সে ছিল অতি সাধারণ পরিবারের এক চমৎকার সুন্দরী তরুণী। তার ছিল কত আশা, কত আকাঙ্ক্ষা। পরিচিত হবার, প্রশংসা পাওয়ার লোভ যেন তার অস্থিমজ্জায় জড়িত। কিন্তু এসব পাওয়ার কোন উপায়ই ছিল না তার। স্বপ্ন জয়ের পথে পা দেবার আগেই পাড়ার বখাটে ছেলেদের চোখ পড়ে তার উপর। দারিদ্র্য পিতা উপায় না পেয়ে মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্রের সন্ধানে নেমে পড়েন। যার তার হাতে তো তার আদরের একমাত্র ছোট্ট মেয়েটি কে তুলে দেওয়া যায় না। কিন্তু বাঁধ সাধল অন্য জায়গায়। বিয়ের বাজারে যৌতুক বিহীন উপযুক্ত পাত্র পাওয়াই যেন দুষ্কর। কিন্তু আল্লাহর অশেষ কৃপায় দারিদ্র্য পিতা তার আদরের মেয়ের জন্য সঠিক পাত্রের সন্ধান পেয়েই গেলেন।
তার সকল আশা আনন্দ পরিচিতি ও প্রশংসা পাওয়ার কোন ধনী মর্ডান ছেলেকে বিয়ে করার স্বপ্ন যেন এখানেই ভাটা পড়ল। তাই স্কুলের সামান্য শিক্ষক হুজুর টাইপ ছেলেটির সাথে বিয়ে সে স্বীকার করে নিয়েছিল। তবুও প্রায়ই তার মনে সর্বদা বেদনা ভরা দুঃখ আর বেপরোয়া সব স্বপ্ন জেগে উঠত। সে ভাবত ফেলে আসা তার স্বপ্নগুলো নিয়ে। এসএসসি পরীক্ষার পর ভালো একটা কলেজে ভর্তি হবে। সেখানে মেয়ে বন্ধুদের পাশাপাশি থাকবে তার অনেক ছেলে বন্ধুও। তাদের সাথে গল্প আড্ডায় কেটে যাবে তার দিন। তার সদ্য জেগে ওঠা ছোট্ট কিশোর মনে যে আরো কত স্বপ্ন উঁকি দিত হয়তো তার হিসাব মিলবে না। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, দশম শ্রেণীতে পা রাখতে না রাখতেই তাকে বসতে হলো বিয়ের পিঁড়িতে।
তার স্বামী নামের পুরুষটি ছিল বেশ চটপটে, বুদ্ধিমান আর মিশুক প্রকৃতির লোক। সে যেমন নম্র-ভদ্র, মানবিকতা সম্পন্ন তেমনি বেশ ধার্মিক আর দ্বীনদার এক পুরুষ। মায়ের পছন্দেই মেহজাবিন নামের মেয়েটিকে তার বিয়ে করা। স্বাভাবিক ভাবে তারও চাওয়া ছিল দ্বীনদার ধার্মিক কোনো নারীই হবে তার একমাত্র জীবনসঙ্গীনী। কিন্তু মায়ের যুক্তির কাছে সে পরাজিত। তাছাড়া ইস্তিগফারে পজেটিভ ফল আসায় বিয়েতে সে আর অমত করেনি। হেদায়াতের মালিক আল্লাহ। বিয়ের পর না হয় মেয়েটিকে সে নিজের মতো করে গড়ে তুলার চেষ্টা করবে। আল্লাহ চানতো এই মেয়েটিই হয়তো হয়ে উঠবে তার মনের মতো বউ!
আজ তার বিয়ের প্রথম রাত। দরজাতে কয়েকবার টুকা দিয়ে সাড়া না পেয়ে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে সে, তারপর ছিটকিনিটা আটকে দেয়। খানিকপর এগিয়ে এসে গলা ঝেড়ে মেহজাবিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-আসসালামু আলাইকুম...।
মেহজাবিন বিরক্ত দুঃখ হতাশা ও নৈরাশ্যে কাঁদতে কাঁদতে একদম নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। সেই যে কতগুলো মেয়ে তাকে কনের সাজে এখানে বসিয়ে গেছে, এরপর কতটা সময় চলে গেছে তা সে বলতেই পারবে না। ফেলে আসা স্বপ্নগুলোকে হাতড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার ধরূন আশপাশের সবকিছু ভুলে সে প্রায় অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ অপরিচিত গলার আওয়াজে তার ধ্যান ভাঙল। চট করে মুখ তুলে সামনে তাকাতেই হাসিমাখা একখান মুখ দেখতে পেল।
-আ... আ.. আপনি ক..কে আপনি?
মেহরাব এই প্রথম স্বচক্ষে মেহজাবিনকে দেখল। মেহজাবিন কে এক পলক দেখেই মন থেকে মাশাআল্লাহ বলে উঠল মেহরাব!
-সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব জানো নিশ্চয়!
-জ.... জ্বি ওয়া...লাইকুমুস সালাম...
-ওহম.. জ্বি আমি মেহরাব। এবার নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছ।
মেহজাবিন কোন উত্তর করল না।
মেহরাব বেশ কিছুক্ষণ ওকে পরখ করল। ও যে খুব নার্ভাস ফিল করছে সে বুঝাই যাচ্ছে। কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। চোখের কোণে এখনও পানি টলমল করছে। সে এগিয়ে এসে মেহজাবিনের মাথায় হাত রেখে কিছু একটা বিড়বিড় করে পড়ে।
আঁতকে উঠে মেহজাবিন!
তা দেখে মেহরাব বলে,
-ভয় নেই....। আমায় তুমি বন্ধু ভাবতে পারো। নাও ওয়াড্রবের দ্বিতীয় ড্রয়ারে তোমার প্রয়োজনীয় সব জিনিস রাখা আছে। ভালো একটা কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নাও। এই নাও চাবি। মা-ই এটা তালা দিয়ে রেখেছেন। বলতে বলতে মেহরাব মেহজাবিন এর হাতে চাবিটা ধরিয়ে দেয়।
আর শুনো, ওয়াড্রবের ডান পাশে তোমার মোহরানার টাকাটা রাখা আছে। পরে তোমার সুবিধামতো রেখে দিও।
আজ পর্যন্ত বাবার কোন কথারই অবাধ্য হয়নি মেহজাবিন। এখানে আসার আগেও বাবা কিছু কথা বলেছিলেন তাকে। কথাগুলো বলার সময় সে তার বাবার মুখে দেখেছিল তৃপ্তির হাসি আর চোখে আনন্দের অশ্রু। বাবার বক্তব্য ছিল এরকম-
-মারে, তুই আমার সবচেয়ে আদরের মেয়ে, হৃদয়ের টুকরো! আল্লাহ তোকে সহীহ বুঝ দান করুন এই দোয়াই করি। এতো দিন তুই তোর বাবার স্নেহ-মমতার সুকোমল ছায়ায় বড় হয়েছিস। তোদের সুখ শান্তিই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের অভাব তোদের কখনো বুঝতে দেইনি। তোদের শিক্ষা দীক্ষা, চারিত্রিক সংশোধন ও উন্নতির একমাত্র জিম্মাদার ও দায়ী ছিলাম আমি, তোদের বাবা। আজ থেকে তুমি একটা নতুন সংসারে পা দিচ্ছো, সেখানে তোমার যাবতীয় স্বভাব চরিত্র চাল চলন আচার ব্যবহারের জন্য একমাত্র তুমিই দায়ী মা...। আজ আমি তুমায় কিছু কথা বলব। এগুলোকে তুমি আদেশ বা উপদেশ যা ইচ্ছা মনে করতে পারো। আমি আশা করি আমার মেয়ে এই কথাগুলো মেনে চলবে ইনশাআল্লাহ....
-ওহম ,,,ওহম,,,
মেহরাবের হাঁচির শব্দে ভাবনার জগতে ভাটা পড়লো তার। নাহ সে তার বাবার সব কথা মেনে চলবে। বাবার মুখে সে সবসময় অমন হাসিই দেখতে চায়। আজ থেকে সে তার স্বামীর আদর্শ বউ হওয়ার চেষ্টা করবে ইনশাআল্লাহ..।এর জন্য যা যা করা লাগে সবি সে করবে। সে তাকিয়ে দেখলো মেহরাব সোফায় হেলান দিয়ে একটা বই উল্টেপাল্টে দেখছে।
-জ্বি,,, হয়ে গেছে....! ফ্রেশ হয়ে মেহরাবের সামনে দাঁড়িয়ে কথাটি বলল সে।
মেহরাব বই থেকে মুখ তুলতে তুলতে বলল,
-কি হয়ে গেছে?
মেহজাবিনকে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বইটা সোফায় রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর বলল,
-তুমি আমার নামাজের সঙ্গী হবে। চলো দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি, তিনি মে আমাদের দুজনকে বৈধভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন। বলে মেহরাব হাতটা বাড়িয়ে দিল ওর দিকে।
এরপর নামাজ পড়ে মহান রবের কাছে ওদের নতুন জীবনের জন্য দোয়া করল।
মেহরাব এগিয়ে গেল ওয়াড্রবেরর দিকে। একটু পর দুটি প্যাক হাতে ফিরে এলো। হাত বাড়িয়ে একটি প্যাক মেহজাবিনকে দিয়ে অন্যটি বুকের সাথে আগলে রেখে, বলল,
-প্যাকটা খুলো মেহের......
মেহজাবিন চমকে উঠে বলে,
-আ.. আমার নাম মেহজাবিন, মেহের নয়!
-আমি জানি তোমার নাম মেহজাবিন। কিন্তু আমি তোমায় মেহের বলে ডাকব। এতো ফজিলতপূর্ণ আর খুব সহজ সুন্নাতটাকি ছেড়ে দেয়া যায়। মা আয়েশা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদর করে হুমায়রা বলে ডাকতেন জানো তো....?
মেহের চুপচাপ প্যকটি খুলতে লাগল,,
-এ..এটা....
-হ্যাঁ এটা জায়নামাজ বোরকা আর হিজাব। এগুলো বাসর রাতে তোমার স্বামীর দেওয়া প্রথম উপহার। কি গ্ৰহণ করবে না?
মেহের ওগুলোকে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল, ওর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল গুমোট বাঁধা কষ্টে। আজ থেকে সে বন্দিনী। তাকে কোথাও বেরুতে হলে খালাম্মা সেজে বেরুতে হবে। বহু কষ্টে চোখের পানি ধরে রেখেছিল সে।
মেহরাব অন্য প্যাকটি বাড়িয়ে ধরে বলে,
-এতে কি আছে জানো?
-......
-এতে আছে পবিত্র কোরআন শরীফ। তুমি কোরআন পড়তে পারো?
-জ্বী,,,পারি কিন্তু...….
-আলহামদুলিল্লাহ.. আজ থেকে আমরা দুজনে মিলে পবিত্র কোরআন শরীফ সহীহ শুদ্ধভাবে পড়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ....।
-জ্বি ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করব..।
মেহরাব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-মেহের তোমার বয়সটা খুব অল্প। আচ্ছা তুমি এবার কোন ক্লাসে পড়তে?
মেহেরের চোখের পানি যেন আর বাঁধ মানতে নারাজ। হেঁচকি দিয়ে কান্না চলে এলো। ভেতরটা যেন ফেটে যাচ্ছিল তার। কোনমতে বলল,
-কে..ক্লাস টেনে..
মেহরাব বলল,
-জানি তোমার চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল। থাকারই কথা, এই বয়সটাইতো রঙিন। আমি আজ তোমার সব কথা শুনব, যদি তুমি বলো! আর আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব তোমার সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত করার। তার আগে লক্ষি মেয়ের মতো কান্নাটা বন্ধ করো প্লিজ..। যাও চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে এসো–আর আমি এই ফাঁকে দু'কাপ কফি করে নিয়ে আসি কেমন...!
এভাবে একে অন্যের সুখ দুঃখের কথা শুনতে শুনতে চলে গেল সেই রাত।
আজ তাদের বিয়ের তিনমাস পূর্ণ হলো। মেহজাবিন স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে মেহরাবের জন্য কফি বানাতে গেল!
হ্যাঁ সেদিন মেহরাব তাকে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। তবে শর্ত ছিল ধর্মীয় নির্দেশগুলো তাকে যথাযথ ভাবে পালন করতে হবে। মেহের এখন পূর্ণ পর্দা করেই স্কুলে যায়। লেখাপড়া, নামাজ, নিয়মিত দুজন মিলে কোরআন তেলাওয়াত, সংসারের টুকিটাকি কাজ, শ্বাশুড়ির সেবাযত্ন, শ্বাশুড়ি আর মেহরাবের সান্নিধ্যে ভালোই কাটছে মেহজাবিনের দিন। এখন মেহেরের নিজের কাছে নিজেকে খুব সুভাগ্যবতী মনে হয়, যে তার মতো একটি মেয়ে মেহরাবের মতো খাঁটি দ্বীনদার পুরুষের স্ত্রী হতে পেরেছে।পরশপাথরের ছোঁয়ায় যেমন লোহা সোনা হয়। তেমনি মেহরাবের ছোঁয়ায় সে যেন সঠিক পথের ঠিকানা পেল। ইসলামের ছায়াতলে যে এতো শান্তি তা সে এ বাড়িতে আসার আগে কখনো উপলব্ধি করেনি। এখনকার মনের অবস্থা সে যেন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। সে এখন সহীহ শুদ্ধ ভাবে কোরআন শরীফ পড়তে পারে। নিয়মিত শ্বাশুড়ির সাথে নামাজ আদায় করে। তার মনের খুশির খুড়াকটা যেন সে পেয়ে গেছে। এখন পুরো বাড়িটা সে মাতিয়ে রাখে। এ যেন তার ছোট্ট সংসার।মেহেরের বাবাও ভীষণণ খুশি মেয়ের এমন পরিবর্তনে।
-আসসালামু আলাইকুম..... আপনার কফি..
বলে কফির কাপটা বাড়িয়ে ধরল মেহের।
কফিটা নিতে নিতে মেহরাব জবাব দিল,
-ওয়ালাইকুমুস সালাম...। জাযাকিল্লাহু খাইরান..
-ওয়া আংতুম ফা জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।
-বাহ তোমার তো বেশ উন্নতি হয়েছে দেখছি। আলহামদুলিল্লাহ.. মুচকি হেসে বলল মেহরাব।
মেহজাবিন লজ্জাবনত মুখটা নিচু করল। তাকে মাথা নিচু করে নিজের হাত মুচড়াতে দেখে মেহরাব প্রশ্ন করল,
-কি, কিছু বলবে?
-হুম! চটপট জবাব মেহেরের।
-দাড়িয়ে না থেকে এখানটায় বসো...এবার বলো কি বলবে!
-না মানে...আ....আমি
- না মানে, আ...আমি, আমি হা..হাফেজা হতে চাই। আমি কোরআন শরীফ মুখস্থ খতম করব। আ.. আপনি আমায় হেল্প করবেন?
মেহরাবের মুখ থেকে অটো বেরিয়ে এলো, আলহামদুলিল্লাহ। সবসময় আল্লাহর কাছে সে মেহেরের হেদায়েতর দোয়াই করেছে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি যে এতোটা পরিবর্তন হবে সে তা স্বপ্নেও ভাবেনি। নিজেকে সামলে মেহরাব কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে বলল,
-অবশ্যই, আমারও অনেক দিনের শখ এটা, কিন্তু..বাদ দাও। আজ থেকে আমরা দুজনে একসাথে কোরআন কে জানব, বুকে ধারণ করব ইনশাআল্লাহ।
-ইনশাআল্লাহ, তাহলে আজ থেকে স্টাডি শুরু করা যাক। মেহরাবকে লাফ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল মেহের।
মেহরাব ওর কপালে আলতো চুমু দিয়ে বলে,
-হুম...।
দেখতে দেখতে চলে গেছে প্রায় দুটি বছর। এর মধ্যে মেহেরের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। রেজাল্ট ভালোই হলো। মেহরাব তাকে কলেজে ভর্তি করাতে চাইলে সে অমত করল। ওসবে নাকি তার আর আগ্ৰহ নেই। এখন সে মা আয়েশা, খাদিজা, ফাতেমা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু এর জীবনের মতো নিজের জীবনকেও রাঙাতে চায়। এ কয়দিনে ওনাদের জীবনী সে পড়েছে আর ভেবেছে ইশ..আরো আগে যদি সে ইসলামের স্বাদটা পেতো। মেহরাবকে না পেলে হয়তো এখনো সে ঐ অন্ধকারেই ডুবে থাকত। মেহরাবই তাকে বইগুলো গিফট করেছিল। বিয়ের একসপ্তাহ পর একদিন সে অনেকগুলো বই নিয়ে বাড়ি ফিরল। মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-অবসরে বইগুলো পড়ে দেখতে পারো। আশা করি ভালো লাগবে,আর অনেক কিছু শিখতেও পারবে ইনশাআল্লাহ।
মেহের সেদিন অনেক খুশি হয়েছিল, ভেবেছিল তার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বা অন্য কোন লেখকের গল্প-উপন্যাসের বই হবে হয়ত। কিন্তু যখন দেখল সবগুলোই ইসলামী বই, তখন ওর মনটা বেশ খারাপ হলো! তবে মন খারাপটা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। যখন সে বইগুলো পড়তে শুরু করল তখন তার মনে এক অপার্থিব ভালো লাগা জন্ম নিল। এরপর প্রতি সপ্তাহেই মেহরাব ওকে নতুন নতুন ইসলামী বই এনে দিতো। আর মেহের খুশি মনে তা গ্ৰহন করতো। মেহরাব নামের মানুষটা যেন তার জীবনের মুড় ঘুরিয়ে দিল।
মেহের আজ খুব খুশি। সে তার শ্বশুরির রুমে এসে তাঁকে সালাম করে জড়িয়ে ধরল। তিনি মেহেরকে খুশি দেখে বলেন,
- কি ব্যাপার কি অইছে আমার পাগলিডার, এতো খুশি খুশি লাগতাছে?
-মেহের তাকে জড়িয়ে ধরেই বলে, মা জানেন আপনার ছেলে আজকে পূর্ণ হাফেজ হয়ে গেছেন। বলে সে মায়ের অনুভূতি দেখার জন্য তার দিকে তাকাল।
সালামা বেগম তার একমাত্র ছেলের বউয়ের মুখে এমন বোকা মার্কা কথা শুনে চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। তারপর কিছু কাগজ হাতে ফিরে এলেন। ওগুলো মেহেরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন,
-মামনি আমার পুলা আইজ থাইকা কুঁড়ি বৎসর আগে ওর জহন সাত বৎসর বয়স তহন পূর্ণ হাফেজ অইয়া পাগড়ি পাইছিল। এই তার সনদপত্রর।
মেহের শ্বাশুড়ির কথা শুনে থ মেরে গেল!
মেহরাব সেই কখন থেকে খাতা দেখে যাচ্ছে। প্রায় তিন ঘন্টা হয়ে এলো। সেই যে এশার নামাজ থেকে ফিরে রাতের খাবার সেরে এক্সামের খাতা দেখতে বসেছে এখনো ওঠার কোনো নাম নেই।
মেহরাব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় বারোটা বেজে গেছে। নাহ আর কাজ নেই, কাল ছুটির দিন কাল নাহয় বাকি খাতা দেখা যাবে। মেহরাব উঠে পড়ল।সামনে তাকাতেই দেখে মেহের এখনো বসে আছে,
-আরে তুমি এখনো বসে আছো কেন, ঘুমাওনি?
-ঘুম আসছে না..
-বললেই হলো, বেশি রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে, যাও ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে।
-আপনার বুঝি করবে না?
-....আরে বোকা আমি আর তুমি এক হলাম নাকি।আমাকে মাঝে মাঝে রাত জেগে এমন টুকিটাকি কাজ করতে হয়। এতে কিছু হবে না।
-আমারও কিছু হবে না। আপনিইতো বলেন, স্বামী আর স্ত্রীর সম্পর্ক হাত আর চোখের মতো...
মেহরাব চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। একটু পর তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো।
-আপনি আমায় বলেননি কেন?
-কি বলিনি? বোকার মতো তাকিয়ে আছে মেহরাব।
-এই যে আপনি সাত বছর বয়সে কোরআন মুখস্ত খতম করেছেন।
-ওহ তাহলে এই কথা, এই কারণেই বুঝি মন খারাপ হ্যাঁ.. বলিনি তো কি হয়েছে, এখন তো জানলে।
-এখন জানা আর তখন জানা কি এক হলো? গাল ফুলিয়ে বলল মেহের।
মেহরাব ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
-মেহের তুমি খুব রূপবতী একটা মেয়ে তা কি তুমি জানো?
-এটা নতুন কি সবাই বলে!
-আমি কি বলেছি কখনো?
-এটাই তো দুঃখ...
-আজ বলছি সত্যিই তুমি রূপবতী, সুস্নিগ্ধা, গুণবতী, অসাধারণ একটি মেয়ে
মেহের চোখ মুছে বলে,
- আর আপনি?
-আমি সেই অসাধারণ মেয়েটির স্বামী। কপালে আলতো চুমু দিয়ে।
-নাহ, আপনি আমার আদর্শ স্বামী। বলে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল মেহের।
-তাই..
-হুম, মুখ তুলে চোখ মুছে বলে মেহের।
-আচ্ছা আপনি আমায় এতো ভালোবাসেন কেন?
-ভালোবাসতে পারলাম আর কোথায়। আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ, পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা আমি থাকে উজাড় করে দিতে চাই। কিন্তু বউটা আমায় সেই সুযোগটাই দিতে চায় না। মন খারাপের ভঙ্গিতে বলল মেহরাব।
-সুযোগ দিতে হবে কেনো? সুযোগ আদায় করে নিতে হয় জানেন...
বলেই নিজের জিভ কাটল মেহের, কি বলতে কি বলে ফেলল সে, এখন কি হবে!
-তাইতো.... আমি কি বোকা না, এই সহজ কথাটা আমার মাথায় এতো দিন এলো না কেন! যাক আজ তো এসেছে। আজ কিন্তু আমি আমার ভালোবাসা আদায় করে নেব কি বলো... মুচকি হেসে বলল মেহরাব।
মেহের লজ্জায় ওর বুকে মুখ লুকাল। শুরু হলো ভালোবাসার নতুন এক অধ্যায়। পবিত্র ভালবাসার সৌরভের ভরে উঠল মেহরাব-মেহজাবিনের ঘর।
সকাল দশটা। এক্সামের কিছু খাতা বাকি ছিল।এগুলোই দেখতে বসেছে মেহরাব। অল্প হওয়ায় আধঘন্টায় খাতাগুলো দেখা কমপ্লিট হয়ে যায় তার।ওর দু’চোখ এখন মেহেরকে খুঁজছে। সেই সকাল থেকেই লক্ষ্য করছে মেহের ওর চোখ ফাঁকি দিয়ে চলার চেষ্টা করছে, 'বাহ বউটা দেখছি ভীষণ লজ্জাবতী, মাথা চাপড়ে মুচকি হাসে মেহরাব?
-মামনি যাও তো মেহেরাবরে একটু আমার কাছে আওনের লাইগা কও। তুমিও আসবা।
এতক্ষণ ও মেহরাবের চোখ এড়িয়ে চলছিল। কিন্তু এখন তো না গিয়ে উপায় নেই। মেহরাবকে ডাকতে মাথা নিচু করে ঘরে প্রবেশ করল সে,
-আপনাকে মা ডাকছেন..
-যাক বাবা... রাণী লজ্জাবতী লতার দেখা পেলাম তবে।তা কি ব্যাপার আমায় ইগনোর করা হচ্ছে নাকি।
-কি যা তা বলছেন, ই...ইগনোর করব কেন। কাজ ছিলো ত..তাই।
-বাহ, এখন কিন্তু তোমার ওসব চালাকি চলবে না।
-চা.. চালাকি
-হুম চালাকি..কারণ ভালোবাসা কিভাবে আদায় করে নিতে হয় তুমি তা আমায় শিখিয়ে দিয়েছ..
মুচকি হেসে চোখ টিপ্পনী দিয়ে বলল মেহরাব।
-ম..মা অ..
ম..মা অপেক্ষা করছেন, আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। বলতে বলতে মেহের উধাও।
সালমা বেগম পান চিবুতে চিবুতে বলেন,
-হুন বাপ, আমার একবার দেশে যাওন লাগব। জমি লইয়া কি যানি ভেজাল হইছে। আর তোর ফুপ্পিও বেশ কিছুদিন ধইরা অসুস্থ। সামনের শুক্রবার যাওনের ব্যাবস্থা কর। ইস্কুল থাইকা কয়দিনের ছুটি নে।
মেহরাব মায়ের কথা শুনে বলে,
-মা, এখন তো ছুটি নেয়া যাবে না। আচ্ছা শুক্রবার তো এমনিতেই ছুটি। আমি নাহয় তোমায় পৌঁছে দেব।
-কছ কি আমি কি আমার যাওনের লাইগা কছছি।তুই সারাডা দিন ইস্কুলে থাকবি। আমার মাডারে ঘরে একলা কেমনে রাইখা যাই ক-তো।
-হুম....আচ্ছা মা ওসব নিয়ে তুমি ভেবো না। আমি নাহয় ইস্কুল থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসব। তাছাড়া জায়গা জমির ব্যাপার কয়দিন লাগে কে জানে।ছাত্রদেরও সামনে এসএসসি এক্সাম। নাহয় ছুটি নেওয়া যেত কিন্তু এ সময় ছুটি নেয়া ঠিক হবে না মা, বুঝতে চেষ্টা করো।
সালমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
-হুম...তাও ঠিক। আচ্ছা জরিনারে রাইখা গেলে কেমন হয়। তুই না আসা পর্যন্ত ও মেহজাবিনের লগে থাকল।
-তা বলতে পারো।
.
আজ মেহেরের শরীর টা ভীষণ খারাপ। বেশ কয়েকবার বমিও করছে। জরিনার বাসায় মেহমান আসবে বলে আজ ও আসেনি। একসপ্তাহ হলো শাশুড়ি দেশে গেছেন। জমির ভেজাল নাকি শেষ হয়েছে। দুদিন পর উনি ফিরবেন।
মেহরাব স্কুল থেকে ফিরে দেখে মেহের শুয়ে আছে। চুপচাপ সে ফ্রেশ হয়ে মেহেরের পাশে বসে অনেক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে!
মেহেরের ঘুম ভেঙ্গে যায়, শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ দুটো লেগে এসেছে টেরই পায়নি সে! মেহরাবকে ওর মাথার পাশে বসে থাকতে দেখে ও উঠে বসে বলে,
-আপনি কখন এলেন?
-এইতো অনেক্ষণ.. কি ব্যাপার এই অসময়ে শুয়ে আছ যে, শরীর খারাপ?
-নাহ, তেমন কিছু না, মাথায় একটু ব্যাথা করছিল আরকি! আপনি বসুন আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি! বলে মেহের উঠে যেতে লাগল।
মেহরাব ওর হাত ধরে টেনে বসালো,
-আরে বসোতো, দেখি এখন ব্যাথা কমেছে?
-হুম এখন একটু ভালো লাগছে।
-কোন কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকো, আমি খাবার নিয়ে আসছি। নিশ্চয়ই তোমারও এখনো খাওয়া হয়নি, বলে মেহরাব ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উঠে গেল আর এক প্লেট খাবার হাত ফিরে এলো,
-নাও হা করো..
-আমার ভালো লাগছে না, এখন খাবো না, আপনি খেয়ে নিন...
-ওহ তাহলে প্রতিদিন এমন করো, না খেয়ে খেয়ে শরীরের কি অবস্থা করেছ সেদিকে খেয়াল আছে! নাও হা করো...নয়তো
মেহরাবের জুড়াজুড়িতে মেহের অনেক কষ্টে দুই লুকমা ভাত গিললেও তৃতীয় লুকমা মুখে দেওয়ার সাথে সাথে যেন ভেতরটা মুচড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে মুখ চেপে ধরে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিল। মেহরাব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, দু'এক মিনিট পর সেও গেল, গিয়ে দেখে মেহের বেসিন আকড়ে ধরে জুড়ে জুড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মেহরাব ভয় পেয়ে দৌড়ে ওর কাছে গেল,
-মেহের কি হয়েছে তোমার। তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেন।
-জা নি না মাথাটা...বলতে বলতে মেহরাবের বুকে মাথা এলিয়ে দেয় মেহের!
.
খুশির খবরটা শুনে সালমা বেগম আর থাকতে পারলেন না। সেদিনই চলে এলেন। এসেই মেহেরকে জড়িয়ে ধরে যেন খুশিতে কেঁদেই দিলেন। মেহরাবের খুশিও যেন আর ধরে না। সে বাবা হবে! এরচেয়ে খুশির খবর আর কি হতে পারে। মেহেরের জীবনটাও যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠল। মাতৃত্বের স্বাদ যে কতো মধুর তা একজন মা ব্যাতীত অন্য কেউ পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে পারবে না সেটা সম্ভবও নয়। সেও মা হবে তারও ফুটফুটে একটা বাবু হবে। এটা ভাবতেই মেহেরের মনে এক অদ্ভুত আনন্দগণ অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছিল। এভাবে হাসি আনন্দের মধ্যেই চলছে তাদের দিন।
মেহরাবের মিষ্টি শাসন আর শাশুড়ির আদর যত্নে কাটছে প্রতিটা দিন। যেন মেহেরকে মাথায় রাখতে পারলেই তাদের শান্তি। এটা করো না ওটা করো না।ইদানিং ওরা মা ছেলে মিলে মেহেরকে কোন কাজই করতে দেয় না। দুপুরে না ঘুমালে শ্বাশুড়ির কড়া ধমক শুনতে হয় মেহেরকে। তিনি বিভিন্ন কথা বলতে বলতে নিজেই মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দেন মেহেরকে,
-হুন মা এই সময় তোমার বেশি বেশি কইরা সুষম পুষ্টিকর খাবার খাওন লাগব। তুমি তো একদম খাইতে চাওনা। এইডা কিন্তু একদম ঠিক না। শাক-সবজি ফলমূল খেতে মন না চাইলেও জোর কইরা খাইবা। এতে লৌহের ঘাটতি পূরণ অইব। বেশি কইরা পানি খাইবা। ডাক্তার কি কইল হুন নাই। তোমার শরীর ডা খুব দুর্বল। এই সময় না খাইলে অইব! আর বেশি বেশি কইরা ইবাদত করবা। এতে কইরা আমার সোনামনি ডা নেকবখত অইব।
মেহের শ্বাশুড়ির কথা শুনে কেঁদে দেয়। নিঃশব্দে কান্না। হয়তো তার মা থাকলে আজ এভাবেই ওকে আদর করেতেন।
সালমা বেগম ওর চোখে পানি দেখে বলেন,
-আমার মাডার কি অইছে, চোখে পানি কেন? আমি খারাপ কিছু কইছি।
মেহের তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে বলে,
-ছি ছি মা কি বলছেন, আপনি খারাপ কিছু বলবেন কেনো.... চোখে কি যেন পড়ছে তাই..
-আমার লগে মিছা কথা কও? নিশ্চয় মেহেরাবে তোমারে কিছু কইছে! আজ ..
-না না মা উনি কিছু বলেননি। হঠাৎ ......
-হুম হঠাৎ
- মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিলতো তাই...
-কি কইলা মেয়ে, মায়ের কথা মনে পড়ছিল মানে, তাইলে আমি আমি কে?
বলেই মেহেরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উনি উঠে গেলেন।
মা...
সালমা বেগম জানালা থেকে হাত সরিয়ে চোখ মুছে পিছনে তাকালেন। মেহের দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল। মা..এরপর আবার কান্না।
-ছি মা এমন কইরা কেউ কাঁদে। দেখি, দেখো মুখের কি অবস্থা করছ, বলে উনি মেহেরের চোখ মুছে দিলেন। মেহের এখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
-কি রে আমি এহনো তোর শ্বাশুড়ি না...মা হতে পারিনি!
মেহের আবার উনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-নাহ মা, আপনিই আমার মা.. আমি আসলে কথাটা ওভাবে বলিনি!
-যেভাবেই বলো, আর কখনো ওমন কইরা মন খারাপ করবা না। মারে রাইখা আবার মায়ের লাইগা কান্না হ্যাঁ, বোকা মেয়ে!
-কি ব্যাপার, মেয়েকে খুব আদর করা হচ্ছে না, করবেইতো আমিতো পর! গাল ফুলিয়ে পেছন থেকে বলে উঠল মেহরাব।
সালমা বেগম এগিয়ে এসে ওর কান টেনে বলেন,
-দুষ্টু ছেলে আইসাই আমাগো মা-মেয়ের ভালোবাসায় ভাগ নিতে চইলা আইলি। যা ভাগ গিয়া আগে ফ্রেশ হ।
-হুম.... আমি তো এখন পর সব আদর মেয়েকেই করো গে..... বিড়বিড় করতে করতে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরূমে ঢুকল মেহেরাব।
ওর ন্যাকামো দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল মেহের। সালমা বেগম মুচকি হেসে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মেহেরের দিকে, আর মনে মনে ভাবেন...
ওর ন্যাকামো দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল মেহের। সালমা বেগম মুচকি হেসে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মেহেরের দিকে। আর মনে মনে ভাবেন এভাবেই সারাজীবন আমি তোদের হাসিমাখা মুখখানা দেখে যেতে চাই!
.
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল সাতটি মাস। আজ মেহরাব বেশ ক্লান্ত। স্কুলের পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে শেয়ারে নতুন একটা বিজনেস শুরু করেছে সে। অল্প সময়ে বেশ সাফল্য পেতে শুরু করেছে ব্যাবসাটা। তাই একটু বেশিই খাটতে হচ্ছে তাদের। বিজনেসটা অনলাইনে হওয়ায় মাঝে মাঝে শখের বসে মেহেরও ওকে হেল্প করে। মেহেরের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখে মেহেরাবও আর মানা করে না। কিন্তু কয়েকদিন থেকে মেহেরের শরীরটাও যেন ভালো নেই। প্রায়ই ওকে ঘুমহীন কাটাতে হয় প্রতি প্রহর। মেহরাব সেটা লক্ষ্য করে কিন্তু কিছু বলে না। আজ সে নামাজ পড়ে এসেই রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে। মেহের মায়ের কাছে বসে গল্প করছিল।
রাত প্রায় বারোটা। ওয়াশরুম থেকে ভেসে আসা পানির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে মেহরাবের। হ্যাঁ যা ভেবেছিল তাই, সেখান থেকে বেরিয়ে আসে মেহের। ড্রিম লাইটের ঝাপসা আলোয় সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে।ওর মায়াবী মুখের আড়ালে কতটা ব্যাথা যে সে অনায়াসে লুকিয়ে রেখেছে তা হয়তো কেউ বুঝতে পারবে না। এমনকি মেহরাবও না। হঠাৎ মেহেরের চিৎকারে ধ্যান ভাঙ্গে তার।
-ওহ মা... আল্লাহ.. বলেই মেহের মুখ চেপে কোনমতে সোফায় বসে ছটফট করতে থাকে।
একটু পর উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়ে।
মেহরাব তাড়াতাড়ি উঠে মেহেরের কাছে যায়,
-মেহের কি হয়েছে তোমার, কষ্ট হচ্ছে খুব না, বলেই মেহেরের মুখটা নিজের বুকের সাথে আগলে ধরে মেহরাব। ভয় পেয়ো না একটু সহ্য করো দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ...বলতে বলতে নিজের অজান্তেই চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার।
মেহরাবের এমন পাগলামিতে মেহের বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।
-কই কষ্ট হচ্ছে না-তো...বলে মেহের নিজের পেটে হাত রেখে বলে ‘আমাদের বাবুটা ব্যাথা পেয়েছে, এটাই আমায় জানিয়েছে, তাই ওর কষ্টে আমারও কষ্ট হচ্ছে। বলে মেহের মুচকি হাসে।
-আমায় ধাক দিয়ে জাগিয়ে তুললেই-তো পারতে। তোমার কষ্টে বুঝি আমার কষ্ট হয় না... তুমি এখানে ব্যাথায় ছটফট করবে আর আমি ঐখানে পড়ে পড়ে ঘুমাব এটা ভাবো কি করে!
এরপর অনেকক্ষন চুপ থেকে বলে সত্যিই মায়েরা সব ব্যাথা হাসিমুখে মেনে নিতে পারেন। তাইতো মহান আল্লাহ মায়ের পায়ের নিচে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ জান্নাত রেখে দিয়েছেন। আর আমাদের দিয়েছেন কেবল সান্তনা পুরুষ্কার। সত্যিই... যদি তোমরা এই ত্যাগ শিকার না করতে তবে হয়তো আমরা কোনদিনই বাবা হওয়ার আনন্দটা পেতাম না.....বলতে বলতে মেহরাব সামনে এগিয়ে যায়, এরপর ফিরে এসে বলে,
-নাও...
মেহের অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে,
-আপনি কি করে জানলেন?
-জানি তো, আরও অনেক কিছু জানি, নাও...
মেহের কোরআন শরীফটা হাতে নিয়ে বুকের সাথে আগলে রাখে অনেক্ষণ, এরপর কোরআন শরীফ খুলে পড়তে শুরু করে। মেহেরাব মুগ্ধ হয়ে শুনে তার তিলাওয়াত।
পড়া শেষে মেহের কোরআন শরীফটা জায়গামতো রেখে আসার জন্য উঠতে গেলে মেহরাব ওকে থামিয়ে বলে, তুমি বসো দাও আমি রেখে আসি!
.......... ........ .........
-হুম এবার বলো, ব্যাথা কিছুটা কমছে?
-হুম.. আলহামদুলিল্লাহ..
-তবে চলো...
-কোথায়..?
-ঘুমাবে না!
-হুম,, তার আগে বলুন আপনি আর কি কি জানেন?
-নামায পড়বে..
-হুম..
-তবে চলো আগে নামাজ আদায় করে নেই,পরে তুমার প্রশ্নের উত্তর দেই।
নামাজ শেষে মেহের বলে ,
-এবার বলেন আপনি আর কি কি জানেন?
-ওম..... হ্যাঁ...তোমার নতুন রুটিন মানে, আজ কয়েকদিন থেকে দেখছি তুমি প্রতি রাতে না ঘুমিয়ে কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করো, এরপর আমার বুকে মানে এখানে মাথা রেখে শুয়ে থাকো, আর আমি তাহাজ্জুদের নামায আদায় করার জন্য উঠতে গেলে আমার সাথে তুমিও উঠে পড়ো, মোট কথা তুমি রাতে ঘুমাও না, মানে ঘুমাতে পারো না আমাদের দুষ্টু বাবুটার জন্য ... মেহের ওর কথা কেটে নিয়ে বলে,
-ওমা এটা তো আমি আপনায় বলিনি। আপনি কি করে জানলেন..?
-হুম আর এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা, কেনো তুমি আমায় সেটা বলোনি? নিজে একা একা কষ্ট করছ?
-এটা কোন কষ্ট হলো আপনাকে প্রতিদিন কতো কষ্ট করতে হয়। আর রাতের এই সামান্য সময় যদি আমার জন্য আপনি ভালোভাবে ঘুমাতে না পরেন তবে জান্নাতে আপনার জন্য নির্ধারিত ঐ স্ত্রী(হূর)আমায় অভিশাপ দেবে যে..। যেটা আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারব না.. গাল ফুলিয়ে বলে মেহের।
মেহরাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে দেখছে সেটা লক্ষ্য করে রসিকতা করে মেহের আবার বলে,
-তাছাড়া আমি জানি আমি না বললেও আমার হাত ঠিকই আমার চোখের জল মুছে দেবে।
-বাহ এতো কনফিডেন্স..মাথা চুলকে বলে মেহরাব
-কেনো সন্দেহ আছে?
মেহরাব মুচকি হেসে মেহের কে বুকে জড়িয়ে বলে
-নাহ.. তবে এটা কেমন কথা, জান্নাতের ঐ স্ত্রী (হুর) মানে টা কি?
মেহের বলে,
- কোনো স্ত্রী যখন তার স্বামীকে কষ্ট দেয়, তখন ঐ পুরুষের জন্য জান্নাতে নির্ধারিত স্ত্রী (হূর) বলতে থাকে, হে অভাগিনী আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুক, তোমার স্বামী কে কষ্ট দিও না, সে তো তোমার কাছে কিছু দিনের জন্য মেহমান মাত্র, অচীরেই সে জান্নাতে আমার কাছে চলে আসবে।
(তিরমিজিঃ১১৭৪)
মেহের কেঁদে কেঁদে বলে,আমি জান্নাতেও আপনাকে চাই, এর জন্যে পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট আমি মাথা পেতে নেব, তবুও আপনাকে আমি হারাতে পারব না।
-ধুর পাগলি, আমিও কি জান্নাতে তুমি ছাড়া সুখে থাকতে পারব বলো! আল্লাহ যদি তাঁর এই অধম বান্দাকে জান্নাতে দেন, তবে সেই জান্নাতে মহান প্রভুর কাছে আমার প্রথম চাওয়টাই হবে তুমি। মেহের উল্লাসিত কন্ঠে বলে,
-সত্যি..
মেহরাব ওর নাক টেনে বলে,
-একদম সত্যি..
.......
-মেহের..
-হুম..
-মা হতে অনেক কষ্ট অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়,আমি জানি অনেক কষ্ট আছে যা মাকেই করতে হয়, আমি চাইলেও সেই কষ্টের ভাগ নিতে পারব না, কিন্তু সেই কষ্টের সময় আমি তোমার পাশে তো থাকতে পারি, এই সুযোগটা অন্তত আমায় দিও..
-কে বলল আপনি আমার পাশে নেই, আপনি পাশে আছেন বলেই তো আমি সঠিক পথের নিশানাটা পেয়েছি। আপনি পাশে থাকার কারণেই আমি সেই জাহেলিয়াতি চিন্তাচেতনা থেকে উঠে আসতে পেরেছি।আপনিইতো আমার বেঁচে থাকার শক্তি। এই যে আমি ঘুমাতে পারিনা দেখে আপনিও ঘুমান না,অথচ আমায় বুঝতে দেননি কখনো, আমার কষ্টে আপনার চোখে পানি আসে, আমার সকল চাওয়া পাওয়া আমি চাওয়ার আগেই আপনি পূরণ করতে চেষ্টা করেন... এগুলো কি পাশে থাকা নয়!
-নাহ নয় আমি তোমার সমস্ত সুখে দুঃখে ছায়া হয়ে পাশে থাকতে চাই..জানো আজ স্কুল থেকে পাক্কা পাঁচ মাসের ছুটি নিলাম।
-ওমা.... পাঁচ মাস.. বলেন কি! কি করবেন এতো ছুটি দিয়ে?
-আপাদত তোময় দেখে রাখব,এরপর বাবু আসবে,ওদের প্রতিদিন গোসল করাব, খাইয়ে দে... ওহ থুক্কু এটা তুমি করবে, ঘুম পাড়িয়ে দেব, প্রস্রাব করলে ডায়পার চেঞ্জ করে দে..
-স্টপ স্টপ..সবই যদি আপনি করেন তবে আমি করব টা কি হ্যাঁ?
মেহরাব মুচকি হেসে বলে,
-তুমি শুধু বসে বসে খাবে..আরে না না খাইয়ে তো আমি দেব তুমি শুধু কষ্ট করে একটু চিবিয়ে গিলে ফেলবে ব্যাস..আর বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করবে।
মেহের বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ওর দিকে! এই পাগল মানুষটাকে কি বলবে ভেবে পায় না।
জীবনে সুখ আর দুঃখ একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জীবনে যেমন হাসি আনন্দের জোয়ার আছে তেমনি ওপিঠে লুকিয়ে আছে বেদনার অশ্রু। এটাই যে নিয়তি।
কেননা এভাবেই জীবনচক্র সাজানো হয়েছে ।আল্লাহ বলেন " আমি তো মানুষ সৃষ্টি করেছি কষ্ট -ক্লেশের মধ্যে। ( সূরা বালাদ:আয়াত : ৪ )
মেহরাব যোহরের নামাজ থেকে ফেরার পথে মায়ের ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে রিসিভ করে,
-আসসালামু আলাইকুম মা..
-ওয়ালাইকুমুস সালাম, বাপ জলদি একখান গাড়ি লইয়া আয়, আমার মাইয়াটা কেমনে যেন করতাছে হসপিটালে লইয়া যাওন লাগব।
মেহের কে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো মেহরাব আর সালমা বেগম। ফোন করে মেহেরের বাবাকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। উনিও আসছেন।
মেহের সেই কখন থেকে আবোল তাবোল বকেই যাচ্ছে। মেহরাব আর সালমা বেগম ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন আর একে অন্যের থেকে নিজের চোখের পানি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছেন। মেহের যে সালমা বেগমের কলিজার টুকরা, বুকের ধন।ওর কষ্টে যেন ওনার ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছেন অবিরাম। মেহরাবের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। হঠাৎ মেহরাব হাত দিয়ে আগলে ধরার চেষ্টা করে মেহের আর মাকে।
অমনি সামনে থেকে একটা মালবাহী ট্রাকের ধাক্কায় চারপাশ থমথমে হয়ে যায়, চারিদিকে নিরব-নিস্তব্ধতা। অন্ধকারে ছেয়ে যায় চারপাশ।
প্রায় দুই দিন পর জ্ঞান ফিরল মেহেজাবিনের।
চোখ তুলে তাকাতেই দেখে ডাক্তার তিশা দাঁড়িয়ে আছে।এই তিশা মেহরাবের দুঃসম্পর্কের এক কাজিন।প্রথম থেকেই মেহেরের সমস্ত ট্রিটমেন্ট তিশাই করেছে। মেহের তিশার হাত ধরে বলে,
-আপু.. উনি কোথায়, মা কোথায় আমার কি হয়েছে ,আমার মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?
মেহেরের কথার আওয়াজে মেহেরের বাবা বাইরে থেকে ছুটে এলেন, এগিয়ে এলেন মেহেরের বড় বোন মেহেরুন্নেসাও!
তিশা আস্তে করে ওর পাশে বসে ওর মাথায় হাত রেখে বলল,
-শান্ত হও বোন, দেখো আল্লাহ তোমায় কি সুন্দর দুটো ফুটফুটে বাচ্চা দান করেছেন..
মেহেরুন্নেসা এগিয়ে এসে একটি বাচ্চাকে ওর কোলে তুলে দিয়ে বলে,
-জাবিন দেখ বোন কি কিউট দুইটা বেবি..
মেহের তাকিয়ে দেখে ওর বাবার চোখে পানি টলমল করছে, মেহের ডাকে,
-বাবা....
উনি কোলের বাচ্চাকে বাড়িয়ে ধরে বলেন,
-দেখ মা, আমার নাতনি আমার লগে কি করে খেলতাছে দেখ...
মেহেরের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে,কান্না করতে করতে মেহের বলে,
-বাবা ..আপু...তিশা'পু, তোমরা কেউ বলছ না কেনো উনি কোথায় আমার মা কই.....
বলতে বলতে জ্ঞান হারায় মেহের।
মেহের আজও বেঁচে আছে মেহরাবের শেষ স্মৃতিটুকু নিয়ে। বেঁচে আছেন সালমা বেগমও। তবে এক্সিডেন্টে হারিয়েছেন দুটি পা। মেহরাব একদিন বলেছিল, 'মেহের তুমি দেখে নিও আমাদের টুইন বেবী হবে! মেহের সেদিন অবাক হয়ে বলেছিল,
-মানে..?
মানে আমার খুব ইচ্ছে আমাদের টুইন বেবী হবে আর ওদের একজন হবে ছেলে আর অন্যজন মেয়ে। আমার বিশ্বাস আল্লাহ আমার এই চাওয়াটা পূর্ণ করবেন। মহান প্রভু সেদিনের তার ওই চাওয়াটা পূর্ণ করেছেন, কিন্তু সেই মানুষটি তা দেখে যেতে পারল না। এটাই বোধহয় নিয়তি! মেহরাবের পছন্দেই ছেলেমেয়েদের নাম রেখেছে মেহের।ছেলের নাম তালহা আর মেয়ের নাম সুমাইয়া। ওদের নিয়েই হয়তো কেটে যাবে মেহেরের বাকী জীবন।
প্রতি নামাজের শেষ মুনাজাতে মহান প্রভুর কাছে মেহের একটি দোয়া'ই করে।
আর সেটা হলো,ওপারে যেন মহান প্রভু তাদের আবার এক করে দেন, অনন্তকালের সেই শেষ ঠিকানায় যেন তারা আবার একসাথে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে।
★★★★★★★★★সমাপ্ত★★★★★★★★★
লিখাঃ নুসাইফা আশরাফী আনিফা