(এক)
নিকো বিরক্ত হয়ে লোকটির দিকে তাকাল। অনেকক্ষন থেকেই তাকে ফলো করে আসছে। এর সঠিক কারনটা সে বলতে পারবে না। ভদ্রতার খাতিরে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না। নিকোর এই এক সমস্যা, কাউকেই কিছু বলতে পারেনা। এইতো কিছুদিন আগে বাসে করে বাড়ি ফেরার সময় এক পকেটমার দিব্যি পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা হাতিয়ে নিল। সে কিচ্ছু বলতে পারল না। লজ্জার ব্যাপার, একটা লোক মানিব্যাগ বের করে নিচ্ছে, এখন এই কথাটা যদি সে চেঁচিয়ে বলে উঠে তাহলে কেমন শোনাবে? ওই বেচারাও না জানি কতখানি লজ্জা পাবে। এর চেয়ে চেপে যাওয়াই বরং ভাল। ছোটবেলা থেকেই নিকো এরকম। সে বড় হয়েছে অরফানেজে। সেখানকার বড়রা বলত একদিন সকালে তাকে অরফানেজের গেটে আবিষ্কার করা হয়। কে বা কারা তাকে এখানে ফেলে গেছে কেউ জানত না। ছোটবেলা থেকেই নিকো অসম্ভব ভদ্র ছিল। অভদ্রতামি কী জিনিস সেটা সে জানত না। কেউ অপরাধ করলেও নিজে থেকে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতো। এজন্য তার কোন শত্রুও ছিল না। আজ রাস্তায় জ্যাম ছিল জন্য এমনিই দেরি হয়ে গেছে। বাসায় গিয়ে আবার তাকে রান্না করতে হবে। এমন অবস্থায় যদি এরকম উটকো একটা লোক পিছু নেয় তখন বিরক্ত লাগাটাই স্বাভাবিক। নিকো হঠাৎ থেমে গেল। তারপর উল্টো ঘুরে লোকটার দিকে ফিরল।লোকটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না হুডির ক্যাপটা সে নাক পর্যন্ত নামিয়ে রেখেছে। নিকো ধরা গলায় বলল, 'তুমি কী আমার কাছ থেকে কিছু চাও?আমি কী তোমার কোন কাজে আসতে পারি?কোন কিছু দরকার হলে.......
নিকো কথা শেষ করতে পারল না। লোকটি তার নাকে নিহিলিন (১) মেশানো রুমাল চেপে ধরল। কিছু বোঝার আগেই সে জ্ঞান হারাল। লোকটি পকেট থেকে ফোন বের করল। তারপর একটা নম্বর ডায়াল করল।বলল,'কাজ হয়ে গেছে '
ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠস্বর শোনা গেল,'নিয়ে এসো'
নিকো আর কিছু সময় জেগে থাকলেও দেখতে পেত লোকটির ডায়াল করা নম্বরটি কোন সাধারন নম্বর ছিল না। এই নম্বর শুধুমাত্র বিজ্ঞান একাডেমির রেড সিলপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদেরই থাকে।
* * * * * * * * * * *
(দুই)
কোয়ান্টাম কম্পিউটারটি গরগর শব্দ করে উঠল। মহাজাগতিক সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী এর অর্থ হল সে কিছু বলতে চায়। রু জানালা দিয়ে অতিপ্রাকৃত বিশালতা অনুভব করার চেষ্টা করছিল। শব্দে সে সৎবিৎ ফিরে পেল। বলল,
-হ্যা ফিওনা বলো। কী বলতে চাও
-রু, তোমাদের জন্য পৃথিবী থেকে একটি ম্যাসেজ আছে। আমি এটি গত সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে ভিডি টিউবে সংরক্ষন করে আসছি। যেহেতু আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা নতুন গ্রহটিতে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি, তাই এখনই এটি বলার সঠিক সময়।
-হাসালে ফিওনা। এই তিন হাজার বছরে তোমরা নিজেদের মস্তিষ্ককে ভালই উন্নত বানিয়ে ফেলেছ। হাসি মস্করার মত মানবিক ব্যাপারগুলো ভালই আয়ত্ত করে ফেলেছ।
-সেটা কখনই সম্ভব নয় রু। তোমাদের মস্তিষ্ক বিলিয়ন বিলিয়ন নিউরনের সমন্বয়। আরও কয়েক কোটি বছরেও আমরা তোমাদের সমতূল্য হতে পারব না। এটা সত্যি যে তোমাদের জন্য একটি ম্যাসেজ আছে। তুমি চাইলে এটা তোমাদের সবাইকে একসাথে শোনানো হবে। এতদিন যেসব প্রশ্ন করতে করতে তোমরা আমার নার্ভাস সিস্টেমে সমস্যা বাধিয়ে দিচ্ছিলে, তার উত্তর এখানে পেয়ে যাবে তোমরা।
মহাকাশযানটি প্রায় তিন হাজার বছর ধরে কোন এক গন্তব্যে ছুটে চলেছে। এই মহাকাশযানের যাত্রী পাঁচজন। রু এদের ক্যাপ্টেন।তিন হাজার বছরে মোট ছয়বার তাদের স্লিপিং সেল থেকে জাগানো হয়েছে, বাকি সময়টা তারা ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। আর এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা নতুন একটি গ্রহতে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে। এখন এরকম একটা ম্যাসেজের ব্যাপার শোনা আসলেই চাঞ্চল্যকর ব্যাপার। নিজেদের মধ্যে আদিম এক উত্তেজনা অনুভব করে তারা।
-আচ্ছা আমি তাহলে ভিডিওটি চালু করছি,বলল ফিওনা।
সবাই একবাক্যে সায় দিল।
তাদের সামনে একটি হলোগ্রাফিক পর্দা ভেসে উঠল। তাতে দেখা গেল একজন অতি সুদর্শন পুরুষকে। তিনি প্রথমে এক গ্লাস বাদামি তরল পান করলেন, একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর বলা শুরু করলেন,
"আমার হিসাবমতে তোমরা আর এক সপ্তাহের মধ্যেই ইডিরো-৩৫৭ তে ল্যান্ড করবে। এখন তোমাদের কয়েকটা ব্যাপার জানা প্রয়োজন। তোমরা এখন যে সময়টাতে আছো, সেটা হচ্ছে ৬৭২১ সাল। তোমরা জেনে অবাক হবে যে তোমাদের সময় থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এখন আমি যে সময়টাতে আছি সেটা ৩২২৮ সাল। এখন পৃথিবী অনেক বেশি উন্নত, অনেক আধুনিক। তবুও আমরা পৃথিবীকে নিশ্চিত ধ্বংস থেকে বাঁচাতে পারছি না। আমি বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি কিম শুধুমাত্র হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করতে পারছি না। অথচ পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পেছনেও রয়েছে একটিমাত্র ছোট্ট প্রোগ্রাম। উচ্চিংড়ে-০৯২১। গত বছর আমাদের কাছে কয়েকজন ক্লায়েন্ট থেকে অভিযোগ আসে যে তাদের জিটি (২) গুলো বারবার ক্রাশ করছে। বিভিন্ন ডার্ক ওয়েব এড্রেসে অটোমেটিক ঢুকে পড়ছে। তখন থেকেই সমস্যাটা শুরু হয়। ছোট্র একটি প্রোগ্রাম দিয়ে একটি অজানা গোষ্ঠী সম্পূর্ন পৃথিবীর সমস্ত জিটির কন্ট্রোল নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে। তথ্যভান্ডারের কোন কিছুই আমাদের হাতে নেই। আমরা জানতে পেরেছি যে চাঁদ থেকে ৪৭ টি গ্লুকোনাইট (৩) মিসাইল পৃথিবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। আর তিনদিনের মধ্যেই তারা পৃথিবীতে আঘাত হানবে। সম্পূর্ন পৃথিবী নিশ্চিন্ন হয়ে যাবে। আমরা সমগ্র পৃথিবীর মানুষ শান্তিপ্রিয়। তবে একদল উগ্রবাদী, মানসিক ভারসাম্যহীন অথচ অসম্ভব মেধাবী লোকের কারনে পৃথিবী আজ ধ্বংস হতে চলেছে। তোমরাই সমগ্র পৃথিবীর মানুষের প্রতিনিধি।তোমরাই শেষ পাঁচজন জীবিত মানুষ। তোমরা এই মুহূর্তে যে মহাকাশযানটিতে আছো,তার নাম 'ইনোপ'।। এটি এখন পর্যন্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। এটি এতটাই শক্তিশালী যে ব্ল্যাকহোলের বিরুদ্ধেও এন্টি গ্র্যাভিটি উৎপন্ন করতে পারে। এটিতে এত পরিমান শক্তি সঞ্চিত আছে যে এটি আগামী ত্রিশ হাজার বছর পর্যন্ত মহাশূন্যের পানে নির্দিধায় ছুটতে পারবে। তোমরা হলে সম্পূর্ন পৃথিবী শুদ্ধতম পাঁচজন মানব মানবী। পুরো পৃথিবী চষে তোমাদের খুজে বের করা হয়েছে। তোমাদের মস্তিষ্কে ইরিডিয়াম সংকরায়ন করা হয়েছে যার কারনে থ্যালামাস এবং হাইপোথ্যালামাসের আকৃতি হবে বিশাল। তোমরা অত্যন্ত দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারবে। তোমাদের জিনেটিক স্টাকচারে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে তোমাদের দেহে ডেথ হরমোন অনেক দেরিতে আসবে। তোমাদের আয়ু হবে সুবিশাল। তোমরা হবে দ্বিতীয় পৃথিবীর প্রথম মানব মানবী।আশাকরি এখন তোমরা বুঝতে পেরেছ কেন সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে তোমরা এই মহাকাশযানে পড়ে আছো?তোমাদের প্রতি আমার শুভকামনা। তোমাদের সামনে অনেক বড় দায়িত্ব। আশাকরি তোমরা বিফল হবেনা।বিদায়। ভাল থেকো। "
দশটি চোখ স্তম্ভিত হয়ে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে আছে। তারা এখনও বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে তাদের কী করা উচিত।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
(তিন)
পিট এখনও বুঝতে পারছে না যে সে কী করবে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার মত একটা গাজাখুরি গল্প কতখানি বিশ্বাসযোগ্য হবে সে জানেনা। তবে বিজ্ঞানী ক্লাসান আদেশ করেছেন যে অভিনয়টা আসল মনে হতে হবে। ওরা পৃথিবীর প্রতিনিধি। ওদেরকে পৃথিবী সম্পর্কে কোন খারাপ ধারনা দেওয়া যাবে না। ওরা যদি জানতে পারে যে পৃথিবীর মানুষের স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য জানোয়ার হয়ে যায়,নিজেই নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়,তাহলে সেটা তাদের জন্য ভাল হবেনা। সে তার হাতের একটি সুইচে চাপ দিতেই ক্যামেরাটি অন হয়ে গেল। তারপরে সে এক গ্লাস পানি পান করল। এই পানির রংটিই ইমেজ ইফেক্ট দিয়ে বাদামি করে দিতে হবে। তারপর একটু কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলা শুরু করল,..........
___________________________
(চার)
"আজ একটা গল্প বলব।কিছুক্ষনের জন্য বিজ্ঞান এর কাঠখোট্টা বিষয়গুলো তোলা থাক। আজ থেকে এক হাজার বছর আগের গল্প। ওইযে একটা কথা আছে না,'সহজ জিনিস সহজভাবে বলা কঠিন' অনেকটা ওইরকমই।গল্পটা বাচ্চাদের। '৯' একবার '৮' কে চড় মারল কারন ৮, ৯ এর চেয়ে ছোট ছিল।৮ গিয়ে ৭ কে চড় মারল।৭ চড় মারল ৬ কে। এভাবে শেষে এসে ২ চড় মারল ১ কে। এখন নিয়ম অনুযায়ী ১ এর উচিত ০ কে চড় মারা। কিন্তু ১, ০ কে চড় না মেরে তাকে নিজের সাথী করে নিল।এতেই তারা হয়ে গেল ১০, অন্য সবার চেয়ে বড় আর শক্তিশালী।
আচ্ছা আপনারা কী এই গল্পের সাথে আমাদের বর্তামান অবস্থার সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন? চড় খেতে খেতে আমরা মানব সম্প্রদায় আজ এই অবস্থায় এসেছি। এখন আমাদের সাথে অন্য কারও একীভুত হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলেই আমরা সবচেয়ে শক্তিশালী হব।
কিন্তু, কেউ কী এমন কোন জাতি বা সত্ত্বার নাম বলতে পারেন? যাদের শক্তি হয়ত আমাদের চেয়ে বেশি, কিন্তু বুদ্ধি কম?
ভীড়ের ভিতর থেকে কেউ বলে উঠল, 'রোবট'
'একদম ঠিক।রোবট। সহজ ভাবে দেখুন, রোবটের শরীর শক্ত ধাতু দিয়ে তৈরি,তারা কঠিন কঠিন কাজ অতি সহজে করতে পারে। কিন্তু তাদের ব্রেইনে রয়েছে মানুষের তৈরি প্রোগ্রাম।তারা নিজে নিজে চিন্তা করতে পারেনা,নিজে নিজে কোন কিছু উদৃভাবন করতে পারেনা। অথচ আমরা মানুষ, সামান্য আঘাতে হেরে যাই ঠিকই কিনৃতু বুদ্ধির দিক দিয়ে আমরা অসাধারন।
এবার ভেবে দেখুন। আপনি একজন মানুষ, আপনার শরীর রোবটের।আপনার দেহ থেকে মস্তিষ্কটা আলাদা করে একটা রোবটের মাথায় বসিয়ে দেওয়া হল।কেমন হবে?
আপনার শক্তি কমবে?
কনশাসনেস লোপ পাবে?
চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পাবে?
এগুলোর কোনোটাই হবেনা। তবে, আপনি আর সামান্য আঘাতে নত হয়ে যাবেন না আপনার শরীর হবে প্রচন্ড শক্ত।অনেক কঠিন কাজ সহজে করতে পারবেন।আবার আপনার পৃথিবীর খাবারও খেতে হবেনা, অল্প পরিমানে কেসিনিয়াম (৪) শরীর ফুল চার্যড হয়ে যাবে।আমরা হব অমর। আমরা হব সবচেয়ে শক্তিশালী।
আপনারা জেনে খুশি হবেন যে এই নতুন প্রজাতি তৈরির আপ্রান চেষ্টা আমরা আমাদের ল্যাবে চালিয়ে যাচ্ছি। এবং আমাদের পরিশ্রম সফল হবে, সে দিন বেশি দূরে নয়।"
বিজ্ঞানী গ্লসিয়াস তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। চারদিকে হাততালির বন্যা বয়ে গেল।সবাই খুব খুশি। সাংবাদিকেরা গ্লসিয়াসকে ঘিরে ধরেছে। সবাই অটোগ্রাফ নিচ্ছে।শুধু বিজ্ঞানী ক্লাসান মুখ শক্ত করে বসে আছেন।তাঁর মনে একটা ব্যাপার খচখচ করছে। গ্লসিয়াস কী তবে তাঁর বক্তব্য থেকে কোন কিছু এড়িয়ে গেলেন?
খুব গুরুত্বপূর্ন কোন কিছু?
(পাঁচ)
বিজ্ঞানী ক্লাসান অনেকদিন পরে তাঁর স্টাডি রুমে প্রবেশ করলেন।এই পুরো রুমটা তাঁর বিভিন্ন আবিষ্কারে ভর্তি।সবচেয়ে বড় করে ঘরের মাঝখানের দেয়ালে আটকানো আছে তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারের রিসার্চ পেপারটা।পেপারটা ব্রেইন হাইব্রিডাইজেশন এর উপরে তৈরি।এই রিসার্চই তাঁকে রেড কার্ড পেতে সাহায্য করেছিল। একই সাথে তিনি উপহার পেয়েছিলেন আজ থেকে প্রায় বারশো বছর আগেকার একজন অসামান্য মেধাবী মানুষের ব্রেইনের কিছু টিস্যু। তাঁর নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। এই লোকটিই আজকের এই আধুনিক পৃথিবীর পথিকৃৎ ছিলেন।একটা সময় ছিল যখন ক্লাসান প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে একবার করে এই টিস্যুগুলো দেখতেন।অসম্ভব মানসিক প্রশান্তি পেতেন। অথচ নতুন একটা রিসার্চ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে একমাসে একবারও এই রুমে প্রবেশেরই সুযোগ পাননি।তাঁর রিসার্চটা হল একদল মানুষকে তাদের পূর্বের সব স্মৃতি ভুলিয়ে মহাকাশযানে করে নতুন একটা গ্রহে পাঠানো হবে।নতুন স্থানে তারা কীভাবে বেঁচে থাকে, কীভাবে খাদ্য উৎপাদন করে, সে সবকিছু পর্যবেক্ষন করা হবে । যেহেতু পৃথিবী আজ অনেকটাই বসবাসের অনুপযোগী,তাই এখন মানুষের উচিত অন্য বাসস্থানের খোঁজ করা। এমনটা যে মানুষ আগেও করেনি, তা নয়।মঙ্গলগ্রহে কয়েকবার বসবাসের চেষ্টা করা হয়েছে।এবং মানুষ প্রতিবারই ব্যর্থ।মঙ্গল গ্রহ বর্তমানে মৃত্যুপুরী।তবে এই অভিযানটা ভিন্ন হবে। এই মানুষগুলো জানবে না তারা কোথায় যাচ্ছে, কী করতে যাচ্ছে। যাহোক তিনি আজ দেখছেন কাঁচের বোতলে এজপার্মিয়ামে (৫) ডোবানো একটা পরমানেন্ট স্লাইড। এই স্লাইডেই আইনস্টাইনের ব্রেইনের টিস্যু আছে। তিনি রোবোটিক হ্যান্ড ব্যবহার করে স্লাইডটি বের করলেন।তারপর মাইক্রোস্কোপের নিচে বসালেন।তবে চোখ রেখে তিনি কিচ্ছু দেখতে পেলেন না।অনেকটা হতভম্ব হয়ে গেলেন।স্লাইডটা ঠিকমত বসিয়ে আবার চোখ রাখলেন।
নাহ কিচ্ছু নেই। এবার ক্লাসান ভয় পেতে শুরু করলেন।এর সাথে কী তবে গ্লসিয়াসের যোগসূত্র রয়েছে। তবে কী তিনি যা সন্দেহ করছেন, তাই ই সত্যি হবে?
(ছয়)
তিনি নিজের চেহারাকে পুরূ গোফের সাথে দেখতে অভ্যস্থ। ঠিক কতদিন পরে সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছেন, তিনি জানেন না।শেষবার যখন চিন্তা করছিলেন,তখন দেখেছিলেন খুব চিকন ছোট একটা রাস্তা দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। অনেক সামনে বিন্দুর মত একটা আলো, সেটাই গন্তব্য। যেতে যেতে প্রায় কাছে পৌছে গেছেন, আলোটা ছুঁতে যাবেন, এমন সময়ই সব ওলট পালট হয়ে গেল।
'স্যার। উনি মানে রোবটটা চোখ খুলছে।'
বিজ্ঞানী গ্লসিয়াস দৌড়ে এলেন।সত্যিই রোবটটা চোখ খুলেছে। এটা আইনস্টাইনের রোবট। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ব্রেইনের টিস্যু থেকে তাঁকে ক্লোন করা হয়েছে। তারপর ব্রেইনটা ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছে। ইনিই হলেন এখনকার সময়ের আইনস্টাইন। এবার পূর্বের সব বিজ্ঞানীকে ক্লোন করতে হবে। তাঁদের সবার রোবট তৈরি করতে হবে।
মিডিয়াল (৬) এর হেডলাইনে একটা ভিডিও দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞানী গ্লসিয়াস যা বলছেন,তার সারকথা এই যে, রোবটের শরীরে মানুষের ব্রেইন ট্রান্সপ্লসন্ট সফল হয়েছে। নতুন এই প্রজাতির নাম হবে ব্রেনোবোট।আর কয়েকটা পরীক্ষামূলক যাচাই বাছাই করে সকলের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। সকলেই চাইলে স্বেচ্ছায় নিজের শরীর ছেড়ে রোবটের শরীর গ্রহন করতে পারবে।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন অথবা তাঁর ব্রেইনওয়ালা রোবট,যেটাই বলা হোক, তিনি এখনও ধাতস্থ হননি। হলে হয়ত বুঝতে পারতেন, তাঁর ঘাড়ের পিছনে একটি চিপ ঢোকানো আছে। যার মাধ্যমে তাকে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।
(সাত)
বিজ্ঞানী ক্লাসান কয়েকদিন হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন।খুব দ্রুত অনেককিছু ঘটে যাচ্ছে। গ্লসিয়াস মানুষদেরকে ব্রেনোবোটে রূপান্তরের অনুমতি বিজ্ঞান একাডেমি থেকে পেয়ে গেছেন।অনেক মানুষই এখন ব্রেনোবোট হয়ে যাচ্ছে। তবে সমস্যাটা তিনি ধরতে পেরেছেন।
প্রতিটা মানুষেরই একসময় না একসময় মরে যেতে হবে। সে মারা না গেলে নতুনরা সুযোগ পাবেনা। নতুনত্ব সৃষ্টি হবেনা। পৃথিবীটা ধীরে ধীরে একঘেয়ে হয়ে যাবে।বিজ্ঞানী গ্লসিয়াস মৃত্যুর মত একটা অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিতে চাইছেন।প্রকৃতি মানুষের মৃত্যু ঘটায়, যদি প্রকৃতির কাজে কেউ বাধা দেয়,তবে তার ফলাফল হয় ভয়াবহ, অত্যন্ত ভয়াবহ।গ্লসিয়াসের ব্রেনোবোটরা হয়ত সব কাজ সহজে করতে পারবে তবে তারা জৈবিক চাহিদা পূরন করতে পারবে না। আগে নারী পুরুষের যৌনমিলনে সন্তান হত।আর এখন হবে ব্রেইন হাইব্রিডাইজেশনে।বিজ্ঞানী ক্লাসানের মনে হল,তাঁর মানবজাতিকে রক্ষা করতেই হবে। এই পৃথিবীতে আর নয়, অন্য পৃথিবীতে গিয়ে হলেও মানুষ বেঁচে থাকবে নিজেদের মত করে।
তাঁর এসিস্ট্যান্ট রু কে দ্রুত নির্দেশ দিলেন পাঁচজন শুদ্ধতম মানুষ খুঁজে বের করতে। তাপর তিনি একজন প্রফ হ্যাকার খুঁজে বের করলেন। তাকে কাজ দিলেন একটি ছোট্ট ভাইরাস প্রোগ্রাম তৈরি করতে।
(আট)
রু এইমাত্র তাঁর ৬ মিনিটের অভিনয়টি শেষ করল। এখন সে রীতিমত হাঁপাচ্ছে। কয়েকটা ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে যায়,এতটাই দ্রুত যে মানুষ বুঝেও উঠতে পারেনা।
এখানেও তেমনই ঘটেছে। দলে দলে মানুষ ব্রেনোবোট হয়ে যাচ্ছে। একদল গোপন বিদ্রোহী দেখা দিয়েছে যাদের মতাদর্শ বিজ্ঞানী ক্লাসানের সাথে মিলে যায়। তারা কোনভাবেই চায় না যে মানুষ ব্রেনোবোট হোক। তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চায়।
রু বেরিয়ে এল।বিজ্ঞানী ক্লাসানের কম্পিউটার থেকে এবার প্রফ হ্যাকারের তৈরি করা উচ্চিংড়ে-০৯২১ সব কম্পিউটারে ছড়িয়ে দিতে হবে। এক সপ্তাহের জন্য সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে। এর মধ্যে যত বেশি সম্ভব অ্যান্টিম্যাটার মহাকাশযানে মজুদ করতে হবে।
(নয়)
সব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পন্ন হল। এতটাই পুঙ্খানুপুঙ্খ যে রু এবং বিজ্ঞানী ক্লাসান দুজনেই অবাক হয়ে গেলেন।ইনোপকে লঞ্চ করা হল।কেউ ঘুনাক্ষরোও টের পেল না কিছু। তবে কী প্রকৃতি তাদের সাহায্য করছে?
হতেই পারে।
মহাকাশযানটি পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি। এটি তে যারা যাচ্ছে তাদের মস্তিষ্ককে খুব সূক্ষ্ম কিছু ঘটনার মাধ্যমে প্রভাবিত করা হবে।
মহাকাশযানের সবগুলো রোবট পুরোপুরি ডাম্ব রোবট। শুধুমাত্র নির্ধারিত কাজ ছাড়া আর কিছু করতে পারবেনা। এমনকি কেন্দ্রীয় কম্পিউটার 'ফিওনা' পর্যন্ত কোন কথা বলার আগে গরগর শব্দ করে নেবে।এর অর্থ মানুষের প্রতি সন্মান এবং দাসত্ব। ঠিক যেমনটা আইজ্যাক আসিমভ বলেছিলেন ২০ শতকে।
ইনোপ লঞ্চ হওয়ার দুইদিন পরে গ্লসিয়াস সবকিছুর কন্ট্রোল ফিরে পেলেন। তিনি যদি আর ছয় ঘন্টা আগেও কন্ট্রোল ফিরে পেতেন,তাহলে দেখতেন একদি অত্যাধুনিক মহাকাশযান বৃহস্পতির মহাকর্ষ কাজে লাগিয়ে প্রথম হাইপার ডাইভটি সম্পন্ন করছে।
(দশ)
সেই প্রফেশনাল হ্যাকারকে ধরা হয়েছে। সে রু আর বিজ্ঞানী ক্লাসানের কথা বলে দিয়েছে। তাঁদের দুজনে ধরা হল। তারপরে একদিন গ্লসিয়াস দুজনকে মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়ে দিলেন।এর আগে অবশ্য তাঁদের ব্রেইনের কিছু টিস্যু কপি করে নেওয়া হয়েছিল।
সম্পূর্ন দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রন করছেন গ্লসিয়াস। শুধুমাত্র কয়েকজন বিদ্রোহী বাদে।সকলের ঘাড়ের মাইক্রোচিপ এর কারনে সকলেই এখন গ্লসিয়াসের হুকুমের গোলাম। এতগুলো শক্তিশালী দেহ মিলেও কয়েকজন বিদ্রোহীর কোন ক্ষতি করতে পারছে না। এতে যতটা না অবাক গ্লসিয়াস হচ্ছেন, তারচেয়ে বেশি অবাক হচ্ছে বিদ্রোহীরা। তবে কী এবারও প্রকৃতিই তাদের রক্ষা করছে?
বিদ্রোহীর দলটা অসাধ্য সাধন করে ফেলল।একদিন হঠাৎই পেছন থেকে কয়েকশ পিস্তলের গুলি লাগল গ্লসিয়াসের গায়ে। তার মাথা থেকে ব্রেইনটা ছিটকে বেরিয়ে গেল।উল্লেখ্যা গ্লাসিয়াস নিজে তখনও ব্রেনোবোট হননি। এত নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে সামান্য কয়েকটা হাজার বছরের পুরনো অস্ত্র নিয়ে একটা দল কীভাবে গ্লসিয়াসকে হত্যা করল তার উত্তর কেউ দিতে পারেনি। গ্লসিয়াসকে মারার পরে বাকি ব্রেনোবোটরা বিদ্রোহীদের সবাইকে ব্রেনোবোটে পরিনত করল। কিন্তু তারা জানতেও পারল না,নিজেদের অজান্তেই তারা মুক্ত।মুক্ত কারন এতদিন গ্লসিয়াস তাদের নিয়ন্ত্রন করতেন এখন কেউ করবে না।তবে মুক্ত হয়েও তারা প্রকৃতির নিয়মকে লঙ্ঘন করে ফেলেছে।
(এগারো)
৫০০ বছর পর,একটি ট্রেপোসারাসের (৭) মহাকাশযান একটি ভগ্নপ্রায় গ্রহের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল।তাদের একজন গ্যালাক্টিক এনসাইক্লোপিডিয়াতে চেক করতেই দেখল, এই গ্রহের প্রানীগুলো নিজেদের ব্রেইনকে রোবটের শরীরে ট্রান্সপ্লান্ট করেছিল। এতে তারা অমর হয়ে যায় ঠিকই, তবে জীবনের প্রতি আগ্রহ মরে যায়। মাত্র ১০০ বছর আগে তারা পৃথিবীতে অনেকগুলো গ্লুকোনাইট মিসাইল ব্লাস্ট করে সকলে একসাথে মারা গেছে।
ট্রেপোসারাসের দলটি ধিক্কার দিয়ে উঠল মানুষদের। প্রকৃতি যখন প্রতিশোধ নেয় তখন হয়ত যুক্তি কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
(বার)
নিকো বড় পাথরটার উপরে উঠে বসেছে। আজ বেশ ভাল বাতাস বইছে, অসাধারন এই আবহাওয়ায় একটু একা বসে না থাকলেই নয়। হঠাৎ সে তার হাতের উপরে অন্য একটি হাতের স্পর্শ অনুভব করে, সে বুঝতে পারে,এই হাতটি নিরার।
এই গ্রহটাও পৃথিবীর মতই। পৃথিবীর মতই এই গ্রহেও বৃষ্টি নামে। তবে এখানকার গাছগুলো অন্যরকম আর বাতাসে অক্সিজেনও তুলনামূলক বেশি।
হঠাৎ বৃষ্টি নামল। নিকো আর নিরা দুজনেই ভিজে যেতে লাগল। এসময় আশেপাশে বিজ্ঞানী ক্লাসান থাকলে দেখতে পেতেন দ্বিতীয় পৃথিবীর প্রথম এবং সবচেয়ে পবিত্র ভালবাসা।
(সমাপ্ত...)
___________________________
(১) নিহিলিন-সপ্তবিংশ শতাব্দীর নতুন আবিষ্কার।ক্লোরোফর্মের বিকল্প হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়।এর কোন পার্শপ্রতিক্রিয়া নেই।
(২) জিটি-পার্সোনাল কম্পিউটারের আপগ্রেটেড ভার্সন।এটি পোর্টেবল।অর্থাৎ ব্যবহারের পর ভাঁজ করে যেকোন জায়গায় বহন করা যায়। কাপড়ের মতই পাতলা।
(৩) গ্লুকোনাইট-ত্রিশ শতাব্দীর আবিষ্কার।বিষ্ফোরক পদার্থ। বায়ুতে অক্সিজেন ৫০০ পিপিএম এর চেয়ে বেশি হলেই বিষ্ফোরিত হয়।
(৪) কেসিনিয়াম: তেইশ শতাব্দীর আবিষ্কার। রোবটদের পাওয়ার আপ করার জন্য ব্যবহৃত তরল।
(৫) এজপার্মিয়াম: ফরমালিনের বিকল্প। অ্যামাইডের জাতক যৌগ। ফরমালিনের মতই কাজ করে, বিষপ্রভাব মুক্ত।
(৬) মিডিয়াল: ত্রিশ শতাব্দীর পত্রিকা।সাথে ভিডি টিউব যুক্ত থাকে বলে ভিডিও দেখা যায়।
(৭) ট্রেপোসারাস: আলফা সেন্টরি নক্ষত্রের একটি গ্রহের জীব।এরা অন্যের মনের কথা বুঝতে পারে।
Writer: Adin Noor
Notre Dame College, Dhaka
Tags:
Science Fiction