ক্লোরোম্যান


(এক)
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পরিষদ’ এর আয়োজনে সম্মেলনের রাজধানী খ্যাত সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে চলছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলন । সারা বিশ্ব থেকে গণ্যমান্য বিজ্ঞানীরা সুইজারল্যান্ডে এসে তাদের গবেষণাপত্র পাঠ করছেন। আজ অনুষ্ঠানের শেষ দিন । এবারের বিজ্ঞান সম্মেলনটি অন্যান্য যে কোনোবারের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ । অন্যান্যবার বিজ্ঞান সম্মেলনে কোনো বিষয় নির্ধারিত থাকে না। কিন্তু এবার বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছেঃ ‘সমস্যাসঙ্কুল ও ধ্বংসপ্রায় পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে বিজ্ঞানীদের করণীয়।’
প্রকৃতির ওপর মানুষের অনিয়ন্ত্রিত হস্তক্ষেপ পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে ঠেকিয়েছে । পৃথিবীর বাতাস আজ দূষিত, শ্বাস প্রশ্বাসের অনুপযোগিপ্রায়। কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রাধিক্য হেতু অসংখ্য ছিদ্রে বরবাদ হয়ে গেছে বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তর। গ্রিন হাউস এফেক্টের কারণে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে সহ্যসীমা ছাড়িয়েছে। বহু প্রাণী এই তাপমাত্রার সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সারা পৃথিবীতে দেখা দিয়েছে বন্যার প্রকোপ । সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কয়েকটি দেশ সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে ইতোমধ্যেই । বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন অনেক আগেই ‘নাই’ হয়ে গেছে। মানুষের; বিশেষতঃ জলবায়ু শরণার্থীদের হাহাকারে ভারী হয়ে উঠেছে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস । ধনী দেশগুলোর পরিবেশনীতি না মানার কারণে খেসারত দিতে হচ্ছে সবাইকে । সমগ্র পৃথিবীর নিম্নভূমি প্লাবিত হয়ে আবাদি জমির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার খাদ্যঘাটতি মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশগুলো। যেহেতু হাইব্রিড ফসলেরও একটা লিমিটেশন আছে । এই করুণ পরিস্থিতিতে সমগ্র বিশ্বের ধনী দেশগুলোর টনক নড়েছে এতদিনে । তাদের উদ্যোগে সারা বিশ্বের সরকারপ্রধানগণ মিলিত অনুরোধ জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি ও প্রবীণ বিজ্ঞানী ডঃ হেনরী ল্যাম্পপোস্টকে, ‘এবারের মত একটা উপায় বের করুন । এর পর থেকে পরিবেশনীতি মেনে চলব ।’
কিন্তু হেনরী ল্যাম্পপোস্ট পৃথিবীর রক্ষাকর্তা নন, তিনি সবিনয়ে জানিয়ে দিলেন সেকথা, ‘মাফ করবেন, ধ্বংসপ্রায় পৃথিবীকে আমি কীভাবে রক্ষা করতে পারি ?’
‘আপনি কোনো উপায় বাৎলান, আমরা তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করব। আপনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।’
অনেক ভেবে একটা বুদ্ধি বের করলেন তিনি। একটা বিশেষ বিজ্ঞান সম্মেলন করবেন। পৃথিবীর সব দেশ থেকে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য তাদের আইডিয়া তুলে ধরবেন। সেগুলোর মধ্য থেকে তিনি একটি মাত্র আইডিয়া বা গবেষণা (প্রযোজ্যক্ষেত্রে একাধিকও হতে পারে) নির্বাচিত করবেন- যেটি বাস্তবায়িত হবে সারা পৃথিবী জুড়ে।
এবারের বিজ্ঞান সম্মেলনে আর সববারের মতো সাজ সাজ রবটি নেই । কেমন যেন থমথমে ভাব, অথচ সবার আগ্রহ এদিকেই । আগামী পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই সম্মেলনের ওপর, তাই সবার চোখে-মুখে ব্যগ্রতা। হাড্ডাহাড্ডি খেলার শেষ পরিণতি দেখার জন্য যেমন মানুষ রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে থাকে অনেকটা তেমন । পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতামূলক পোস্টারে ছেয়ে গেছে রাস্তা । আর বিজ্ঞান সম্মেলনের সফলতা কামনা করে বাণী দিচ্ছেন সারা বিশ্বের হোমরাচোমরা ব্যক্তিবর্গ। পত্রিকা-চ্যানেলের বড় একটা অংশ জুড়ে বিজ্ঞান সম্মেলনের খবর । কে, কী আবিষ্কার করলেন তার বিস্তারিত বৃত্তান্ত ।
তিন দিনব্যাপী বিজ্ঞান সম্মেলনের আজ শেষ দিন চলছে । গবেষণাপত্র পাঠ করছেন রাশান বিজ্ঞানী মিখাইল কোভালোভস্কি । তাঁর গবেষণাপত্রের সারকথা হলো, পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তাই সদ্য আবিষ্কৃত ফ্লোরিটা গ্রহে মানুষকে স্থানান্তর করা যেতে পারে, যেহেতু সেখানকার পরিবেশ অনেকটা পৃথিবীর মতো ।
এরপর এলেন ডঃ ইয়ান বেল-আমেরিকার বিখ্যাত জীন বিজ্ঞানী। তিনি এক ধরণের জেনেটিক্যালি মডিফায়েড মাশরুম আবিষ্কার করেছেন যার কান্ড বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদের মতো শক্ত; ডালপালা গজায় এবং বীজ হয় । উচ্চতায় বিশাল, জলজ পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। অর্থাৎ একবার রোপন করলে অনেক বছর ফল ভোগ করা যায়, যা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে ব্যাপক অবদান রাখবে ।
সকলের করতালিতে অভিনন্দিত হলেন তিনি।
এরপর একে একে এলেন আরো কয়েক বিজ্ঞানী । মুহুর্মুহু করতালিতে ভরে উঠল পুরো সম্মেলনকক্ষ । সবশেষে এলো বাংলাদেশী বায়োটেকনোলজিস্ট ডঃ হাসমত মৃধার পালা।
সকলের কাছে তিনি ‘পাগল বৈজ্ঞানিক’ নামে খ্যাত । এর কারণ হলো, তাঁর প্রতিটা আবিষ্কারে অভিনবত্ব থাকে, থাকে নতুনত্ব। চিন্তার সাথে কিছু হাসির খোরাকও ফ্রি পাওয়া যায় । ভার্সিটি লাইফেই এক পাগলাটে আবিষ্কারের কারণে Ig nobel পেয়েছিলেন ( Ig nobel শব্দটি এসেছে ignoble ও nobel শব্দদুটির সমন্বয়ে) । মূলত এটি নোবেল প্রাইজের প্যারোডি; ১৯৯১ সাল থেকে ‘Annals of Improbable Research’ নামক একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানে উদ্ভট ও তুচ্ছ আবিষ্কারের জন্য এই প্রাইজ দিয়ে আসছে । ‘First make people laugh, and then make them think’-এই শ্লোগানে বিশ্বাসী তারা । তবে মজার ব্যাপার হলো, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই পুরষ্কার বিজয়ীর হাতে তুলে দেওয়া হয় সত্যিকারের কোনো নোবেল বিজয়ীর হাত দিয়ে।
ডঃ হাসমত মৃধা যখন স্টেজে উঠলেন তখন সকলের মধ্যে কৌতুহলসূচক গুঞ্জন উঠল, ‘না জানি এবার কী হাজির করেন পাগল বৈজ্ঞানিক।’
ডঃ হাসমত মৃধা এমনভাবে স্টেজে উঠলেন যেন সার্কাস দেখাবেন । প্রথাগত স্টাইলে প্রবন্ধ পাঠ না করে তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘সম্মানিত সুধী! সবাইকে জানাই শরতের সাদা কাশফুলের শুভেচ্ছা । আপনারা জানেন পৃথিবীর মানুষ পরিবেশ ধ্বংস করে আজ নিজেই ধ্বংসের মুখোমুখি । পরিবেশ ধ্বংসের যতগুলো কারণ আছে তারমধ্যে শিল্পায়নই প্রধান কারণ । মানুষ বনভূমি ধ্বংস করে কলকারখানা গড়ে তুলেছে। যার ফলে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়েছে। ওজোনস্তরে ফুটো তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের সামনে যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা দুটি হল, দূষিত বাতাসকে বিশুদ্ধ করা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সঠিক অনুপাতে খাদ্য রেখে যাওয়া । আমি গবেষণা করে যে জিনিসটি আবিষ্কার করেছি তা এই সমস্যা দুটির সমাধান করতে পারবে বলে আশা রাখি । কোনো প্রশ্ন?’
নিজের সামনে থাকা মাইক্রোফোনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন জনৈক বিজ্ঞানী, ‘এক সাথে দুটো সমস্যার সমাধান? বেশ হবে তো তাহলে!’
‘হ্যাঁ ।’ ছোট্ট করে জবাব দিলেন ডঃ মৃধা । তারপর জাদু দেখানোর ভঙ্গিতে দুই হাত উপরে তুললেন। ধীরে ধীরে পর্দা পড়ে গেল স্টেজের!
মিনিট খানেকের মধ্যেই আবার যখন পর্দা উঠল তখন স্টেজে দেখা গেল দুই জনকে- না, না - তিনজনকে ।
ডক্টর মৃধা, একজন নারী এবং নারীর কোলে একটা শিশু!
অবাক হয়ে শিস দিয়ে উঠলেন কেউ কেউ । সবার মনে কৌতুহল, এই শিশুটিকে নিয়ে কি করবেন মৃধা ।
নিরবতা ভেঙ্গে প্রথম কথা বলে উঠলেন ডঃ মৃধা, ‘পরিচয় করিয়ে দেই। আমার সহকারী মনিকা ওবায়েদ, তার কোলে যে শিশুটিকে দেখছেন সেটি আসলে একটা ক্লোন!
‘ক্লোন!!!’ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন উপস্থিতসকল ।
বলে চললেন ডঃ মৃধা, ‘তবে কিছু ভিন্নতা রয়েছে, ভালো করে দেখুন ।’
স্টেজের সামনে লাগানো বড় স্ক্রীনে ফোকাস করে দেখানো হল শিশুটিকে ।
বিস্ময়ে অস্ফূট শব্দ করে উঠলেন সকলে। শিশুটির গায়ের রঙ কচি পাতার মতো সবুজ!
‘আপনাদের কারো কিছু জানার আছে?’ সিরিয়াসভাবে প্রশ্নটি করলেন ডঃ মৃধা। এখন তার মধ্য থেকে রসিক রসিক ভাবটি উধাও ।
এক সাথে ওপরে উঠল অনেকগুলো হাত। সাংবাদিক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ- কারো হাতই বাদ গেল না। বিজ্ঞানীদের কথা তো বলাই বাহুল্য ।
‘ক্লোনের গায়ের রঙ সবুজ কেন?’, বিস্ময় আটকাতে না পেরে বিচারকের আসনে বসে থাকা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি হেনরী ল্যাম্পপোস্ট স্বয়ং প্রশ্ন করে বসলেন।
‘ফান্ডামেন্টাল কোয়েশ্চন!’ ডঃ মৃধা বললেন করুণ কণ্ঠে, ‘আমি জানি, আমার এই আবিষ্কার মনোনীত হলে বদলে যাবে মানুষের চিরায়ত রূপ, কিন্তু ধ্বংসপ্রায় পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য এর বিকল্প আমি দেখি না ।’
সবাই দেখলেন ডঃ মৃধার চোখে পানি । ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে গেছেন সবাই। কারো মুখে কোনো কথা নেই ।
ডঃ মৃধা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, ‘মানুষের গায়ের রঙ থেকে শুরু করে জীবনযাপন প্রণালী... সবই বদলে যাবে । কিন্তু...কিন্তু এছাড়া যে আমি করার কিছু দেখছি না...আমি যা করছি তা তো ভালোর জন্যই।’ চোখ মুছলেন তিনি অকস্মাৎ ।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন উপস্থিত সভ্যরা, ‘কী হয়েছে ডঃ মৃধা?’
নিজেকে দ্রুতই সামলে নিলেন বিজ্ঞানী, ‘স্যরি, ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। আসলে ইয়ে মানে... আপনারা যে শিশুটিকে দেখছেন সে পুরোপুরি মানুষ নয় !’
বোমা ফাটালেন যেন বিজ্ঞানী । বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন উপস্থিত সভ্যরা ।
কোনোরকমে জিজ্ঞেস করলেন এক সাংবাদিক, ‘তা...ত্তাহলে সে কী?’
‘বৃক্ষমানব!’
‘বৃ-ক্ষ-মা-ন-ব!!!’
‘হ্যাঁ, মানুষ আর বৃক্ষের মিশেল । দেখতে মানুষের মতো হলেও সে উদ্ভিদের মতো কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে আর অক্সিজেন ত্যাগ করে!’
‘হাউ অ্যাস্টোনাইজিং ! ক্যামনে কী?’ কেউ একজন জিজ্ঞেস করলেন ।
‘ক্লোরোপ্লাস্ট!
‘ক্লোরোপ্লাস্টটা কী স্যার?’ আমন্ত্রিত এক অতিথি বললেন ।
‘ধন্যবাদ । এখানে অনেক আমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গ আছেন যারা হয়তো বিজ্ঞানের অনেক টার্মের সাথে ঠিক পরিচিত নন। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, উদ্ভিদকোষ ও প্রাণিকোষের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। তার মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য হলো, উদ্ভিদকোষে ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে যা প্রাণিকোষে থাকে না । ক্লোরোপ্লাস্ট হচ্ছে এক ধরণের কোষীয় অঙ্গাণু যার কারণে উদ্ভিদ নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে কিন্তু এটা না থাকার কারণে প্রাণিকুল তা পারে না । ক্লোরোপ্লাস্টের ভেতরে থাকে ক্লোরোফিল নামক সবুজ বর্ণ কণিকা । সবুজ উদ্ভিদ তার পাতার ক্লোরোফিলের মাধ্যমে সূর্যালোকের ফোটন থেকে শক্তি সংগ্রহ করে কার্বন ডাই অক্সাইডকে পানির সাথে বিক্রিয়া করিয়ে গ্লুকোজ জাতীয় খাদ্য তৈরি করে । এবং উপযোগ হিসেবে অক্সিজেন ত্যাগ করে । যা গ্রহণ করে প্রাণিকুল বেঁচে থাকে । আমার উদ্ভাবিত এই ক্লোন যার নাম দিয়েছি ক্লোরোম্যান অর্থাৎ ক্লোরোপ্লাস্ট + ম্যান, জন্মের পর থেকে আজ নিয়ে ৩ মাস ১০ দিন হল, এখন পর্যন্ত কোনো খাবার গ্রহণ করেনি। প্রতিদিন তাকে সকালের মিঠে রোদে একটুখানি রেখে দেওয়া হয়, ব্যাস!’
আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন উপস্থিতসকল। নতুন করে দেখতে লাগলেন শিশুটিকে ।
‘আপনি কীভাবে করলেন এ কাজ ?’
‘খুব সোজা! ক্লোন করার সময় একটি ডিম্বানু নিয়ে তার ভেতর থেকে নিউক্লিয়াসটা সরিয়ে ফেলি । তারপর ১০ বছর বয়সী এক ডোনারের পেশীকোষ থেকে একটি নিউক্লিয়াস নিয়ে সেটা উক্ত নিউক্লিয়াসবিহীন কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেই। সেই সময় আরো একটি জিনিস ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম কোষটির মধ্যে, সেটাই হচ্ছে- ক্লোরোপ্লাস্ট । হ্যাঁ, কাঁঠালপাতার কোষ থেকে একটি ক্লোরোপ্লাস্ট নিয়ে সেটাও ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর কোষটি বিভাজনের বিভিন্ন ধাপে মরুলা, ব্লাস্টুলা দশা পার হয়ে যখন পূর্নাঙ্গ ভ্রূণে রূপান্তরিত হলো তখন মনিকা ওবায়েদ- তাকে ধন্যবাদ ক্লোনটির সারোগেট মাদার হিসেবে কাজ করার জন্য- তার জরায়ুতে ইমপ্লান্ট করি। এরপর স্বাভাবিক নিয়মে তিনি এই ক্লোনটি প্রসব করেন ।’
বলে চলেছেন ডঃ মৃধা, ‘দিন দিন মানুষ বৃদ্ধির ফলে প্রয়োজনীয়তার সাথে পাল্লা দিয়ে কলকারখানার সংখ্যা বাড়ছে। এ ধারা আপনি থামাতে পারবেন না । তাই বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য এমন এক ব্যবস্থা করতে বাধ্য হলাম যেন স্বয়ং কোটি কোটি মানুষ বাতাসে অক্সিজেনের প্রোভাইডার হয়ে যায় । এর ফলে জনসংখ্যা যত বাড়বে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পাবে, ওজোনস্তরের ফুটো বুঁজে আসবে ! এবার যত খুশি কলকারখানা বানানো হোক; এমনকি বনের পাশে পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানো হলেও কোনো মানবতাবাদী সংগঠনই প্রতিবাদ করতে আসবে না । বরং কার্বন ডাই অক্সাইড বেশি হলে মানুষের শ্বাস নিতেও সুবিধা। ফলে মানুষ চাইলে কারখানার চিমনিতে নাক ডুবিয়েও বসে থাকতে পারে, অথবা যানবাহনের তাজা ধোঁয়া খেয়েও ফুসফুস চাঙ্গা করতে পারে... এটাই মোক্ষম দাওয়াই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষের জন্য । তবে আমার আবিষ্কার মনোনীত হলে আমাকে কিন্তু পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে, নতুবা রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের হাতে খুন হয়ে যেতে পারি।
তাঁর রসিকতায় হেসে উঠল পুরো সম্মেলন কক্ষ ।


(দুই)
এক মাস পর...
সারা বিশ্বের সব দেশের সরকারপ্রধানদের বৈঠকে বক্তৃতা করছেন ডঃ হেনরী ল্যাম্পপোস্ট ।
...এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। পৃথিবী থেকে ২৫ আলোকবর্ষ দূরের ফ্লোরিটা গ্রহে কোটি কোটি মানুষের স্থানান্তর স্পষ্টতঃ অসম্ভব, আর হাইব্রিড ফুড দিয়ে খাদ্য সমস্যার আংশিক সমাধান হলেও ওজোনস্তরের পুনর্গঠন, পরিবেশ দূষণ রোধ ইত্যাদি সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আসলে আপনারা আমাকে এমন এক গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন যা না দিলেই বেশি ভালো হত। যাই হোক, যেহেতু আমাকে একটা উপায় নির্ধারণ করতেই হবে, আমি দীর্ঘ এক মাস বিশ্লেষণ করে দেখলাম ডঃ হাসমত মৃধার আবিষ্কারটাই সবচেয়ে সময়োপযোগী। উদ্ভিদ ও প্রাণির যৌথ আলিঙ্গন ছাড়া পৃথিবীকে বাঁচানো সম্ভব নয় । কাজেই এটাই হবে হিউম্যান বিয়িং এর শেষ প্রজন্ম, এরপর সারা পৃথিবী জুড়ে চলবে ক্লোরোম্যানদের রাজত্ব- আমার সিদ্ধান্ত ।’
চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন ডঃ হেনরী ল্যাম্পপোস্ট ।
**************************************************
Writer: তাসরুজ্জামান বাবু
(সাইফাই গল্পগ্রন্থ 'তৃতীয় অনুভুতি' থেকে )

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম