জ্বীন জাতির শ্রেণীবিভাগ



★রংয়ের ভিত্তিতে জীনের শ্রেনীবিভাগ করা যায় এবং এটা অনেক ইন্টারেস্টিং। এই হিসাবে জীন মূলত পাচ প্রকার।

১.কালো জীন( ﺍﻟﺠﻦ ﺍﻟﺴﻮﺩﺍﺀ ) – সবচেয়ে শক্তিশালী জীন এরাই। এরাই সাধারনত জীন রাজ্যগুলোর রাজা হয়। এদের ব্যাপারে তেমন কিছু জানা যায়নি তবে এরা সাধারনত খারাপ হয়না। ফার্সী ভাষাতে এদেরকে বলে ‘শামির’।

২.নীল জীন( ﺍﻟﺠﻦ ﺍﻷﺯﺭﻕ ) – এরা গোত্রপ্রধান হয়। অনেক জ্ঞানী হয় এরা। মানুষের সাথে এদের তেমন কোন যোগাযোগই নেই। মারিদ, নেক্রাতায়েল, আফ্রিত ইত্যাদি প্রতাজির জীনের নীল হয়।

৩.হলুদ জীন( ﺍﻟﺠﻦ ﺍﻟﺼﻔﺮﺍﺀ ) – এরা মধ্যবয়সী জীন। এরা পরিবার প্রধান হয়ে থাকে। মানুষ এবং পার্থিব জগতের প্রতি এদের তেমন কোন আকর্ষন থাকেনা। এদের ভিতরে ভালো ও খারাপ দুধরনের জীনই আছে। ভালো জীনদেরকে বলা হয় জুযাম আর খারাপদেরকে বলা হয় ইফ্রিতি।

৪.সবুজ জীন( ﺍﻟﺠﻦ ﺍﻟﺨﻀﺮﺍﺀ ) – অল্পবয়স্ক এবং সবচেয়ে কম ক্ষমতাধর জীন এরা। মানুষের সাথে এদেরই যোগাযোগ বেশী হয়। মানুষকে জালাতন মূলত এরাই করে থাকে। এরহনাম,জান,ককাস ইত্যাদি প্রজাতির জীনেরা সবুজ হয়।

৫. লাল জীন ( ﺍﻟﺠﻦ ﺍﻷﺣﻤﺮ ) – এরা সবার থেকে আলাদা। খুবই বয়স্ক আর ক্ষমতাবান জীন এরা। এরা ঈবলিশের উপাসক। এরা বেশীরভাগই আগে নীল জীন ছিল। ঘুল,শায়তিন,ইফ্রিত ইত্যাদি প্রজাতির জীনেরা এই রংয়ের হয়ে থাকে।

★জীনদের জাতিগত শ্রেনীবিন্যাস

১.ঘুল( ﻏﻮﻝ)
এরা নিশাচর প্রজাতির লাল জীন। যেহেতু এদের রং লাল সেহেতু এদের নেচার প্রচন্ড ডেমোনিক। ফার্সী ভাষাতে এদেরকে বলা হয় ‘ঘালা’। মেসোপটেমিয়ান মিথের ডেমন ‘গাল্লু’ র নাম থেকে এদের নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। আরব্য রজনীতে এদের উল্লেখ আছে। এদের পায়ের পাতা গাধার মত হয় আর এদের মাথাতে ছাগলের মত শিং থাকে।
এরা মানুষের মাংস ও রক্ত খেয়ে বেচে থাকে। ক্লান্ত পথিক আর বাচ্চারা এদের শিকার হয়ে থাকে প্রধানত। এছাড়া এরা কবরস্থানে লাশ ভক্ষন করে বলেও শোনা যায়। মরুভূমিতে এদের বেশী দেখা যায়, এছাড়া নির্জন জায়গাতে এদের উৎপাত বেশী থাকে। এরা মানুষের বেশও ধরতে পারে। মেয়ে ঘুলদেরকে বলা হয় ঘুলা। এরা সুন্দরী নারীর রূপ ধরতে পারে আর বোকা পুরষদের নিজেদের শিকার বানায়।

ইউরোপের zombie আর Ghoul এর ধারনা এই ঘুল থেকে এসেছে বলেই ধারনা করা হয়। ১৭৮৬ সালে উইলিয়াম বেকফোর্ডের নভেল vathek এর মাধ্যমে ইংরেজী সাহিত্যে ঘুলরা প্রবেশ করে।

২.মারিদ( ﻣﺎﺭﺩ )
মারিদ জীনেরা হল জলচর নীল জীন। এরা আকৃতিতে অনেক বড় হয়। আরব্য রজনীতে জীন বলতে আমাদের যা বুঝানো হয় সেটা আসলে এই মারিদই। যেহেতু এরা নীল জীন সেহেতু স্বভাবতই এরা জ্ঞানী হয় সাথে সাথে এরা অনেক ক্ষমতাধরও। এরা মানুষের ইচ্ছা পূরন করতে পারে। আরব্য রজনীর “জেলে ও জীন” গল্পের জীনটি মারিদ জীনই ছিল। আলকেমী,জ্যামিতি, ত্রিকোনমিতি আর স্থাপত্যবিদ্যাতে এদের প্রচুর জ্ঞান। প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে পারসিক স্থাপত্যবিদরা এই জীনদের সাধনা করতেন বলে জনশ্রুতি আছে।
এই প্রজাতির জীনদের Non Humanoid ফর্ম আছে। ঈসা(আঃ) যে বিশাল আকৃতির মাছ বাহামুথ( ﺑﻬﻤﻮﺕ ) দেখেছিলেন সেইটা এই জীন প্রজাতিরই। হিব্রু পন্ডিতদের মতে এই বাহামুথ হিব্রু মিথের ডেমন বেহেমথ এরই আরেক রূপ। বাহামুথ গভীর সাগরে থাকে। এই মাছের পিঠে একটি ষাড় থাকে যার নাম কুজাটা, এই ষাড়ের পিঠে একটি পাহাড় আর পাহাড়ের উপরে একজন অ্যাঞ্জেল দাঁড়িয়ে সপ্ত আসমানকে ধরে থাকেন।
মারিদ জীনেরা প্রধানত পানিতেই থাকে। এদের Humanoid আর Non Humanoid ফর্মগুলাকে পানিতেই দেখা যায়। এরা সাধারনত মানুষের সাথে কনট্যাক্টে আসেনা যেহেতু এরা উচ্চস্তরের জীন। আর যদিও বা এসে যায় তারপরেও মানুষের ক্ষতি করেনা।

৩.ইফ্রিত( ﻋﻔﺮﻳﺖ)
ইফ্রিত জীনেরা হল উড়তে সক্ষম কালো জীন। এদের পিঠে দুইটি ডানা থাকে। এরা খুব তাড়াতাড়ি একটি জায়গা থেকে অপর জায়গাতে যেতে পারে। কুরআনে এদের উল্লেখ রয়েছে। রাজা সলোমন বা সুলায়মান(আঃ) এর আদেশে একটি একজন ইফ্রিত জীনই সেবার রানীর সিংহাসনটি উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল। যেহেতু কালো রংয়ের সেহেতু এরা প্রচন্ড শক্তিশালী হয়। এদের নিয়ন্ত্রন করাও অনেক কঠিন।
এই জীনগুলি প্রচন্ড ধূর্ত হয়। ইফ্রিত জীনদের সমাজ তিনভাগে বিভক্ত । রাজ্য, গোত্র এবং পরিবার। এরা নারী ও পুরুষ উভয়ই হয়ে থাকে। এরা সাধারনত নিজেদের মধ্যেই বিয়ে করে তবে মাঝে মধ্যে এরা মানুষদের দিকেও নজর দেয়। আর যে নারী বা পুরুষদের এরা পছন্দ করে তাদের তারা উড়িয়ে নিজেদের রাজ্যে নিয়ে যায়।
সাধারন অস্ত্রশস্ত্র এদের উপরে কোন কাজ করেনা। শুধুমাত্র নিয়মতান্ত্রিক কিছু কঠিন রিচুয়াল অনুসরন করেই এদেরকে নিয়ন্ত্রন করা যায়। ইফ্রিত জীনেরা মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ই হয়ে থাকে।

৪.জানন্(ﺟﻦ )
এরা মরুভূমিবাসী নীল জিন। এরা ক্রমাগত নিজেদের আকৃতি আর রূপ পরিবর্তন করতে পারে। এদেরকে মরুঝড় আর উটের বেশেই বেশী দেখা যায়। মানুষের ব্যাপারে এরা খুবই উদার। যেহেতু উচ্চস্তরের জিন এরা সেহেতু এরা মানুষের সাথে কনট্যাক্টে সাধারনত আসতে চায়না। অনেকের মতে মরুভুমির মরীচিকা এই জিনগুলাই সৃষ্টি করে।
মানুষের কনট্যাক্টে না আসলেও যদি কোন কাফেলাকে এদের পছন্দ না হয় তবে এরা মরুঝড় রূপের চরমভাবে তাদের উপরে আঘাত হানে। ঘুল প্রজাতির জীনদের সাথে এদের প্রচন্ড শত্রুতা রয়েছে।

৫.সিলাত্( ﺳﻴﻼﺕ )
এরা হল উড়তে সক্ষন নারী নীল জিন। পরী বলতে সাধারনত আমরা এদেরকেই বুঝি। এরা ক্রমাগত নিজেদের রূপ পরিবর্তন করতে পারে। তবে এদেরকে খুব কমই দেখতে পায় মানুষ। লেজেন্ড বলে যে কোন মানুষ যখন খুব বিপদে পরে তখন নাকি এরা মানুষকে সাহায্য করে। ঠিক যেমনটা আরব্য রজনীতে বলা হয়। আলকেমী আর স্থাপত্যবিদ্যাতে এদের প্রচন্ড জ্ঞান রয়েছে। এরা বেশীরভাগ সময় আকাশেই কাটায়, মাটিতে খুব একটা নামেনা।

৬.শায়াতিন( ﺷﻴﻄﺎﻥ )
এরা লাল জিন। নীল জিন গুলার ভিতর থেকে যারা শয়তানের উপাসক তারাই শায়াতিনে পরিণত হয়। এদের ক্ষমতা প্রায় কালো জিনদের সমান। আকাশ,পানি এবং মাটি তিন জায়গাতেই এদের বিচরন রয়েছে। কথিত আছে মানুষের মাথাতে খারাপ চিন্তাভাবনা এরাই ঢুকিয়ে দেয়। হিব্রু মিথের ডেমন আর এরা প্রায় একই রকম।তবে হিব্রু মিথের ডেমনরা ভবিষ্যতের খবর রাখে যেটা লেজেন্ড অনুযায়ী শায়াতিনরা পারেনা। তারাও মানুষের মত বর্তমান আর অতীতের জ্ঞান রাখে।

৭.নাস্ নাস্(ﻧﺴﻨﺎﺱ )
এরা নিম্নস্তরের সবুজ জিন। মানুষের সাথে এদেরই দেখা বেশী হয়। এরা অনেকটা উদ্ভট দেখতে হয়। এই যেমন ধরুন মাথাটা কুকুরের আর শরীরটা গরুর আবার শরীরটা হাতির মাথাটা মানুষের। মানুষ মাঝে মাঝেই এদের দেখে ফেলে। প্রচন্ড নিচুস্তরের বুদ্ধিমত্তা এদের।

৮.শিকক্( ﺷﻴﻚ )
এরাও নিম্নস্তরের সবুজ জিন। এদের শরীরটা মানুষের মত। কিন্তু মাথাটা ন্যাড়া হয় আর আকারে অনেক বড় হয়। ঠিক একটা বড় হাড়ির মত। আর মাথাটা নেমে ঠিক শরীরের মাঝখানে চলে আসে। অনেকের মতে এদের শরীরে নাকি অগুনতি চোখ থাকে। এদের বুদ্ধিমত্তাও খুব নিম্নস্তরের। এরা চারপায়ে হাটে।

৯.ফালিস( ﺍﻟﻔﺎﻟﻲ )
এরাও নিম্নস্তরের সবুজ জিন। আর সবচেয়ে নিম্নস্তরের জিন এদেরকেই ধরা হয়। এদের মরুভূমিতে দেখা যায়। কোন মুসাফির ঘুমিয়ে থাকলে এরা তার পায়ে কামড় দিয়ে রক্ত চুষে খায়। এরা ঠিক পায়ের পাতার নিচের অংশে কামড় দেয়। এদেরকে বোকা বানানোর জন্য দুজন মুসাফির দুই বিপরীত দিকে মাথারে ঘুমান আর পায়ের নীচের অংশ একে অপরের সাথে ঠেকিয়ে রাখেন। যেহেতু এই জিনগুলা বোকা তারা তখন আর পা খুজে পায়না।

ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী জিনদের সৃষ্টি করা হয়েছে ধোয়াবিহীন আগুনের শিখা থেকে। এটা নিশ্চিত যে তাদেরকে সৃষ্টি করার হয়েছে মানুষ সৃষ্টির অনেক আগে। কিছু কিছু ইসলামিক পন্ডিতের মতে জিনদের মানুষের এক হাজার বছর আগে সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলাম অনুযায়ী জিনদেরও মানুষের মত আল্লাহকে মান্য বা অমান্য করার অপশন আছে। এজন্যই হাশরের ময়দানে জিনদেরও হিসাব নেওয়া হবে মানুষের মত। আর কোন সৃষ্টির হিসাব নেওয়া হবেনা।

লুসিফার বা ইবলীশ বা শয়তান আসলে জিন ছিল। তবে সে ফেরেশতাদের নেতা হয়েছিল। সে যে জিন ছিল তার আরেকটি প্রমান হল অ্যাডাম বা আদম(আঃ) কে সেজদা না করা। ফেরেশতাদের সামনে আল্লাহর আদেশ অমান্য করার অপশনই নেই। সে জিন ছিল বলেই সে এইটা করসে। যারা মনে করেন যে সে বিশুদ্ধ ফেরেশতা ছিল তারা ভুল ভাবেন। তার আসল নাম হল আযাযীল। কিন্তু অভিশপ্ত হওয়ার পর তার নাম হয় ঈবলীশ(The cursed one).

জিনরা পাচটি রঙয়ের হয়। কালো,নীল,হলুদ,সবুজ আর লাল। রংযের উপর তাদের ক্ষমতা অনেকটাই নির্ভরশীল। জিনদেরও আমাদের মত পরিবার,সমাজ আর রাজত্ব আছে। লেজেন্ড বলে গোটা পৃথিবীতে জিনদের ৭ টি রাজ্য আছে। তার ভিতরে ২ টি রাজ্য মুসলমান জিনদের বাকি ৫ টি রাজ্য অমুসলিম জিনদের। ৭ রাজ্য আবার ২২ টি উপরাজ্যে বিভক্ত। এই ২২ টি উপরাজ্যে জিনদের মোট ৪৮ টি গোত্র বসবাস করে। প্রতিটি রাজ্যের থাকে একজন করে রাজা, সে একজন ক্ষমতাশালী কালো জিন হয়। আর প্রতিটি উপরাজ্যের শাসনকর্তা হিসাবে থাকে একজন করে জ্ঞানী নীল জিন। হলুদ আর সবুজ জিনেরা সাধারন ভাবে বসবাস করে। লাল জীনেরা সাধারনত সমাজে বসবাস করেনা। তারা শয়তানের উপাসক হয়। জিনরা সাধারনত মানুষের চেয়েও অনেক বেশী বাচে। একজন জিন রাজা সাধারনত একহাজার বছর রাজত্ব করেন। রাজাকে একমাত্র গুপ্তহত্যার মাধ্যমেই সিংহাসন চ্যুত করা যায়। জিনদের জগতে আমাদের সাথেই প্যারালালি অবস্থান করে। আমরা উচ্চস্তরের জিনদের দেখতে পাইনা। নিম্নস্তরের জিনদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়। জিনরা আমাদের জগতকে ঝাপসা দেখে। লেজেন্ড বলে যে জিন দম্পতি সারাজীবনে শুধু একবারই সন্তান জন্ম দিতে পারে। আর সেটাও একটা বিশেষ সময়ে। অনেকের মতে জিনরা ঝড়-তুফান আর বৃষ্টিতে বের হতে পারেনা কারন তারা আগুনের শিখা থেকে তৈরী। কিন্তু ঝড় বাদলের রাতে জিনের খপ্পরে পরার কাহিনী আমাদের দেশে অহরহই শোনা যায়।

অনেকে জিনদেরকে হিব্রু মিথের ডেমন বলে থাকেন। তবে ধারনাটা ঠিক নয়। হিব্রু মিথের ডেমনরা কখনো ভালো হয়না কিন্তু জিনরা ভালো বা খারাপ উভয়ই হয়ে থাকে। আর ডেমনরা কোন পৃথক সৃষ্টি নয়। তারা মুলত সেই ফলেন অ্যাঞ্জেল গুলা যারা মাইকেলের অ্যাঞ্জেলবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল লুসিফারের পক্ষ নিয়ে আর পরাজিত হয়ে লুসিফারের সাথে বিতাড়িত হয়েছিল। জিনরাও মানুষের মত শুধু অতীত বর্তমানের জ্ঞান রাখে কিন্তু ডেমনরা অতীত আর বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতেরও জ্ঞান রাখে। জিনরা মারা যায় কিন্তু হিব্রু মিথের ডেমনরা কিয়ামতের আগ পর্যন্ত অমর। সো দুইটা আলাদা কনসেপ্ট। ডেমনরা মূলত ক্যাথলিক চিন্তাধারা থেকে এসেছে। এদের সাথে জিনদের মিল হল উভয়েই মানুষের উপর ভর করে।

Lutful Kaiser

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম