স্প্লিট ব্রেইন



"এক দেহ দুই মস্তিষ্ক"-এমন কি কখনো ঘটা সম্ভব? মানব মস্তিষ্কের ডান ও বাম অংশ সম্পুর্ণ পৃথক কাজ করে থাকলেও তাদের কাজে সমন্বয় ঘটায় মধ্যকার আন্তঃসংযোগ যার নাম কর্পাস ক্যালোসাম।এই কর্পাস ক্যালোসাম দিয়ে মস্তিষ্কের এক অংশ অন্য অংশের সাথে তথ্য আদান প্রদান করে। পরিবেশের সাথে কাজের ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু কোন কারণে এই সংযোগ যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে কি ঘটবে? চলুন জেনে আসা যাক গত শতাব্দীর নিউরোসায়েন্সের সবচেয়ে চমকপ্রদ একটা বিষয় স্প্লিট ব্রেইন।

কোনো অপারেশন বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে কর্পাস ক্যালোসাম আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে অথবা কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেললে দুই সেরেব্রাল হেমিস্ফিয়ারের মধ্যকার আন্তঃসমন্বয় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তারা স্বাধীন ভাবে কাজ করা শুরু করে। এ যেন একই মানুষে দুটি মস্তিষ্ক থাকার মতো ব্যাপার। এ অবস্থাকে স্প্লিট ব্রেইন বলে। এ অবস্থায় শরীরের দুই পাশ দুই রকম কাজ করতে থাকে।

প্রতিটা হেমিস্ফিয়ারের আলাদা আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। দেখা যায় কোনো একটা কাজ ডান অংশ করতে পারলেও বাম অংশ করতে পারে না। আবার এর উল্টোটাও ঘটে। কিন্তু কখনো কি এটা মাথায় এসেছে যে কি করে বিজ্ঞানীরা বুঝল এই অংশ এই এই কাজ করে? মস্তিষ্কের দুই অংশ তো একসাথে সমন্বয় করে কাজ করে। তাহলে কে কোন কাজটি করে সেটা কি করে বোঝা গেল?এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন রজার স্পেরি। তিনি স্প্লিট ব্রেইন রোগীদের উপর বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করে দুই অংশের বিশেষত্ব ও পৃথক কার্যক্রম আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। এজন্য ১৯৮১ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান।

স্প্লিট ব্রেইন রোগীদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় দুটি হেমিস্ফিয়ার সম্পুর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে। তাই কোন ভাগ কি কি কাজ করে তা বের করা সহজ হয়ে যায়। ধরুন আমি আপনার ডান হাতে একটা চাবি দিলাম। আপনার চোখ বন্ধ থাকলেও আপনি মুহূর্তেই বলে দিতে পারবেন যে এটা একটা চাবি। এই প্রক্রিয়াটা একটু ব্যাখ্যা করি। আমরা সবাই জানি দেহের বাম অংশ নিয়ন্ত্রণ করে ডান মস্তিষ্ক আর ডান অংশ নিয়ন্ত্রণ করে বাম মস্তিষ্ক। তাই যখন আমি চাবিটা আপনার ডান হাতে দিলাম তখন এই তথ্য স্নায়ু দিয়ে বাম মস্তিষ্কে পৌঁছে গেল।বাম মস্তিষ্কে এটি প্রসেস হয়ে আপনাকে জানিয়ে দেবে যে এটা একটা চাবি। একইভাবে আমি যদি চাবিটা বাম হাতে দিই তাহলে এটি ডান মস্তিষ্কে প্রসেস হয়ে আপনাকে জানাবে। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় ডান বা বাম মে অংশেই প্রসেস হোক না কেন আপনি কথা বলে আমাকে বোঝাতে চাইলে আপনাকে বাম মস্তিষ্কের উপর নির্ভর করতে হবে। কারণ ভাষা শিক্ষা ও বাকশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে বাম মস্তিষ্ক। তাই আমি যদি শুধুমাত্র আপনার বাম মস্তিষ্কে তথ্য প্রসেস করতে দিই তাহলে আপনি কথা বলতে পারবেন। কিন্তু শুধু ডান মস্তিষ্কে তথ্য দিলে আপনি সেটা কি বুঝলেও বলতে পারবেন না।

এখন আমরা এই পরীক্ষাটা করব একজন স্প্লিট ব্রেইন রোগীর সাথে যার ডান ও বাম মস্তিষ্কের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি যদি চাবিটা তার ডান হাতে রাখি তাহলে সে বলে দিতে পারবে যে এটা একটা চাবি। কারণ ডান হাতে থাকায় এর প্রসেস ঘটছে বাম মস্তিষ্কে। আর বাম মস্তিষ্ক যেহেতু ভাষা ও বাকশক্তির কেন্দ্র তাই এক্ষেত্রে তার বলতে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু চাবিটা যদি বাম হাতে রাখি তাহলেই হবে সমস্যা। কারণ বাম হাতে রাখায় এর প্রসেস ঘটছে ডান মস্তিষ্কে। কিন্তু ডান মস্তিষ্ক ল্যাঙগুয়েজ প্রোডাকশন করে না। তাই এক্ষেত্রে ওই রোগীটি বুঝতে পারবে যে এটা চাবি কিন্তু সে বলতে পারবে না।

রজার স্পেরি ঠিক এরকম একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি মস্তিষ্কের দুই অংশের কাজের ভিন্নতা দেখানোর পাশাপাশি মানুষের ভাষাগত শিক্ষা,এর প্রসেস এবং বাকশক্তি নিয়ন্ত্রণের কাজ যে বাম মস্তিষ্ক করে তা দেখাতে সক্ষম হন।

স্প্লিট ব্রেইন রোগীদের আরেকটি বিচিত্র সমস্যা দেখা যায় দৃষ্টিক্ষেত্রের উপর। আমাদের চোখের ক্ষেত্রেও ব্রেইন একই কাজ করে। অর্থাৎ ডান চোখে দেখা জিনিস প্রসেস হয় বাম মস্তিষ্কে আর বাম চোখে দেখা জিনিস ডান মস্তিষ্কে।এখন স্প্লিট ব্রেইন রোগীর চোখের ডানপাশে কোনো বস্তু রাখা হলে সে সাথে সাথেই বস্তুটি কি তা বলতে পারবে। কারণ বাম মস্তিষ্ক বিশ্লেষণে পারদর্শী। কিন্তু যদি বাম পাশে রাখা হয় তাহলে সে এ সম্পর্কে কিছুই বলতে পারবে না।এর কারণ ওই একই। ডান অংশ বিশ্লেষণ করতে পারে না। সে হয়তো ইশারায় বা ছবি এঁকে বা অন্য কোন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারে কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবে না। বিখ্যাত নিউরোসায়েন্টিস্ট গাজানিগা এই এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন।(চিত্র ২)। এভাবেই একই জিনিস এর উপর স্প্লিট ব্রেইন রোগীরা দ্বৈত ক্রিয়া দেখায়।

গাজানিগা এর পাশাপাশি আরেকটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। সেটা হলো ফেস রিকগনিশন। তিনি রোগীকে আর্কিমবল্ডোর আঁকা ছবি(চিত্র ৩) দিয়ে বলেছিলেন যে তারা কি দেখতে পাচ্ছে। এক্ষেত্রে তার জবাব ছিল এরকম মে সে যখন ডান চোখ দিয়ে ছবিটি দেখেছিল তখন সে ফলমূল ছাড়া আর কিছু দেখতে পায়নি। কিন্তু যখন বাম চোখ দিয়ে দেখল তখন সে বলল সে একটা ফেস দেখতে পাচ্ছে। অর্থাৎ ফেস রিকগনিশন বা মানুষের চেহারা মনে রাখতে সাহায্য করে ডান মস্তিষ্ক।

তবে কিছু বিরল ক্ষেত্রে এ সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করে। যদি দুটি হেমিস্ফিয়ার একে অপরকে ডমিনেট করার চেষ্টা করে তখন এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।যেমন ডান হাত হয়তো জামার বোতাম লাগাচ্ছে কিন্তু বাম হাত সাথে সাথেই লাগানো বোতাম খুলে ফেলছে। তবে এটি নিতান্তই বিরল।


স্প্লিট ব্রেইন এর এক্সপেরিমেন্ট গুলো মস্তিষ্কের বেশ কিছু রহস্য সমাধান করতে পেরেছে। চিকিৎসাক্ষেত্রেও মাঝে মাঝে এটি ব্যবহৃত হয়। যেসব রোগীর ভয়াবহ খিঁচুনি আছে বা রিফ্রাকটরি এপিলেপসির শিকার, তাদের মস্তিষ্কে‌র নিউরন থেকে নিউরনে এই খিঁচুনি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে শেষ চিকিৎসা হিসেবে চিকিৎসকরা কর্পাস ক্যালোসাম বিচ্ছিন্ন করে দেন।এই চিকিৎসা পদ্ধতির নাম কর্পাস ক্যালোসোটমি। এতে এক হেমিস্ফিয়ার থেকে অন্য হেমিস্ফিয়ারে খিঁচুনি ছড়িয়ে পড়া রোধ করা যায়।স্প্লিট ব্রেইন তাই নিউরোসায়েন্সে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

References:
1. https://en.wikipedia.org/wiki/Split-brain
2.https://www.britannica.com/science/split-brain-syndrome
3.https://www.nature.com/articles/483260a
4.https://link.springer.com/article/10.1007/s11065-020-09439-3

Writer: Soumik Mondal

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম