1.
শহরের তিনশ তের নম্বর সেক্টর থেকে ইমারজেন্সি সংকেতের তীব্র সাইরেন বেজে ওঠার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে দুটি ছোট ঘটনা ঘটে গেল । উত্তর পূর্বান্ঞলের পাওয়ার সাপ্লাইয়ের গোটা প্ল্যান্টটা মাটিতে মিশিয়ে দিলো কিছু 'দুষ্কৃতিকারী' । খানিক পরই তিনশ তের নম্বর সেক্টরে শহরের সবচেয়ে বড় ইনফ্যান্টারি ফার্ম থেকে চুরি হল একুশটি শিশু ।
প্রচারমাধ্যমে শিশু চুরির ব্যাপারটা খুব সাবধানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে । শুকনো চেহারার এক সংবাদপাঠিকা, যে নিঃসন্দেহে একটি লিবন-7 মাত্রার রোবট , পাওয়ার প্ল্যান্ট এ বিস্ফোরণ ঘটানো 'অপরাধী ' দের দ্রুতসময়ের মধ্যে গ্রেফতার করার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে বারবার ।
2.
ত্রিমাত্রিক স্ক্রিনে সংবাদটি দেখে সরু গোঁফের নিচে বিচিত্র একটা হাসি ফুটে ওঠে রুহান রুমাসের । তার পরিচিতরা শুধু রুহান বলে ডাকে ।
পশ্চিমান্ঞলের একটি অখ্যাত রেস্তোরায় বসে বিষাদ একটি পানীয় গিলছে সে আশ্চর্য নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে । আপাত নিরীহদর্শন এই যুবকটি তার ইস্পাতকঠিন মনোবল দিয়ে সঙ্গী সবার আস্থাভাজন হয়ে আছে ।
রেস্তোরার ভিড় আর সার্ভ করা পি-টু মডেলের রোবোটগুলোর চোখ এড়িয়ে সাবধানে যোগাযোগ মডিউলে স্পর্শ করল রুহান । প্রায় নিঃশব্দ গলায় প্রধানকে জানালো, ' মিশন সফল, প্রফেসর '। বৃদ্ধ প্রফেসর রাউলের জড়িমা মেশানো মৃদু হাসি ভেসে এলো ।
' কোথায় আছো? '
জবাব শুনে চিন্তিত গলায় সিটি গার্ডদের ব্যাপারে সতর্ক করলেন বৃদ্ধ রাউল ।
সিটি গার্ড ঐ অখ্যাত রেস্তোরায় খোঁজ নিতে আসবে না, রুহানের এই কথায় দ্বিমত এলো রাউলের তরফ থেকে । সরে থাকার পরামর্শ দিয়ে মডিউল কানেকশনটি কেটে দেন তিনি ।
3.
রাত নেমেছে খানিকক্ষণ হল । বহু প্রাচীন কাল পূর্বের সাহিত্যে যে জোসনার কথা মেলে, প্রায় তেমনই ছড়িয়ে আছে, কৃত্রিম চাঁদের কোমল আলো । জুবান , মধ্যবয়েসী সতেজ চেহারার যুবক, হাঁটছে ছিমছাম রাস্তাটি ধরে । মোলায়েম বাতাস বইছে । কোন্ ঋতু এখন ? শরত? বসন্ত? জুবানের হঠাৎ তীব্রভাবে মনে হল পৃথিবীর মানুষ ঋতুর খেয়াল রাখে না বহুকাল ।
অল্পস্বল্প লোক চলাচলের রাস্তায় একটা শিশুও চোখে পড়ে না । সামাজিক জীবন বিলুপ্ত হয়ে গেছে চতুর্বিংশ শতকেই । যৌনতা ব্যাপারটা আজকাল পুরোটাই যান্ত্রিক । পরিবার বলতে কিছু নেই । প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র । ফার্টিলিটি ফার্মগুলোতে সন্তান জন্ম হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত হারে, তারপর ইনফ্যান্টারি ফার্মে লালন পালন হয় ষোল বছর অব্দি । শারীরবিদ্যার অকল্পনীয় উন্নতিতে তথ্য ও জ্ঞান সরাসরি নিউরনে ঢুকিয়ে দেয়াটা ডালভাত । ষোল বছরের শেষে প্রত্যেকের মস্তুিষ্কে জ্ঞান বিজ্ঞানের কোন একটা শাখার তথ্য ঢুকিয়ে তাকে সেই ক্ষেত্রে কর্মরত করা হয় । নিস্তরঙ্গ সেই মানুষটি আর একটি যন্ত্রের মাঝে বিশেষ কোন পার্থক্য থাকে না তখন । মানবিক আবেগ অনুভূতি হাসি আনন্দ কষ্ট দুঃখ হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে । প্রতিদিনকার কাজ নিয়মমাফিক করা, সময়মত নেটওয়ার্কের পাঠানো ক্রেডিট তুলে খাবার কেনা, অবসরটি নেটওয়ার্কের নানা অত্যাধুনিক বিনোদন ব্যবস্থায় কাটানো আর নিয়মমাফিক ফার্টিলিটি সেন্টারে জীবনে একবার যাওয়া । অভ্যস্ত এ জীবনে সেন্ট্রাল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছে সমস্ত প্রক্রিয়াটি ।
পৃথিবীর মানুষ যতদিনে বুঝতে পারল কোন একটা কিছু ভুল হচ্ছে ততদিনে দেরি হয়ে গেছে ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুবান পকেট থেকে মডিউলটা বের করে । খানিকক্ষণ সময় নিয়ে রূহানের উদ্দেশ্যে একটা বার্তা পাঠালো সে । তারপর ধূসর একটি বোতাম চেপে ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে তার লক্কর ঝক্কর গাড়িটি বের করে আনে ।
খানিকক্ষণ পরই দেখা গেল, উত্তর পূর্বের নির্জন পাহাড়ি এলাকা ধরে ছুটছে গাড়িটি ।
4.
সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ রাউল প্রশান্তমুখে বসে আছেন একুশটি বাচ্চার পাশে । চুলগুলো সাদা, মুখময় বলিরেখার দাগ, তবু জ্বলজ্বলে শান্ত চোখের প্রগাঢ় মমতা যেন শান্তি বর্ষণ করছে ।
শিশুগুলিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে ক্রয়োজেনিক বিছানায় ।
রাউল হাসিমুখে বলেন, ' নিয়ানা, ওদের মুখটা কত নিষ্পাপ দেখেছো? '
অল্পবয়সী নিয়ানা মাথা নাড়ে, ' শুনেছি বাচ্চারা ঘুমালে এমন নিষ্পাপ দেখায় '
' আমাদের খাবার আর পোশাকের আরও মজুদ দরকার পড়বে ' রাউল শান্তমুখে বলেন, শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়ে ।
'পশ্চিম তীরের দলের সাথে যোগাযোগ হয়েছে । মজুদ এসে যাবে কদিন পরই, প্রফেসর । '
হাস্যমুখে নিয়ানার দিকে ঘুরে তাকান রাউল , ' প্রফেসর রাউল তো বহুকাল আগে হারিয়ে গেছে । বুড়ো রাউল বলবে গো মেয়ে ।'
নিয়ানা ফিক করে হেসে ফেলে । ঋষিতুল্য সাধাসিধে এই বৃদ্ধ, প্রাচীন পৃথিবীর গ্রামীন এক বুড়োর মত জীবন কাটায় যে , কখনও কি ভাবে যে তার প্রতিভা আর মহত্ত্বের গুণে স্রষ্টার পর দ্বিতীয় স্থানে তারা সবাই রেখেছে তাকে ।
5.
রাউল আর নিয়ানার উল্টো দিকে বসে আছে রুহান । যোগাযোগ মডিউলটায় অনেকক্ষণ আগে বার্তা পাঠিয়েছে কেউ । মুক্ত ফ্রিকোয়েন্সিতে চালু করলে ঝুঁকি রয়ে যায়, তাই এতক্ষণ দেখতে পারে নি । গোপন একটা ফ্রিকোয়েন্সিতে বার্তাটি খুলতেই বিস্ময়ে বিমূঢ় হল সে । জুবান পাঠিয়েছে, সাথে তিন মাত্রার কোড ওয়ার্ড ।
'রাউল, জুবানের বার্তা এসেছে, কোডওয়ার্ড থ্রি '
বৃদ্ধ রাউল এবং নিয়ানা দুজনে একসঙ্গে স্তব্ধ হয়ে যায় ।
কাঁপা হাতে মডিউলটি স্পর্শ করে ভিডিও বার্তাটি চালু করে রুহান ।
"রুহান", বিষাদমাখা এক টুকরো হাসি ঠোঁটে নিয়ে বলে জুবান , "কোডওয়ার্ড থ্রি দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ, সেন্ট্রাল নেটওয়ার্ক আমার অবস্থান জেনে গেছে । আমার হিসাব মতে আর ঘন্টাখানেকের ভেতর লুহার - 10 নিরাপত্তারক্ষী রোবট এসে পড়বে । এবং নিয়ম মোতাবেক ধরা পড়ার আগেই আমার নিজের মৃত্যুর ব্যবস্থা করতে হবে ।
রুহান, বুড়ো রাউল নিশ্চয় তোমার পাশে আছে, ওকে বোলো বহুদিন পূর্বে ও যেদিন আমাদের কে শিশু অবস্থায় এনেছিলো আজকের একুশটি শিশুদের মত, সেদিন থেকে আজ অবধি প্রতিটা মুহুর্ত আমি বুড়োটার কাছে ঋণী, পরিপূর্ণ সত্যিকার একটা মানুষের জীবন পেয়েছি সেজন্য ।
আমি জানি, রুহান, একদিন তোমরা বিজয়ী হবে, আমি তুমি রাউল, আমরা কেউ দেখে যেতে না পারলেও একদিন মানুষ জয়ী হবে ।পৃথিবী জুড়ে এগারোটি গোপন আস্তানায় যে দুহাজার মানুষ আমরা দলে রয়েছি , প্রজন্মে প্রজন্মে আরও অনেকগুলো শিশুকে বাঁচাবে তোমরা যন্ত্র হয়ে যাওয়া থেকে । তারপর একদিন যখন সময় হবে, সেন্ট্রাল নেটওয়ার্ক আর তার রোবট বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বে তারা, লড়বে সত্যিকারের কিছু মানুষ ।
বুড়ো রাউলকে বোলো, যে স্বপ্ন সে দেখেছে সারা জীবনভর, তা সত্যি হবে একদিন । এমন একদিন আসবে, যেদিন প্রাচীন কালের মত বাবা মা আদরে মমতায় বড় করবে তার সন্তানকে, দুরন্ত শিশুদের ছোটাছুটিতে মুখর হবে পথ, উঠতি তরুণ উদ্ধত ভঙ্গিতে ছুটবে শিস দিতে দিতে, চাঁদের আলোয় সমুদ্র তীরে দাড়িয়ে অলৌকিক সংগীত শুনবে প্রেমিক প্রেমিকা । যেদিন মানুষ স্বাধীন হবে, সংগীতে, কলায়, জ্ঞানে, ইচ্ছায় । আবারো একদিন আসবে যেদিন প্রাচীনকালের মত, মানুষগুলো হবে সত্যিকারের মানুষ । "
জুবানের রুক্ষ কন্ঠ কোমল হয়ে আসে । বলে চলে সে , " রুহান, জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো আমি কাটাতে যাচ্ছি ঐ কালো পাহাড়টার ধারে । সেই পাহাড়, কিশোর বয়সে অজস্রবার যেখানটায় উঠে আকাশের তারা গুণেছি আমরা । "
যোগাযোগ মডিউলটার আলো থেমে স্থির হয়ে গেল । দূরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল রুহান । ইস্পাত কঠিন হৃদয়েও ঝড় বয়ে চলে যেন...সেই শিশুকাল থেকে...... . বিশ বছর...... বিশটি বছর... জুবান আর সে অবিচ্ছেদ্য হয়ে ছিলো ।
রাউলের দিকে তাকালো সে, ঠায় দাড়িয়ে থাকা বয়র্ষী বৃদ্ধের চোখেমুখে নির্লিপ্ত শূন্যতা । বিসদৃশভাবে চোখের কোণে এসে গেছে খানিকটা জলও ।
ওদিকে নতুন শিশুদের মধ্যে একজনের তখন ঘুম ভেঙে গেছে । ক্ষুদ্র চোখজোড়া মেলে অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে সোজা ওপরের ধূসর ছায়ারঙে । ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল রুহান । বিছানার নীলাভ বলয়ের পাশে হাত রেখে , মৃদু ব্যাকুল গলায় নতুন নামে ডাকল শিশুটিকে, ' জুবান........ জুবান....... '
_________
কথামালা 1. আমি মূলধারার সাহিত্যের (কথাসাহিত্য, কাব্য) অনুরাগী মূলত, ও নিয়েই থাকি কিংবা লিখবার ব্রতে রই অহোরাত্র । সাইফাই লেখার এটিই প্রথম চেষ্টা ছিল । গল্পটা শেষ অব্দি বিজ্ঞানের নিপুণ শৈলী অনুসরণ করেনি, সাইফাইয়ে যেটা হতে হয়, বরং "সাইফাই কম মানবিক-আবেগময় গল্প বেশি" হয়েছে ।
কথামালা 2. প্রভাব কাটানোর চেষ্টা করেছি । যদিও থিমটা বহুচর্চিত অতিসাধারণ । তবে নামগুলোয় জাফর ইকবাল স্যারের প্রভাব মেনে নিয়েছি অকুন্ঠচিত্তে ।
Writer: Fahim Firoze