অনেকদিন ধরেই একটা ট্যুর দেয়ার জন্য ভীষণ ইচ্ছা করছিল। ভার্সিটি লাইফ শেষ করেই কর্মজীবনের এই ব্যস্ততা সেই ব্যস্ততায় ছুটি মিলছিলই না। তাই ভাবলাম এবারের পূজার ছুটিটা কাজে লাগাই। ওইদিকে শোভনেরও একই অবস্থা। একটা ট্যুরের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত পূজার ছুটিটাই বেছে নিলাম। এবার জায়গা ঠিক করার পালা। শিমলা-মানালী, সিকিম এগুলার নামও এলো। কিন্তু বারবার ইন্ডিয়া না ঘুরে এবার একটা অন্য দেশ ঘুরার কথা মাথায় এলো আর এভাবেই শুরু হলো আমাদের ভূটান ট্যুরের প্ল্যান। দিনক্ষণও ঠিক, জায়গাও ঠিক। । এবার পালা মানুষ যোগারের। ওইদিকে রোবাইয়াত ভাই আর সামিন ভাই ইচ্ছা পোষণ করল যদিও শেষমেশ আমি, শোভন আর রোবাইয়াত ভাই এই তিনজন মিলে ভূটান যাই।
তো এভাবেই আমাদের ভূটান ট্যুর শুরু হয়। তবে এই একটা ট্যুর যেটার পদে পদে এত বাঁধা আসছিল যা এর আগে কোনো ট্যুরেই হয় নি, এমনও মনে হচ্ছিল ট্যুরটা বুঝি আর হবে না। আমরা প্রথমে বাই এয়ারে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাকিদের সাজেশনে বাই রোড বেছে নিই। এবং এটা সঠিক সিদ্ধান্তই ছিল। বাই রোডে সময় একটু বেশি লাগলেও পাহাড়ি আঁকাবাকা রাস্তায় গাড়ি চলার থ্রিল সাথে ভূটানের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেই হবে। আর সেই কারণেই ফুন্টশোলিং থেকে থিম্পু যাওয়ার চার ঘণ্টা আপনার জীবনের অন্যতম সেরা চারটি ঘণ্টা হতে বাধ্য। কিন্তু এই বাই রোডে যাবার জন্য কম ঝক্কিও পোহাতে হয় নি, বাই রোডে যাবার জন্য দরকার ইন্ডিয়ার ট্রানজিট ভিসা। এমনিতেই পূজার মৌসুম উপচে পরা ভীড় তো ছিলই। NOC যোগাড় করা ভিসা আবেদন করা এই সেই কাজ। সবই চলল আমাদের অফিসের ফাঁকে ফাঁকে। দুই একবার মারাও খেলাম সবাই, জরিমানাও খসল। তাই অবশ্যই আপনার ভিসা আবেদন যথাযথভাবে সতর্কতার সাথে করবেন। ট্রানজিট ভিসার আবেদনপত্র যাওয়ার যত দিন আগেই করেন না কেন ভিসা অফিস থেকে পাসপোর্ট সাধারণত যাওয়ার দুই একদিন আগেই ফেরত দেয় তাই একবার ভুল হলে সেটার সংশোধনের সুযোগ নেই বললেই চলে। আর ভিসা পাওয়ার পর অবশ্যই পোর্ট মিলিয়ে নিবেন। সাধারণত ভূটান যাওয়ার জন্য পোর্ট চ্যাংড়াবান্দা/জয়গাঁ দিতে হয়। আমাদের একজনের পোর্ট নাম ভুল আসে যদিও ভুল ছিল সম্পূর্ণ ভিসা অফিসের। অথচ সেই ভুলের খেসারত হিসেবে তার ট্যুরই বাতিল হয়ে যায়। যাই হোক এরকম ছোটোখাটো অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করি ভূটানের উদ্দেশ্যে। রাত সাড়ে দশটায় আমাদের এসি বাস পিংকি পরিবহনে করে আমরা বুড়িমারি পৌঁছাই সকাল নয়টায়। বর্ডারে প্রচন্ড ভীড় পূজার ছুটির কারণে। চ্যাংড়াবান্দা বর্ডারে যাবতীয় সব কাজ শেষ করে আমরা ট্যাক্সিতে করে ভারত-ভূটান বর্ডারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল। সেখানেও সব কাজ করে আমাদের আগে থেকে ঠিল করে রাখা গাড়ি ও ড্রাইভার মনুদার সাথে আমরা ফুন্টশোলিং হতে থিম্পুর উদ্দেশ্যে রওনা হই। সেদিন থিম্পু পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। রাতের খাবার সেরে হোটেল পৌঁছেই দেই ঘুম। এভাবেই আমাদের ক্লান্তিকর প্রথম দিন শেষ হয়। তবে পরদিন থিম্পু ঘুরব এই আনন্দেই রাতে ঘুমটা বেশ ভালো হয়।
(Day-1)
সকালে উঠেই আমাদের সবার চক্ষু চড়কগাছ। রাতে টের পাই নি আসলে কোথায় ছিলাম। এত সুন্দর গোছানো একটা শহর থিম্পু দেখেই আমরা অতি আনন্দে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। সকালে উঠেই মানুষজন যে যার কাজে যাচ্ছে। আমরাও ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম থিম্পু ঘুরব বলে। একে একে ঘুরে দেখি National Memorial Chorten, Buddha Dordenma, Changangkha Lhakhang Monastery, Takin Reservation zoo, Folk Heritage Museum, Tashichho Dzong View Point, Royal Palace View Point, Clock Tower, Handicraft Market, Farmers Market etc. সারাদিন থিম্পুতেই ঘুরি, সবচেয়ে ভালো লাগে বুদ্ধা ডরদেনমা স্ট্যাচু। বিশালাকৃতির বুদ্ধা মূর্তিটি থিম্পুর প্রাণ। চারদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে মানবসৃষ্ট এই বিশালাকৃতির মূর্তি, এর পেছনের ইতিহাস আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আপনি ভূটানের যেকোনো Monastery/Dzong(দুর্গ) এই যান না কেন টিকিট জনপ্রতি ৩০০ রূপি করে। অনেকক্ষেত্রে যা একটু বেশিই মনে হবে। দিনের ঘোরা শেষে লাঞ্চ করি ভূটানের ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে। ভূটানিজরা সব খাবারে অত্যাধিক পরিমাণ মরিচ দিয়ে ভরিয়ে ফেলে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, খাবারগুলি অতো ঝাল হয় না, ওদের মরিচে ঝাল কম বোধ হয়। আমরা রেড রাইস, এমা দাসি, কেওয়া দাসি, চিকেন সিজলিং, ফিশ সিজলিং, বিফ পা, পনির মসালা, সুজা এগুলা অর্ডার করি। এর মধ্যে Ema datchi টা মূলত Chili with cheese আর Kewa datchi টা Potato with cheese। সুজা হলো Butter tea. খাবারগুলি খুবেকটা খারাপ লাগে নি তবে ভিনদেশে এসে ভিনদেশী খাবার টেস্ট করার অভিজ্ঞতা কেই বা মিস করে। এরপর চলে যাই Farmers market এ। থিম্পু আসলে বিকালের দিকে এই বাজারে ঢুঁ মেরে আসা মাস্ট। এইখানে একটু ঘুরে আমরা বিভিন্ন পদের একদম ফ্রেশ কিছু ফল কিনি। এত সুস্বাদু ফল বিশেষ করে ভূটানের আপেলের আমি ফ্যান হয়ে গেছি। এরপর হোটেলে পৌঁছে রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়ি শহর ঘুরতে। সৌভাগ্যক্রমে আমরা ক্লক টাওয়ারে ( এটাই মূলত থিম্পুর সেন্টার পয়েন্ট ) একটা লোকাল প্রোগ্রাম পেয়ে যাই। সেই প্রোগ্রামটা কিছুক্ষণ উপভোগ করে চলে যাই Handicrafts Market এ। এভাবেই শেষ হয় আমাদের ট্যুরের প্রথম দিন। পরের দিনের গন্তব্য ভূটানের আরেকটি শহর, পুনাখা....
 |
National Memorial Chorten |
 |
Buddha Dordenma |
 |
Thimphu view point |
 |
Traditional Bhutanese Lunch ( Red Rice, Ema datchi, Kewa Datchi, Chicken Curry, Chicken Sizzling, Fish Sizzling, Paneer Masala, Beef Paa ) |
(Day-2)
এই দিনটা আমাদের পুরো ট্যুরের সবচেয়ে Crucial দিন ছিল। কেন সেটা বলছি। ভূটান বর্ডার দিয়ে বা বাই এয়ারে যখন ভূটানে প্রবেশ করা হয়, তখন শুধুমাত্র থিম্পু আর পারো এই শহর দুটি ঘোরার অনুমতি দেয়া হয় নির্দিষ্ট দিনগুলির জন্য। এখন কেও যদি দিন বাড়াতে চায় বা এই দুটি শহরের বাইরে ঘুরতে চায় তাকে অবশ্যই থিম্পু ইমিগ্রেশন অফিস থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু এই অফিস শুধু Working day গুলিতেই খোলা থাকে। আমাদের প্ল্যানে পুনাখা আর হা এই দুটি শহরও ছিল। আর এইদিন আমাদের পুনাখা ঘোরার কথা। কিন্তু ঝামেলাটা হলো, ভূটানে শনি আর রবি সরকারি বন্ধ আর এদিন ছিল সোমবার। পরের দিন থেকে তিন দিনের সরকারি ছুটি( থিম্পু ছেছু ফেস্টিভাল এর দুইদিন, দাশেরা একদিন)। তারমানে এই দিন permit না পেলে আমাদের পুনাখা ঘোরা হবে না। Permit নেয়া প্যারা না তেমন, এমনিতে ৩০ মিনিট বা তারও কম সময়ের ব্যাপার। কিন্তু Bhutan এর পিক সিজন আর এত ছুটির মাঝে মাত্র একদিন খোলা অফিস, তাই উপচে পড়া ভীর থাকবেই বোঝা যাচ্ছিল। হলোও তাই, সকাল থেকেই লাইন। অফিস খুলল ৯ টায় আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ফর্ম জমা দেই সাড়ে দশটায়। এরপর সকালের নাস্তা সেরে এসে বারোটার মধ্যে permit পেয়ে যাই। আনন্দের আর সীমা থাকে না। শুরু হয় পুনাখা এর উদ্দেশ্যে যাত্রা। থিম্পু থেকে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। পথের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। পাহাড়ের পর পাহাড় বেয়ে আমাদের গাড়ি চলতে থাকে। পথিমধ্যেই আমাদের আজকের দিনের প্রথম স্পট “Dochula Pass” পড়ে। ১০৮টি স্তূপা সমৃদ্ধ এই মাউন্টেইন পাসে শীতকালে স্নো পাওয়া যায়, তবে এই সময়টায় থাকে না। যদিও কুয়াশা আর হালকা হালকা বৃষ্টি এর জন্য এখানটায় বেশ হাড়কাঁপানো শীত ছিল, যদিও এখন নাকি ভুটানে সামার চলে। এখানে একটা টেম্পলও আছে, বছরে একবার এখানে একটা ফেস্টিভাল টাইপ হয়। আমরা কিছুক্ষণ থেকে আবারো যাত্রা শুরু করলাম। এবার পাহাড় থেকে নীচের দিকে নামার পালা, সাথে শীতও কমতে শুরু করল সাথে গরম বাড়তে থাকল, আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তন ভূটানের এই সিজনটার কমন একটা বৈশিষ্ট্য । "Royal Botanical Park” এর ভিতর দিয়ে অবশেষে পুনাখা পৌঁছালাম। এবারের স্পট ফচু আর মচু রিভার ভিউ। ভুটানিজ ভাষায় চু শব্দের অর্থ নদী। ফচু হলো Male River আর মচু Female River. এই দুই নদীর মিলন স্থল দেখলাম, অসাধারণ ভিউ যেন ছবিতে আঁকা কোনো কাল্পনিক চিত্র। এত সুন্দর। নদীর পাশেই একটা স্কুলে বাচ্চারা খোলা আকাশের নীচে ক্লাস করছে। দুনিয়ার একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ ভূটান আমাদের পদে পদে তার অসাধারণ রূপ দিয়ে মুগ্ধ করেই যাচ্ছে। এরপর যাই Punakha Dzong এ। বিশাল বড় একটা দুর্গ একদম নদীর তীরেই। আগেই বলেছি ভূটানে যেই Dzong or Monastery ই হোক না কেন টিকিট মাথাপিছু ৩০০ রূপি যা অনেকবারই বেশি মনে হলেও এই দুর্গটির জন্য তা একেবারে উশুল হয়ে গেছে। টিকিটের সাথে গাইড ফ্রী। গাইডই ঘুরে ঘুরে সব দেখাবে আর ইতিহাস বলবে একেকটার। তিনটি বড় বড় Courtyard সমৃদ্ধ এই সুবিশাল দুর্গটি, এর পেছনের ইতিহাস, ধর্মীয় তাৎপর্য অবাক হওয়ার মত। আমরা খুবই উপভোগ করেছি। ভিতরে তিনটির মত টেম্পল থাকলেও একটায় ঢুকার অনুমতি রয়েছে। ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। ভিতরে বড় বড় তিনটি মূর্তিসহ( Buddha, Padmasambhava, Ngawang Namgyal or Unifier of Bhutan) অনেক মূর্তি ও স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। অনেক সময় নিয়ে গাইডের সাথে আমরা বেশ ভালোই ঘুরে বেড়ালাম Dzong এ। এরপর বিকেলটা কাটে আমাদের Punakha Suspension Bridge এ দুলতে দুলতে। Dzong থেকে পনেরো মিনিট হাঁটা পথ। রাফলি ৫৫০ ফিট লম্বা আর অসংখ্য প্রেয়ার ফ্লাগবেষ্টিত এই সাসপেনশান ব্রীজের একমাথা থেকে আরেকমাথা যেতে স্নায়ুর একটা ভালোই পরীক্ষা হয়ে যাবে।সন্ধ্যা প্রায় আসতে থাকে আর আমাদেরও পুনাখা ঘুরা শেষের পথে। এর মাঝে দুপুরে যে আমরা লাঞ্চই করিনি ভুলেই গিয়েছিলাম। পুনাখা অনেকটা গ্রামাঞ্চলের মত। থিম্পুর মত জাঁকজমকতা নেই। কিন্তু ছবির মত সুন্দর একটা শহর। আমরা হালকা খাওয়াদাওয়া সেরে বাজো নামের একটা এলাকায় হোটেলে উঠি। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে রাতে বের হই। শহরের প্রায় সবাই তখন ঘুম, শুধু আমরা তিনজন। সোডিয়াম বাতির হলুদ আলোতে পুরো শহর জ্বলজ্বল করছিল। দোকানপাট সব ততক্ষণে বন্ধ। শহরের রাস্তায় হেঁটে এক চক্কর দিয়ে আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম কোথাও খাবার না পেয়ে। ভাবছিলাম স্ন্যাকস দিয়েই রাতটা পার করাতে হবে আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অনেকটা unexpectedly আমরা ফ্রীতে ব্যুফে ডিনার পেয়ে যাই হোটেল মালিকের আতিথেয়তায়। আমরা থ বনে গিয়েছিলাম।
যাই হোক, দিনটা ভালোই গেল, রাতে এবার জম্পেশ একটা ঘুম দরকার....
 |
Punakha City |
 |
Dochula |
 |
Fochu-Mochu Riverside |
 |
নদীর তীরে পড়াশোনা হচ্ছে |
 |
Punakha Dzong |
 |
Dzong এর একটি বাড়ি |
 |
Suspension Bridge |
 |
Suspension Bridge এর উপর |
(Day-3)
আজকে পুনাখাকে বিদায় জানানোর পালা। ছোটোখাটো খুবই সুন্দর একটা শহর পুনাখা। আজকের পর আমাদের গন্তব্য ভূটানের আরেকটি শহর পারো। পুনাখা থেকে প্রায় চার ঘণ্টার পথ। মাঝে থিম্পু পড়বে। আর থিম্পুতে হচ্ছে দুইদিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী Tsechu ফেস্টিভাল। আমরাও ফেস্টিভালে যাবার সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাইলাম না। তাই ঠিক হলো থিম্পুতে ফেস্টিভাল দেখেই পারো যাব। শুরু হলো ভূটানে আমাদের তৃতীয় দিন যেটিকে ট্যুরের সবচেয়ে কালারফুল দিনও বলা যায়। যদিও দিনের শুরু হয় প্রচন্ড কুয়াশা আর হালকা বৃষ্টি দিয়ে। বৃষ্টির মধ্য দিয়ে পাহাড়ী পথ দিয়ে থিম্পু যাচ্ছিলাম, মাঝে দোচুলা পাসটা আবার দেখে নিলাম যাত্রাবিরতি দিয়ে। কুয়াশাঘেরা দোচুলা পাস দেখে এক কেজি আপেল কিনে নিলাম। ভূটানের আপেলের আমি ফ্যান হয়ে গিয়েছি। এত সুস্বাদু আর এত কম দামে ( ১০০ রূপি কেজি ) লাল টকটকে একদম ফ্রেশ আপেল খেতে খেতে আমরা থিম্পু পৌঁছে গেলাম। এবার গন্তব্য Tashichho Dzong or Thimphu Dzong. চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত এই দুর্গটি পুনাখার দুর্গটি থেকে আয়তনে বেশ ছোট হলেও সৌন্দর্যে কোনো অংশে কম নয়। দুর্গটির প্রবেশমুখে হরেক রকম ফুলের বাগানের মাঝে বিখ্যাত Rhododendrons এর দেখাও মিলল। এই দুর্গটিতে আসার প্রধান উদ্দেশ্যই হলো Thimphu Tsechu Festival. দুইদিনব্যাপী চলে এই ফেস্টিভ্যাল, ভূটানিজ ছেলেমেয়েরা তাদের ঐতিহ্যবাহী "গো" আর "কিরা" পড়ে আসে, জামাকাপড়ে থাকে বিভিন্ন ফুলের নকশা আর অনেক অনেক রং। ভিতরে ঢুকেই এত এত মানুষ আর এত এত রং দেখে নিজেদের মনেও একটা একটা ফেস্টিভ্যাল ফেস্টিভ্যাল ভাব চলে আসে। জায়গা নিয়ে বসে অনেকক্ষণ তাদের প্রোগ্রাম উপভোগ করলাম। তাদের অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানলাম। ফেস্টিভাল উপলক্ষে থিম্পুতে দুইদিন সব ছুটি, যেন থিম্পুর সবাই এখানে চলে আসছে। ভূটানিজদের তাদের নিজস্ব ইতিহাস-সংস্কৃতিকে এভাবে লালন করার বিষয়টা ভালো লেগেছে। যাই হোক, এবার পালা পারো যাবার। পারো পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। পারো এয়ারপোর্ট এর পাশ দিয়েই রাস্তা। চারদিক পাহাড়ে ঘেরা এই এয়ারপোর্টটি বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক এয়ারপোর্ট। শুনেছি অনুমোদিত ৮ থেকে ১০ জন পাইলটেরই এখানে বিমান Landing আর Takeoff এর অনুমতি রয়েছে। ভূটানের প্রতিটি শহরের কমন বৈশিষ্ট্য হলো এখানে একটা প্রাচীন Dzong থাকবেই। তাই পারো এসেই চলে গেলাম Paro Dzong দেখতে। অন্যান্য Dzong এর সাথে এই দুই Courtyard বেষ্টিত এই দুর্গটির পার্থক্য হলো: পুরো দুর্গটি নির্মানে কোথাও লোহা বা তারকাটা ব্যবহৃত হয় নি, কাঠগুলি বিশেষ উপায়ে একটি আরেকটির সাথে লক করে এই সুবিশাল দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছে। আরেকটি জিনিস এই দুর্গটির টেম্পল গুলাতে গেলে young বা ছোটবয়সী বুদ্ধার মূর্তি দেখতে পাওয়া যাবে যা মূলত Young monks দের উৎসাহিত করতেই করা। দুর্গটির পাশেই পাচু নদী আর নদীর ওপারেই রাষ্ট্রীয় প্যালেস। দুর্গটি অবশ্যই গাইড নিয়ে ঘোরা উচিত, টিকিটের সাথে গাইড ফ্রীতেই পাওয়া যায়। পারোর এই দুর্গটিকে পারোর অলংকার বলা হয়, কারণ রাতে পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই দুর্গটিকে দেখলে মনে হয় যেন এটা কোনো অলংকার। এরপর গন্তব্য ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ পারো। যদিও দাশেরার ছুটির কারণে আমরা মিউজিয়ামটি বন্ধ পাই। যাই হোক, এরপর হোটেলে ফিরে রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যায় টুকটাক শপিং এর জন্য বের হলাম আমরা। পরেরদিন ট্যুরের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দিন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য....

Tsechu Festival এর ছোট্ট অতিথি |
|
 |
Tsechu Festival |
 |
Tsechu Festival |
 |
Paro International Airport |
 |
Paro view point |
 |
Veg Thali |
(Day-4)
আমাদের হোটেলটা ছিল পারো শহর থেকে একটু ভিতরের সাইডে। পাচু নদীর তীর ঘেঁষে চারিদিকে যেদিকে চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সকালে চা খেতে খেতে ভাইরের ভিউ উপভোগ করলাম কিছুক্ষণ। এরপর সকালের নাস্তা খেয়ে বের হয়ে গেলাম ভূটান ট্যুরের সবচেয়ে এডভ্যাঞ্ছারাস দিনটি উপভোগ করতে। আজকের আমাদের গন্তব্য ছিল টাইগার নেস্ট বা Taktsang Monastery. স্বভাবতই ট্যুরের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দিনটি অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। মেঘালয়ে কিছু ট্রেক করেছিলাম। কিন্তু ওইগুলা এটার কাছে ডালভাত। বিভিন্ন রিভিউ আর ভিডিও দেখে মনে হচ্ছিল পারব না হয়তো। কিন্তু পণ করেছিলাম শুরু করলে এটা শেষ করেই ছাড়ব। ট্রেকটা মূলত তিন ভাগে বিভক্ত। টাইগার নেস্টের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,২৩২ ফুট। আমরা অলরেডি সাত হাজার ফুট উচ্চতায় ছিলাম। তাই প্রথমে প্রায় তিন হাজার ফুট উচ্চতার চূড়ায় উঠতে হয় খাড়া পথ দিয়ে, পথ এতই খাড়া যে অনেক কষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি তো প্রায় পাঁচ মিনিট পর পরই শর্ট ব্রেক নিচ্ছিলাম। এরপর প্রায় তিন হাজার সিঁড়ি নীচে নামতে হবে, শেষে আবার দুই হাজার সিঁড়ি উপরে উঠতে হবে। ফেরার পথে আবার উল্টোটা একই পথে। যাই হোক হালকা কিছু শুকনো খাবার আর পানি নিয়ে আমরা ঠিক সাড়ে আটটায় যাত্রা শুরু করলাম আল্লাহর নাম নিয়ে। বিভিন্ন দেশের অনেক মানুষ ছিল তাই একটা আলাদা সাহসও পাচ্ছিলাম। ট্রেকের মাঝপথে একটা ক্যাফেটেরিয়া পড়ে। আমি আধা ঘণ্টা যেতে না যেতেই ভূটানীজ কোনো গাইড দেখলেই জিজ্ঞেস করছিলাম, ক্যাফে কতদূর। এটা মূলত করছিলাম মনে মনে একটা টার্গেট সেট করার জন্য। যাই হোক যাত্রাপথে অনেক মানুষের সাথেই পরিচয় হয় বিভিন্ন দেশ প্রান্তরের। সবাই একে অপরকে উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে উজ্জীবিত রাখছিলাম। পর্তুগালের একটা গ্রুপের সাথেও পরিচয় হয়, আড্ডা হয় ফুটবল আর রোনাল্ডোকে নিয়ে। পিক সিজনের এটাই মজা, এত এত বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে পরিচয় হবে, অনেক কিছু জানা হবে, শেখা হবে। বেলজিয়ামের এক মহিলা আমাকে শিখিয়েছিল এই ধরণের পথ ট্রেক করতে সবসময় নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ছাড়তে হয়, তাহলে শরীর কম হয়রান হয়। ফরেইনার গুলা বিশেষ করে সাদা চামড়ার যারা তারা এত ফাস্ট আর শারীরিকভাবে ফিট যে বয়স যাই হোক না কেন তরতর করে উঠে যাচ্ছিল চোখের সামনে। এবং এরা দুপুরের মাঝে ফেরাও শুরু করে দিয়েছিল, আমাদের ফেরার পথে শুধু সাউথ এশিয়ান কন্টিনেন্টালের মানুষ বাদে আর কেও ছিল না, বাকিদের অনেক আগেই শেষ। এই ট্রেকে অবশ্য ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্ত চাইলে ঘোড়ার পিঠে চড়েও উঠা যায়, গুনতে হবে ৮০০ রূপি। কিন্তু এই অবলা প্রাণীদের কষ্ট দেয়া আর পথের অনেক রিস্ক আর পিচ্ছিলতা ভেবে আমার মনে হয়েছে এটার কোনো দরকারই নেই। যাই হোক এভাবেই হেঁটে হেঁটে আমরা প্রায় সাড়ে ১১টা নাগাদ ক্যাফেটেরিয়া পৌছাই। জিনিসপত্রের মাথাচড়া দাম দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। এক কাপ চা আর ৪-৫টা বিস্কুট ১৩০ রূপিতে বিক্রি করছিল।কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম এখানেই। অনেকেই মাঝপথে হাল ছেড়ে দিয়েছে, অনেকে এই পর্যন্ত এসেই খুশী আর যাবে না। আমরা যেহেতু পণ করেছি যাবই, আমরা গিয়েই ছাড়ব। শুরু হলো আমাদের দ্বিতীয় দফার ট্রেকিং। এবার অনেকটা সমতল পথ এরপর থেকেই সিঁড়ি শুরু। অনেকে সিঁড়ি দেখেই ফিরে গিয়েছে আমাদের চোখের সামনেই। আমরা আস্তে ধীরে রেস্ট নিয়ে নিয়ে সবচেয়ে বোধ হয় ধীর গতিতেই যাচ্ছিলাম আর আশেপাশের ভিউ উপভোগ করছিলাম। এত সুন্দর পৃথিবী হতে পারে আর আমাদের তা দেখার সৌভাগ্য হবে এটা ভাবতেই দূর থেকে ঝর্ণার আও্য়াজ পেলাম। অল্প এগোতেই দেখলাম অনেক বড় একটা ঝর্ণা। এতক্ষণে গরম লাগতে লাগতে হঠাৎ করেই পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে গেল। অল্প দূরত্বেই টাইগার নেস্টও দেখা যাচ্ছিল। পথের শুরু থেকে দেখা ছোট্ট টাইগার নেস্টটি বড় হতে লাগল যত কাছে এগোলাম তত। আর অল্প কিছু পথ (২০০০ সিঁড়ি এর মত উপরে উঠতে হবে এই যা) । ঠিক দুপুর দেড়টার দিকে আমরা একদম চূড়ায় উঠলাম। আহ অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস। কল্পনায়ও ভাবিনি এটা শেষ করতে পারব। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো Monastery তে ঢুকতে হলে ট্রেক শুরুর আগে নীচে থেকে ৫০০ রূপি দিয়ে টিকিট কেটে নিয়ে উঠবেন। সাথে থাকা টিকিট দেখিয়ে আমরা ফ্রী গাইডকে সাথে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ তাই সব ফোন ক্যামেরা ইত্যাদি বাইরে লকারে রেখে আসতে হয়। ভিতরে মোট পাঁচটি বুদ্ধিষ্ট টেম্পল। একদম পাহাড়ের খাঁজ বরাবর এমন একটা মোনাষ্ট্রি কীভাবে বানাল, আর কীভাবেই বা এটা যুগের পর যুগ টিকে আছে – ভাবার বিষয়। যেন একতা বড়সড় ভূমিকম্প হলেই সব শেষ হয়ে যাবে। ভিতরে প্রায় ঘণ্টা খানেক ঘুরলাম গাইডের সাথে। গাইডই সুন্দর করে সব এক্সপ্লেইন করে দিবে, সবকিছুর তাৎপর্য শুনে অবাক হয়ে যেতে হয়। বুদ্ধিষ্ট বিশ্বাস অনুযায়ী খুবই পবিত্র এই মন্দিরগুলি। অনেকে হয়তো ভাববে এই মোনাষ্ট্রি দেখার জন্য এত কষ্ট কি দরকার! কিন্তু না এখানে মূল সৌন্দর্য “Destination” এ পৌছানোর মাঝে নয়, মূল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে “Journey” এর মাঝে। আর এ কারণেই এখানে গিয়ে কেও অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে না, বরং ভূটান ট্যুরের সেরা গিফট লুকিয়ে আছে এখানে। তাই এটা মিস করা যাবে না কোনো ভাবেই। একটু ফিজিকাল ফিট থাকার পাশাপাশি মনের জোড় থাকলে যে কেওই এটা কমপ্লিট করতে পারবে। যাই হোক, আড়াইটায় আমরা ফেরা শুরু করি, নামার পথে তিন ঘণ্টা লাগে। সাড়ে পাঁচটায় যখন নীচে নামি অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করছিল। ইয়েস!! আমরা পেরেছি, এচিভমেন্ট আনলকড। যাই হোক, আরেকটা ইনফোরমেশন দেই, যদি ভূটান থেকে Handicraft, Souvenir etc. Shopping করার ইচ্ছা থাকে তবে টাইগার নেস্ট এর পাদদেশে এইখানে স্বল্প পরিসরে লোকাল মার্কেট বসে, শহরের সেইম জিনিস সবই পাওয়া যাবে কিন্তু প্রায় ২০০-৩০০ রূপি কম দামে। তাই যারা এসব জিনিস কিনবেন এখানের সুযোগটা কাজে লাগাবেন, আমরাও বেশ বড়সড় একটা শপিং এখানেই সেরে ফেলি। সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে, সাথে প্রচন্ড ক্ষুধা। সামনে যা পাব তাই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। আগের রাতে যে রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম ওইখানের খাবার আমাদের খুব পছন্দ হয়েছিল তাই ওইখানেই চলে যাই আবার আর গপাগপ ভরপেট বিরিয়ানি মেরে দেই। রাক্ষসের মত খেয়েছি সেদিন সবাই। অবশ্য আমাদের ড্রাইভার মনুদা বলছিল টাইগার নেস্ট ট্রেক করে এসে নাকি সবাই এমন রাক্ষসই হয়ে যায়। মনুদা অবশ্য আরেকটা মজার কথা বলল, উনি নাকি আমাদের ফোন কলের অপেক্ষা করছিল, উনি ধরেই নিয়েছিলেন যে আমি পুরো ট্রেক করতে পারব না তাই ফেরত আসব কিন্তু উনাকে ভুল প্রমাণীত করতে পেরেছি এটা ভেবে ভালোই খুশী হয়েছিলাম।
যাই হোক্ খুব ক্লান্ত সবাই। পাশেই পাচু নদীর কলকল শব্দ, আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে আর সেই সাথে আমাদেরও মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ পরদিন আমাদের ট্যুরের শেষ দিন ছিল। শেষদিনে অপেক্ষা করছিল হা ভ্যালী আর চেলেলা পাস……
 |
ট্রেক শুরুর পয়েন্ট |
 |
একটু পা হড়কালেই শেষ |
 |
Praying flags |
 |
১৩০ রুপির চা-বিস্কুট |
 |
যেতে হবে বহুদূর |
 |
কাছাকাছি চলে এসেছি |
 |
Achievement Unlocked |
 |
এইটার জন্য এত কষ্ট |
(Day-5)
ভূটান ভ্রমণে এটি ছিল আমাদের শেষ ঘোরাঘুরির দিন। এদিনের স্পট ছিল চেলালা পাস আর হা ভ্যালী। সকালে একটু দেরী করেই বের হই আমরা যেহেতু খুব বেশী স্পট ছিল না আজ। পারো থেকে হা শহরে যেতে সময় লাগবে প্রায় ৩ ঘণ্টা। যাওয়ার পথে মাঝে চেলালা পাস পড়বে। আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে চেলালা থেকে বিখ্যাত যমলহরি পর্বতের (যা কাঞ্চনজঙ্ঘা এর বউ নামে পরিচিত) চূড়া দেখা যাবে। যাই হোক যাত্রা শুরু করলাম, পাহাড়ি রাস্তা দেখতে দেখতে এতদিনে এই অবস্থা হয়ে গেছে কোনদিনের যাত্রাকে আমরা সবচেয়ে সুন্দর বলব তা নিয়ে আমরা সবাই কনফিউজড। অন্যান্য দিনের পাহাড়ি যাত্রার সাথে আজকের পারো থেকে হা যাবার পথের পার্থক্য হলো পাহাড়ে। এদিনের পাহাড়গুলিতে শুধু সবুজ গাছগাছালিই ছিল না শুধু, হরেক রকমের হরেক রঙ এর ফুলও ছিল। অনেক রোডোড্রেনড্রন গাছের দেখাও মিলল। মনুদা বলল, স্প্রিং এর সময়ে রোডোড্রেনড্রন এর ফুলে ছেয়ে যায় পাহাড়। রক্তিম রঙ এর পাহাড়ের সে আলাদা এক সৌন্দর্য। শুনেই লোভ লাগছিল। আর শীতে নাকি সমস্ত রাস্তা পাহাড় তুষারে ছেয়ে শুভ্র রঙ ধারণ করে। ভূটান এর এই এক বৈশিষ্ট্য, একেক ঋতুতে একেক রকম সৌন্দর্য দেখা যায়। বলতে বলতেই তাপমাত্রা হুট করে কমতে শুরু করল আর চোখের সামনে রাস্তায় মেঘ জমা হতে লাগল। শীত আর বাতাসের পরিমাণ বাড়তে লাগল। আমরা যে চেলালা পাসের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। পারো থেকে ঘণ্টা দেড়েকের পথ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত চেলালা পাস ভূটানের সর্বোচ্চ মোটরেবল রোড। এর একদিকে পারো ভ্যালী আরেকদিকে হা ভ্যালী। এখান থেকে হিমালায়ান রেঞ্জ এর পাহাড়গুলি দেখা যায়, আর দেখা যায় চীন আর তিব্বত বর্ডার। বিশেষকরে যমলহরী, কিন্তু এদিন যাওয়ার পথে এত মেঘ ছিল যে আমরা যমলহরীর চূড়া দেখতে পাই নি কিন্তু আসার পথে তা দেখতে পেরে আক্ষেপ দূর হয়েছিল, ভাগ্যিস! চেলালা পাসের কথা কিছু না বললেই নয়। চারদিকে ভ্যালীতে ঘেরা উঁচু এই পাসটি প্রেয়ার ফ্লাগে ঘেরা, যারা ছবি তুলতে ভালোবাসে তাদের জন্য বেশ আকর্ষণীয় একটা জায়গা। এখানে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে, আমাদের ড্রাইভার মনুকে এদিনে সেইরকম হ্যান্ডসাম লাগতেসিল, লোকাল ড্রেস এর সাথে সানগ্লাস। আমরা ছবি তুলছিলাম, পাশেই কিছু ভারতীয় ট্যুরিস্ট ছিল, ভাবলাম কিছুটা মজা নেই তাদের সাথে, তাদের কাছে মনুকে পরিচয় করিয়ে দিলাম ভূটানীজ নায়ক হিসেবে। সবাই সরলমনে বিশ্বাস করে নিয়ে তার সাথে ছবি তোলা শুরু করে দিল। মনুদাও ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করল, দুই একতা ছবির নাম বলে তাদের দেখার কথাও বলল, মুহূর্তে সেখানে ছোটখাট একটা জটলা লেগে গেল, ভীড়ের মাঝে মনুকে উদ্ধার করে আনলাম। কি একটা অবস্থা! এরপর মোমো আর রাইস স্যুপ(জঘন্য) দিয়ে হালকা নাস্তা করলাম। অনেকে চেলালা পাস দেখে এখান থেকেই পারো ফিরে যায়, কিন্তু আমরা হা না দেখে যাচ্ছি না। তাই আবার যাত্রা শুরু করলাম। উঁচু থেকে নীচুতে যাত্রা শুরু, চেলালা থেকে হা এর পথে। হা মূলত একটা দুর্গম বর্ডার এরিয়ার শহর, এই শহরে গেলে জায়গায় জায়গায় আপনি মিলিটারি গাড়ি ও ক্যাম্প দেখা যায়। ইন্ডিয়ান আর্মির বেশ কয়েকটা ক্যাম্প আছে এখানে, সেখানে ভূটানিজ আর্মিদের ট্রেনিং দেয়া হয়। খুবই ছোট আর সুন্দর গোছানো একটা শহর হা। যাওয়ার পথে দেখা হলো রিকসাম, পুরো পথ জুড়েই এটা দেখা যাচ্ছিল আমরা যেন এটাকেই রাউন্ড দিচ্ছিলাম আঁকাবাঁকা পাহড়ি পথ দিয়ে। রিকসাম মানে হলো তিন পাহাড়, পাশাপাশি একই রকম দেখতে তিনটি পাহাড়কে একসাথে রিকসাম বলে, রিক মানে তিন আর সাম মানে পাহাড়। হা ভ্যালীতে আমরা দুই জায়গায় যাব মূলত, এক হা মোনাস্ট্রি আর দুই হা জং। ভূটানে এত এত মোনাস্ট্রি আর জং দেখলাম যদি এর তালিকা করি সুন্দরের দিক দিয়ে মোনাস্ট্রি গুলির মধ্যে শুরুতে থাকবে হা মোনাস্ট্রি আর জং গুলির মধ্যে অবশ্যই পুনাখা জং। হা জংটা অতটা ভালো লাগে নি যদিও। হা মোনাস্ট্রিটা আয়তনে বেশ বড়, আর্কিটেকচারাল দিক দিয়েও বেশ সুন্দর। আশেপাশের প্রকৃতির কথা নাই বললাম। ভেতরে একটা টেম্পল আছে, বেশ কয়জন বুদ্ধিষ্ট মঙ্ক এর দেখাও মিলল। কিছুক্ষণ এখানে থেকে আমরা চলে যাই হা যং এ। তেমন আহামরি কিছু না আগেরগুলির কাছে, তবে এইখানে একটা আর্মিদের ক্যানটিন আছে। এইখানে তরমুজ খেয়েছিলাম, অদ্ভূত মিষ্টি। যাই হোক এদিনের স্পট গুলি প্রায় কাভার করা শেষ। বিকাল দুপুর তিনটা বাজে প্রায়, এবার ফেরার পালা। হা থেকে পারোর পথে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের সুদীর্ঘ ভূটান সফর শেষের পথে, স্লো স্যাড প্লেলিস্ট এর গান শুনতে শুনতে আমরা পারোতে পৌঁছাই। শেষ দিনের যার যা শপিং বাকী করে নেই। এদিন আবার ছিল পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় আলোকিত পারোকে কি উপমা দিব ভেবে পাচ্ছিলাম না, এত সুন্দরও কিছু হয়। শপিং শেষে মাউন্টেইন ক্যাফেতে (পারো শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই ক্যাফেটি বেশ নামকরা ) কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম, আর বিগত দিনগুলির স্মৃতিচারণ করলাম। তারপর হোটেলে ফিরলাম, ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছাচ্ছিলাম আর বারবার মনে হচ্ছিল ইশ! আরো কয়েকটা দিন যদি থেকে যাওয়া যেত, সময় কত দ্রুতই না যায়। অবশ্য দেশ ও বাড়ির প্রতিও মন টানছিল, অনেক হয়েছে ঘোরা। কেমন মিশ্র একটা অনুভূতি। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে পাচু নদীর তীরে বসে কিছুক্ষন সময় কাটালাম। অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য যেন শিল্পীর আঁকা কোনো চিত্র বা কবির কল্পনা। নদীর কলকল শব্দ, পাহাড় থেকে ঢেয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস আর সাথে জ্যোৎস্না তো আছেই। এটা লিখে বোঝানো যাবে না। রাতটা আরেকটু দীর্ঘ হলেই পারতো !!!!
 |
পাচু নদী |
 |
চেলালা পাস |
 |
হা মোনাস্ট্রি সেন্টার টেম্পল |
 |
রিকসাম |
(Day-6)
খুব ভোরে আমাদের উঠতে হলো, সাতটার ভেতর বের হতে হবে। নয়তো সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে বাংলাদেশ এ ঢোকা যাবে না। কিন্তু গোড়াতেই পড়ে গেলাম বিপদে, গোটা পারো শহর কিংবা আর আশেপাশে কোথাও কোনো পাম্পে পেট্রোল নেই। আমাদের যেতে হবে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার পথ ভূটান-ইন্ডিয়া বর্ডার পর্যন্ত আর পথে আর কোনো পাম্প পড়বে না। তাই নিতে হলে এখানে থেকেই নিতে হবে অথবা অপেক্ষা করতে হবে। কি একটা বিপদ! ইন্ডিয়া থেকে তখনো পেট্রোল আসেনি তাই গোটা ভূটান পেট্রোলহীন। ভূটানে কোনো সমুদ্র বা নদী বন্দর নেই, তাই দেশটি ভারতের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। যাই হোক শেষ পর্যন্ত অনেক ঘুরে একটা মুদি দোকান থেকে খুচড়া পেট্রোলের বন্দোবস্ত হয়েছিল। পারো থেকে ফুয়েন্টশোলিং প্রায় পাঁচ ঘণ্টার পথ। তবে এই পাঁচ ঘণ্টার জার্নি আপনার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জার্নি হতে বাধ্য কারণ পথের সৌন্দর্য। ফুয়েন্টশোলিং যখন পৌছালাম, ঘড়িতে প্রায় একটা। তড়িঘড়ি করে সবকাজ সেরে বর্ডার ক্রস করলাম আর সেই সাথে বিদায় জানালাম আমাদের এই কয়দিনের যাত্রাসংগী মনুদাকে। খারাপ লাগছিল। বিদায় সবসময়ই কষ্টের যাই হোক এরপর জয়গা থেকে আমরা ট্যাক্সিতে করে চলে আসি চ্যাংড়াবান্দা বর্ডারে। ঘড়িতে প্রায় ৫টা। বিশাল লাইন বর্ডারে। ছয়টা নাগাদ আমাদের সিরিয়াল আসল। আহ! অবশেষে বাংলাদেশে ফিরতে পারলাম একটা অসাধারণ ট্যুর শেষে। সাতদিন পর শুনতে পারা মসজিদ থেকে ভেসে আসা সুমধুর মাগরীবের আযান শুনতে শুনতে আমরা পিংকি পরিবহনের বাসে উঠে পড়লাম। শুরু হলো বাড়ি ফেরার যাত্রা।
পাদটীকা: ভূটান ট্যুর ছিল আমার তৃতীয় বিদেশ সফর। এই সফরের আগে এত এত বাঁধা আর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল যে শেষমেশ এত ভালো একটা ট্যুর দিতে পারব ভাবতেই পারি নি। যাই হোক ভূটান অপূর্ব সুন্দর, ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতিকেও কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয় ভূটানের কাছে অনেক শেখার আছে। ভূটান পৃথিবীর একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ। এইখানে দেশের উন্নতি মাপা হয় Global Happiness Index দিয়ে। আর এজন্যই ভূটানকে Kingdom of Happiness or The Last Shangri-La ও বলা হয়ে থাকে। আর সবচেয়ে ভালো লেগেছে এখানের মানুষের ব্যবহার, একটা ঘটনা বলি, একবার শপিং শেষে আমরা হোটেলে ফিরব পারো তে। আমরা পথ হারিয়ে ফেলি, যে ট্যাক্সিতে উঠেছিলাম উনিও পথ চিনে না, উনাকে নিয়ে আধাঘণ্টার মত ঘুরার পরও খুঁজে পাচ্ছিলাম না অন্যদিকে আমাদের মনুদার ফোনও যাচ্ছিল না, উনি এদিন আমাদের পারো নামিয়ে থিম্পু যাচ্ছিল রাতে। তো কি হলো, ড্রাইভার যখন পথ পাচ্ছিল না উনি নিজে আমাদের কাছে এতটা লজ্জিত হয়েছিল আর বারবার সরি বলছিল যে আমরাই লজ্জা পেয়ে যাচ্ছিলাম, শেষমেশ উনি আমাদের আবার মলে ফেরত এনে অন্য একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছিল, জোর করার পরও উনি লজ্জায় একটা পয়াসাও নেননি আমাদের থেকে। ভূটানে এই সাতদিনে আমরা কোনো গাড়ির হর্ণ শুনি নি বললেই চলে, কোনো ওভারটেকিং দেখি নি। সব মিলিয়ে সাতদিনের এই সফরে আমরা শুধু ঘুরেছিই এমন না, অনেক কিছু শিখেছিও বটে। ভূটান, কপালে থাকলে আবারো দেখা হবে তোমার সাথে, আপাতত বিদায় !!!
Writer: Saeed Alam Utsha
Member, Traveller of Bangladesh.
Lecturer, Department of computer science and technology at KUET