কখনো কি ভেবে দেখেছেন লাল রং শুনতে কেমন? কিংবা গিটারের সুর কি মিষ্টি নাকি ঝাল? অথবা 9 এর গাত্রবর্ণ কি?
না না, পাগল হয়ে যাইনি আমি। শুনতে স্রেফ গাঁজাখুরি শোনালেও ব্যাপারগুলো কিন্তু মোটেই অবাস্তব নয়। বলছি আমাদের বিস্ময়কর মস্তিষ্কের আরেকটি চমকপ্রদ ব্যাপার নিয়ে।
সিনেস্থেসিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে বলে সিনেস্থেট (synesthete). অবশ্য আক্রান্ত বলাটা ঠিক হচ্ছে না, কারণ অধিকাংশ সিনেস্থেট এটাকে কোনো সমস্যা কিংবা রোগ বলেই মনে করেন না, বরং সৃষ্টিকর্তার উপহার হিসেবে গ্রহণ করেন। বলা বাহুল্য যে উপহারই বটে..... কেননা এ কারণে সিনেস্থেটদের স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো হয়। বহু বছর আগের সামান্য কোনো ঘটনা বেশ খুঁটিনাটি সহ তারা মনে করতে পারেন, পারেন কঠিনতম কিছু কোনো ছন্দ (mnemonic) ছাড়াই মনে রাখতে। সিনেস্থেসিয়া তাদের জন্য 'in-built mnemonic' বলা যায়। অবাক করা ব্যাপার হলো সিনেস্থেটরা কিন্তু মোটেই বিরল নয়। পরিসংখ্যান বলে 4.4% মানুষেরই কম বেশি সিনেস্থেসিয়া রয়েছে (প্রতি 23 জনে 1জন) !! তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কই, আমরা তো দেখি নাই কাউকে? এর ব্যাখ্যা দিতে বলা যায় যে, অধিকাংশ সিনেস্থেটরাই নন-লোকালাইজার (non-localizer)
ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন কিছু নিউরোলজিস্ট আলাদা আলাদাভাবে সিনেস্থেসিয়ার কয়েকটি কেস উপস্থাপন করেন, সেসময় অন্যান্য বেশিরভাগ নিউরোলজিস্টরাই ব্যাপারটিকে কল্পনা ও অবাস্তব বলে আখ্যা দেন। তারা সিনেস্থেটদের 'কাব্যিক' বলে অভিহিত করে বলেন যে, তারা বিভিন্ন অনুভূতিকে স্রেফ রূপক (metaphore) হিসেবে বর্ণনা করছে। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীতে এসে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সিনেস্থেসিয়াকে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা হিসেবে প্রমান করা গিয়েছে যা মোটেই হ্যালোসিনেশন কিংবা স্রেফ কল্পনা নয়।
সিনেস্থেসিয়াকে প্রধানত ২টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়- ১/প্রজেক্টিভ (projective), ২/ অ্যাসোসিয়েটিভ (associative)
প্রথম শ্রেণীর সিনেস্থেটরা প্রকৃতপক্ষেই বিভিন্ন বর্ণ দেখতে পান, শব্দ শুনতে পান কিংবা স্বাদ অনুভব করেন, এদেরকে localizer ও বলা যায়। অপরদিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর সিনেস্থেটরা ২টি অনুভূতির মাঝে বেশ জোরালো সংশ্লিষ্টতা অনুভব করেন, এদের non-localizer বলেও অভিহিত করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, বাঁশির শব্দে প্রজেক্টিভ সিনেস্থেটরা প্রকৃতপক্ষেই হয়তো সবুজ রং দেখতে পান কিন্তু অ্যাসোসিয়েটিভ সিনেস্থেটদের কাছে বেশ জোরালো ভাবে মনে হবে বাঁশির শব্দটা কেমন সবুজ সবুজ!
এখনো যদি পুরো ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য ঠেকে তবে একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা দেয়া যাক।
কোনো একটি অনুভুতিকে আমাদের মস্তিস্ক ঠিক কিভাবে অনুভব করে এবং তার কি অর্থ করে তা অন্য কেউ যে কিনা ওই অনুভুতি টি কখনো অনুভব করে নি , সে কখনোই বুঝতে পারবে না। যেমন, কোনো জন্মান্ধ ব্যক্তিকে আপনি কখনোই বোঝাতে পারবেন না যে নীল রং দেখতে কেমন কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কে কখনো ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবেন না যে কুমিল্লার রস মালাই খেতে কেমন (আশা করি সে খায় নি)। এই ব্যাপারটিকে বলা হয় qualia. আপনার যদি কোনো নির্দিষ্ট qualia না থাকে তবে কখনোই ওই নির্দিষ্ট অনুভুতি টি বুঝতে পারবেন না। তো সহজ ভাবে বলা যায় সিনেস্থেটদের সাধারণ মানুষের চাইতে কিছু অতিরিক্ত qualia থাকে। (কেন থাকে এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে)
এবারে সিনেস্থেসিয়ার কিছু প্রকরণের সাথে পরিচিত হওয়া যাক
১) Grapheme-colourউদাহরণস্বরূপ নিচের প্রথম চিত্রটি খেয়াল করুন। বা পাশের চিত্র টি কোনো একজন Graphemes-color
২) Chromesthesia: শব্দ থেকে বর্ণ দেখতে পাওয়া।
৩) Spatial sequence synesthesia: বিভিন্ন সংখ্যা বা বর্ণমালাকে কাছে কিংবা দূরে মনে হওয়া।
৪) Number form: ক্রমবর্ধমান সংখাসমূহ কে একটি ম্যাপ এর মতো মনে হয়।
৫) Auditory tactile synesthesia: শব্দানুভূতি থেকে স্পর্শ অনুভব করা।
৬) Ordinal linguistic personification
৭) Mirror touch synesthesia: সামনে বসে থাকা কারো স্পর্শানুভূতি নিজেও অনুভব করা। যেমন, আপনার বন্ধুর গালে কেউ এসে একটা থাপ্পড় বসিয়ে গেল, সেই থাপ্পড়ের অনুভুতি যদি আপনিও অনুভব করেন।
৮) Lexical gustatory synesthesia: কোনো শব্দ শুনে মুখে নির্দিষ্ট কোনো স্বাদ পাওয়া। যেমন, কেউ ভালোবাসি বললেই হয়তো মুখে কাচ্চি বিরিয়ানির স্বাদ পাওয়া যায়....
৯) spatio temporal synesthesia: সময় কে ত্রিমাত্রিক কোনো কাঠামো রূপে দেখতে পাওয়া!!!
সমাজে বিভিন্ন সময়ে অগণিত সিনেস্থেট এর উদাহরণ থাকলেও একজনকে একটু আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হয়; রাশিয়ান এই ব্যক্তির নাম সলোমন সেরেশেভস্কি। তাকে আলাদা করে উল্লেখ করবার কারণ এখন পর্যন্ত উনিই একমাত্র ব্যক্তি যার সিনেস্থেসিয়া এক সাথে ৫টি ইন্দ্রিয়তেই সাড়া জাগায়। উদাহরণস্বরূপ, সাধারণ ঘন্টার শব্দে তিনি একেই সাথে ৭টি অনুভুতি অনুভব করতেন, তার নিজের ভাষ্যমতে, "I heard the bell ringing; a small, round object rolled before my eyes ; my fingers sensed something rough like a rope ; I experienced a taste of salt water, and something white."
সিনেস্থেসিয়া বংশানুক্রমে বাহিত হয়, মানে বাবা কিংবা মায়ের সিনেস্থেসিয়া থাকলে ছেলে মেয়ের ও থাকার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।
সিনেস্থেসিয়ার নির্দিষ্ট কারণ নিয়ে মতভেদ রয়েছে, এটা নিয়ে অন্য একটি লেখায় Ideasthesia এর সাথে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। কারণ অনেক গবেষক সিনেস্থেসিয়াকে ideasthesia (when the meaning of a sensory stimulus rather than the stimulus itself, evoke another sensory experience) এর একটি প্রকরণ বলে মনে করেন। সাধারণ মানুষের মাঝে সিনেস্থেসিয়া না থাকলেও ধারণা করা হয় আমাদের সবার মাঝেই কিছু না কিছু ideasthesia রয়েছে। এর কিছুটা আভাস পাওয়া যায় wolfgang köhler এর একটি পরীক্ষা থেকে। নিচের দ্বিতীয় চিত্রটি খেয়াল করুন, ২টি আকৃতির মধ্যে কোনটিকে bouba আর কোনটিকে kiki বলে মনে হয় আপনার? দেখা গেছে প্রায় ৯৫-৯৮%মানুষ তীক্ষ্ণ অকৃতিটিকে kiki এবং ভোঁতা অকৃতিটিকে bouba নামকরণ করেছেন। একে bouba-kiki effect বলা হয়। কোনো কারণে আমাদের মস্তিস্ক 'kiki' শব্দটিকে তীক্ষ্ণ আর 'bouba' শব্দটিকে ভোঁতা মনে করছে।
LSD এবং mescaline, এই ২টি recreational ড্রাগ কৃত্রিম সিনেস্থেসিয়া ঘটাতে সবচাইতে বেশি কার্যকরী। এগুলো সেবনে সাধারণ মানুষ ও synesthetic experience পায়। একটা সময় সাধারণ ওষুধের মতই কিনতে পাওয়া গেলেও বর্তমানে এগুলো অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় সে আশায় গুড়েবালি।
সবশেষে একটি প্রশ্ন দিয়ে শেষ করছি, প্রায়ই আমরা বলে থাকি যে "মেয়েটি/
পুনশ্চ: শিরোনাম টি নেয়া হয়েছে Holly payne এর একটি উপন্যাসের নাম হতে, যেখানে উপন্যাসের মূল চরিত্র একজন সিনেস্থেট।
পুনশ্চ-২: প্রতি ২৩ জনে ১জন সিনেস্থেট- এই ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল ২০০৫ সালে, এডিনবার্গ-এ, জুলিয়া সিমনার এবং তার কলিগদের করা একটা জরিপ থেকে; যা কিনা প্রক্রিয়াগত ভাবে এই বিষয়ে পূর্ববর্তী সকল জরিপ থেকে নির্ভুল বলে ধরা হয়।
Source:
1. Wednesday is indigo blue- Richard E. Cytowic, M.D., and David M. Eagleman, Ph.D.
2. Wikipedia
Writer: Muhammad Naeemur Rahman