(তুরস্কের বর্তমান আধুনিক গোয়েন্দা সংস্থার মূল ভিত্তি সূচিত হয়েছিল উসমানীয় যুগেই, আনুমানিক উনবিংশ শতাব্দীতে। বিভিন্ন সুলতানের শাসনামলে এর বিভিন্ন রকম সংস্কার করা হয়। সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের সময় সিক্রেট গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম এতটা শক্তিশালী ও ব্যাপক হয়ে ওঠে, যে উনার বিরোধীরা আবদুল হামিদের শাসনকে "গোয়েন্দাদের শাসন" হিসেবে অভিহিত করত।)
১৮৭৬ সালে, উসমানীয় সাম্রাজ্যে দুইজন সুলতান ক্ষমতায় আসেন। সুলতান আবদুল আজিজ সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সুলতান পঞ্চম মুরাদ, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে তিনিও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ক্ষমতায় আসেন দ্বিতীয় আবদুল হামিদ। ক্ষমতায় আসার সময় তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রব্যবস্থা প্রবর্তনসহ তরুণ তুর্কিদের নানা দাবিদাওয়া মেনে নিলেও একবছরের মাথায় তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইস্তাম্বুল থেকে তাড়িয়ে দেন। এর প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী দুই বছরে ব্রিটেনের মদদে ইস্তাম্বুলে দুই দফা সেনা অভ্যুত্থান হয়- আবদুল হামিদ দুটোই সফলভাবে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হন।
এছাড়া এ সময়কালে আবদুল হামিদকে লক্ষ্য করে কয়েকবার গুপ্তহত্যার চেষ্টাও চালানো হয়। এসব ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে আবদুল হামিদ একটি শক্তিশালী গুপ্তসংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ফলাফল হিসেবে ১৮৮০ সালে আবদুল হামিদ একটি শক্তিশালী "স্পেশাল সিক্রেট এজেন্সি" প্রতিষ্ঠা করেন, যার কোড নেম দেওয়া হয় 'হুদহুদ'। বাকি পোস্টে একে হুদহুদ বলেই ডাকা হবে।
এর আগেও উসমানীয়দের ইতিহাসে বেশ কয়েকটি গুপ্তসংগঠনের ইতিহাস পাওয়া যায়, যেমনঃ- আকিনজি, আসেসবাশি, বোজেকবাশি,চুহাদার, আসেস, জাবতিয়ে- ইত্যাদি, তবে হুদহুদ এদের চেয়ে অনেক আধুনিক ও সুশৃঙ্খল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।(বাকি সিক্রেট সংস্থাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ আলাদা পোস্টে দিয়ে কমেন্ট বক্সে লিংক দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ)
হুদহুদ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আবদুল হামিদকে প্রথম পরামর্শ ও সহায়তা দেন উজিরে আজম সাঈদ পাশা। এতে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টসমূহ গোয়েন্দা দপ্তরে না পাঠিয়ে সরাসরি রাজপ্রাসাদে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তিনি ইন্টেলিজেন্স অফিসারদের নিজের পক্ষে আনার জন্য তাদেরকে প্রচুর উপহার ও মেডেল পাঠানো শুরু করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যে মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয় শুরু হয়ে গেছে এবং মানুষকে অনুগত রাখার কার্যকর উপায় তাকে টাকা,উপহার ও মেডেল দিয়ে বশে রাখা।
এসবের মাধ্যমে তিনি অল্প সময়ের মাঝে আনুমানিক ৩০,০০০ হাজার সদস্য নিয়ে হুদহুদ সিক্রেট এজেন্সি দাঁড় করিয়ে ফেলেন। তাদেরকে 'হাফিয়ে'(ইংরেজিতে spy) বলে ডাকা হতো৷ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝ থেকে গুপ্তচর বাছাই করা হতো৷ যেমন-
কাশগড় থেকে একজন দরবেশ, দাগেস্তানের একজন 'মোল্লা', ভারতের ভিক্ষুক, সুদানের পর্যটক, লিবিয়ান শাইখ, কুর্দি ও আফগান গৃহস্থ, তাতারি হোজা সহ অসংখ্য বাজিকর, অভিনেতা, জাদুকরসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আবদুল হামিদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করত। প্রাদেশিক অফিসার, দূতাবাসের কর্মকর্তারাও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এমনকি সিনিয়র রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, তাদের উপপত্নী(মানে দাসী), এবং আগারাও অর্থের বিনিময়ে নিয়মিত গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রেরণ করত।
এসব রিপোর্ট আবদুল হামিদ ব্যাক্তিগতভাবে পড়তেন, তারপর যেগুলোর বিস্তারিত তদন্তের প্রয়োজন মনে করতেন, সেগুলো থেকে স্পাইয়ের স্বাক্ষর কেটে নিয়ে তা পুলিশ অফিসারদের নিকট পাঠিয়ে দিতেন। উনার একার পক্ষে অবশ্য এত রিপোর্ট পড়া সম্ভব হতো না। উনি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিদ্রোহীরা উনার বাসভবনে বিপুল পরিমাণ গোয়েন্দা রিপোর্টের সন্ধান পায়, যা কখনোই খোলা হয় নি। লোকেরা প্রচন্ড বিস্মিত হয় এটা দেখে, যে তরুণ তুর্কির উচ্চপদস্থ অসংখ্য অফিসার সুলতান আবদুল হামিদের নিকট নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাতেন। এগুলো পুড়িয়ে ধ্বংস করতে তাদের দিনের পর দিন লেগেছিল।
এসব রিপোর্টের মাঝে আর্জেন্ট রিপোর্টসমূহ যেকোন অবস্থায় আবদুল হামিদের নিকট পৌছানোর নির্দেশ ছিল- এমনকি তিনি ঘুমে বা এমনকি শাওয়ারে থাকা অবস্থাতেও৷ এর মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যের দুর্গম এলাকাতেও কি ঘটছে, সে ব্যাপারে অবগত থাকতেন।
তিনি বাহ্যিকভাবে যেসব রিপোর্ট অগুরুত্বপূর্ণ মনে হতো- সেগুলোকেও অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। একদিন উনার চীফ স্পাই কাদরি বে- যাকে সুলতান একটা রিপোর্টের অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, রিপোর্টটি দেখে গুরুত্বহীন ভেবে হেসে উঠলেন। তখন আবদুল হামিদ বললেন, "আমি যদি এখন তোমাকে বরখাস্ত করি, তাহলে ইয়েনি মসজিদের সামনে দোকান ভাড়া করে দালাল হিসেবে কাজ করা ছাড়া তোমার আর কোন উপায় থাকবে না। আর তুমি যদি ছোটখাটো রিপোর্টগুলো গুরুত্বহীন মনে করে ফেলে রাখো, তাহলে আমার কবরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না"।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে সিক্রেট এজেন্সি দুর্বল হতে থাকে, এবং এর গুরুত্ব কমে যেতে থাকে। দেখা গেল, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা একে অপরের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা শুরু করেছে। হাস্যকর গুজব, এমনকি একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে উদ্ভট অপবাদ দিয়েও রিপোর্ট পাঠানো শুরু করলো। পাশাদের সবাই একে অপরকে অবিশ্বাস-সন্দেহ করা শুরু করল, এবং প্রত্যেকে একে অপরের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। স্পাইদের টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট পাঠানোর চলও শুরু হয়ে গেল। আবদুল হামিদ সব বুঝতে পারলেও উনার হাতে কিছুই করার ছিল না, উনি ছিলেন নিরুপায় ৷ সিক্রেট এজেন্সিতে, এমনকি পুরো প্রশাসনেই ধীরে ধীরে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়লো৷ দোষী ব্যাক্তির সাথে সাথে নির্দোষ ব্যাক্তিরাই শাস্তি পাওয়া শুরু করল - লাল রঙের ফেজ পড়া উসমানীয় কর্মচারীদের দেখলেই সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হওয়া শুরু করল।
তরুণ তুর্কিদের স্পাইরা এ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল, এবং এর ভিত্তিতে আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে বিপুল প্রোপাগাণ্ডা প্রচার শুরু করলো। জনগণ যারা আবদুল হামিদকে গভীরভাবে ভালোবাসত, তাদের একটা অংশ এসব স্পাইদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে নিজেদের মুখ ফিরিয়ে নিতে লাগল। উল্লেখ্য, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে এ সময়কালে তরুণ তুর্কিরা প্রাসাদ, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে বিপুল পরিমাণে নিজেদের লোক ঢোকানো শুরু করে- যা কেউ খেয়াল করে নি। সাথে সাথে সুলতানের বিশ্বস্ত ব্যাক্তিরাও গুপ্তহত্যার শিকার হতে থাকেন।
এর অনিবার্য ফলাফল হিসেবে হুদহুদ আভ্যন্তরীণভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে৷ ফলে যে সিক্রেট এজেন্সি আবদুল হামিদকে ৩৩ বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছিল, তা ১৯০৮ সালে তরুণ তুর্কিদের সামান্যতম বাধা দিতেও ব্যর্থ হয়, ও ভেঙে পড়ে৷ তরুণ তুর্কিরা ক্ষমতায় আসার পর হুদহুদকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়, এর বিপুল সংখ্যক অফিসার ও স্পাইদেরকে হত্যা ও নির্বাসনে প্রেরণ করা হয়। এর মাধ্যমে পতন ঘটে একটা ইতিহাসের।
পরবর্তীতে হুদহুদের পরিবর্তে তরুণ তুর্কিদের মিলিটারি সিক্রেট এজেন্সি হিসেবে 'তেশকিলাত-ই-মাহসুসা' প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া আধুনিক তুরস্কতে নানা ধরনের গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সেগুলোর ইতিহাস অন্য কোন সময় জানব। আজ এ পর্যন্তই।