টর্চের আলোয় স্পস্ট দেখা যাচ্ছে একটা মেয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে।সমস্ত ফ্লোর জুড়ে রক্ত।অর্ধ-আবৃত মেয়েটাকে চিনতে সুধীর বাবুর ভুল হয় নি।দৌড়ে গিয়ে নয়নার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে সুধির বাবু চিৎকার করে বলল-
"এই নয়না! কি হইছে তোর?"
নয়না কিছু বলছে না।শুধু গোঙাছে।"অ"অ"।
নয়নার এমন অবস্হা দেখে সুধীর বাবু আর অন্যদের বুঝতে ভুল হয় না।নয়নার সাথে আসলে কি হয়েছে.! আনাড়ি হাতে নয়নার পরনের কাপড় শালীন ভাবে ঢেকে দিয়ে অ্যাম্বুলেসকে ফোন করেন সুধীর বাবু।চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে তার।নয়নাকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন তিনি।জানোয়ার গুলো যে নয়নার এমন অবস্হা করবে সেটা সুধীর বকবু ভাবতেই পারে নি।একটু পরে অ্যাম্বুলেস এসে নয়নাকে গায়বান্ধার সদর হাসপাতালে নিয়ে যায় ।এটেম্ট টু মার্ডার কেস।পুলিশ এসেছে।সমস্ত বাড়ি সার্চিং নিচ্ছে।না,সবকিছু ঠিকিই আছে।টাকা-পয়সা,সোনা চান্দি সব বাড়িতেই আছে।তাহলে বাড়ির সবাই গেল কোথায়? সব মোবাইলও তো বাড়িতেই।
"তাহলে?"
এসিপি ফাহাদ মাথায় হাত দিয়ে চিন্তা করতে লাগল।ভিকটিমকে মারা কোন ব্যাপরিই ছিল রায় পরিবারের জন্য।নয়নাকে যদি মারতেই চাইত তাহলে এমন আধমরা অবস্হায় রেখে গেল কেন? ওরা ইচ্ছা করলে নয়নাকে মেরে কোথাও গুম করে নিশ্চিন্তে পালিয়ে যেতে পারত।সাপও মরত লাঠিও ভাঙত না।কিন্তু সেটা না করে নয়নাকে আধা-মরা করে রেখে বাড়ি থেকে কিছু না নিয়ে হঠাত উধাও হয়ে গেল সবাই।
"না।এর মধ্য নিশ্চই কোন গন্ডগোল আছে"
·
ফরেনসিক রিপোর্ট থেকে ফোন এসেছে।পুলিশ সুপার তারেক রহমান ল্যাবের বাইরে পায়েচারি করছে।হঠাত করে ডা. তুর্জয় ল্যাব থেকে বেরুল;
"ওহও।মি. তারেক,আপনি এসেছেন? আসুন ল্যাবে আসুন আপনাকে একটা জিনিস দেখাব।যেটা দেখলে আপনি চমকে যাবেন"
এই বলে ডা. তুর্জয় আবার ল্যাবে ঢুকল।সাথে পুলিশ সুপার তারেক রহমান।পরিপাটি ল্যাব।জিনিসপাতি গুলো একদম গোছানো।অবশ্য তুর্জয় সাহেবের বউও ডাক্তার না হলে ল্যাবের অবস্হা এমন হতো না।
এভিডেন্স পলিতে একটা রড হাতে নিয়ে ডাঃ রাতুল পুলিশ সুপার তারেক রহমানের হাতে দিলেন।দীর্ঘ সময় রডের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু বুঝতে না পেরে অবশেষে বললেন;
"এটা কি?"
"রড"
"সেটা তো বুঝেছি।কিন্তু এটা আমার হাতে দিলেন কেন?"
"মিঃ তারেক এটা আসলে যেমন তেমন রড নয়।এটাকে বলে জয়নিং রড।"
"মানে?"
তারেক রহমানের কথায় ডাঃ তুর্জয় প্রজক্টরের স্ক্রিনে একটা কাটা পায়ের হাড়ের ছবি দেখিয়ে বললেন;
"মিঃ তারেক।এই যে ছবিটায় মানুষের পায়ের ভাঙা হাড়টা দেখতে পারছেন।সেটা আপনার হাতের রডটা দিয়েই জয়েন দেওয়া হয়েছে।"
"এখনো ঠিক বুঝলাম না?"
"বুঝবেন বুঝবেন।দ্বারান বুঝাচ্ছি।
মিঃ তারেক হাত ভেঙে গেলে কিভাবে প্লাস্টার করা সেটা দেখেছেন?"
"হ্যা"
"যদি মানুষের হাড় ভেঙে পিষে যায় বা বেকে যায় তখন এই রকম রড দিয়ে সেই হাড় প্লাস্টার করা হয়।"
"হুম।বুঝলাম।তবে এটা এখন কি কাজে আসবে?"
পুলিশ সুপার তারেক রহমানের কথায় ডাঃ রাতুল মৃদু হাসলেন।এরপর রডটা হাতে নিতে নিতে বললেন:
"মিঃ তারেক রডের গায়ে এই যে নাম্বারটা দেখতে পারছেন।সেটা দিয়েই খুনি পর্যন্ত পৌছান যাবে।বুঝলেন?"
"না"
"এই রডের গায়ে যেমন নাম্বারটা দেখতে পারছেন।তেমনি প্রত্যেকটা রডের গায়ে আলাদা আলাদা নাম্বার থাকে।আর সেটা দিয়ে হসপিটালে চেক করালেই বডির আসল রহস্য খুজে পাওয়া যাবে."
"ওহ মাই গড।ইউ আর এ্যা জিনিয়াস ড. তুর্জয়।আপনি তো আমার কাজটা আরো সহজ করে দিলেন"
পুলিশ সুপার তারেক রহমানের কথায় ডাঃ তুর্জয় মৃদু হেসে বললেন;
"ওহ,মিঃ তারেক।ইট'স মাই ডিউটি।
পাচঁ সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে।আগন্তুক তিনটা মার্ডারের কেস সলভের জন্য।ইতিমধ্যেই রডের নাম্বার RPH-341 প্রত্যেকটা পুলিশ স্টেশনে ফ্যাক্স করে পাঠানো হয়েছে।সব হসপিটালে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।পুলিশ সুপার তারেক রহমান থানায় নিজের ডেস্কে বসে দুই হাত থুথুনিতে দিয়ে বলল;
"যাক অবশেষে একটা ক্লু তো পাওয়া গেল"
·
"মিসেস নয়না।সেদিন রাতে আপনার সাথে আসলে কি হয়েছে?"
আজ তিন দিন পর নয়নার জ্ঞান ফিরল।নয়নার বাবা-মা,বোন নিখোঁজ।তাদেরকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।সেই জন্যে নয়নার দেখাশোনার জন্য এক্সট্রা নার্স রাখা হয়েছে।এসিপি ফাহাদ আর একদল রিপোর্টার দাড়িয়ে আছে নয়নার বেডের সামনে।সারা দেশ নয়না টর্চার কেসে জেগে উঠেছে।যেকোন চ্যানেল খুললেই শুধু নয়না মার্ডার কেসের ব্রেকিং নিউজ।।
সাংবাদিকের কথায় নয়না ভাঙা গলায় বলতে লাগল;
"সেদিন রাতে আমাকে দেয়ালে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে আমি অজ্ঞান হই।তারপর যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে আমার দেবর মৃদুলের বেডে পাই।আস্তে আস্তে বেড থেকে উঠি আমি।বেড থেকে উঠার পর আমি বুঝতে কেউ আমাকে"
এটুকু বলে নয়না হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাদতে শুরু করে।নয়নার এমন কান্ড দেখে এসিপি ফাহাদ কিছুটা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন;
"তারপর?"
নয়না কিছু বলছে না।শুধু ফুপিয়ে কাদতে থাকল।
সাংবাদিকরা কৌতুহলে হন্যে হয়ে বলল : "তারপর কি হলো মিসেস নয়না? প্লিজ বলুন"
"আমি বুঝতে পারি,কেউ আমাকে তার রাতের স্বীকার বানিয়েছে।তার আক্ষাঙ্কার পন্যে বানিয়েছি।বিছানা থেকে কোন মতে উঠে দরজা থেকে বেরুতেই আমি আমার শ্বশুরের গলাই শুনতে পাই,
"সরকার মশাই,নয়নার তো কাজ শেষ।ওরে রাইখা আর কি হইবো?"
"হ,ঠিকিই কইছেন রায় মশাই।আমিও সেইটাই ভাবছিলাম।কাজ যহন হইয়া গেছে,তহন বাড়তি বোঝা লইয়া কি হইব।খালাস কইরা দিই?"
"বাবা" -চিৎকার করে বললাম আমি।আর সাথে সাথে আমার কথায় সবাই আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়।হঠাত করে পাশ থেকে জয়া বলে;
"আব্বা।শালি তো সব শুইনা নিছে।এখন কি হইব?"
"কি আর হইব? সোজা জম রাজের কাছে
"
ফেলুনাথের কথায় সবাই হা হা করে হেসে উঠল।আমি কিছু বলতে চাইলাম কিন্তু হঠাত করে পিছন থেকে কে যেন আমার গলা টিপে ধরছিল।ছটপট করতেই আমার তলপেটে দুইটা ঘুষি দেয় সে।বলিষ্ট হাত থেকে নিজেকে বাচাতে চাইছিলাম।কিন্তু পাই নি? আমাকে জোরে ধাক্কা দেয়।সিড়ি থেকে গড়িয়ে পড়তে পড়তে কিসের সাথে যেন ধাক্কা খাই আমি।তারপর আর কিছু মনে নেই আমার"...
"ওহ মাই গড।শেষে কিনা আপনার বাবা-মা ই আপনাকে খুন করতে চেয়েছিল।
হাউ ইট ইস পসিবল?" - প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল সবাই।
"জানি না।আমি কিচ্ছু জানি না।
জানেন এসিপি স্যার,আমি সেদিন প্রচন্ড শকড খেয়েছিলাম।প্রচন্ড শকড।কি এমন স্বার্থে আমার বাবা-মা আমাকে মেরে ফেলতে চায়।কি জন্য ভলতে পারেন?"
এসিপি ফাহাদ কিছু বলল না।বসে থেকে উঠে দাড়াল।সাংবাদিকদের ইন্টার্ভিউ শেষ।এক এক করে বের হয়ে যেতে লাগল তারা।এসিপি ফাহাদ হাসপাতালের জানালার গ্রিল ধরে ভাবতে লাগল;
"কি এমন কারন থাকতে পারে।যার কারনে জন্মদাতা পিতা তার নিজের মেয়েকে মেরে ফেলতে চায়।কি এমন স্বার্থ?"
হঠাতই দরজার সামনে দাড়িয়ে কুড়িগ্রাম সদরের পুলিশ সুপার তারেক বললেন;
"আসতে পারি,মিঃ ফাহাদ?"
এসিপি ফাহাদ দরজার দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলো।পুলিশ ড্রেস পড়া এরা আবার কারা?
"আসুন।কে আপনারা?"
"আমি কুড়িগ্রাম সদরের পুলিশ সুপার তারেক রহমান।আর ইনি কনস্টেবল বিজয়,ইনি হলেন কনস্টেবল ফারুক।"
"তা আপনারা এখানে?"
"আসলে আমরা এখানে এসেছি একটা কেসের হেল্প নিতে?"
"বলুন।আমি আপনাদের জন্য কি করতে পারি?"
"সাত দিন আগে আমরা তিস্তার তীরে বস্তাবন্দী তিনটা লাশ পাই। লাশ গুলো আমরা যখন পোস্টমর্টাম করি।তখন আমরা একটা লাশের পাঁয়ের হাড় থেকে জয়নিং রড পাই।পরে সেই জয়নিং রডের খোজ নিতেই জানতে পারি সেটা আপনার ভিকটিম নয়নার বাবার পায়ের।"
"কি বললেন অফিসার? না এমন হতে পারে না।কখনই না।আমার বাবা-মা কিছুতেই মরতে পারে....."
তারেক রহমানের কথাগুলো খুব মনযোগ সহকারে শুনছিল নয়না।জন্মদাতে পিতার মৃর্ত্যুর খবর শুনে নয়নার মনে হলো কে যেন তার হৃৎপিন্ডে হাতুর দিয়ে স্বজোরে মেরেছে।চিৎকার করে এটুকু বলেই অতিরিক্ত মানসিক চাপ নয়না সেন্সলেস হয়ে যায়।এসিপি ফাহাদ অবাক দৃষ্টিতে পুলিশ সুপার তারেকের দিকে তাকিয়ে আছে।
- "কি হচ্ছে এসব? প্রথমে নয়নাকে মেরে ফেলতে চাওয়া।এরপর তিস্তার ঘাটে তাদের লাশ পাওয়া।"
অবশ্য তারেক রহমান এখনো শিউর না যে লাশ গুলো নয়নার মা-বাবা আর বোনেরই হবে.! কিন্তু লাশ গুলো যদি নয়নার বাবা-মা আর বোনেরই হয়? তাহলে নয়নার শশুর বাড়ির সদস্যরা কোথায় গেছে? নাকি উনারাই নয়নার বাবা-মা আর বোনকে মেরে ফেলেছে?
"ঘোর ষড়যন্ত্র।নিশ্চই কোনো বড়-সরো কাহিনী আছে এই খুনগুলোর পিছনে"-বিড় বিড় করে বললেন তারেক রহমান।
(চলবে...)
Written By - Sohanur Rahman Sohan
Tags:
Thriller