নিউট্রন তারা - একটি নিবন্ধ




মহাবিশ্বের এক অন্যতম প্রধান উল্লেখযোগ্য বস্তু হলো নিউট্রন তারা। অতি শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ থেকে অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন চৌম্বকীয় ক্ষেত্র পর্যন্ত পদার্থবিদ্যার চরম মাত্রাগুলি নিউট্রন তারার জন্য আদর্শ। এর বিপরীতে কৃষ্ণ গহ্বরের সঙ্গে প্রায় কাছাকাছি তুলনা করা গেলেও সেগুলোকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না। কৃষ্ণ গহ্বরের থেকে নিউট্রন তারকাগুলি নিয়ে অপেক্ষাকৃত সহজে গবেষণা করা যায়। এর অভ্যন্তরীণ গঠন, এর পৃষ্ঠদেশ পরিস্কারভাবে বোঝা যায় এবং এদের অনেক বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করা সম্ভব।

এই মহাজাগতিক বস্তুকে পেতে গেলে আগে একটি তারকার মৃত্যু ঘটতে হবে। একটি নক্ষত্রের জীবনের শেষ পর্যায় প্রধানত তার ভরের উপর নির্ভর করে। সূর্যের মতো সাধারণ নক্ষত্ররা তাদের আরও বড়ো নক্ষত্রের তুলনায় অপেক্ষাকৃত শান্তভাবে তাদের জীবন শেষ করে। নক্ষত্ররা তাদের বেশিরভাগ জীবদ্দশায় মাধ্যাকর্ষণের জন্য সৃষ্ট অন্তর্মুখী চাপের সঙ্গে তাদের কেন্দ্রে ঘটে চলা নিউক্লিয়ার ফিউশনের বহির্মুখী চাপের মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে। অবশেষে তারকাটির মধ্যে পারমাণবিক জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। যেমন সূর্যের ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ হতে প্রায় 5 বিলিয়ন বছর লাগবে, তারপর শুরু হবে হিলিয়াম জ্বালানির পালা। এখানে সেই বিষয়ে বিশদ আলোচনায় আর যাচ্ছি না। 

অন্যদিকে, সূর্যের চেয়ে আরও বিশাল নক্ষত্রের আরও অনেক পর্যায় রয়েছে, যা ক্রমান্বয়ে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, কার্বন, নিয়ন, অক্সিজেন এবং অবশেষে সিলিকনের পারমাণবিক ফিউশনের অনুমতি দেয়। সিলিকন ফুরিয়ে যাওয়ার পরে, তারার কেন্দ্রে পড়ে থাকে লোহা। নক্ষত্রের জন্য দুর্ভাগ্যবশত, লোহার ফিউশন থেকে আর কোন শক্তি অর্জন করা যায় না, তাই প্রক্রিয়াটি সেখানেই থেমে যায়। পারমাণবিক ফিউশনের জন্য এই জাতীয় তারার জ্বালানী শেষ হয়ে গেলে, তারাকে বাইরের দিকে ঠেলে দেওয়ার চাপটি হারিয়ে যায় এবং মাধ্যাকর্ষণ এই ভারসাম্যকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। নক্ষত্রটি বিস্ফোরিত হয়, এর বাইরের স্তরগুলি ভিতরের দিকে ভেঙে পড়ে।

নক্ষত্রের বাইরের স্তর নিজের কেন্দ্রের মধ্যে ভেঙ্গে পরার ফলে কেন্দ্রের কণাগুলি একসাথে অতিঘন সন্নিবদ্ধ হয়ে পড়ে। একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে প্রদক্ষিণকারী ইলেকট্রনগুলি প্রথমে চাপ অনুভব করে। ইলেকট্রনগুলো এই অন্তর্মুখী চাপের কারণে তারা তাদের নিজস্ব ধরণের বাহ্যিক চাপ তৈরি করে, যা ইলেকট্রন ডিজেনারেসি চাপ (electron degeneracy pressure) নামে পরিচিত। এটি মহাকর্ষের অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়, যার ফলে কেন্দ্রের বাইরের উপাদানটি বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়। এর ফলে তৈরী হয় শ্বেত বামন( White dwarf) নক্ষত্র। শেষ পর্যন্ত, সূর্যের মতো নক্ষত্ররা এই তারার অবশিষ্টাংশ হিসাবে তাদের জীবন শেষ করে। পরবর্তিকালে এরা কৃষ্ণ বামন (Black dwarf) নক্ষত্রে পরিণত হয়।

তবে আরও বড় তারার জন্য মাধ্যাকর্ষণ এখানে আরেকটি যুদ্ধ জয় করে। সেখানে মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রে লোহার পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রন ডিজেনারেসি চাপকে অতিক্রম করে নিউক্লিয়াসের সঙ্গে মিশিয়ে দেয় এবং নতুন নিউট্রন ও প্রচুর পরিমাণে নিউট্রিনো তৈরি করে। তখন নিউট্রনগুলো নিজেদের মধ্যে পিষ্ট হতে থাকে এবং neutron degeneracy pressure উৎপন্ন হয়। এই চাপ মাধ্যাকর্ষণজনিত অন্তর্মুখী চাপকে পুনরায় আপাত ভাবে রোধ করে। নিউট্রিনোগুলি অন্যান্য শক্তি ও পদার্থের সঙ্গে প্রবল গতিতে বিষ্ফোরণের মাধ্যমে ছিটকে বেরিয়ে আসে এবং সুপারনোভা উৎপন্ন করে। অবশেষ হিসেবে তৈরি হয় নিউট্রন তারা। সবচেয়ে চরম ক্ষেত্রে, মাধ্যাকর্ষণ এমনকি এই শক্তিকেও অতিক্রম করে যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং একটি ব্ল্যাক হোল গঠন করে।

নিউট্রন নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করার পূর্বেই তার অস্তিত্বের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। 1933 সালে, জ্যোতির্বিজ্ঞানী Walter Baade এবং Fritz Zwicky আমেরিকার Proceedings of the National Academy of Sciences এ প্রকাশিত "Cosmic Rays from Super-Novae" শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। তাঁরা সেখানে প্রস্তাব করেছিলেন যে সুপারনোভা ('সুপারনোভা' শব্দটি তাঁরাই তৈরি করেছিলেন) মহাকাশে আমাদের ছায়াপথের বাইরে থেকে আসা রহস্যময় মহাজাগতিক রশ্মি এবং "একটি সাধারণ তারার একটি নিউট্রন তারাতে রূপান্তর" - উভয়ই উৎপন্ন করে। তাঁরা এই বস্তুগুলিকে "খুব ছোট ব্যাসার্ধ এবং অত্যন্ত উচ্চ ঘনত্বের অধিকারী" হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।

প্রথম নিউট্রন তারকা আবিষ্কার করতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আরও 30 বছর লেগেছিল। 1967 সালে,  Jocelyn Bell Burnell যিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, Mullard Radio Astronomy Observatory তে বড় রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে একটি দুর্বল এবং পর্যায়বৃত্ত সংকেত দেখতে পান। প্রথমে সেটিকে এলিয়েনের পাঠানো সংকেত হিসাবে দেখলেও পরে সেই ধারণাকে নাকচ করে দেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিন দশক আগে Baade এবং Zwicky যে একটি অস্বাভাবিক তারকার বৈশিষ্ট্যের প্রস্তাব করেছিলেন তা এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। তারপর থেকে এই নিউট্রন তারকা সম্পর্কে আরও বহু গবেষণা হয়েছে। 

নিউট্রন তারা অবিশ্বাস্যভাবে ছোট। গড় নিউট্রন নক্ষত্রের ব্যাস প্রায় 12.5 মাইল (20 কিলোমিটার), বা একটি শহরের আকারের মতো। এবং সেই ছোট আয়তনের মধ্যে চেপে ভরা আছে সূর্যের সমান বা দ্বিগুণ আয়তনের ভর। একটা তুলনামূলক ভাবে বলা যায় নিউট্রন তারকার একটা চিনির দানার আকারের উপাদানের পৃথিবীর মাপকাঠিতে ওজন হবে প্রায় 1 বিলিয়ন টন, যা কিনা মাউন্ট এভারেস্টের সমান! তবে এগুলিই নিউট্রন তারার একমাত্র চরম বৈশিষ্ট্য নয়। তারা অতি বিস্ময়কর গতিতেও নিজের অক্ষের চারপাশে ঘূর্ণিত হয়। পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক নিয়ম কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণের জন্য কমপ্যাক্ট নিউট্রন তারাগুলি তাদের পূর্বপুরুষ নক্ষত্রের তুলনায় অনেক বেশি হারে ঘূর্ণনশীল। একটি ঘূর্ণায়মান ফিগার স্কেটার কল্পনা করুন। যখন তাদের বাহুগুলি প্রসারিত হয়, তারা ধীরে ধীরে ঘোরে, কিন্তু যখন তারা তাদের বাহু টেনে নেয়, তখন তারা গতি বাড়ায়। তারকাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একটি সুপারনোভার পরে, অবশিষ্টাংশের একটি ক্ষুদ্র ব্যাস থাকে এবং এইভাবে তার পূর্বপুরুষের তুলনায় অনেক দ্রুত ঘোরে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দ্রুততম ঘূর্ণায়মান নিউট্রন তারকা, PSR J1748-244ad, প্রতি সেকেন্ডে 716 বার পাক খায়। সময়ের সাথে সাথে, ফিগার স্কেটারের মতো, একটি নিউট্রন তারার স্পিন কমতে শুরু করে। নিউট্রন তারকাকে ঘিরে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্রের উপস্থিতির জন্য একটি বিরোধী শক্তি কাজ করে যা শেষ পর্যন্ত তারার ঘূর্ণনে ব্রেক রাখে।

একটি নিউট্রন তারার চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি মহাবিশ্বে পাওয়া অন্য যেকোন চৌম্বক শক্তির উৎসের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। অবশ্য ঠিক কীভাবে এই বস্তুগুলি এত উচ্চ চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে তা ভালভাবে বোঝা যায় না। সম্ভবত এটি নিউট্রন তারার কম আয়তনের সাথে তার আগের তারার চৌম্বক ক্ষেত্রকে ধরে রাখে। যদিও নিউট্রন নক্ষত্রে দেখা চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি ব্যাখ্যা করার জন্য এই প্রভাব একাই যথেষ্ট নয়।

যদিও তাদের চৌম্বক ক্ষেত্র এবং ঘূর্ণন চরম হতে পারে, নিউট্রন তারা দৃশ্যমান আলোতে খুব উজ্জ্বল নয়। মিল্কিওয়ে এবং Magellanic Cloud এ আনুমানিক 2000 টি নিউট্রন তারার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে আমাদের মিল্কিওয়েতে এক বিলিয়ন নিউট্রন তারা লুকিয়ে আছে। তাহলে এতটা বৈষম্য কেন? তার কারণ হলো বেশিরভাগ নিউট্রন তারা অনেক পুরানো। আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রতি 50 বছরে শুধুমাত্র একটি সুপারনোভা ঘটছে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। নিউট্রন তারা সময়ের সাথে সাথে আরও শীতল হতে থাকে। একে radiational cooling বলা হয়। তবে এই সময়কাল অনেক দীর্ঘ। তাদের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র ব্যতীত (যা একটি নিউট্রন তারার আশেপাশে স্থানকালকে বিকৃত করে), বেশিরভাগ একা নিউট্রন তারা সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে যায়, অবশেষে অপরিহার্যভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু এমনকি অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক নিউট্রন তারাও চিহ্নিত করা কঠিন হতে পারে।

তবে একটি দারুণ বৈশিষ্ট্য নিউট্রন তারকাকে খুঁজে পাওয়া সহজ করতে পারে। তাদের মধ্যে অনেকেই দুটো বিপরীত গোলার্ধ (বিশেষত মেরুপ্রদেশ) থেকে ক্রমাগত উজ্জ্বল বিকিরণ নির্গত করে। যদি নিউট্রন নক্ষত্রটি পৃথিবীর সাপেক্ষে সঠিক অভিমুখে ঘুরতে থাকে তবে সেই বিকিরণের স্রোতটি আমাদের গ্রহ জুড়ে বারবার সুইপ করতে পারে। এই ধরনের নিউট্রন তারাকে পালসার (pulsar) বলা হয়। 1967 সালে বিজ্ঞানী Bell Burnell মহাকাশে এই ধরনের বস্তু আবিষ্কার করেন। আকাশে এই পালসারগুলি লক্ষ্য করলে আমাদের মনে হয় একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর তা  জ্বলছে-নিভছে।

আর এই পালসার অত্যন্ত দ্রুত গতিতে নিজের চারপাশে ঘূর্ণিত হয়। দ্রুততম ঘূর্ণায়মান নিউট্রন তারকা - অর্থাৎ পূর্বে উল্লেখিত PSR J1748-244ad - আসলে একটি পালসার বা, আরও স্পষ্টভাবে বললে একটি মিলিসেকেন্ড পালসার। এমনিতে সাধারণ পালসারের ক্ষেত্রে মাত্র এক সেকেন্ডের কাছাকাছি সময়ের মধ্যে এক পাক ঘোরা সম্পন্ন হয়ে যায় আর মিলিসেকেন্ড পালসার কয়েক মিলিসেকেন্ডেই নিজের চারপাশে পুরো এক পাক আবর্তন করে! মানে এই দ্রুতগতির পালসারগুলি মিলিসেকেন্ডে স্পিন পিরিয়ড থাকার কারণে তাদের নাম পেয়েছে। সাধারণত, পালসার থেকে নির্গত বিকিরণ রেডিও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমানায় থাকে। তবুও কয়েকটি অপটিক্যাল, এক্স-রে এবং গামা-রে পালসার আবিষ্কৃত হয়েছে। অপটিক্যাল পালসারের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হল ক্র্যাব নেবুলার কেন্দ্রে অবস্থিত নিউট্রন তারকা।

আর একটা বিষয়, পালসারগুলির সাহায্যে সময় অবিশ্বাস্য ভাবে নিখুঁত সময় মাপা যায়। যখন তারা ঘোরে, পালসারগুলি যে তীব্র তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণ নির্গত করে তা পৃথিবীতে নিয়মিত এবং সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত স্পন্দন হিসাবে সনাক্ত করা হয়। বলা হয় যে অনেক দীর্ঘকাল ধরে বিচার করলে একটি পারমাণবিক ঘড়ির চেয়ে বেশি নির্ভুল সময় দেয় এই পালসারগুলি। পরিচিত পালসারের হার কয়েক মিলিসেকেন্ড থেকে কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত থাকে, যা তাদের ঘূর্ণনের গতির উপর নির্ভর করে।

পালসার হলো নিউট্রন তারকার পরিবারে এক নির্ভর যোগ্য সদস্য। অন্যদিকে Magnetar হলো পরিবারের দুরন্ত এবং গন্ডগোল পাকানো সদস্য। Magnetar এর চারপাশে ছড়িয়ে আছে অতি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র। এই চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর তুলনায় প্রায় এক হাজার ট্রিলিয়ন গুণ শক্তিশালী এবং প্রায়শই পালসারের চেয়ে 100 থেকে 1,000 গুণ বেশি শক্তিশালী। কিন্তু একটি অতি-শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তার বিপত্তি ছাড়া তো আসে না। এদের মধ্যে থেকে ক্রমাগত অনিয়ন্ত্রিত গামা রশ্মি এবং এক্স-রে বিস্ফোরণ হতে থাকে। এর সঙ্গে এদের নিজের অক্ষের চারপাশে ঘূর্ণনও নিয়মিত হারে হয় না।

ম্যাগনেটারগুলিও পালসারের মতো বিকিরণ নির্গত করতে পারে তবে সেই দুটো ক্ষেত্রের স্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত হয়। রেডিও পালসারগুলিতে, বিকিরণ একটি সুন্দর ছোট পালসের মতো এবং এটি প্রতিবার আসে। কিন্তু ম্যাগনেটারে এটা "বুম, বুম, বুম" - এর মতো। সুতরাং যেখানে পালসারগুলি অনুমানযোগ্য, সেখানে ম্যাগনেটার থেকে নির্গমন আরও এলোমেলো ও বিশৃঙ্খল।

পালসারের চেয়ে ম্যাগনেটারগুলি খুঁজে পাওয়া আরও কঠিন। এখন পর্যন্ত মিল্কিওয়ে জুড়ে আবিষ্কৃত 2,000 নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে শুধুমাত্র 31টি নিশ্চিতভাবে চুম্বক হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। এ রকমের একটা ম্যাগনেটারের উদাহরণ হলো SGR 1935+2154, যা velpecula নক্ষত্র পুঞ্জে অবস্থিত। ম্যাগনেটারগুলি সম্পর্কে অনেক কিছুই এখনো অজানা।

যখন দুটো তারার মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে সেটা স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক হয়, বিশেষ করে যদি সেই দুটি তারা নিউট্রন তারা হয়। এই সংঘর্ষকে বলা হয় কিলোনোভা (Kilonova)। একটা নিউট্রন তারকা আর একটি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে সংঘর্ষকেও কিলোনোভা বলা হয়, তবে সে আলাদা প্রসঙ্গ। একটি কিলোনোভা সাধারণ নোভার চেয়ে প্রায় 1000 গুণ বেশি শক্তিশালী। কয়েকজন বিজ্ঞানীর মতে আমাদের সূর্য তার 10-বিলিয়ন বছরের জীবদ্দশায় যত বেশি শক্তি উৎপাদন করবে একটি কিলোনোভা তার চেয়ে বেশি শক্তি প্রকাশ করে। এই বিস্ফোরণের ফলে সোনা এবং প্লাটিনামের মতো ভারী উপাদানের সৃষ্টি হয় যা বিপুল বেগে মহাবিশ্বে নিক্ষিপ্ত হয়। তবে কিলোনোভার ফলে উৎপন্ন শক্তি দৃশ্যমান আলোর সীমানায় খুব বেশি নয়, (সুপারনোভা এর চেয়ে বেশি উজ্জ্বল) এর আসল শক্তি আরও ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে যেমন অতিবেগুনী রশ্মি, এক্স রশ্মি বা গামা রশ্মি অঞ্চলে। 2008 সালে প্রথম কিলোনোভার সন্ধান পাওয়া যায় সেটি হলো GRB 080503. এর পরে আরও কয়েকটি কিলোনোভার খোঁজ মিলেছে।

নিউট্রন তারা সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যেই অনেক মতভেদ রয়েছে। গত 2019 সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ আমাদের থেকে প্রায় 54 মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে M87 এর কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলে গোটা পৃথিবীতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। অন্যদিকে এখনো পর্যন্ত সনাক্ত করা সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা নিউট্রন তারা RXJ185635-3754, যার দূরত্ব মাত্র 200 আলোকবর্ষ, (হাবল টেলিস্কোপ অনুযায়ী) তার সম্পর্কে এখনো অনেক গবেষণা চলছে।

নিউট্রন তারার অভ্যন্তরীণ গঠন কেমন তা বিজ্ঞানীদেরও ধন্দে ফেলে দেয়। নিউট্রন তারার কেন্দ্রে অতিরিক্ত পরিমাণ মাধ্যাকর্ষণ জনিত চাপ degenerate নিউট্রনের পক্ষেও সহ্য করার পক্ষে খুব শক্তিশালী। সাধারণ নক্ষত্রের মতো নিউট্রন নক্ষত্রও স্তর দিয়ে গঠিত। এগুলিকে সম্পূর্ণরূপে নিউট্রন সমন্বিত মনে করা সহজ, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে নিউট্রন তারার বায়ুমণ্ডলের একটি পাতলা স্তর রয়েছে যা হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের সমন্বয়ে গঠিত। এর নীচে বাইরের ত্বকের একটি পাতলা স্তর রয়েছে যা এক ইঞ্চির চেয়েও কম পুরু। এখানে ইলেকট্রনগুলি পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের সাথে সংযুক্ত থাকে না। অভ্যন্তরীণ ভূত্বকের মধ্যে, সেই ইলেকট্রন এবং নিউক্লিয়াসগুলি একসাথে সন্নিবিষ্ট হয়ে যায়। কিছু ইলেকট্রন অপেক্ষাকৃত হালকা মৌলের নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সাথে একত্রিত হয়ে নিউট্রন তৈরি করে এবং ভারী পারমাণবিক নিউক্লিয়াসগুলি মুক্ত হিসেবে থাকে। নিউট্রন সমৃদ্ধ পরিবেশের সূচনা হল বাহ্যিক কেন্দ্র(outer core)। এর মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ কোর, যার গঠন পদার্থবিদরা কেবল অনুমান করতে পারেন। নিউট্রন নক্ষত্রের কেন্দ্রে অনেক পরিবর্তন ঘটে। এখানে নিউট্রন ডিজেনারেসি চাপের পক্ষে ঘনত্ব খুব বেশি। কিছু তত্ত্ব কোয়ার্ক থেকে উৎপন্ন চাপের দিকে নির্দেশ করে - যে কণাগুলি প্রোটন এবং নিউট্রন তৈরি করে। এই বল অভ্যন্তরীণ কোরকে ধরে রাখে। বিকল্পভাবে, একটি নতুন কণা দায়ী হতে পারে। তবে ঠিক কোন মডেলটি ধরে আছে তা খুঁজে বের করার জন্য আরও তথ্য প্রয়োজন।

আরও বিশাল নিউট্রন তারা খুঁজে পাওয়া তত্ত্বগতভাবে সমস্যা পূর্ণ। এখানে সর্বোচ্চ ভরের একটি সীমা রয়েছে যার উপরে গেলে নিউট্রন তারকা একটি ব্ল্যাক হোলে ভেঙে পড়ে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখনও জানেন না ব্ল্যাক হোল এবং নিউট্রন তারার মধ্যে সীমানা কোথায়। সবচেয়ে বড় নিউট্রন তারকা, PSR J0740+6620, হল 2.1 সৌর ভর, যেখানে পাওয়া ক্ষুদ্রতম ব্ল্যাক হোল, যাকে ইউনিকর্ন বলা হয়, যার ভর প্রায় 3টি সৌর ভরের সমান। মাইক্রো বা মিনিয়েচার ব্ল্যাক হোলের কথা এক্ষেত্রে ধরা হয় না।

প্রতিটি নতুন নিউট্রন তারকা আবিষ্কৃত হওয়ার সাথে সাথে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই কমপ্যাক্ট বস্তুগুলি সম্পর্কে আরও শিখছেন। কিছু ম্যাগনেটার কখনো কখনো পালসারের মতো আচরণ করে আবার এর উল্টোটাও ঘটতে দেখা গেছে। এমনকি Chandra X-ray Observatory কিছু অপরিচিত বস্তু আবিষ্কার করেছে যাদের বিজ্ঞানীরা anti-magnetar নাম দিয়েছেন। এগুলিকে অস্বাভাবিকভাবে কম চৌম্বক ক্ষেত্র সহ নিউট্রন তারা বলে মনে করা হয়। গত এক দশকে, সুপারনোভার অবশিষ্টাংশের কেন্দ্রস্থলে এই অদ্ভুত বস্তুর প্রায় দুই ডজন উদাহরণ পাওয়া গেছে।

এই অত্যন্ত আকর্ষণীয় নিউট্রন তারার কথা ফুরিয়ে যাওয়ার মতো নয়। যত দিন যাবে এ সম্পর্কে আরও নতুন নতুন তথ্য ও গবেষণা চলছে। 

লিখাঃ সরোজ নাগ। 


তথ্য সূত্র - 1) https://www.nasa.gov/mission_pages/GLAST/science/neutron_stars.html#:~:text=Astronomers%20have%20found%20less%20than,to%20cool%20and%20spin%20down.

2) https://hubblesite.org/contents/media/images/2000/35/1008-Image.html?news=true

3) https://www.britannica.com/science/star-astronomy/Star-formation-and-evolution

4) আরও কিছু ওয়েবসাইট 


চিত্র পরিচিতি -

চিত্র 1 - নিউট্রন তারকার কল্পিত চিত্র। সৌজন্যে NASA’s Goddard Space Flight Center Conceptual Image Lab

চিত্র 2 - শিল্পীর ভাবনায় একটি পালসার। সৌজন্যে Bill saxton, NRAO/AUI/NSF

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম