কল্পবিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা (পর্ব ৩)


“কল্পবিজ্ঞান”-এর নাম শুনলেই আমাদের মনের পর্দায় ভেসে উঠে কল্পনা এবং বিজ্ঞান মিশ্রিত কিছু অভাবনীয় দৃশ্যপট। বাংলাদেশসহ পুরো দুনিয়াতেই রয়েছে কল্পবিজ্ঞানের বিশাল পাঠক এবং ভক্তকুল। তবে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যভিত্তিক কোন গল্পের কথা উঠলেই সাধারণত অনেকের মনে হয় গল্পটি রোবট নিয়ন্ত্রিত পৃথিবী কিংবা ভিনগ্রহের কোন সত্তাভিত্তিক কোন কাহিনী। কিন্তু কল্পবিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা আরো অনেক গভীরে নিহিত। আর কল্পবিজ্ঞানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শাখা-প্রশাখা নিয়েই মূলত এই ফিচার।

টাইম ট্রাভেল

কল্পবিজ্ঞানের আরেক আকর্ষণীয় ধারা হলো টাইম ট্রাভেল বিষয়ক কল্পবিজ্ঞান। কোন ব্যক্তি বা বস্তুর অতীত কিংবা ভবিষ্যতের সময়ে চলে যাবার ক্ষমতা এবং এর ফলাফলকে ঘিরেই সাধারণত এ ধরণের কল্পবিজ্ঞান লেখা হয়। এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানের সাথে বিভিন্ন ধরণের প্যারাডক্স ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তার ভিতরে উল্লেখযোগ্য প্যারাডক্সগুলো হলো গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স (যদি কেউ অতীতে গিয়ে তার দাদাকে তার বাবা জন্মানোর আগেই মেরে ফেলে তাহলে সে জন্মালো কী করে?), বুটস্ট্রাপ প্যারাডক্স (এখানে কোন ব্যক্তি বা বস্তু এমনভাবে একটি প্যারাডক্সের ভিতরে আটকে যায় যাতে তার কোন পয়েন্ট অফ অরিজিন থাকে না) এবং প্রিডেস্টিনেশন প্যারাডক্স (এটার মানে যা হবার তা হবেই, তা আটকানোর কোন পথ নেই)।
এ ধরণের সাই-ফাই গল্পের প্লট এবং ন্যারেশন সাধারণত বেশ কমপ্লেক্স হয় এবং অনেক সময় অল্টারনেট হিস্টোরি, প্যারালাল ইউনিভার্স বা মাল্টিভার্সও তৈরী হয়।
এইচ. জি. ওয়েলসের জগদ্বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান “দ্য টাইম মেশিন” এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানের পথিকৃৎ। এ ছাড়াও ডিয়ানা গাবোল্ডনের “আউটল্যান্ডার”, স্টিফেন কিং-এর “১১.২২.৬৩”, ডিন কুন্টজ-এর “লাইটনিং”, রে ব্রাডবেরীর “এ সাউন্ড অফ থান্ডার”, অদ্রি নিফেনেগার-এর “দ্য টাইম ট্রাভেলার্স ওয়াইফ” কল্পবিজ্ঞানের এ শাখার অংশ। বাংলা ভাষায় সাম্প্রতিক সময়ে জাবেদ রাসিন-এর “সময়ের সিঁড়ি বেয়ে একটি বুলেট”, তানজিরুল ইসলামের “প্রজাপতি বসে আছে মাত্রায়” এই শাখার লেখা।

নিকট ভবিষ্যৎ / দূরবর্তী ভবিষ্যৎভিত্তিক সাই-ফাই

ভবিষ্যতের কালপ্রবাহকে কেন্দ্র করে কল্পবিজ্ঞানের যে দুইটি শাখা তৈরী হয়েছে সে দুইটি শাখা হলো নিকট ভবিষ্যৎ এবং দূরবর্তী ভবিষ্যৎ ভিত্তিক সাই-ফাই। নিকট ভবিষ্যৎভিত্তিক কল্পবিজ্ঞান সাধারণত বর্তমান সময় কিংবা অদূর ভবিষ্যতের কোন কাহিনী নিয়ে লেখা হয়। এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানের পরিবেশ এবং সমাজ ব্যবস্থা অনেকটাই পরিচিত থাকে এজন্য অনেক সময় একে মান্ডেন সাই-ফাইও বলা হয়। উইলিয়াম গিবসনের “নিউরোম্যান্সার, আর্নেস্ট ক্লাইন-এর “রেডি প্লেয়ার ওয়ান”, অ্যান্ডি ওয়্যার-এর “দ্য মার্শিয়ান” এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানের উদাহরণ।
অপরদিকে, দূরবর্তী ভবিষ্যৎভিত্তিক সাই-ফাই তে সাধারণত এমন একটি সময়ের কথা বলা হয় যা আমাদের চেনা পরিচিত পরিবেশ থেকে একেবারেই আলাদা। এ ধরণের গল্পে সাধারণত নানা ধরণের ফিউচারিস্টিক জিনিস এবং প্রযুক্তি দিয়ে ভরা থাকে যা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় শুধু কল্পনাই করা যায়। ভেরনোর ভিঞ্জের “এ ফায়ার আপন দ্য ডিপ”, ফ্রাঙ্ক হার্বার্ট-এর “ডিউন”, কিম স্ট্যানলি রবিনসনের “২৩১২” কল্পবিজ্ঞানের এ শাখার অংশ।


হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট

কল্পবিজ্ঞানের এ ধারায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ধরণের প্রজাতি বিশেষ করে মানব প্রজাতিকে আরো উন্নত বা উন্নত করার চেষ্টা করাকে নিয়ে মূলত চালিত হয়। এ শাখার প্রশাখা গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অমরত্ব, বয়স ধীর গতিতে বাড়ানো, বৈজ্ঞানিকভাবে বিভিন্ন সুপারন্যাচারাল শক্তির আবিষ্কার করা (টেলিকাইনেসিস, টেলিপ্যাথি, ইএসপি ইত্যাদি), ট্রান্সহিউম্যানিজম, মাইন্ড আপলোডিং, সিঙ্গুলিরাটি ইত্যাদি।
কল্পবিজ্ঞানের আরেক আইকনিক টার্ম “ম্যাড সায়েন্টিস্ট” এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানে অহরহ দেখা যায়। সোভিয়েত কল্পবিজ্ঞান লেখক আলেক্সজান্ডার বেলায়েভ এর বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান “দ্য এম্ফিবিয়ান ম্যান”, এইচ. জি. ওয়েলস-এর “দ্য আইল্যান্ড অফ ডক্টর ম্যুরো” এবং “দ্য ইনভিজিবল ম্যান”, মেরি শেলীর “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন”, কাসান্দ্রা ক্লেয়ারের “দ্য মরটাল ইনস্ট্রুমেন্ট” সিরিজ, চার্লস স্ট্রস-এর “এক্সেলেরান্ডো” এ ধরণের সাই-ফাই এর উদাহরণ।বাংলা ভাষায় মুহম্মদ জাফর ইকবালের “ইকারাস”, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর “বনি”, সত্যজিৎ রায় এর শঙ্কু সিরিজের কয়েকটি বই এবং মাশুদুল হকের ডক্টর কিজিল সিরিজের কয়েকটি গল্প এই শাখার ভিতরে পরে।

মিলিটারি সাই-ফাই
কল্পবিজ্ঞানের এ অংশে সাধারণত বিভিন্ন দেশের সামরিক সংস্থা, নানা ধরণের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, অস্ত্রশস্ত্র এবং যুদ্ধকে ঘিরে আবর্তিত হয়। কখনো কখনো এ যুদ্ধ যেমন বিভিন্ন দেশের সামরিক শক্তির মধ্যে হয় আবার কখনো বিভিন্ন ভিনগ্রহের প্রাণীদের সাথে ইন্টারগ্যালাকটিক যুদ্ধও হয়।
সাধারণত মারমার কাটকাট টাইপের জনরা হওয়ায় এ ধরণের গল্পে সে সময়কার বিজ্ঞান এবং সমাজ ব্যবস্থার চেয়ে সামরিক সংস্থা এবং যুদ্ধের ডিটেলিং-এর উপর জোর দেয়া হয়। এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানে সাধারণত রে গান, প্লাজমা গান, পাওয়ার আর্মর, নানা ধরনের সেন্টিয়েন্ট অস্ত্র , সাইবার ওয়েপন থেকে শুরু করে ডুমসডে মেশিন সহ নানা ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের দেখা পাওয়া যায়।জন স্ক্যালজির “ওল্ড ম্যানস ওয়ার”, জো হেলডিম্যান-এর “দ্য ফরেভার ওয়ার”, রবার্ট এ. হেইনলেইন-এর “স্টারশীপ ট্রুপার্স” এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানের কিছু উদাহরণ।

সুপারহিরো সাই-ফাই

নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে কল্পবিজ্ঞানের এ ধারাটি বিভিন্ন ধরণের সুপারহিরো এবং সুপারভিলেনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।সাধারণত সফট সাই ফাই ভিত্তিক কল্পবিজ্ঞানের এ ধারাকে জনপ্রিয় করতে বিভিন্ন ধরণের কমিক বুক এবং গ্রাফিক নোভেলের প্রচুর অবদান রয়েছে।
মার্ভেল এবং ডিসি কমিক্স ছাড়াও প্রায় প্রতিটি প্রথিতযশা কমিক বুক পাবলিশারের এই শাখায় প্রচুর কমিক বুক এবং গ্রাফিক নভেল রয়েছে। বিখ্যাত জাপানি মাঙ্গা সিরিজ "ওয়ান পাঞ্চ ম্যান", “আকিরা” এবং “গোস্ট ইন দ্য শেল”-ও কল্পবিজ্ঞানের এ ধারার ভিতরে পড়ে।

Zahidul Islam Razu

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম