সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জাদুর কাঠিঃ অ্যালগরিদম



আমার মা প্রায়ই বলেন, “ বাবা, আমার ফেসবুক পেজে শুধু রান্নার জিনিস আসে কেন? আর কিছু শিক্ষকতার জিনিস আসে, অন্য জিনিসগুলো কোথায়?”

মায়ের এই প্রশ্নের উত্তর খুব সোজা ,”এর পেছনে কাজ করে এক ভার্চুয়াল জাদু, নাম হলো অ্যালগরিদম”

> ***জিনিসটা আসলে কি?***

অ্যালগরিদম শব্দটির অর্থ সহজ বাংলায় নির্দেশনা। কোনো কাজ সমাধান করার যে ধাপ বা নির্দেশনা সেগুলোই হচ্ছে অ্যালগরিদম।

যদি প্রোগ্রামিং এর ক্ষেত্রে বলা হয়, তবে বলতে হয়, কোনো একটা সমস্যা সমাধানের জন্য লেখা প্রোগ্রামই অ্যালগরিদম। আমাদের জীবনে যেসকল সফটোয়্যার আমরা ব্যবহার করে থাকি , সেগুলো তৈরির পেছনে কাজ করে কিন্তু অনেকগুলো প্রোগ্রাম , আর এই প্রোগ্রামগুলো যেভাবে লেখা বা যে নিয়মে লেখা এই সম্পূর্ণ জিনিসটাকে অ্যালগরিদম বলা যায় । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয় তার আলাদা নাম দেওয়া হয়েছে , যাকে বলে “Social Media Algorithm”। Social Media Algorithm এমনভাবে তৈরি হয়, যাতে কোনো ব্যবহারকারীর ব্যবহারের ধরন, সময়ক্ষেপণ, ইন্টারেকশন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ঐ মিডিয়ায় থাকা কন্টেন্টের তালিকা তৈরি হয়, যেটা ঐ নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীকেই প্রদর্শন করানো হবে। যেমনঃ ধরা যাক, আমি জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আগ্রহী, ফলে আমি নাসার ফেসবুক পেজে মাঝে মঝে ঢু মারি। এর মাধ্যমে ফেসবুকের অ্যালগরিদম বুঝে যায় আমাকে এ বিষয়ে কন্টেন্ট দিলে আমি খুশি হব এবং বেশি ফেসবুক ইউজ করব এসব কন্টেন্ট দেখার জন্য। তাই তাদের অ্যালগরিদমর কারণে আমি আমার নিউজ ফিডে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত ছবি, ভিডিও (সর্বোপরি মিডিয়া) বেশি বেশি পাব। এভাবে প্রত্যেকটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিজের অ্যালগরিদম আছে, যার মাধ্যমে মানুষদের তারা আকর্ষণ করে তাদের মাধ্যম ব্যবহারে।

অ্যালগরিদম খায় নাকি মাথায় দেয়, এসম্পর্কে হয়তো একটু ধারণা পেয়েছেন। অনেকের হয়তো ধারণা অ্যালগরিদম তৈরি হয় ব্যবহারকারী যাতে ঐ প্লাটফর্ম বেশিক্ষণ ব্যবহার করে ,তা নিশ্চিত করার জন্য। ধারণাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ধরনের উপর ভিত্তি করে অ্যালগরিদমগুলো তৈরি হয় ভিন্নভাবে, তাদের কাজও হয় ভিন্ন। যেমনঃ

১। কিছু অ্যালগরিদম তৈরি হয় যাতে করে ব্যবহারকারী প্রতিদিন সেই মাধ্যম ব্যবহার করে।

২। কারো আবার ব্যবহারকারীকে প্রতিদিন দরকার হয় না, তারা এমনভাবে তৈরি করে যাতে ব্যবহারকারী যতক্ষণই থাকে না কেন, তাদের কন্টেন্টের সাথে যাতে সে সংযুক্ত হয়ে থাকে । ফলে ব্যবহারকারী এরপরে ২ দিন সেই সাইটে না গেলেও ঐ কন্টেন্ট তার বয়সী বা তার বন্ধুদের দেখানো হবে, এতে তাদের Engagement বাড়বে।

এছাড়াও আরো অনেক উদ্দেশ্যে বিভিন্নভাবে অ্যালগরিদম তৈরি হয়।

> ***কাজ করে সে কীভাবে?***

চলো এবার দেখা যাক অ্যালগরিদমগুলো এই কাজ করে কীভাবে। (তোমাকেই ব্যবহারকারী ধরে নিলাম কিছুক্ষণের জন্য)

কোনো সাইটের অ্যালগরিদম কাজ করার জন্য প্রথমেই যা দরকার সেটা হলো ডাটা। এই ডাটা তারা সংগ্রহ করে ব্যবহারকারী থেকে। যেমনঃ তুমি কি লাইক করছ, কোথায় ডিসলাইক দিচ্ছ, কোন ধরনের কন্টেন্টে সময় বেশি দিচ্ছ, কোথায় তোমার ইনগেজমেন্ট এমনকি তোমার বয়স, কোথায় বসবাস কর এরকম অনেক ডাটা তারা সংগ্রহ করে। এই ডাটাগুলো নিয়ে তোমার জন্য তারা কন্টেন্টের লিস্ট তৈরি করে। একে বলা হয় “কন্টেন্ট র‍্যাংকিং”। আর যে ডাটাগুলোর ভিত্তিতে এই র‍্যাংকিং তৈরি হয় , সেগুলোকে বলে “র‍্যাংকিং সিগন্যাল”। বুঝতেই পারছ, র‍্যাংকিং বানাতে সিগন্যাল বা দিকনির্দেশনা দেয় ডাটাগুলো, তাই র‍্যাংকিং সিগন্যাল বলা হয়।

কোনো সাইটের অ্যালগরিদম এবং র‍্যাংকিং সিগন্যাল গুলোকে গোপন রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা সাইটগুলো করে থাকে। কেননা তা জেনে গেলে সকল মানুষ ঐ র‍্যাংকিং সিগন্যালগুলোকে টার্গেট করে কন্টেন্ট বানাবে। ফলে একপেশে সাইটে পরিণত হবে।

এজন্য দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তাদের র‍্যাংকিং সিগন্যালগুলো পরিবর্তন করে, অনেক সময় অ্যালগরিদমরই বড় পরিবর্তন করা হয় যাতে করে ব্যবহারকারীরা একটু ভিন্ন স্বাদ পায়।

চল দেখা যাক কিছু পরিচিত র‍্যাংকিং সিগন্যাল যা আমাদের পরিচিত সাইটগুলো ব্যবহার করে থাকে বলে অনেক্টুকু নিশ্চিত হওয়া যায়।

***ফেসবুকঃ***

***Interactivity:* **তুমি যদি তোমার কোনো বন্ধু বা কোনো সেলিব্রেটির পোস্টের সাথে ইন্টারেক্ট কর, তবে দেখা যাবে অ্যালগরিদমতোমাকে সেই বন্ধু বা ব্যক্তিত্বের পোস্ট বেশি রিকমেন্ড করবে। অন্যদিকে যাদের পোস্টের তুমি ইন্টারেক্ট করবে না মানে লাইক ,কিমেন্ট, শেয়ার এসব করবে না, তাদের পোস্ট বা কন্টেন্ট তোমাকে তুলনামূলক কম দেখানো হবে।

***Interest:*** ধর, তোমার কোনো বিষয় খুব পছন্দের, যেমন হতে পারে ক্রিকেট। তাই তোমার সার্চ, লাইক, কমেন্ট, শেয়ার এসব সিগন্যালের মাধ্যমের ফেসবুকের অ্যালগরিদমতোমার Interest বুঝে যাবে। তাই তোমাকে ক্রিকেট নিয়ে বেশি বেশি কন্টেন্ট দেখাবে। অন্যদিকে যদি তুমি গলফ তেমন একটা পছন্দ না কর, তাহলে তোমাকে অ্যালগরিদম সেগুলো শো করবে না। এই পছন্দ না করা ফেসবুক জানবে অ্যালগরিদম আর ডাটা তথা র‍্যাংকিং সিগন্যাল গুলোর মাধ্যমে।

***Impression:*** দেখা যায় কি , কোনো পোস্ট না কন্টেন্ট পুরো দেশে সারা ফেলেছে। সারা দেশের মানুষই এনগেজ হচ্ছে কন্টেন্টটির সাথে। যাকে আমরা বলি ভাইরাল হওয়া। এরকম ভাইরাল হওয়া জিনিসকে ফেসবুকের অ্যালগরিদম তোমাকে শো করে।

***Content quality:*** পোস্ট বা কন্টেন্টগুলো সত্য কিনা, সময়োপযোগী কিনা এসব জানতে ব্যবহারকারীদের থেকে তথ্য জানতে চাওয়া হয়। এসবের উপর ভিত্তি করে পজিটিভ রিভিউ পাওয়া কন্টেন্টকে ফেসবুক অ্যালগরিদম প্রমোট করে। অন্যদিকে নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়া কন্টেন্টকে ফেসবুক অ্যালগরিদম কম প্রচার করে।

***YouTube:***

ইউটিউব কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও সার্চ ইঞ্জিন হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে এটি বিশ্বের ২য় জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন। এর কিছু র‍্যাংকিং সিগন্যাল হলোঃ

***Performance:*** কোনো ভিডিওর পার্ফরমেন্স কেমন সেটা কিছু বিষয়ের মাধ্যমে ইউটিউব অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে।

* Average View Duration*

* Likes and Dislikes*

* Viewer Surveys etc.*

***Personalization:*** ব্যবহারকারী কোন ধরনের ভিডিওতে বেশি সময় দিচ্ছে, কোন টপিকে ভিডিও বেশি দেখছে এসবের উপর ভিত্তি করে ভিডিওর র‍্যাংকিং তৈরি করে।

***Search Activity:*** ইউটিউব যেসকল জিনিসগুলো ব্যবহারকারী সার্চ করে, সেসকল জিনিস সংশ্লিষ্ট ভিডিও ব্যবহারকারীকে প্রদর্শন করে।


***Pinterest:***

পিন্টারেস্ট আবার প্রথমেই কিছুটা ডাটা নিয়ে নেয়। কেউ যখন একাউন্ট খুলে তখন জেনে নেয় ঐ ব্যবহারকারীর প্রিয় টপিকগুলো কি কি। যেমন হতে পারে গাড়ি, হোম ডেকোরেশন, বা এস্ট্রোনমি এরকম বিভিন্ন টপিক। তখন পিন্টারেস্টের অ্যালগরিদম এসকল পছন্দ করা বিষয়ের উপর ছবি দেখায় ঐ ব্যবহারকারীকে।

এছাড়াও আরো যেসকল র‍্যাংকিং সিগন্যাল এর অ্যালগরিদম ব্যবহার করে থাকে তারা হলোঃ

*ইমেজ কোয়ালিটি*

* পিন (পোস্ট করা ছবি) ব্যবহার করা কি ওয়ার্ড (এর মাধ্যমে অ্যালগরিদম ঐ পিনকে র‍্যাংক করানোর জন্য সহজে খুজে পায়)*

ইত্যাদি


***Twitter: ***

টুইটারের কিছু পরিচিত র‍্যাংকিং সিগন্যাল হলোঃ

***User Interactions:*** টুইটারের নিজেদের হেল্প পেইজেই এ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া আছে। বলা হয়েছে “we choose them(tweets to show) based on accounts you interact with frequently, Tweets you engage with, and much more..”। অর্থাৎ যেসকল একাউন্টের টুইটে ব্যবহারকারী এঙ্গেজ হয়, সেসকল একাউন্টের টুইট বেশি করে প্রদর্শন করার জন্য তাদের অ্যালগরিদম চয়েজ করবে।

***Current popularity:*   পপুলার টুইট বা কন্টেন্ট যেগুলো ব্যবহারকারীর ভৌগোলিক এলাকায় জনপ্রিয় সেগুলোকে টুইটারের অ্যালগরিদম শনাক্ত করে এবং ব্যবহারকারীকে প্রদর্শন করে।**


> ***অ্যালগরিদেমর ভালো মন্দ***

**অ্যালগরিদেমর ভালো কিছু দিক হলোঃ**

* ব্যবহারকারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পছন্দের জিনিস দেখতে পায়, তাই আনন্দের খোরাক যোগায় এবং ব্যবহারকারীর মনে প্রশান্তি যোগায়।*

* অ্যালগরিদম ব্যবহারের পেছনে বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবসা করা। এতে ব্যবহারকারী সময় দেয়, এড দেখে, প্রমোশনে এঙ্গেজমেন্ট দেখায়, তাই অ্যালগরিদমর মাধ্যমের আয়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।*

* ব্যবহারকারী সহজেই তার দরকারি জিনিস খুজে পায়, যাতে করে সময় বেচে যায়*

* অনেক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যালগরিদম এমনভাবে তৈরি যাতে করে সাহায্যপ্রার্থী মানুষ সহজেই সাহায্য পায়, যেমনঃ ব্লাড ডোনেশন, ইমার্জেন্সি হেল্প ইত্যাদি*

* কোনো কন্টেন্ট ক্রিয়েটর একটি নির্দিষ্ট বয়সের বা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য কন্টেন্ট বানালে অ্যালগরিদম ঠিক তাদের কাছেই সেই কন্টেন্ট পৌছে দেয়, এর ফলে ব্যবহারকারীর কাছেও যেমন কন্টেন্ট প্রাসঙ্গিক লাগে, তেমনি কন্টেন্ট ক্রিয়েটরও টার্গেট অডীয়েন্স খুজে পায় সহজে।*


আবার কিছু ***নেতিবাচক দিক***ও অ্যালগরিদমর আছে। কিছু হলোঃ

***· Echo Chamber:*** এর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি তার থেকে ভিন্নমতের বা ভিন্ন চিন্তাধারার মানুষের কন্টেন্ট দেখে না। এর ফলে ব্যবহারকারীর নিজের ধারণা বা চিন্তাধারাই তার কাছে ঠিক মনে হতে থাকে। যা অনেকসময় মারাত্মক ;সামাজিক ব্যাধির জন্ম দেয়।

***· Addiction:* **বেশিরভাগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যালগরিদম এমনভাবে তৈরি যাতে ব্যবহারকারী তাতে বেশি সময় দেয়, এতে করে আসক্তির জন্ম হতে পারে, যাতে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভুগছে।

***· Controversy:*** বিতর্কিত বিষয়ের জিনিসে মানুষের এনগেজমেন্ট বেশি থাকে, যাতে করে অ্যালগরিদম সেগুলোকে প্রমোট করে। এতে করে বিতর্কিত বিষয় আরো বিতর্কিত হয় এবং মানুষ এর মাঝে ও সমাজে অস্থিরতা তৈরি হয়। ২০২১ সালে ফেসবুককে বিচারের সম্মুখীন হতে হয় , বিতর্কিত বিষয় প্রমোট করে এমন অ্যালগরিদম তৈরির জন্য।

> ***শেষ কথা***

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সাফল্যের পেছনে যে জাদুর কাঠিটি রয়েছে, সেটা হলো তাদের অ্যালগরিদম। এই অ্যালগরিদমর মাধ্যমে ব্যবহারকারী আনন্দদায়ক প্লাটফর্ম পায়, সামাজিক মাধ্যমগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ব্যবসার মাধ্য হয়ে ওঠে টেক জায়ান্টে। আর তাদের অ্যালগরিদম কিভাবে কাজ করে তা গোপন রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করে আর একইসাথে অ্যালগরিদম নির্দিষ্ট ব্যবধানে পরিবর্তন করে। তাই কিভাবে কাজ করে তা জানা গেলেও খুব নিখুতভাবে জানা সম্ভব নয়। আশা করি এই লেখার মাধ্যমে কিছুটা হলেও অ্যালগরিদমর ধারণা দিতে পেরেছি।

Writer: Md Newaz

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম