জন্মান্তর বা পুনর্জন্ম কি সম্ভব?



জন্মান্তর বা পুনর্জন্ম কি সম্ভব - এ ধরণের প্রশ্ন প্রায়ই দেখি। কেউ কেউ আবার কিছু গুরুত্বহীন কথিত গবেষণাপত্রের সন্ধান দিয়ে এর পক্ষে জোর তর্ক শুরু করেন, এতে নষ্ট হয় সময়। তাই এটা লেখতে হল। সবাই যতটুকু সম্ভব ধর্মকে এড়িয়ে বিজ্ঞান-নির্ভর আলোচনা করবেন।


আগে দেখি জন্মান্তর জিনিসটা কী। 

জন্মান্তরের বিভিন্ন ধারণা রয়েছে। উপমহাদেশে যে ধারণা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত সেটা হচ্ছে, আত্মা অবিনশ্বর। কোনো জীব মারা যাওয়ার পর তার আত্মা এই দেহ ছেড়ে নতুন দেহে আবার জন্ম নেয় তার কর্মফল অনুযায়ী। কেউ ভাল কাজ করলে তার পরজন্মে সে একটা ভাল জীবন পাবে, মন্দ কাজ করলে মন্দ। আমরা পুরনো কাপড় ফেলে দিয়ে যেভাবে নতুন কাপড় পরি - আত্মার জন্য ব্যাপারটা এরকম। মোক্ষলাভ পর্যন্ত এটা চলতে থাকবে। 

আপাতত আত্মার ধারণা বাদ দিয়ে আমরা দেখি আসলে কি কোনো মানুষকে আবারও জন্ম দেয়া সম্ভব, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে।   

ধরেন একটা লোক, নাম তার যধু। এখন এই যধুর মত হুবহু একটা লোক বানানো হল বা কোনো প্রক্রিয়ায় জন্ম নিল; তার নাম দিলাম মধু। এই যধু আর মধু কখনো একই ব্যক্তি হবেনা। যদিও তারা একেবারেই একজন আরেকজনের কপিপেস্ট।  কেন এক হবেনা? কারণ তারা আসলেই ভিন্ন লোক। একজন ব্যথা পেলে নিশ্চয় আরেকজন পাবেনা। একজন সুখ পেলে আরেকজন পাবেনা। 

আবার জেনেটিক্যালি একই রকম হলেও দুইজন মানুষের ক্ষেত্রে হুবহু একই রকম পরিবেশ অসম্ভব। মানুষের আচরণ-চরিত্র-দর্শনের উপর পরিবেশ তথা অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-ভৌগলিক-শিক্ষাগত অবস্থার ব্যাপক প্রভাব আছে। যধু যদি বাংলাদেশে চোর হয়, মধু যদি বেড়ে উঠে  জাপানে, সে হয়ত হবে একজন পুলিশ অফিসার। আবার যধুর অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে সে হয়ত লেখাপড়া করেনি, কিন্তু মধু হয়ে গেল একজন নামকরা গবেষক।  আবার উল্টোটাও হতে পারে। মধু হয়ত বাজে লোকের চক্করে পড়ে উন্নত দেশে থেকেও হয়ে গেল খুনি, কিন্তু চোর হল না।

এগুলো বুঝার জন্য সদৃশ জমজদের কথা ভাবেন। দুজনের মধ্যে জেনেটিক মিল এত বেশি থাকার পরও দুজন ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন ধরণের মানুষ।  কাউকে ক্লোন করে হুবহু তার মত কাউকে জন্ম দিলেও সে ভিন্ন একটা মানুষ।  

এখন অন্যভাবে চিন্তা করি। ধরি যধু মারা গেল। মারা যাওয়া মানে তার দেহ-মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ বিকল, ধীরে ধীরে ডিকম্পোজড হয়ে পুরোপুরি মেশে গেল মাটিতে। এখন কেউ তার এই দেহ উপকরণ সংগ্রহ করে এ থেকে পুনরায় একই মানুষ তৈরী করল( এটা কল্পনা করে নিতে হবে, বাস্তবে সম্ভব নয়) । তাহলে কী হবে? না, তাহলেও সে আর যধু হবেনা। সে হবে যধুর কপি-পেস্ট। এখন এই কপিপেস্টকে যধুর কোন কৃতকর্মের দায় দেয়া যাবেনা, পুরস্কৃতও করা যাবেনা। একারণে মৃত্যুর পর কারো যদি পুনরায় জন্ম হয়ও, সে মানুষটি আর আগের মানুষ নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। এটা কি বুঝা গেল?

আরেকটু অন্যভাবে চিন্তা করি।  যধু বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে এখানেই থেকে গেলে সে এদেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-ভৌগলিক-শিক্ষাগত কারণে যেরকম মানুষ হবে তা থেকে অনেক ভিন্ন একটা মানুষ হবে তাকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দিলে, ধরেন ছোটবেলায়ই।  এর মানে হচ্ছে একজন মানুষ নিজের আচরণ ও কৃতকর্মের জন্য নিজে শতভাগ দায়ী নয়, পরিবেশের দায় বিশাল।  আপনার কথাই চিন্তা করেন। জীবনেও কখনো স্কুলে না গেলে আপনি যেরকম মানুষ হতেন এর সাথে কী বর্তমানে আপনি 'যা', এর সাথে কোন মিল আছে? আপনি গরু-রাখাল হলে বা কৃষক হলে বা রিক্সা ড্রাইভার হলে আরেক মানুষ হতেন। আইনজীবি হলে এক মানুষ আর শিক্ষক হলে বা ব্যবসায়ী হলে অন্য মানুষ হতেন।  ২০ হাজার টাকার চাকরি করলে এক মানুষ হতেন আর এক লক্ষ টাকার চাকরি করলে অন্য মানুষ হতেন।  দরিদ্র পরিবারে কুড়েঘরে জন্মালে এক মানুষ হতেন আবার বিলিয়নিয়ারের ঘরে জন্মালে অন্য মানুষ হতেন। এই একই মানুষ চিন্তা-চেতনা-আচরণ-উপলব্ধিতে বেশ  ভিন্ন হতেন। আবার বয়সও একটা ফ্যাক্টর। কেউ কম বয়সে অপরাধী হয়, একটু বয়স হলে ভাল মানুষ হয়; উল্টোটাও ঘটে। তাই একজন অপরাধী সংশোধনের সুযোগ না পেয়ে হুট করে মরে গেলে এর দায় কাকে দেয়া যায় বুঝা মুশকিল। এ আলোচনা থেকে এটাও বুঝা যায় যে, কোনো মানুষের আসলে একক কোনো অস্তিত্ব নাই। তাই একটা মানুষের পুনর্জন্ম কথাটারও নির্দিষ্ট কোনো অর্থ নাই। কারণ সে একেক পরিবেশে, একেক বয়সে একেক রকম। 

এখন আবার আত্মার ধারণায় ফিরে আসি। একই উদাহরণ। যধু মারা গেল। তার আত্মা গিয়ে আরেকটি দেহধারণ করল যার নাম মধু। মধুর মধ্যে যধুর সূক্ষদেহ অবস্থান করছে। তাই মধু হচ্ছে যধুর পরজন্ম। যধুর কর্মফল ভোগ করবে মধু। 

এই ব্যাপারটি কেন সম্ভব নয় বলছি। আগেই আমরা দেখেছি এমন কোনো উপায় নেই যে হুবহু একই লোককে আবার জন্ম দেয়া যাবে; হুবহু একই দৈহিক ও জেনেটিক বৈশিষ্ট্য থাকলেও না। অথচ দুটি ভিন্ন সময়ের ভিন্ন দৈহিক ও জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের দুটো মানুষকে একজন আরেকজনের পরজন্ম বলা হচ্ছে কারণ কথিত আত্মা নাকি একজনের মারা যাওয়ার পর আরেকজনের দেহকে ধারণ করেছে। এ থেকে বুঝা যায়, আত্মা জিনিসটাই ভুয়া। ভিন্ন দেহ হলে এর মধ্যে বায়বীয় বা অদৃশ্য আত্মার বিনময় হয়ে দুই ভিন্ন লোক একজন আরেকজনের পরজন্ম হওয়ার দাবি কোনো সেন্স মেইক করেনা। যা সকল মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে, এক দেহ থেকে আরেক দেহে যাচ্ছে অথচ এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া গেল না। 

আমরা আমাদের অস্তিত্ব অনুভব করি মস্তিষ্ক দিয়ে, সেন্সলেস হলেই অনুভুতি হারিয়ে ফেলি। মস্তিষ্কই সকল অনুভূতি আর আবেগের কারণ, কথিত আত্মা বা এরকম কিছু নয়।  যারা পুনর্জন্মের ধারণা তৈরী করেছেন তারা জানতেন না মানুষের বা জীবের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে, মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সম্পর্কে, মানুষের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে। 

যেখানে যধু-মধু দুজন ভিন্ন লোক, সেখানে একজন আরেকজনের কর্মফল ভোগ করবে কেন? কোনো মানে হয় এগুলোর? 

আগের আলোচনা থেকে দেখেছি, একজন মানুষকে তার কৃতকর্মের জন্য শুধু তাকে দায় দিয়ে তার ব্যাপার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সেটা হবে অগ্রহণযোগ্য, পরিবেশের ভূমিকা বিবেচনায় আনতে হবে।  কাউকে শাস্তি হিসাবে নিম্নস্তরের প্রাণি হিসাবে জন্ম দেয়া ব্যাপারটি কেমন, ভাবেন।  আবার পৃথিবীতে শাস্তি দেয়ার মূল কারণ কাউকে সংশোধন করা, তাহলে মৃত্যুর পরে শাস্তি দেয়ার আসল কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছিনা।  এটা থাক, আলোচনা ভিন্নদিকে চলে যাবে।

অনেক বাচ্চা নিজেকে দাবি করে সে এর আগে নাকি কোথাও জন্ম নিয়েছিল। এগুলো নিয়ে অনেকে নাকি সিরিয়াস(আসলে গার্বেজ) গবেষণাও করে ফেলেছে।  বাচ্চারা খুব কল্পনাপ্রবণ হয়, হাজারো জিনিস ভাবে-বলে-স্বপ্ন দেখে। এরকম কোটি কোটি বাচ্চার মধ্যে কিছু বাচ্চা যদি বলে সে আগে একবার জন্ম নিয়েছিল তবে একে নিয়ে উল্লসিত হওয়া আহম্মকি।  এছাড়া মা-বাবার কাছ থেকে, আশেপাশের কেউ বা কোন বন্ধুর কাছ থেকে, টিভি বা ভিডিও দেখে জন্মান্তরের চিন্তা তার মাথায় আসতেই পারে।

বিজ্ঞানের আলোয় দূর হয়ে যাক সকল কুসংস্কার, সকল অন্ধকার।

Writer: Alam Jaha

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম