জোনাকির আলো



জোনাকি দুই পাখাওয়ালা একপ্রকার পতঙ্গ, যা তার স্বয়ংপ্রভ দ্যুতির জন্য জগদ্বিখ্যাত। রাতের অন্ধকারে ঝাঁক বেঁধে চলা এদেরকে দূর নক্ষত্রপুঞ্জের মতো মিটমিট করতে দেখা যায়। তা দেখে বাংলার কবি আদর ক’রে জোনাকির নাম দিয়ে গেছেন তমোমণি।  

সারা পৃথিবীতে জোনাকির বিচিত্র প্রজাতি পাওয়া গেছে প্রায় দু’হাজার। মূলত গ্রীষ্মমন্ডল ও নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় এদের বসবাস। থাকার জন্য পছন্দের জায়গা হিসেবে তারা বেছে নেয় সিক্ত বনাঞ্চল বা খানাডোবা, যেখানে তাদের শূককীট ছানারা পর্যাপ্ত খাদ্যসহ বেচে থাকার অনুকূল পরিবেশ পায়। এই অপূর্ণাঙ্গ কীটগুলো থেকেও অনর্গল জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয় দেখে এদেরকে গ্লোওয়ার্ম বলা হয়।  

জোনাকির শরীর থেকে নির্গত হয় মূলত ৫১০ থেকে ৬৭০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো। এজন্য এই আলোগুলোর রং সাধারণত সবুজ, হলুদ বা ফিকে লাল। এতে কোন অতিবেগুনী বা অবলোহিত তরঙ্গ থাকে না। এছাড়া পূর্ব আমেরিকায় ধীরেধীরে-জ্বলজ্বলে ‘নীল ভূত’ নামক জোনাকির কিছু প্রজাতি আছে, যারা হ্রস্বতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীলাভ আলো নি:সরণ করতে পারে।    

অর্থাৎ পৃথিবীতে লাল, হলুদ, সবুজ ও নীল এই চার বর্ণের আলোর জোনাকি পোকা দেখা যায়। তলপেটের স্বয়ংপ্রভ এই দ্যুতি দ্বারা তারা খাদ্যসন্ধানের পাশাপাশি যৌনসঙ্গীকে আকর্ষণ করে। এভাবে জ্বলানেভার সমবেত ছন্দে গাঁথা হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে অলস-বিলাসে উড়তে থাকে জোনাকি।

আমরা জানি, জোনাকির আলোয় তাপ নেই। এধরণের শীতল আলো প্রজ্জ্বলন প্রক্রিয়াকে বলে লুমিনিসেন্সিয়া। জোনাকি ছাড়াও অন্য অনেক জাতের কীটপতঙ্গ এবং কোন কোন মাছ ও উদ্ভিদেরও এ ধরণের শীতল আলো উৎপাদনের ক্ষমতা আছে। যেমন ব্রাজিলে রেললাইনের পাশেপাশে এক বিশেষ জাতের পোকা দেখা যায়, যাদের দেহ থেকে লাল ও হলুদ জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়।  

জোনাকির আলো কেন জ্বলে এবিষয়ে হার্ভে, গিবসন, গ্রীন, টটার প্রমুখ বিজ্ঞানীরা ব্যাপক গবেষণা করেছেন। পরীক্ষানলের ভিতরে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থগুলোর সংমিশ্রণে একই ধরণের আলো তৈরি করা গেছে। দেখা গেছে, জোনাকি শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে সাথে অক্সিজেন তথা অম্লজানের যে আদানপ্রদান করে, তার সঙ্গেই চলতে থাকে তার জ্বলানেভার কাজ। প্রক্রিয়াটাকে সংক্ষেপে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়:

জোনাকির শ্বাসের সাথে গৃহীত অম্লজান তার শরীরের লুসিফারিন নামে এক যৌগপদার্থকে জারিত করে তাকে একটি ক্ষণভঙ্গুর পদার্থে পরিণত করে। এটি সম্ভব হয় জোনাকির খাদ্যের দহন-সঞ্জাত এটিপি-বাহিত তেজ এবং অনুঘটক আমিষ লুসিফারেজের সাহায্যে। এই ক্ষণভঙ্গুর পদার্থটি দ্রুত অম্লজান ও লুসিফারিনে ভেঙ্গে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। এবং এই ভাঙ্গার সময় লুসিফারিনের অণুগুলো থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে উজ্জীবিত ফোটনের ঝাঁক, যা আমাদের চোখে স্নিগ্ধ আলো হিসেবে প্রতিভাত হয়।  

দেখা যাচ্ছে, অতিপারমাণবিক তরঙ্গ-কণিকা এই ফোটনগুলো লুসিফারিনের জারণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া তেজেরই পরিবর্তিত রূপ। যা আদতে জোনাকির খাদ্যের অণুতে আটকে’ থাকা এবং জৈবরাসায়নিক দহনের মাধ্যমে ছাড়া পাওয়া সৌরশক্তিরই নামান্তর। 

অর্থাৎ জোনাকির আলো আসলে আর কিছু না – তা জোনাকির খাদ্যের মাধ্যমে বাহিত, মুক্তি পাওয়া সূর্যের আলো।    

আত্মচেষ্টায় সমুজ্জ্বল এই বিশেষ জাতের গুবরে পোকা খদ্যোৎ থেকে তাহলে আমরা কী শিখলাম?    

না, শক্তি নিত্য। তার সৃষ্টি নেই, বিনাশ নেই, আছে শুধু অসংখ্য রূপান্তর। আমাদের চারপাশের এ মহাজগৎ স্তরেস্তরে পুঞ্জিভূত অফুরন্ত শক্তির জমাট বিন্যাস। সেই শক্তিকে আমরা সুর বা অসুর, ভালো বা মন্দ, যেকোন শক্তিতে পরিবর্তিত করতে পারি। …

ঝোপেঝাড়ে, বিলঝিলের আঁধারে লক্ষলক্ষ বছর ধরে জোনাকিরা জ্বলছে নিবছে আর শক্তির সদ্ব্যবহারের শিক্ষায় অলক্ষ্যে মানুষকে অনবরত ডেকে যাচ্ছে।  

যেন আমরা আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তিকেও সচেতন সাধনায় ঢেলে পিটিয়ে শুভশক্তিতে রূপান্তরিত ক’রে তাকে নিত্যকল্যাণের অভিমুখে পরিচালিত করি, তার নিয়ত আহবান শোনাচ্ছে জোনাকি। …

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম