The City (Sci-fi)



১.

রুহিব শাওয়ার নিচ্ছে । তার স্ত্রী মল্লিকা রান্নাঘরে। মোরগপোলাও রান্না হচ্ছে। ১ টা বেজে গেছে। আজ রবিবার। ছুটির দিন বলে দুইজনই ঘুম থেকে দেরিতে উঠেছে। এতো দেরিতে আর নাস্তা করার প্রয়োজন নেই, তাই সোজা লাঞ্চ করবে।

মল্লিকা টেবিলে খাবার সাজাতে সাজতে ডাকলো,"কই গো! খেতে আসো টেবিলে।"

শাওয়ারের পানির শব্দে রুহিব কিছুই শুনতে পেলো না।

মল্লিকা আবার ডাকলো, "কই!"

রুহিবের সাড়া না পেয়ে ওয়াশরুমের দরজায় নক করলো। রুহিব শাওয়ার থামিয়ে বললো," দুইমিনিট আর। ওয়েট,আসছি আমি।"

মল্লিকা টেবিল সাজাতে চলে গেলো আবার।

রুহিব তাড়াতাড়ি শাওয়ার শেষ করে বের হলো।

এখন একসাথে বসে খাচ্ছে।

মল্লিকা বললো, "আব্বু কল দিয়েছিলো। রাশেদ নাকি মোটরবাইক এক্সিডেন্ট করেছে সকালেই। পায়ে নাকি প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে। মাসখানেক বেডরেস্টে থাকা লাগবে। চলো আজকে বিকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসি।"

"চলো।"

"আচ্ছা। সকালে আবার শুনলাম ২০৯ ফ্লাটের লতা আপার বাবা মারা গেছেন। বেচারি কি যে কান্না করতে করতে দৌড়ে গাড়িতে উঠেছে।"

"আহহা! কিভাবে মারা গেলেন?"

"ক্যান্সারের লাস্ট স্টেইজে ছিলেন নাকি। সকালে উঠে বডির কোনো নড়াচড়া না দেখে ডাক্তার চেক করে জানালেন যে হি ইজ নো মোর।"

"লতা আপা ফিরলে তাকে সহ কোথাও ট্যুর দিও। মুড ঠিক হবে তাহলে।"

"আচ্ছা।"

"অফিস থেকে মেইল পেলাম। এই বুধবারে একটা কনফারেন্স আছে কয়েকজন বিজ্ঞানীর সাথে। তাদের মধ্যে ফিজিসিস্ট আহমেদও আছেন।"

"কি বলো! তুমি তো বেশ বড় মাপের বিজ্ঞানী হয়ে গেছো। "

"কি যে বলো! তোমার থানার কি খবর বলো তো।"

"শহরে তো এখন আর তেমন কোনো গুরুতর অপরাধী পাওয়া যায় না। তাই আমাদের কাজও কম।"

"হ্যাঁ,তাও বটে। শহরটা এখন বেশ নিরাপদ।"

রুহিব অনেকক্ষণ ধরে একটা জিনিস নিয়ে ভাবছে। সে বললো, "শোনো আজকে সকাল থেকে একটা নতুন আইডিয়া মাথায় আসলো।"

"কী? বলো তো।"

"ভাবছিলাম যে আমরা যদি রাস্তায় গাড়ি চালানোর বদলে আকাশপথে যানবাহন চালাতে পারি তাহলে অনেক সময় বাঁচাতে পারবো। ভাবছি যে এতোদিনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এই আইডিয়া বুঝি আর কারো মাথায় আসে নি?"

মল্লিকা মুচকি হেসে বললো,"সবাই কি আর তোমার মতো বুদ্ধিমান নাকি! বেশ ভালো আইডিয়া তোমার। এটা নিয়ে গবেষণা শুরু করো।"

"সেটাই ভাবছি। দেখি। নিজে কিছু একটা নকশা বানিয়ে তারপরই কনফারেন্সে এটার কথা তুলবো। কাল থেকে ল্যাবে খাটা শুরু করবো।"

"তাই করো।"

খাওয়া শেষ করে রুহিব বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফিজিসিস্ট আহমেদের 'রহস্যময় জেনারেল রিলেটিভিটি' বই পড়তে শুরু করলো।

বিকালে দুইজন গেলো রাশেদকে দেখতে। দুই পায়ে প্লাস্টার করা। ডাক্তার এক মাস বেডরেস্টের কথা বললেও আগামী তিন চারমাস তাকে আস্তে আস্তে হাটতে হবে। সন্ধ্যার একটু পরেই তারা বাসায় ফিরে এলো। লাঞ্চের মোরগপোলাও অনেকখানি আছে। রুহিব একবেলার খাবার অন্যবেলায় খায় না। পিজ্জা অর্ডার করলো। ডিনার শেষে প্রায়ই মদে চুমুক লাগায়। জিনিসটা নাকি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাতে রুহিবের কিছু আসে যায় না।

শহরের নাম 'দ্যা সিটি'। শহরে নিম্নশ্রেণির কোনো মানুষ নেই। সবাই স্বচ্ছল। সবাই মোটামুটি শান্তিতে আছে বলেই মনে হয়। মদ হাতে ছাদ থেকে আকাশ দেখে বিলাপ করে রুহিব। মাথা ঘুরে হঠাৎ বমি করে দেয়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তার মনে হচ্ছে চাঁদ তার কাছে চলে আসছে। অনেক কাছে চলে এসেছে এখন। হাত বাড়াইলেই মনে হয় সে চাঁদ ছুতে পারবে।


২.

ডক্টর হ্যাসম্যান চিন্তিত গলায় বললেন," সব ঠিক আছে তো?"

ডক্টর হিপার বললেন," ইয়াহ। অল ওয়েল।"

"গ্রেট।"

"পরের নির্দেশনা এসেছে?"

"না। মেইল পাঠিয়েছি একটা বিকালে লাইভ মিটিংয়ের জন্য। দেখি কি নির্দেশ আসে।"

"আচ্ছা।"

"অমরত্বের স্বাদ কেমন মনে হলো?"

"শিওর না।"

"৫০তম চেকআপেও আপনি সন্তুষ্ট নন কি!?"

"প্রতি দশকেই ২/১ জন মরছে। একবিংশ শতাব্দীর সাধারণ মানবসমাজের মতো না হলেও এই অল্পস্বল্প মৃত্যুগুলো কিন্তু ভালো সংবাদ নয়। অ্যাক্সিডেন্ট আটকানো যাচ্ছে না।"

"তা হতেই পারে। কেউ-ই ভুলের উর্ধ্বে নয়। নিজেদের দোষেই তো মরছে। "

"আমরা সময়ের সাথে খেলছি শুধু। প্রকৃত অমরত্ব কিন্তু কেউ পাচ্ছি না।"

"প্রকৃত অমরত্বের সংজ্ঞা কি?"

"বায়োলজিক্যালি সব রোগ প্রতিকার বা প্রতিরোধ করে Aging প্রসেসকে বন্ধ করে দেওয়া।"

হ্যাসম্যান বিরক্তির সুরে বললেন, "আহহা! প্যানেসিয়ার মহৌষধ ছাড়া বাকি কোনো উপায়েই কি প্রকৃত অমরত্ব সম্ভব নয়?!"

"সম্ভব। তবে আমরা যা করছি তা কোনোভাবেই প্রকৃত অমরত্ব নয়। কারণ এ অমরত্ব ক্ষণস্থায়ী। মেশিনের কিছু হ....."

অপারেশনের লিড ফিজিসিস্ট রবার্তো ভিতরে ঢুকতেই সবাই দাড়িয়ে পড়লো।

হিপাররে দেখে আনন্দিত হয়ে রবার্তো জিজ্ঞেস করলেন,"চেকআপের কি খবর? রিপোর্ট বানিয়েছো চেয়ারম্যানের সামনে উপস্থাপনের জন্য?"

"সব পার্ফেক্ট চলছে বস। রিপোর্ট বানিয়েছি।"

"ওকে।"

"আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ডিসকাশনের জন্য মিটিং ডেকেছি। মিটিংয়ে কিছু ফাইনাল হলে সন্ধ্যায় চেয়ারম্যানের সাথে মিটিংয়ে অনুমতি চাওয়া যাবে। বিষয়টা হচ্ছে যে, আমরা সব ভলান্টিয়ারের মেমোরি সেভ করছি ঠিকই কিন্তু মেশিনের মেমোরির স্পেস কমে আসছে। আমাদের ধারণা এতো বেশি মেমোরির কারণে মেশিনের কাজে বিঘ্ন ঘটতে পারে। আপনাদের কি মত?"

হিপার বললো,"কিছু মেমোরি ডিলেট করতে হেড অফিস অনুমতি দিচ্ছে না কেন,বস?"

রবার্তো বললেন,"সার্বজনীন প্রয়োগের বেলায় এই মেমোরি বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত তথ্য অত্যন্ত কাজে দিবে বলে সবাই মনে করছি।"

হ্যাসম্যান বললো,"এসব তো র‍্যান্ডম মেমোরি। র‍্যান্ডম মেমোরি বিশ্লেষণ করে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে কি আদৌ?"

রবার্তো বললেন,"অসম্ভব না। ভবিষ্যতে এই মেমোরির প্রয়োজন পড়তে পারে।"

হিপার বললো," মেমোরির জন্য অন্য মেশিন ইউজ করা যেতে পারে কি? তাতে 'পিস' এর উপর থেকে চাপ কমবে।"

রবার্তো একটু ভেবে বললেন, "তা ভেবে দেখা যেতে পারে। মেশিনটা একচুয়ালি সবকিছুকে পূর্বের অবস্থায় নেওয়ার পাশাপাশি ইজিলি শহরে সিসিটিভির মতো সব মেমোরি জমা করে। অন্য মেশিন দ্বারা করলে সেটা কতোটা এফিশিয়েন্ট হবে তা নিয়ে শিওর না আমি। ডিএনএ মেমোরি চিপ যথাসম্ভব ছোট করার চেষ্টা চলছে। ইনাফ ছোট করলে তা মেশিনে ইনস্টল করা যেতে পারে চেয়ারম্যানের অনুমতি সাপেক্ষে।"

অন্যমনস্ক হয়ে হিপার কিছু একটা ভাবলেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মিটিংয়ে মনোযোগ দিলেন।


৩.

আজ রবিবার। ছুটির দিন। রুহিব সায়েন্টিস্ট হবার পাশাপাশি বেশ ভালো শেফও। আজ কাবসা রান্না করছে। অ্যারাবিয়ান ডিশ। খেতে অসাধারণ। মল্লিকা তার পুলিশি জীবন নিয়ে ল্যাপটপে প্রায়ই নোটস লেখে, বিশেষত ছুটির দিনে। মোটামুটি একটা বই প্রকাশ করার কথা ভাবছে সে। কলিংবেল শুনে দরজা খুলতে গেলো মল্লিকা। ২০৯ ফ্ল্যাটের লতা এসেছেন।

মল্লিকা বললো, "আরেহ আপা। কি অবস্থা? কেমন আছেন?"

"ভালো না আপা। মা'র শরীর প্রচন্ড বাজে। ডাক্তার বলছে একটা কিছু হয়ে যেতে পারে। বাবা ছোটবেলায় ছেড়ে গেলেন, এখন মায়ের এই অবস্থা।"

বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছে লতা। মল্লিকা তাকে ভিতরে নিয়ে বসালো। লতাকে পানি দিলো। পানি খেয়ে লতা বললো,"রাব্বি অফিসে গেছে। ছুটির দিনেও আর্জেন্ট যেতে হয়েছে। কল দিলাম। মিটিংয়ের কারণে সে যেতে পারছে না এখন। রাতে বাসায় আসলে আপনার থেকে চাবি নিতে বলেছি। বাসার চাবিটা রাখেন আপা।"

"আচ্ছা। রাব্বি ভাইয়ের জন্য রান্না করবো?আমাদের সাথে খাবেন কি?"

"না। সে বাইরের থেকে খেয়ে আসবে।"

"আচ্ছা।"

"আমাকে এখন যেতে হবে আপা। আসি।"

"আচ্ছা।"

লিফটে উঠতে যেয়ে তিনি আবার কাঁদতে শুরু করলেন। মল্লিকার তা দেখে কষ্ট লাগলো।  লিফটের গেট বন্ধ হতেই মল্লিকাও দরজা লাগিয়ে ভিতরে গিয়ে বসলো আবার নোট লেখতে। এর মাঝেই রাশেদ কল দিলো।

"কিরে কি অবস্থা?"

"এইতো আপা।"

"আব্বা কেমন আছেন?"

"ভালোই আছেন। তোরা কেমন আছিস আপা?"

"ভালোই। আব্বা আর পরীকে নিয়ে বেড়াতে আসতে পারিস না এখানে?"

"আরেহ তোদের বাসার এদিকেই এসেছি পার্কে। সকাল থেকে পরী মাথা খারাপ করে দিয়েছিলো ঘুরতে যেতে। অনেকদিন একসাথে ঘোরা হয় না।  তাই বের হলাম। আব্বা আসতে চাইলেন না। উনার বন্ধুরা নাকি আজ বাসায় আসবেন। তাদের সাথে গল্পগুজব করবেন।"

"আচ্ছা চলে আয় তাহলে বাসায়। বিকালে সবাই একসাথে আবার বের হবো।"

"আচ্ছা আপা।"

মল্লিকা ফোন রাখলো। রান্নাঘরে গিয়ে রুহিবকে জানালো তার ভাই ও ভাবীর আসার কথা।

দুপুরে রাশেদ ও তার স্ত্রী পরী আসলো। একসাথে খেয়ে সবাই বিকালে বের হলো ফসিল মিউজিয়াম দেখতে। অসাধারণ একটা মিউজিয়াম। চারশো ষাট কোটি বছরের বিবর্তনের ইতিহাসের ছোট্ট একটা বর্ণনা পাওয়া যায় এই মিউজিয়ামে ঘুরে আসলে। তাদের বাসায় ফিরতে রাত ৮ টা বেজে গেলো। রাশেদ আর পরী বাড়িতে চলে গেছে। মল্লিকা আর রুহিব তেমন একটা টায়ার্ড না। রুহিব কিছুক্ষণ রেস্ট করে ফিজিসিস্ট আহমেদের একটা বই হাতে নিলো। অনেকদিন আগে কিনে রেখে দিয়েছে এটা সে। এখনো পড়া শুরু করতে পারে নি। রুহিব শুয়ে শুয়ে বই পড়তে গিয়ে ঘুমিয়ে যায় সাধারণত। কিন্তু ফিজিক্সের বই পড়তে গিয়ে যে পরিমাণ ভাবা লাগে তাতে ঘুম আসার প্রশ্নই আসে না। বইয়ের নাম আবার 'রহস্যময় জেনারেল রিলেটিভিটি'। এই রহস্য শব্দটা বিজ্ঞানের প্রায় সব বইতেই পাওয়া যায়। বিজ্ঞানে সত্যিকারে যতো রহস্য নাই তার থেকে বেশি রহস্য বোধহয় এই রহস্য শব্দটায়। বিজ্ঞানের বইগুলাতে রহস্য রহস্য করতে করতেই সহজ অনেক টপিক লেখকরা জটিল করে তোলেন। এরা নিজেরাই আদৌ সেসব বুঝে কিনা সন্দেহ। এই সহজ বিষয় জটিল করা বই পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়েই হয়তো রুহিব ঘুমিয়ে গেছে। মল্লিকার অনেক ডাকার পর রুহিব ঘুম থেকে উঠেছে। ডিনার করে দুইজনে ছাদে গেলো। আজ পূর্ণিমা। কোনো এক পূর্ণিমার দিনেই মল্লিকা রুহিবকে প্রপোজ করেছিলো। সেদিনটা মল্লিকার চোখে ভাসে। রুহিবের হাত সে শক্ত করে ধরে। রুহিব হাত শক্ত করে ধরার কারণ বুঝতে পারে নি। তার সেদিনের কথা মাথায় আসছে না। সে চুপ করে নিস্তব্ধ ছাদে বসে চাঁদ দেখছে আর বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। রাতে দুজন ছাদের বেঞ্চেই একে অপরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।


৪.

"২৯/০২/২৮০৮

প্রযুক্তি প্রচুর এডভান্স হলেও টাইম ট্রাভেল এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। অনেক উপায়ে টাইম ট্রাভেলের উপর পরীক্ষা চলছে। কিন্তু সব একমুখী। টাইম ট্রাভেল যারা করেছেন এখন অবধি কেউ-ই ফিরে আসেন নি। টাইম মেশিনে থিওরিটিক্যালি কোনো সমস্যাই নাই। প্রজেক্টের বিজ্ঞানীদের ধারণা তারা অন্য টাইমলাইনে চলে গেছে যেখান থেকে এই টাইমলাইনে ফেরা সম্ভব না। অন্য উপায়ে ফিউচারে যাওয়া সম্ভব। টাইম ডায়ালেশনের মাধ্যমে। টাইম ডায়ালেশনে ব্যক্তির সাপেক্ষে সময়ের গতি স্লো করে দেওয়া হয়। বাইরের দুনিয়ায় যখন অনেক সময় পার হয়ে যার তখন মেশিনের ভিতরের সব বস্তু বা ব্যক্তির সময় খুবই অল্প পরিমাণে বাড়ে। এভাবে অনেকেই গিয়েছে ভবিষ্যতে। কিন্তু ভবিষ্যতে যাওয়ার পর বর্তমানটসাপেক্ষে অতীত হয়ে যায়। অতীতে টাইম ট্রাভেল এখন অবধি সম্ভব হয় নি। ভবিষ্যতেও তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কেননা তাহলে আমরা ভবিষ্যতের অনেককেই বর্তমানে খুঁজে পেতাম।

তবে অতীতে ট্রাভেলের কাছাকাছি কিছু একটা করা গেছে যাতে আপাতভাবে অমরত্বও সম্ভব মনে হচ্ছে। গবেষণা চলছে।

বিশাল একটি স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে একটা শহর। স্যাটেলাইটকে বিভ্রান্ত করাসহ এই শহরের অস্তিত্ব গোপন রাখার সকল ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নেওয়া হয়েছে কয়েক লাখ ভলান্টিয়ার। এদের সবাইকে জানানো হয়েছে যে এরা অমর হয়ে যাবে এই প্রজেক্টের আওতায়। কিন্তু এই প্রজেক্ট আরো বেশি জটিল। সবার মেমোরি পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকে শহরে একটা করে ক্যারেক্টার এবং ক্যারেক্টার অনুযায়ী অতীতের মেমোরি পেয়েছি। একদিন পার হলেই Peace মেশিনটা এই শহরের সব কণাকে ১ দিন পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়। অর্থাৎ এই মেশিন সকল কণার বেগ এবং অবস্থান একই টাইমে পার্ফেক্টলি ক্যালকুলেট কর‍তে সক্ষম! সব কণা ১ দিন পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ায় ক্যারেক্টারদের নিত্যদিনের মেমোরিও মুছে যায়। আবার সিসিটিভির মতো শহরের সবকিছুই মেশিনটা তার ডিএনএ মেমোরিতে স্টোর করে। ক্যারেক্টাররা যতো দিনই কাটাক না কেন তাদের নতুন কোনো মেমোরি থাকবে না। তারা একই অতীত স্মৃতি নিয়ে নতুন দিন শুরু করে। শারিরীক কোনো পরিবর্তনও হয় না। সব পূর্বের অবস্থায়। কিন্তু অন্য সকল স্বাভাবিক শহরের মতো এখানেও মৃত্যু ঘটে, যদিও তা খুবই কম। মৃতের শরীরের সকল কণাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিলে সে শরীরে তৈরি হয় নতুন কোনো কনশাসনেস, নতুন কোনো ব্যক্তিত্ব। তাকে শহরে অবস্থান করাতে হলে আরো অনেক সমস্যা ট্যাকেল করা লাগে। সেসব সমস্যা কেউই ফেইস করতে চায় না। তাই মৃত ব্যক্তিকে পূর্বাবস্থায় ফেরানো হয় না। সে শহরের সব জীব, সব বস্তুর স্মৃতি থেকে বিদায় নেয় চিরকালের জন্য।

বাইরের দুনিয়া প্রচুর এডভান্স হলেও ভিতরের দুনিয়ার সবাই ব্যবহার করছে একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি। ধারণা করা হয়েছিলো তাদের বেশি উন্নত প্রযুক্তি দিলে তারা এই একদিনের নতুন মেমোরি দিয়েই হয়তো 'দ্যা সিটি'র সব রহস্য উদঘাটন করে ফেলবে।

'দ্যা সিটি' প্রজেক্টের সার্বিক দায়িত্বে আছে প্রায় ১২০০ জনের টিম। সবকিছু পরিচালনা করা হয় হেডঅফিস থেকে। চেয়ারম্যানের সাথে প্রায়ই লাইভ মিটিং হয়, অর্থাৎ তার একটা প্রজেকশন আমাদের সামনে এসে যাবতীয় নির্দেশনা দেয় ও মত বিনিময় করে। প্রজেক্টের টিমের জন্য আছে বিলাসবহুল অত্যাধুনিক সব ল্যাব ও বসবাসের জায়গা।"

"তুমি কি করছো?ঘুমাবে না?"

টেবিলে লাইট জ্বালানো দেখে হিপারের স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেছে।

চশমা খুলে হিপার বললো, "এইতো ঘুমাবো। ডায়েরি লিখছিলাম।"

"আসো।"

"আচ্ছা।"

এখনকার দিনে কেউই ডায়েরি লেখে না। অত্যাধুনিক কম্পিউটার আছে মাইন্ড রিড করার জন্য। যা ভাবা হবে কম্পিউটার তা-ই নোটে লিখে ফেলবে। স্মার্ট ওয়াচেও এখন এরকম আধুনিক কম্পিউটার থাকে। হিপার তবুও ডায়েরিতে নিজের হাতেই লেখে। তাতে ডায়েরির প্রতি মায়া কাজ করে। মায়া জিনিসটা দারুণ।

৮ হাজার একরের বিশাল এলাকায় 'দ্যা সিটি' প্রজেক্টের পরিচালনা টিমের অফিস। অফিসের ভিতরেই বিশাল বিশাল লেক, বাগান,পার্কসহ সবকিছু আছে যা একটা মানুষকে কখনোই প্রকৃতির কোল থেকে দূরে নিবে না। এখানে নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে পারা যায়। মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে উন্নত হতে হতে এমন উন্নতই হয়ে গেলো যে এরা আবার প্রকৃতির কোলে ফিরে আসলো। অনেক দিন মাকে ছেড়ে দূরে থেকে আবার ফিরে আসলে মা যেমন আদর-যত্নে কোনো কার্পণ্য করেন না, নিজের পুরাটা উজাড় করে দেন সন্তানের জন্য, প্রকৃতিও তেমন আদর করে মানুষকে আবার কোলে তুলে নিয়েছে। হিপারের বাসার চারপাশে বিস্তৃত ফুলের বাগান। বাসার ভিতরেও টবে অনেক গাছপালা। মাথার উপরে কাঁচের ছাদ। পরিষ্কার গ্রহ,নক্ষত্রমন্ডলী,চাঁদ দেখা যাচ্ছে। এই প্রকৃতির কোলে শুয়ে চোখ বুজলেই ঘুম চলে আসে। সে যে কি শান্তির ঘুম!


৫.

২৯/০১/২৬০৮

বিশ্বের সব বড় বড় নেতা, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীরা অবশেষে 'পিস প্রজেক্ট'-এ একমত হয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যে সবাই দ্যা সিটি'তে স্থানান্তরিত হবে।

প্রফেসর রুহিব ব্রিফ প্রেজেন্টেশন দিচ্ছেন।

"এক শতক আগের স্ট্যাটিস্টিক্স অনুযায়ী মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে ২৯০ বছর হওয়ার কথা। কিন্তু গত এক শতকেই ৬ টা বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। বিশ্বের জনসংখ্যা বর্তমানে এক শতক আগের তুলনায় মাত্র 0.009%। এমতাবস্থায় বিশ্বের সকল দেশ ও দেশের প্রতিনিধি কর্তৃক গৃহীত হয়েছে 'পিস প্রজেক্ট', যাকে মিডিয়া 'দ্যা সিটি প্রজেক্ট' নামেও অবহিত করছে। এই প্রজেক্টের আওতায় মানুষদেরকে নতুন ক্যারেক্টার দিয়ে প্রবেশ করানো হবে 'দ্যা সিটি' শহরে। সেখানে সবাই 'পিস' মেশিনের মাধ্যমে অমর হয়ে যাবে। মেশিন রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করবে এক পরিচালনা টিম। মেশিনে কোনো প্রকার সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা দুই হাজার সেক্সট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। তবুও যদি কোনো কারণে মেশিন বন্ধ হয়ে যায় সাথে সাথে সবাই তাদের বর্তমানের মেমোরি ফিরে পাবে। 'দ্যা সিটি'-তে সব প্রযুক্তি থাকবে একবিংশ শতকের। এটি হবে একটি স্বর্গ বানানোর প্রজেক্ট।"

সবার হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠলো পুরো সভা।

প্রফেসর আহমেদের বেশ কাছের জুনিয়র রুহিব। দুইজন ছাদে মদ নিয়ে বসেছে। ছাদে দুইটা সোফা আর সামনে টেবিলে মদ। প্রজেক্ট অবশেষে সর্বজনস্বীকৃত হয়েছে। অবশ্য অনেকে এর নেগেটিভ ইফেক্ট নিয়েও কথা তুলছে, সমালোচনা চলছে। কিন্তু মানবসভ্যতা এখন প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। যে হারে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং সব রাষ্ট্র নিজেদের গোপন ক্ষেপণাস্ত্র বানানো শুরু করেছে তাতে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কোনো উপায় ছিলো না।

আহমেদ দুই পেগ খেয়েই তোতলামো শুরু করেন সাধারণত। চার পেগের পর হুশ থাকে না।

রুহিবের কিছু জানার ছিলো। তার মনে হচ্ছে প্রজেক্ট নিয়ে আরো কিছু জিনিস সে জানে না।

প্রফেসর আহমেদ ৩ পেগ খাওয়ার পর রুহিব বলতে শুরু করলো,"বস, প্রজেক্টের পরিচালনা টিম যদি হঠাৎ বিশ্বাসঘাতকতা করে?"

প্রফেসর আহমেদ হেসে ফেললেন। মদ খাওয়া অবস্থায় তিনি বুঝে হাসছেন নাকি না বুঝে তা বোঝা যাচ্ছে না।

রুহিব আবার বললো,"বস,হাসছেন যে? সম্ভাবনা কি উড়িয়ে দেওয়া যায় ব্যাপারটার?"

প্রফেসর আহমেদ হাসতে হাসতে জবাব দিলেন," আরেহ পরিচালনা টিম তো হলো পুতুল। এদেরকে তো পরিচালনা করার কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। 'পিস' মেশিনটা স্বয়ংক্রিয়। পরিচালনা টিম রাখা হচ্ছে সবাইকে আশ্বস্ত করার জন্য। পাশাপাশি কিছু প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা এটা-সেটা কোনো সমস্যা হলে সেটা দেখবে পরিচালনা টিম। তাদের লিডার হবে আমার বানানো সর্বকালের সেরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। তাকেও সরাসরি মেশিনের কোনো নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হবে না। পরিচালনা টিমের সবাই আমাদের মতোই ক্যারেক্টার পাবে। তারা ভাববে যে তারা মানবজাতির অগ্রযাত্রায় বিশাল ভূমিকা রাখছে আসলে তো...."

মাতাল অবস্থায় মানুষ কি করে হুশ থাকে না। রুহিবের একটি প্রশ্নে প্রফেসর আহমেদ পুরো বৃত্তান্তই বলে দিলেন।

একটু থেমে আবার বলার চেষ্টা করলেন প্রফেসর আহমেদ," আসলে তো তারা....."

বলতে বলতে অতিরিক্ত হাসতে গিয়ে হঠাৎ মুখভরে বমি করে দিলেন। রুহিব তাকে ধরে সোফায় বসালো। কি যেন বলতে বলতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।

রুহিবের আর কিছু জানার প্রয়োজন নাই। তাই প্রফেসর আহমেদকে আর ঘুম থেকে জাগানোর প্রয়োজন নেই।

কালকে থেকে অনেক কাজ। প্রজেক্ট সবার সমর্থন পেয়েছে। এবার সবকিছু পার্ফেক্টলি এক্সেকিউট করতে হবে। রুহিব সোফায় শুয়ে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন। পাশে অনেক তারা ঝলমল করছে, মনে হচ্ছে যেন জ্বলছে আর নিভছে। রুহিবের আকাশ দেখতে দারুণ লাগে।


ইমদাদুল হক আফনান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম