ছিলাম যারা নিজেরাই নিজেদের বিবর্তিত করেছি নিজেদেরই তৈরী প্রযুক্তি দিয়ে। আমরা প্রকৃতি থেকে পেয়েছিলাম বায়োলজিকাল বডি ১.০ কিন্তু সেটাকে আপগ্রেড করতে করতে ভার্সন ২.০ , ৩.০, ৪.০ বা ৫.০ ছাড়িয়ে গেছি।
আমরা বায়োনিক্সের কেবল সূচনা করেছি। এটা আমাদের বহুদূর নিয়ে যাবে।

(৯)
সন ২০৪০।
ইন্টারন্যাশনাল সাইবর্গ অলিম্পিক্স এর আজ স্প্রিন্ট রেস হবে। ত্রিশটা দেশ থেকে অংশগ্রহন করেছে ত্রিশজন দৌড়বিদ। সবাই লাইন ধরে আছে।
বুম!
হঠাৎ গুলির শব্দ আর অমনি সবাই এক ছুট লাগালো! চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, একশ কিলোমিটার বেগে দৌড়ে চলছে সব প্রতিযোগী। চারপাশে দর্শকদের উল্লাস, জুয়াড়িদের হা-হুতাশ আর রিপোর্টারদের ড্রোনের ছোটাছুটি। তুমুল উত্তেজনার খেলা চলল তিন মিনিট।
ফিনিশিং লাইন ছিড়ে বেরিয়ে গেল নতুন এক মুখ। বিশ্ব পেয়ে গেল তাদের নতুন চ্যাম্পিয়ন। সবচেয়ে দ্রুতগামী সাইবর্গ!
ম্যাকুইন! ম্যাকুইন! ম্যাকুইন! ম্যাকুইন! ম্যাকুইন! ম্যাকুইন! ম্যাকুইন! ম্যাকুইন! ম্যাকুইন! ম্যাকুইন! ম্যাকুইন! ম্যাকুইন!...
চারপাশে ঘুরে ঘুরে দর্শকদের কন্ঠে তার নাম শুনতে থাকল ম্যাকুইন। তার লাল জার্সির নিচে একটির বদলে শোভা পাচ্ছে দুটি বায়োনিক পা!
(সমাপ্ত)

লেখকঃ মনিফ শাহ চৌধুরী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম