১. ব্যান্ড সংগীতের মূলত কোনো সঠিক প্রতিশব্দ আমার জানা নেই।যতদূর জানি প্রচলিত আধুনিক বাংলা গান ঘরানার বাইরে গিয়ে রক ঘরানার সঙ্গীতকেই ব্যান্ড সঙ্গীত বোঝায়। গুগলে জমাকৃত এবং আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য এন্টেনায় এর বাইরে বাংলা ব্যান্ডের বিশদ বিবরণ আমার জানা নেই।তারুণ্যের উচ্ছ্বাস,প্রেয়সীর ভালোবাসা অথবা বিদ্রোহী কোনো প্রতিবাদ;এই সবকিছু প্রকাশের জন্য জগৎজুড়ে অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম এই ব্যান্ডসংগীত।
২.স্বাধীন বাংলার জন্মলগ্নে এদেশের ব্যান্ড সংগীতের যেই সু-বিশাল বিপ্লব ঘটে বাংলাদেশে তাঁর শুরুটা হয় গুরু আজম খানের ব্যান্ড "উচ্চারণ" আর ফেরদৌস ওয়াহিদ/ফিরোজ সাঁই'দের ব্যান্ড "স্পন্দন"এর মাধ্যমে।এরপর পালাক্রমে একে একে আবির্ভাব হয় সোলস/ফিডব্যাক টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরী/বালার্ক/এ্যাবনর্মাল থ্রি প্লাস সহ মাইলসের মতো সব লেজেন্ডারি ব্যান্ডের।আশির দশকের মাঝামাঝিতে আবির্ভাব হয় আরেক সাড়া জাগানো ব্যান্ড ওয়ারফেইজের,এর কিছুদিন পর সঞ্জিব চৌধুরির হাতেগড়া ব্যান্ড "দলছুট" জন্মনেয় নব্বই দশকের দিকে।নব্বই দশকের অন্যতম জনপ্রিয় রকষ্টার গুরু জেমস,
এবি স্যার এবং হাসান ছিলেন তৎকালীন ব্যান্ড
ফিলিংস/এলআরবি/আর্ক ব্যান্ডের লিড ভোকাল।এই ব্যান্ডগুলোর মাধ্যমেই বাংলা গান তাঁর সোনালী অধ্যায় রচনা করে।ভাগ্য সহায়; তখনকার মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে পাইরেসি আর পেনড্রাইভ নামক জলাতঙ্ক ছিলোনা।শুনেছি এই ব্যান্ডগুলোর সিডি ক্যাসেট রিলিজ হবার পর একপ্রকার হট্টগোল লেগে যেত গলির মোড়ের সিডির দোকানে।বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের প্রতি কতটা ক্রেজ ছিলো সেই প্রজন্মের কল্পনা করা যায়!এইছিলো আমাদের ব্যান্ড সংগীতের সোনালী ইতিকথা;এবার আসি বর্তমানে।
৩.নব্বই দশকের শেষদিকে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জন্ম নেয়া ব্যান্ডগুলোর তালিকা ক্রমাগত দীর্ঘায়িত হলেও পাইরেসি আর পেনড্রাইভের কবলে পড়ে এই ব্যান্ডগুলোর অস্তিত্ব যেন অস্তমিত সূর্যের মতই বেওয়ারিশ হয়ে পড়েছে।ব্যান্ডগুলো বর্তমানে টিকে থাকার একমাত্র উৎস লাইভ কন্সার্ট। এইটা আবার মৌসুমী ফলের মত।আর তাই জীবিকার তাগিদে প্রায় নিরানব্বই ভাগ মিউজিসিয়ানই ব্যক্তিগত কাজে মনোনিবেশ করে আছেন।এতকিছুর মাঝেও কিছু মিউজিসিয়ান আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ব্যান্ড মিউজিকের সোনালী ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে।ঠিক তেমনই একজন মিউজিসিয়ান সম্পর্কে আজ বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করবো।
৪. ১৯৭৪ এ জন্ম নেয়া তুহিনের শৈশব,কৈশোর আর যৌবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে যাদুর শহর ঢাকাতে।ছেলেবেলায় মা চাইতেন ছেলে গান শিখুক যাতে চারপাশের চলমান রাহুরগ্রাস থেকে ছেলে মুক্ত থাকে।তাই একপ্রকার জোর করেই গান শিখতে যেতে হতো এই মানুষটির।এরপর বুলবুল ললিতকলা একাডেমী(বাফা)তে নজরুল সঙ্গীত এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিষয়ে অধ্যয়ন করেন তিনি।আর সেখানেই ওস্তাদ আখতার সাদমানি,নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী,নারায়ণ চন্দ্র বসাক এবং ওস্তাদ কিরণ চন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন।গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক,ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন তুহিন।মূলত বুয়েটে অধ্যয়নকালে ব্যান্ড সংগীতে যুক্ত হন "শিরোনামহীন" নামক ব্যান্ডকে সাথে নিয়ে।যা পরবর্তীতে ব্যান্ড মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে কালজয়ী অনেক গানের আতুরঘর হিসেবে পরিচিতি পায়।২০১৭ পর্যন্ত প্রায় আঠারো বছর একটানা মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো দরাজ কন্ঠের এই যাদুকর হটাৎ করেই হার্ট এ্যাটাকের কবলে পড়েন।এর কিছুদিন পরেই চরম লেভেলের ভুল বোঝাবুঝিতে ফাটল ধরে বন্ধুত্বে,ব্যান্ড শিরোনামহীন থেকে সরে আসেন একপ্রকার চাপা অভিমান নিয়ে।তার কিছুদিন পর ২০১৭ সালের শেষদিকে সুমন,রাজু,রিংকু, শাওন-ভাইদের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ডদল "আভাস"।নতুন করে পথচলায় এপর্যন্ত দুইটি গান রিলিজ হয় ব্যান্ড আভাসের যার মধ্যে টাইটেল ট্র্যাক 'আভাস' অত্যন্ত শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করে।যা সাম্প্রতিক সময়ে রিলিজ হওয়া বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের মাঝে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নেয় ইতিমধ্যে।
৫.ব্যান্ড মিউজিকের চলমান অস্থিরতার পাশাপাশি উনার ভবিষ্যৎ চিন্তা-ধারা যানতে আগ্রহ প্রকাশ করলে অন্যসব মিউজিসিয়ানদের মতই চলমান নানাবিধ আগ্রাসন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন,এক পর্যায়ে তিনি বলেন....
"দেখো,আমি প্রথমবার স্ট্রোক করার পরে তোমাদের মাঝে হয়তো আবার নাও ফিরতে পারতাম।সাধারণত এই সংখ্যাটি দুই-তিনবার হলে মানুষের কী হয় ওটা নিশ্চয় জানো।এর আগে যতদূর সম্ভব আরোকিছু স্মৃতি জমাতে চাচ্ছি।বাকিটা সময়ই বলে দিবে।নতুন গানের জন্য আমাদের অবশ্যই সময়ের প্রয়োজন।কারণ,কোয়ালিটি ছাড়া কোনভাবেই গান রিলিজ দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না।আর প্রতিকূলতা তো আছেই।সবার জন্য দোয়া করবে।"
‘জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ-মৃত্যু সেখানে শেষ কথা নয়।’ প্রিয় তুহিন ভাই,মানুষ হারালেও সৃষ্টি কখনো হারায় না। আর এজন্যই আমরা সৃষ্টি হয়ে স্রষ্ঠায় ভালোবাসি।আমাদের এই প্রজন্মের কতশত না বলা গল্পের মাঝে আপনার এই দরাজ কন্ঠ বহমান তা হয়তো আপনার জানা নেই।এই গল্পগুলোর জন্য হলেও আপনাকে সুস্থ্য থাকতে হবে।বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের এই অসময়ে আপনাদের ছায়া বড্ড প্রয়োজন।আপনাদের সমসাময়িক মিউজিসিয়ানদের মাধ্যমেই বাংলা ব্যান্ড মিউজিক ফিরে পাবে তার হারানো জৌলুস,আর আমরা ফিরে পাবো পুরানো সেই সোনালী অতীত।
সুস্থ্য থাকুন সর্বদা আর আসছে আগামীর জন্য নিরন্তর শুভ কামনা।
ইয়াছিন আরাফাত
Tags:
মিউজিক