নিমের ঔষধি ঔষধি গুন



পরিচিতি:   নিম একটি ঔষধি গাছ। এর ডাল, পাতা, রস, সবই কাজে লাগে। নিম একটি বহু বর্ষজীবি ও চির হরিত বৃক্ষ। প্রায় হাজার বছর ধরে নানা রোগের চিকিৎসায় নিম পাতা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কৃমিনাশক হিসেবে নিমের রস খুবই কার্যকর। নিমের কাঠ খুবই শক্ত। এ কাঠে কখনো ঘুণ ধরে না। পোকা বাসা বাঁধে না। উইপোকা খেতে পারে না। এ কারণে নিম কাঠের আসবাবপত্রও তৈরি করা হচ্ছে আজকাল। এছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই বাদ্যযন্ত্র বানানোর জন্য কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। এর উত্পাদন ও প্রসারকে উত্সাহ এবং অন্যায়ভাবে নিম গাছ ধ্বংস করাকে নিরুত্সাহিত করছে। নিমের এই গুনাগুনের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘোষনা করেছে। বিশেষ করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এতটাই শক্তিশালী করে তোলে যে ছোট-বড় কোনও রোগই ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারে না। নিম গাছের পাতা, ফল, ছাল বা বাকল, নিমের তেল, বীজ সমস্ত অংশ ব্যবহার করা হয়। বিশ্বব্যাপী নিম গাছ, গাছের পাতা, শিকড়, নিম ফল ও বাকল ওষুধের উৎকৃষ্ট কাঁচামাল হিসেবে পরিচিত। বর্তমান বিশ্বে নিমের কদর তা কিন্তু এর অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে ব্যহারের জন্য। নিয়মিত নিম পাতা খেলে উপকার পাবেন এভাবে। নিম ছত্রাকনাশক হিসেবে ব্যাকটেরিয়া রোধক হিসেবে কীট-পতঙ্গ বিনাশে, ম্যালেরিয়া নিরাময়ে,দন্ত চিকিতসায় ব্যাথামুক্তি ও জ্বর কমাতে, জন্ম নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়। 


 নিমের ঔষধি গুণগুলি হলোঃ

 ➢ কফজনিত বুকের ব্যথা: অনেক সময় বুকে কফ জমে বুক ব্যথা করে। এ জন্য ৩০ ফোটা নিম পাতার রশ সামান্য গরম পানিতে মিশিয়ে নিয়ে ৩/৪ বার খেলে বুকের ব্যথা কমবে। গর্ভবতী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এ ঔষধটি নিষেধ।

 ➢ শরীর বিষ মুক্ত হয়: Journal of Pharmacology এ প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুসারে প্রতিদিন নিম পাতা খাওয়া শুরু করলে লিভারের ক্ষমতা বাড়ে, যে কারণে রক্তে মিশে থাকা ক্ষতিকর টক্সিক উপাদানগুলি শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। ফলে নানা রোগ-ব্যাধির খপ্পরে পড়ার আশঙ্কা যেমন কমে, তেমনই মেটাবলিক রেটের উন্নতি ঘটতেও সময় লাগে না। 

 ➢ কৃমি: পেটে কৃমি হলে শিশুরা রোগা হয়ে যায় ও পেটে বড় হয়। চেহারা ফ্যকাশে হয়ে যায়। এ জন্য ৫০ মিলিগ্রাম পরিমাণ নিম গাছের মূলের ছালের গুড়া দিনে ৩ বার সামান্য গরমপানি সহ খাওয়ালে কৃমি ঠিক হয়ে যায়।

 ➢ উকুন নাশ: নিমের পাতা বেটে হালকা করে মাথায় লাগান। ঘন্টা খানেক পরে মাথা ধুয়ে ফেলুন। ২/৩ দিন এভাবে লাগালে উকুন মরে যাবে।

 ➢ চিকেন পক্সের দাগ মিলিয়ে যাবে: এক বালতি জলে গোটা পনেরো নিম পাতা ভিজিয়ে মিনিটপাঁচেক অপেক্ষা করুন। সময় হওয়া মাত্র সেই জল দিয়ে স্নান সেরে নিন। নিয়মিত নিম পাতা ভেজানো জলে স্নান করলে পক্সের দাগ দ্রুত মিলিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে নানা ত্বকের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমবে।

 ➢ খোস পাচড়া: নিম পাতা সিদ্ধ করে পানি দিয়ে গোসল করলে খোসপাচড়া চলে যায়। পাতা বা ফুল বেটে গায়ে কয়েকদিন লাগালে চুলকানি ভালো হয়।

 ➢ অজীর্ণ: অনেকদিন ধরে পেটে অসুখ। পাতলা পায়খানা হলে ৩০ ফোটা নিম পাতার রস, সিকি কাপ পানির সঙ্গে মিশিয়ে সকাল- বিকাল খাওয়ালে উপকার পাওয়া যাবে।

 ➢ পোকা-মাকড়ের কামড়: পোকা মাকড় কামড় দিলে বা হুল ফোটালে নিমের মূলের ছাল বা পাতা বেটে ক্ষত স্থানে লাগালে ব্যথা উপশম হবে।

 ➢ ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় : বর্ষাকালে মশার প্রকোপ খুব বেড়ে যায়, যে কারণে বছরের এই সময় ম্যালেরিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সময় থাকতে-থাকতে নিম পাতা খাওয়া শুরু করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ, এতে উপস্থিত Gedunin নামক উপাদান, ম্যালেরিয়ার মতো রোগকে দূরে রাখতে যেমন বিশেষ ভূমিকা নেয়, তেমনি ম্যালেরিয়ার চিকিৎসাতেও দারুণ কাজে আসে। আর যদি ঘরের প্রতিটা কোণায় অল্প করে নিম পাতা থেঁতো করে রেখে দিতেন পারেন, তা হলে নিমের (Neem) গন্ধে মশার উপদ্রব কমতে দেখবেন সময় লাগবে না।

 ➢ দাতের রোগ: নিমের পাতা ও ছালের গুড়া কিংবা নিমের চাল দিয়ে নিয়মিত দাত মাজলে দাত হবে মজবুত, রক্ষা পাবে রোগ থেকে।

 ➢ জন্ম নিয়ন্ত্রণে নিম: নিম তেল একটি শক্তিশালী শ্রক্রানুনাশক হিসেবে কাজ করে। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, নিম তেল মহিলাদের জন্য নতুন ধরনের কার্যকরী গর্ভনিরোধক হতে পারে। এটি ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই শুক্রানু মেরে ফেলতে সক্ষম। 

➢ মুখের দাগ দূর করতে: মুখের দাগ দূর করার সব থেকে ভাল ওষুধ হল নিম মুখে ব্রনের সমস্যা হলে চিন্তা করার দরকার নেই। নিম পাতার প্যাক মেখেই আপনি এর থেকে পরিত্রান পেতে পারেন। কি করে তৈরি করবেন এই প্যাকটা চলুন জেনে নিই। চার পাঁচটা নিম পাতা ভাল করে ধুয়ে মিক্সিতে পিষে নিন৷ এর মধ্যে এক চামচ মূলতানি মাটি, অল্প গোলাপ জল মিশিয়ে প্যাক তৈরি করুন৷ প্যাকটা যদি গাঢ় হয়ে যায় তাহলে ওর মধ্যে গোলাপ জল মিশিয়ে নিয়ে মুখে লাগিয়ে বেশ কিছুক্ষন রেখে দিন। প্যাকটা মুখে শুকিয়ে গেলে হালকা উষ্ণ জল দিয়ে মুখটা ধুয়ে ফেলুন। দেখবেন ব্রণ অনেক ভালো হয়েগেছে। 

 ➢ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: নিম পাতার গুঁড়ো রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে অনেক বেশি উপকারী। প্রতিদিন সকালে নিম পাতার গুঁড়ো খেলে ডায়াবেটিসের মতো রোগ দূরে থাকে। 

 ➢ ত্বকের জেল্লা বাড়ায়: নিম পাতার সঙ্গে সম পরিমাণ গোলাপের পাপড়ি আর চামচদুয়েক গোলাপ জল মিশিয়ে তৈরি পেস্ট মুখে লাগিয়ে ততক্ষণ অপেক্ষা করুন, যতক্ষণ না ফেসপ্যাকটা একেবারে ড্রাই হয়ে যায়। তারপর ঠান্ডা জল দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে বারতিনেক এইভাবে ত্বকের যত্ন (Neem Leaves for Skin) নিলে বলিরেখা তো কমবেই, সঙ্গে ত্বকের উপরে জমে থাকা মৃত কোষের স্তরও সরে যাবে। 

 ➢ নিম এবং লেবু :

 দশ-কুড়িটার মতো নিম পাতা নিয়ে শুকিয়ে নিন। এবার ড্রাই পাতাগুলি গুঁড়ো করে নিয়ে তার থেকে এক চামচ পাউডার নিয়ে তার সঙ্গে এক চামচ লেবুর রস এবং চামচ দুয়েক গোলপ জল মিশিয়ে তৈরি পেস্ট, মুথে লাগিয়ে ধীরে-ধীরে মিনিটদুয়েক মালিশ করুন। তারপর ঠান্ডা জল দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন। ত্বকের তেলতেলে ভাব তো কমবেই, সেই সঙ্গে কোনও ধরনের ত্বকের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও আর থাকবে না।

 ➢ চুলের যত্নে নিম : 

 ১| মাত্রতিরিক্ত চুল পড়ার মতো সমস্যা দূরে থাকবে মাত্রাতিরিক্ত হারে চুল পড়ার কারণে যাঁরা চিন্তায় রয়েছেন, তাঁরা আজ থেকেই নিম পাতা খাওয়া শুরু করুন। সঙ্গে নিম পাতার পেস্ট লাগান চুলে এবং স্ক্যাল্পে। এমনটা করলে চুলের গোড়ায় বেশ কিছু উপকারী ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ার কারণে চুল পড়ার হার তো কমবেই, সঙ্গে স্ক্যাল্পের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে। 

 ২| খুশকির প্রকোপ কমবে একটা বাটিতে চামচ পাঁচেক নারকেল তেল নিয়ে তার মধ্যে খান পাঁচেক নিম পাতা এবং কয়েক ফোঁটা লেবুর রস ফেলে মিশ্রণটি মিনিটপাঁচেক ফুটিয়ে নিন। এবার মিশ্রণটা একটু ঠান্ডা করে নিয়ে চুলে এবং স্ক্যাল্পে লাগিয়ে সারা রাত রেখে দিন। সকালে উঠে শ্যাম্পু দিয়ে ভাল করে চুল ধুয়ে নিন। প্রায় দিনই এই তেল চুলে লাগালে দেখবেন খুশকি কমে যেতে সময় লাগবে না।

 ৩| একজিমার চিকিৎসায় কাজে আসে নিম পাতায় উপস্থিত nimbidin নামক উপাদানটি একজিমার প্রকোপ কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

 ৪| চুলের জেল্লা বাড়ে বর্ষাকালে নানা কারণে চুলে এত জট পরে যে চুলের সৌন্দর্যের বারোটা বেজে যায়। এক্ষেত্রে নিম তেলকে কাজে লাগালে কিন্তু বেশ উপকার মিলবে।


 নিম পাতার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

 ➢ গর্ভবতী মায়েরা একেবারেই নিম পাতা খাবেন না - কারণ এই সময় নিম পাতা খেলে নাকি মা এবং বাচ্চার নানা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

➢ খালি পেটে নিম পাতা খাওয়া উচিত না - 

খালি পেটে নিম পাতা খেলে নানা উপকার মেলে ঠিকই। কিন্তু তাই বলে টানা এক মাসের বেশি খালি পেটে নিম পাতা খাবেন না তাতে উপকারের থেকে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। প্রয়োজনে এই বিষয়ে কোনও এক আয়ুর্বেদিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম