আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীর মানব প্রজন্ম। মানব ইতিহাসে প্রযুক্তিগত ভাবে আমরা বেশ কিছু উৎকর্ষ লাভ করেছি। আজ মানুষ কিছুটা বলতে পারে বিজ্ঞান এই এতো উন্নতি করেছে, ওই অতো কিছু করেছে। কিন্তু যদি মোট সম্ভাবনার দিক থেকে দেখা যায় তবে দেখতে পাবো যে আমরা প্রযুক্তিগত দিক থেকে এখনো শৈশবকাল পার করতে পারি নি। সেটা জানতে গেলে আমাদের এক অদ্ভুত জগতে প্রবেশ করতে হবে।
প্রযুক্তিগত ভাবে আমরা এখন ঠিক কোন জায়গায় আছি তা নির্ধারণ করতে গিয়ে 1963 সালে একজন রাশিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাই কার্ডাশেভ একটি কাল্পনিক মাপকাঠি তৈরি করেন। সেটা হলো কার্ডাশেভ স্কেল। একটি সভ্যতা প্রযুক্তিগত ভাবে কতটা উন্নতি করেছে, তা নির্ভর করে সেই সভ্যতাটি মোট কতটা শক্তি তার কাজে লাগাতে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম - এই ধারণার উপর ভিত্তি করে এই স্কেলটি তৈরি করা হয়েছে। একটি সভ্যতা যত বৃদ্ধি পাবে এবং যত উন্নতি করবে তার শক্তির চাহিদা ততই বাড়বে। কার্ডাশেভ প্রথমে তিনটি ধাপ তৈরী করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে আরও কয়েকটি ধাপ যুক্ত করা হয়। এর সবকিছুই যে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে তা বলা যায় না তবে মিলে যাওয়ার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে।
Type I সভ্যতা --
এর আরেক নাম planetary civilization. এই সভ্যতা যে গ্রহে গড়ে উঠেছে সেই গ্রহে অবস্থিত সকল প্রকার শক্তি ব্যবহার ও সঞ্চয় করতে পারে। এর শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা 10^16 থেকে 10^17 ওয়াট ( মানে প্রতি সেকেন্ডে 10^16 থেকে 10^17 জুল পরিমান শক্তি ব্যবহৃত হয়)। এই সভ্যতা গ্রহে উপলব্ধ সকল প্রাকৃতিক শক্তি (যেমন সূর্য থেকে আগত সকল শক্তি ইত্যাদি) ব্যবহার করতে সক্ষম। ফিউশন প্রক্রিয়া পুরোদমে ব্যবহার করতে হবে। ম্যাটার-আ্যন্টিম্যাটার সংঘর্ষ থেকে প্রাপ্ত শক্তি ব্যবহার করতে সক্ষম হতে হবে। গ্রহের আবহাওয়া, আগ্নেয়গিরি এমনকি ভূকম্পনের শক্তিও ব্যবহার করতে হবে। (এই ধরনের ক্ষমতা আমাদের কাছে এখন অবিশ্বাস্য লাগলেও এর পরবর্তী ধাপের সভ্যতার ক্ষমতার তুলনায় তা একদমই আদিম!)
Type II সভ্যতা --
এর আরেক নাম stellar civilization. এই সভ্যতা তাদের "সৌরজগতের" বা তার নক্ষত্র এবং গ্রহমণ্ডলের সকল শক্তি ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এই ধরনের সভ্যতা 10^26 ওয়াট হারে শক্তি ব্যবহার করবে। একটি নক্ষত্রের প্রায় সমগ্র শক্তি ব্যবহার করার একটা উপায় হতে পারে সেই নক্ষত্রের চারপাশে একটা megastructure গঠন করা, একে ডায়সন গোলোক ( Dyson sphere) বলে। এটি নক্ষত্রটিকে সম্পূর্ণভাবে পরিবেষ্টন করে পুরো শক্তি সংগ্রহ করে তা সভ্যতার জন্য কাজে লাগাতে পারবে। বিজ্ঞানী ফ্রীমান ডায়সন এর প্রাথমিক আইডিয়া দিয়েছিলেন। তাঁর মতে মহাবিশ্বে যদি কোথাও এই ধরনের গঠন পাওয়া যায় তবে সেটা হবে উন্নত সভ্যতার মাইল ফলক, সেক্ষেত্রে আমরা সহজেই তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারবো। যাইহোক, এই টাইপের সভ্যতা ফিউশন রিয়াকটরকে মহাকাশে পাঠিয়ে দিয়ে অন্যান্য গ্রহগুলি থেকে শক্তি আহরণ করতে পারে। এই ধরনের শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা কোন ধরনের সভ্যতার পরিচয় বহন করে তার একটা আনুমানিক উদাহরণ দেওয়া যাক। জানা গেল আমাদের চাঁদের মতো বড়োসড়ো কোনো বস্তু তাদের বাসগ্রহের দিকে ধেয়ে আসছে। এক নিমেষে তারা সেই আগন্তুককে ভস্মীভূত করে ফেলবে। বিশ্বাস হচ্ছে না? না হওয়ারই কথা। তবে এর পরেরটা জানলে কি বলবেন? যদি তারা যথেষ্ট আগে থেকে সেই আগন্তুকের সম্পর্কে জানতে পারে তখন তারা নিজেদের গ্রহটাকেই তার রাস্তা থেকে সাময়িক ভাবে সরিয়ে নিতে পারে! সেই সভ্যতা প্রতিবেশী গ্রহগুলিকেও একইভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। (বড্ড বেশি কল্পনা হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু বৈজ্ঞানিকেরা এইভাবেই চিন্তা করেছেন!) বিজ্ঞানী ডেভিড ক্রিসওয়েলের মতে সেই সভ্যতা তাদের নক্ষত্রের একটা সামান্য অংশ নিয়ন্ত্রিত ভাবে সরিয়ে নিয়ে নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারবে। একে star lifting বলা হয়। ব্ল্যাক হোলকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলেও তার শক্তি এই সভ্যতা ব্যবহার করতে পারবে। ইন্ড্রাস্টিয়াল স্কেলে আ্যন্টিম্যাটার উৎপাদিত করে ব্যপক ভাবে ব্যবহৃত হবে। Type I থেকে Type II পর্যায়ে পৌঁছাতে আনুমানিক 2000 বছরের বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
Type III সভ্যতা --
একে বলা হয় galactic civilization. এরা নিজেদের গ্যালাক্সির শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এই পর্যায়ে আসতে টাইপ II সভ্যতার প্রায় 100,000 বছর লেগে যাবে। এর শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা 10^37 ওয়াট। এদের সভ্যতায় পুরো গ্যালাক্সি জুড়ে Dayson sphere তৈরি হবে। গ্যালাক্সির নানা প্রান্তে অনায়াসে যাতায়াত করা সাধারণ ব্যাপার হয়ে যাবে। এই সভ্যতা গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে তা ব্যবহার করতে পারবে। তারা তাদের ইচ্ছামতো শক্তি উৎপাদনকারী নক্ষত্র সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। বিশাল পরিমাণে ক্ষমতাসম্পন্ন gamma-ray bursts (GRBs) এর শক্তিকে ব্যবহার করতে পারবে। এমনকি কোয়াসারের শক্তিকেও কাজে লাগাতে পারে।
কার্ডাশেভ এর পরবর্তী উন্নত টাইপের সভ্যতার কথা কল্পনা করেননি। তিনি মনে করেছিলেন এর চেয়ে বেশি উন্নত সভ্যতা কষ্টকল্পনার পর্যায়ে চলে যাবে। বর্তমানে কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন এর চেয়েও অনেক বেশি উন্নত সভ্যতা তত্ত্বগতভাবে সম্ভব। যেমন Type IV সভ্যতা হয়তো এই বিশ্বের অধিকাংশটা নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে! সেই সভ্যতা ব্যবহার করবে 10^46 ওয়াট শক্তি। তারা প্রসারণশীল মহাবিশ্বের জানা এবং এখনো পর্যন্ত অজানা শক্তিকে ব্যবহার করবে। Type IV সভ্যতার ব্যাপারে আরও মনে করা হয় যে সেই সভ্যতার বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ থাকবে অত্যাধুনিক রোবট আর সাইবর্গদের হাতে, উন্নত প্রজাতির প্রাণীদের শরীরের বেশিরভাগ জৈবিক অংশ যন্ত্র দিয়ে বদলে ফেলা হবে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং লেখক মিশিও কাকুর মতে সম্ভবত ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি সেই সভ্যতার করায়ত্ত হবে। আর কি কি করতে পারবে তা কল্পনা করা মুশকিল।
Type V !!! হ্যাঁ, এর পরেও আরও উন্নত সভ্যতা থাকতে পারে! তারা আমাদের ভাবনার তুলনায় প্রায় অসীম পরিমানে ক্ষমতাধর। আজকের বৈজ্ঞানিক ধারণার সাহায্যে তা চিন্তার আওতায় মধ্যে পড়বে না। হয়তো তারা একাধিক বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে, তাদের বিজ্ঞানের নতুন নিয়ম নীতি ব্যবহার করতে হবে। তবে সেগুলো বর্তমানে আমাদের কাছে অনেকটাই দূর কল্পনা।
এতোক্ষণ তো গেল উপরের দিকের পর্যায়। নীচের দিকে Type 0 সভ্যতাও রয়েছে। তারা 10^6 ওয়াট শক্তি ব্যবহার করে। এরা গ্রহে প্রাপ্ত জৈব-রাসায়নিক উৎস থেকে শক্তি আহরণ করে যেমন কাঠ, কয়লা এবং ফসিল জ্বালানি। এই সভ্যতার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
এই স্কেলে আমাদের অবস্থান কোথায়? 1973 সালে আমাদের অবস্থান ছিলো 0.7, শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা 10^13 ওয়াট। 2019 সালে এই স্কেলে আমরা রয়েছি 0.73 মাপকাঠিতে। আগামী 100 থেকে 200 বছর পরে হয়তো আমরা Type I সভ্যতায় পদার্পণ করতে পারি। বলা বাহুল্য যে আমরা বিশ্বে এখনো কোনো টাইপের সভ্যতার সন্ধান পাই নি, হয়তো ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে। মানুষ যদি আগামী দিনে নিজেকে ধ্বংস না করে ফেলে অথবা কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে মানবসভ্যতার অবলুপ্তি না হয় তাহলে হয়তো এই স্কেলে মানবসভ্যতা অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। অবশ্য তখন মানুষ বিবর্তনের রাস্তায় চলতে চলতে অন্য প্রজাতিতে পরিণত হয়ে যাবে। সেই যাত্রা ভবিষ্যতের গর্ভে।
লিখাঃ সরোজ নাগ
তথ্য উইকিপিডিয়া সহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত।
সঙ্গের ছবিটি একটি সরল ডায়সন গোলোকের রূপরেখা...