মহাকাশে দুটো নক্ষত্রের মধ্যে দূরত্ব এতই বেশি যে আমাদের বর্তমান প্রযুক্তির সাহায্যে তাদের মধ্যে যাতায়াতের কথা চিন্তাই করা যায় না। একটা গ্যালাক্সির মধ্যে যাওয়া আসা করা তো অকল্পনীয় ব্যাপার। উদাহরণ হিসেবে ভয়েজার-1 এর কথা বলা যায়। ঘন্টায় প্রায় 61500 কিমি বেগে দীর্ঘ 40 বছর ধরে চলার পর প্রথম মনুষ্য সৃষ্ট মহাকাশযান হিসেবে সবে সে আন্তনক্ষাত্রিক শুন্যে পদার্পণ করেছে। এই ভাবে এগোতে থাকলে নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টুরি পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে তার 73000 বছর লেগে যাবে।
এর পরেও খারাপ খবর হলো যে আন্তনক্ষাত্রিক যাতায়াতের ক্ষেত্রে প্রকৃতি আমাদের মহাকাশযানের বেগ ও ত্বরণের মান বেঁধে রেখেছে। আইনস্টাইন দেখিয়েছেন কোনো বস্তুই আলোর চেয়ে অধিক বেগে যেতে পারে না। এক একটা গ্যালাক্সির ব্যাস 1,00,000 আলোকবর্ষেরও বেশি হওয়ার জন্য আলোর চেয়ে কম বেগে সেগুলো পার হতে গেলে তা একটা অভাবনীয় ব্যাপার হয়ে যায়। তবে হয়তো একদিন ভ্রমণের সময় কমানো সম্ভব হতে পারে। এটি কীভাবে করা যায় সে সম্পর্কে অনেকগুলো ধারণা রয়েছে, লেজার-ত্বরিত সৌর পাল থেকে পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহৃত মহাকাশযান পর্যন্ত। কিন্তু এমনকি এইসকল প্রযুক্তির সাহায্যে, আমরা মানুষের জীবনে খুব বেশি দূরে যেতে পারবো না। যদি আমরা পদার্থবিজ্ঞানের পরিচিত সূত্র ধরে এগোতে থাকি, তাহলে মনে হয় গ্যালাক্সি-বিস্তৃত মানব সভ্যতা এবং তাদের বিকাশ অসম্ভব।
যদি না আমরা Warp Drive তৈরী করতে পারি।
Warp Drive -- কল্পবিজ্ঞানের একটা অন্যতম প্রিয় বিষয়। তো এই জিনিসটা আসলে কি? আদৌ কি এটা তৈরী করা সম্ভব? দেখা যাক।
প্রথমে আসা যাক ওয়ার্প বা মোড়ানো ব্যাপারে। সুমহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী আমরা চার মাত্রিক স্থান-কালের মধ্যে বাস করি। এই স্থান-কাল স্থির বা অনড় নয়। একে প্রসারিত, বাঁকানো এবং ভাঁজ করা সম্ভব। এই চার মাত্রিক ক্ষেত্র দিয়ে অভিকর্ষীয় তরঙ্গ অগ্রসর হয়। সুতরাং একে বিকৃত করা যেতে পারে। Warp Drive এর ক্ষেত্রে বলা হয় সাধারণত স্পেসটাইমের আকৃতিকে বিকৃত করে মানে যাতে দুটি দূরবর্তী অবস্থানকে একত্রে কাছাকাছি আনা যায় - এবং আমরা কোনোভাবে তাদের মধ্যে "জাম্প" করে অগ্রসর হই।
এটাই হলো কল্পবিজ্ঞানগুলোর মূল ধারণা যা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। Star Trek সিরিজগুলো থেকেই এই Warp Drive নামটা জনপ্রিয় হয়েছে। অন্তত 1994 পর্যন্ত এটা পুরোপুরি কল্পনার আওতায় ছিলো। মেক্সিকান তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মিগুয়েল আ্যলকুবিয়ের (Miguel Alcubierre) 1994 সালে একটা গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। তাঁর নামানুসারে সেই প্রকল্পটির নাম Alcubierre drive রাখা হয়। আপেক্ষিকতাবাদ অনুসারে কোন কিছুই আলোর চেয়ে দ্রুত ভ্রমণ করতে পারে না। কিন্তু সামান্য সৃজনশীলতা প্রয়োগ করে, আ্যলকুবিয়েরে একটি পথ চিহ্নিত করেছিলেন। চতুর্মাত্রিক স্থান-কাল একটি বিছানার চাদরের মতোই ভারী বস্তু দ্বারা বিকৃত হয়। সেই চাদরের মধ্যে (বা স্থান-কালের মধ্যে) কোনো বস্তু শুধুমাত্র আলো দ্বারা নির্ধারিত গতিসীমা পর্যন্ত ত্বরান্বিত হতে পারে। অন্যদিকে চাদরটি (বা স্থান-কাল) নিজেই যে কোনো গতিতে বিকৃত হতে পারে, যেমন মহাবিশ্ব নিজেই বাস্তবিকই এইভাবে প্রসারিত হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিগ ব্যাং এর সময়ে মূল স্থানকাল কাঠামোটি এক সেকেন্ডের কয়েক ভগ্নাংশের জন্য আলোর চেয়ে বহু গুণ বেশি বেগে প্রসারিত হয়েছিল। আজও, এই প্রসারণশীলতা আমাদের থেকে অত্যন্ত দূরবর্তী ছায়াপথগুলিকে আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে চালিত করে চলেছে, যার মানে তাদের আলো আর আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারে না।
আ্যলকুবিয়েরে অনুমান করেছিলেন এটি ওয়ার্প ড্রাইভের একটি ছোট পদক্ষেপ। যদি স্পেসটাইম একটি স্পেসশিপের সামনে সংকুচিত হয় এবং তার ক্ষতিপূরণের জন্য সেই স্পেসশিপের পিছনে প্রসারিত হয়, তাহলে আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে গন্তব্যে যাওয়া সম্ভব হবে। জাহাজটি একটি বুদবুদের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে এবং তার মধ্যে মহাকাশ যাত্রীরা আন্তঃনাক্ষত্রিক যাত্রা অনুভব করতে পারবেন না। এটা অনেকটা একটা কনভেয়ার বেল্ট বা এসকালেটরের মতো, আপনি কল্পনা করতে পারেন যে আপনার পিছনের মেঝেটি আপনা থেকে তৈরি হচ্ছে এবং আপনার সামনে এটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তাই আপনি এগিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতার ভাষায় তৈরি হওয়া এই ধারণাটি তৎক্ষণাৎ বড় ধরনের ব্যবহারিক সমস্যার জন্ম দেয়। প্রথমত, স্পেসটাইমকে এত আমূলভাবে বিকৃত করার জন্য, একটি পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের চেয়েও পাতলা প্রাচীর দ্বারা আবদ্ধ একটি বুদ্বুদে একটি বিশাল পরিমাণে ভর আবদ্ধ করতে হবে। তাহলে বুদ্বুদটিকে বজায় রাখার জন্য দুটি ধরণের পদার্থের প্রয়োজন হবে। সাধারণ পদার্থের ভরের মাধ্যাকর্ষণ বুদ্বুদের সামনের স্থানটিকে সঙ্কুচিত করে পুরো কাঠামোটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু একই সময়ে, বুদবুদের পিছনের স্থানটিকে ক্রমবর্ধমান ময়দার তাল-এর(dough) মতো প্রসারিত করতে হবে। এবং সেই সম্প্রসারণ ঘটানোর জন্য, অ্যালকুবিয়েরের মতে, এক ধরণের অ্যান্টিগ্র্যাভিটি সৃষ্টিকারী কিছু ধরণের ঋণাত্মক শক্তির প্রয়োজন হবে।
আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E = mc^2 অনুযায়ী ঋণাত্মক শক্তি মানেই হলো তার তুল্য ঋণাত্মক ভর, যার কোনোটাই প্রকৃতিতে পাওয়া যায় নি। তাহলে কি হবে! এবার কোয়ান্টাম তত্ত্বে কি বলছে দেখা যাক। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, শক্তির প্রকৃতপক্ষে একটি ঋণাত্মক মান থাকতে পারে। এটি শুধুমাত্র বিরল ও বিশেষ ক্ষেত্রে ঘটতে পারে বলে মনে করা হয়, তবে - একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র স্কেলে। উদাহরণস্বরূপ, তথাকথিত Casimir effect -এ, কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত পরিমাণগুলি এতটাই ক্ষুদ্র যে কোনও প্রযুক্তিগত প্রয়োগকে অযৌক্তিক বলে মনে হয়।
2021 সালে Erik Lentz এবং Alexey Bobrick ও Gianni Martire এর গবেষণার ফলে একটা নতুন পথের সন্ধান পাওয়া গেল। Erik Lentz এর গবেষণায় Alcubierre ড্রাইভ থেকে আলাদা ধরনের মডেলের সন্ধান মেলে যাতে প্রচুর পরিমাণে ভর এবং শক্তির প্রয়োজন কিন্তু তা পজিটিভ বা সাধারণ ভর এবং শক্তি। এটা সেই বিকৃত স্থান-কালের অনেকটা ডায়মন্ড আকৃতির অঞ্চল গঠন করে। তবে এই মডেলে চার্জযুক্ত কণার একটি অত্যন্ত ঘন অবস্থা (যেরকম নিউট্রন তারার অভ্যন্তরে পাওয়া পদার্থের মতো) দিয়ে তৈরি হওয়া রিং এবং ডিস্কের একটি জটিল স্তরবিন্যাসের প্রয়োজন হয়।
Alexey Bobrick ও Gianni Martire এর দেখিয়েছেন যে সমস্ত ওয়ার্প ড্রাইভ তিনটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত: (1) একটি বুদবুদের অভ্যন্তরীণ স্থানকাল অঞ্চল যাকে প্যাসেঞ্জার স্থান বলা হয়; (2) ধনাত্মক (অথবা ঋণাত্মক) শক্তি সহ উপাদানের একটি শেল, যাকে ওয়ার্পিং অঞ্চল বলা হয়; এবং (3) একটি বাইরে, যথেষ্ট দূরে স্বাভাবিক পরিচিত স্থানকালের মতো দেখায়। তবে তাঁদের মতে সাধারণ ধনাত্মক শক্তি দিয়েই ওয়ার্প ড্রাইভ তৈরি করা সম্ভব। বুদবুদটির মধ্যেও স্থান-কাল বেঁকে থাকবে। বুদবুদের ঠিক মাঝখানে একটি স্পেসশিপে ভ্রমণকারীদের কাছে তাদের ঘড়িগুলি বাকি স্থানের তুলনায় ধীর গতিতে চলবে। সুতরাং যদিও সেটা আমাদের সাপেক্ষে আলোর চেয়ে কম গতিতে চলবে, তবুও মহাকাশ যানের ভিতরে থাকা যাত্রীদের কাছে তা আলোর চেয়ে বেশি গতিতে এগোতে থাকবে।
মহাকাশযাত্রীদের কাছে সময়ের এই ধীরগতিতে চলা খুব প্রয়োজনীয় হলেও প্রকৃতপক্ষে আমাদের সাপেক্ষে তার ত্বরণ আলোর চেয়ে বেশি হবে না। তাছাড়া স্পেসশিপের চারপাশের স্থান-কালের অতি বিকৃতির কারণে তার ভিতরে থাকা যাত্রীদের স্পেসশিপটিকে কন্ট্রোল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বিজ্ঞানীদের মতে এই সমস্যাগুলোকে ভবিষ্যতে অতিক্রম করা সম্ভব হবে। ওয়ার্প ড্রাইভের ধারণা একেবারেই অবাস্তব নয়। আগামী দিনে এটা সম্ভব হতে চলেছে। আন্তনক্ষাত্রিক যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে Warp Drive ছাড়াও আরও কয়েকটি মাধ্যম সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা চিন্তা ভাবনা করছেন, যেমন হোয়াইট হোল (ব্ল্যাকহোলের বিপরীতে থাকা তাত্ত্বিকভাবে উপস্থিত মহাজাগতিক গঠন) অথবা ওয়ার্ম হোল (আইনস্টাইন-রোজেন ব্রীজ) প্রভৃতি। একমাত্র উন্নত বিজ্ঞানই পারবে আমাদের সেই জায়গায় পৌঁছে দিতে।
লিখাঃ সরোজ নাগ
তথ্য ইন্টারনেটের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
চিত্র পরিচিতি - একটি Warp Drive এর কাল্পনিক রূপরেখা। স্পেসশিপের পিছনে উলম্বভাবে দেখানো ডাইমেনশনটি স্থান-কাল কতটা মাত্রায় প্রসারিত হচ্ছে তা দেখায়। এই স্থান-কাল মহাকাশ যানের পিছনে প্রসারিত হয়ে যানটিকে সামনের দিকে চালনা করে। অপরদিকে স্পেসশিপের সামনে স্থান-কালের সংকোচন পিছনের প্রসারণকে ব্যালেন্স করে স্পেসশিপকে ঘিরে থাকা বুদবুদকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।