কুয়াশা মন (পর্ব ৪)



"আমাকে আপন ভাবলে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার জীবন নিয়ে খেলতি না। আমাকে নিশ্চয় কাঠপুতুলের মতো দেখায়।" শান্ত ভঙ্গিমায় মিহির মুক্তাকে বলছিলেন, "শত খেললেও যেন আঘাত পাব না। তুই জানিস, আমি মেয়েদের পছন্দ করি না। সাবিহাকে তো ছোটকাল থেকে বরাবরই অপছন্দ। সে বড় হতেই দেখেছি তোকে সে নিজ পক্ষে করে নিয়েছে। তুই তারই ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছিস। তখনই তোর প্রতি ভালোবাসা একটু কমেছে আমার। একদিন হুট করেই এমন কাজ করে বসেছিস যে, ভাবতেই শুরু করে দিয়েছিলাম, এখানে আপন কেউ আমার আর রইল না। জানিস? বাবার মনে আমাকে নিয়ে এক কণা পরিমাণ ভরসাও জাগলে আমার কী পরিমাণ সাচ্ছন্দ্য বোধ হয়? জানি না, কী অপরাধ করেছি বলে বাবার মনে আমাকে নিয়ে এটুকুও সম্মান জাগাতে পারি না।
সেদিন আমাকে হুট করে টেইলর শপে তোর স্বামীর নিয়ে যাওয়াটা মাথায় খুব আজব ঠেকেছিল। সে এর পূর্বেও এই ধরনের অদ্ভুত কাজ বহু করেছে তা আমার জানা আছে। সেদিনেরটা একটু ভিন্নই লেগেছিল। আমি তবু গেলাম। ফিরে আসার পর যখন বাবা লিপস্টিকের চিহ্নের কথা জিজ্ঞেস করলেন, তখনই বুঝলাম আসলে এসব কে করেছিল এবং কেন করেছিল। বাবাকে শত বোঝানোর পরও তিনি নিজ ধারণায় অটল রইলেন।
আমার মুখে বিন্দুমাত্র ক্লেশ ছিল না। তবে বুঝিয়েছি অনেক। বাবা ভেবেই ফেললেন আমি বাহিরে গিয়ে তাঁর অগোচরে অনুচিত কাজ করে আসি এবং এসে মিথ্যা কথা বলি। সেযাবৎ এরচেয়ে অত্যধিক কটু কথা তার পূর্বে আমি কখনও সইনি। আমার নির্দোষিতার সাফাই আমার আছে।
আমি ভাবলাম, আমার সাথে শেষবারের মতো ছিল তোর স্বামী। যা করেছেন তা হয়তো তারই কারসাজি। আবার আমার সাথে তাঁর এমন কোনো সম্পর্ক নেই যে, এমন নীচু স্তরের মজা আমার সাথে সে করবে। বড় ভাইয়ার বিয়ের সময়ের কথা মনে পড়তেই সব বুঝেছি। বিয়ের শেষে স্বামীর সাথে মিলে তুই আমাকে আর সাবিহাকে এক করার ধান্দা করেছিলি। সেদিনও সে যা করেছিল, নিশ্চয় তোর নির্দেশে করেছিল। এমন দুষ্টু-বুদ্ধি তো একমাত্র তোরই থাকতে পারে। তুই আর তোর স্বামী একসাথে মিলে করেছিস বলে ধরা যায় সাবিহার জন্যই সব করেছিস। সাবিহা সে হিসেবে তোদের পক্ষে ছিল। সাবিহা আর মামার পরিবারকে ভালো করে চিনি। মামা আমাদের প্রতিপত্তির সাথে বরাবরি করতে কতই না আকাঙ্ক্ষা রেখেছিলেন। মেয়েকে উঁচু খান্দানে বিয়ে দেওয়ার সুযোগ অতি সহজেই মেলে নাকি? প্রথম বিয়ে ভাঙার পর উপায়ান্তর না দেখে হয়তো আমার পেছনে লাগতে সাবিহাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সাবিহার কথা না-ই বা বললাম। তার মতো মিথ্যাবাদী, চালবাজি মেয়ে আগে আমি কোথাও দেখেছি বলে সন্দেহ। ছোটবেলা থেকেই সে বাবার মনে প্রতিবার নিজের ভালো স্বভাবের প্রতিমা গাড়ানোর জন্য আমায় ব্যবহার করে এসেছে। আমায় বকা শুনিয়েছে সবটা সময়। নিঃসন্দেহে আমার সাথে বিয়ের করানোর খেয়াল তোর দেমাকে সে-ই ঢুকিয়েছে। প্রতিপত্তি লাভের ভূত যে চড়েছে বাবা-মেয়ে উভয়ের মাথায়। এরচেয়ে অধিক আর কীই বা বলব? সবকিছু আমি জানি, তুইও অনবগত না। কাজেই সব পরিষ্কার উভয়ের সামনেই আছে। বোন হয়েও যে আরেকজনের তরফে থাকে, ওখানে আমার আপন হওয়ার কী ভরসা? সত্যি বলতে, ভেঙে পড়েছি আমি। কাউকেই আপন বলে মনে হচ্ছে না। বিয়ের পর থেকে এগুলোর জন্য সাবিহাকে কথার করাঘাত করতে যাইনি। কী লাভ? তাকে আগেও অসংখ্যবার বকা দিয়েছি, ঝগড়া করেছি তার সাথে। প্রতিবার সে ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজ সাফাইয়ের একটা কিসসা গেয়ে যেত। এমন করুণ সুরে বলা অনেক কথা আছে যেসবে অনেকে বিশ্বাস না করে পারে না। আমিও অনায়াসে ওর প্রতিটা মিথ্যায় বিশ্বাস করে এসেছি, যৎসামান্য হলেও। বিয়ের পর ওই ভুল আর করিনি। ওর সাথে কথা আর বলতে যাইনি। সে যে স্বার্থ চেয়েছে তা একবারেই পেয়েছে তাই বড় কথা। ভাবলাম, আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে হলেও যে যার ইচ্ছা পূরণ করুক। তুই তোর ভাবি হিসেবে একটা বান্ধবী পেয়েছিস, সাবিহার বাবার ধন বেড়েছে, বাবাও আমাকে বিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। এরচেয়ে অধিক কিছু কেউ করে দিতে পারে না। তোরা এখন সুখে থাকার কথা। তবে এতো চিন্তা, এতো প্রশ্ন কেন?"
আমি আর মুক্তা তাঁর দিকে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। তাঁকে এই নিয়ে বহুবার বুঝিয়েছে, পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবগত না হয়ে কারও চরিত্র সম্বন্ধে ফয়সালা না-ই করতে। কিন্তু তিনি এই ভুলই বারংবার পুনরাবৃত্তি করেন। অবশেষে জানলাম, তিনি আমাকে নিয়ে এই ধারণা রাখেন? তিনি একবার সবকিছুর গহীনে গিয়ে ভাবতে পারতেন।
মুক্তা তখনই বলার জন্য উদ্যত হয়, "ভাইয়া, তুমি আমাদের খুব ভুল বুঝছ। এখানে বেশিরভাগ দোষ আমার। এতে সাবিহার তো হাত নেই-ই বলতে গেলে। আমি প্রতিবার কোনো বোকামো করার আগে ভাবি না একটিবার, হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। কাজগুলো আমি ছেলেমানুষের ন্যায় করে ফেলি। আমি কল্পনাও করিনি, সেসব কাজের কারণে বাবা তোমাদের কাছ থেকে এতকাল যাবৎ মুখ ফিরিয়ে থাকবেন। আমি সত্যিই এমন ধারণা করিনি ভাইয়া। সাবিহা একদম নির্দো.."
কথা শেষ করতে না দিয়ে মুক্তার কাঁধে হাত রাখলাম। সে পাশে ঘুরে আমার দিকে তাকালে আমি নম্র চাহনিতে ইশারায় আর কিছুই বলতে নিষেধ করে দিলাম। কারণ মুক্তার এতো কথাবার্তায় তাঁর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কথাগুলো শোনেও যেন শুনছেন না। এতকিছু তাঁকে বলে আর লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। আজীবনের জন্য আমি দোষিণী হয়ে গেলাম। আমাদের শত স্বীকারোক্তিতেও আমাকে নিয়ে গড়া তার অভিমানের দর্পণ সহজেই ভাঙবে না।
কিন্তু মুক্তার ধৈর্যের বাঁধ সহজেই তর সইছে না। সে আবার ক্ষিপ্রবেগে বলতে লাগল, "ভাইয়া তুমি এসব ঠিক করছ না। তোমার যাই মনে আসে তাই ভাববে? তুমি এভাবে সহজেই সাবিহাকে ফেলনার মতো ভাবতে পারো না। বললাম তো, ও দোষী নয়। যা হবার হয়ে গিয়েছে। ওসবকে বাদ দিয়ে সাবিহাকে আপন করে নাও। এতে সবারই ভালো।"
"তোদের ছাড়া আমি অচল নই। আমি একাই থাকতে পারব। আমি না হয় সাবিহার কাছ থেকে তালাক নেবো। তবু এই মেয়ের সাথে আমার সংসার করার আর কোনো ইচ্ছা নেই।"
"তালাক? তুমি সাবিহাকে তালাক দেবে? ভাইয়া, মেজাজ কিন্তু আমারও খারাপ হতে দেরি লাগে না। যা করছ না, আমি কিন্তু এসবের মাঝে বাবাকে নিয়ে আসতে বাধ্য হব। তাকেই বলব আপনাকে ঠিক করতে।"
"যা, যাই ইচ্ছা তাই কর। বাবার ভয়েই প্রতিবার চুপ থাকি। এই মৌনতারই সুযোগ নিয়ে আমাকে নিয়ে খেলা হচ্ছে। এইবার আমি সেই মৌনতাকেই ভাঙব। বাবাকে বলবি তাই না? ঠিক আছে, তার মাধ্যমেই আমি এই তালাকটা নেওয়াবো। দেখিস।"
মিহির মুক্তাকে আর এক শব্দ কথাও বলতে না দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরাচ্ছিলাম। মুক্তা আমার কাছ থেকে রাফাকে নিয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল। আমি নীরবে কেঁদে যাচ্ছিলাম।
"দুঃখিত আমি, কথা এতদূর এগোবে তা আমার কল্পনার ভেতরে ছিল না। দাঁড়া, আমি ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলছি।"
"কী বুঝিয়ে বলবি?" কিছুটা ধমকের সুরে বললাম, "আর কত সার্কাস দেখতে চাস আমার জীবনে? আর কত তামাশা দেখার বাকি আছে? নাকি আমার তালাকটা শেষ পর্যন্ত করিয়ে ছাড়বি? তোকে আমি বলেছিলাম, মিহিরকে নিয়ে টেনশন করিস না। আমার নিয়তি যা চায় তাই হবে। কিন্তু তুই? কেবল তোর জীবন সুখের হলেই হলো? আমাদের জীবনগুলোর কোনো মূল্য নেই? তোর পাগলামোর কারণে কত কী দেখেছি। আমাদের নামের বিয়েটা হয়েছে কেবল তোর কারণে। যদি আমাদের মাঝে তালাক হয়েও থাকে, তবে তার জন্য দায়ী কেবল তুই-ই হবি। আমি হাত জোড় করে বলছি, আমার জীবন নিয়ে আর খেলিস না। যা হবে তাই দেখে নেব। আর এমনিতেও আমাকে কী দেখার জন্য বাকি রেখেছিস? কিছুই আছে? সবই শেষ। মিটিয়ে নিয়েছিস শখ ভাবীকে বান্ধবী বানানোর? দুঃখ, এর জন্যই আজ ওর স্ত্রী হতে পারলাম না। থাক, মুক্তা, তোর উপকার আমি আর চাই না।"
আমিও তাকে যাচ্ছেতা শুনিয়ে কান্না মুছে বেরিয়ে এলাম। দৌড় লাগালাম। সময় থাকতে পৌঁছতে পারলাম না। তার আগেই তিনি গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। আমি বেশ কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পর বাবার কল এলো।
"সাবিহা!"
"হ্যাঁ বাবা, বলুন।"
"মিহির চলে এসেছে। তুই কেন আসিসনি? ঝগড়া হয়েছে নাকি বৌমা?"
"না, তেমন একটা না।"
"আচ্ছা, বুঝেছি। তুই খাঁড়া,আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি তোর জন্য।"
"ঠিক আছে।" ফোন নামিয়ে রাখলাম।
আমি আর ভেতরে গেলাম না। ধরে নিলাম, মুক্তার সাথে এখন থেকে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। ওকে অনুসরণ করব না আমি। যা হবে নিজেই হজম করে নেবো। মিনিট দশেক পর গাড়ি চলে আসে। আমি বাসায় চলে এলাম। শুরুতেই বাধা হয়ে দাঁড়ালেন বাবা। শোধালেন, "ঝগড়া?"
"ছোটখাটো।"
"সত্যিই ছোট তো?"
"হ্যাঁ, ছোট।"
"তাহলে নিজেই ঠিক করে নিস। আবার যদি বড় হয়ে থাকে তবে বলে দে, আমি এখনই ওকে সোজা করব।"
আমি ভাবলাম, বলে দেবো। না, ভাবলাম, আগে উনাকে শেষবারের মতো বুঝাই।
"না বাবা, বড় না।"
"বড় না হলেই ভালো।"
আমি রুমে ধীরে ধীরে পা ফেলে ঢুকলাম। তিনি বিছানায় বিপরীত দিকে মুখিয়ে বসে আছেন। আমি এক বুক সাহস নিয়ে তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম, "আমি দুঃখিত। আমার কথা হয়তো শুনতে চাইবেন না.."
"আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। যাও আমার পাশ থেকে।"
"শুনুন প্লিজ, আমি মুক্তাকে বলেছি ব্যাপারটিকে বড় আর না করতে। ও বাবাকে কিছুই বলবে না। আপনি প্লিজ রেগে থাকবেন না। আমি আমার মতো করে থাকার চেষ্টা করব। বিরক্ত করব না আপনাকে। আপনি যাই বলেন তাই হবে। স্ত্রীত্ব খাটাতে আসব না। আপনি কেবল সব কথা ভুলে যান। আমাকে তালাক দেওয়ার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিন। তালাকের মাধ্যমে হয়তো দুইজন আলাদা হয়ে যাব। অনুমান করতে গেলে, আমরা একে অপরের কাছ থেকে আলাদাই আছি। তালাকের সাক্ষরটা সমাজ থেকে আমাদের কিছু অধিকার কেড়ে নেবে। তার চেয়ে বরং যেভাবে সংসারটা এতদিন চলেছিল, সেভাবেই চলুক। আপনি আমাকে মিথ্যাবাদী, দোষিণী, চালবাজ যাই ইচ্ছে ভাবুন। কেবল আপনি আগের মতো থাকলেই হয়। এই আমার একমাত্র কাম্য। কেবল আমার কাম্য বলেই এসব করতে বলছি না। বাবার কথাও একটু ভেবে দেখুন। তিনি আমাদের জুটিকে অনেক আগেই আশীর্বাদ করে দিয়েছিলেন। আমাদের বিচ্ছেদে তাঁর ওপর খুব গহীন প্রভাব ফেলবে। কারণ কোথাও না কোথাও তিনি আমার প্রতি নিজের মেয়ের চেয়ে অধিক গুণে মমতাময়ী। যা হয়েছে, চাপা দিন। খবর বাবার কানে গেলে খুব ক্ষতি হবে।"
"কোনো ক্ষতি হবে না। তিনি একবার আমার দুঃখের কথা জানলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ভেবে ফেলেছি, আজ সব গ্লানিদায়ক জিনিসকে আমার জীবন থেকে দূর করে দেব। বাবা কিছুদিন হয়তো অস্বাভাবিক থাকবেন। তারপর আমাদের জীবন আগের মতোই বিবাদহীন হয়ে পড়বে।"
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমি হাত দিয়ে বাধা দিয়ে হাত জোড় করে বিনয়ের সাথে কেঁদে বুঝালাম। তার পায়েও ধরলাম। ক্ষমা চেয়ে তাঁর পদতলে লুটিয়ে পড়লাম। তিনি হাত দিয়ে আমাকে তোলে সরিয়ে আমাকে পেছনে রেখে চলে গেলেন।
আমি রুমে পূর্ববর্তী জায়গায় স্থির হয়ে কাঁদতে লাগলাম।
তথাকথিত প্রসঙ্গে বাহির থেকে কলরব শোনা গেল। বাবারও চেঁচানো ভেসে আসছে।
ভাবলাম, আমি এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছি? সময় এখনও হাত থেকে পিছলেনি। মামলা হাতের মুঠোয় করার সুযোগ বেশিক্ষণ থাকবে না। তৎক্ষণাৎ বাহিরে চলে গেলাম।
বাবাকে ততক্ষণে তিনি তালাকের কথা বলে সেরেছে। আমি বাবাকে বুঝানোতে লেগে পড়লাম, "কেবল একটুখানি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সব ঠিক করে ফেলব আমি।"
বাবা ওর বিরোধিতা করে বলতে লাগলেন, তিনি থাকতে আমাদের বিচ্ছেদ হতে দেবেন না।
কিন্তু মিহিরের মেজাজ চরমভাবে খারাপ হয়েছে। বাবার কথার এদিক-ওদিক করতে না পেরে জেদ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। বুঝলাম না, আজও তার কুয়াশা আচ্ছাদিত মনকে। বুঝলাম না, কেন তার তিক্ততা বাড়ছে।
বাবাকে আমি বুঝাতে লাগলাম। সব ঠিক হয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিতে লাগলাম। এও বললাম, মেজাজ ঠিক হলে ঠিকই বাসায় ফিরে আসবেন তিনি। শেষের কথার সম্ভাবনা আমি নিজেকেও দিতে পারব না। তবু সান্ত্বনার খাতিরে বললাম।
দুপুরবেলা তিনি খেতেও আসেননি। ফুফি বকবক করতে লাগলেন। তাঁর প্রতিটি কথায় লুকিয়ে আছে সবই আমার দোষ। আমি কলঙ্কিনী। এই বাড়িতে এসে সবার মাঝের দূরত্ব বাড়িয়েছি। আসলে তাই কি? যদি এমনটে হয় তবে মিহির যা চান তাই হবে। আমি এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব। তালাক চাইলে তালাক দেবো। হ্যাঁ, হয়তো পরিস্থিতি সামলাতেই বাবাও স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন। আমি চলে গেলে সবাই সুখী হবে। বড় ভাবীও আমার কাছ থেকে রেহাই পাবেন। সম্পত্তি আমার ভাগেরগুলো ফেরত দিলে তাঁর পক্ষের ভার বাড়বে। আমার সাথে রেষারেষি করবেন না আর তিনি। আজই হয়তো এই বাড়িতে আমার শেষ দিন। শেষবারের মতো না হয় একবার বাবার মাথায় তেল মালিশ করে দিয়ে আসি।
সামিরা এটুকু পড়ে ডায়েরি রেখে দিলো, রুমে বুয়া ঢুকেছেন বিধায়। বিষাদে ভরাট হয়েছে সামিরার মন। সে ভেবেছিল তার মাও মিহিরের মতো খারাপ, যে কারণে আজ পর্যন্ত মায়ের কথা সে মুখে আনেনি। বুঝাই যাচ্ছে, দোষ সকল হয়তো মিহিরেরই। ডায়েরির পরবর্তী অংশে হয়তো সে দেখবে, তার মায়ের একটা প্রত্যাশিত সুখী সংসারের ইতি ঘটবে। সামিরা ভ্রূ কুঞ্চিত করে নিজেকেই বিড়বিড় করে বলল, যদি এখানেই সমাপ্তি হয়, তবে আমার জন্ম কী করে হলো?
সামিরা আগেই বুঝেছে, মিহির আর তার মায়ের মাঝে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তার জন্মের বিষয় নিয়ে বিচলিত হয়ে আছে সে। ভাবছে, নাকি মোড় পালটেছিল? কেবল বুয়ার যাবার অপেক্ষা।
তার আজকাল মন কেমন যেন করছে। ইচ্ছে করছে দেশের বাড়িতে ছুটে যায় সে। ওখানে দাদু, নানু হয়তো সকলেই আছে। আর তাঁরা তো খুব ভালো। নিশ্চয় তাঁরাও সামিরার কথা ভাবে, সামিরাকে মনে করে। তার ভেতর খুব খারাপ লাগা কাজ করছে। এতটা বছর সে স্বার্থপরের মতো আপন-পর কারও কথাই জিজ্ঞেস করেনি। কেবল ভেবে এসেছে, কেউই ভালো নয়। বুয়া কাপড় ধুয়ে যেতেই সে চট করে তার মায়ের ডায়েরি নিয়ে বসে পড়েছে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়ে আসা রাতের আঁধার আমার মনকে নিস্তব্ধ করে তুলছে। তিনি সাধারণত বাহিরে থাকলে মনটা খামোখাই ভয়ভীতিতে থাকে অঘটনের ভয়ে। তার ওপর আজ মেজাজ খারাপ করে গিয়েছেন বিধায় মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা হচ্ছে। বাসায় সচরাচর মঈন ভাইয়া থাকেন না। তিনি থাকলে না হয় মিহিরকে আনতে পাঠাতাম। কিন্তু বাবাকে কী করে বলব মাথায় আসছে না।
ক্ষণকাল গত হলো, রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে দেখে এসেছি মিহির এলো কিনা। কিন্তু যা হয়েছে তাতে আমার মনে হয় না, তিনি সহজেই এসব মামলা ভুলে যাবেন। তিনি ভেবেছিলেন বাবাকে বোঝালে তিনি সব বুঝে যাবেন। ঘটনার আকস্মিকতায় এমনটা হলো না দেখে উনার রাগ প্রচণ্ড হওয়াটা স্বাভাবিক।
তিনি এখন পাশেই ঘুমোচ্ছেন। ঘুমে তলিয়ে গেছেন। সেই ফাঁকে আমি পাশে চার্জলাইট জ্বালিয়ে তার আলোয় ডায়েরিতে লিখছি।
সন্ধ্যার শেষে ডায়েরিতে লেখা বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলাম। কলিং বেলটা বেজে উঠল এগারোটা নাগাদ। তড়িঘড়ি করে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। বাবা মিহিরের হাত ধরে তাকে ঢুকাচ্ছেন ভেতরে। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, বাবা কবে বাহির থেকে তাকে আনতে গিয়েছিলেন।
"বৌমা, ওকে কিছু খাইয়ে দাও। আর হ্যাঁ, নিজেও খেয়ে নাও।"
আমি নীরবে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। বাবারা সবাই শুয়ে পড়লেন। আমি তাকে টেবিলে ভাত বেড়ে দিলাম। চুপটি করে তিনি খেয়ে রুমে চলে এলেন। কী হলো বা হতে চলেছে তার চিন্তায় মগ্ন আমি, তেমন খেলাম না। এসে দেখি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। আমি ধীরে ধীরে গিয়ে বিছানার অন্য পাশে বসলাম। বললাম, "আমি বুঝেছি এখন আমার ভুল। আমার কারণে আপনি নিজেকে এভাবে শাস্তি দেবেন না। আপনি না তালাক দেবেন বলেছিলেন, ঠিক আছে, তাই হবে। আমি ভাবলাম, বাবা সবই যখন জেনে ফেলেছেন তখন তালাকটা হয়ে গেলে মন্দ হবে না। আপনি, ফুফি নির্বিশেষে সকলেই রক্ষা পাবেন আমার কাছ থেকে।" তিনি নিশ্চুপ রইলেন দেখে আমি আবার শোধালাম, "কী হলো? কিছু বলছেন না!"
তিনি একবার আমার দিকে মেজাজ শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন। এই দৃষ্টি আমার খুব একটা চেনা নয়, নম্র, শীতল এক চাহনি যেন আজ কিছু হয়নিই।
"তুমি কী বলেছিলে যেন? কী কী যেন করবে বা করা থেকে বিরত থাকবে বলেছিলে, যদি তালাক না দিই?"
"বলেছিলাম, আমি আমার মতো করে থাকার চেষ্টা করব। বিরক্ত করব না আপনাকে। আপনি যাই বলেন তাই হবে। স্ত্রীত্ব খাটাতে আসব না। আপনি কেবল সব কথা ভুলে যান। আমাকে তালাক দেয়ার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিন।"
তিনি ভ্রূদ্বয়কে কিছুটা কুঞ্চিত করে আমার দিকে তাকালেন। আমি হুবহুই কথাগুলো বলে দেবো তা হয়তো তার কল্পনাতীত ছিল। যাইহোক, আমি যে আজকের দিনের কিছুই ভুলতে পারব না। সবচেয়ে খারাপ দিন হিসেবে আমার জীবনে আওতাভুক্ত হওয়ায় তার প্রতিটা সেকেন্ডের নিষ্ঠুরতা স্মৃতির দৃষ্টে গেঁথে আছে।
"হ্যাঁ, তাই। এখন থেকে তাই করবে। তুমি ঠিকই বলেছিলে, আমাদের তালাকে বাবার ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে। তাই তোমাকে তালাক দেবো না। পরিবর্তে তুমি এসব করবে। আমার কাছে ঘেঁষার প্রয়াস করবে না। আমার সাথে ছাড়া বাসার বাকি সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখলেই হলো।"
আমি মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এতেই মহাখুশী আমি। তার ভালোবাসা না পেলেও, তার আশেপাশে থাকা থেকে বঞ্চিত হব না। তিনি শুয়ে পড়লেন। এই একটু আগে তিনি ঘুমে তলিয়েছেন। সেই ফাঁকে ডায়েরিতে লিখছি যাবতীয় কথা। কী হয়েছে বিগত সময়ে? তাকে এতো শান্তশিষ্ট কেন দেখাচ্ছে? একপ্রকার খুশিই হওয়া যায় এদিক থেকে। ভেবেছিলাম আমার সাথে আরও খারাপভাবে আচরণ করবেন এবং শেষে তালাকের কাজ শুরু করবেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, তালাকটা আর হবে না। এখন থেকে আমার কাছেই সন্তর্পণে চলতে হবে। তার মেজাজ বিগড়ে যাবে, এরূপ কাজ স্বপ্নেও করতে পারব না। তবে তার এই নীরবতা কারণ? জানতে হবে আমায়।
বাবার সাথে কথা বলে একটু-আধটু আঁচ করেছি , মিহিরের এই পরিবর্তনের কারণ। মিহিরের চিন্তায় বাবা মঈন ভাইয়ার আসার অপেক্ষা না করে নিজেই চলে গিয়েছিলেন। তিনি কোথায় থাকবেন বাবার ভালো জানা আছে। গিয়ে তিনি মিহিরকে আমাদের সম্বন্ধে বুঝালেন, আমাদের যে তিনি ভুল বুঝছেন। আর বাবা তালাকটা তাকে না নিতে বাধ্য করেছেন। বলেছেন, আমাদের বিচ্ছেদ তাঁর ওপর অনেক প্রভাব ফেলবে। সেই সাথে মিহিরকে ছেলে বলতে অস্বীকার করে দেবেন। মিহির এসব শর্তের ভয়ে বলে দিয়েছেন, বাবার অনিষ্ট তিনি মোটেও চান না। এই তালাক তিনি নেবেন না, যদি বাবার বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়। এভাবেই কালরাত সবকিছু ঠিক হয়েছে।
বেশ পৃষ্টা কয়েক পর।
ঠিক এক বছর পার হয়েছে। সবকিছু ঠিকই চলছে বলতে গেলে। আমারও আর তেমন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। ভালো একটা সংসার পেলাম এতেই মহানন্দ। প্রত্যাশা কেবল আছে একটা, আমারও যদি একটি ফুটফুটে মেয়ে হতো! আমার সকল মানসিক চাহিদা গুছত। কিন্তু আমি শর্তে বন্দি। মিহিরের বাহুর পাশ দিয়েও ঘেঁষি না। এতেই যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তবে আমি চিরজীবন নিঃসন্তান থাকতে রাজি আছি।
গেল বছরে আমার সাথে তার তেমন কোনো বিবাদই বাঁধেনি। দুজন সবসময় দুই জায়গায় ছিলাম। কথাবার্তা যাও হতো, স্রেফ প্রয়োজনীয়ই। তিনিও আমার কাজে বাধা দিতে আসতেন না। ফুফির সাথে হাবভাব একটু-আধটু ভালো জমছে। বাবা অনেক সাধনার পরই ফুফির মুখে আমাকে বৌমা ডাকাতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি এখন হয়তো আমাকে আর অপছন্দ করেন না। এটাই স্বাভাবিক, দুই জীবের সহাবস্থানে তারা অতি নিকটে আসে। পাশে থাকলে মন পর্যন্ত পৌঁছনো যায়। বছরটায় ফুফির নিকটেই ছিলাম। তার কিছুর প্রয়োজন হলে আগেভাগে দৌড়েছি। আমি এই বাড়িতে আসার পর থেকে ফুফিকে এক-পাও নড়তে দিইনি। ফুফা-ফুফির মাঝে এখনও ভুল বোঝাবুঝি হয়। তখন তাদের মাঝের ঝগড়াটা আমাকেই প্রভাবিত করে বেশি। আমি তাঁদের ঝগড়াগুলো মোটেও সইতে পারি না। তাই গিয়ে মাঝে-মধ্যে ফুফির দোষগুলো নিজেই বহন করে নিই। এতে ফুফা আর তাঁর সাথে ঝগড়া করতে যান না। আমাকেও তেমন কিছু বলেন না। ফুফিকে প্রতিবার প্রতিরক্ষা করার কারণেই হয়তো তিনি এখন আমাকে অপছন্দ করেন না। সবকিছুই মানিয়ে নিয়েছি আমি বিগত সময়ে। শুধু ভালো কোনো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলাম না বড় জায়ের সাথে। কেমন একঘেয়েমিজনিত রোগ আছে যেন উনার। রুম থেকে সহজেই বের হন না। কাজ যে প্রায় সব আমার আর বুয়ার একার করতে হয় তা নিয়ে ভাবীর বিশেষ মাথা ব্যথা করতে দেখিনি। নিজের মতো করে চলতেই তিনি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বরং কারও সাথেই তার বড় ভাব নেই। মাঝে মাঝে তো বোধ হয় নিজের ভাগের সম্পত্তিগুলো নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে পারলেই তিনি সুখী।
এরই মধ্যে মায়া আপু মাঝে মাঝে বেড়িয়ে গেলেও মুক্তা একবারও আসেনি। সেদিন একটু বেশিই শুনিয়েছি তাকে। অভিমান করে আছে এখনও। আমিও ওকে আসতে বলিনি, তার সাথে যে আমি কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। কিন্তু বেশ কয়েকবার কল করেছি। রিসিভ করেনি সে।
এছাড়া বাকি সবকিছু ঠিক আছে। আজকাল আমার জীবনের স্বাদ কমে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন প্রতিটা ধাপে রোমাঞ্চকর কিছু ঘটে যেত। প্রতিটি ঘটনার সংলাপ অনেক বড় ছিল আকারে। যেমন, আমার প্রথম বিয়ে ভাঙার কাহিনি, মিহিরের সাথে বিয়ের প্রেক্ষাপট। সবই ছিল রোমাঞ্চকর। তখন জীবনের রস হিসেবে সুখ-দুঃখ সবই উপভোগ করেছি একসাথে। এখন ঐরূপ তেমন কিছুই ঘটে না। এখন দিনগুলো এদিকে শুরু হয়, ওদিকে যেন শেষ হয়। মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক ঘুরতে যাই পাশের বাসার ভাবীগুলোর সাথে। বাকিটা সময় বাসায় কাটাই বড় ভাইয়ার মেয়ে মিতুকে নিয়ে। ডায়েরিটাও এযাবৎ পাঁচ কী ছয়বারের বেশি ধরা হয়নি। একসময় এতে প্রতিটা দিন ভরপুর করে লিখতাম। স্মৃতি কেবল। এখন লিখি কম, ওইগুলোই পড়ে সময় কাটাই। এভাবেই দিন যায়।
শেষের লেখাগুলো সাবিহা নিজ মন থেকে লিখলেও অন্যজনের কাছে বিরক্তিকর ঠেকার কথা। সামিরার হালও তাই। এই অংশ পড়তে পড়তে ঝিমুতে শুরু করেছে। তবুও পড়া এগিয়ে নেপয়ার কৌতূহল তার যাচ্ছে না। ঝিমুনির চোখে সে হঠাৎ পরবর্তী পৃষ্টার তারিখ দেখে চমকে উঠল। দুইমাস পরের তারিখ! শেষ যে লেখাগুলো সামিরা পড়েছিল, তা লেখা হয়েছিল ফেব্রুয়ারিতে। আর এই পৃষ্টার উপরের তারিখ দেখে বোঝা যায় নিম্নে বর্ণিত লেখাগুলো নিশ্চয় দুইমাস পর মে মাসে লেখা হয়েছে। সামিরার কিছুটা খটকা লাগল এতে। তার মা সাধারণত ডায়েরিতে এতো দীর্ঘ সময় না লিখে থাকেনি। মুহূর্তেই তার ঘুমঘুম ভাব উধাও হয়ে গেল। পড়ায় সে মনোযোগী হলো।
কী অপরাধ করলাম আমি যে, এমন এক আপনকেই হারাতে হলো? বিয়ের পর থেকে তিনিই তো সর্বদা আমার সঙ্গী ছিলেন। কী এমন পাপ করেছি, যার দরুন অচিরেই তাঁকে হারালাম? কেন বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন?
পরবর্তী পৃষ্টায়। এক বৃষ্টির দিনে আমি বাবার মাথায় তেল মালিশ শেষে রুমে চলে এসেছিলাম। তিনি মালিশ করার সময় মুক্তাকে খুব করে মনে করলেন। আমাকে বারবার তার কথাই বলে গেলেন। সন্ধ্যার দিকে উনাকে না পেয়ে যখন কল করলাম, তখন তিনি ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে বললেন, তিনি মুক্তাকে দেখতে গিয়েছেন। আমার প্রচণ্ড রাগ হলো। এভাবে না বলেই বাসা থেকে বাইরে যাওয়া স্বভাব হয়ে গেছে উনার, তা জানা আছে। রাগ দমিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কখন আসছেন? তখন মিহির পাশে এসে দাঁড়ালেন এবং আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিলেন।
"বাবা, আপনি কাউকে বলে যেতে পারেন না? আচ্ছা, কখন আসছেন?.. ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি মানে এখনই চলে আসুন। বাহিরের অবস্থা খুব খারাপ।"
উনি ফোন রেখে দিলেন। আমরা যথাযথ নিজের কাজে মশগুল হয়ে গেলাম। একসময় আমার পিলে চমকে উঠল। দেখলাম রাত দশটা বাজে। খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। বাবার ফেরার কথা সন্ধ্যার দিকে। মুক্তার শ্বশুরঘর এখান থেকে গাড়িতে করে গেলে দশ মিনিটের দূরত্বে। উনি গাড়ি ছাড়া কোনোদিকেই যান না। আমি মিহিরের দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালাম। তিনিও অনুরূপ আমার দিকে তাকালেন। তারপর তড়িঘড়ি করে ড্রাইভারের ফোনে ফোন লাগালেন বেশ কয়েকবার।
আমিও এমতাবস্থায় উনার পাশে গিয়ে বসলাম। একসময় কল রিসিভ হলো ওপাশে। আমি কান প্রায় লাগিয়ে দিলাম ফোনের সাথে। ওপাশ থেকে অপরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসছে। ড্রাইভার সেলিম চাচার নয় এই আওয়াজ।
"আপনি কে বলছেন?" মিহির বলল।
"আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি এখন হাসপাতালে। আপনি যাকে কল করেছেন তার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে কথা বলছি। আপনার কে হন দুজন?"
আমরা একে অপরকে চাওয়া-চাওয়ি করছিলাম। হৃদপিণ্ড প্রবলভাবে যেন উঠানামা শুরু করছে।
"হ্যালো, কথা বলছেন না কেন? শীঘ্র চলে আসুন। দুজনের এক্সিডেন্ট হয়েছিল। সাংঘাতিক অবস্থা।"
আমরা দুজন বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে ঝড়ের বেগে উক্ত হাসপাতালে চলে গেলাম। বাসায় ফেরার সময় বাবা আর সেলিম চাচার লাশকে নিয়ে ফিরলাম।
এই দুটো মাস উনার শোকেই কেটেছে। আমরা যেন আমাদের মধ্যেই ছিলাম না। বাবাকে সবথেকে বেশি ভালবাসত মিহির। সে এখন ভেঙে একাকার। দুটো মাস হলো, তার খাওয়া-দাওয়ায় তেমন একটা মন নেই। মুখখানা অনুজ্জ্বলতায় ভরেছে। দুটো মাস উনার মুখের একটা শব্দও কর্ণগোচর হলো না, বোবা হয়ে গিয়েছেন যেন। যেখানে বসেন, সেখানেই অবিরাম বসে থাকেন।
বাবার মৃত্যুর খবরে বাসায় ছুটে এসেছিল মুক্তা। সে বজ্রাহতের মতো মাটিতেই গেঁড়ে পড়ল যেন। কাঁদতে পারছিল না, তার অনুভূতিও প্রকাশ পাচ্ছিল না। যখন তার হুঁশ হয়েছে, তখন কান্নায় ভেঙে পড়ে সে শুধু একটি বাক্য উচ্চারণ করেছিল, "বাবা, যখন আপনি গিয়েছিলেন আমায় দেখতে, তখন আপনার সাথে কেন কথা বললাম না ভালো করে?"
ডায়েরির পাতা ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে ভিজে যাচ্ছে দেখে সামিরা ডায়েরি বন্ধ করে ফেলল। নিরিবিলিতে কাঁদতে লাগল। এই না ভাবছিলাম? দাদারা হয়তো আমার কথা মনে করছে? দাদা এখন কোথায়? দাদা নেই পৃথিবীতে? তিনি মারা গেছেন?
ডায়েরি পড়ে সে তার দাদার প্রতিবিম্ব সৃষ্টি না করতেই দেখার আয়নাটিই ভেঙে চুরমার হয়েছে।
এখন আমি আর মিহির দুবাইয়ে থাকছি। বাবা গত হওয়ার বছরখানেক ঘুরে গেছে, মিহির এখনও স্বাভাবিক হচ্ছেন না। মিহিরের অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে দিন কিছু হলো, সবাই বলল, দেশের বাইরে গেলে ভালো লাগবে তার। তাছাড়া আমাদের বিবাহিত জীবনের স্বাদের কথা কখনও উঠেনি। বিয়ের পর আমরা কোথাও যাইনি দেখে মাও আমাদের এখানে দুবাইয়ে বছরখানেক বেড়িয়ে যেতে বললেন। মঈন ভাইয়া, বাবার মৃত্যুর পাঁচ-ছয়মাস গত না হতেই তাঁদের ভাগের সম্পত্তি সাথে স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলেন। নতুন এক জায়গায় সংসার জীবন শুরু করলেন। মিহিরের আমার সাথে থাকা বা না থাকা নিয়ে তেমন একটা সায় ছিল না। তবে একটা সুবিধা, বাবা মিহির সকলেই আগেকার যাবজ্জীবনে প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। আজ উনার বেঁহুশি অবস্থায় খুব কাজে আসছে তা। তিনি বলতে গেলে সবকিছুতে অপারগ হয়ে পড়েছেন। কথার মাঝে জোর দেখি না, চাহনিতে কোনো গাম্ভীর্যভাব নেই, অপলক একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন একদিকে, কোনোকিছু বললে তেমন ভ্রূক্ষেপ নেই। উনার মাঝেই উনি নেই যেন। মিহির সবসময় বাসায় থাকে। কাজে যায় না। কারও সাথে কথা বলে না। মা বারবার ফোন করে তাঁর কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন এবং তাঁর সাথে অন্তত মিনিট খানেকের জন্য কথা বলতে চাইছেন। কিন্তু তিনি কারও সাথেই কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। আমি বিগত দুটো বছর উনার সাথে অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে যাইনি বা উনার পাশেও ঘেঁষিনি। অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি এসবে, যার জন্য গিয়ে তাঁর সাথে কথা বলা হয় না। আমার লাগছে, এখন তার মেজাজ শূন্য। কাজেই কথা বললে বা সান্ত্বনা দিলে চটে যাবেন না। যাইহোক, আগের মিহিরকে এখন দেখি না।
রাত এখন প্রায় এগারোটা। মিহির বেলকনিতে একা বসে আছে। গিয়ে তার পাশে বসব কি? নাকি মেজাজ পরিবর্তন হয়ে যাবে? যা হয় দেখা যাবে। এখন না হয় গিয়ে উনার পাশে বসি।
তার পাশে গিয়ে বসেছিলাম। তখনই উনি আমার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। এই বুঝি আবার বেড়ে যাবে উনার তিক্ততা। কিন্তু তেমনটা হলো না। উনি শান্ত ভঙ্গিতে দৃষ্টি অন্য দিকে রেখে বসে রইলেন। আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলাম। একসময় গলা খাঁকার দিয়ে বলতে শুরু করলাম, "আর ইউ অলরাইট?"
আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, "হুঁম"
"আসলেই কি?"
উনি জবাব দিলেন না। আমি আরেকটু পাশে গিয়ে বসলাম। উনি খেয়াল করে চুপ রইলেন।
"বাবা গেছেন এক বছর হয়ে আসছে। আপনি নিজেকে এখনও স্বাভাবিক করছেন না। এটা কিন্তু ঠিক না। বাবা যদি জীবিত থাকতেন, আপনার এই আচরণ যদি লক্ষ করতেন, তবে খুব কষ্ট পেতেন। আপনজনের বিয়োগে কাঁদলে মনটা হালকা হয়। বেদনা না কমলেও, বহনের শক্তিটা পাওয়া যায়। আপনি ববাবার মৃত্যুর পর থেকেই এমন। হাসি-কান্না কিছুই করছেন না। শুধু লাগছে, আপনার মাঝে আপনিই নেই। এরূপ হলে জীবন কি চলবে? আপনি না হয় ভেতরের কষ্টটা কান্নার মাধ্যমে কমিয়ে ফেলুন। একটু কান্না করুন না হয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
আমি ছিলাম উৎসুক। তিনি আমার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। আহ্, আমি নিশ্চয় পাগলাটে ধরনের কথা বলে ফেলেছি। নিজেই নিজের ঠোঁটে কামড় খেয়ে নজর ফিরিয়ে নিলাম।
"আপনের বিয়োগে মানুষ কাঁদে। সে কাঁদাটা ক্ষণিকের, সাপ্তাহিক কী মাসিক।" তিনি শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, "কাঁদার সীমার কথা কেন বলছি জানো? কারণ তাদের আপন আরও থাকে। একজনের চলে যাওয়ায় ওরা নিজেকে পুরটাই বিধ্বস্ত করে ফেলে না। তারা অন্য আপনের জন্য নিজেকে সামলে নেয়। ওই কান্নাটা করে সাময়িকের জন্য। কারণ না কাঁদলে ভেতরেই খুব জখম হয়। তাদের আপন আরও আছে যাদের জন্যে নিজেকে সুখে রাখতে হবে। তাই তারা এক আপনের বিয়োগে নিজেকে ভেঙে না ফেলে ভেতরের দুঃখ কান্নার মাধ্যমে উজাড় করে দেয়। কিন্তু আমার আপন শুধু একজনই ছিল। সে-ই আমাকে চিরতরে ছেড়ে চলে গিয়েছে। তিনি ছাড়া আমার আসল আপন কেউ নেই। উনার মুখ দেখেই আমি জীবন অতিবাহিত করছিলাম। হঠাৎ করেই উনার যাওয়াটা আমাকে হতভম্ব করে রাখল। ভেতরের কষ্টটা কান্নার মাধ্যমে সহজেই বেরুচ্ছিল না। আপন আর কেউ নেই বিধায় কষ্টটা মনের ভেতরেই বাসা বাঁধার পরিকল্পনা এঁটেছে। আমিও বাঁধতে দিয়েছি।"
"আপনার কথার আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কতজনই না আছে। ফুফি, মুক্তা, মায়া আপু সকলেই তো আপনার আপন।"
"ওদের ভালো লাগে না।"
"কী বললেন আপনি? আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? রাগ করবেন না তো?"
"কী কথা?"
"আমার লাগছে আপনি রাগ করবেন। আপনার মেজাজ এখন শীতল আছে দেখে বলতে চাচ্ছিলাম।"
উনি উনার শীতল চাহনি দিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। আমি বশীভূতার মতো চেয়ে রইলাম উনার দিকে। উনি চোখ সরালেন। আমি আমার কানের সামনে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলাম।
"ইয়ে, মানে আপনি এমন কেন?"
"কেমন?"
"এই যে, যে কাউকে সহজে পছন্দ করেন না। বিশেষ করে মেয়েদের দিকে ফিরেও তাকান না। নিজেকেও যে খুব তুচ্ছ মনে করেন।"
"শেষের কথাটি কীভাবে জানলে?"
"দুইবছর যাবৎ থাকছি আপনার সাথে। আর, বিয়ের সময়টায় কীভাবে কী হয়েছিল আপনি আন্দাজ করেছিলেনই। আপনি চাইলেই মুক্তার স্বীকারোক্তির মাধ্যমে বাবার বিশ্বাস ফিরে পেতে পারতেন, হয়তো এ বিয়েটাও করতে হতো না। কিন্তু আপনি এমনটা করেননি। আপনার বিয়েতে অনেকেরই মকসুদ পূর্ণ হবে দেখে বিয়েটা করে ফেললেন। নিজের জীবনের কথা একটুও ভাবেননি। এই থেকেই অনেকটা ধারণা করেছি আপনার সম্বন্ধে।"
"আর কী কী ধারণা করেছ?"
"এই যে," ইতস্ততভাবে বললাম, "কোথাও না কোথাও বাবা আপনাকে খারাপ ছেলে ভাবতেন।"
উনি বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। যতটুকু জানি, সেসময় আমি আমার চাহনিতেই উনাকে বুঝিয়েছিলাম যে, দুনিয়ার সকল মানুষ উনাকে খারাপ ভাবলেও আমি অমনটা ভাবব না। উনি হ্যাঁ বা না কোনো জবাবই করেননি। আমি এসব কথা আগেও ধারণা করেছিলাম। কিন্তু তা তিনি জানতেন না।
"আপনার মনে কী আছে আমায় বলুন। আপনি এক্ষেত্রে আমাকে একটি নির্জীব বস্তুই ভাবতে পারেন। নির্দ্বিধায় সব বলে দিন নির্জীব বস্তুটিকে। আর নির্জীব বস্তু কথা বলতে পারে না। কাজেই এই নির্জীব বস্তুটি কাউকেই কিছু বলবে না। আমার মনে হয়, আমাকে কোনোকিছু শেয়ার করলে অসুবিধা হবে না।"
উনি দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ফেললেন। মনে আমার ক্ষীণ আশা জাগ্রত হলো; বলবেন উনি, সব বলবেন।
আমি আরেকটু চাপ দিলাম, "বলুন না প্লিজ।"
"এসব কথা কাউকে বললে আমার কোনো সমস্যা হবে না। তুমি জানো না কেন তা আমি জানি না। তবে না জানারই কথা।" তিনি খুব শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, "তুমি নিশ্চয় জানো না, আমার বাবা ছিলেন তোমার ফুফির দ্বিতীয় স্বামী।"
আমি হতবাক! কথাটি শোনার জন্য আমি সত্যিই অপ্রস্তুত ছিলাম। উনিও টের পেলেন এ বিষয়। "কী বললেন? আমি তো জানতামই না।"
"কী করে জানতে! তোমার প্রথম ফুফা যখন মারা গিয়েছিলেন তখন তোমার জন্মই হয়নি।"
"তাহলে আপনার আসল মা মানে আমার আসল শাশুড়ি কে?"
"প্লিজ, তাকে আমার মা বলবে না। তবে নিজের শাশুড়ি বলতে চাইলে বলতে পারো।"
"না, না, আপনি উনাকে মা না ভাবলে আমি কেন শাশুড়ি ভাবব? বিয়ে তো আপনার সাথেই হয়েছে।"
তিনি কিছুটা গলা খুলে হাসলেন। আমি পরে নিজেই বুঝলাম, আমি একটি হাস্যকর কথা বলেছি। শতই হোক, নিজের বোকামোতে নিজেকে শাসালাম না, উনি যে এতদিন পর একটু হেসেছেন। তাঁর হাসিতে যে এতো মায়া আছে, বছর খানেকের শোকের চাপে ভুলেই গিয়েছিলাম।
"উনি খুব খারাপ। জানি না, এখন কোথায়, কয়টা পুরুষের সাথে লালসা মিটাচ্ছে।"
আমি উনার কথায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করলাম। তা তিনি বুঝে আরও কিছু বলতে অগ্রসর হলেন। পরিবেশ এখন কেমন থমথমে। আমাদের মনও থমথমে। কুয়াশা মনেরটায় বেশি বলা চলে। কেমন মলিন স্বর!
"বাবা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। যাকে বিয়ে করেছিলেন, তিনি কোনো দিক দিয়ে কম রূপবতী ছিলেন না। বাবা তার রূপের পিয়াসি হননি। তিনি সত্য ভালোবেসেছিলেন। দাদা-দাদিদের ইন্তেকালের পর বাবা উনাকে বিয়ে করে নিজের একটা সোনার সংসার পাতলেন। সোনার সংসার কেন বলছি হয়তো এটাই ভাবছ। বাবা খুব প্রতিপত্তিশীল লোক। টাকা -পয়সা এক হাতে কামিয়েছেন, অন্য হাত দিয়ে উজাড় করেছেন। তবু সম্পত্তি কমত না। বিয়ে করে আনার পর স্ত্রী যা চাইলেন মুহূর্তেই হাজির করে দিয়েছেন। ভাবতে পারো, বাবা তাঁকে কত ভালোবাসতেন। বছর কয়েকে আমি আর বড় ভাইয়া জন্মগ্রহণ করলাম। আমার বয়স যখন দুই বছর, তখনই বাবা জানতে পেলেন নিজের স্ত্রীর পরকীয়ার সম্বন্ধে, তাও বাহিরের লোকের কাছে। ধীরে ধীরে জানতে পেলেন, সে ধনীলোকদের বশীভূত করার চেষ্টা করে রূপের মোহ দিয়ে। বাবা এসব কথায় কান তেমন দিলেন না। অন্ধ ভালবাসার মোহ যাকে বলে। তিনি সেটার মাধ্যমে মোহিত হয়েই তাঁর আসল রূপ আগে চিনেননি। একদিন সত্যিই তিনি হাতে-নাতে ধরা পড়েছেন বাবার কাছে। আমি উনার রক্তের সন্তান। কেউ ধোঁকা দিলে কতটা ঘৃণার সৃষ্টি হয় বা বাবার বেলায় কতটুকু হওয়ার কথা তা খুব ভালোভাবেই অনুমান করতে পারি। বাবা ওই ধোঁকাবাজের সাথে এক মুহূর্তও সংসার করলেন না। একগুচ্ছ টাকা ছুঁড়ে মেরে তাকে পর করে দিলেন। এসবের পর বাবা দুইবছর একাই আমাদের দুই ভাইয়ের দেখাশোনা করেছেন। তিনি মানসিক দিক থেকে পূর্বে থেকে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের ভার উনার একার ওপর উঠায় উনি পুরোটাই ভেঙে পড়েছিলেন। শেষে আমাদের প্রতিবেশীর বলায় বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করলেন, তোমার ফুফিকে। তোমার প্রথম ফুফা বিয়ের এক বছর না ঘুরতেই রোগে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। তোমার ফুফির একটা মেয়ে সন্তান হয়েছিল। মায়া। বাবার সাথে বিয়ের পর মুক্তা জন্ম নেয়। এভাবেই বিক্ষিপ্তভাবে আমরা প্রত্যেকে এধার-ওধারের সন্তান। আমরা দুইভাই বাবার আর আগের মায়ের সন্তান। মায়া, মা আর তোমার আগের ফুফার সন্তান। বাবা আর মায়ের সন্তান কেবল মুক্তা। মুক্তার সাথে রক্তের টান আছে বিধায় ওর সাথে আমার যাও পড়ে, মায়ার সাথে পড়েই না। বাবা বিয়ের পর মাকে তেমন একটা ভালোবাসেননি। যা বেসেছে তাকে সম্মানের নাম দেওয়া যায়। বাবা কেবল যথার্থভাবে সম্মান করতেন মাকে। কারণ তিনি এই মায়ের মধ্যেও মাঝে মাঝে আগের মায়ের ছায়া দেখতেন বলে মনে হতো। তিনি কখনও মায়ের সাথে সুখ-দুঃখের কথা বলেননি, মায়ায় পড়ে যাবেন ভেবে। এই মায়াটা বড় ক্ষতিকর জিনিস, এর কারণেই মানুষ ধোঁকা পায়। বাবা কখনও এজন্যে আগের মায়ের মতো করে ভালোবাসা কাউকে দেননি। তাঁর কাছে আগের মায়ের অনেক কথা শুনেছি আমি। ধীরে ধীরে আমিও বাবার কাতারে গিয়ে পড়লাম। সৃষ্টি হলো মেয়ে জাতির জন্য ঘৃণা। মেয়েদের খুব ঘৃণা করতে শুরু করলাম। এমনকি তোমার ফুফি, এই যে, বর্তমানে যাকে মা বলে ডাকি, তাকে কেবল সম্মানের খাতিরে মর্যাদা দেই। শতই হোক, আমাদের পেলেছেন, যত্ন করেছেন।
বাবা মাঝে মাঝে আগের মায়ের কথা মনে করতেন, মনের কোটরের কোথাও না কোথাও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখতে পেতেন। আমাকে এসব শেয়ার করতেন, আমি জ্বলে- পুড়ে অগ্নিশর্মা হতাম, বাবা ওই ধোঁকাবাজের কথা ভাবছে দেখে। মায়া বা মুক্তা এসব কথা জানে না। ভাইয়াও সবকিছু সম্বন্ধে অবগত আছেন। কিন্তু দেখে এসেছি, আমার মনে মেয়েদের প্রতি যতটুকু ক্ষোভ জন্মেছে, তার বিন্দুমাত্র লেশ ভাইয়ার কাছে দেখিনি। ভাইয়া যখন কৈশোর, তখনই বুঝলাম, আগের মায়ের ধোঁকার সম্বন্ধে জেনেও তার মন্তব্যে বৈপরীত্য কেন ছিল না। কারণ সেও জন্ম নিয়েছে আগের মায়ের মতো হয়ে। নিজ রক্তের ভাইয়েরই চরিত্র সম্বন্ধে বলতে লজ্জা করছে। সে বড় হতেই বাবা তাকে অনেকবার হাতে-নাতে ধরেছে এবং শাসিয়েছে। তবু মেয়েদের প্রতি লোভ তার গেল না। আট-দশটা মেয়ের সাথে হাঁটা, কথা বলা, না জানি আরও কত কিছু। আমি ছোট ছিলাম বিধায় বাবা কী দেখেছেন বা জেনেছেন ভাইয়ার কুকৃর্তির সম্বন্ধে তা আমাকে জানাননি, ধারণা নেই। তবে বড় হয়ে অনেকটা আঁচ করেছি। শেষে নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছেন। শুনেছিলাম, তাঁদের সংসার এখন বেশ একটা সুবিধার নয়, দুজনই যে একি ধাঁচের। আগের মায়ের মতো ওকেও পর করে দিয়েছি, অনুশোচনা হয় না আমার। আর আমি বড় হতেই তোমার পাল্লায় পড়লাম। আমি মায়ের মতো হইনি, হয়েছি বাবার মতো। তবে ভালোবাসা কখনও খুঁজিনি, বাবার মতোই একদিন পরিণতি হবে ভেবে। আমি বড় হতেই আমার জীবনে তুমি এলে। সবকিছুতে বাবা ভাবলেন, আমার মাঝে আগের মা আর ভাইয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু আদৌ আমার মাঝে মেয়েদের নিয়ে কোনো নীচু স্তরের ভাবনা কাজ করে না। কিন্তু বাবাকে আমি বুঝাতে পারলাম না। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে তোমার সাথে বাসায় একা থাকায়, তোমার হাতের আঁচড় দেখে বাবা কত কী ভেবেছিলেন। বিয়ের কাণ্ডের কথা না-ই বা বললাম। তুমি হয়তো অনেকবার ভেবেছ, সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি আমি তোমাকেই। কেন, তা হয়তো বুঝেছ। বাবাই একমাত্র আপন ছিলেন। তিনিই আমাকে অহেতুক ভুল বুঝলেন। ঘৃণা জন্মানোর কথা নয় কি?"
আমি এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে শুনে যাচ্ছিলাম তাঁর কথা। শেষের কথা শুনে আমি মুখ নীচু করে ফেললাম। একসময় আমি ভাবতাম, মিহির কোনো পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবগত না হয়েই যে কারো চরিত্র সম্বন্ধে ফয়সালা করে ফেলতেন। আজ আমার মনে হচ্ছে, কাজটি সে-ই না, বরং আমি করেছি। আসলেই শুরু থেকে মিহিরকে আমি ভুল বুঝে এসেছি। তাঁর ক্রোধকে কত সময় কত মন্দভাবে বিবেচনা করেছি। তার আড়ালে কী থাকতে পারে কখনও বিবেচনা করিনি। আসলেই, উনার স্থলে আমি থাকলে, আমিও হয়তো এরূপ করতাম, মেয়েদের নিয়ে ঘৃণা পোষতাম।
"বলো, ঘৃণা কি জন্মানোর কথা নয়?" নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ে থেকে তিনি বললেন।
(চলবে..!)


লিখাঃ ফারিয়া কাউছার

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form