বাটপার এজেন্সিদের নতুন হাতিয়ার জার্মানির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়


গত কয়েকদিন ধরে একটি জিনিস খুব বেশি দেখতেছি আর সেটা হচ্ছে অমুক জার্মান প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে ফোন দিয়ে আমাকে এডমিশন দিবে বলছে। এমনকি সেই সব প্রাইভেট ভার্সিটি নাকি এইচএসসি পর ব্যাচেলারে সরাসরি এডমিশন দিতেছে। অনেকে আবার এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করিয়ে এডমিশন পেয়েছেন। এখন আমাকে অনেকে বলেন সামনে আগানো যাবে কিনা? তাই এই বিষয়ে আমি এখানে কিছু ফ্যাক্ট তুলে ধরলাম। তাই আপনারা সিদ্ধান্ত নেন সেখানে যাবেন কিনা।
প্রথমত, জার্মানিতে ব্যাচেলার প্রোগ্রামে পড়তে হলে আমাদের দেশের ছাত্রদের এইচএসসি পড়ার পর দেশের যেকোন ভার্সিটি থেকে ১ বছর/১.৫ বছর পড়ে সেই ভার্সিটির টোটাল ক্রেডিটের ২৫% কমপ্লিট করতে হয়। তারপর আপনি জার্মানিতে ব্যাচেলারে সরাসরি আবেদনের যোগ্যতা রাখেন। এটা সার্বজনীন নিয়ম। অর্থ্যাৎ এম্বাসিও এই নিয়ম জানে এবং আপনার আবেদন যেই সিটিতে যাবে সেই সিটি অফিসাররাও জানে। এখন কিছু প্রাইভেট ভার্সিটি টাকার লোভে এই নিয়ম না মেনে এডমিশন দিয়ে দেয়। এমনকি এরা কিছুই দেখে না। আপনি জাস্ট আবেদন করবেন আর দেখবেন পরের দিন এডমিশন দিয়ে দিতেছে। আর এটাই ফায়দা নিতেছে এইসব বাটপার এজেন্সি। তারা আপনাকে এটা থেকে সহজেই এডমিশন এনে দিবে। যেহেতু এসব ভার্সিটিতে আবেদন করলেই এডমিশন দিয়ে দেয় তাই এটা মানে এজেন্সির জন্য কিছু ব্যাপার না। এখন এভাবে তো এডমিশন পেলেন, কিন্তু ভিসা পাবেন কি? মনে রাখা ভাল বিশ্ববিদ্যালয় এডমিশন এবং ভিসা প্রক্রিয়া দুইটা আলাদা জিনিস। এজেন্সি তো আপনাকে প্রাইভেটে এডমিশন দিতে পারবে কিন্তু ভিসা দিতে পারবে কি? আর এজেন্সির ভুয়া কথা মানে, 'জার্মানিতে এডমিশন পাওয়া মানে ভিসা পাওয়া' এই ধরনের কথায় যদি বিশ্বাসী হয়ে থাকেন তাহলে আপনার জন্য শুভ কামনা।

দ্বিতীয়ত, অনেকে বলেন এভাবে সেখানে গিয়ে কিছু দিন পরে পাবলিকে মুভ করা যাবে না? এটা এজেন্সির বাটপাররা বলে থাকে। আমার প্রশ্ন আপনি ভিসা পাবেন কিনা সেটা নিশ্চিত করেন আগে। তারপর মুভ করার চিন্তা করেন। আর দেশ থেকেই এডমিশন নিতে পারতেছেন না, আর সেখানে কি গিয়ে করবেন।

তৃতীয়ত, যারা এইচএসসি শেষে ১ বছর দেশে পরে প্রাইভেটে যেতে যাচ্ছেন বিশেষ করে বার্লিনের কয়েকটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে তাদের যদি খুব ভাল আর্থিক ব্যাকাপ থাকে তাহলে ট্রাই করতে পারেন। এই সব ভার্সিটির টিউশন ফিস খুব বেশি। তার মধ্যে এক বছরের আগে দিয়ে দিতে হয়। তারপর আবার ব্লক একাউন্ট। সো যেখানে জার্মানিতে অনেক পাবলিক ভার্সিটিতে আছে যারা অনেক ধরনের কোর্স অফার করে এবং যেখানে আপনি বিনা খরচে/নাম টিউশন ফিস দিয়ে পড়তে পারতেছেন সেখানে প্রাইভেটে গিয়ে উচ্চ টিউশন ফিস দিয়ে পড়াটা আমার কাছে ভাল কোন সিদ্ধান্ত মনে হয় না। বরং এটা চরম একটা বোকামি। তাছাড়া এই সব প্রাইভেট ভার্সিটি সেই ধরনের পড়াশোনা ফিলিংস পাবেন না। কারণ এদের ক্যাম্পাস বলতে কিছু নাই। জাস্ট একটা বিল্ডিং এ আপনাকে ক্লাস করাবে। তাছাড়া শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছেই। তবে আপনার ভাল আর্থিক ব্যাকাপ এবং ইচ্ছা থাকে তাহলে নিংসন্দেহে আবেদন করতে পারেন। ভিসা পাবেন কিনা সেটা নির্ভর করবে এম্বাসি এবং সিটির উপর। তবে সাধারণত নিয়ম মত করলে ভিসা হয় তবে তা খুবই নগন্য।
চতুর্থ বিষয়টা হচ্ছে এই সব ভার্সিটি এখন এজেন্সি দের হাতিয়ার। এরা ঠিকই এই ভার্সিটিতে এডমিশন নিয়ে পার্ট নিবে কিন্তু যখন ভিসা রিজেক্ট হবে তখন দেখবেন কত টাল বাহানা। আপনার ভিসা হল নাকি হল না এদের কাছে এটা ফ্যাক্ট না। আপনার কাছ থেকে ওরা কিছু তো খেতে পারছে এটাই ওদের কাছে অনেক বড় বিষয়। আপনাকে বোকা বানিয়ে এরা আপনার কাছ থেকে টিউশন ফিস, বাসার ভাড়া, এম্বাসি ফিস বলে টাকা নিতে থাকবে এবং আর আপনাকে ফকির করতেই থাকবে। শেষমেস দেখবেন কিছুই হবে না। তাই এদের থেকে দূরে থাকেন। আমি আবার বলতেছি যদি টাকা এবং সময় রক্ষা করতে চান তাহলে এদের থেকে দূরে থাকবেন। ভুলেও এদের ফাদে পা দিবেন না।

এখন কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, বার্লিনে একটা প্রাইভেট ভার্সিটি আছে। আগের পোস্টে অনেকে কমেন্ট করেছেন এটার নাম বলতে। তাই বললাম। এটার নাম GISMA Business School। এটার মান নিয়ে কোন কিছু বললাম না। ইন্টারনেট ঘাটলে পাবেন। প্রচুর টিউশন ফিস দিয়ে পড়তে হবে। তাছাড়া এটার রেপুটেশন খুব বাজে। সাধারণত আবেদন করলেই এরা অফার লেটার দিয়ে দেয়। কোন কোয়ালিফিকেশ, রেজাল্ট এরা দেখে না। কারণ এদের দরকার স্টুডেন্ড। জার্মানির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বনামধন্য কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই ভার্সিটি যোজন যোজন পিছিয়ে। তাছাড়া উচ্চ টিউশন ফিস হওয়ায় সেই ভাবে পড়াশোনা ম্যানেজ করা যায় না। এখন আসি মেইন বিষয়টা নিয়ে। যেহেতু এই ভার্সিটি কোন কিছু তোয়াক্কা না করেই অফার লেটার দিয়ে দেয় তাই এম্বাসিতে এই ভার্সিটির আবেদন প্রায় রিজেক্ট হয়। গতবার এবং এবার উইন্টারে অনেকের হয়েছে। আমার সাথে একজন ভাই এই ভার্সিটি থেকে অফার লেটার পেয়ে ভিসা ইন্টারভিউ দিয়ে ১০ দিনের মাথায় রিজেক্ট খেয়েছেন। আরেকজন ভাইকে দেখলাম উনি এইচএসসি পাস করে(ব্যাচেলারে জার্মানিতে এইচএসসি পাস করে ১ বছর দেশে পড়ে তারপর আবেদন করতে হয়) এটাতে আবেদন করেছেন এবং ১ দিন পর উনাকে অফার লেটার দিয়ে দিয়েছে যেটা জার্মানি ভাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে কখনও সম্ভব না। উনি লাফাতে লাফাতে ভিসা ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছেন কিন্তু ভিসা অফিসার ৫ মিনিটের মধ্যে উনার আবেদন রিজেক্ট করে দিয়েছিলো। এটার মাধ্যমে উনার অনেক টাকা লস এবং সময় নষ্ট হয়েছিলো উনার। এছাড়া আমি গ্রুপে দেখেছি অনেকে এই ভার্সিটি দিয়ে ভিসা ইন্টারভিউ দিয়ে রিজেক্ট খেয়েছেন। তাই আমি আপনাদেরকে বলব একটু রির্সাচ করে সামনে দিকে আগান।
এখন আসি নিজের লাইফের একটা হিসাব নিয়ে। আমি জার্মানিতে আবেদন করেছিলাম এই বছর। এই গ্রুপ থেকে শুরু করে গুগল, ইউটিউব সহ ইন্টারনেটের সব জায়গায় নিজে নিজে রিসার্চ করে, সাহায্য নিয়ে নিজে নিজে আবেদন করি। আমার শুরু থেকে ভিসা পাওয়া পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ৩০ হাজার(ব্লকের টাকা আলাদা হিসাব) টাকা যেটা অনেকে শুনলে অবাক হয়। মানে ভার্সিটিতে আবেদন ফিস, ডিএচএল খরচ, স্টুডেন্ট ফাইল এবং ব্লকের টাকা পাঠানোর জন্য ব্যাংক ফিস, ভিসা ফিস এবং অন্যন্য খরচ। সেখানে আপনি কিনা এজেন্সির মাধ্যমে (+/-)১০ লাখ টাকা দিয়ে জার্মানিতে যেতে চাচ্ছেন। প্লাস ব্লকের টাকা আরও ১০ লাখ। মানে জার্মানিতে যাওয়ার আগেই প্রায় ২০ লক্ষ টাকা! তাও আবার ভিসা ইন্টারভিউ দেওয়ার আগেই! আর ভিসার কথা তো বললাম না! এডমিশন পাওয়া ছেলে খেলা হতে পারে কিন্তু ভিসা না।
এখন চিন্তা করেন তো একবার। আপনি কি আসলে বোকার স্বর্গে বাস করেন কিনা? যেখানে সবাই ফ্রি তে পড়তেছে সেখানে আপনি বছরে ১০ লাখ টাকা টিউশন ফিস দিয়ে মানহীন প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়বেন!
যাইহোক, আপনার জীবন, আপনার সিদ্ধান্ত। আমরা শুধু আপনাকে অভিজ্ঞতা এবং বাস্তব পরিস্থিতি দেখাতে পারবো। বাকীটা আপনার ইচ্ছা। এই ডিজিটাল যুগে এসে এজেন্সির কাছে যাওয়াটা কত বোকামি সেটা বুজতে পারবেন তখন যখন সময় এবং টাকা নষ্ট হবে।

গুগল, ইউটিউব তথা ইন্টারনেটে সব রিসোর্স আছে। আপনাকে শুধু একটু খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে। তাছাড়া ফেইসবুকে এই গ্রুপ আছে। এখানে অনেক সিনিয়র, অভিজ্ঞ ভাই-বোনেরা আছেন যারা আপনাদেরকে সাহায্য করবেন। আপনার আবেদনকারী ভার্সিটির যেকোন জিনিস বুজতে সমস্যা হলে ভার্সিটিকে মেইল করবেন। কিছু জানতে চাইলে বা কনফিউশনে থাকলে গ্রুপে প্রশ্ন করবেন। কেউ না কেউ আপনাকে ঠিকই সাহায্য করতেছে। আর এইগুলো যদি করতে না পারেন তাহলে আপনি কখনও জার্মানিতে আসতে পারবেন না। এটাই বাস্তব। নিজের কাজ নিজে করতে হবে। কেউ আপনার কাজ করে দিবে না। নিজের কাজে যখন আটকাবেন তখন অভিজ্ঞ মানুষদের কাছ থেকে সাহায্য এবং পরামর্শ নিবেন। দিন শেষে এরাই আপনাকে সঠিক গাইড লাইন দিবে। এই সব ভন্ড এজেন্সি শুধু টাকা চিনে। এরা আপনাকে কিভাবে মারতে হয় সেটা চিন্তা করবে। সাহায্য আর পরামর্শ তো দূরে থাক।

যাইহোক নিজে নিজে আবেদন করেন। ইনশাআল্লাহ ভাল ফলাফল পাবেন। সবার জন্য শুভ কামনা।

লিখাঃ Sabbir Ahmed
Member, Bangladeshi Expat and Student Society in Germany

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম