জেরোনিমোঃ এক অসম সাহসী যোদ্ধা



১ ও ২ মে, ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেনকে গ্রেপ্তার (বা হত্যা) করার জন্য মার্কিন বাহিনী 'সীল টিম ৬' পাঠায় পাকিস্তানের এবোটাবাদে এবং সেখান থেকে লাদেনের মৃতদেহ তুলে শেষকৃত্যের আয়োজন শেষে সাগরে ডুমিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সে টিমের এক সদস্য ঐ মিশন সম্পর্কে একটি বই লিখে সমালোচিত হয়। 'SEAL Target Geronimo: The Inside Story of the Mission to Kill Osama bin Laden' নামের বইটি নিষিদ্ধ না হলেও রাষ্ট্রীয় গোপণ তথ্য প্রকাশের দায়ে লেখকের উপর বিপদ নেমে আসে। এমনও শোনা যায় সেই মিসশনের সকল সদস্যই বিভিন্ন 'অস্বাভাবিক' উপায়ে মারা যায়। তবে গুজবে কান না দিয়ে অন কথায় আসি। এই মিশনের নাম প্রথম রাখা হয় 'অপারেশন জেরোনিমো' যা পরবর্তীতে পরিবর্তন করে 'অপারেশন নেপচুন স্পীয়ার' রাখা হয়। দুইটি বিশেষ স্টেলথ 'ব্ল্যাক হক' হেলিকপ্টারে করে এই মিশন পরিচালিত যার মাঝে একটি কালশনিকভ রাইফেলের গুলিতে ভূপাতিত হয়। এসব নিয়ে এখনও অনেক কথা চলছে এবং আরো চলবে। তবে কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি কে এই 'জেরোনিমো' যার নামে আমেরিকানরা এমন একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ মিশনের নাম রাখা হয়?
ওয়েস্টার্ন জনরার পাঠকরা আদিবাসী 'ইন্ডিয়ান'দের সাথে ইউরোপ থেকে যাওয়া শ্বেতাঙ্গদের মধ্যকার কোন্দলের কথা ভালো করেই জানেন। যারা জানেন না তাদের তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি কলাম্বাস ইন্ডিয়া অভিযান চালাতে গিয়ে আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করেন এবং ভুলবশত এর বাসিন্দাদের 'ইন্ডিয়ান' আখ্যা দেন। শুরু হয় আক্রমনকারী সাদাদের সাথে সেখানকার অধিবাসী লালদের লড়াই। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে শ্বেতাঙ্গরা উন্নত থাকায় একের পর এক পরাজয় ঘটতে থাকে ইন্ডিয়ানদের। তবে তীব্র প্রতিশোধপরায়ন ও অসহনীয় অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তারাও ইউরোপীয়দের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে পড়ে। রেড ইন্ডিয়ানরা বিভিন্ন গ্রুপে সংঘঠিত হয়ে সাদাদের আক্রমন করতো। তাদের আক্রম্ন ছিলো 'হিট এন্ড রান' পদ্ধতিতে। সোজা কথায় গেরিলা। অস্ত্রের দিক দিয়ে প্রথমে তীর, বর্শা ও কুঠারই সম্বল ছিলো যদিও পরে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার শুরু করে।
বাংলায় ওয়েস্টার্ন ধারার জনক কাজি মাহবুব হোসেন এর লেখা 'বাস্তবে ওয়েস্টার্ন কাহিনীর পশ্চিম' বইটা থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি নিচের প্যারাটা।
''দুঃসাহসিক অ্যাপাচি চীফ জেরোনিমো ছিল এক বীর যোদ্ধা। বহুবার সে সাদা আমেরিকানদের সাথে শান্তি চুক্তির চেষ্টা করে বারবার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে। এই বিদ্রোহী চীফ ১৮৮৬-তে শেষবারের মত আত্মসমর্পণ করে নিজের লোকজন সহ ফ্লোরিডাতে নির্বাসিত হলো। (শিয়া) মুসলমানদের 'ইয়া আলি' হাঁকের মত আমেরিকানরা এখনও কোন দুঃসাহসিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে 'জেরোনিমো' বলে হুঙ্কার ছাড়ে। এতেই বোঝা যায় এই অ্যাপাচি যুবককে অকুতোভয় পুরুষ হিসেবে কত উঁচুতে স্থান দেয়া হয়।
জেরোনিমো এবং তার রেনেগেড দলের অত্যন্ত নৃশংস বলে যথেষ্ট দুর্নামও ছিলো। তবে এদের ওপর সাদারা যেভাবে অকথ্য নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছে তাতে জেরোনিমোর দলকে তেমন একটা দোষও দেয়া যায় না।"

১৬ই জুন ১৮২৯ সালে আরিযপে, সোনোরা, মেক্সিকোতে জন্মগ্রহন করেন। চিরিকাওয়া গোত্রের এই অ্যাপাচি যোদ্ধা প্রথম জীবনে অন্য গ্রুপের হয়ে সাদাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আক্রমনে অংশগ্রহন করেন। ছিলেন একজন রোগ উপশমকারী ওঝা বা শামান নেটিভ ইন্ডিয়ানরা যাকে 'মেডিসিন ম্যান' বলে থাকে। মূলত অ্যাপাচি-আমেরিকা ও অ্যাপাচি-মেক্সিকান কনফ্লিক্টগুলোতেই জড়িত থাকতেন। তখন প্রায়শই শ্বেতাঙ্গরা অ্যাপাচিদের বসতিতে হামলা চালিয়ে মালামাল লুট করে নিতো এবং পাইকারী হারে হত্যা করতো যাদের মাঝে বেশির ভাগই ছিলো মহিলা ও শিশু। ক্রমাগত এসব আক্রমনে অতিষ্ঠ হয়ে আদিবাসীরাও হাতে অস্ত্র তুলে নেয় এবং বেপরোয়াভাবে ইউরোপীয়দের আক্রমন করতে থাকে।
৫ই মার্চ, ১৮৫১ সালে প্রায় ৪০০ সৈন্যের অংশগ্রহনে কর্নেল জোসে মারিয়া কারাসকো জেরোনিমোর গ্রাম
(বা ক্যাম্প) আক্রমন করে যখন গ্রামের প্রায় সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ব্যবসার কাজে বাইরে ছিলো। ফিরে এসে সে তার বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও তিন শিশু সন্তানের রক্তাক্ত লাশ পায়। এরপর থেকে সারেন্ডার করার পূর্ব পর্যন্ত একের পর এক মেক্সিকান দল আক্রমন ও হত্যা করতে থাকে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেক্সিকানদের মনে-প্রাণে ঘৃণা করতো।
I have killed many Mexicans; I do not know how many, for frequently I did not count them. Some of them were not worth counting. It has been a long time since then, but still I have no love for the Mexicans. With me they were always treacherous and malicious.
— Geronimo, My Life: The Autobiography of Geronimo, 1905.
আত্মসমর্পণের পূর্বের কয়েক মাসে মাত্র ১৬জন যোদ্ধা নিয়ে ক্রমাগত আক্রমন করে প্রায় ৫০০-৬০০ মেক্সিকান হত্যা করে এবং স্বীকারও করে যে এর জন্য তার মনে সামান্য পরিমাণ অনুশোচনাবোধ নেই। যদিও সেই কর্নেল অ্যাপাচিদেরই দায়ী করে সকল প্রকার খুনখারাবীর জন্য। পরাজিত দলের কাঁধেই সকল দোষ চাপানো মানবজাতির সহস্র বছরের অভ্যাস।

১৮৭৩ সালে মেক্সিকানদের সাথে অ্যাপাচিদের দীর্ঘ সময় যাবত যুদ্ধ চলে এবং একপর্যায়ে মেক্সিকানদের আহবানে শান্তি চুক্তি করে। বন্ধুত্ত্বের প্রতীক হিসেবে মেক্সিকানরা অ্যাপাচিদের 'মেজকেল' নামক একপ্রকার মদ উপহার দেয়। যখন অ্যাপাচিরা খোশ মেজাজে মদ গিলে মাতাল হয়ে যায় ঠিক তখনই তাদের অসতর্ক মূহুর্তে চুক্তি ভঙ্গ করে মেক্সিকানরা তাদের আক্রমন করে প্রায় ২০ জন অ্যাপাচি যোদ্ধাকে হত্যা করে ও অন্যদের বন্দী করে ধরে নিয়ে যায়।
১৮৫৮ থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত জেরোনিমো একাধিক বার মেক্সিকান ও আমেরিকানদের সাথে লড়াই করে এবং তার সব দুধর্ষ আক্রমন ও পলায়নের জন্য সেই সময় 'কিংবদন্তী'তে পরিণত হন। একবার নিউ মেক্সিকোর (আমেরিকায়) দক্ষিণ-পশ্চিমে 'রেবলেডো মাউন্টেন' এর এক গুহায় তার দলবল নিয়ে আত্মগোপণে যায় এবং আমেরিকান সৈনিকরা গুহার মুখে শক্ত অবস্থান নেয় যাতে জেরোনিমোকে বের হওয়া মাত্র গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও পাত্তা না পাওয়াতে খোঁজ করে দেখে গুহার অপর পাশে আরও একটি ছোট ফোকর আছে যা দিয়ে অনেক্ষন আগেই জেরোনিমো তার গ্যাং নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। যোদ্ধা জীবনের শেষে মাত্র ৩৮ জন সদস্য যার মাঝে নারী ও শিশুও ছিলো, ক্রমাগত আক্রমনে কয়েক হাজার আমেরিকান ও মেক্সিকান ট্রুপসকে ফাঁকি দেয়। যদিও শ্বেতাঙ্গরা জোর দাবী করে যে অ্যাপাচিরা নিরীহ লোকদের খুন করছে।ন্যাটিভ আমেরিকান (রেড ইন্ডিয়ান) দের নিকট সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি হয়ে ওঠেন আর ইউরোপীয় সেটলারদের নিকট 'জঘন্যতম ইন্ডিয়ান' তকমা পান।
এক সময় কোনঠাসা হয়ে জেরোনিমো তার দল নিয়ে ২৭ মার্চ, ১৮৮৬ সালে আমেরিকানদের নিকট সারেন্ডার করে। তখন তার কাছে ছিলো একটি ১৮৭৬ মডেলের লিভার একশন উইনচেস্টার রাইফেল যা এখন ইউনাইটেড স্টেট মিলিটারী একাডেমিতে ডিসপ্লের জন্য রাখা আছে। তাছাড়া একটি সিঙ্গেল একশল কোল্ট মিলিটারী রিভলভার, একটি শেফিল্ড বাউয়ি নাইফ ও একটি ড্যাগার ছিলো। এগুলো এখন ফোর্ট সিল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
The Indians always tried to live peaceably with the white soldiers and settlers. One day during the time that the soldiers were stationed at Apache Pass I made a treaty with the post. This was done by shaking hands and promising to be brothers. Cochise and Mangus-Colorado did likewise. I do not know the name of the officer in command, but this was the first regiment that ever came to Apache Pass. This treaty was made about a year before we were attacked in a tent, as above related. In a few days after the attack at Apache Pass we organized in the mountains and returned to fight the soldiers.
— Geronimo, Geronimo's story of his life, Coming of the White Men, 1909
বারংবার শ্বেতাঙ্গদের বেঈমানীর শিকার হয়ে তাদের উপর সকল বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং যখন তাদের আক্রমন করতো কাউকেই আর রেহাই দিতো না।
General Crook said to me, "Why did you leave the reservation?" I said: "You told me that I might live in the reservation the same as white people lived. One year I raised a crop of corn, and gathered and stored it, and the next year I put in a crop of oats, and when the crop was almost ready to harvest, you told your soldiers to put me in prison, and if I resisted to kill me. If I had been let alone l would now have been in good circumstances, but instead of that you and the Mexicans are hunting me with soldiers".
— Geronimo, Geronimo's story of his life, In Prison and on the war path, 1909
তাদের নিজস্ব ধর্মে বিশ্বাসী ছিলো যেটা 'বেডঙ্কোহে' নামে পরিচিত এবং সে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করতো। তবে শেষ জীবনে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করে যদিও মৃত্যুর পূর্বে তার আগের ধর্ম বিশ্বাসে ফিরে যায়।
১৯০৯ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে ঘোড়া থেকে পড়ে আহত হয় এবং দীর্ঘ সময় তীব্র ঠান্ডার মাঝে সারারাত মাটিতে পড়ে থাকে। পরদিন তার এক বন্ধু দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। নিউমোনিয়াতে ভূগে ১৭ই ফেব্রুয়ারী ফোর্ট সিল, ওকলাহামা ইন্ডিয়ান প্রিজনে একজন যুদ্ধাপরাধী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুশয্যায় তার ভাইপোর কাছে এই বলে স্বীকার করেন যে তার আত্মসমর্পণ করা বড় ধরনের ভুল ছিলো। আমেরিকান ও মেক্সিকান্দের বিরুদ্ধে আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটাই উচিত ছিলো তার।
Apache Indian Prisoner of War Cemetery তে সমাহিত করা হয় তাকে।
তার হাড় এবং খুলি চুরিরও খবর রটে একসময় যার সাথে ইয়েল ইউনিভার্সিটির একটি বিশেষ গ্রুপ যারা 'সিক্রেট সোসাইটি স্কালস এন্ড বোনস' নামে পরিচিত, তাদের জড়িত থাকার কথা ছড়িয়ে পড়ে। এই সোসাইটির একজন সদস্য প্রেসকট বুশ যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন ফিল্ড আর্টিলারি ব্রিগেডের ক্যাপ্টেন ও সাবেক সিনেটর এবং সাবেক ইউএস প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের বাবা ও সাবেক ইউএস প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের দাদা, সে সময় ফোর্ট সিলের আর্মি ভলান্টিয়ার ছিলেন। এই সোসাইটির ব্যাপারে 'প্রেত চর্চা' জাতিয় কাজের সাথে জড়িত থাকার কথা শোনা যায় যদিও ফোর্ট সিলের কর্তৃপক্ষ এসবকে 'নিছক গুজব' বলে উড়িয়ে দেন। জেরোনিমোর গ্রেট গ্র্যান্ডসন (ছেলের ঘরের নাতির ছেলে) হারলিন জেরোনিমো তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট George W. Bush কে একটি চিঠি লিখে জেরোনিমোর কংকাল পুনরায় জোগাড় করে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুনরায় কবরস্থ করার অনুরোধ করে।

নাজমুস সাকিব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম